You dont have javascript enabled! Please enable it! চুয়াডাঙ্গা-কুষ্টিয়ার প্রতিরোধ যুদ্ধের বিবরণ | বাংলা একাডেমীর দলিলপত্র - সংগ্রামের নোটবুক

চুয়াডাঙ্গা-কুষ্টিয়ার প্রতিরোধ যুদ্ধের বিবরণ
সাক্ষাৎকারঃ লেঃ কর্নেল এম এ ওসমান চৌধুরী
(১৯৭১ সালে মেজর পদে কর্মরত ছিলেন)
৩১-১-১৯৭৪

আমি ইপিআর, ৪র্থ উইং-এর ভার গ্রহণ করার পূর্ব থেকেই ওখানে (চুয়াডাঙ্গায়) ছিলেন দুইজন ক্যাপ্টেন-সহকারী উইং কমান্ডার হিসাবে। তাদের মধ্যে একজন ছিলেন বাঙালি। নাম তার ক্যাপ্টেন এ আর আজম চৌধুরী (বর্তমানে মেজর), দ্বিতীয় জন ছিলেন অবাঙালি, তার নাম ক্যাপ্টেন (মরহুম) সাদেক।

এই উইং-এর অধীনে ছিল ৫টি কোম্পানী। ১টি কোম্পানী চুয়াডাঙ্গা হেডকোয়ার্টারে, অন্য চারটি ছিল সীমান্ত এলাকায়। উইং-এর সীমান্ত এলাকা ছিল দক্ষিণে মাসলিয়া বিওপি থেকে উত্তরে মহেশকুন্ডি বিওপি পর্যন্ত। প্রত্যেকটি কোম্পানীর কমান্ডার ছিল একেকজন সুবেদার। মোট সৈন্যসংখ্যা ছিল প্রায় ৮৫০। তার মধ্যে আনুমানিক অবাঙালি সেনার সংখ্যা ছিল ১৫০।

২০শে মার্চ ১৯৭১ সন। চট্টগ্রাম থেকে আমার ব্যক্তিগত গাড়ীটি সড়ক পথে চুয়াডাঙ্গা এসে পৌঁছল। ২৪শে মার্চ সকাল ১০টায় ওই গাড়ী করেই আমার স্ত্রী কন্যাদের নিয়ে মেহেরপুরের পথে কুষ্টিয়া রওনা হই। আমার পরনে ছিল ইপিআর পোশাক। সাথে চলল ইপিআর জীপে চড়ে ৪ জন সশস্ত্র ইপিআর সৈনিক। উদ্দেশ্য ছিল, আমার সরকারী বাড়ী মেরামত করার খরচ হিসাবে কুষ্টিয়ার ডিসি’র কাছ থেকে ৫ হাজার টাকা সংগ্রহ করা। ইচ্ছা ছিল, ঐ দিনই কাজ সেরে কুষ্টিয়ায় রাত্রি যাপন করার পর ২৫শে মার্চের পূর্বাহ্নেই চুয়াডাঙ্গা ফেরত আসার। কিন্তু মেহেরপুরে গিয়েই গাড়ীটা আমার নষ্ট হয়ে গেল। কিছুতেই দোষ খুঁজে পেলাম না। জীপ ফেরত পাঠিয়ে চুয়াডাঙ্গা থেকে মেকানিকস আনালাম। গাড়ী ঠিক হতে হতে বিকেল ৩টা বেজে গেল। আবার রওনা কুষ্টিয়া অভিমুখে। আরো ১৫ মাইল যাবার পর খারাপ হয়ে গেল। বাধ্য হয়ে আশে-পাশের বাড়ী থেকে পাটের রশি সংগ্রহ করে জীপের পেছনে গাড়ীকে বেঁধে কুষ্টিয়া পৌঁছলাম। উঠলাম কুষ্টিয়া সার্কিট হাউসে।

পরদিন ২৫শে মার্চ সকাল সাড়ে ৯টায় ডেপুটি কমিশনার সাহেবের অফিসে গেলাম। ডেপুটি কমিশনার ছিলেন জনাব শামসুল হক। তাঁর অফিস ও বাসস্থান ছিল একই প্রাঙ্গণে। তিনি আসলেন, কথাবার্তা হল, চায়ের পর্ব শেষ হল। তারপর পিয়নের মারফত ডাকলেন ল্যাণ্ড একুইজিসন অফিসারকে। এল এ সাহেব আসলেন, সব শুনলেন, তারপর গেলেন অফিসে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ও চেকবুক আনবার জন্য। অসহযোগ আন্দোলনের প্রতিবন্ধকতা সেরে আমাকে চেক ইস্যু করতে করতে বেলা দেড়টা বেজে গেল। তখনকার ন্যাশনাল ব্যাংক বন্ধ হয়ে গেল, তাই টাকা আর উঠানো গেল না। চুয়াডাঙ্গায় এমন কোন জরুরী অবস্থা ছিল না তাই টাকা সাথে করে নিয়ে যাবো মনে করেই ২৫শে মার্চ রাতেও কুষ্টিয়া সার্কিট হাউসে রয়ে গেলাম।

২৬শে মার্চ ভোর ৬টায় ঘুম থেকে উঠে বারান্দায় গিয়ে দেখতে পেলাম অল্প দূরেই রাস্তার উপর মিলিটারী জীপে করে পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীর লোক টহল দিচ্ছে আর জানিয়ে দিচ্ছে ৩০ ঘণ্টার জন্য কারফিউ। কুষ্টিয়ার জনসাধারণ ঘরে বসেই দরজা জানালা দিয়ে উঁকি মেরে দেখছে। ব্যাপারটা কেমন যেন ঘোলাটে মনে হল। ডিসি’কে টেলিফোন করে জেনে নিতে চাইলাম ব্যাপার কি? কিন্তু টেলিফোন উঠিয়ে এটার কোন সাড়াই পেলাম না। বুঝতে পারলাম লাইন কেটে দিয়েছে। পিছনে চেয়ে দেখলাম সামরিক বাহিনী সার্কিট হাউসের ঠিক পিছনেই তথা জিলা স্কুলে করেছে তাদের সদর দপ্তর। কি করব বুঝতেই পারলাম না। এই বিভ্রান্তিকর অবস্থাতেই কেটে গেল তিন ঘণ্টা। রেডিও লাগান ছিল, ঢাকা বেতারের নিয়মিত প্রোগ্রামটা শুনে যাচ্ছিলাম। তা থেকে শুভাশুভ কিছুই বুঝতে পারলাম না। সাড়ে ৮টা কি ৯টার দিকে হঠাৎ ঘোষণা করা হল নতুন নতুন ‘মার্শাল ল’ আইন। কেঁড়ে নিল আমাদের ব্যক্তি ও বাক স্বাধীনতা। বুঝতে পারলাম, বোধ হয় এসেছে আমাদের সেই চরম ও পরম পরীক্ষার দিন। আর এক মুহূর্তও কুষ্টিয়ায় থাকা সমীচীন মনে করলাম না। জীপের পেছনে আবার গাড়ীটাকে বেঁধে এবার উল্টাদিকে অর্থাৎ ঝিনাইদহের দিকে যথাসম্ভব তীব্র গাড়ী চালিয়ে দিলাম। ভাগ্য ভাল কুষ্টিয়ার সার্কিট হাউস ছিল শহরের দক্ষিণ প্রান্তে অবস্থিত। কাজেই কুষ্টিয়া শহরের সীমা অতিক্রম করতে আমাদের এক মিনিটের বেশী সময় লাগেনি। দূর থেকে ইপিআর-এর পোশাক পরা অবস্থায় আমাদের দেখেও আমাদের কিছুই ওরা বলেনি। কেন বলেনি সেটা পরে যতবার ভেবেছি, ততবারই ওদের বোকামি ছাড়া কিছুই মনে করতে পারিনি। তবে আমি মনে করি এটা বোধ হয় আল্লাহরই মহিমা। বেলা ১১টায় ঝিনাইদহ পৌঁছে দেখি শহর লোকে লোকারণ্য। আমার জীপকে আসতে দেখে তারা রাস্তা ছেঁড়ে দিল।

এখানে একটু বলে রাখা ভাল যে, চুয়াডাঙ্গার ইপিআর-এর ৪র্থ উইং-এর ইতিহাসে আমি ছিলাম প্রথম বাঙালি কমান্ডার। আমার বা আমার পরিবারের কারও গায়ের রং দেশে স্থানীয় লোক বিশ্বাসই করতে পারেনি যে আমরা বাঙালি। তাছাড়া এই স্বল্প সময়ে জনসাধারণের সাথে পরিচয় করাও সম্ভব হয়নি। স্থানীয় লোকজনের সাথে পরিচয় করার ওটাই একটা সুবর্ণ সুযোগ মনে করে আমি গাড়ী থেকে নেমে বাংলা ভাষায় লোকজনকে ডাকলাম। লোকজন সবাই দৌড়ে আসল। পরিচয় পেয়ে উৎসাহিত হল। আমার আহবানে সমস্ত সহযোগিতার আশ্বাস দিল। আমি তাদেরকে প্রস্তুত থাকবার উপদেশ দিয়ে সেখান থেকে চুয়াডাঙ্গা অভিমুখে রওনা দিলাম।

আনুমানিক বেলা ১টায় চুয়াডাঙ্গা আমার সদর দপ্তরের সামনের রাস্তায় পৌঁছলাম। আমার গাড়ী দাঁড়াবার সাথে সাথেই আমার বাঙালি উইং হাবিলদার-মেজর মজিবর রহমান এসে অভিবাদন করে ঢাকার ঘটনার আনুপূর্বিক বিবরণ দিল। আরও জানাল যে, ক্যাপ্টেন আজম চৌধুরীর কোনরকম নির্দেশ ছাড়াই উইং হেডকোয়ার্টারের সমস্ত অবাঙালি সেনাদের সে আটক করে রেখেছে এবং অস্ত্রাগার থেকে সমস্ত অস্ত্রশস্ত্র সরিয়ে নিরাপদ স্থানে লুকিয়ে রেখেছে।

হাবিলদার মেজর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি দুরভিসন্ধির খবরও আমাকে জানাল। সেটা হল যে ২৫শে মার্চ বিকেলবেলা হঠাৎ করে যশোর থেকে তৎকালীন ইপিআর সেক্টরের উপ-অধিনায়ক অবাঙালি মেজর সরদার আবদুল কাদের চুয়াডাঙ্গা এসেছিল যশোরে একটা অত্যন্ত জরুরী মিটিং-এর অজুহাতে আমাকে নিয়ে যানার জন্য। কিন্তু যখন শুনল আমি চুয়াডাঙ্গায় নেই তখন সে ক্যাপ্টেন সাদেকের বাসায় রাত্রি যাপন করে ২৬শে মার্চ ভোর ৪টার সময় ক্যাপ্টেন সাদেক ও তার পরিবারবর্গকে নিয়ে যশোরে পালিয়ে যায়।

যাই হোক, হাবিলদার মেজরের কাছ থেকে আনুপূর্বিক সমস্ত ঘটনা জানতে পেরে আমি মনে মনে একটা সিদ্ধান্তে প্রায় পৌঁছতে পারলাম। তবুও তাদেরকে সর্বতোভাবে তৈরি থাকতে নির্দেশ দিয়ে আমি আমার বাসভবনে চলে গেলাম। সেখানে গিয়েই আমি আমার অফিসার ক্যাপ্টেন আজম চৌধুরী ও আওয়ামী লীগের স্থানীয় এমপি ডাঃ আসহাবুল হক ও স্থানীয় পুলিশ কর্মকর্তা, বেসামরিক কর্মচারী প্রমুখদের জরুরীভাবে তলব করে পাঠালাম। ডাঃ আসহাবুল বোধ হয় তৈরিই ছিলেন আমার অপেক্ষায়। খবর পেয়ে ৫ মিনিটের মধ্যে তিনি এসে উপস্থিত হলেন। অন্যান্য সবাই আসার পর আমি তাদেরকে নিয়ে একটা রুদ্ধদ্বার বৈঠক করলাম। ২৫শে মার্চ রাত ১২টার পর থেকে তখন পর্যন্ত ঢাকা এবং অন্যান্য জায়গায় আনুপূর্বিক সমস্ত ঘটনা ও দুর্ঘটনা নিয়ে আলোচনা করলাম। সর্বসম্মতিক্রমে স্থির করা গেল, এ অন্যায় আমরা সইব না। শপথ নিলাম আমরা এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করব, যুদ্ধ করব এবং যেমন করেই হোক নিজের প্রানের বিনিময়ে হলেও মাতৃভূমিকে এই পশুশক্তির কালো হাত থেকে রক্ষা করব। সবাই আমাকে সমস্ত সামরিক ও বেসামরিক কার্যকলাপের প্রধান বলে মেনে নিলেন। আমিও নির্দেশ জারি করলাম যে, সেই থেকে আমার নির্দেশ মতই সবাইকে আপন আপন কাজ সমাধা করতে হবে। সমস্ত সিদ্ধান্তের পর আমি সমস্ত সামরিক ও বেসামরিক কর্মচারীদের সমভিব্যহার আমার উইং-এর কোয়ার্টার গার্ডে বাংলাদেশের পতাকা সসম্মানে উত্তোলন করে ওটাকে জাতীয় অভিবাদন দিলাম। এটা যে একটা কত বড় জীবনের ঝুঁকি, বিশেষ করে যখন কোন রকম সংযোগবিহীন অবস্থায় বিনা নির্দেশে এবং আর কেউ বিদ্রোহ করেছে কিনা, সেটা না জেনেই সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত চেতনায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মত একটা এতবড় শক্তিশালী সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা যে কত বড় চ্যালেঞ্জ, বিজ্ঞজন মাত্রেই তা অনুধাবন করতে পারবেন।

তারপর আমি আমার সৈন্য ও ভারী অস্ত্র নানা গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় অবস্থান করানো এবং গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় ব্যারিকেড সৃষ্টি করা ইত্যাদি সামরিক ও বেসামরিক নির্দেশ দানে প্রায় অর্ধারাত অতিবাহিত করি। ইতিমধ্যে অয়ারলেস মারফত সীমান্তের আমার সৈন্যদেরকেও অবস্থা বর্ণনা করে সজাগ থাকতে নির্দেশ দিই। এইভাবে অতিবাহিত হল ২৬শে মার্চ।

২৭শে মার্চ সকাল ৭ ঘটিকায় মাসলিয়া বিওপি কোম্পানী হেডকোয়ার্টার থেকে কোম্পানী কমান্ডার সুবেদার আব্দুল মজিদ মোল্লা অয়ারলেস মারফত জানালেন যে ক্যাপ্টেন সাদেক তিনজন সৈনিকসহ যশোর থেকে সীমান্ত রাস্তা দিয়ে মাসলিয়া বিওপিতে প্রবেশ করেছে। আমি তাকে ক্যাপ্টেন সাদেকের উপর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখার নির্দেশ দিলাম। খবরটা পেয়ে আমি অনুমান করেছিলাম যে, হয়তবা ২৬শে মার্চ ভোর ৪টা পর্যন্ত কুষ্টিয়া থেকে আসতে পারিনি লক্ষ্য করেই বোধ হয় ক্যাপ্টেন সাদেক ভেবেছিল যে, সীমান্তের সৈন্যদেরকে নিশ্চয় কোন রকম সজাগ থাকার আদেশ দেওয়া হয়নি। তাই তার মাসলিয়া যাবার উদ্দেশ্য সৈন্যদেরকে চতুরতার সাথে নিরস্ত্র করা।

যাই হোক, প্রায় ১০ মিনিট পর সুবেদার মজিদ মোল্লা জানান যে, ক্যাপ্টেন সাদেক আদেশ পালন না করার অপরাধে একজন বাঙালি সিপাহি-এর উপর পিস্তলের গুলি করে যশোর অভিমুখে জীপে করে পালিয়ে যায়। অবশ্য, এরপর আমার নির্দেশ অনুসারে পরবর্তী বিওপিকে খবর দিয়ে গুলির বিনিময়ে তাদের গতি রোধ করা হয়। গোলাগুলিতে ক্যাপ্টেন সাদেক ও তার সঙ্গীরা মারা যায়। কিছুক্ষণ পর সুবেদার মজিদ মোল্লা অত্যন্ত ভীতস্বরে অয়ারলেসে আমাকে এ খবর জানায়। আমি তাকে অভয় দিয়ে মৃতদেহগুলি পুঁতে ফেলার আদেশ দেই। এইখানেই শুরু হয় আমার এলাকায় পদ্মার ওপারে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হনন পর্ব। এখানেই বুঝতে পারলাম- “I am in a point of no return. Either I have to kill the enemy or get killed.” (অনুবাদঃ এখন আর ফেরার কোন উপায় নেই। হয় আমাকে শত্রুকে মারতে হবে, অথবা মরতে হবে)

কুষ্টিয়া পুনর্দখলের পরিকল্পনাঃ ডাঃ আসহাবুল হক সাহেবকে খবর দিলাম। দুই কমরেড মিলে ছক আঁকলাম-কুষ্টিয়া আমাকে পুনরুদ্ধার করতেই হবে। পরিকল্পনা করলাম পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে। সীমান্তের সৈন্যবাহিনীকে জরুরী ভিত্তিতে চুয়াডাঙ্গায় জমায়েত হবার নির্দেশ দিলাম। ফিলিপনগর কোম্পানীকে একটা নির্দিষ্ট সময়ে কুষ্টিয়া শহরের অদূরে একটা নির্দিষ্ট স্থানে সমবেত হবার পর পরবর্তী আদেশের অপেক্ষা করতে নির্দেশ দিলাম। এই কোম্পানীর কমান্ডার ছিলেন সুবেদার মোজাফফর আহমেদ (বর্তমানে লেঃ ইপিআর)। দুই কমরেড মিলে ঐ এলাকার নামকরণ করলাম- “সাউথ ওয়েস্টার্ণ কমাণ্ড দক্ষিণ পশ্চিম রণাঙ্গন” কমান্ডার হলাম আমি মেজর মোহাম্মদ আবু ওসমান চৌধুরী (বর্তমানে লেঃ কর্নেল)।

এখানে কুষ্টিয়ার শত্রুর সৈন্যসংখ্যা ও তাদের শক্তির উপর কিছুটা আলোকপাত করা দরকার। যশোর ব্রিগেড থেকে ২৭ বেলুচ রেজিমেন্ট তথা রিকনাইসেন্স ও সাপোর্ট ব্যাটালিয়নের এক কোম্পানী-অর্থাৎ প্রায় ২০০ সৈন্য কুষ্টিয়া অধিকার করে ২৫/২৬শে মার্চ রাত দেড়তায়। তাদের সাথে ছিল পর্যাপ্তসংখ্যক ১০৬ এম-এম আর-আর (জীপে সংস্থাপিত) চীনা এইচ-এম-জি, এলএমজি, এসএমসি ও অটোমেটিক রাইফেলসমূহ। তার সাথে প্রচুর পরিমাণ গোলাবারুদ, গাড়ী ও বেতারযন্ত্র ছিল। তুলনামূলকভাবে রেকি ও সাপোর্ট কোম্পানীর ফায়ার পাওয়ার একটা সাধারণ ইনফ্যানট্রি ব্যাটালিয়নের প্রায় সমপরিমাণ এই সত্য আমার ভাল করেই জানা ছিল। আমি জানতাম, যুদ্ধের প্রচলিত নিয়ম অনুসারে আমি অন্ততঃপক্ষে সমান ধ্বংসাত্মক মরণাস্ত্র নিয়ে তিনগুন সৈন্যের কম হলে ওদেরকে আক্রমণ করতে পারি না। কুষ্টিয়ার শত্রুদের অধিনায়ক ছিলেন মেজর শোয়েব। তার সাথে উপ-অধিনায়করা ছিল ক্যাপ্টেন শাকিল, ক্যাপ্টেন সামাদ ও লেঃ আতাউল্লাহ শাহ্‌।

আমার মোট সৈন্যসংখ্যা ছিল প্রায় ৭০০ জন ইপিআর সৈনিক। তাদের অস্ত্র বলতে ছিল ৩০৩ রাইফেল, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের ৩০৩ এলএমজি, এমজি ও দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের মর্চে পড়া ৪টা ৩.৫ রকেট লাঞ্চার। গোলাবারুদের সংখ্যা একেবারেই ছিল অপর্যাপ্ত। তদুপরি ছিল আধুনিক যুদ্ধে অনভিজ্ঞ ও অশিক্ষিত লোকজন। অফিসার বলতে আমার সাথে ছিল একমাত্র ক্যাপ্টেন আজম চৌধুরী। তবে ভরসা ছিল এই যে আমার সাথে ছিল সমস্ত জনসাধারণ।

তবুও পরিকল্পনা অনুযায়ী আমি কিছু সংখ্যক আনসার ও মুজাহিদকে একদিনের ট্রেনিং –এর পর আমার বাহিনীর অন্তর্ভুক্ত করি। স্থানীয় পুলিশ ও আনসারদের ৩০৩ রাইফেলগুলো দ্বারা এই বাহিনীকে সজ্জিত করি।

আমার কাছে কোন রকম ফিল্ড অয়ারলেস বা ফিল্ড টেলিফোন কম্যুনিকেশনের ব্যবস্থা ছিল না। তাই টেলিফোন বিভাগের সাহায্যে পোড়াদহের খোলা প্রান্তরে ফিল্ড এক্সচেঞ্জ লাগিয়ে দেওয়া হয়। সেনাবাহিনীর ন্যায় খাদ্য সরবরাহের কোন রকম নিয়মিত পদ্ধতি না থাকায় ভলান্টিয়ার গ্রুপের কিছু লোকে কুষ্টিয়ায় পাঠিয়ে সেখানকার আওয়ামী লীগ দলের গণ্যমান্যদের সাহায্যে আমার সমস্ত সৈন্যবাহিনীর খাদ্যের পুরোপুরি ব্যবস্থা করা হয়। আরও ব্যবস্থা হয় সেচ্ছাসেবক বাহিনীকে প্রয়োজনমত যথাস্থানে ব্যবহার করার। স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর হাতিয়ার বলতে ছিল বাঁশের লাঠি।

২৮শে মার্চ দুপুর ১২টা পর্যন্ত সীমান্তের সমস্ত কোম্পানী আদেশক্রমে চুয়াডাঙ্গায় সমবেত হয়। পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী এক কোম্পানী সৈন্য আমি ঝিনাইদহে পাঠিয়ে দিই ও যশোর-ঝিনাইদহ রাস্তা অবরোধ করে রাখি, যেন যশোর থেকে কোন রকম সৈন্য বা অস্ত্র কুষ্টিয়াকে সরবরাহ করতে না পারে। আর এক কোম্পানী সৈন্যকে ঐদিন বিকেল বেলা ক্যাপ্টেন আজমের নেতৃত্বে চুয়াডাঙ্গা-পোড়াদহ কাঁচা রাস্তা দিয়ে আমি পোড়াদহ পাঠিয়ে দেই। ক্যাপ্টেন আজমের প্রতি নির্দেশ ছিল তার গন্তব্যস্থানে পৌঁছবার পরেই সে যেন সুবেদার মুজাফফরের কোম্পানী কুষ্টিয়ার পুলিশ লাইনের দিক দিয়ে আক্রমণ করবে, ক্যাপ্টেন আজমের কোম্পানী শহরের দক্ষিণ পশ্চিম কোণে অর্থাৎ সার্কিট হাউসের দিক দিয়ে আক্রমণ করবে এবং একটা প্লাটুন ও স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর কিছু সংখ্যক লোক পূর্ব দিক থেকে মোহিনী মিল ও অয়ারলেস স্টেশনের উপর আক্রমণ চালাবে। আক্রমণ হবে সংযুক্তভাবে একই সময়ে তিন দিক থেকে।

আক্রমণের সময় ও তারিখ ছিল ২৯শে মার্চ ভোর ৪টা। পরিকল্পনায় এটাও ঠিক করে রাখা হয়েছিল যে, আক্রমণ শুরু হওয়ার প্রাক্কালে আমার বাহিনীর পশ্চাদভাগে যেন কমপক্ষে ৫ হাজার বেসামরিক লোক আক্রমণের সাথে সাথেই জয়ধ্বনি দিতে দিতে আক্রমণকারী বাহিনীকে অনুসরণ করে। এসময় বেসামরিক ব্যবস্থার ভার ছিল ডাঃ আসহাবুল হকের উপর যিনি তাঁর দলীয় লোক, স্থানীয় ছাত্র ও স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর সাহায্যে খুব সুষ্ঠুভাবেই সম্পন্ন করেছিলেন।

আক্রমণের সমস্ত আয়োজন সম্পূর্ণ, কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা গেল, চলাচল অসুবিধার জন্য ও একটা গাড়ী দুর্ঘটনার কবলে পতিত হওয়ার দরুন সুবেদার মুজাফফরের কোম্পানী নির্দিষ্ট স্থানে নির্দিষ্ট সময়ে পৌঁছতে পারেনি। তাই বাধ্য হয়ে আমি আক্রমণের দিন ও সময় ২৪ ঘণ্টা পিছিয়ে দিই। অর্থাৎ আক্রমণের নতুন দিন ও সময় স্থির করি ৩০শে মার্চ ভোর ৪টায়।

প্রসঙ্গতঃ উল্লেখযোগ্য যে, ২৬শে মার্চ সকাল ১০টায় আমার মাসলিয়ায় অবস্থানরত কোম্পানী কমান্ডার সুবেদার মজিদ মোল্লা অয়ারলেসে খবর পাঠালেন যে, ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রথম ব্যাটালিয়ন, যারা সিনিয়র টাইগার নামে পরিচিত, তাদের সমস্ত সৈন্য ও অস্ত্রশস্ত্র সহকারে বাঙালি কমান্ডার লেঃ কর্নেল রেজাউল জলিলের নেতৃত্বে চোগাছায় অবস্থান করছে। এই ব্যাটালিয়ন নাকি ২৪শে মার্চ তারিখে বাৎসরিক ফিল্ড এক্সসারসাইজের জন্য চৌগাছায় এসেছিল যশোর ক্যান্টনমেন্ট থেকে। খবর শুনে আমার মনে বিরাট একটা ভরসা আসল। আমি অয়ারলেসে সুবেদার মজিদ মোল্লাকে দিয়ে আমার তরফ থেকে লিখে পাঠালাম লেঃ কর্নেল জলিলের কাছে। ঐ খবরে আমি লিখেছিলাম যে, ‘দেশের ও দেশের লোকের নিরাপত্তা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে বিপর্যস্ত, মা বোনদের ইজ্জত লুণ্ঠিত, জ্ঞানী-গুণী ও ছাত্ররা হতাহত হচ্ছে। তাই এর বিরুদ্ধে আমি আমার ইপিআর বাহিনীকে নিয়ে বিদ্রোহ করেছি, বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়েছি। আর কে কি করেছে জানি না। কিন্তু আপনি সিনিয়র, আপনার কাছে সৈন্য আছে, হাতিয়ার আছে। আপনি আসুন অধিনায়কত্ব গ্রহণ করুন। আমরা সম্মিলিত ভাবে এদের হনন করতে সক্ষম হব।’ সুবেদার মজিদ মোল্লা ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রথম ব্যাটালিয়নে গিয়ে এ সংবাদ তাঁর কাছে পৌঁছায়। কিন্তু অনেক অপেক্ষা করেও তাঁর কাছ থেকে কোন সদুত্তর পাওয়া যায়নি। আমাকে এ খবর দেয়ার পর ২৮শে মার্চ আবার এই মর্মে চিঠি লিখে দানেশ নামক এক বিশেষ মুক্তিযোদ্ধাকে তার মোটরসাইকেলে করেই লেঃ কর্নেল জলিলের কাছে পাঠাই। চিঠি তাঁর কাছে পৌঁছানো হয়, কিন্তু নিস্ফল সব আশা। তিনি কোন রকম আশ্বাস দেয়া দূরের কথা, আমার কার্যকলাপকে আদৌ গুরুত্ব না দিয়ে সেদিনই বিকেল বেলা যশোর ক্যান্টনমেন্টে তাঁর জীপে করে চলে যান এবং ২৯শে মার্চ পত্রবাহক মারফত ব্যাটালিয়নের কাছে সংবাদ পাঠান যে, যশোর ক্যান্টনমেন্টে কোন রকম গোলমাল নেই এবং তার আশঙ্কাও নেই, তার পুরো ব্যাটালিয়ন যেন যশোর ক্যান্টনমেন্টে সেদিনই ফেরত আসে। তদনুযায়ী এই ব্যাটালিয়ন ২৯শে মার্চ বিকেল পর্যন্ত যশোর ক্যান্টনমেন্টে ফেরত গিয়ে অস্ত্রশস্ত্র জমা করে আপন কাজে লিপ্ত হয়। শুনেছি, ব্রিগেডিয়ার সরদার আব্দুর রহিম দুররানী নাকি রাত্রেই তাদের অস্ত্রাগারের চাবি হস্তগত করে। পরদিন ৩০শে মার্চ সকাল ১০টায় এই ব্যাটালিয়নের অস্ত্রবিহীন সৈন্যদের উপর চতুর্দিক থেকে আক্রমণ ও গোলাগুলি বর্ষণ করা হয়। এই আক্রমণে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রথম ব্যাটালিয়নের অধিকাংশ সৈন্যই নিরীহভাবে মারা যায়। শুধু লেঃ হাফিজউদ্দিন (বর্তমানে ক্যাপ্টেন) ও ১৪৮ জন জেসিও এবং অন্যান্য সাধারণ সৈন্য জীবন নিয়ে পালিয়ে এসে আবার ঐ চৌগাছা এলাকায় সমবেত হয়। তাদের অস্ত্র নেই, খাবার নেই, পরনে কাপড় নেই। তারা বহুকষ্টে সীমান্তে ভারতীয় সীমান্ত বাহিনীর লোকজনের সাথে যোগাযোগ করে খাদ্য সংগ্রহ করে।

এদিকে কুষ্টিয়ার যুদ্ধক্ষেত্রের ঘটনা হলো, ২৮শে মার্চ রাত থেকে ২৯শে মার্চ রাত পর্যন্ত অত্যন্ত গোপনীয়ভাবে আমাদের সৈন্যদের কুষ্টিয়া শহর থেকে অদূরে মাঠে ময়দানে ও জঙ্গলে অবস্থান করতে হয়। সুবেদার মুজাফফরের কোম্পানী নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছতে সক্ষম হয় ২৯শে মার্চ ভোরবেলা। নিয়মিত যোগাযোগ করে তাদেরকে আক্রমণের পরিকল্পনা সুষ্ঠুভাবে বুঝিয়ে দেয়া হয় এবং যথারীতি অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ, ঔষধপত্র ও বেসামরিক লোক সরবরাহ করা হয়। পরিকল্পনা অনুযায়ী ৩০শে মার্চ সকাল ৪টায় তিন দিক থেকে অতর্কিতভাবে কুষ্টিয়া আক্রমণ করি। আক্রমণের সাথে সাথে অনুসরণকারী জনগণের গগনবিদারী জয়ধ্বনিতে বোধ হয় শত্রুপক্ষের মনোবল ভেঙ্গে যায়। প্রায় ঘণ্টাখানেক তুমুল যুদ্ধের পর আমাদের সৈন্যরা পুলিশ লাইন ও অয়ারলেস কেন্দ্রের ভিতর ঢুকে পড়ে শত্রু হনন করতে থাকে। উপায়ান্তর না দেখে সামান্য সংখ্যক শত্রু সৈন্য তাদের অস্ত্রশস্ত্র ফেলে দিয়ে দ্রুতগতিতে তাদেরই সদর দপ্তরের দিকে পালিয়ে যায়। পালাবার প্রাক্কালেও অনেকে নিহত হয়। পুরোদিনের যুদ্ধে একমাত্র তাদের সদর দপ্তর ও পার্শ্ববর্তী এলাকা ব্যতীত সমস্ত শহরই আমাদের হস্তগত হয়। আমার সৈন্যরা শত্রুদেরকে ৩০শে মার্চ সারারাত চতুর্দিক থেকে ঘিরে রেখে মুহুর্মুহু জয়ধ্বনি সহকারে গোলাবর্ষণ করতে থাকে। শত্রুরা অয়ারলেস সেটের মারফত শত্রুপক্ষের অয়ারলেসের আবেদন মনিটরিং করে যশোরের দেওয়া প্রত্যুত্তর আমাদের হস্তগত হয়। যশোরের প্রত্যুত্তর ছিল- “Reinforcement not possible. Try to live on your own.” (অনুবাদঃ সহায়তা দেয়া সম্ভব নয়। তোমরা নিজেরা নিজেদের মতো বাঁচতে চেষ্টা কর)

পরদিন ৩১শে মার্চ ভোরবেলা আমাদের আক্রমণ পুরোপুরি সফল হতে পারেনি। তুমুল গোলাগুলির সাহায্যে শত্রুপক্ষ আমাদের মাথা নিচু রাখতে বাধ্য করে। সারাদিনের যুদ্ধের পর আনুমানিক জীবিত শত্রুর সংখ্যা ছিল ৪০/৪৫ জন। তার মধ্যে অফিসাররা সকলেই জীবিত ছিল। গত্যন্তর না দেখে রাতের অন্ধকারে তারা দুইটি জীপ ও একটি ডগ গাড়ীতে আরোহণ করে আমাদের ব্যূহ ভেদ করে তীব্র গতিতে ঝিনাইদহের দিকে পালিয়ে যেতে চেষ্টা করে। আমার সৈন্যরা সাথে সাথে তাদেরকে অনুসরণ করে। শত্রুদের ভাগ্য মন্দ। শৈলকূপার পুলের গোড়ায় আমরা গর্ত খনন করে তার-পোলিন দিয়ে সেই গর্তকে ঢেকে রেখেছিলাম সেটা তারা জানত না। তাদের প্রথম ২টা জীপ উপর্যুপরি গর্তে পড়ে গিয়ে মারাত্মকভাবে দুর্ঘটনায় পড়ে। মেজর শোয়েব ও কয়েকজন শত্রুসেনার সেখানে ভবলীলা সাঙ্গ হয়। বাকিরা আশেপাশের গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে, কিন্তু সজাগ মুক্তিযোদ্ধা, স্বেচ্ছাসেবক ও জনগণের হাত থেকে একটি শত্রুসেনাও বাঁচতে পারে নি। আমার নির্দেশে উৎসাহিত হয়ে তারা এক একজনকে হত্যা কতে তাদের হাতিয়ার এনে আমার সদর দপ্তরে জমা দেয়। এমনও হয়েছে একটি ছেলে একটা শটগান দিয়ে একজন এলএমজিধারী শত্রুসৈন্যকে হত্যা করে তার হাতের একটি আঙ্গুল ও এলএমজি আমার সদর দপ্তরে জমা করে। এই ছেলেটির বয়স ছিল ১৮/২০ বছর। নাম তার সুলতান আলী জোয়ারদার। যুদ্ধের প্রচণ্ডতা ও হৈ-হুল্লোড়ে এই ছেলেটির সাথে দেখা করা আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি।

সেই রাত্রেই লেঃ আতাউল্লাহ শাহ্‌ ধরা পড়ে। তাকে ঝিনাইদহে প্রাথমিক চিকিৎসার পর ২রা এপ্রিল বিকেলের দিকে আমার সদর দপ্তরে আনা হয়।

১লা এপ্রিল কুষ্টিয়া সম্পূর্ণরূপে আমাদের হাতে মুক্ত হয়। এরপর সামান্য সংখ্যক সৈন্য কুষ্টিয়ায় রেখে বাকি সৈন্যদের আমি ঝিনাইদহের দিকে পাঠিয়ে দেই। কিছু সংখ্যক সৈন্য মাগুরা, কিছু সংখ্যক ঝিনাইদহের দক্ষিণে বিশাখালী ও কিছু সংখ্যক সৈন্য কোটচাঁদপুরে অবস্থান করে। উদ্দেশ্য, যশোর থেকে উত্তর দিকে শত্রুদের অগ্রসর হবার সব পথ অবরোধ করে রাখা।

এদিকে ২৮শে মার্চ তারিখেই কলিকাতা হয়ে বহির্বিশ্বের সাথে টেলিফোন যোগাযোগ স্থাপন করা হয়। আমার মনে আছে টেলিফোনে আমি ও ডাঃ আসহাবুল হক পালাক্রমে কলিকাতার বিভিন্ন পত্র-পত্রিকার কাছে যুদ্ধের খবর সরবরাহ করতাম।

এক রাত্রের কথা আমি ভুলব না। সেদিন বোধ হয় ২৮ কি ২৯ তারিখ রাত্রের ঘটনা। ঢাকা থেকে খবর পেলাম যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডক্টরেট উপাধিধারী বিশিষ্ট শিক্ষাবিদদের নিজ নিজ ঘরে পাক সেনাবাহিনী অত্যন্ত ঘৃণ্যতমভাবে হত্যা করেছে। কলকাতার স্টেটসম্যান পত্রিকাকে টেলিফোনে এ খবর দিতে দিতে আমি ও ডাঃ আসহাবুল হক কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছিলাম। সেদিন তাদেরকে এও বলেছিলাম যে, আমরাও এর প্রতিশোধ সমভাবেই গ্রহণ করব। কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গার অন্যান্য বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ তথা জনাব ইউনুস আলী এমপিও, ব্যারিস্টার বাদল রশীদ, প্রিন্সিপাল ফুলে হোসেন, ইঞ্জিনিয়ার সাইফ উদ্দিন ও আরো অন্যান্যকে নানা বেসামরিক সংযোগ, অভ্যর্থনা, সাহায্য গ্রহণ ইত্যাদি কাজকর্মে নিযুক্ত করা হয়েছিল। স্থানীয় জনসাধারণ ও ছাত্র সমাজ প্রত্যেকেই আপন আপন সামর্থ্য ও সাধ্যানুযায়ী এই যুদ্ধের আয়োজন ও সরঞ্জামে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে দিনরাত সাহায্য করেছিল।

বিদ্রোহ করার অব্যবহিত পড়ে বর্তমান রাষ্ট্রবন্ধু ভারতের সাথে সংযোগ হওয়ার সাথে সাথেই আমার স্ত্রীকে সেখানকার কোন নিরাপদ স্থানে পাঠিয়ে দিতে চেয়েছিলাম, বেশ পরে অনেক সুহৃদই এই প্রস্তাব করেছিল। কিন্তু আমার স্ত্রী ও মেয়েরা আমার সাথে যুদ্ধক্ষেত্রেই হাসিমুখে যেকোন পরিস্থিতিতেই থাকবার জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিল, তাই আর যাওয়া হল না। থাকল ওরা আমারই ট্যাক্টিক্যাল হেডকোয়ার্টারের একটি কামরায়। সেখানে থেকেই মিসেস ওসমান স্থানীয় সেনাদের খাবার ও পানীয় সরবরাহের কর্তৃত্ব গ্রহণ করে তা সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করেন। এ কাজের ভার তাকে সঁপে দিতে হয় নি, নিজেই চিন্তা করে তা শুরু করেন। এমনকি সে রণাঙ্গনের যেসব সেনাদের স্ত্রী-পুত্র-পরিবার সেখানে থাকত, তাদের খাবার ও পানীয়, টাকা-পয়সা পৌঁছিয়ে দেবার দায়িত্বও তিনি পরিচালনা করেন। তার উপর হেডকোয়ার্টারে আমাকে বা প্রয়োজনবশত ডাঃ আসহাবুল হক ও অন্যান্য অফিসারদেরকে নানাভাবে সাহায্য করতে দ্বিধা করেননি। প্রয়োজনবশত মাটিতে পজিশন নেওয়া, পরিখাতে ঢুকে সতর্ক পাহারা দেওয়া, ঔষধপত্রের ব্যবস্থা করা, এমনকি অস্ত্রশস্ত্র-গোলাবারুদের ও সেনাসামন্তের মেইন্টেন করা, এ জাতীয় বহু কাজেও আমাদেরকে সক্রিয়ভাবে সাহায্য করতে তিনি অত্যন্ত আনন্দবোধ করেছিলেন। তিনি যুদ্ধক্ষেত্রে যুদ্ধ করেননি সত্য, কিন্তু যুদ্ধের যে সরঞ্জাম তিনি দিয়েছিলেন, তা সক্রিয়ভাবে যুদ্ধ করার চেয়ে কোন অংশে কম নয়।

পরিকল্পনা ও নির্দেশ অনুযায়ী কুষ্টিয়ার সৈন্যদের তুলে নিয়ে ঝিনাইদহের দক্ষিণ-পশ্চিম ও পূর্ব-দক্ষিণের ভিন্ন ভিন্ন সামরিক গুরুত্বপূর্ণ স্থানে নিয়োগ করা হয়। যশোর সেনানিবাস থেকে শত্রুপক্ষ যাতে কোনো দিক দিয়ে পালিয়ে আমাদের পেছনে বা মধ্যে আসতে না পারে তার জন্য জোর পেট্রলিং করা হচ্ছিল।

এদিকে পূর্বনির্দেশ অনুযায়ী ক্যাপ্টেন আজম চৌধুরী কুষ্টিয়ায় অধিকৃত সমস্ত অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ ও গাড়ী ৩রা এপ্রিল অতি প্রত্যুষে হেডকোয়ার্টার চুয়াডাঙ্গা অভিমুখে পাঠিয়ে দেয়। সেদিন আমি ও ডাঃ আসহাবুল হক সাহেব যখন আমাদের পরবর্তী পরিকল্পনার খসড়া তৈরি করেছি, এমন সময় সেখানে এসে উপস্থিত হলো ফরাসী টেলিভিশন কর্পোরেশনের ভ্রাম্যমাণ দল। তারা আমার কাছে বিশ্বময় টেলিভিশন পাবলিসিটির জন্য আমার সাক্ষাৎকার চাইলেন। আমি চিন্তা করে দেখলাম, যে পর্যন্ত একমাত্র বিবিসি ও আকাশবাণী ছাড়া আর কোথাও আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সঠিক রূপ প্রকাশ পায়নি। এমনকি বিবিসি থেকেও ২/৪টা খুচরো সংবাদ ছাড়া বিশেষ কিছু প্রকাশ পেত না। অতচ বিশ্ববাসী আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সঠিক রূপ এবং যুদ্ধ চালিয়ে যাবার জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞার বিষয়ে জানতে না পারলে তাদের সমর্থন পাওয়া অসম্ভব। বিশ্বের সমর্থন ছাড়া যে কোন মুক্তিযুদ্ধ লোকালাইজড হতে হতে শেষ পর্যন্ত নিঃশেষ হয়ে যেতে বাধ্য হয়। তাই এ সুযোগ আমি হেলায় ফেলতে পারলাম না। দীর্ঘ ১৫ মিনিট পর্যন্ত আমার সাক্ষাৎকার নেয়া হল। আমার ৬ বছরের ছোট মেয়ে, দাকনাম তার কলি, তখন কাগজের উপর বাংলাদেশের পতাকা বানিয়ে সেটাকে ছোট একটা কঞ্চিতে লাগিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। এত কচি শিশুর এত উদ্দিপনা ও মনোবল তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করল। সেই মুহূর্তেই তারা কলির সেই ভঙ্গিমার মুভি শট নিলেন, আরও নিলেন আমার স্ত্রী, বড় মেয়ে চম্পা এবং অন্যান্য আরও দু’চার-জনের সংক্ষিপ্ত কথা ও ছবি। আমাদের সৈনিকদের মনোবল দেখানো হলো নানাস্থানে ভারী অস্ত্রে সজ্জিত অবস্থান। বেলা তখন প্রায় সকাল ১০টা। এসে গেল কুষ্টিয়া হতে প্রেরিত অধিকৃত অস্ত্রশস্ত্র ও যানবাহনের কনভয়। কুষ্টিয়ার যুদ্ধে আমাদের অভাবনীয় জয়ের সেগুলি ছিল জীবন্ত নিদর্শন। টেলিভিশন কর্পোরেশনের সদস্যরা বেশ উৎসাহিত হলেন। সাথে সাথে সমস্ত ‘কনভয়’কে হেডকোয়ার্টারের সম্মুখে অবস্থিত রাস্তার উপর সার বাঁধিয়ে বড় বড় কামান ও মেশিনগুলির ভাল করে ডিসপ্লে করে রাখা হল। একের পর এক সুষ্ঠুভাবে তারা নিলেন এগুলোর জীবন্ত ছায়াছবি। আমাদের হাতে বন্দী লেঃ আতাউল্লাহ শাহ্‌কেও আনিয়ে মাথার ব্যান্ডেজ বাধা অবস্থায় সেই লাইনের অধিকৃত একটি জীপের পাশে বসিয়ে দেয়া হল। দীর্ঘ ১৫ মিনিট পর্যন্ত ধরা পড়ল তার জীবন্ত সাক্ষাৎকার।

আল্লাহ্‌র কি ইচ্ছা, শুটিং শেষ করে কর্পোরেশনের সদস্যরা তাদের টেপরেকর্ডার ও মুভি ক্যামেরা গুটাতে যাবে, ঠিক এমনি সময় আসল চুয়াডাঙ্গার উপরে পাকিস্তান বিমান বাহিনীর বিমান হামলা। চলল বিমানে-জমিনে লড়াই। কর্ণবিদারী আওয়াজে মুখরিত হয় চুয়াডাঙ্গা। এই সুযোগের অপচয় করেননি ফরাসী টেলিভিশন কর্পোরেশনের নির্ভীক সদস্যরা। অসম সাহসের সাধে তারা নিতে লাগলেন বিমানের উড্ডয়ন, বোমা ও রকেট নিক্ষেপ, জমিনমুখী গুলি ও এন্টি-এয়ারক্রাফট ফায়ার-এর ছবি ও আওয়াজ। ধরা পড়ল তাতে সৈন্যদের ব্যস্তসমস্ত অ্যাকশন ও রিঅ্যাকশনের জীবন্ত ছবি। বাংলার মাটিতে নিক্ষিপ্ত হল প্রথম নাপাম বোমা চুয়াডাঙ্গার ইপিআর উইং-এর প্রাক্তন হেডকোয়ার্টার ভবনে। ধরে গেল আগুন। কর্পোরেশনের সদস্যরা ভাগ্যবশত ঠিক সেখানটায় উপস্থিত ছিলেন। নাপাম বোমার নিক্ষেপ থেকে শুরু করে টার্গেট হিট, আগুন ধরা সবকিছুর জীবন্ত ছবি উঠে গেলো তাদের ক্যামেরায়। ওরা এত নির্ভীক যে ত্রস্ত গতিতে গাছের উপর উঠেও তারা এই আকাশ ও জমিনের যুদ্ধের ছবি তোলা পরিচালনা করেন।

এই যুদ্ধে আমাদের বিশেষ কিছু ক্ষতি হয় নি, শুধু একজন স্বেচ্ছাসেবকের গায়ে বোমার সামান্য একটা টুকরা লেগে সামান্য আহত হয়। তবে চুয়াডাঙ্গা শহরের ঠিক দক্ষিণ ভাগে একটা বাড়ীর কুঁড়েঘরে নাপাম বোমা নিক্ষিপ্ত হলে সে ঘরটা পুড়ে ছাই হয়ে যায়। এত সুষ্ঠুভাবে এত সাহসের সহিত টিভির সদস্যরা এই জীবন্ত ছবি তোলার কাজ সমাপন করেন যে তাদেরকে আমি সালাম না জানিয়ে পারিনি।

আমার মনে আছে, এই মুভি রীলের মধ্যে আমি জোর দিয়ে একটা কথা পরিষ্কারভাবে বিশ্বকে জানিয়ে দিতে চেয়েছি যে, আমরা পৃথিবীর স্বাধীন দেশগুলোর শুধু নৈতিক সমর্থন চাই, বস্তুগত সমর্থনের দরকার আমাদের নেই, কারণ আমার হাতের চীনা এসএমজি’টা দেখিয়ে ওদেরকে শত্রুর অস্ত্র দিয়েই আমরা শত্রুকে হনন করবো।

পরিশেষে এই টিভি সদস্যদল আমাদের কাছে বিদায় গ্রহণ করে কলিকাতা যান। বলে গেলেন যে, তারা প্যারিসে সেদিনই চলে যাবেন এই অ্যাকশন ফিল্মের পাবলিসিটি দেবার জন্য।

পরবর্তীকালে এই সদস্যদলের দ্বিতীয়বার আগমন জানাতে পারলাম, তাঁরা নাকি এই ফিল্মের কপি আরও ৫১টি বিদেশী রাষ্ট্রের কাছে বিক্রি করেছে। আরো জানতে ও শুনতে পেলাম নামকরা চলচ্চিত্র পরিচালকের মাস্টার পিস ফিল্ম প্রোডাকশনের মত এই যুদ্ধের ফিল্মটিও সারা বিশ্বে সুপারহিট করেছিল, কারণ এটাই সে পর্যন্ত বহির্বিশ্বে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণা ও প্রতিজ্ঞা সাফল্যজনকভাবে বিশ্বের স্বাধীনচেতা লোকদের মনোযোগ ও সমর্থন আকর্ষণ করতে পেরেছেন। লণ্ডন, ওয়াশিংটন ও অন্যান্য জায়গা থেকে সামরিক ও বেসামরিক অফিসাররাও এই সত্যের স্বীকৃতি দিয়েছিলেন।

ইতিমধ্যে ভারতীয় সীমান্ত বাহিনীর কাছ থেকে কিছু কিছু ৩০৩ রাইফেল, ২/১টা এলএমজি, কিছু স্টেনগান ও সামান্য পরিমাণ গোলাবারুদ পেয়েছিলাম। অনেকে ভারত থেকে আমার কাছে এসেছিলেন দেখা করতে সামান্য কিছু রিলিফ সামগ্রী নিয়ে। তাঁদের মধ্যে বাংলাদেশ সহায়ক সমিতির খ্যাতনামা সেক্রেটারী শ্রী এম কে ভিমানী এবং বিহারের মুখ্যমন্ত্রী এসে আমার কাছ থেকে আমার কি কি প্রয়োজন তার একটা ফর্দ করে নিয়ে গেলেন। কিন্তু ঐ ফর্দের কোন জিনিসই কোন কালে পেলাম না, তাদেরও আর সাক্ষাৎ পেলাম না। অবশ্য শ্রী ভিমানী আমার সৈন্যদের যে পরিমাণ রিলিফ সামগ্রী পাঠিয়েছিলেন, তাতে যুদ্ধক্ষেত্রে বুট, কাপড়, ঔষধপত্র থেকে আরম্ভ করে ওদের কোন কিছুরই অভাব হয়নি।

ভারতের সাথে যোগাযোগ

৫ই এপ্রিল, ১৯৭১ সন, সময় সকাল ১০টা। সীমান্তবর্তী জীবননগর থানা থেকে খবর আসল আমার সদর দপ্তরে যে, মাননীয় তাজউদ্দীন সাহেব এবং ভারতীয় কয়েকজন উচ্চপদস্থ অফিসার আমার সাথে দেখা করার জন্য জীবননগর সীমান্তে অবস্থান করছেন। যথাসম্ভব দ্রুতগতিতে আমার সেখানে যাওয়া উচিৎ। একটি জীপে চড়ে ২জন সৈনিক সাথে করে রওনা হলাম। সীমান্ত পার হয়ে ভারতের মাটিতে পা দিতেই লেঃ কর্নেল এইচ আর চক্রবর্তী (সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর ৭৬ নং ব্যাটালিয়ন কমান্ডার, কৃষ্ণনগর) আমাকে জোর আলিঙ্গন করে গ্রহণ করেন ও আমার বীরত্বপূর্ণ যুদ্ধের ভূয়সী প্রশংসা করেন। সেখানে দেখা হয় তাজউদ্দীন সাহেব এবং ভারতের সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর আই-জি সাহেবের সাথে। মনোযোগ সহকারে তাঁরা শুনলেন আমার রণাঙ্গনের আদ্যোপান্ত ইতিহাস। শুনতে চাইলেন আমার যশোর আক্রমণের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা। আরও শুনতে চাইলেন ঐ পরিকল্পনাকে সার্থক করতে হলে আমার কি কি প্রয়োজন। বললাম সবকিছু। তাজউদ্দীন সাহেব আশ্বাস দিলেন যে, যথাশীঘ্রই আমরা সব পাব। লেঃ কর্নেল চক্রবর্তী এত বেশী আবেগপ্রবণ হয়ে গেলেন যে, তখনই তিনি সাথে করে আনা একটি চেকোস্লোভাকিয়ান এলএমজি দিতে চাইলেন। এটার ব্যবহারকৌশল আমার জানা ছিল না বলে তিনি আমাকে দুপুরের খাবারের পর নিয়ে গেলেন ওটার কৌশল শিখাবার জন্য। এমন সময় আমার সদর দপ্তর চুয়াডাঙ্গা থেকে টেলিফোনে খবর আসল যে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটা বড় দল ঝিনাইদহের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। এখানে একটু বলে রাখা ভালো যে, ৩রা এপ্রিল চুয়াডাঙ্গায় বিমান হামলা চলাকালীন যশোর থেকে পাক সেনাবাহিনীর একটা দল অগ্রসর হতে গিয়ে কালীগঞ্জ এলাকায় আমাদের ফাইটিং পেট্রোলের এমবুশে পড়ে কিছুসংখ্যক প্রাণ হারিয়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। যাই হোক, খবর পেয়ে আমি আমার একজন সৈনিককে ঐ চেকোস্লোভাকিয়ান এলএমজি’র কৌশল শিখিয়ে ওটা নিয়ে আসবার জন্য ওখানে রেখে আমি সদর দপ্তরের দিকে দ্রুতগতিতে চলে আসি। সদর দপ্তরে তখন ছিলেন আসহাবুল হক সাহেব ও আমার স্ত্রী। এই খবর স্বাভাবিকভাবেই ওরা একটু মুষড়ে পড়েছিল। যাই হোক, আমি যাবার পর প্রয়োজনীয় খবরাখবর ও সৈন্য মোতায়েন করার পর অবস্থা আয়ত্তে আসে। পাকিস্তানীরা আর অগ্রসর হয়নি। বুঝতে পারলাম এটা ছিল তাদের নকল আক্রমণের প্রহসন।

জীবননগর থেকে চলে আসার পূর্বে লেঃ কর্নেল এইচ,আর, চক্রবর্তী আমাকে সবরকম আশ্বাস দিয়ে বললেন যে, আচিরেই আমরা আমাদের ভারী অস্ত্রাদি পাব, যার জন্য তিনি আমাকে আইজি-এর অফিসে মেজর বি,এন, ভট্রাচার্যের সাথে সর্বক্ষণ যোগাযোগ রাখার উপদেশ দিলেন। তাঁর নিজের টেলিফোন নাম্বারও দিলেন। সেই থেকে প্রতিক্ষণ ইন্ডিয়ান বিএসএফ-এর আইজি সাহেবের অফিসে মেজর ভট্রাচার্যের কাছে টেলিফোনে সর্বশেষ অবস্থা কি জানতে চাইতাম। তিনি আমাকে প্রতিবারই আশ্বাস দিয়ে বলতেন যে আমার ডিমাণ্ড দিল্লীর অফিসে বিবেচনাধীন আছে, শীঘ্রই এসে যাবে।

এদিকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী যশোর থেকে ৬ই এপ্রিল ভোরবেলা আমার বিশাখালী সৈন্যাবস্থান আক্রমণ করে, কিন্তু তাদের ভাগ্যের পরিণতি কে এড়াবে! কিন্তু আমার বাহিনী সর্বোতভাবে প্রস্তুত ছিল, সতর্ক ছিল। এদের পালটা আক্রমণে পাকিস্তানীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। ছত্রভঙ্গ হওয়ায় তাদের বহু প্রাণের ক্ষয়ক্ষতি হয়, কেবল সামান্য কিছু লোক যশোর সেনানিবাসে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে যেতে সমর্থ হয়। এটা ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মুখে আমাদের সামরিক সুরুত্বপূর্ণ প্রথম বিজয়, যার জন্য আমার সেনাবাহিনী ও স্থানীয় জনসাধারণের মনের বিশ্বাস ও উদ্দীপনা আকাশচুম্বি অবস্থা গ্রহণ করে। আমিও এই সুযোগে আমার বাহিনীর অবস্থান সীমা পরিবর্তন করে কালীগঞ্জের দক্ষিণে যশোর সেনানিবাস থেকে ৫ মাইল দূরে অর্ধবৃত্তাকারে অবস্থান করি। ব্যাপকভাবে পেট্রলিংও কায়েম রাখি যার জন্য যশোর পাক-বাহিনী বের হতে আর সাহস করেনি।

অন্যদিকে জীবননগরের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী আশ্বস্ত হয়ে আমি দর্শনা-গেদের রেলওয়ে স্টেশনের মধ্যবর্তী উঠিয়ে ফেলা রেললাইন জোড়া দিয়ে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে রেল যোগাযোগ স্থাপন করি এবং ৭ ই এপ্রিল অপরাহ্নে একটা লম্বা খালি মালবাহী ট্রেন গেদে স্টেশন দাঁড় করিয়ে রাখি আমাদের ইস্পাত ভারী অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ বহন করে নিয়ে আসার দুরাশায়। এটা যে সত্যি দুরাশা ছিল, তখন ভেবে দেখার ফুসরত পাইনি, সন্দেহও হয়নি। এদিকে ৬ ই এপ্রিলের পর থেকে তীব্র গতিতে চলতে লাগল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর রি-ইনফোর্সমেন্ট প্রোগ্রাম-জল ও আকাশপথে। আকাশপথে বাধা দিবার আমার কোন শক্তি ছিল না। জলপথেও বাধা দিতে পারিনি, কেননা যশোর সেনানিবাস থেকে আরম্ভ করে দক্ষিন দিকে খুলনা মংলা বন্দর পর্যন্ত আমার আয়ত্ত্বাধীন ছিল না।

ইপিআর-এর ৫ নং উইং-এ অবস্থান ছিল খুলনায়। তার কমান্ডার ছিল অবাঙালি। তারা পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী সেখানে ইপিআর সেনাবাহিনীকে প্রায় পুরোপুরিভাবে নিরস্ত্র করে রেখেছিল। লড়াই লাগার সাথে সাথে অনেকে প্রাণ দিল, অনেকে আত্নগোপন করে রইল। যারা আত্নগোপন করে রইল তাদের সামান্য সংখ্যকের কাছে রাইফেল ও স্টেনগান ছিল।

তৎকালীন ইপিআর সেক্টর হেডকোয়ার্টার ছিল যশোর। বেশীর ভাগই বাঙালি। ক্যাপ্টেন হাশমত (পদাতিক বাহিনী) ও ক্যাপ্টেন আওলাদ হোসেন (সিগন্যালস) এই দুজনে ছিলেন বাঙালি অফিসার। ২৬ শে মার্চ আমি ক্যাপ্টেন হাশমতের কাছে আমাদের বিদ্রোহ করার খবর জানিয়ে তাদেরকেও জরুরী অবস্থা গ্রহণ করতে অয়ারলেসে খবর পাঠাই। কিন্তু দুর্ভাগ্য, আমার সেখানকার বাঙালি সুবেদার ও জওয়ানদের দৃঢ় মনোবল সত্ত্বেও এই দু’জন অফিসার আত্মগোপন করে। পরবর্তী এক সপ্তাহকাল পর্যন্ত এই ক্ষুদ্র সৈন্যদল নায়েব সুবেদার আব্দুল মালেকের নেতৃত্বে সীমিত কিন্তু প্রচণ্ডভাবে লড়াই শেষে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। তারা বেনাপোলের দিকে পালিয়ে যায়। সেখানেও তারা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সাথে খণ্ড খণ্ড যুদ্ধে লিপ্ত হয় এবং এপ্রিল মাসের ২০ তারিখ পর্যন্ত পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে নাভারণ থেকে দূরে রাখতে সমর্থ হয়। তৎকালীন লেঃ হাফিজের মুখে শুনেছি, ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীর ব্যাটালিয়ন কমান্ডার লেঃ মেঘ সিং- তার এক কোম্পানী সৈন্য নিয়ে লেঃ হাফিজ ও ইপিআর বাহিনীর সাহায্যার্থে বাংলাদেশের মাটিতে ঢুকে পরেন এবং নাভারনে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সাথে যুদ্ধ করেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত লেঃ কর্নেল মেঘ সিং-এর ২/৩ জন সৈন্য পাক-বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে, যার পরিণামে আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক মহলে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। তবে ভারত তাদের সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর প্রত্যক্ষভাবে বাংলার মাটিতে ঢুকে যুদ্ধে লিপ্ত হবার কাহিনী অস্বীকার করে। লেঃ কর্নেল মেঘ সিং তার সৈন্যদের নিয়ে নিজের মাটিতে ফিরে যেতে বাধ্য হন।

অপরিহার্য কারণবশত বেনাপোল-যশোর রোডসহ দক্ষিণাঞ্চল সরাসরি এবং প্রত্যক্ষভাবে আমার নিয়ন্ত্রণে আসেনি এপ্রিল মাসের ১৯ তারিখ পর্যন্ত।

এদিকে মেহেরপুর তদানীন্তন এসডিও জনাব তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী ও ঝিনাইদহের তদানীন্তন এসডিপিও জনাব মাহবুবউদ্দিন আহমদ আমার সাথে যোগদান করেন। মাহবুব উদ্দিন সাহেব পুলিশ অফিসার বিধায় আমি তখনই তাঁকে ঝিনাইদহ রক্ষণাবেক্ষণের ভার ও ঝিনাইদহে প্রেরিত সকল সৈন্যের নেতৃত্ব প্রদান করি। কুষ্টিয়া যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে মাহবুল সাহেব সুনিপুণভাবেই ঝিনাইদহে প্রেরিত সকল সৈন্যের নেতৃত্ব প্রদান করি। কুষ্টিয়া যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে মাহবুল সাহেব সুনিপূনভাবেই ঝিনাইদহে তাঁর কর্তব্য পালন করেন। এপ্রিল মাসের ২/৩ তারিখে ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজের প্রফেসর সফিকুল্লাহ সাহেব ও আমার সাথে যোগদান করেন । এদের আমি অশেষ দেশপ্রেম ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে যুদ্ধের কঠিন সংকল্প দেখতে পেলাম। আগেই বলেছি আমার কাছে ক্যাপ্টেন আজম ছাড়া দ্বিতীয় কোন অফিসার ছিল না। তাই ৭ই এপ্রিল সেক্টর অর্ডার- এর মাধ্যমে যুদ্ধক্ষেত্রে সৈন্যবাহিনী পরিচালনা করার জন্য আমি তাদেরকে সরাসরি ক্যাপ্টেন র‍্যাঙ্ক পড়িয়ে দিই। সেক্টর অর্ডারে আমি লিখেছিলাম – “On behalf of the Bangladesh High Command I hereby award Commission to the following persons directly in the rank of Captain to meet operational requirements:-
(a) Mr. Toufiq Elahi Chowdhury.
(b) Mr. Mahabubuddin ahmed.
(c) Mr. Md. Safiqullah

(অনুবাদঃ বাংলাদেশ হাই-কমান্ডের পক্ষে আমি কাজের চাহিদার প্রেক্ষিতে নিম্নোক্ত লোকজনকে সরা সয়াসরি ক্যাপ্টেন র‍্যাঙ্কে উন্নীত করলামঃ
ক। মোঃ তৌফিক ইলাহী চৌধুরী
খ। মোঃ মাহবুবুদ্দিন আহমেদ
গ। মোঃ শফিকুল্লাহ)

এই তিনজন অফিসারই পরবর্তীকালে যুদ্ধের শেষ দিন পর্যন্ত সেক্টরে কোম্পানী কমাণ্ডার হিসাবে যুদ্ধ করেছেন। তাদের বীরত্ব ছিল সত্যিই অতুলনীয়।

কুষ্টিয়া যুদ্ধের পর ২রা এপ্রিল প্রথম বঙ্গ শার্দুলদের দুঃখময় পরিণামের খবর আমার গোচর করা হয়। আরও বলা হয় যে তাদের কিছুসংখ্যক লোক পালিয়ে চৌগাছায় একত্রিত হয়েছে এবং লেঃ হাফিজ নামে একজন বাঙালি অফিসারও সেখানে আছে। ঐদিনই আমি আমার কাছে উপস্থিত হবার জন্য লেঃ হাফিজকে লোক মারফত চিঠি দিয়ে নির্দেশ দিলাম, কিন্তু হাফিজ আসেনি। ৪ঠা এপ্রিল তাই ঝিনাইদহের কমান্ডার মিঃ মাহবুবকে লেঃ হাফিজের খোজে পাঠাই। লেঃ হাফিজ তার ২/৩ জন লোক সাথে করে মাহবুবের গাড়ী করে আমার কাছে উপস্থিত হয়। তার কাছে প্রথম বঙ্গ শার্দুলদের করুণ কাহিনী বিস্তারিত জানতে পারলাম এবং আমার খবর পাওয়া সত্বেও আমার সাথে দেখা না করার একটা কারণ খুজে পেলাম। যাই হোক, আমার পরিস্কার মনে আছে যে আমার অধিনস্থ ইপিআর বাহিনীর জামা-কাপড়, ইউনিফর্ম, বুট, ইকুইপমেন্ট এবং কুষ্টিয়া থেকে অধিকৃত ভারী ও হালকা অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ এবং গাড়ী দিয়ে ওদেরকে সজ্জিত করে চৌগাছা এলাকায় সন্নিবেশিত করলাম।

পূর্বেই বলেছি যে, বিশাখালী (ঝিনাইদহ থেকে ৩ মাইল দক্ষিণে) যুদ্ধের পর আমার সৈন্যদের ডিফেন্স লাইনকে অগ্রগামী করে যশোর ক্যান্টনমেন্ট থেকে মাত্র ৫ মাইল দূরে রেখেছি। তার কারণ ছিলো এই যে, ক্যান্টনমেন্ট থেকে আমার অবস্থান তাদের দূরপাল্লার কামানের আওতার বাইরে রাখা। দ্বিতীয়ত আমার কোনো ভারী অস্ত্রশস্ত্র না থাকায় প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সীমান্তে মাননীয় তাজউদ্দীন সাহেবের প্রতিশ্রুত ভারী অস্ত্রাদির অপেক্ষায় থাকা ও একই সঙ্গে ক্যান্টনমেন্টের উপর চাপ সৃষ্টি করে রাখা। পরিকল্পনা ছিলো, ভারত থেকে কিছু ভারী অস্ত্রাদি পেলেই আমরা যশোর ক্যান্টনমেন্ট আক্রমণ করবো। এদিকে ঐ অস্ত্র আসার অপেক্ষায় থাকতে থাকতে বুঝতে পেরেছিলাম যে প্রতিদিনই পরিস্থিতি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অনুকুলে চলে যাচ্ছে। কারণ জল ও আকাশপথে তাদের রি-ইনফোর্সমেন্ট পুরোদমেই চলছিলো। ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর ভারপ্রাপ্ত অফিসারের কাছে প্রতি পলে সিচ্যুয়েশন রিপোর্ট দিয়েও শুধু আশ্বাস ছাড়া আর কিছুই পাইনি। অবশ্য এটা যে শুধু আশ্বাসই ছিলো তখন তা বুঝতে পারিনি। এভাবে কেটে গেলো ১১ এপ্রিল ১৯৭১ সন।

গোয়ালন্দ প্রতিরোধ

১২ এপ্রিল খবর আসলো যে, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটা বিরাট অংশ আরিচা থেকে জলপথে গোয়ালন্দের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। বুঝতে পারলাম এদেরকে যদি গোয়ালন্দে নামতে দেয়া হয় তাহলে আমার যশোরের পরিকল্পনা ভেস্তে যাবে। আমার ক্ষুদ্র সেনাবাহিনী থেকে কোনোরকমে এক প্লাটুন সৈন্য ২টি এলএমজি, ১টি ও একটি ট্যাংক বিধ্বংসী ছোট কামান সহকারে পাঠিয়ে দিলাম নায়েক সুবেদার শামসুল হকের নেতৃত্বে গোয়ালন্দে। তাদের উপর আমার নির্দেশ ছিলো যে, পাক সেনারা যাতে কোনমতেই পদ্মার এপারে অবতরণ করতে না পারে। ১৩ই এপ্রিল এই অগ্রগামী সৈন্যের সাথে পদ্মার পারে আমার ক্ষুদ্র সেনাদলের এক তীব্র সংঘর্ষ হয়। এতে পাক বাহিনীর একটি জাহাজ ডুবে যায় এবং তারা উত্তরাভিমুখে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। পরে খবর পেলাম যে, পাকবাহিনী একই সময়ে নগরবাড়ীতে অবতরণ করার চেষ্টা করছে। বুঝতে পারলাম নগরবাড়ীতে যদি পাকবাহিনী বিনা বাঁধায় নামতে পারে, তাহলে তারা পাবনা ঈশ্বরদী হয়ে আমার পিছন দিক থেকে আক্রমণ চালাতে পারে। তাতে আমার পজিশন অত্যন্ত সংকটময় হয়ে যাবে। তাই রাজশাহীতে যুদ্ধরত মেজর মরহুম নাজমুল হককে টেলিফোন করে নগরবাড়ীতে এক কোম্পানী সৈন্য জরুরী ভিত্তিতে পাঠাবার জন্য অনুরোধ করলাম। কিন্তু তিনি যদিও এক প্লাটুন সৈন্য পাঠিয়েছিলেন তারা সময়মত পৌঁছতে পারেনি।

এদিকে শুনতে পেলাম তদানীন্তন অবসরপ্রাপ্ত ক্যাপ্টেন খোন্দকার নাজমুল হকের নেতৃত্বাধীন এক কোম্পানী পরিমাণ মুজাহিদ ছিলো নগরবাড়ী রক্ষণাবেক্ষণে লিপ্ত। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ২/৪টা গোলা নগরবাড়ীতে পড়ার সাথে সাথেই তারা সব পালিয়ে যায় এবং পাকবাহিনী ১৫ই এপ্রিল পুরোপুরিভাবে নগরবাড়ীতে অবতরণ করতে সক্ষম হয়। অবতরণের পর পরই পাকসেনারা তীব্র গতিতে পাবনার দিকে অগ্রসর হয়। ১৬ই এপ্রিল ভেড়ামারায় অবস্থিত আমার ক্ষুদ্র সেনাদলের সাথে প্রচণ্ড গোলাগুলির পর পাকবাহিনী ভেড়ামারায় অবতরণ করে। ভেড়ামারার কমান্ডে তখন ছিলো সুবেদার মেজর মুজাফফর। উপায়ন্তর না দেখে সে তার সৈন্যদল নিয়ে পিছু হটে যায়।

ওদিকে যুগপৎভাবে পাক সেনাবাহিনী ও বিমানবাহিনী যশোর থেকে আমাদের উপর হামলা চালায়। এই দুই দিক থেকে (সামনে ও পিছন দিক থেকে) হামলা প্রতিহত করার মতো সৈন্যবল ও অস্ত্রবল আমার ছিলো না। কাজেই আমার সম্মুখভাগ (ফ্রন্ট লাইন) সঙ্কুচিত করার উদ্দেশ্যে দুই দিক থেকেই সৈন্যদের অপসারণ করে পিছিয়ে নিয়ে আসি পর্যায়ক্রমে এবং পুনঃপ্রতিরক্ষাব্যূহ গঠন করি কোটচাঁদপুর, ঝিনাইদহ, শৈলকুপা (রাস্তা), পোড়াদহ লাইনে। কিন্তু ১৬ই এপ্রিল অপরাহ্নেই পাকবাহিনীর হাতে ঝিনাইদহের পতন হয়।

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার উদ্বোধনঃ অপরপক্ষ ১০ই এপ্রিল গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গঠনের পর চুয়াডাঙ্গাকে বাংলাদেশের অস্থায়ী রাজধানী ঘোষণা করার সাথে সাথেই চুয়াডাঙ্গার উপরে চলতে থাকে তীব্র বিমান হামলা। এতদসত্ত্বেও বাংলাদেশ সরকার মনস্থীর করলেন যে চুয়াডাঙ্গার কোনো মুক্ত এলাকাতে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হবে ১৭ই এপ্রিল। নির্বাচন করা হলো আমারই পূর্বতন ইপিআর কোম্পানী হেডকোয়ার্টার বৈদ্যনাথতলার আম্রকানন। সময় সকাল ১০ ঘটিকা। আমি যুদ্ধে ওতপ্রোতভাবে লিপ্ত থাকা বিধায় স্টেজ ও আনুষ্ঠানিক ব্যবস্থাপনার ভার নিলেন ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীবাহিনীর ৭৬ ব্যাটালিয়ন কমান্ডার লেঃ কর্নেল চক্রবর্তী। স্থানীয় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাও করলেন তিনি। আমাকে শুধু নির্দিষ্ট সময়ে উপস্থিত হবার জন্য খবর দেয়া হলো। ওদিকে প্রতিকুল পরিবেশের মধ্যে ঐ রাতেই সদর দপ্তর মেহেরপুর থেকে ভৈরব নদীর অপর পারে ইছাখালী বিওপি’তে স্থানান্তরিত করি। এই বিওপি থেকে ভারতীয় বিওপি’র দুরত্ব ছিলো প্রায় ৬০০ গজ। বিওপি’তে থাকবার মতো কোনো ব্যবস্থা না থাকায় সৈন্যদের যথাক্রমে প্লেস করিয়ে গাড়ীতে করে আমার স্ত্রী কন্যাদের নিয়ে এই প্রথমবারের মতো ভারতে পদার্পণ করি।

সে রাতে সামান্য একটা ঘটনার কথা কোনোদিন ভুলতে পারবো না। ঘটনাটা হলো এই যে, ভারতীয় মাটিতে পদার্পণ করার সাথে সাথেই আমার স্ত্রী নিজেকে অত্যন্ত অসহায় অনুভব করে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলেন। সাথে সাথে কন্যাদের অবস্থাও তথৈবচ। আমার স্ত্রী যতক্ষণ সম্ভব বাংলার মাটিতে কাটাবে বলে সিদ্ধান্ত নেয়। তাই ফিরে আসা হলো সেই ইছাখালীতে। বিওপি’র ভাঙ্গা ঘরে ছিলো না কোনো বিছানাপত্র, ছিলো না কোনো শোবার জায়গা। মাটিতে শুয়ে ওরা রাত কাটিয়ে দিলো।

পরদিন ১৭ই এপ্রিল সকাল ১০টায় বৈদ্যনাথতলার আম্রকানন লোকে লোকারন্য। অথচ তখনো আমি মেহেরপুরে। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী নবগঠিত সরকারকে সালাম দেবার কথা আমাদেরই। কিন্তু এদিকে নিশ্চিত না করে রওয়ানা করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। ওদিকে দেশ বিদেশের সাংবাদিক সমভিব্যহারে বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে পৌঁছে যান অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ এবং অন্যান্যরা। ভাগ্যবশতঃ তৌফিক এলাহি ও মাহবুবকে আমি ভোর ৭টায় পাঠিয়ে দিয়েছিলাম ওখানে। ত্রস্ত গতিতে মাহবুব উপস্থিত কিছু সংখ্যক যুদ্ধক্লান্ত ইপিআর ও আনসার-মুজাহিদের মিলিত সৈন্যদের একত্রিত করে সদ্য আগত প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীকে সালাম প্রদান করেন। তার কিছুক্ষণ পরেই আমি, ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন (বর্তমানে মেজর), ক্যাপ্টেন হাফিজ, আমার স্ত্রী কন্যা এবং সমান্য সৈন্য সমভিব্যহারে সেখানে উপস্থিত হই। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের ঘোষণা ও সনদপত্র পাঠের পর এই নবগঠিত সরকারকে আমি অভিবাদন দেই। তারপর আনুষঙ্গিক আলাপ-আলোচনা, পরিচয়, ভাষণ ও সবশেষে মধ্যাহ্ন ভোজের পর এই উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শেষ হয়।

গৌরবের বিষয় যে, পলাশীর আম্রকাননে বাংলার স্বাধীনতা লুপ্ত হবার পর আবার বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে স্বাধীনতার উন্মেষ অনুষ্ঠানের মতো এতবড় একটা ঐতিহাসিক পর্বে স্বাধীনতা যুদ্ধে লিপ্ত কমান্ডারদের মধ্যে একমাত্র আমিই বাংলার নারী জাতির প্রতিনিধি হিসেবে আমার স্ত্রী সেখানে উপস্থিত ছিলেন।

ফিরে এলাম আমার অস্থায়ী আড়ম্বরহীন সদর দপ্তর ইছাখালী বিওপি’তে।

এখানে একটা কথা বলে রাখা আবশ্যক যে, ১৬ই এপ্রিলে যখন দেখতে পেলাম সদর দপ্তর চুয়াডাঙ্গা থেকে সরিয়ে নিতে হবে, ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে তখনই নির্দেশ দিলাম সমস্ত স্থানীয় ও দূরবর্তী ব্যাংকের টাকা পয়সা সোনা গয়না সাথে নিয়ে নেয়ার জন্য। নির্দেশ অনুযায়ী ডাঃ আসহাবুল হক, ক্যাপ্টেন তৌফিক এলাহী, ক্যাপ্টেন মাহবুব এবং আরো কয়েকজন গণ্যমান্য লোকের প্রচেষ্টায় আনুমানিক সাড়ে চার কোটি টাকা ও আধা মণ সোনা আমরা সাথে নিয়ে যাই। স্থানীয় যত গুদামে চাউল ও আটা ছিলো সবগুলো আমাদের গাড়ীতে উঠিয়ে নেই।

১৮ই এপ্রিল সকালবেলা ঐ সীমান্তে ক্যাপ্টেন আজমের নেতৃত্বাধীন এক কোম্পানী সৈন্য রেখে বাকী ও সদর দপ্তর নিয়ে আমি চলে যাই বেনাপোল এবং সেখানে স্থাপন করি আমার সদর দপ্তর। ঐ দিনই আমি বেনাপোল ও যশোর রোড এবং তার দক্ষিণাঞ্চলের কর্তৃত্বভার প্রত্যক্ষভাবে নিজের অধীনে নিয়ে বেনাপোল থেকে পূর্বদিকে কাগজপুকুর এলাকায় আমার প্রতিরক্ষাব্যূহ গঠন করি। ২০শে এপ্রিল সকাল ১০টায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর নবনিযুক্ত সেনাপতি কর্নেল এমএজি ওসমানী (বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল) বেনাপোলে আমার সদর দপ্তর পরিদর্শনে আসেন। বেনাপোলে তাকে যথাযথভাবে সামরিক সালাম দেওয়া হয়। আমি সেনাপতিকর প্রতিরক্ষা পরিকল্পনা বুঝিয়ে দেই এবং আমার সামরিক সরঞ্জামাদির অভাব সম্বন্ধে তাকে অবগত করাই।

বেনাপোল থেকে পূর্বদিকে কাগজপুর এলাকায় আমার প্রতিরক্ষাব্যূহ স্থাপন করি কিন্তু প্রথাগত প্রতিরক্ষার জন্য অস্ত্রশস্ত্র ও সাজ-সরঞ্জামাদি যে আমার ছিলো না, তা পূর্বেই বলেছি। এই প্রতিরক্ষাব্যূহের সবচেয়ে মারাত্মক দুর্বলতা ছিলো যে প্রতিরক্ষার জন্য আমাদের সাপোর্টিং অস্ত্রশস্ত্র ছিলো না এবং ফিল্ড অয়ারলেস বা ফিল্ড টেলিফোন এবং ডিগিং যন্ত্রপাতির মারাত্মক অভাব। এতদসত্ত্বেও ২টি কোম্পানী ইপিআর সৈন্য নিয়ে আমি এই প্রতিরক্ষাব্যূহ যথাযথ সম্ভব পরিপূর্ণভাবে গড়ে তুলতে চেষ্টা করি। আমার কাছে মাত্র ২টি ৩ ইঞ্চি মর্টার ও কিছুসংখ্যক গোলা ছিলো। সেগুলো আমি রিজার্ভে রেখেছিলাম স্থান ও কালভেদে প্রয়োজন মতো ব্যবহার করার আশায়। এই প্রতিরক্ষাব্যূহে আমার সাথে ক্যাপ্টেন তৌফিক, ক্যাপ্টেন মাহবুব, ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন (বর্তমানে মেজর) ও ডাঃ আসহাবুল হক উপস্থিত ছিলেন। উল্লেখ্য যে ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন ও ক্যাপ্টেন মুস্তাফিজুর রহমান (বর্তমানে মেজর) ১০ই এপ্রিল ঢাকা থেকে পালিয়ে এসে আমার সাথে যোগদান করেন। প্রথম বঙ্গশার্দুল থেকে পালিয়ে আসা ১৫০ জন সৈন্য নিয়ে হাফিজকেও বেনাপোল কাস্টম কলোনীর দক্ষিণভাগে রিজার্ভ বাহিনী হিসেবে পজিশন নেবার জন্য নির্দেশ দেই।

২৩শে এপ্রিল সকাল ১০টায় তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী মাননীয় তাজউদ্দিন আমার সদর দপ্তর বেনাপোল এসে উপস্থিত হন বাংলার মাটিতে ব্রিটিশ এমপি মিঃ ডগলাস ম্যানকে স্বাগত জানানোর জন্য। দীর্ঘ ৩ ঘন্টা অপেক্ষা করার পর ব্রিটিশ অতিথি আমার সদর দপ্তরে এসে মাননীয় তাজউদ্দিন সাহেবের সাথে ১ ঘন্টাব্যাপী আলোচনা করেন। সুখের বিষয় এই যে, ব্রিটিশ এমপি ভারত থেকে বাংলায় এসে পদার্পণ করার সাথে সাথেই আমার সদর দপ্তরে উড্ডয়নরত বাংলার জাতীয় পতাকা দেখতে পান ও তার পতপত আওয়াজ শুনে অনেকটা আশ্বস্ত হন আমাদের ভবিষ্যৎ স্বাধীনতাপ্রাপ্তির সম্ভবনায়। মাননীয় অতিথি বিদায় নেবার ১ ঘন্টা পরে জনাব তাজউদ্দিন মুজিবনগরে চলে যান। তিনি বিদায় নেবার ঠিক ১৫ মিনিটের মধ্যে ২৩শে এপ্রিল বিকেল সাড়ে ৩টায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী আমাদের উপর আঘাত হেনে আমাদের প্রতিরক্ষাব্যূহ কাগজপুকুর থেকে বেনাপোলের পূর্ব সীমানা পর্যন্ত সঙ্কুচিত করতে বাধ্য করে। যাই হোক রাতারাতি আবার আমরা নতুন করে প্রতিরক্ষা পজিশন সংগঠিত করে নেই।

২৪ শে এপ্রিল ভোর ৪টায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দুই ব্যাটালিয়ন সৈন্য সহকারে আমাদের পজিশনে আক্রমণ করে। আমার বাম দিকের কোম্পানী পজিশনে প্রথম আক্রমণ করা হয়। দুই কোম্পানীর মধ্যে যোগাযোগ করার জন্য রানার ব্যতিরেকে আমার আর কোনো ব্যবস্থা ছিলো না। অন্ধকারে এই কোম্পানীর সাথে তুমুল যুদ্ধ চলে। ভোর ৬টায় একটা ১টন ডজ গাড়ীতে করে ৩ ইঞ্চি মর্টারগুলো পাঠিয়ে দেই তাদের সাহায্যার্থে। তারা কিছুটা সুবিধাজনক স্থানে পজিশন নিয়ে শত্রুর উপর মুহুর্মুহু গোলাবর্ষণ করতে থাকে। এমন সময় শত্রুর আক্রমণের চাপে আমার ভাইটাল পজিশন থেকে এমজিওয়ালা তার এমজি সহকারে পশ্চাদপসরণ করার চেষ্টা করে। কিন্তু ঠিক সে সময় পূর্বতন হাবিলদার-মেজর তখনকার নায়েক সুবেদার মুজিবল হক সেখানে উপস্থিত হয় এবং তার কাছ থেকে এমজি ছিনিয়ে নিয়ে ঐ ভাইটাল পজিশন থেকে ক্ষিপ্র গতিতে অগ্রগামী শত্রুর উপর সুইপিং ফায়ার চালাতে থাকে। সুবিধা ছিলো এই যে, শত্রুর অবস্থান ছিলো তখন খোলা এবং নিচু জায়গায়। মুজিবুল হকের এই তীব্র আক্রমণে শত্রুপক্ষের অধিকাংশ সৈন্য ধরাশায়ী হয় এবং তাদের আক্রমণ প্রায় ব্যর্থ হবার উপক্রম হয়।

ওদিকে পাকিস্তান বাহিনীর দ্বিতীয় ব্যাটালিয়ন আমার ডানদিকের কোম্পানীর উপর আক্রমণ চালায় সকাল ৬টায়। তারা এসেছিলো ইপিআর পোশাক পড়ে। কাজেই প্রথমতঃ আমার ইপিআর বাহিনী ধোঁকা খেয়ে যায়। কিন্তু পরক্ষণেই তারা এই চালাকি বুঝতে পেরে তাদের আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য তীব্র প্রচেষ্টা চালায়। ওদিকে মুজিবুল হকের একক অথচ তীব্র এমজি’র সুইপিং ফায়ারে যখন শত্রুসৈন্য বিধ্বস্ত প্রায়, তখনই ডানদিক থেকে ইপিআর পোশাকের বেশে এক প্লাটুন শত্রুসৈন্য তার দিকে অগ্রসর হয়। মুজিবুল হক তাদেরকে দেখতে পেয়েও ইপিআর বাহিনী ভ্রমে তাদের উপর ফায়ার করেনি। এটাই হলো তার ও আমাদের চরম দুর্ভাগ্য। প্রকৃত এমজি ম্যান ল্যান্স নায়েক বার বার মুজিবুল হককে হুশিয়ার করা সত্ত্বেও সে ইপিআর বাহিনী বলে শত্রুর উপর ফায়ার করতে অস্বীকার করে কিন্তু মিনিট পরেই এই ইপিআর-বেশধারী শত্রু প্লাটুন তার উপর হামলা চালায়। শত্রুর এলএমজি’র বুলেট মুজিবুল হকের বক্ষ ভেদ করে তৎক্ষণাৎ তার জীবন শেষ করে দেয় (ইন্না……………….রাজেউন)। এলএমজি ম্যান হামাগুড়ি দিয়ে পালিয়ে আসতে সক্ষম হয়। নায়েক সুবেদার মুজিবুল হকের অপরিসীম সাহস, কৃতিত্ব ও আত্মত্যাগের ঋণ বাংলার জনসাধারণ কোনকালেই শোধ করতে পারবে না। প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণে জানা যায়, মুজিবুল হকের এমজি সহকারে তীব্রযুদ্ধে আনুমানিক ১৫০ জন শত্রুসৈন্য নিহত হয়, যার জন্য সাময়িকভাবে শত্রুর আক্রমণ প্রতিহত হয়। ইত্যবসরে, আমার বামদিকের কোম্পানী মুজিবুল হকের ফায়ারের আড়ালে থেকে সীমান্তবর্তী এলাকায় পশ্চাদপসরণ করতে সক্ষম হয়। ওদিকে ডানদিকের কোম্পানীও সাপোর্ট ফায়ারের অভাবে ক্ষণিক যুদ্ধের পর সীমান্তবর্তী এলাকায় অপসারণ হয়। দুঃখের বিষয়, মুজিবুল হকের পতনের সাথে সাথেই আমার মর্টার বাহিনী মর্টার গুটিয়ে গাড়ীতে করে পশ্চাদপসরণ করার চেষ্টা করে। কিন্তু অল্প দূরে শত্রুসৈন্যের অবস্থান দেখতে পেয়ে ড্রাইভার গাড়ী দাড় করিয়ে রাস্তার আড়ালর হামাগুড়ি দিয়ে পিছনে পালিয়ে যায়। উপায়ন্তর না দেখে মর্টার বাহিনীর কমান্ডার মোমিনুল হককেও একই পদ্ধতিতে পশ্চাদপসরণ করতে হয়। গাড়ী ও মর্টার শত্রুর হস্তগত হয়।

এদিকে সীমান্ত এলাকাতে আমার বাহিনী প্রাণপণে শত্রুর মোকাবেলা করতে থাকে। সমস্ত দিন গোলাগুলির পরেও শত্রুসেনারা আমার বাহিনীকে সম্পূর্ণভাবে উৎখাত করতে পারেনি এবং আমার সদর দপ্তরে উড্ডয়নরত বাংলার জাতীয় পতাকার পতপত ধ্বনিকে শত চেষ্টা সত্ত্বেও তারা কোনো দিন স্তব্ধ করতে পারেনি। স্বাধীনতা যুদ্ধের শেষদিন পর্যন্ত ঐ পতাকা উড্ডয়নরত থাকে।

——————————————————