জীবনচিত্র নামঃ ডা. মাহতাবউদ্দিন আহমেদ
Dr. Mahtabuddin Ahmed
ডাকনামঃ মাতু
পিতার নামঃ মো, আফতাবউদ্দিন আহমেদ
পিতার পেশাঃ ব্যবসায়
মাতার নামঃ সখিনা বেগম
ভাইবোনের সংখ্যাঃ আট ভাই ও এক বোন; নিজম-পঞ্চম
ধৰ্মঃ ইসলাম
স্থায়ী ঠিকানাঃ গ্রাম-মধ্য চড়াইল, ইউনিয়ন-কালিন্দী,
ডাকঘর/উপজেলা-কেরানীগঞ্জ, জেলা-ঢাকা
শহীদ ডা. মাহতাবউদ্দিন আহমদ
নিহত হওয়ার সময় ঠিকানাঃ ঐ
জন্যঃ ১০ ফেব্রুয়ারি ১৯৩৬; কেরানীগঞ্জ, ঢাকা
শিক্ষাগত যোগ্যতাঃ
ম্যাট্রিকঃ ১৯৪৩, প্রথম বিভাগ, জামালপুর সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়, জামালপুর
আইএসসিঃ ১৯৪৬, প্রথম বিভাগ, ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজ
এমবিবিএসঃ ১৯৫৮, ঢাকা মেডিকেল কলেজ
শখঃ খেলাধুলা, মুদ্রা সংগ্রহ!
চাকরির বর্ণনাঃ পার্ক ডেভিস মেডিসিন কোম্পানি, করাচি। পরবর্তীতে প্রাইভেট প্র্যাকটিশনার
হত্যাকারীর পরিচয়ঃ পাকিস্তান সেনাবাহিনী
নিহত হওয়ার তারিখঃ ২ এপ্রিল ১৯৭১
মরদেরঃ
প্ৰাপ্তি স্থানঃ কেরানীগঞ্জে নিজ বাড়ির পুকুরপাড়
প্রাপ্তি তারিখঃ ২ এপ্রিল ১৯৭১
সন্ধানদাতার পরিচয়ঃ মো. নাসিরউদ্দিন
কবরস্থানঃ কসাইভিটা (হাউলি) কবরস্থান, ঢাকা
স্মৃতিফলক, স্মৃতিসৌধঃ নেই
মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হিসেবে সাহায্য/দান/পুরস্কারঃ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সরকার থেকে ১৯৭৯ সালে ২০০০ টাকা
স্ত্রীর নামঃ মাজেদা বেগম
সন্তান-সন্ততিঃ এক পুত্র ও তিন কন্যা
মো. মইনুল আলম খোকন, বিকম, ব্যবসায়ী
মাসুদা বেগম, বিএ, গৃহিনী
মোরশেদা বেগম শীলা, এইচএসসি, গৃহিণী
খোরশেদা বেগম মিলা, এইচএসসি, গৃহিণী
মুক্তিযুদ্ধে শহীদ নিকটাত্মীয়ঃ
মমিনুল হুদা (শহীন ডা. মাহতাবউদ্দিনের ভাগ্নে)
তথ্য প্রদানকারী
মো. মইনুল আলম খোকন
শহীদ চিকিৎসকের
১৩,
মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ ২৮৫
আমার বাবা
শহীদ ডা. মাহতাবউদ্দিন আহমেদ
মো. মইনুল আলম খোকন
২ এপ্রিল ১৯৭১। প্রতিদিনের মতো আজ আর আজান বা পাখির গানে ঘুম ভাঙল না। রাত শেষ হতেই ভোরে শুরু হলো কামান, মেশিনগান, আর মর্টারের গুলি। সমস্ত কেরানীগঞ্জবাসীর ঘুম ভেঙে গেল এ গুলির শব্দে। মানুষেরা ভয়ে-আতঙ্কে আঁতকে উঠল, আমরাও ভয়ে-আতঙ্কে হতবিহ্বল হয়ে পড়লাম। কিন্তু আমার পিতা ডা. মাহতাবউদ্দিনের বুঝতে দেরি হলো না যে, এ পাকবাহিনীর আক্রমণ। অঘোষিত কার্ফু জারি হয়েছে। দেখামাত্র গুলি।
২৫ মার্চ শুক্রবার কালরাতে ঢাকা শহরে হাজার হাজার মানুষকে পাখির মতো গুলি করে মেরেছে। ঠিক পরের শুক্রবার ২ এপ্রিল কেরানীগঞ্জে আক্রমণ করলো বর্বর হানাদার পাকবাহিনী। কেরানীগঞ্জের মানুষ ভয়ে-আতঙ্কে দিগ্বিদিক ছোটাছুটি করে পালাতে লাগলো। বৃষ্টির মতো গুলি ছুটছে।
ডা. মাহতাবউদ্দিন ঘরে বসে থাকলেন না। তিনি রাস্তায় বেরিয়ে রাস্তার ছোটাছুটি করা মানুষদের ঘরে এনে বসালেন। গ্রামের মানুষদের ঘর থেকে বের হতে বারণ করে বললেন, ‘মরতে হয় মা, বাবা, ভাই-বোন নিয়ে বাড়িতে মরব। রাস্তায় গেলে এলোমেলো গুলি এসে লাগতে পারে। দেখামাত্র গুলি করবে। তোমরা ঘর থেকে বের হয়ো না।’ তিনি গ্রামের প্রায় প্রতি বাড়িতেই গিয়ে সবাইকে সাবধান করে এলেন। আসার সময় দেখলেন রাস্তায় একজন পায়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে কাতরাচ্ছে। পাশে একজন কাঁদছে। হয়তো তার কোনো স্বজন হবে। সে কী করবে বুঝে উঠতে পারছিল না। আমার আব্বা দেখলেন, পা দিয়ে রক্ত ঝরছে। তখন ঐ লোকটিকে ধরাধরি করে সাথে নিয়ে আমার ছোট চাচার। ঘরে নিয়ে শুইয়ে দিলেন। আমার মাকে বললেন, ‘গজ-ব্যান্ডেজ বাক্সটা দাও।’ মা ভয়ে আঁতকে উঠলেন, বললেন, কী হয়েছে আপনার? আব্বা বলেন, নাসুর ঘরে (ছোট চাচা) একজনকে শুইয়ে এসেছি; ওর পায়ে গুলি লেগেছে, রক্ত ঝরছে; গুলি বের করতে হবে। রক্ত বন্ধ করতে হবে, না হলে লোকটা মারা যেতে পারে।’ মা ছোট একটি বাক্স বের করে দিলেন।
২৮৬ মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ
শহীদ ডা. মাহতাবউদ্দিন আহমেদ
নিয়ে চলে গেলেন আব্বা। লোকটার গুলি বের করে ব্যান্ডেজ বেঁধে দিয়ে এসে ঘরে বসলেন। কিছুক্ষণ পর পাশের বাড়ির আমার মামাতো ভাই মমিনুল হুদা, আরও কয়েকজন এসে আব্বাকে ডাক দিয়ে বলল, ডাক্তার সাব ঘরে বসে থাকবেন? বাইরে আসেন, শুনলাম মিলিটারিরা মুসলমানদের মারে না, হিন্দুদের খুঁজতেছে। আমরা বলি, ‘এখানে হিন্দু নেই। এইটা মুসলিম এলাকা।’ বলার সাথে সাথে আব্বা মাকে বললেন, ‘টুপিটা দাও।’ টুপি নিয়ে বেরিয়ে গেলেন। এটাই মার সাথে তাঁর শেষ কথা। মিলিটারিরা গ্রামে ঢুকে আমাদের পেছনের বাড়িতে কাউকে না পেয়ে আগুন লাগালো। সেই বাড়ির লোকজন সকালে পালিয়েছে। সে আগুন আমাদের বাড়িতে লাগল। প্রথমে আমার দাদির ঘর পুরাটাই পুড়ে ছাই হয়ে গেল। আমাদের ঘরের দরজা-জানালায় আগুন লাগলো, আমরা পেছনের দরজা দিয়ে পাশে মামার বাড়িতে চলে যাই। তাঁর কিছুক্ষণ পরে কাছেই কয়েকটা গুলির শব্দ শুনতে পেলাম। পরে জানতে পারলাম সেই মামাত ভাই মমিনুল হুদা গুলিতে মারা গেছেন।
আমাদের বাড়ির উত্তর দিকে একটা পুকুর। আমার আব্বা জুমার নামাজের জন্য তখন ঐ পুকুরে ওজু করছিলেন। আব্বা দেখলেন পুকুরের ঐ পাড়ে আমার ফুফাত ভাই রাব্বানীকে মিলিটারিরা ধরে এনেছে এবং তাঁর সাথে কথা বলছে। আব্বার মনে হলো রাব্বানী ভাইকে মারার জন্য ধরে এনেছে, যাই গিয়ে দেখি ওকে বাঁচানো যায় কি না? এই চিন্তা করে পুকুরের কিনার দিয়ে পুকুর পার হতে চেয়েছিলেন; কিন্তু পুকুর আর পার হতে পারেননি। বরং একেবারেই পরপারে চলে গেলেন। মিলিটারিরা বলে উঠল ‘ঠায়রো!’ ফুফাতো ভাইকে জিগ্যেস করলো, ‘ইয়ে আদমি কোন হ্যায়?’ ফুফাত ভাই বললো, ‘এ আদমি ডাক্তার ও গ্রামের মেম্বার হ্যায়।’ এ কথা শুনে ভাইকে বলল, ‘তোম ঘরমে যাও।’ বলে আব্বাকে সারেন্ডার হতে বললো, আব্বা দুই হাত উঁচু করে দাঁড়াতেই ফায়ার করল। নিমিষেই আব্বা মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন। ছয়টা গুলি তাঁর শরীর ভেদ করে চলে গেল। পুকুরপাড়েই তাঁর জীবনাবসান ঘটলো। এ পাড়ে পড়ে রইল তার মরদেহ, ওপারে চলে গেল তার আত্মা। আমার ছোট চাচা আগুন নেভানোর জন্য পুকুরঘাটে পানি আনতে গিয়ে দেখেন, আব্বা পুকুরপাড়ে পড়ে আছে। তখন সময় আনুমানিক বেলা ১টা কি দেড়টা হবে।
পরে মিলিটারিরা গ্রাম ছেড়ে চলে যায়। শেষ করে দিয়ে যায় আব্বার মতো হাজার হাজার কেরানীগঞ্জের নিরীহ মানুষকে। শহীদ হলেন ডা. মাহতাবউদ্দিন আহমদ। লেখা হলো কেরানীগঞ্জের ইতিহাসে হাজার শহীদের সাথে তার নাম। বিনা গোসলে, বিনা কাফনে, রক্তভেজা শার্ট ও লুঙ্গিপরা অবস্থায়ই তাঁকে দাফন করা হলো কসাইভিটা (হাউলী) কবরস্থানে। এই স্মৃতি মনে হলে আজও গা শিউরে ওঠে। চোখ জলে ভরে যায়। আজও তাঁর অনেক স্মৃতি মনে পড়ে। সব স্মৃতি তো লেখা সম্ভব নয়।
প্রাসঙ্গিক উল্লেখযোগ্র তথ্যসূত্রঃ
ক. মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, সেগুনবাগিচা, ঢাকায় সংরক্ষিত শহীদ চিকিৎসকের স্মারক সামগ্রীর ভ্ৰাম্যমাণ প্রদর্শনী
খ. স্মৃতি বিস্মৃতির ঢাকা মেডিকেল কলেজ, সম্পাদনাঃ আহমদ রফিক, প্রকাশনাঃ মাওলা ব্রাদার্স, প্রকাশকালঃ আগস্ট ২০০৩, পূ. ২৫০ ।
মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ ২৮৭
Reference: মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ – বায়জীদ খুরশীদ রিয়াজ