You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.10.15 | বাংলাদেশের বিজয় সুনিশ্চিত | বাংলাদেশ - সংগ্রামের নোটবুক
শিরোনাম সংবাদপত্র তারিখ
বাংলাদেশের বিজয় সুনিশ্চিত বাংলাদেশ,
ভলিউম ১, নম্বর ৭
১৫ অক্টোবর, ১৯৭১

 

আমাদের পাঠকদের মন্তব্যঃ বাংলাদেশের জয় সুনিশ্চিত হবার ১০টি কারণ

সামরিক
১) বাংলাদেশে পশ্চিম পাকিস্তানের দখলদার বাহিনী এখানকার ভূখণ্ডের সাথে অপরিচিত, জলবায়ুর সাথে অনভ্যস্ত এবং স্থানীয় ভাষা ও রীতিনীতির ব্যাপারে অজ্ঞ। পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্যদের গণহারে বাঙ্গালি-নিধনের ফলে, মূলত বিহারী-অধ্যুষিত ক্ষুদ্র অভিবাসী জনগোষ্ঠীর কাছ থেকেই শুধুমাত্র তারা স্থানীয় সমর্থন পেতে পারে।
২) পশ্চিম পাকিস্তানের নিরাপত্তাকে বিপদগ্রস্ত না করে, বাংলাদেশে এক লক্ষের চেয়ে বেশি পাকিস্তানি সৈন্যের অবস্থান করা সম্ভব নয়, যদি না পাকিস্তান তার সেনাবাহিনীতে নিয়োগের সংখ্যা বৃদ্ধি করে। কিন্তু পাঞ্জাবী-নিয়ন্ত্রিত সেনাবাহিনী (৮৫% এরও বেশি) অপাঞ্জাবীদেরকে সামরিক প্রশিক্ষণ দিতে ইচ্ছুক নয়, কারণ তাদের আশঙ্কা এতে করে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর মধ্যে (সিন্ধি, বেলুচি, পাঠান) সশস্ত্র বিদ্রোহের সূচনা হতে পারে। সেনাবাহিনী পাঞ্জাবের তথাকথিত “সামরিক” জেলাগুলোতে বলতে গেলে “বাধ্যতামূলকভাবে সেনাবাহিনীতে নিয়োগদান নীতি” চালু করতে বাধ্য হয়েছে।
৩) সেনাবাহিনীর মাথাব্যথা মূলত মুক্তিবাহিনী, যারা দ্রুতই সংখ্যায় বৃদ্ধি পাচ্ছে, লড়াইয়ের অভিজ্ঞতা অর্জন করছে এবং ক্রমশঃ জটিল অস্ত্রশস্ত্র ব্যবহার করছে। বছরের শেষে, মুক্তিবাহিনী সক্ষমতা অর্জন করবে দখলদার বাহিনীর চেয়েও বেশি সংখ্যক যোদ্ধা মাঠে নামানোর। এটা জানা কথা যে, গেরিলা যোদ্ধাদের ঠেকানোর জন্য সাধারণত সৈন্যসংখ্যা অন্তত পাঁচগুণ বেশি হতে হয়।
অর্থনৈতিক
৪) পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনীতিতে ঘাটতি রয়েছে। তারা পূর্ব পাকিস্তান থেকে প্রাপ্ত রাজস্ব এবং বৈদেশিক মুদ্রার ওপর খুব বেশি নির্ভরশীল। পূর্ব পাকিস্তান থেকে বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা, এমনকি পূর্ব পাকিস্তানকে নিজস্ব উচ্চমূল্যের পণ্যের বাজার হিসেবেও ব্যবহার করা পশ্চিম পাকিস্তানের পক্ষে আর সম্ভব নয়।
৫) পাকিস্তানকে দেয়া বৈদেশিক অর্থসহায়তা, যার সিংহভাগই পশ্চিম পাকিস্তানে ব্যয় হতো, পাশ্চাত্য দাতা দেশগুলো সেটি কার্যতঃ বন্ধ করে দিয়েছে (যুক্তরাষ্ট্র ব্যতীত), যার ফলে বৈদেশিক মুদ্রায় অর্ধ বিলিয়ন ডলারের ক্ষতি হয়েছে, যা পাকিস্তানের বার্ষিক আমদানির অর্ধেক। বাংলাদেশে গণহত্যার পর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস পাকিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের পাঠানো সকল সাহায্য বন্ধ করার পক্ষে, যতক্ষণ পর্যন্ত পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হচ্ছে। চীন থেকে পাওয়া সহায়তার পরিমাণ কম এবং সেটা অর্থমূল্যের মাধ্যমে পরিশোধ করা হয় না।
৬) সামরিক খাতে ব্যয়ের পরিমাণ ১৯৬৫ সালে বার্ষিক ৪০০ মিলিয়ন ডলার থেকে বৃদ্ধি পেয়ে এখন বার্ষিক ৮০০ মিলিয়ন ডলার হয়েছে। যুদ্ধাস্ত্রের বেশিরভাগই আমদানি করতে হয়, এর ফলে সীমিত বৈদেশিক মুদ্রার একটা বড় অংশ ব্যয় হয়ে যায়। সামরিক অস্ত্রশস্ত্রের যেটুকু অভ্যন্তরীণ উৎপাদনহয়েথাকে, তাও হয় পশ্চিম পাকিস্তানে। এর ফলে, সকল অস্ত্রশস্ত্র পরিবহন করতে হয় ভারতীয় সমুদ্রসীমা ঘুরে এসে, যার ফলে খরচ হয় অত্যধিক। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে পরিবহন করাটাও আরেকটা বড় সমস্যা, কারণ চট্টগ্রাম এবং বাংলাদেশের অভ্যন্তরের মধ্যে রেলপথ এবং সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা অচল করে দেয়া হয়েছে।
রাজনৈতিক
৭) অর্থনৈতিক সমস্যাগুলোর সমাধান না করে পাকিস্তান সরকার বাংলাদেশে সামরিক প্রয়োজনকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিচ্ছে। সামরিক ক্র্যাকডাউন খুব অল্প সময়ের মধ্যে সুচারুভাবে সমাপ্ত হবে, এ বিশ্বাসে পশ্চিম পাকিস্তানের ব্যবসায়ী গোষ্ঠী শুরুতে একে সমর্থন দিয়েছিল। তারা এখন অসন্তুষ্ট। পাকিস্তানের ভবিষ্যতের ব্যাপারে আস্থার অভাবে বড় বড় ব্যবসায়ীরা এবং শিল্পমালিকরা কালোবাজারির মাধ্যমে তাদের ফান্ড বিদেশে পাঠিয়ে দিচ্ছে। মধ্যবিত্তরা এ দুর্গতি অনুভব করছে আরো বেশি, কারণ মার্চ মাস থেকে করের উচ্চহার এবং দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি। শ্রমিকদের মধ্যেও দেখা দিচ্ছে অসন্তোষ।
৮) উত্তেজনা নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য পশ্চিম পাকিস্তানের অনেক রাজনৈতিক নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।এমনকি যিনি ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে একত্রে চক্রান্ত করে বর্তমান সংকট সৃষ্টি করেছেন, সেই ভুট্টো নিজেও জনসম্মুখে “পশ্চিম পাকিস্তানে গৃহযুদ্ধের” সম্ভাবনার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। একইরকম বক্তব্য এর আগে দিয়েছিলেন ওয়ালি খান, যাঁর দল পশ্চিম পাকিস্তানে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ আসন পেয়েছিল।
৯) পশ্চিম পাকিস্তানের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্প্রীতির অভাব ক্রমশ বাড়ছে। টিক্কা খান — সেনাবাহিনীতে যাঁর উত্থান শুরু হয়েছিল ১৯৫৮ সালে, যখন তিনি নির্মমভাবে বোমাবাজি করে বেলুচি আদিবাসীদেরকে পশ্চিম পাকিস্তানের বশ্যতা স্বীকারে বাধ্য করেছিলেন – তাঁর অপসারণকে এটা অবশ্যম্ভাবী করে তুলেছে।
নৈতিক
১০) স্বাধীনতা আদায়ের সকল সংগ্রামেই আন্তর্জাতিক নৈতিক অনুভূতি সবসময় বড় ভুমিকা রেখে আসছে। বিদেশী দখলদার বাহিনীর দমন-পীড়নের পদ্ধতির বিরুদ্ধে জনমতের বিশ্বব্যাপী পরিবর্তন শেষ পর্যন্ত প্রধান প্রধান অঞ্চলে “[দখলদারদের] ইচ্ছের অভাবের” জন্ম দেয়, আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তির অবক্ষয় ঘটায়। পুরো পৃথিবীর সাথে পাকিস্তানের রাজনৈতিক সম্পর্ক অবধারিতভাবে আরো খারাপ হবে, শুধুমাত্র সেসব সরকারগুলো বাদে যারা পাকিস্তানের অনুরূপ নীতি মেনে চলে (যেমন, মুসলিমপ্রধান উত্তর আফ্রিকার নাইজেরিয়া), অথবা যেসব দেশগুলো ব্যতীত যারা জনসমর্থিত শক্তি দমনে পাকিস্তানি ভাড়াটে সৈন্য ব্যবহার করে বা করতে পারে (যেমন, পারস্য সাগরের উপকূলবর্তী আরব দেশসমূহ)।
একজন কূটনীতিবিদ
ওয়াশিংটন ডিসি