পাক-ভারতে মার্কিন সরকারের নীতিমালা | মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেনেটর গোপন দলিল – জগলুল আলম
১৯৬৫ সালে ভারত ও পাকিস্তান কাশ্মীর প্রশ্নে দ্বিতীয়বারের মতাে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। অনেকেই মনে করেন, উপমহাদেশে আমেরিকার উস্কানিমূলক ভ্রান্ত সামরিক সরবরাহ নীতিমালার কারণেই এ যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে।
১৯৬০ সালে আমেরিকা ভারত ও পাকিস্তান উভয়কেই সামরিক মারণাস্ত্র সরবরাহ করে। এ সময় আমেরিকার শর্ত ছিল যে, কোনাে পক্ষ অপর পক্ষের বিরুদ্ধে এই অস্ত্র ব্যবহার করবে না। আমেরিকার মতে, উপমহাদেশে চীনা কমিউনিস্ট প্রভাব প্রতিহত করার জন্যই মূলত এই অস্ত্র সরবরাহ করা হয়েছিল। বিশ্লেষকরা মনে করেন, জনসন ও কেনেডি প্রশাসনের পরস্পরের বিরুদ্ধে মারণাস্ত্র ব্যবহার না করার শর্ত ছিল কেবল লােক দেখানাে… যার ফলে একদিকে ভারত ও পাকিস্তান, অন্যদিকে খােদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে দীর্ঘদিন যাবৎ এর খেসারত দিতে হয়েছে।১
আমেরিকা যদি কোনাে পক্ষকেই সামরিক সরঞ্জাম বিশেষ করে ট্যাংক ও যুদ্ধবিমান সরবরাহ না করতাে তা হলে এই যুদ্ধ সংঘটিত হতাে না বলে যুদ্ধবিশারদরা মনে করেন।২ কারণ সে সময়ে ভারতের বিশাল সামরিক বহরকে রুখার মতাে বিমান শক্তি পাকিস্তানের ছিল না। ভারতের সেনা সংখ্যা ছিল তখন ৮ লক্ষ ৬৭ হাজার যেখানে পাকিস্তানের ছিল ১ লক্ষ ১ হাজার জন। অবশ্য পাকিস্তান ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রশক্তি এবং সিয়াটো বা সাউথ ইস্ট এশিয়া ট্রিটি অর্গানাইজেশনের মাধ্যমে কমিউনিস্টবিরােধী জোটে আবদ্ধ। অন্যদিকে জোটনিরপেক্ষ ভারত সহজেই পাকিস্তানকে সামরিক জোটের অন্তর্ভুক্ত বলে দাবি করার সুযােগ পেয়েছিল।
১৯৬৫ সালের সেপ্টেম্বরে পাক-ভারত যুদ্ধ সংঘটিত হওয়ার সময়ে ভারতের এয়ার পাওয়ার ছিল পাকিস্তানের প্রায় পাঁচগুণ।৩ ভারতের হাতে ছিল পর্যাপ্ত সংখ্যক ব্রিটিশ নির্মিত হান্টার ও ক্যানবেরা, ভারতের স্বয়ং নির্মিত ন্যাট ও রাশিয়ার মিগ ২১। অন্যদিকে পাকিস্তানের ছিল ১২ স্কোয়াড্রন পুরনাে আমলের স্টার ফাইটার,
পৃষ্ঠা: ৪৯
৬ স্কোয়াড্রন সাবেক আমলের জেট এবং দুই স্কোয়াড্রন ২৪ মার্টিন বি-৫৭ বােমারু বিমান। যুদ্ধে ক্ষয়ক্ষতির দিক দিয়েও পাকিস্তানের সামগ্রিক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে ভারতের তুলনায় অনেক বেশি। যুদ্ধে ভারত ৫০৪ বর্গকিলােমিটার এলাকা ও পাকিস্তান ১৮০০ বর্গকিলােমিটার জায়গা হারায় বলে দাবি করা হয়।৪
পাক-মার্কিন সামরিক সম্পর্ক বিশ্বের অন্যতম জটিল সম্পর্কের একটি। মার্কিন উদ্দেশ্য সাধনের জন্য পাকিস্তানকে যুগে যুগে ব্যবহার করা হয়েছে এবং প্রয়ােজনবােধে এই সম্পর্কের লাগাম টেনে পাকিস্তানে মার্কিন সামরিক সবরাহ বন্ধ বা সীমিত করা হয়েছে। মার্কিন-ভারত সম্পর্কের বেলায়ও একই কথা প্রযােজ্য। ভারত-সােভিয়েত প্রভাবের সঙ্গে ভারসাম্য রাখতে গিয়ে আমেরিকা ভারতকে উদার হস্তে সাহায্য করেছে, যার পরিমাণ ক্ষেত্রবিশেষে হয়েছে পাকিস্তানকে দেয়া সামরিক সাহায্যের অনেক বেশি। অন্যদিকে উপমহাদেশে কমিউনিস্ট চীনের প্রভাব রুখতে গিয়েও আমেরিকা ভারতে প্রচুর অস্ত্রের চালান দিয়েছে।
স্নায়ুযুদ্ধ শুরু হওয়ার পরপর আমেরিকা ইসলামাবাদের সাহায্য প্রত্যাশা করেছে এবং সেজন্য তারা পাকিস্তানের দ্বিচারিতাকে উপেক্ষা করতেও দ্বিধাবােধ। করেনি।৫ ৫০ দশকের শেষ ভাগে এবং ৬০ এর প্রথমার্ধে আমেরিকা সােভিয়েত রাশিয়ার ওপর ইউ-২ গােয়েন্দা বিমান পরিচালনার জন্য পাকিস্তানে সামরিক ঘাঁটি নির্মাণ করেছে এবং সে সময়ে তারা পাকিস্তানের একনায়কতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থার সঙ্গে সমঝােতা করতে সংকোচ বােধ করেনি। ‘৬০ থেকে ৬৫ সালে আমেরিকা একই সঙ্গে ভারতে ও পাকিস্তানে সামরিক সরঞ্জামের চালান দিয়ে গেছে। আবার ‘৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের সময় কোনাে পক্ষ অবলম্বন না করে যুদ্ধের পরে উভয় দেশেই সামরিক সরবরাহ বন্ধ অথবা সীমিত করে দিয়েছে। ‘৬০ এর দশকের শেষের দিকে আমেরিকা চীনের সঙ্গে গােপন যােগাযােগের জন্য পাকিস্তানের কৌশলগত সহায়তা নিয়েছে, অথচ সে সময় তারা পাকিস্তানে মানবাধিকার লংঘনের বিষয়টি উপেক্ষা করে গেছে।
১৯৬৯ সালের ২ জুলাই রাওয়ালপিন্ডিস্থ মার্কিন দূতাবাস থেকে ডিপার্টমেন্ট অব স্টেট এ মার্কিন মিলিটারি সাপ্লাই পলিসির ওপর একটি গােপন প্রতিবেদন। টেলিগ্রাম আকারে পাঠানাে হয়।৬ প্রতিবেদনের সারসংক্ষেপে বলা হয় যে,
আমেরিকার বিদ্যমান স্বার্থেই ১৯৬৭ সালের এপ্রিলে সরবরাহ সংক্রান্ত সামরিক নির্দেশে কিছুটা নমনীয়তা নিয়ে আসা প্রয়ােজন। প্রতিবেদনে পাকিস্তান ও ভারত উভয়ের কাছে সীমিত পরিমাণে হলেও মারণাস্ত্র বিক্রির সুপারিশ করা হয়। এতে বলা হয় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের অবনতি ঘটলেও যুক্তরাষ্ট্রকে এ ঝুঁকি নিতে হবে, কারণ তা না করলে পাকিস্তান তার সামরিক সরঞ্জামের উৎস খুঁজতে গিয়ে কমিউনিস্ট চীনের দিকে ঝুঁকে পড়বে। এ কারণে অনতিবিলম্বে ১৯৬৭ সালের এপ্রিলের নীতিগত কঠোরতা শিথিল করার জন্য
পৃষ্ঠা: ৫০
পরামর্শ দেয়া হয়। এতে বলা হয় যে, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া লাহােরে আগস্ট মাসে প্রেসিডেন্ট নিক্সনের সঙ্গে বৈঠকে বসার সময় এ বিষয়ে একটা সুসংবাদ পাবেন বলে আশা করা হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে যাতে কোনাে ভুল বােঝাবুঝি না হয় সেজন্য ১৯৬৭ সালের নীতিমালার কোন অংশটি নমনীয় করার কথা বলা হচ্ছে, সে সম্পর্কে আগেই কিছুটা আলােকপাত করে নেয়া প্রয়ােজন। নমনীয়তা বলতে বিপুল আকারে সমরাস্ত্র প্রত্যক্ষভাবে বিক্রির কথা বলা হচ্ছে না। এখানে কেবলমাত্র নীতির থার্ড পার্টির মাধ্যমে বিক্রির কথাটি নমনীয় করে সরাসরি বিক্রির ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এ যাবৎ এ ধরনের রুট থাকাতে ভারত ৬টি দেশ থেকে অস্ত্র সংগ্রহ করতে পারছে অথচ পাকিস্তান একটি দেশ থেকেও তা পারছে না।
সরাসরি বিক্রির ব্যবস্থা করা হলে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলােতে বর্তমান সােভিয়েত ও কমিউনিস্ট চীনের প্রভাবের স্থলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব উল্লেখযােগ্য পরিমাণে বাড়ানাে সম্ভব হবে। এতে করে যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসের দোটানা মনােভাব এবং ভারতের মনস্তাত্ত্বিক মনােভাব এড়ানােও সম্ভব হবে।
উপরন্তু নীতির নমনীয়তার ফলে বেসরকারি সহযােগিতার আড়ালে প্রচুর সংখ্যক সামরিক সংক্রান্ত উৎপাদন কারখানা উভয় দেশে পরিস্থাপন করা যাবে। এর ফলে ভারত লাভবান হবে পাকিস্তানের তুলনায় অনেক বেশি। এ ছাড়া একই সঙ্গে উভয় দেশে অনুদানের মাধ্যমে সামরিক প্রশিক্ষণের কর্মসূচিও বহুলাংশে বাড়ানাে যেতে পারে।
তুরস্কের সঙ্গে করা বর্তমান ১০০ ট্যাংক চালানের পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলেও প্রত্যক্ষ বিক্রির মাধ্যমে আরাে ১০০টি পুরনাে হয়ে যাওয়া এম-৪৭ ট্যাংক বিক্রি করা যাবে যা প্রেসিডেন্ট জনসন এবং আইউব খান ১৯৬৭ সালের ২৩ ডিসেম্বর আলােচনা করেছিলেন। এই ট্যাংক বিক্রির সময় অবশ্যই শর্ত রাখতে হবে যে, পাকিস্তানকে আরাে পুরনাে হয়ে যাওয়া সমসংখ্যক ট্যাংক পরিত্যক্ত ঘােষণা করতে হবে এবং একই ধরনের কোনাে যুদ্ধাস্ত্র অন্য কোনাে উৎস থেকে সংগ্রহ করা যাবে না। এর পরে কেস বাই কেস ভিত্তিতে বিক্রয় পরিধি বাড়ানাের ব্যবস্থা করা যেতে পারে এবং তা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিবেচনায়ও চাপ সৃষ্টির জন্য ব্যবহার করা যাবে। যেভাবেই হােক, এ মূহূর্তে ৬টি এফ-১০৪ এম জঙ্গি বিমান বর্তমান নীতির অধীনেই বিক্রি করা যায় এবং তা এক্সিডেন্ট লসের রিপ্লেসমেন্ট হিসেবে দেখানাে যায়।
বিদ্যমান পাকিস্তান ও ভারতের রাজনৈতিক অচলাবস্থার সূত্র ধরে বলা যায় যে এ মূহূর্তে এবং অদূর ভবিষ্যতে এ অঞ্চলে বিভিন্ন কাজে পাকিস্তানকে ব্যবহার করা যাবে। ইরান, জর্দান, সৌদি আরব, তুরস্কের মতাে নমনীয় মুসলিম দেশগুলাের ভূমিকায় শক্তিশালী অবদান রাখতে সক্ষম।
পৃষ্ঠা: ৫১
পাকিস্তান সরকারের অবস্থা এখন এমন দাঁড়িয়েছে যে, এখন তারা আর পশ্চিম ইউরােপ থেকে চড়া বাণিজ্যিক মূল্যেও অস্ত্র সংগ্রহ করতেও সক্ষম নয়। যুক্তরাষ্ট্রই হলাে একমাত্র ননকমিউনিস্ট উৎস। আইউববিরােধী সামরিক শাসনের সুবাদে ইয়াহিয়ার সরকার সামাজিক খাতে ব্যয়বরাদ্দ বহুল পরিমাণে বাড়াতে বাধ্য, বিশেষ করে পূর্ব পাকিস্তানে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্রভাণ্ডার পুরনাে হয়ে যাওয়ায় দিনে দিনে কার্যকারিতা হারাচ্ছে। সেহেতু পাকিস্তান সরকার যে কোনাে উৎস থেকে অস্ত্র সংগ্রহ করে সামরিক মানােন্নয়নের প্রচেষ্টা চালাতে পারে যা তার সামরিক ব্যয়কে বহুগুণ বাড়িয়ে তুলবে।
রাশিয়া পাকিস্তানকে অস্ত্র দিলে ভারতের যেমন গাত্রদাহ হয়, চীনের সেরকম অনুভূতি নেই। পক্ষান্তরে, সােভিয়েতরা ভারতকে নারাজি করেই পাকিস্তানে অস্ত্র পাঠাবার বিষয়টি বিবেচনা করতে পারে। আমেরিকা তার শর্ত নমনীয় না করলে এক্ষণে পাকিস্তানের কমিউনিস্টদের দিকে না ঝোঁকার কোনাে কারণ নেই।
এ পর্যায়ে যুক্তরাষ্ট্রের ১৯৬৭ সালের অনমনীয় দক্ষিণ এশিয়ায় সামরিক সরবরাহ নীতি নমনীয় করার জন্য জোর সুপারিশ করা হচ্ছে। এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করা হলে প্রেসিডেন্ট লাহােরে আগস্ট মাসে ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে বৈঠকের সময় ইয়াহিয়ার কাছ থেকে এই মর্মে নিশ্চয়তা আদায় করতে সক্ষম। হন যে, ভারত বা কাশ্মীর অনুরূপ কোনাে ইস্যুতে এই অস্ত্র ব্যবহার করা হবে না। এ প্রসঙ্গে প্রেসিডেন্ট পাকিস্তানে আমাদের বিরাটাকারের অর্থনৈতিক সহযােগিতার কথা উল্লেখ করে বলতে পারেন যে, এর মাধ্যমে পাক ভারতের সম্পর্ক দিনে দিনে উন্নতির পথে এগিয়ে যাবে এবং পাকিস্তানে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা, নির্ভরযােগ্য রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান ও বৃহত্তর রাজনৈতিক অংশগ্রহণ নিশ্চিত হবে।
১ আগস্ট প্রেসিডেন্ট নিক্সন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সঙ্গে লাহােরে প্রকাশ্য আলােচনায় মিলিত হন। নিক্সনের উপদেষ্টামণ্ডলীর মধ্যে বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন প্রেসিডেন্টের সহকারী হেনরি কিসিঞ্জার, জোসেফ এ সিসকো, অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি অব স্টেট মরিস উইলিয়ামস, এ আই ডি’র এসিসটেন্ট এডমিনিস্ট্রেটর ও ডেপুটি চিফ অব মিশন জর্ডান রজার্সসহ অন্যান্যরা। অন্যদিকে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার পক্ষে ছিলেন পররাষ্ট্র সচিব এস এম ইউসুফ, এস জি এম এম পীরজাদা, প্রিন্সিপাল মিলিটারি স্টাফ অফিসার টু দি প্রেসিডেন্ট, তথ্য সচিব এম এম আহমেদ, আমেরিকায় পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত আগা হিলালীসহ আরাে কয়েকজন। প্রথমে অনুষ্ঠিত উপদেষ্টামণ্ডলীর বৈঠকে সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে আলােচনা করা হয় ও পরে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ও প্রেসিডেন্ট নিক্সন বৈঠকে যােগ দেন।৭
বৈঠকে কিসিঞ্জার বলেন প্রচার মাধ্যমে নতুন একটি এশিয়ান পলিসির কথা বলা হচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে শুধু এ ইঙ্গিতটি দেয়া হয়েছে যে
পৃষ্ঠা: ৫২
আঞ্চলিক নিরাপত্তার ব্যাপারে আমেরিকা বিশেষভাবে উৎসাহী। আমেরিকা এশিয়া থেকে সরে যেতে চায় না, তবে এখানে থাকতে হলে এশিয়ার সঙ্গে নানা ধরনের সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। প্রেসিডেন্ট বলেছেন যে আমেরিকা তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করবে, তবে নয়া নীতিমালাকে যেন ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করা না হয়।
তিনি অভ্যন্তরীণ সমস্যাগুলােকে উন্নয়ন কর্মসূচি দিয়ে মােকাবিলা করার প্রস্তাব দিয়ে বলেন যে, এ কাজে আমেরিকার জনশক্তি ব্যবহার না করাই উত্তম।
ইউসুফ জিজ্ঞেস করেন, আমেরিকা চাইছে এশিয়ানরাই সবরকম উদ্যোগ গ্রহণ করুক। ঠিক কী ধরনের উদ্যোগ আমেরিকা আশা করছে? যুক্তরাষ্ট্র কি কোনাে সমন্বিত নিরাপত্তা ব্যবস্থায় সংগঠনকারীর ভূমিকা পালনে করবে? কিসিঞ্জার সে সম্ভাবনা সরাসরি নাকচ করে দেন।
এ পর্যায়ে ইউসুফ উপমহাদেশে চীনা আগ্রাসন সম্পর্কে আমেরিকার দৃষ্টিভঙ্গি কী জানতে চাইলে কিসিঞ্জার বলেন যে, এ ব্যাপারে পাকিস্তানের দৃষ্টিভঙ্গি কী সেটা আগে জানা দরকার, কারণ পাকিস্তান চীনের সঙ্গে বেশি ঘনিষ্ঠ।
চীনের অবস্থানকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উল্লেখ করে ইউসুফ বলেন, এশিয়ায় একটি সমন্বিত নিরাপত্তা ব্যবস্থা চীনের উদ্বেগের কারণ হতে পারে। চীন পাকিস্তানের অত্যন্ত সৎ প্রতিবেশী। এখন পর্যন্ত চীন পাকিস্তানে কোনাে আগ্রাসন চালায়নি এবং চীনের সঙ্গে সহাবস্থান খুবই সম্ভব। চীন পাকিস্তানকে অবিচ্ছিন্ন দেখতে চায়। ভারতের বিপরীতে পাকিস্তানে চীনের প্রবল স্বার্থ রয়েছে। চীন পাকিস্তানে পর্যাপ্ত সামরিক ও বেসামরিক সহযােগিতা দিচ্ছে এবং কখনােই বলেনি যে কেবলমাত্র চীন থেকে সাহায্য নিতে হবে।
পাকিস্তান যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে অবিরাম ঋণ ও সাহায্য প্রবাহ প্রত্যাশা করে উল্লেখ করে তিনি বলেন যে, সে এলাকায় কমিউনিজমকে রুখতে হলে সাহায্য বাড়াতে হবে। সাম্প্রতিক কনসাের্টিয়াম বৈঠকে আমেরিকার সুযােগ্য ভূমিকার প্রশংসা করে তিনি আশা করেন যে কংগ্রেস সাহায্য বিলটি সহজে অনুমােদন করবে।
তিনি বলেন, ১৯৬৫ এর পরে অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ হওয়ায় পাকিস্তান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ভারতের ফ্যাক্টরিগুলােতে নিজেদের অস্ত্র তৈরি হচ্ছে। পাকিস্তান কোনাে ব্যাপক আগ্রাসন চায় না, ন্যূনতম প্রতিরক্ষাই যথেষ্ট।
এ পর্যায়ে আমেরিকা ও পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট বৈঠকে যােগ দেন। নিক্সন বলেন যে, ১৯৫৩ সালের পরে বিশেষ করে সিয়াটো ও সেন্টোর পটভূমিকায় পরিস্থিতিতে পরিবর্তন ঘটেছে। যুক্তরাষ্ট্র তার আগের প্রতিশ্রুতিতে অটল, কিন্তু হুমকি আসছে ভিন্ন প্রেক্ষাপট থেকে। যুক্তরাষ্ট্র জানে যে, এ শতাব্দীর শেষ নাগাদ এশিয়া হবে উন্নতি কিংবা আত্মবিধ্বংসীতার চরমতম অবস্থানে। সে অনুযায়ীই সকলকে পদক্ষেপ নিতে হবে।
পৃষ্ঠা: ৫৩
১৯৬৯ সালের ২২ নভেম্বর ন্যাশনাল সিকিরিটি কাউন্সিল রিভিউ গ্রুপ আমেরিকার দক্ষিণ এশিয়া সামরিক সরবরাহ নীতিমালার ওপর বিশ্লেষণধর্মী একটি প্রতিবেদন কাউন্সিলের কাছে পেশ করে।৮ প্রতিবেদনে বলা হয় যে,
১৯৬৭ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ এশিয়ায় যে অস্ত্র সরবরাহ নীতি পরিচালনা করেছে তাতে সন্তোষজনক ফলাফল আসেনি।
১৯৬৫ সালের সেপ্টেম্বরে ভারত ও পাকিস্তান এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে ও আমেরিকান অস্ত্র একে অপরের বিরুদ্ধে ব্যবহার করে। আংশিকভাবে কংগ্রেসের বিরূপ সমালােচনার মুখােমুখি হওয়ায় যুদ্ধের সময়ই দু’দেশে আমেরিকার সামরিক সরবরাহ বন্ধ করে দেয়া হয়। ১৯৬১ সালের ফেব্রুয়ারিতে মারণাস্ত্র নয় এমন হালকা অস্ত্র ক্রয়ের ওপর নিষেধাজ্ঞা কিছুটা শিথিল করা হয়।
ফরেন অ্যাসিস্ট্যান্ট অ্যাক্টের কন্টি লং এমেন্ডমেন্ট অনুসারে৯ এবং সিমিংটন এমেন্ডমেন্ট১০ অনুসারে অনুন্নত দেশে আধুনিক অস্ত্র সরবরাহ নিষিদ্ধ করার কথা বলা হয়েছে এবং শেষােক্তটিতে যেসব উন্নয়নশীল দেশে সামরিক ব্যয় বেশি সেখানে অস্ত্র বিক্রির নিষেধাজ্ঞার সুপারিশ করা হয়েছে। অন্যদিকে যে কোনাে সামরিক বিক্রয়ের বিলের ওপর কংগ্রেসে কোনাে না কোনাে ধরনের আপত্তি উত্থাপিত হয়।
১৯৬৭ সালের এপ্রিলে জনসন প্রশাসন আবার দক্ষিণ এশীয় নীতি সংশােধন করে ভারত ও পাকিস্তানে মারণাস্ত্র সরবরাহের ওপর নিষেধাজ্ঞা বহাল রাখে। এতে আগে কেনা অস্ত্রের পার্টস নগদ টাকায় কেনার ওপর অনুমতি দেয়া হয় এবং কেস বাই কেস ভিত্তিতে তৃতীয় দেশ থেকে আমেরিকার সরবরাহ করা অস্ত্র কেনার অনুমতি দেয়া হয়। একই সঙ্গে আমেরিকায় ক্ষুদ্রাকারে সামরিক প্রশিক্ষণ আবার চালু করা হয় এবং উভয় দেশে সামরিক সাহায্য বন্ধ করে সেখান থেকে মার্কিন সামরিক মিশন প্রত্যাহার করা হয়।
পলিসির সাফল্য ব্যাখ্যা করে বলা হয় যে,
এর ফলে পাকিস্তান আমেরিকার সরবরাহ করা অস্ত্র যতটা সম্ভব সচল রাখার চেষ্টা করেছে এবং সরবরাহের নতুন উৎস অনুসন্ধান একেবারে বন্ধ না করলেও কমাতে পেরেছে। অন্যদিকে ব্যর্থ হয়েছে এ কারণে যে, তৃতীয় পক্ষ থেকে মার্কিন অস্ত্র সংগ্রহের নীতি খুব একটা সন্তোষজনক ফল দেয়নি এবং পক্ষান্তরে জার্মানি, ইতালি, তুরস্ক ও ইরানকে ব্ৰিত করা হয়েছে। তুরস্ক থেকে পাকিস্তানে ১০০ ট্যাংক পাঠাবার কর্মসূচি বাস্তবায়িত হলে সেটাই হবে এ ধরনের লেনদেনের প্রথম উদাহরণ।
এমন সম্ভাবনাও রয়েছে যে এর ফলে দেশগুলাে এখন অন্য উৎস থেকে আরাে আধুনিক অস্ত্র সংগ্রহের চেষ্টা করবে। উদাহরণস্বরূপ, পাকিস্তানের এফ-
পৃষ্ঠা: ৫৪
১০৪ প্রায় বাতিল হবার পথে এবং সম্ভবত চীনের তৈরি বিমান ফ্রান্স থেকে কিনে সেই স্থান পূর্ণ করা হবে। ইতােমধ্যেই এই নীতি সােভিয়েত থেকে ভারত ও পাকিস্তানকে এবং চীন থেকে পাকিস্তানকে মারণাস্ত্র ক্রয়ে উৎসাহিত করেছে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, দক্ষিণ এশীয় সামরিক সরবরাহ নীতির বিদ্যমান পরিস্থিতি হলাে এই যে ১৯৬৯ সালের ফরেন এইড অ্যাসিস্ট্যান্ট অ্যাক্ট এখনাে কংগ্রেসের সামনে। এতে বলা হয় যে,
হাউজ অথরাইজেশন বিল পাস করেছে, এখন হাউজ ও সিনেট উভয় কক্ষে এপ্রােপ্রিয়েশন বিল পাস করাতে হবে। বিদ্যমান নিষেধাজ্ঞা শিথিল করা যাবে কি না তা নিয়ে একেবারে নিশ্চিত হওয়া যায় না, তবে কতগুলাে শুভ ইঙ্গিত রয়েছে। কন্টি লং এবং সিমিংটন এমেন্ডমেন্ট এখন অনেকটা নমনীয়।১১
আরেকটি বড় সমস্যার উদ্ভব ঘটে এ কারণে যে আইনের একটি বিধান অনুসারে কোনাে দেশের সরকার মৌলিক গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের বিরােধিতা করলে এবং মৌলিক স্বাধীনতা হরণ করলে সেসব দেশে আমেরিকান সাহায্য দেয়া উচিত হবে না। এতে আরাে বলা হয়েছিল যে, কোনাে দেশের সরকার অসাংবিধানিকভাবে ক্ষমতায় এলে সে দেশে মার্কিন সাহায্য স্থগিত রাখা হবে। যদি আগের ঘটনা থেকে কার্যকর হিসেবে এই আইন প্রযােজ্য হয়, তা হলে। তা পাকিস্তানকে সামরিক সাহায্য পাওয়ার ব্যাপারে অযােগ্য করে তুলতে পারে।
গ্রুপ রিপাের্টে নীতির সমালােচনা করে বলা হয় যে,
এ নীতির ফলে পাকিস্তান ও ভারত উভয়েই অস্ত্র সংগ্রহের জন্য কমিউনিস্ট দেশগুলাের দ্বারস্থ হয়েছে। ভারত বিদ্যমান নীতিতে সন্তুষ্ট এবং তারা আরাে কড়াকড়ি হলেও নারাজি নয়। কারণ, তারা রাইফেল বা গােলাবারুদের মতাে মাঝারি ধরনের মারণাস্ত্রের জন্য কখনাে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীল ছিল না। রাশিয়া থেকে তাদের পর্যাপ্ত পরিমাণে সরবরাহ আসছে। বরং পলিসি শিথিল করা হলে তারা ধরে নিতে পারে যে পাকিস্তানকে ফেভার করার কারণেই এ শিথিলতা আনা হয়েছে।
পাকিস্তান যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে অস্ত্র কেনার আগ্রহ প্রকাশ করেছে, অনুদান হিসেবে অস্ত্র সাহায্যের কথা বলেনি। চীন ও রাশিয়া থেকে এবং ক্ষেত্র বিশেষে তৃতীয় পক্ষ থেকে কিছু অস্ত্র সংগ্রহ করলেও পাকিস্তানিরা মার্কিন অস্ত্রের ওপর বেশি আগ্রহী এবং তারা ভারতের চাইতে অনেক বেশি পরিমাণে অস্ত্র কিনবে। তা ছাড়া পাকিস্তান কমিউনিস্ট উৎসের ওপর নির্ভরতা কমাতেও আগ্রহী।
২৫ নভেম্বর ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের রিভিউ গ্রুপ এক জরুরি বৈঠকে বসে। বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন কাউন্সিলের চেয়ারম্যান হেনরি কিসিঞ্জার। বৈঠকে
পৃষ্ঠা: ৫৫
যেসব বিষয় নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ করা হয় সেগুলাে হলাে : উপমহাদেশে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান, যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র পাকিস্তানে বিক্রির সম্ভাবনা, পাকিস্তানকে তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে অস্ত্র সরবরাহের সম্ভাবনা এবং আইটেম বাই আইটেম ভিত্তিতে পাকিস্তানের নষ্ট হয়ে যাওয়া কিছু পরিমাণে মারণাস্ত্র পুড়িয়ে দেয়ার সম্ভাবনা।১২
কিসিঞ্জার বৈঠকে বলেন যে,
পাকিস্তানিদের সঙ্গে সফরে প্রেসিডেন্ট নিক্সন জোর কোনাে প্রতিশ্রুতি দেননি, তবে পাকিস্তানিরা একরকম ধরে নিয়েছে যে, যুক্তরাষ্ট্র তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল ও অচিরেই তারা যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে অস্ত্র সাহায্য পাবে। যাই হােক, পাকিস্তানিদের সেপ্টেম্বরের মধ্যে জানানাে হবে ইঙ্গিত দেয়া হয়েছিল।
বৈঠকের আলােচনায় উঠে আসে যে,
এ মুহূর্তে পাকিস্তান ও ভারতের ওপর থেকে প্রত্যক্ষভাবে অস্ত্র বিক্রির নিষেধাজ্ঞা। উঠিয়ে দিলে তাদের কাছে সরাসরি অস্ত্র সরবরাহ করা যাবে। তবে কংগ্রেস বিষয়টিতে সংবেদনশীল বলে এই বিক্রি শর্তসাপেক্ষ হওয়া উচিত। আলােচনাকালে বলা হয় যে, ভারত ও পাকিস্তানে সরাসরি অস্ত্র বিক্রির একটি অসুবিধা হলাে এই যে, তারা এতে অসুবিধায় পড়বে। কারণ, পাকিস্তানের হাতে এখন অত পরিমাণে টাকা নেই। এক পর্যায়ে অনুদান হিসেবে পাকিস্তানকে এবং নগদ অর্থের বিনিময়ে ভারতে অস্ত্র সরবরাহের প্রস্তাব উঠলে। বিকল্প হিসেবে পাকিস্তানকে ঋণ হিসেবে এবং ভারতকে নগদ অর্থে অস্ত্র দেয়ার পক্ষে অভিমত রাখা হয়।
কিসিঞ্জার বলেন যে,
এখন পর্যন্ত ভারত যুক্তরাষ্ট্রকে পলিসি শিথিল করার জন্য চাপ দেয়নি। কিন্তু বৈঠকে মত দেয়া হয় যে, পাকিস্তান ও ভারতকে এ ক্ষেত্রে সমান সুযােগ দেয়া। উচিত—তা না হলে ভারত কমিউনিস্ট উৎস থেকে বেশি পরিমাণে অস্ত্র সংগ্রহ করবে।
বৈঠকে অভিমত প্রকাশ করা হয় যে, চুক্তি নমনীয় করা হলে প্রথম দিকে পাকিস্তানে অস্ত্র সরবরাহের পথ উন্মুক্ত হওয়ায় ভারতে এর তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেবে। তবে সময়ান্তরে তা ঠাণ্ডা হয়ে আসবে, কারণ ভারত নিজেই যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে অস্ত্র সংগ্রহে আগ্রহী হবে।
থার্ড পার্টির মাধ্যমে বিক্রির বিদ্যমান পরিস্থিতির বিষয়ে আলােচনায় উঠে আসে যে, তুরস্ক যদি পাকিস্তানকে ১০০টি এম-৪৭ এম ট্যাংক দেয় তা হলে এক সময়ে তুরস্ককে ১০০টি এম-৪৮-এস ট্যাংক বিক্রি করা যাবে। যুক্তরাষ্ট্রের এ হেন সামরিক লেনদেনে পাকিস্তান এবং তুরস্ক উভয়েই সম্মত রয়েছে এবং তা বাস্তবায়িত হলে পাকিস্তানের পক্ষে অস্ত্র জোগাড় করা কঠিন হয়ে পড়বে।১৩
পৃষ্ঠা: ৫৬
বৈঠকের চারদিন পর ২৯ নভেম্বর হেনরি কিসিঞ্জার প্রেসিডেন্ট নিক্সনের কাছে জরুরি একটি নােট পাঠান। এতে তুরস্ক ও পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পাদিত থার্ড পার্টি লেনদেন অনতিবিলম্বে সমাধান করার জোর সুপারিশ করা হয়। এতে বলা হয় যে,
তুরস্কের নয়া সরকার অপ্রত্যাশিতভাবে জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্র যদি তাদের এম৪৭-এস ট্যাংক সরবরাহ করে তা হলে তারা পাকিস্তানকে ১০০টি এম-৪৭ ট্যাংক দিতে সম্পূর্ণ প্রস্তুত। বিষয়টি এক বছর যাবৎ ঝুলে আছে এবং এখন দক্ষিণ এশীয় অস্ত্র সরবরাহ নীতির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। তুরস্কের এই প্রস্তাব যুক্তরাষ্ট্রের আইনগত বিষয়ের সঙ্গেও সঙ্গতিপূর্ণ এবং তিন থেকে ৬ মাসের মধ্যে এটি বাস্তবায়ন করা সম্ভব।
কিসিঞ্জার বলেন,
তুরস্কের জন্য বরাদ্দ করা অন্যান্য সামরিক সহায়তার আওতায় তাদের কাঙ্ক্ষিত ট্যাংক সরবরাহ করতে হবে এবং এর আর্থিক মূল্যমান প্রায় ৩৭ লক্ষ ডলার, যা চুক্তির সময়ের তুলনায় প্রায় ১০ লক্ষ ডলার বেশি। তুরস্ককে ইতােমধ্যেই জানিয়ে দেয়া হয়েছে যে, তুরস্কের জন্য বরাদ্দকৃত মিলিটারি এইডের আওতার বাইরে এর লেনদেন করতে হবে।
এখন শুধু দেখতে হবে, পাকিস্তান এখনাে এই লেনদেন করতে চায় কি না। প্রায় একবছর ধরে তাদের কোনাে বক্তব্য এ বিষয়ে পাওয়া যায়নি। সন্দেহ রয়েছে যে, তারা বােধ হয় ১০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠেয় যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ এশীয় অস্ত্র সরবরাহ নীতির ওপর পর্যালােচনা বৈঠকের ফলাফলের অপেক্ষা করছে।১৪
দক্ষিণ এশিয়ায় আমেরিকা তার সামরিক সরবরাহ নীতি সরলীকরণ করতে এর পরেও তার দ্বিধাদ্বন্দ্ব অব্যাহত রাখে। এর প্রধান কারণ ছিল আমেরিকার প্রশাসনের অভ্যন্তরে সিদ্ধান্তহীনতা। বারংবার আমেরিকার উচ্চমহল থেকে নীতি সরলীকরণের কথা বলা হলেও কোনাে না কোনাে পর্যায়ে গিয়ে সেই সিদ্ধান্ত হোঁচট খেয়েছে। ফলে ১৯৬৭ সালে প্রেসিডেন্ট জনসন আইউব খানের কাছে সামরিক সহযােগিতার সুস্পষ্ট প্রতিশ্রুতি দিলেও তার আমলে যেমন তা কার্যকর হয়নি, তার পরবর্তী নিক্সনের আমলেও প্রাথমিকভাবে তা বাধার সম্মুখীন হয়েছে।
আমেরিকার সুস্পষ্ট ধারণা ছিল যে, পাকিস্তানে সামরিক সহযােগিতা না দিলে একদিকে তারা উপমহাদেশে প্রভাব বিস্তারের একটি মােক্ষম সুযােগ হারাবে, অন্যদিকে পাকিস্তানকে কমিউনিস্ট কোনাে রাষ্ট্র বা পশ্চিম ইউরােপের অন্য কোনাে ক্রেতার দিকে ঠেলে দেয়া হবে। আবার এই ভয়ও ছিল যে, দক্ষিণ এশীয় সামরিক সরবরাহ নীতি নমনীয় করলে সাময়িকভাবে হলেও আমেরিকাকে ভারতের বিরাগভাজন হতে হবে এবং আমেরিকার অভ্যন্তরে বিশেষ একটি মহল কিছুতেই সেই ঝুঁকি নিতে চাইছিলেন না।
পৃষ্ঠা: ৫৭
হেনরি কিসিঞ্জার প্রেসিডেন্ট নিক্সনের কাছে নীতি সরলীকরণ ও পাকিস্তানের কাছে তুরস্কের ট্যাংক বিক্রির জোর সুপারিশ করলেও সেক্রেটারি রজার্স এই লেনদেনের কার্যকর ফলাফলের ওপর সন্দিহান ছিলেন। এ ব্যাপারে সেক্রেটারি রজার্স বেশ কয়েক দফা চিঠি চালাচালি করেন ও শেষ পর্যন্ত রিভিউ কমিটির বৈঠকে নীতিমালার সরলীকরণের ওপর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত এই লেনদেন স্থগিত রাখতে সমর্থ হন।
১৯৬৯ সালের ২১ ডিসেম্বর হেনরি কিসিঞ্জার তার ভাষা কিঞ্চিত সংশােধন করে হােয়াইট হাউজে পাঠানাে এক মেমােতে বলেন যে,
তুরস্কের ট্যাংক বিক্রির ব্যাপারে চূড়ান্ত নির্দেশ দেয়ার আগে সেক্রেটারি রজার্সের পরামর্শ মতাে এই লেনদেন আগে না করার সুপারিশ করা হচ্ছে এবং জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের পরবর্তী বৈঠকে এ নিয়ে আলােচনার পর সিদ্ধান্ত নেয়া বাঞ্ছনীয়।১৫
এর কারণ হিসেবে বলা হয় :
(১) এর ফলে পাকিস্তানের কাছ থেকে প্রাপ্তি হবে যৎসামান্য, কারণ তাতে যুক্তরাষ্ট্রকে ভারতের বিরাগভাজন হতে হবে। ভারতীয়রা ধরে নেবে যে, এটি হলাে একটি পাকিস্তানপন্থী সিদ্ধান্ত। তা ছাড়া এতে ভারতের হ্যানয়কে স্বীকৃতি দানের প্রশ্নটিতেও নতুন সমস্যার উদ্ভব ঘটতে পারে। (২) সিনেটে এ নিয়ে তুমুল সমালােচনা হবে… বিশেষ করে তারা এক্ষণে জর্দানে পাকিস্তানের ৪০ মিমি কামান ও ৬০০ জন সৈন্যসহ বিমানবিধ্বংসী কামান পাঠানাের পরিকল্পনার কথা তুলবে; (৩) ট্যাংক বিক্রির জন্য জনসন যে সময় আইউব খানকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন বর্তমানে আমেরিকার সঙ্গে পাকিস্তানের সেই সম্পর্ক পরিবর্তিত হয়েছে। কারণ, পাকিস্তানে এখন আর আমেরিকার গােয়েন্দা সংস্থাপন নেই। অন্যদিকে, ইতােমধ্যেই পাকিস্তান সােভিয়েতের কাছ থেকে ২০০ ট্যাংক পাবার প্রতিশ্রুতি পেয়েছে যা ১৯৭০ সালের শেষের দিকে পাকিস্তানে পৌঁছাবে। যাই হােক, ১৯ জানুয়ারি ১৯৭০ প্রেসিডেন্ট নিক্সনের কাছে লেখা এক চিঠিতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান দক্ষিণ এশীয় মার্কিন সামরিক নীতি স্থিরীকরণে বিলম্ব হওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন যে, গত এক দশক ধরে পাকিস্তান মার্কিন সামরিক সাহায্যের ওপর নির্ভর করছে এবং চার বছরেরও বেশি সময় আগে যে নিষেধাজ্ঞা আরােপ করা হয়েছে তাতে পাকিস্তানের সংকটের মুখােমুখী হয়েছে। তিনি বলেন যে, ভারতের সঙ্গে অস্ত্র প্রতিযােগিতায় পাকিস্তানের কোনাে খায়েশ নেই কিন্তু পাকিস্তানের যদি ন্যূনতম প্রতিহতকরণ ক্ষমতাও না থাকে তা হলে উপমহাদেশের শান্তি বিঘ্নিত হতে বাধ্য।১৬
এখানে বলা নিষ্প্রয়ােজন যে আমেরিকার প্রশাসনের অভ্যন্তরে গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ ছিল দক্ষিণ এশীয় সামরিক সরবরাহের ওপর দেয়া নিষেধাজ্ঞা
পৃষ্ঠা: ৫৮
প্রত্যাহারে অনিচ্ছুক এবং তাদের কাছে পাকিস্তানের অসুবিধার তুলনায় ভারতের অস্বস্তিই ছিল বড় উদ্বেগের কারণ। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে দক্ষিণ এশিয়ার ওপর আমেরিকার সামরিক স্বার্থ ছিল যৎসামান্যই। হ্যানয়কে স্বীকৃতি দানের ব্যাপারে ভারতের উদ্যোগ এবং পাকিস্তানের সঙ্গে মার্কিন সম্পর্কের খানিকটা অবনতি সত্ত্বেও মােটামুটিভাবে দুই দেশের সঙ্গে আমেরিকার সম্পর্কের সার্বিক অবনতি ঘটেনি। ১৯৬২ সালের চীন-ভারত যুদ্ধের পর ভারতীয় সেনাবাহিনী যে পুনর্গঠনের পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করেছে তাতে করে চীনের যে কোনাে ভবিষ্যৎ হামলা ঠেকানাের ক্ষমতা ভারতের ছিল। আর পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ অনিশ্চয়তার কারণে সহসা আরেকটি পাক-ভারত যুদ্ধেরও সম্ভাবনা ছিল না।
১০ ফেব্রুয়ারি ১৯৭০ মার্কিন ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি অব স্টেট এলিয়ন রিচার্ডসন প্রেসিডেন্ট নিক্সনের কাছে একটি স্মারকলিপি পাঠান। তাতেও দক্ষিণ এশিয়ায় মার্কিন সামরিক নীতি নমনীয় না করার ইঙ্গিত দেয়া হয়।১৭
এতে বলা হয়,
যুক্তরাষ্ট্রের কাছে পাকিস্তানের চাইতে ভারতের গুরুত্ব বেশি। যুক্তরাষ্ট্রের নীতিমালায় কোনাে পরিবর্তন আনা হলে ভারত তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করবে। যদি দুটি দেশের মধ্যে একটিকে খুশি করার কথা বিবেচনা করা হয়, তা হলে পাকিস্তানের চাইতে ভারতকে খুশি করাই উত্তম। কারণ, আকারে ভারত অনেক বড় এবং আন্তর্জাতিক প্রভাবের ক্ষেত্রেও পাকিস্তানের চাইতে শক্তিশালী।
পাকিস্তানের বর্তমান অসন্তুষ্টি নিবারণ করা যাবে, কারণ চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে পাকিস্তান যতই মাখামাখি করুক না কেন যুক্তরাষ্ট্র হলাে পাকিস্তানের সবচাইতে বড় ঋণদাতা দেশ। ১৯৬৯ সালে ভারতে ২০০ মিলিয়ন ডলার সাহায্যের বিপরীতে পাকিস্তান ১০০ মিলিয়ন ডলার সাহায্য পেয়েছে। যদিও ভারতের লােকসংখ্যা পাকিস্তানের ৫ গুণ। এ মুহূর্তে অস্ত্র সরবরাহের ওপর নিষেধাজ্ঞা সম্পূর্ণ উঠিয়ে দিলেও তাতে ভারত ও পাকিস্তানের নিজস্ব নীতির কোনাে পরিবর্তন হবে না। কারণ, তাদের সমস্যা ভূ-রাজনৈতিক, যাকে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্রনীতি দিয়ে খুব একটা প্রভাববান্বিত করা যাবে না।
বর্তমান অবস্থায় অস্ত্র সরবরাহ করে রাশিয়া কিংবা চীন দক্ষিণ এশিয়ায় খুব একটা প্রভাব বিস্তার করতে পারবে বলে মনে হয় না। পাকিস্তান ও ভারত দু’পক্ষই জোটের বেলায় এখন নিরপেক্ষ থাকতে পছন্দ করছে এবং অদূর ভবিষ্যতে তাদের কমিউনিস্ট প্রভাবে আচ্ছন্ন হয়ে যাওয়ার কোনাে আশঙ্কা নেই।
বর্তমান নিষেধাজ্ঞা বহাল রাখতে হলে ভারত ও পাকিস্তান উভয়কে বলে দেয়া যায় যে, আমাদের দক্ষিণ এশীয় অস্ত্র সরবরাহ নীতি নিয়ে পর্যালােচনা চলছে। এর পরেও যদি ইয়াহিয়ার সঙ্গে সাক্ষাতের ভিত্তিতে প্রেসিডেন্ট কোনাে বাধ্যবাধকতা অনুভব করেন, তা হলে অস্ত্ৰনীতি নমনীয় না করেও ইয়াহিয়ার
পৃষ্ঠা: ৫৯
প্রতি শুভেচ্ছা উপহার হিসেবে একবারের জন্য ব্যতিক্রম ঘটিয়ে পাকিস্তানকে ছয়টি এফ-১০৪ জঙ্গি বিমান দিয়ে দেয়া যায়। তবে তুরস্কের সঙ্গে লেনদেন একবারেই বন্ধ রাখা উচিত।
তবে বছরের শেষ দিকে গিয়ে পাকিস্তান এই বিলম্বের কারণে একরকম অধৈর্য হয়ে ওঠে এবং রাওয়ালপিণ্ডি ও নয়াদিল্লিতে মার্কিন রাষ্ট্রদূতরাও তা খানিকটা আঁচ করতে পারেন। এ ব্যাপারে রাষ্ট্রদূত ফারল্যান্ড (পাকিস্তান) ও কিটিং (ভারত) ভিন্ন ভিন্ন মত প্রকাশ করলেও ওয়াশিংটন থেকে কোনােটিকেই একেবারে অগ্রাহ্য করা হয়নি। ফারল্যান্ডের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল সীমিত আকারে হলেও অস্ত্র সরবরাহ শুরু করা, তুরস্কের সঙ্গে ট্যাংক লেনদেন চূড়ান্ত করা এবং অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থা হিসেবে কিছু সংখ্যক এয়ারক্রাফট সরবরাহ করা। তিনি মত দিচ্ছিলেন যে, আমেরিকা থেকে সাহায্য পাওয়া না পাওয়া ইয়াহিয়ার জন্য প্রেস্টিজ ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে, এমনকি এর ফলে পাকিস্তান ভেঙেও যেতে পারে। তিনি জানতেন যে, পাকিস্তান এবং ভারত উভয়ে রাজনৈতিক অস্থিতিশীল অবস্থায় দু’পক্ষকে অস্ত্র দিলেও এ মুহূর্তে উপমহাদেশে অস্ত্র প্রতিযােগিতার কোনাে অবকাশ নেই। বরং ইয়াহিয়ার আসন্ন সােভিয়েত সফর ও চো এন লাইয়ের আসন্ন পাকিস্তান সফরের সময় অস্ত্র সরবরাহের আলােচনা প্রাধান্য পাবার আশঙ্কা রয়েছে। ফলে ইয়াহিয়া যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে কোনাে আভাস না পেলে সরাসরি রাশিয়া ও চীন থেকে অস্ত্র আমদানির পদক্ষেপ নিতে পারেন।
তিনি আরাে যুক্তি দেখাচ্ছিলেন যে, পাকিস্তানে অস্ত্র সরবরাহ না করে অন্যদিকে ইসরায়েলকে ক্রমাগতভাবে এয়ারক্রাফট দেয়া হতে থাকলে মুসলিম বিশ্বেও অসন্তোষ বাড়বে। এতে পাকিস্তানের ইসরায়েলের বিরুদ্ধে আরব বিশ্বের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
১৯৭০ সালের জন্য পাকিস্তানে মার্কিন বরাদ্দ
১৯৭০ সালের ৬ এপ্রিল হেনরি কিসিঞ্জার প্রেসিডেন্ট নিক্সনের কাছে লেখা এক মেমােতে পাকিস্তানের জন্য ১০২ দশমিক ৫ মিলিয়ন ডলারের অর্থনৈতিক সহযােগিতা মঞ্জুরির প্রস্তাব করেন। এই অর্থ ছিল এর আগে নভেম্বর মাসে। প্রেসিডেন্টের মঞ্জুরকৃত ৯০ মিলিয়ন ডলারের পি এল-৪৮০ এর আওতায় পাঠানাে খাদ্য সাহায্যের অতিরিক্ত। ফলে ১৯৭০ সালে সেই সাহায্যের পরিমাণ দাঁড়ায় ১৯১ দশমিক ৫ মিলিয়ন ডলারে। কিসিঞ্জার জানান যে, প্রস্তাবিত এই অর্থ মার্কিন তহবিলের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ এবং কংগ্রেসের ফরেন এসিস্ট্যান্স এপ্রােপ্রিয়েশন বরাদ্দের আওতাভুক্ত।
অবশ্য এই পরিমাণ অর্থনৈতিক সাহায্য ছিল ১৯৬৯ সালের পিএল-৪৮০ বহির্ভূত ১৪০ মিলিয়ন এবং ১৯৬৮ সালের ১৫৮ মিলিয়ন ডলারের চাইতেও কম।
পৃষ্ঠা: ৬০
আমেরিকার নিজস্ব বাজেটসংক্রান্ত প্রতিকূলতাকে এই স্বল্পতর সাহায্য দানের কারণ হিসেবে দেখানাে হয়। কিসিঞ্জার তার মেমােতে বলেন যে, পাকিস্তানের দাবি বিবেচনা করে বছরের শেষ নাগাদ এই সাহায্য প্রবাহ আরাে ২০ থেকে ৩০ মিলিয়ন ডলার বাড়ানাে যাবে বলে আশা করা যায়। মােট সাহায্যের মধ্যে ৮৭ মিলিয়ন ডলারের ঋণ আন্তর্জাতিক কনসাের্টিয়ামের মােট ৩৭০ মিলিয়ন ডলার ঋণের ২৫ ভাগ যা আগের বছরগুলাের চাইতে কম।১৮
এই মােট সাহায্যের মধ্যে ৮৩ মিলিয়ন ডলার বরাদ্দ করা হয় পাকিস্তানের সাধারণ আমদানি বাড়াবার জন্য, বিশেষ করে সার এবং শিল্পের কাঁচামাল, যাতে করে কৃষি ও শিল্পখাতে উৎপাদনে সহায়তা করা যায়। এ সময় পাকিস্তান তার নিজস্ব নীতির অধীনে বিনিয়ােগ পদ্ধতি সরলীকরণ, কৃষিখাতে উৎপাদন বৃদ্ধি এবং শক্তিশালী একটি বেসরকারি খাত গড়ে তােলার চেষ্টা করছিল, যাতে এই ঋণ বিশেষ অবদান রাখবে বলে আশা প্রকাশ করা হয়।
পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পদ বণ্টনের বৈষম্যের কারণে যে মনােমালিন্য চলছিল তা এ সময় অর্থনৈতিক দুর্যোগের পাশাপাশি পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতিকেও দূষিত করে চলছিল। কিসিঞ্জার তার মেমােতে বলেন যে, মােট ঋণের মধ্যে রয়েছে ৮ মিলিয়ন ডলারের কারিগরি সাহায্য। পাশাপাশি পি এল৪৮০’র অধীনে দেয়া অনুদান ও তা থেকে পাকিস্তানের নিজস্ব কারেন্সির আয় প্রেসিডেন্টের কৃষি উৎপাদন বাড়ানাের কর্মসূচিকে বিশেষভাবে সাহায্য করবে এবং রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে বিধ্বস্ত পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের জীবনযাত্রার মানােন্নয়নে বিশেষ সহায়ক হবে।
১৯৭০ সালের ১৩ এপ্রিল হেনরি কিসিঞ্জার প্রেসিডেন্ট নিক্সনের বরাবর আরেকটি চমকপ্রদ মেমােরেন্ডাম পাঠান। এ মেমাের বার্তা ছিল তার আগের যে কোনাে বার্তার চাইতে ভিন্নতর।১৯ তিনি বলেন যে, তার আগেরবার পাঠানাে মেমােতে কিছুটা অস্পষ্টতা থাকায় তিনি কতকগুলাে বিষয় পরিষ্কার করতে চান। তিনি বলেন,
আগের পাঠানাে মেমােটাতে ভুল বােঝাবুঝির কিছু অবকাশ থাকায় প্রেসিডেন্ট এমন একটি অপশন বাছাই করেছেন যে যদি মনে করা হয় আগের সরবরাহ করা ট্যাংক ও অন্যান্য মারণাস্ত্রগুলাে দীর্ঘদিনের ব্যবহারের ফলে অকেজো হয়ে পড়েছে, তা হলে বিদ্যমান অস্ত্র সরবরাহের নিষেধাজ্ঞা শিথিল করে রিপ্লেসমেন্ট ট্যাংক বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নেয়া হচ্ছে। তা ছাড়া প্রেসিডেন্টের আগের মন্তব্য থেকে মনে হয়েছিল যে, তিনি এমন একটি ব্যবস্থা করবেন যাতে করে পাকিস্তানের প্রতি কিছুটা সহানুভূতি দেখানাে যাবে এবং একইসঙ্গে তা হবে রাজনৈতিকভাবে সকলের কাছে সহনশীল। সেজন্যই নীতিমালায় মৌলিক কোনাে পরিবর্তন না হলে সীমিত আকার ও পরিমাণে ট্যাংক ও বিমান সরবরাহ
পৃষ্ঠা: ৫১
করার সুপারিশ করা হয়েছিল। এ হিসেবে আমেরিকার সামনে দুটি পথ খােলা রয়েছে। সেগুলাে হলাে :
১. নিয়মিত সরবরাহের ওপর নিষেধাজ্ঞা বহাল রেখে পাকিস্তানের কাছে একবারের মতাে ব্যতিক্রমধর্মী সিদ্ধান্ত নিয়ে কিছু পরিমাণে মারণাস্ত্র বিক্রি করা এবং সেগুলাে হবে সে ধরনের যন্ত্রপাতি যা পাকিস্তানের জন্য প্রকৃতভাবে জরুরি। এতে পাকিস্তানের প্রতি বন্ধুত্বমূলক আচরণ দেখানাে হবে এবং এর মাধ্যমে নিয়মিতভাবে অস্ত্র সরবরাহের প্রতিশ্রুতিও দিতে হবে না। বর্তমান নীতিমালায় খুচরা যন্ত্রাংশ বিক্রির ওপর কোনাে নিষেধাজ্ঞা না থাকায় যন্ত্রাংশ নিয়মিতভাবেই সরবরাহ করা যেতে পারে। সেক্ষেত্রে যেসব সামগ্রী বিক্রি করা যায় সেগুলাে হলাে ছয়টি এফ-১০৪ ফাইটার বিমান এবং বি-৫৭ বােমারু বিমান এবং ১০০ এম-৪৭ ট্যাংক।
দেশের ভেতরে কতিপয় সমালােচক এবং দেশের বাইরে ভারত সামরিক সরবরাহ নীতিমালায় যে কোনাে রকম শিথিলকরণের সমালােচনা করবে, বিশেষ করে সেই নীতিমালা যদি পাকিস্তানের অনুকূলে যায়। সেই সমালােচনা এই বলে প্রতিহত করা যাবে যে, (ক) যুক্তরাষ্ট্র নিয়মিতভাবে দক্ষিণ এশিয়ায় নতুন করে অস্ত্র সরবরাহ শুরু করতে চায় না। এবং (খ) একবারের মতাে কিছু পরিমাণ অর্থনৈতিক সাহায্যকে সামরিক সরঞ্জাম রিপ্লেস করার জন্য পরিবর্তিত করা হলে পাকিস্তানকে নতুনভাবে আমদানির জন্য অতিরিক্ত অর্থব্যয়ের ঝুঁকি থেকে বাঁচানাে যায়।
২. নীতি শিথিল করে নিয়মিতভাবে রিপ্লেসমেন্টের আওতায় অস্ত্র বিক্রয় করা। এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রের আগের বিক্রয় করা যুদ্ধাস্ত্র স্বাভাবিক ব্যবহারের ফলে পুরনাে হয়ে যাওয়ায় নতুনভাবে ট্যাংক, যুদ্ধবিমান ও অন্যান্য মারণাস্ত্র বিক্রি করা যাবে। পাকিস্তানিরা নিষেধাজ্ঞা পুরােপুরি প্রত্যাশা করলেও এটুকু পেলেও তারা নিজেদের সৌভাগ্যবান বলে মনে করবে।
যুক্তরাষ্ট্রের ভেতরে সমালােচকরা এই প্রশ্ন তুলতে পারেন যে, পাক-ভারত দ্বন্দ্ব থেকে একবার নিজেদের সফলভাবে সরিয়ে আনতে পারলেও আমেরিকা আবার স্বেচ্ছাপ্রণােদিতভাবে সেই দ্বন্দ্বে জড়াতে চাইছে। এবার পাকিস্তান তাদের পুরনাে হয়ে যাওয়া এফ-৪৬ এয়ারক্রাফট বা পুরনাে ট্যাংক বদল করে এফ১০৪ যুদ্ধবিমান বা এফ-৫ এয়ারক্রাফট এবং পরবর্তী সংস্করণের ট্যাংক চাইবে। অন্যদিকে ভারতীয়রা অভিযােগ করবে যে, যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের সঙ্গে তার বন্ধুত্ব আবার পাকাপাকি করতে চাইছে। কিন্তু তখন নিক্সন ডকট্রিনের দোহাই দিয়ে তাদের আশ্বস্ত করা যাবে যে, কমিউনিস্ট উৎসের অস্ত্রভাণ্ডার থেকে পাকিস্তানকে দূরে রাখার জন্যই এ ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।
মেমােতে অবশ্য প্রথম অপশনটিকে দ্বিতীয় অপশন থেকে বেশি কার্যকর হবে বলে অভিমত প্রকাশ করা হয়।
পৃষ্ঠা: ৬২
এদিকে আমেরিকার দক্ষিণ এশীয় নীতি নিয়ে বিলম্বের কারণে আমেরিকার সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্কের দ্রুত অবনতি ঘটতে থাকে, যার ফলে মার্কিন প্রশাসন। কিছুটা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। ২১ মে রাষ্ট্রদূত ফারল্যান্ডের সঙ্গে প্রতিরক্ষা বিভাগের মন্ত্রী মেলভিন লেয়ার্ডের এক আলােচনার সারসংক্ষেপে বলা হয় যে,
আমেরিকার সিদ্ধান্তহীনতার কারণে পাকিস্তান ক্রমাগত রাশিয়া ও চীনের দিকে ঝুঁকছে। তার ধারণা প্রেসিডেন্ট জনসনের প্রতিশ্রুতি এবং নিক্সনের আশ্বাস সত্ত্বেও আমেরিকা পাকিস্তানকে সাহায্য না করায় দু’দেশের মধ্যকার সম্পর্ক অবনতির চূড়ান্ত স্তরে উপনীত হয়েছে।২০
রাষ্ট্রদূত ফারল্যান্ড পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর স্টাফ প্রধানের সঙ্গে এক বৈঠকের সূত্র ধরে বলেন যে, পাকিস্তানি পক্ষ তাকে জানিয়েছেন, পাকিস্তানকে নিজস্ব প্রতিরক্ষার কথা ভাবতে হবে এবং দাম বেশি পড়লেও যে কোনাে সূত্র থেকে তাদের যুদ্ধাস্ত্র সংগ্রহ করতে হবে। পাকিস্তানি প্রতিনিধি তাকে জানিয়েছেন যে, এখানে ব্যয়ের প্রশ্নটি মুখ্য নয়, আসলে তারা প্রতিশ্রুতির প্রশ্নটি বেশি বিবেচনা করছেন। এ সময় লেয়ার্ডের সঙ্গে চীনের কাছ থেকে পাকিস্তানের সম্ভাব্য প্রাপ্তির পরিমাণ সম্পর্কে আলােচনার প্রসঙ্গ উঠলে তিনি বলেন যে,
পাকিস্তান এখানাে চীনের প্রতি পূর্ণ আনুগত্য দেখায়নি, কিন্তু সময় ও সুযােগ দ্রুত ফুরিয়ে আসছে ও বিলম্ব হলে এই পরিস্থিতি ধরে রাখা যাবে না। উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন যে, গত মার্চ মাস থেকে চাঁদের পাথর ও সেখানে স্থাপিত পাকিস্তানের পতাকা উপহার দেয়ার জন্য নিক্সনের তরফ থেকে ইয়াহিয়ার সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করা হচ্ছে, কিন্তু প্রতিবারই অ্যাপয়েন্টমেন্ট না দিয়ে ভদ্র ভাষায় পাকিস্তানে মার্কিন অস্ত্রের প্রয়ােজনীয়তার বিষয়টি মনে করিয়ে দেয়া হচ্ছে। অথচ পাকিস্তানের প্রচার মাধ্যমে চীনকে আমেরিকার চাইতে বেশি অগ্রাধিকার দেয়া হচ্ছে। লেয়ার্ড বলেন যে, ফারল্যান্ডের বক্তব্য সত্যি হতাশাব্যঞ্জক এবং মনে হচ্ছে ইতােমধ্যেই অনেক দেরি হয়ে গেছে। রাষ্ট্রদূত তাকে আশ্বস্ত করেন যে, দেরি হয়ে গেলেও এখন অবধি পরিস্থিতির উন্নতির কিছুটা ব্যবস্থা করা যায়।
চীন ও রাশিয়া পাকিস্তানে অস্ত্র দেয়ার বিনিময়ে কীরকম সুযােগ-সুবিধা চাইছে, লেয়ার্ডের এই প্রশ্নের জবাবে ফারল্যান্ড বলেন যে, চীন সম্ভবত চীন ও বঙ্গোপসাগরের মধ্যবর্তী দেশগুলাের ওপর অধিকতর চায়নিজ কমিউনিস্ট নিয়ন্ত্রণ চাইছে। বার্মা, আসাম ও পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট নিয়ন্ত্রণে থাকলে চীন অনায়াসে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার ওপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে পারবে এবং একই সঙ্গে ভারতকে রুখতে পারবে। তিনি বলেন, রাশিয়া সম্ভবত ভারত মহাসাগর ও পারস্য উপসাগরের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে গিয়ে পাকিস্তানের সাহায্য নেবে।
রাষ্ট্রদূত ফারল্যান্ড পাকিস্তানে কিছুসংখ্যক ট্যাংক পাঠানাের ওপর জোর দেন। তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে তা পাঠানাের সম্ভাবনা কতটুকু অবশিষ্ট আছে তা নিয়েও
পৃষ্ঠা: ৬৩
বৈঠকে সংক্ষিপ্ত আলােচনা হয়। এতে সকলেই একমত হন যে, কয়েক মাস আগেও যা সহজে সম্ভব ছিল এখন পর্যন্ত পরিস্থিতি তার তার চাইতে প্রতিকূলে চলে গেছে।
এদিকে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার মস্কো সফর আসন্ন হয়ে আসায় মার্কিন প্রশাসনেও কিছুটা নড়াচড়ার আভাস পাওয়া যায়। আমেরিকার সংশ্লিষ্ট কূটনীতিকরা অনুভব করতে থাকেন যে, ইয়াহিয়া মস্কো যাবার আগে যদি তার হাতে কোনাে ইতিবাচক সংবাদ পৌছানাে না যায়, তা হলে বিকল্প হিসেবে পাকিস্তান অস্ত্রের জন্য রাশিয়ার সঙ্গে দেনদরবার করবে এবং রাশিয়ার সঙ্গে পাকিস্তানের কোনাে চুক্তি স্বাক্ষরিত হলে পুরাে পরিস্থিতি আমেরিকার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। ভারত এবং মার্কিন কংগ্রেসের চাপে দক্ষিণ এশীয় নীতিতে অনমনীয়তা নিয়ে আসায় এবার পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কের চিত্রই পুরাে পাল্টে যাবার পরিস্থিতি দেখা দেয়। রাষ্ট্রদূত ফারল্যান্ড এসময় পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক ধরে রাখার পেছনে জোর তদবির করতে থাকেন এবং ঘন ঘন প্রশাসনের উচ্চতর স্তরে এ নিয়ে যােগাযােগ করে নিজেদের যুক্তি উপস্থাপন করতে থাকেন।
১১ জুন হেনরি কিসিঞ্জার হােয়াইট হাউজে একটি মেমােরেন্ডাম পাঠান, যাতে সঙ্গীদের এই মনােভাব বিশদভাবে ব্যক্ত করা হয়। প্রেসিডেন্ট নিক্সনের বরাবর। পাঠানাে সেই মেমােতে বলা হয় যে,
প্রেসিডেন্ট দক্ষিণ এশিয়ায় আমেরিকার সামরিক সরবরাহ নীতিতে শিথিলতা আনার বিষয়টি আপাতত স্থগিত রাখতে বলেছেন। অথচ সেন্টো পররাষ্ট্রমন্ত্রিদের সঙ্গে বৈঠকের পর তিনি অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি অব সিসকোকে পাকিস্তান সম্পর্কে কিছু করা যায় কি না দেখতে বলেছিলেন। এক্ষণে পরিস্থিতি এই দাড়িয়েছে যে পারমিট সেলের ওপর নিষেধাজ্ঞা কিছুটা শিথিল করে পাকিস্তানকে ক্ষয়ে যাওয়া মার্কিন সরবরাহকৃত অস্ত্রের পরিবর্তে কিছু পরিমাণ নতুন অস্ত্র দেয়া সম্ভব তবে তুরস্কের মাধ্যমে থার্ড পার্টি সেলে ট্যাংক সরবরাহ করা সম্ভব হবে না।২১
কিসিঞ্জার বলেন, এ মূহূর্তে সবচাইতে বাস্তবসম্মত পথ হবে পলিসি নমনীয় না করে একবারের মতাে ব্যতিক্রম হিসেবে পাকিস্তানকে জরুরি প্রয়ােজন মেটাবার জন্য কিছু পরিমাণ অস্ত্র সরবরাহ করা। তিনি বলেন, সেন্টো পরাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠকের সময় ফারল্যান্ড জানিয়েছেন যে, ২২ জুন ইয়াহিয়া মস্কো যাচ্ছেন এবং এর আগেই ইয়াহিয়ার কাছে একটা সুসংবাদ পৌছানাে দরকার। সেক্রেটারি রজার্সও নীতি শিথিল না করে একবারের মতাে শিথিলকরণের মাধ্যমে পাকিস্তানকে সাহায্য করার পক্ষপাতী বলে কিসিঞ্জার জানান। সেক্রেটারি রজার্স যেভাবে সাহায্যের প্যাকেজ তৈরি প্রস্তাব করেছেন সেগুলাে হলাে :
১. ছয়টি এফ-১০৪ ফাইটার ইন্টারসেপ্টরের রিপ্লেসমেন্ট অথবা ১২টি এফ৫ অথবা এফ-১০৪ এর অন্য মডেল। ৩০০টি আর্মড পারসােনেল ক্যারিয়ার ও ৪টি এন্টি সাবমেরিন পেট্রোল এয়ারক্রাফট।
পৃষ্ঠা: ৬৪
২. ৭টি বি-৫৭ বােমারু বিমান ও ১০০টি এম-৪৮ ট্যাংক।
এতে বলা হয় যে, পাকিস্তান ও ভারত উভয় স্থানে এই লেনদেনের বিষয়টি অত্যন্ত গােপন রাখতে হবে। তবে খবরটি ফাঁস হয়ে গেলে এমনভাবে ব্যাখ্যা করতে হবে যে, পাকিস্তানের জন্য একটি জরুরিভিত্তিক ব্যতিক্রম হিসেবে এই অস্ত্রের চালান দেয়া হচ্ছে।
পরদিন ১২ জুন ১৯৭০ বেলা সাড়ে ১১টায় হেনরি কিসিঞ্জার ও অ্যাসিস্ট্যান্ট অব স্টেট ফর নিয়ার ইস্টার্ন অ্যান্ড সাউথ ইস্টার্ন অ্যাফেয়ার্স জোসেফ সিসকো’র মধ্যে টেলিফোনে আলাপ হয়।২২ টেলিফোনের বিবরণ ছিল নিম্নরূপ :
সিসকো : এখন পাকিস্তান সম্পর্কে আলােচনা করা যাক।
কিসিঞ্জার : আমি আপনার সঙ্গে আলাপ করতে চেয়েছিলাম। প্রেসিডেন্ট নৈতিকভাবে পাকিস্তানের জন্য কিছু করতে চাইছেন। তিনি প্যাকেজের সঙ্গে বি-৫৭ বােমারু বিমান ও ট্যাংক যােগ করতে চাইছেন।
সি : সেগুলাে যােগ করা হলে ডিফেন্সিভ প্যাকেজটাকে অফেন্সিভের মতাে দেখাবে। ট্যাংকগুলােকে একেবারে ফ্যান্টমের মতাে দেখায়। এগুলােকে বিক্রয় করা কঠিন হবে, কারণ কংগ্রেস বাধা দেবে। ভারতের প্রতিক্রিয়াও হবে বেশি। আমার মনে হয় বি-৫৭ যােগ করা যায়, কারণ এ দিয়ে পুরনাে ট্যাংক রিপ্লেস করার যুক্তি তােলা যাবে। তবে ট্যাংক যদি আমরা ৫০-টিতেও নামিয়ে আনি তবুও তার ওপর পাকিস্তানের মনস্তাত্ত্বিক প্রতিক্রিয়া হতে পারে।
কি : মনে হচ্ছে প্যাকেজটা খুব ছােট হয়ে যাচ্ছে। পাকিস্তানিরা একে অপমান বলে মনে করতে পারে।
সি : আমাদের যদি আঘাতই নিতে হয়, তবে আর ছােটটির জন্য হতে হবে কেনাে?
কি : যথার্থ।
সি : দেখা যাক অফেন্সিভ না করে ডিফেন্সিভ প্যাকেজের মধ্যে আর কিছু ঢােকানাে যায় কি না। আমি দু-য়েক ঘণ্টার মধ্যে আবার তােমাকে ফোন করবাে।
সেদিনই বিকাল ৪টা ৫০ মিনিটে সিসকো আবার কিসিঞ্জারকে ফোন করে জানান যে, তার মাথায় একটা বুদ্ধি এসেছে। তিনি ট্যাংক বাদ দিয়ে ৬টি বি-৫৭ বােমারু বিমানের জায়গায় ১২টি বােমারু বিমানের প্যাকেজ তৈরি করার পরামর্শ দেন। তিনি বলেন যে, এর ফলে পাকিস্তান খুশি হবে, কারণ তারা প্রথমে ১২টি চেয়েছিল। অন্যদিকে পাকেজটাকেও অফেন্সিভ না দেখিয়ে ডিফেন্সিভের মতাে দেখাবে। ট্যাংক পাঠানাের বিষয়টি তখনকার মতাে স্থগিত রাখা হয়।২৩
১৭ জুন পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত আগা হিলালী ওয়াশিংটনে কিসিঞ্জারের সঙ্গে এক বৈঠকে বসেন। কিসিঞ্জার তাকে বলেন যে, প্রেসিডেন্ট নিক্সনের নির্দেশে তিনি
পৃষ্ঠা: ৬৫
হিলালীর সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে দেখা করছেন। তিনি বলেন যে, পাকিস্তানে সামরিক সরবরাহ দেয়ার বিষয়টি দীর্ঘদিন ঝুলে আছে এবং কয়েকদিনের মধ্যে পাকিস্তান সরকার মার্কিন সরকারের কাছ থেকে এ ব্যাপারে বিশদ জানতে পারবেন।২৪ নিক্সন চেয়েছেন ইয়াহিয়ার কাছে ব্যক্তিগতভাবে এই বার্তা পৌঁছে দিতে এবং তা হবে ইয়াহিয়া মস্কো যাবার আগেই (২২জুন)। এ পর্যায়ে তিনি বিষয়টি প্রচারণা না করার জন্য হিলালীকে অনুরােধ করেন কারণ মার্কিন সরকার তখনাে বিষয়টি কংগ্রেসকে জানাননি।২৫
তিনি বলেন, কংগ্রেসের অনুমােদন না থাকায় বিদ্যমান অস্ত্র সরবরাহের নিষেধাজ্ঞা একবারে উঠিয়ে দেয়া যাবে না, তবে প্রেসিডেন্টের ইচ্ছাক্রমে একবারের মতাে ব্যতিক্রম হিসেবে পাকিস্তানের অনুরােধ করা অস্ত্রের একটি বিশাল চালান উপহার দিতে নিক্সন তৈরি আছেন। অস্ত্রের মধ্যে রয়েছে ১২টি ট্যাকটিক্যাল ফাইটার, একটি স্কোয়াড্রন (এফ-১০৪ জি অথবা এফ-৫) অথবা ৬টি রিপ্লেসমেন্ট এফ-১০৪-এ, ৩০০ আর্মড পার্সোনেল ক্যারিয়ার, ৪টি অ্যাডভান্সড ডিজাইন ন্যাভাল পেট্রল এন্টি সাবমেরিন এয়ারক্রাফট এবং ৭টি বি-৫৭ বােমারু বিমান।
কিসিঞ্জার বলেন, নিক্সন ইয়াহিয়াকে জানাতে চান যে, তার ব্যক্তিগত হস্তক্ষেপে এই একবারের মতাে ব্যতিক্রমধর্মী বিক্রয় স্থির করা হয়েছে এবং এর মাধ্যমে ধরে নেয়া ঠিক হবে না যে আবার একইভাবে ব্যতিক্রমধর্মী সরবরাহ দেয়া যাবে। হিলালী এই সরবরাহের দিনক্ষণ জানতে চাইলে কিসিঞ্জার বলেন যে, তিনি এ ব্যাপারে লিখিত দিনক্ষণ বলতে পারেন না, তবে এটুকু বলা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটের চাপ এবং জনগণের হইচই একটু কমে গেলেই সরবরাহের ব্যবস্থা নেয়া হবে।
রাষ্ট্রদূত হিলালী ‘বিক্রয়’ কথাটির ওপর জোর দিয়ে তার পরিবর্তে ক্রেডিট এর ব্যবস্থা করা যায় কি না জিজ্ঞেস করলে কিসিঞ্জার বলেন, যুক্তরাষ্ট্র ক্যাশ লেনদেনের বিষয়টি স্থির করেছে এবং এক্ষণে ক্রেডিটের প্রশ্ন তুললে বাড়তি জটিলতা সৃষ্টি হবে।
হিলালী যখন উল্লেখ করেন যে, তালিকায় ট্যাংকের বিষয়ে কিছু বলা হয়নি, তখন কিসিঞ্জার বলেন যে, প্যাকেজে ট্যাংক দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু এর ফলে গােটা সরবরাহই ভেস্তে যেতে পারতাে। এমনও হতে পারতাে যে, কংগ্রেস তা অনুমােদন করতাে না এবং ভবিষ্যতে এপ্রােপ্রিয়েশন বিলে যে কোনাে রকমের সরবরাহই অনিশ্চিত করে তুলতে পারতাে।
কিসিঞ্জারের সঙ্গে বৈঠকের পর হিলালী এনএসসি স্টাফ সন্ডার্সের কাছ থেকে তালিকাটি বুঝে পান এবং দেখেন যে তালিকাটি কিসিঞ্জারের ভাষ্যের সঙ্গে পুরােপুরি সঙ্গতিপূর্ণ।
পরদিন (১৮ জুন, ১৯৭০) রাওয়ালপিন্ডিতে রাষ্ট্রদূত ফারল্যান্ডের কাছে মার্কিন ডিপার্টমেন্ট অব স্টেট থেকে পাঠানাে এক জরুরি টেলিগ্রামে অনতিবিলম্বে
পৃষ্ঠা: ৬৬
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে দেখা করে এই সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়। টেলিগ্রামে বলা হয় যে, ইয়াহিয়াকে পাওয়া না গেলে পররাষ্ট্র সচিবকে তা জানাতে হবে।২৬ এতে একইভাবে বিষয়টি গােপন রাখার জন্য ফারল্যান্ডকে এবং গােপনীয়তার বিষয়টি পাকিস্তানকে অবহিত করার নির্দেশ দেয়া হয়।২৭
১৯৭০ সালের ২২ জুন ইয়াহিয়া খান মস্কো সফর করেন। এই সফরে ইয়াহিয়া মস্কোর কাছ থেকে কোনাে সাহায্য পাননি। পাকিস্তানে একটি ইস্পাত কোম্পানি স্থাপনের জন্য মস্কোর সঙ্গে চুক্তি হলেও সার্বিকভাবে এই সফর সফল হয়েছিল বলা যায় না।২৮
পরবর্তী একমাস সময়ের মধ্যে পরিস্থিতির আর কোনাে উন্নতি হয়নি। ৮ সেপ্টেম্বর রাষ্ট্রদূত ফারল্যান্ড ইয়াহিয়ার সঙ্গে দেখা করেন এবং আমেরিকার দক্ষিণ এশীয় সামরিক সরবরাহ নীতির তখনকার অবস্থা সম্পর্কে প্রেসিডেন্টকে অবহিত করেন। ইয়াহিয়া তাকে বলেন যে, বিগত মাসে প্রেসিডেন্ট নিক্সনের প্রস্তাব ও শুভেচ্ছার নিদর্শন তাকে বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত করেছে যে কারণে তিনি সােভিয়েত সফরকালে সােভিয়েত সরকারের কাছ থেকে কোনাে অস্ত্রের আবেদন জানাননি। তা ছাড়া ইয়াহিয়া তাকে আরাে জানান যে, তিনি কমিউনিস্টদের আলিঙ্গন সম্পর্কে অতটা উৎসাহীও নন।২৯
এরপর রাষ্ট্রদূত মার্কিন কংগ্রেসের কাছ থেকে অস্ত্র সরবরাহের ব্যাপারে অনুমােদন নেয়ার বিলম্বের কারণ ব্যাখ্যা দাবি করেন। নিক্সন এ পর্যায়ে কিসিঞ্জারকে জিজ্ঞেস করলে কিসিঞ্জার জবাব দেন যে, বিষয়টি এখনাে ডিপার্টমেন্ট অব স্টেটে ঝুলে আছে। প্রেসিডেন্ট তখন সিসকোকে এ ব্যাপারে ত্বরিত সিদ্ধান্ত নেয়ার নির্দেশ দিয়ে বলেন যে, তিনি এ ব্যাপারে একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, যা ত্বরিত বাস্তবায়ন করতে হবে এবং বাস্তবায়নের এটাই যথার্থ সময়।
ফারল্যান্ড তার মেমােতে স্মরণ করিয়ে দেন যে, লাহােরে প্রেসিডেন্টের সঙ্গে ইয়াহিয়ার বৈঠকের সময় ইয়াহিয়া তাকে জানিয়েছিলেন যে, অস্ত্র নগদ দামে কিনতে পাকিস্তানের অসুবিধা রয়েছে। ৮ সেপ্টেম্বরের বৈঠকে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া আবার ফারল্যান্ডকে সে কথা মনে করিয়ে দিয়ে বলেছিলেন যে, পাকিস্তান এখনাে অর্থকষ্টে রয়েছে। ইয়াহিয়া সরাসরি প্রেসিডেন্টের কথা না বললেও অর্থায়নের জন্য কিছু একটা করার অনুরােধ জানান।
সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে এ ব্যাপারে বরফ গলতে শুরু করে। ১ অক্টোবর সকাল ১০টায় রাওয়ালপিন্ডিতে আমেরিকার ডেপুটি চিফ অব মিশন সিপনি সােবার পাকিস্তানের অতিরিক্ত পররাষ্ট্র সচিব এমএ আলভী এবং প্রতিরক্ষা সচিব গিয়াসউদ্দিনের সঙ্গে দেখা করেন। পররাষ্ট্র সচিব সুলতান খান দেশের বাইরে থাকায় অতিরিক্ত সচিবের সঙ্গে এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সােবার আলভীকে জানান
পৃষ্ঠা: ৬৭
যে আলােচনার বিষয় প্রতিরক্ষা বিষয়ক হওয়ায় প্রতিরক্ষা সচিবও বৈঠকে থাকলে ভালাে হয়। প্রাথমিকভাবে প্রতিরক্ষা সচিবের অফিসে বৈঠকের কথা থাকলেও ১ অক্টোবর নাসেরের মৃত্যুর ফলে অফিস বন্ধ থাকায় বৈঠকটি স্থান্তর করা হয় প্রতিরক্ষা সচিবের বাসভবনে।৩০
বৈঠকের সূত্রপাতে সিডনি সােবার জানান যে, যুক্তরাষ্ট্র থেকে পাকিস্তানে অস্ত্র পাঠানাের বিষয়টি আনুষ্ঠানিকভাবে পাকিস্তানকে জানাবার সময় এসেছে। মার্কিন নির্বাহী বিভাগ ২১ সেপ্টেম্বর কংগ্রেসকে প্রেসিডেন্টের অস্ত্র বিক্রির ইচ্ছার কথা কংগ্রেসকে জানিয়েছে। তিনি জানান যে, ৩১ অক্টোবরের আগে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সঙ্গে ফারল্যান্ডের আলােচনা প্রেক্ষাপটে ভারত সরকারকেও সাধারণভাবে এই লেনদেনের বিষয়টি জানানাে হয়েছে। সিডনি বলেন যে, ইউরােপ সফর থেকে ফেরার পর প্রেসিডেন্ট নিক্সন আনুষ্ঠানিকভাবে ইয়াহিয়ার কাছে চিঠি লিখে বিষয়টি জানাবেন। ফারল্যান্ড পাকিস্তানে ফেরার পর তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে ইয়াহিয়ার হাতে সেই চিঠি দেবেন।
৫ অক্টোবর সােবার ডিপার্টমেন্ট অব স্টেটে পাঠানাে এক টেলিগ্রামে জানান যে, সেদিন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সঙ্গে দেখা হওয়ার পরে প্রেসিডেন্ট তাকে জানিয়েছেন যে, ইতােমধ্যেই তিনি পররাষ্ট্র অতিরিক্ত সচিব ও প্রতিরক্ষা সচিবের কাছ থেকে সংবাদ পেয়েছেন।৩১ আলােচনাকালে ইয়াহিয়া খান আবার ফারল্যান্ডের সঙ্গে তার পূর্ব আলােচনা উল্লেখ করে বলেন বর্তমান মুহূর্তে পাকিস্তানের আর্থিক সংকট রয়েছে। তিনি বলেন, আমেরিকার প্রচুর অস্ত্র সারপ্লাস স্টকে পড়ে আছে এবং পাকিস্তান আশা করে যে উল্লেখযােগ্য কনসেশনে সেসব অস্ত্র পাকিস্তানের কাছে যুক্তরাষ্ট্র বিক্রি করতে পারে।
ইয়াহিয়া আশা প্রকাশ করেন যে, পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা প্রতিনিধিরা যখন মার্কিন প্রতিনিধিদের সঙ্গে দেনদরবারে বসবেন, তখন এই কনসেশন এবং মূল্য পরিশােধের সময়সীমা নিয়ে দর কষাকষি করার সুযােগ করে দেয়া হবে। তাকে আশ্বাস দিয়ে বলেন যে, ফারল্যান্ড ইতােমধ্যেই পাকিস্তানের আর্থিক বিষয়টি সরকারকে অবহিত করেছেন এবং আশা করেন যে কোনাে একটা উপায় উদ্ভাবনের চেষ্টা করা হবে।
পাকিস্তান ও ভারতের প্রতিক্রিয়া যুক্তরাষ্ট্রের সমরাস্ত্র পাকিস্তানের কাছে বিক্রির সিদ্ধান্ত আনুষ্ঠানিকতা পাবার সঙ্গে সঙ্গে ভারত থেকে তার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করা হয়। সীমিত পরিমাণে এবং বিশেষ বিবেচনার আওতায় এই লেনদেনের সিদ্ধান্ত নেয়া হলেও ভারত
পৃষ্ঠা: ৬৮
একইসঙ্গে দিল্লি ও ওয়াশিংটন থেকে এই সিদ্ধান্তের তীব্র প্রতিবাদ জানায়। আনুষ্ঠানিক ঘােষণার পরপর পাকিস্তান ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে লেনদেনের সিদ্ধান্ত ব্যাখ্যা করে বিবৃতি দেয়া হলেও ভারত সেই ব্যাখ্যায় সন্তুষ্ট হতে পারেনি এবং অত্যন্ত কড়া ভাষায় একটি গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে।
অন্যদিকে পাকিস্তান অনেক দিন ধরে ঝুলে থাকা বিষয়টি শেষ পর্যন্ত আলাের মুখ দেখায় সন্তোষ প্রকাশ করে ও আমেরিকার সঙ্গে এ ব্যাপারে পূর্ণ সহযােগিতার আশ্বাস দেয়। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া প্রকাশ্যে ঘােষণা দেন যে তিনি অক্টোবর ২৪ তারিখে যুক্তরাষ্ট্র সফরকালে হােয়াইট হাউসে নিক্সনের ডিনারের অতিথি হবেন এবং ওয়াশিংটনে মার্কিন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক আলােচনায় মিলিত হবেন।৩২
৭ ও ৮ অক্টোবর আনুষ্ঠানিক মৌখিক প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে ভারত যথাক্রমে নয়াদিল্লি ও ওয়াশিংটনে মার্কিন সিদ্ধান্তের তীব্র প্রতিবাদ জানায় ও মারাত্মক ধরনের ভুল বােঝাবুঝি হবার আশঙ্কা প্রকাশ করে। বন্ধুত্বপূর্ণভাবে প্রতিবাদ করলেও তাদের বক্তব্যে ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি সতর্কবাণী। ভারতীয় মুখপাত্ররা৩৩ সতর্ক করে দিয়ে বলেন যে, এর ফলে অত্যন্ত জোরালাে সহিংস গণবিক্ষোভ সৃষ্টি হবার আশঙ্কা রয়েছে এবং সেখানে ইন্দিরা গান্ধীর সরকারকে প্রচণ্ড চাপের সম্মুখীন হতে হবে। তারা আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন যে, পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের দেনদরবার ও সমঝােতা ইতােমধ্যে অনেকটা এগিয়ে গেলেও আমেরিকার সিদ্ধান্ত সেই সমঝােতার ওপর নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করবে।
৯ অক্টোবর ওয়াশিংটনে নিকটপ্রাচ্য ও দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি অব স্টেট জোসেফ সিসকো এক মেমােরেন্ডামে সেক্রেটারি উইলিয়াম রজার্সের কাছে ভারতের এই প্রতিক্রিয়া ব্যাখ্যা করেন।৩৪ মেমােরেন্ডামে তিনি বলেন যে, এর আগে ভারতের সঙ্গে যেভাবে আলােচনা করা হয়েছে অস্ত্র বিক্রির এই সিদ্ধান্তে তার বিরাট রকমের ব্যত্যয় ঘটেছে বলে ভারত মনে করে। এখন তারা বলছে যে পাকিস্তান এখন রণসজ্জায় সজ্জিত হচ্ছে এবং এই রণসজ্জা শুধুমাত্র ভাতের বিরুদ্ধে। কাজেই পাকিস্তানের বর্তমান সামরিক ক্ষমতার ওপর যে কোনাে কিছু যােগ করা হলে ভারত তাকে অত্যন্ত সিরিয়াসলি নেবে বলে ভারতীয় প্রতিক্রিয়ায় উল্লেখ করা হয়েছে। ভারতের প্রতিক্রিয়ায় বলা হয় যে, এর আগে সােভিয়েত ইউনিয়ন পাকিস্তানে সমরাস্ত্র সরবরাহের সিদ্ধান্ত নেয়ায় ভারত থেকে একই রকম প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করা হয়েছে এবং সােভিয়েত ইউনিয়ন সেই প্রতিক্রিয়ায় ইতিবাচক সাড়া দিয়েছে।
৮ অক্টোবর ভারত সরকার একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। এতে পাকিস্তানের কাছে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র বিক্রির সিদ্ধান্তে বিরূপ প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করে বলা হয় যে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাখ্যায় ভারত সন্তুষ্ট নয়। বিবৃতিতে অভিযােগ করা হয় যে যুক্তরাষ্ট্রের সিদ্ধান্ত দক্ষিণ এশিয়ার শান্তির পরিপন্থী। এতে বলা হয় পাকিস্তান তিন
পৃষ্ঠা: ৬৯
তিনবার ভারতের সঙ্গে যুদ্ধে প্রবৃত্ত হয়েছে এবং অস্ত্র চালানের নবায়ন গভীর উদ্বেগের কারণ। পাকিস্তান যুক্তরাষ্ট্রের আশ্বাস সত্ত্বেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নির্মিত অস্ত্র ১৯৬৫ সালে ব্যবহার করেছে অথচ এবারকার অস্ত্র বিক্রির সিদ্ধান্তের সঙ্গে তেমন কোনাে আশ্বাস পর্যন্ত নেই। তার পরিস্থিতি বর্ণনার মেমােরেন্ডামে সিসকো বলেন,
অভ্যন্তরীণ রাজনীতির কারণে ভারতের হয়তাে বিরূপ প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করে এমন একটি বিবৃতি দেয়া প্রয়ােজন ছিল কিন্তু তারা এটা বিবেচনা করেনি যে, (১) অস্ত্র বিক্রির সিদ্ধান্ত হয়েছে সীমিত আকারে; (২) একবারের মতাে বিশেষ বিবেচনাধীনে অস্ত্র বিক্রির সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে এবং নিষেধাজ্ঞা এখনাে বহাল রয়েছে; (৩) যুক্তরাষ্ট্র কেবলমাত্র পুরনাে অস্ত্রের রিপ্লেসমেন্ট হিসেবে নতুন অস্ত্র দিচ্ছে এবং কোনাে ট্যাংক বিক্রির সিদ্ধান্ত নেয়া হয়নি। অন্যদিকে তারা অস্ত্র বিক্রির নবায়নের যে কথা বলেছে সেটিও ঠিক নয় বরং তার ফলে বাড়তি গণউত্তেজনা সৃষ্টির অবকাশ রয়েছে। অন্যদিকে সােভিয়েত ইউনিয়ন পাকিস্তানে অস্ত্র সরবরাহ করার পর ভারত যেভাবে প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেছিল এবার আমেরিকা অস্ত্র বিক্রির সিদ্ধান্ত নেয়ার পর তার চাইতে অনেক জোরালােভাবে প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেছে। অথচ সেবার সােভিয়েতের সরবরাহকৃত অস্ত্রের পরিমাণ ছিল অনেক বেশি। ইতােমধ্যে ওয়াশিংটনে ভারতীয় কর্তৃপক্ষকে যুক্তরাষ্ট্রের মনােভাবের কথা জানিয়ে দেয়া হয়েছে এবং দিল্লিতে অবস্থিত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতকে অনুরূপ মনােভাব জানানাের জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে পাকিস্তানের সঙ্গে দেনদরবার চূড়ান্ত করার ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে বলে সিসকো তার মেমােরেন্ডামে উল্লেখ করে বলেন খুব সম্ভবত প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া তার আসন্ন সফরে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকের সময় এ নিয়ে প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বিস্তারিত আলােচনা করবেন।
পাকিস্তানে অস্ত্র বিক্রি : অচলাবস্থা অব্যাহত ভারতে এবং মার্কিনবিরােধী বহির্বিশ্বে যখন পাকিস্তানে অস্ত্র সরবরাহের সিদ্ধান্ত নিয়ে তুমুল বিতর্ক চলছিল, সে সময়ে প্রবল সমালােচনার মুখেও পাকিস্তান ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের অস্ত্র লেনদেনের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করতে পারেনি। এর প্রধান কারণ ছিল পাকিস্তানের অর্থনৈতিক সংকট। পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারি হওয়ায় গণতান্ত্রিক পশ্চিমা বিশ্ব ততদিনে সাহায্যের ব্যাপারে পাকিস্তানের কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। ইচ্ছা থাকলেও যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে অসামরিক অর্থ সাহায্যের পরিমাণ বাড়ানাে যাচ্ছে না। অন্যদিকে পূর্ব পাকিস্তানে প্রাকৃতিক দুর্যোগ
পৃষ্ঠা: ৭০
অন্যদিকে পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনৈতিক ভারসাম্য এনে রাজনৈতিক অবস্থা স্থিতিশীল করার দায়দায়িত্ব পাকিস্তান সরকারকে এনে ফেলেছিল প্রবল চাপের মুখে।
বছর | মােট সাহায্য (মিলিয়নডলারে) | মার্কিন সাহায্য | সামরিক সাহায্য৩৫ |
১৯৬০ | ১৬৮৯.৮৪ | ১১৮১.৩৫ | ২৩০.৩৯ |
১৯৬১ | ৯৮৯.৫৩ | ৭৮০.০৪ | ২৬০.৪৭ |
১৯৬২ | ২৩৩৪.৬৫ | ১৪৪৬.২৮ | ৫৪৯.০২ |
১৯৬৩ | ২০৬৬.৭৭ | ১০৬৩.৬৮ | ২৯২.৩১ |
১৯৬৪ | ২২২২.৬৬ | ১৩৩৪.১৬ | ১৮৭.৫৫ |
১৯৬৫ | ১৯২৮.৯ | ১০৪১.৫৮ | ৭৭.৩৮ |
১৯৬৬ | ৮১৬.২৮ | ৬৯১.২৮ | ৮.৪ |
১৯৬৭ | ১২১৩.৩৬ | ৭১৯.৩৮ | ২৬.৩৩ |
১৯৬৮ | ১৫০১.৬৮ | ৬৭২.৫ | ২৫.১৮ |
১৯৬৯ | ৫৪১.৭৬ | ৫০৪.৩১ | ০.৫ |
১৯৭০ | ৯৬৮.৩২ | ৫৭০.৯৩ | ০.৮৭ |
তালিকায় দেখা যায়, টাকার অঙ্কে ৬০ এর দশকের মধ্যে ১৯৭০ সালে প্রাপ্ত বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ছিল সমন্বিত অঙ্কে ৯৬৮ দশমিক ৩২ মিলিয়ন ডলার, যার মধ্যে শুধু আমেরিকার দেয়া সাহায্যের পরিমাণ ছিল ৫৭১ মিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ আমেরিকা নিজে গােটা প্রাপ্ত সাহায্যের প্রায় ৬০ শতাংশ পাকিস্তানকে দিয়েছে। অথচ মােট অঙ্ক এবং আমেরিকা থেকে পাওয়া উভয় ধরনের সাহায্যই ছিল দশকের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বনিম্ন।
১৯৭০ সালের ১৬ অক্টোবর রাওয়ালপিন্ডিস্থ মার্কিন দূতাবাস থেকে ডিপার্টমেন্ট অব স্টেটে পাঠানাে এক টেলিগ্রামে পাকিস্তানে মার্কিন সামরিক সাহায্যের লেনদেনের তখনকার পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করা হয়। এতে বলা হয় যে, মার্কিন প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী লেনদেন স্থির করার জন্য সরকারি পর্যায়ে আলােচনা শুরু হয়েছে। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া, প্রতিরক্ষা সচিবসহ অন্যান্য সামরিক ও বেসামরিক পাকিস্তানি কর্মকর্তারা তাদের সন্তোষ প্রকাশ করছেন। বিশেষ করে ভারতের প্রতিবাদের মুখে আমেরিকা পাকিস্তানের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার লক্ষ্যে সাহায্যের প্রতিশ্রুতির জন্য পাকিস্তানের কর্মকর্তারা তার জন্য কৃতজ্ঞ।৩৬ টেলিগ্রামে বলা হয়,
অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে যে, প্রেসিডেন্ট নিক্সনের সঙ্গে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার আসন্ন বৈঠকের সময় ইয়াহিয়া হয়তাে বাড়তি কিছুটা সুবিধা চাইবেন। এ
পৃষ্ঠা: ৭১
ব্যাপারে তাকে নিরুৎসাহিত করার সবরকম প্রচেষ্টা চালানাে হচ্ছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ইয়াহিয়া এ ব্যাপারে কোনাে আবেদন জানালে তাতে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
আলােচনাকালে মনে হয়েছে বাড়তি অস্ত্রশস্ত্র চাইলে যে সমস্যার সৃষ্টি হবে তার চাইতে বড় সমস্যা হবে লেনদেনের সামর্থ্যের প্রশ্নে। ইয়াহিয়াসহ পাকিস্তানের বেশিরভাগ সিনিয়র অফিসার বলছেন যে, অর্থনৈতিক দিক দিয়ে পাকিস্তান সংকটের মধ্য দিয়ে চলছে এবং তারা পেমেন্টের মধ্যে কিছুটা অতিরিক্ত সুবিধা চান। তারা খুব ভালােভাবেই জানেন যে, লেনদেনের শর্ত হলাে নগদ ক্যাশ অথচ প্রতিটি আলােচনার সময় তারা কোনাে না কোনাে ধরনের বিকল্প সুবিধার কথা তুলছেন।
এটা সত্য যে অভ্যন্তরীণ ব্যয় মেটাতে এবং আমদানি ব্যয় পরিপূরণে পাকিস্তানকে প্রচুর অর্থ খরচ করতে হচ্ছে। কনসাের্টিয়াম সদস্যরা বারবার এক্সচেঞ্জ রেট রিফর্মের জন্য তাগাদা দিচ্ছেন এবং দাবি তােলা হচ্ছে আমদানি ব্যবস্থা নমনীয় করার… যেসব করতে গেলে প্রচুর পরিমাণে নগদ অর্থের প্রয়ােজন। পাকিস্তানকে মিলিটারি-বহির্ভূত ফান্ড থেকে মিলিটারি সামগ্রী ক্রয় করতে হবে এবং এর জন্য কত টাকা প্রয়ােজন হবে তা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে লেনদেন চূড়ান্ত করলেই কেবল জানা যাবে।
শেষ পর্যন্ত যদি পাকিস্তানের তহবিলের অভাবে এই লেনদেন বাস্তবায়িত হয় তা হলে দু’পক্ষেরই নিদারুণ সমস্যা হবে। আনুষ্ঠানিক ঘােষণার পরে পাকিস্তানের জনমনে যে উদ্দীপ্ত ভাবের সৃষ্টি হয়েছে লেনদেন ব্যর্থ হলে তার ওপর চরম আঘাত পড়বে এবং তা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে পাকিস্তান সরকারকে সমূহ ঝামেলার সম্মুখীন হতে হবে।
পাকিস্তানকে এ ব্যাপারে বারবার সতর্ক করে দেয়া হয়েছে যে, যুক্তরাষ্ট্রের দেয়া প্রস্তাব বাড়ানাে বা পরিবর্তন করা যাবে না, এবং যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে পূর্ণ তালিকা, দাম, শর্ত ইত্যাদি পাওয়ার আগে পাকিস্তান সরকারের কাছ থেকে কোনাে চূড়ান্ত প্রস্তাব না পাঠানাের অনুরােধ জানানাে হয়েছে। তবে বি-৫৭ এর ব্যাপারে পাকিস্তানের অভিমত হলাে এই যে, তারা প্রস্তাবকৃত ৭টি বি-৫৭ বােমারু বিমান নিতে চাচ্ছেন না। এর বদলে তারা চাচ্ছেন একটি ফুল স্কোয়াড্রন এফ-৫ বিমান যার দাম পড়বে ১২টি ফাইটার বিমানের সমান। যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, তারা যদি বাকি ৬টি এফ-১০৪ বিমান না নেয় তা হলে এ প্রস্তাব বিবেচনা করা যেতে পারে। পাক প্রতিরক্ষা সচিবের সঙ্গে এ ব্যাপারে কথা হওয়ার পর তিনি স্পষ্টতই বলেছেন যে, তারা এফ-১০৪ এর বদলে এফ৫ চান এবং বি-৫৭ এর বদলেও তারা সমমূল্যের এফ-৫ নিতে আগ্রহী। এতে মনে হচ্ছে যে, পাকিস্তান ভারতীয় এলাকায় বােমা হামলা চালানাের জন্য বেশি
পৃষ্ঠা: ৭২
সক্ষমতা অর্জন করতে চাচ্ছে না। অন্যদিকে যখন তারা চারটি মেরিটাইম এয়ারক্রাফট পি-৩ এর দাম দেখবে তখন তাদের কাছ থেকে আরেক দফা শক আসবে বলে মনে করা হচ্ছে।
৮ নভেম্বর রাষ্ট্রদূত ফারল্যান্ড প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সঙ্গে দেখা করতে গেলে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া তার এফ-৫ এর প্রসঙ্গ আবার উত্থাপন করেন। মার্কিন রাষ্ট্রদূত প্রেসিডেন্টকে জানান যে, পাকিস্তানে দেয়া এফ-১০৪ গুলাে বিশেষভাবে তৈরি এবং কেবল জর্ডানের বাদশাহ হােসেনের বিশেষ আদেশে সেগুলাে তৈরি করা হয়েছিল। এখন অন্যান্য এফ-১০৪ গুলাে মডিফাই করে পাকিস্তানের হাতে থাকা ফাইটারের মতাে করে বানাতে গেলে অনেক বেশি এবং মাত্রাতিরিক্ত খরচ পড়ে যাবে। অত্যন্ত আশ্চর্যজনকভাবে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া বলেন যে, পাকিস্তানে এফ-১০৪ গুলাে জর্দানকে দিয়ে তার রিপ্লেসমেন্ট হিসেবে জর্দান থেকে এফ-৫ এর ব্যবস্থা করলে পাকিস্তান এবং জর্দান উভয়কেই সন্তুষ্ট করা যেতে পারে।৩৭
ফারল্যাণ্ড তাকে জানান যে এ নিয়ে মার্কিন সরকারি মহলে বিস্তারিত আলাপ করে এর সম্ভাবনার দিকটি খতিয়ে দেখতে হবে।
উল্লেখযােগ্য যে, জর্দান ছয়টি এফ-১০৪ ও ৫ এবং একটি এফ-১০৪ বি বিমান চেয়েছিল এবং বিষয়টি ফারল্যান্ড আগেই সেক্রেটারি রজার্সের গােচরে এনেছিলেন।৩৮
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া এফ-১০৪ এর বদলে এ কারণে এফ-৫ বিমান চাইছিলেন যে তার ধারণা এফ-১০৪ খুব তাড়াতাড়ি বাতিল হয়ে যাবে এবং পাকিস্তান অত্যাধুনিক দূরপাল্লার ফাইটার বিমানের চাইতে স্বল্পপাল্লার দ্রুত আবর্তনে সক্ষম বিমান কামনা করছিল। এ সময় প্রেসিডেন্টকে জানানাে হয় যে, এয়ারফোর্সের প্রধান এয়ার মার্শাল জেনারেল রহিম একসময়ে মার্কিন জেনারেল কলিনের সঙ্গে আলােচনার সময় বি-৫৭ এর ব্যাপারে অনাগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন। প্রেসিডেন্ট বলেন, তার অর্থ এই নয় যে পাকিস্তান বি-৫৭ এর কথা একেবারে অস্বীকার করেছে। তবে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া মার্কিন প্রস্তাবিত ৩০০ আর্মড পারসােনেল ক্যারিয়ারের ব্যাপারে দারুণ আগ্রহ দেখিয়ে বলেন যে, প্রতিরক্ষা সচিব গিয়াসউদ্দিনকে সত্বর এ ব্যাপারে আলােচনা ও দেনদরবারের জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্র ভয় করছিল যে, পাকিস্তানকে একবারের মতাে ব্যতিক্রমধর্মী কোনাে সামরিক সহযােগিতা দেয়া হলে ভারতও একবারের মতাে একটা সামরিক সরবরাহ চাইতে পারে। ডিসেম্বর ২৪, ১৯৭০ রাষ্ট্রদূত ফারল্যান্ড কিসিঞ্জারের কাছে একটি মেমােরেন্ডাম পাঠালে সেটাই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। মেমােরেন্ডামে বলা হয় যে, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া সাহায্যের তালিকায় পরিবর্তন নিয়ে আসতে বারবার চাপ দিচ্ছেন এবং নগদ অর্থের বদলে ক্রেডিটে অস্ত্র পেতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন। এরই
পৃষ্ঠা: ৭৩
মধ্যে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ফারল্যান্ডের কাছে নিজের পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে বলেছেন যে, পাকিস্তান আসলে ফ্যান্টম বােমারু বিমান চেয়েছিল। কিন্তু সেগুলাে অত্যন্ত দামি বিধায় এফ-১০৪-এ এবং বি-৫৭-এর পরিবর্তে এফ-৫ বিমান চাচ্ছে। এমনকি এর জন্য তারা বি-৫৭ এর পরিবর্তে হলেও সবগুলাে এফ-৫ পেতে চায়। তিনি অত্যন্ত স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন তার এখন নগদ অর্থে অস্ত্র কেনার সঙ্গতি নেই এবং প্রয়ােজনবােধে তিনি বিষয়টি সরাসরি প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে জানানাের অনুরােধ করেছেন।৩৯ ফারল্যান্ড তার মেমােতে বলেন,
ভারত যে সমস্যা করছে তা পাকিস্তানের সমস্যার চাইতে কম জটিল, কিন্তু তা দক্ষিণ এশিয়ার যুক্তরাষ্ট্রের ভাবমূর্তির ব্যাপারে অনেক বেশি ক্ষতিকর। এর আগে একবার আনুষ্ঠানিকভাবে ভারত কমপক্ষে ২৪টি স্কাইহক বিমান কেনার আগ্রহ দেখিয়েছিল, যাতে তারা নিজেদের এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারের পুরনাে যুদ্ধবিমানগুলাে রিপ্লেস করতে পারে। এক্ষণে সােভিয়েত থেকে নিশ্চিত আশ্বাস সত্ত্বেও তারা পাকিস্তানকে ব্যতিক্রমধর্মী সাহায্যের ধোয়া তুলে স্কাইহকের ব্যাপারে আগ্রহ দেখাচ্ছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে যে, ভারত তার নিজস্ব নৌবহর গড়ে তুলতে চায় এবং তাদের ক্যারিয়ারের জন্য উপযুক্ত বিমান সােভিয়েতের নেই।
এক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান এমন হওয়া উচিত যে, পাকিস্তানকে এ প্যাকেজের জন্য কোনাে অবস্থাতেই ক্রেডিট দেয়া যাবে না। স্টেট ডিপার্টমেন্ট থেকে যুক্তি দেখানাে হয়েছে যে, এর ফলে রাষ্ট্রদূত কিটিংকে বিব্রত করা হচ্ছে, কারণ তিনি ইতােমধ্যেই প্রচার করেছেন এটা একটা নগদ অর্থের লেনদেন। এর জন্য অবশ্য অন্য কোনাে বিকল্প ব্যবস্থা নেয়ার কথা বিবেচনা করা যেতে পারে।
এতে বলা হয়,
স্টেট ডিপার্টমেন্ট এবং প্রতিরক্ষা বিভাগ উভয়ে একমত যে সবগুলাে এফ-১০৪ এর বদলে এফ-৫ দিয়ে দিলে কোনাে অসুবিধা নেই এবং তা হবে প্রেসিডেন্টের সিদ্ধান্তেরই অনুরূপ। এমনকি পাকিস্তানের কাছে দেয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী বি৫৭ এর বদলেও এফ-১০৪ দিয়ে দেয়া যেতে পারে। এফ-৫ হলাে একটি প্রতিরক্ষামূলক বিমান এবং পাকিস্তান বি-৫৭ এর বদলে এফ-৫ পেলে তাতে পাকিস্তানের আক্রমণ করার ক্ষমতা কমবে ফলে নয়াদিল্লির কাছেও তা বেশি গ্রহণযােগ্য হবে। অন্যদিকে প্রতিরক্ষা বিভাগ একধাপ এগিয়ে গিয়ে বলে যে, পাকিস্তানের সবগুলাে বি-৫৭ বদল করে৪০ এফ-৫ দিয়ে দিলেও প্রতিরক্ষা বিভাগের তাতে আপত্তি নেই।
পৃষ্ঠা: ৭৪
তবে তা করতে গেলে বােধ হয় আরেক দফা প্রেসিডেন্টের সিদ্ধান্তের প্রয়ােজন হবে।
প্রতিরক্ষা বিভাগ থেকে সন্ডার্স বলেন, এ মুহূর্তে পাকিস্তানে আর্থিক সংকটের বিবেচনায় সবচাইতে প্র্যাকটিক্যাল সিদ্ধান্ত হতে পারে পাকিস্তানকে দেয়া অমারণাস্ত্র প্রতিরক্ষা সরঞ্জামের বিপরীতে ফরেন মিলিটারি সেলস বা এম এফ এস এর পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়া। সে অনুদানের পরিমাণ বর্তমান ৫ মিলিয়ন ডলার থেকে ১০ মিলিয়ন ডলারে বাড়ানাে যেতে পারে। পাকিস্তানকে আরাে বলা যেতে পারে যে, তারা যেন একবারে সবকিছু না নিয়ে কেনার সময়সীমা বাড়িয়ে নেয়। এ ব্যবস্থায় পাকিস্তানের বােঝা আংশিকভাবে কমলেও এর মাধ্যমে দেখানাে হবে যে যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের অর্থনৈতিক দুর্যোগের বেলায় ছিল বাস্তবেই সহানুভূতিশীল।
১২ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রদূত রজার্স স্টেট ডিপার্টমেন্টে পাঠানাে এক টেলিগ্রামে শেষবারের মতাে প্রেসিডেন্টের ক্রেডিট দানের অনুরােধের পক্ষে ওকালতি করেন এবং নিদেনপক্ষে আর্মড পারসােনেল ক্যারিয়ারকে ননলেথাল সামগ্রীর তালিকাভুক্ত করে এফ এম এস অনুদানের আওতায় আগের প্রস্তাবিত ৩০০ আর্মার্ড পার্সোনেল ক্যারিয়ার বিক্রির সুপারিশ করেন।৪১ কিন্তু স্টেট ডিপার্টমেন্ট থেকে ১০ ফেব্রুয়ারি এক পাল্টা টেলিগ্রামে৪২ চূড়ান্তবারের মতাে নগদ অর্থের বদলে ক্রেডিটে অস্ত্র বিক্রির প্রস্তাব নাকচ করে দেয়া হয় এবং আর্মার্ড পার্সোনেল ক্যারিয়ারকে মারণাস্ত্রের তালিকাভুক্ত হিসেবে বহাল রাখার স্টেট ডিপার্টমেন্ট এবং প্রতিরক্ষা বিভাগ উভয়ের সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেয়া হয়। ২৫ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রদূত ফারল্যান্ড প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সঙ্গে দেখা করেন এবং যুক্তরাষ্ট্রের মনােভাব ইয়াহিয়াকে জানিয়ে দেন।
পৃষ্ঠা: ৭৫
তথ্য নির্দেশিকা
১. পিয়ারে ট্রিসটাম, মিডল ইস্ট ইস্যুজ, দ্য সেকেন্ড কাশ্মীর ওয়ার ১৯৬৫, এবাউট ডট কম গাইড।
২. প্রাগুক্ত।
৩. জন ফ্রিকার, ফ্লাইট গ্লোবাল, এভিয়েশন হিস্ট্রি, ১৯৬৯-২০১১
৪. থমাস এম লিওনার্ড, টেইলর অ্যান্ড ফ্রান্সিস, এনসাইক্লোপিডিয়া অব ডেভেলপিং ওয়ার্ল্ড, পৃ ৮০৬।
৫. মেলভিন গুডম্যান, ইউ এস পাকিস্তান রিলেশন্স, দ্য টেইল স্টিল ওয়াগস দ্য ডগ, টুথ আউট, ১৪ জুন ২০১১।
৬. ফরেন রিলেশনস অব দ্য ইউনাইটেড স্টেট, ১৯৬৯-৭৬, টেলিগ্রাম নং ৬৪৮৪। ন্যাশনাল আর্কাইভস, আর জি ৫৯, ডি ই এফ ১২-৫ পাকিস্তান, গােপনীয়।
৭. ফরেন রিলেশন্স দলিল, ভলিউম ৭, ডকুমেন্ট ৩১ , নিক্সন প্রেসিডেন্সিয়াল মেটেরিয়ালস, বক্স ১৩২০ এন এস সি আনফাইল্ড মেটেরিয়ালস, ১৯৬৯-৭৯, গােপনীয়।
৮. মিলিটারি সাপ্লাই পলিসি টুওয়র্ড সাউথ এশিয়া ইন দ্য কনটেকস্ট অব জেনারেল ইউ এস পােসচুর দেয়ার, রিভিউ গ্রুপের প্রতিবেদন, এন এস সি ফাইলস, বক্স-এইচ ০৪০।
৯. কন্টি লং এমেন্ডমেন্ট ছিল ১৯৬৮ সালের ফরেন এসিস্টেন্ট অ্যান্ড রিলেটেড এপ্রােপ্রিয়েশন অ্যাক্ট-এর ১১৯ ধারা। এতে প্রেসিডেন্টকে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল যে গ্রিস, তুরস্ক, ইরান, ইসরায়েল, চীন, ফিলিপাইন ও কোরিয়া ছাড়া অন্য কোনাে দেশে যে পরিমাণে অর্থনৈতিক সাহায্য দেয়া হবে তার চাইতে বেশি পরিমাণে সামরিক সাহায্য দেয়া যাবে না।
১০. সিমিংটন এমেণ্ডমেন্ট হলাে ১৯৬৭ ফরেন অ্যাসিস্ট্যান্ট অ্যাক্টের ওপর ৬২০ (এস) সংশােধনী, যার মাধ্যমে কোনাে দেশ সামরিক ব্যয় মাত্রাতিরিক্ত বাড়ালে সে দেশে সামরিক সাহায্য বন্ধ করতে প্রেসিডেন্টকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
১১. আগে এটা প্রয়ােজন ছিল যে, প্রেসিডেন্ট যে পরিমাণে আধুনিক সমরাস্ত্র পাঠাবেন তার সমপরিমাণ মূল্যের অর্থনৈতিক সহযােগিতা অনুদান বাতিল করবেন। তা নমনীয় করে পরে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে প্রেসিডেন্ট যে পরিমাণে অর্থনৈতিক সাহায্য বন্ধ করবেন সামরিক অনুদানের বেলায় সেই পরিমাণের আর্থিক মূল্যমান বিবেচনা করা হবে। অন্যদিকে আইন ছিল যে, কোনাে দেশ অতিরিক্ত অর্থ সামরিক কাজে ব্যয় করলে সে দেশে সামরিক সাহায্য বন্ধ রাখা হবে। পরে সেখানে নির্দেশনা দেয়া হয় যে প্রেসিডেন্ট অর্থনৈতিক সাহায্য বরাদ্দের সময় সে দেশে সামরিক ব্যয়ের ধরন নিরীক্ষণ করে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবেন।
১২. ২৫ নভেম্বর ‘৬৯ ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিল রিভিউ গ্রুপের বৈঠকের ধারা বিবরণী; দলিল নং-৪৩, নিক্সন প্রেসিডেন্সিয়াল মেটেরিয়ালস, বক্স এইচ-১১১।
পৃষ্ঠা: ৭৬
১৩. বৈঠকে আরাে উপস্থিত ছিলেন চিফ অব স্টাফ-১২ জেনারেল উংগার, স্টেট ডিপার্টমেন্টের উইলিয়াম আই কারগাে, ডােনাল্ড ম্যাকহেনরি, ক্রিস্টোফার ভ্যান হলেন, অফিস অব ইমারজেন্সি প্রিপেয়ার্ডনেসের হ্যাকন লিনজর্ড, ইউ এস ইনফরমেশন এজেন্সির ফ্র্যাংক শেক্সপিয়ার, প্রতিরক্ষা বিভাগের এন এস সি স্টাফ রিচার্ড এ ওয়েথার, হ্যারল্ড এইচ সন্ডার্স ও রিচার্ড টি কেনেডি এবং সি আই এ-র আর জ্যাক স্মিথ ও জিন ডব্লিউ ডেভিস।
১৪. ন্যাশনাল আর্কাইভস, নিক্সন প্রেসিডেন্সিয়াল মেটেরিয়ালস, বক্স-৬২৩।
১৫. ডকুমেন্ট নং ৪৫। কিসিঞ্জারের কাছ থেকে প্রেসিডেন্ট নিক্সনের কাছে পাঠানাে গােপন মেমাে । নিক্সন প্রেসিডেন্সিয়াল মেটেরিয়ালস, এনএসসি ফাইলস, বক্স-৬২৪।
১৬. নিক্সনকে লেখা ইয়াহিয়া খানের চিঠির অংশবিশেষ। চিঠিতে আরব-ইসরায়েল-জর্দান সম্পর্কিত মধ্যপ্রাচ্য সংক্রান্ত কিছু বিষয়েরও উল্লেখ ছিল, যা এখানে প্রাসঙ্গিক। নিক্সন। প্রেসিডেন্সিয়াল মেটেরিয়ালস, এন এস সি ফাইলস, বক্স-৭৫৯।
১৭. ন্যাশনাল আর্কাইভস, আর জি ৫৯, সেন্ট্রাল ফাইলস, ১৯৭০-৭৩, ডি ই এফ ১২-৫ পাক, গােপনীয়।
১৮. হােয়াইট হাউসে পাঠানাে হেনরি কিসিঞ্জারের মেমােরেন্ডাম, ন্যাশনাল আর্কাইভস, বক্স-৬২৪, কান্ট্রি ফাইলস ভলিউম, ১ ডিসেম্বর ‘৬৯—সেপ্টেম্বর ‘৭০।
১৯. এন এস সি ফাইলস, বক্স-৬৪১, কান্ট্রি ফাইলস, ভলিউম-১, ১৯৭০।
২০. আলােচনার মেমােরেন্ডাম, ফারল্যান্ডের সঙ্গে লেয়ার্ডের বৈঠক, ২১ মে, ১৯৭০, ওয়াশিংটন ন্যাশনাল রেকর্ড সেন্টার, ও এস ডি/আইএস ফাইলস-এফ আর জি ৭৩, বক্স-২২।
২১. প্রেসিডেন্টের অ্যাসিস্ট্যান্ট ফর ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাফেয়ার্স হেনরি কিসিঞ্জারের প্রেসিডেন্ট নিক্সনের কাছে পাঠানাে জরুরি মেমােরেন্ডাম। জুন ১১, ১৯৭০। কিসিঞ্জার প্রথম প্রস্তাবটি সমর্থন করে মেমােরেন্ডামে ইনিশিয়াল দেন এবং বি-৫৭ ও ট্যাংকের প্যাকেজটি প্রথম প্যাকেজের সঙ্গে যুক্ত করে সমন্বিত একটি মাত্র প্যাকেজ বানানাের প্রস্তাব দেন। নিক্সন প্রেসিডেন্সিয়াল মেটেরিয়ালস , এন এস সি ফাইলস, বক্স-৬৪১, কান্ট্রি ফাইলস, সাউথ এশিয়া ভলিউম-১, ১৯৭০, গােপনীয়।
২২. লাইব্রেরি অব কংগ্রেস ম্যানাসস্ক্রিপ্ট ডিভিশন, কিসিঞ্জার পেপারস, বক্স-৩৬৩, টেলিফোন সংলাপ, বর্ণানুক্রমিক বিন্যাস, গােপনীয় হিসেবে চিহ্নিত নয়।
২৩. প্রাগুক্ত।
২৪. পরে তাকে জানানাে হয় যে, পাকিস্তানে রাষ্ট্রদূত ফারল্যান্ডের কাছে একই ধরনের মেমাে পাঠানাে হবে যাতে তিনি রাওয়ালপিন্ডিকে এ ব্যাপারে যথাসময়ে অবহিত করতে পারেন।
২৫. ১৭ জুন, ১৯৭০ ওয়াশিংটনে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত হিলালীর সঙ্গে কিসিঞ্জারের বৈঠকের ধারা বিবরণী, ন্যাশনাল আর্কাইভস, নিক্সন প্রেসিডেন্সিয়াল, এন এস সি ফাইলস বক্স নং ১০২৬, টপ সিক্রেট।
২৬. টেলিগ্রামের বাকি অংশ ছিল আগের দিনের আলােচনার বিষয়বস্তুর অনুরূপ। সে কারণে তা আর পুনরাবৃত্তি করা হয়নি।
২৭. ন্যাশনাল আর্কাইভস, আর জি ৫৯, সেন্ট্রাল ফাইলস, ১৯৭০-৭৩ ডি ই এফ, ১২-৫, পাক সিক্রেট ও ইমিডিয়েট, টেলিগ্রাম নং- ৯৬২৩৬।
২৮. হেমেন রায়, দি এনডিউরিং ফ্রেন্ডশিপপ, অভিনব পাবলিকেশন্স, দিল্লি, ১৯৮৯
পৃষ্ঠা: ৭৭
২৯. ঘটনাবলির বিশ্লেষণে রাষ্ট্রদূত ফারল্যান্ডের রেকর্ড। ডিপার্টমেন্ট অব স্টেট, এন ই এ/পি এ বি ফাইলস, লট ৭৮ ডি ৯৮, মিলিটারি সাপ্লাই, পাক রিকোয়েস্ট। গােপনীয়। ইয়াহিয়ার সঙ্গে ২০ জুন ফারল্যান্ডের বৈঠকের ফলাে-আপ।
৩০. টেলিগ্রাম নং ৭৭৫৪, ন্যাশনাল আর্কাইভস, আর জি ৫৯, ডি ই এফ ১২-৫।
৩১. পাকিস্তানের মার্কিন দূতাবাস থেকে স্টেট ডিপার্টমেন্টে পাঠানাে টেলিগ্রাম। অক্টোবর ৫, ১৯৭০; টেলিগ্রাম নং ৭৮০৫। ন্যাশনাল আর্কাইভস, আর জি ৫৯, সেন্ট্রাল ফাইলস, ডি ই। এফ ১২-৫, পাক, গােপনীয়।
৩২. সিসকোর পাঠানাে তথ্য, মেমােরেন্ডাম, অক্টোবর ৯, ১৯৭০; ডিপার্টমেন্ট অব স্টেট নিয়ার ইস্ট অ্যান্ড সাউথ এশিয়ান অ্যাফেয়ার্স ফাইলস, লট ৭৭, ডি ৫১, ডি টি এস, গােপনীয়।
৩৩. দিল্লিতে ছিলেন ভারতের ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্র সচিব ও ওয়াশিংটনে ছিলেন ভারতের মন্ত্রী পর্যায়ের একজন কূটনীতিবিদ।
৩৪. সিসকোর পাঠানাে তথ্য মেমােরেন্ডাম, প্রাগুক্ত।
৩৫. হিলালী, সেন্টার ফর গ্লোবাল ডেভেলপমেন্ট, ২০১১। সিক্সটি ইয়ার অব ইউ এস এইড টু পাকিস্তান, দ্য গার্ডিয়ান, জুলাই ১১, ২০১১। মুদ্রাস্ফীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ২০০৯ সালের অঙ্কে সংখ্যাগুলাে সমন্বয় করা হয়েছে।
৩৬. টেলিগ্রাম নং ৮১৪১, পাকিস্তানে মার্কিন দূতাবাস থেকে স্টেট ডিপার্টমেন্টে সিডনি সােবারের পাঠানাে তারবার্তা, অক্টোবর ১৬, ১৯৭০; ন্যাশনাল আর্কাইভস, আর জি ৫৯, গােপনীয়।
৩৭. টেলিগ্রাম নং ৮৬৯০, নভেম্বর ৮, ১৯৭০; ০৫৩৫। ন্যাশনাল আর্কাইভস, আর জি ৫৯, সেন্ট্রাল ফাইলস ১৯৭০-৭৩।
৩৮. প্রাগুক্ত।
৩৯. ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিল স্টাফ হ্যারল্ড সন্ডার্সের মেমােরেন্ডাম, ডিসেম্বর, ১৯৭০।
৪০. সর্বমােট ৩৮টি।
৪১. টেলিগ্রাম নং ১২৯১।
৪২. টেলিগ্রাম নং ২১২০১।
পৃষ্ঠা: ৭৮
Ref: মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেনেটর গোপন দলিল – জগলুল আলম