শিরোনাম | সংবাদপত্র | তারিখ |
কর্মকাণ্ডের খণ্ডচিত্র | বাংলাদেশ নিউইয়র্কঃ নম্বর ৩ |
১৬ জুন, ১৯৭১ |
বাংলাদেশ লীগ অফ আমেরিকা (নিউইয়র্ক)
কর্মকাণ্ডের খণ্ডচিত্র
ইস্ট পাকিস্তান লীগ অফ আমেরিকা, বর্তমানে বাংলাদেশ লীগ অফ আমেরিকা ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান লীগ অফ আমেরিকা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ১২ ডিসেম্বর ১৯৭০ এটি ইস্ট পাকিস্তান লীগ অফ আমেরিকাতে পরিবর্তিত হয়। জন্মলগ্ন থেকে সংগঠনটি দেশের এবং দেশের বাইরের বাঙালিদের জন্য কাজ করে গেছে। এখানে বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রধান প্রধান ঘটনাগুলোর সাপেক্ষে এই লীগের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে সংক্ষেপে বিবরণ দেয়া হয়েছে।
ঘুর্ণিঝড়ঃ
পূর্ব পাকিস্তানের ঘূর্ণিঝড় উপদ্রুত মানুষের জন্য তহবিল জোগাড় করতে এই লীগ “সুতরাং” নামে একটি চলচিত্রপ্রদর্শনীর আয়োজন করে। পূর্ব পাকিস্তানের বন্যা আক্রান্ত মানুষের প্রতি কেন্দ্রীয় সরকারের ঔদাসীন্যের বিরুদ্ধে নিউইয়র্ক শহরে প্রতিবাদের আয়োজন করে তারা। পূর্ব পাকিস্তানের ঘূর্ণিঝড় উপদ্রুত মানুষের জন্য আসা খাদ্যশস্যবাহী জাহাজ ঘুরিয়ে করাচী নিয়ে যাবার প্রতিবাদে আমেরিকার সরকার, ইসলামাবাদের আমেরিকান রাষ্ট্রদূত এবং ঢাকার আমেরিকান কনসাল বরাবর চিঠি ও টেলিগ্রাম পাঠানো হয়। এছাড়াও এই লীগ পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক মানসিকতার বিরুদ্ধে এবং পূর্বের স্বায়ত্বশাসনের অধিকারের স্বপক্ষে জাতিসংঘের হিউম্যান রাইটস কমিশন বরাবর স্মারকলিপি প্রদান করে।
সাধারণ নির্বাচনঃ
প্রলয়ঙ্কারী ঘূর্ণিঝড়ের পরপর পাকিস্তানে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের বরাবর পাঠানো ৬ মার্চ ১৯৭১ তারিখের একটি টেলিগ্রামে লীগ নিরঙ্কুশ বিজয়ের জন্য বঙ্গবন্ধুকে অভিনন্দন জ্ঞাপন করে এবং ছয় দফা দাবীর স্বপক্ষে তাদের সমর্থন ব্যক্ত করে। তারা ইয়াহিয়া খান বরাবরেও একটি টেলিগ্রাম পাঠায় যাতে পূর্ব পাকিস্তানকে স্বায়ত্বশাসনের অধিকার প্রদানের দাবী জানানো হয়।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের ঘোষণাঃ
পূর্ব বাংলার স্বায়ত্বশাসনের আন্দোলনের বিরুদ্ধে পাক সেনাবাহিনী নির্দয় আক্রমণ শুরু করলে ২৬ মার্চ ১৯৭১ শেখ মুজিবর গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। জাতির প্রয়োজনে এই লীগ সম্ভাব্য সব উপায়ে সাহায্য করতে এগিয়ে আসে। স্বাধীন বাংলাদেশের স্বীকৃতি অর্জন এবং ইয়াহিয়া খানের সেনাবাহিনীর গণহত্যার বিরুদ্ধে জনমত সৃষ্টি করতে ভূমিকা রাখে তারা। আমেরিকা, সোভিয়েত ইউনিয়ন, ফ্রান্সের রাষ্ট্রপতি এবং ব্রিটেন ও ভারতের প্রধানমন্ত্রীদের কাছে চিঠি ও টেলিগ্রাম পাঠানো হয়। এই সংঘাতের প্রতিরূপ তুলে ধরে এসব চিঠি ও টেলিগ্রামে আশা করা হয় যে তারা বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবেন এবং নিজেদের ক্ষমতার প্রয়োগ ঘটিয়ে গণহত্যা বন্ধে সাহায্য করবেন।
আমেরিকার সরকার এবং কংগ্রেস সদস্যদের কাছে চিঠি ও স্মারকলিপি পাঠিয়ে গণহত্যা বন্ধে সাহায্য চাওয়া হয় এবং পাকিস্তান সরকারের প্রতি কোনোরূপ সাহায্য না পাঠাবার সিদ্ধান্ত তাৎক্ষণিকভাবে গ্রহণের জন্য অনুরোধ করা হয়। জাতিসংঘের প্রায় সকল দেশের দূতদের সাথে লীগের প্রতিনিধিরা দেখা করেন এবং পূর্ব বাংলায় পশ্চিম পাকিস্তানী সেনাদের যথেচ্ছাচারিতার প্রতিবাদ জানাতে অনুরোধ করেন। এছাড়াও তাঁরা বাংলাদেশের সরকার ও জনগণের স্বায়ত্বশাসনের পক্ষে সমর্থন জোগাড়েরও চেষ্টা চালান।
জাতিসংঘ চার্টারের চ্যাপ্টার ৯৯ অনুযায়ী এই সংকটের মোকাবিলায় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য জাতিসংঘ মহাসচিব ইউ থান্টের কাছেও টেলিগ্রাম পাঠানো হয়। তাঁকে বাংলাদেশে জাতিসংঘের একজন পর্যবেক্ষক পাঠাতে অনুরোধ করা হয়। বাংলাদেশে জাতিসংঘের পরিচালনায় একটি ত্রাণ শিবির পরিচালনার জন্যেও অনুরোধ করা হয়। জনাব ইউ থান্টের সাথে বেশ কয়েকবার দেখা করবার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হতে হয়।
সাংগঠনিক কার্যক্রমঃ
৩০ মার্চের এক সভায় জনাব নুরুল আমিন চৌধুরীকে চেয়ারম্যান করে বাংলাদেশ রিলিফ কমিটি গঠন করা হয়। ৪ এপ্রিল, ১৯৭১ এর এক সভায় আগের প্রস্তুত অ্যাকশন কমিটিকে আরো বিস্তৃত করা হয়। এপ্রিলের ২৫ তারিখে লীগের পরবর্তী সাধারণ নির্বাচনের কথা মাথায় রেখে জনাব শাহাদাত হোসেনকে চেয়ারম্যান করে ইলেকশন এক্সামিনেশন কমিটি গঠন করা হয়।
শাখার খবরঃ
বৃহত্তর ওয়াশিংটন ডিসিস্থ বাংলাদেশ লীগ অফ আমেরিকার শাখা বাংলাদেশের সাহায্যকল্পে পুরোদমে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। এই শাখা থেকে প্রতিদিন একদম রুটিনমাফিক একদল প্রতিনিধি প্রাসঙ্গিক তথ্য ও রচনাসহ আমেরিকান সিনেটর ও কংগ্রেসম্যানদের সাথে দেখা করে বাংলাদেশের পক্ষে লবিং চালিয়ে যাচ্ছে। এই চেষ্টা খুবই কার্যকর এবং ফলদায়ক। বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশীপ অ্যাসোশিয়েশনের স্থানীয় শাখা এবং আমেরিকান ইউনিভার্সিটির সাথে মিলে এখানকার লীগ ভারতের ‘সর্বোদয়’ নেতা জয়প্রকাশ নারায়ণের জন্য এক সেমিনারের আয়োজন করে। এছাড়া লীগের পক্ষ থেকে তহবিল সংগ্রহের এক বিশাল উদ্যোগও গ্রহণ করা হয়েছে। লীগের এক সাধারণ সভায় সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে যে লীগের প্রতি সদস্য তার প্রতিমাসের বেতনের অন্তত ৫% লীগের অ্যাকাউন্টে দান করে দেবেন। এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের হারও খবুই আশাপ্রদ।
ম্যাসন সিটি, আইওয়ার ড বদরুদ্দোজা স্থানীয় চ্যানেলে একটি টেলিভিশন অনুষ্ঠান আয়োজন করেন যাতে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার প্রেক্ষাপট ব্যাখা করেন। আমেরিকান সিনেটর ও কংগ্রেসম্যানদের কাছে তিনি তাঁর স্থানীয় আমেরিকান বন্ধুদের মাধ্যমে ৪০এরও বেশি টেলিগ্রামও পাঠান।
১৯৭১ এর এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে কলম্বিয়া ভার্সিটির ইন্টারন্যাশনাল হাউসে বাংলাদেশের উপর একটি প্যানেল আলোচনার আয়োজন করা হয়। শ্রীমান ও শ্রীমতি বমন বসু, ড রশিদুজ্জামান এবং অন্যেরা এতে অংশ নেন। আলোচনার পর সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে বাংলাদেশের যুদ্ধাক্রান্ত মানুষের সাহায্যকল্পে ইন্টারন্যাশনাল হাউসের সদস্যদের অংশগ্রহণে একটি তহবিল গড়ে তোলা হবে।
ড জিল্লুর রহমান আতহার, ড হাবিবুর রহমান, ড ইউনূস, ড ইসমাইল এবং ন্যাশভিল, টেনিসির অন্যান্য অনেকে স্থানীয় চ্যানেলে একটি টেলিভিশন অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। এতে বাংলাদেশে সেনাবাহিনী কর্তৃক চলমান রক্তগঙ্গার বিশদ বিবরণ দেয়া হয়।
নিউইয়র্কে শোভাযাত্রা
নিউইয়র্ক, জুন ১২, ১৯৭১। বাংলাদেশ লীগ অফ আমেরিকা, বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ অ্যাসোশিয়েশন এবং ভারতীয় সংগঠনগুলোর যৌথ উদ্যোগে জুন ১২, ১৯৭১ নিউইয়র্কে বাংলাদেশের পক্ষে এক গণশোভাযাত্রার আয়োজন করা হয়। দেশটির নানা অঞ্চল থেকে বিভিন্ন শ্রেণী ও পেশার প্রায় ১,০০০ মানুষ এই শোভাযাত্রায় অংশ নেয়। এতে শ্রীমান জয়প্রকাশ নারায়ণ, ড ইকবাল আহমেদ, মিস্টার উইলিয়াম রায়ান, ড প্লাসট্রিক, মিসেস অ্যান টেইলর, ড আলমগীর এবং মিস্টার এ পুলি বক্তৃতা করেন। এতে সভাপতিত্ব করেন অশীতিপর মুক্তিযোদ্ধা শ্রীমাণ পি সি মুখার্জী।
ভারতের সর্বোদয় নেতা জয়প্রকাশ নারায়ণ তাঁর ভাষণে উল্লেখ করেন যে পূর্ব বাংলার জনগণ পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্নতা চায়নি, বরং পাকিস্তানী সামরিক জান্তা তাদের সেই পথে জোর করে ঠেলে দিয়েছে। তিনি বলেন যে এখন বাংলাদেশের স্বাধীনতা অবশ্যম্ভাবী, কারণ তা ওই অঞ্চলে বাস করা প্রতিটি বাঙালির জীবন-মরণের সাথে সম্পর্কিত হয়ে পড়েছে। তিনি বিশ্বনেতাদের কাছে, বিশেষ করে মুক্ত বিশ্বের নেতাদের কাছে নিজেদের সক্ষমতা প্রয়োগের মাধ্যমে সংঘাতময় অঞ্চলটিতে সাধারণ মানুষের চাওয়া মোতাবেক ব্যবস্থা গ্রহণ করে খুব দ্রুত শান্তি ফিরিয়ে আনতে আবেদন জানান। তিনি এক্ষেত্রে বৃহৎ শক্তিগুলোর কথা উল্লেখ করে বলেন বাংলাদেশে স্থায়ী শান্তি ফিরিয়ে আনবার পদক্ষেপ নেয়া তাদের কর্তব্য। তিনি আরো বলেন বৃহৎ শক্তিগুলো যদি লাখো বাঙালির চাওয়া-আকাঙ্খা পূরণ করতে ব্যর্থ হয় তবে তারা বাঙালির দুর্দশার জন্য তাদের কাছে দায়বদ্ধ রয়ে যাবে।
পশ্চিম পাকিস্তানের এক বিদ্বান ব্যক্তি, ড ইকবাল আহমাদ ইয়াহিয়া খানের সামরিক সরকারের নৃশংসতার প্রতিবাদ করেন। তিনি এই সামরিক জান্তাকে এক চরম ফ্যাসিস্ট সরকার হিসেবে আখ্যা দেন। তিনি বাঙালিদের স্বায়ত্বশাসনের দাবীর পক্ষে তার পূর্ণ সমর্থনও জানান।
আমেরিয়াকন কংগ্রেসম্যান উইলিয়াম রায়ান তার বক্তৃতায় যতদিন না পর্যন্ত বাঙালিদের অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হচ্ছে ততদিন পর্যন্ত পাকিস্তান সরকারকে সবরকম সাহায্য প্রদান বন্ধ রাখার উপর গুরুত্ব দেন। তিনি বাঙালিদের স্বায়ত্বশাসনের প্রতি তার পূর্ণ সমর্থন ব্যক্ত করেন। নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ড প্লাসট্রিকও পূর্ব বাংলায় স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা না হওয়া পর্যন্ত পাকিস্তান সরকারকে সাহায্য প্রদান বন্ধ রাখার অনুরোধ জানান। তিনি সতর্ক করে দেন যে বাঙালিদের স্বায়ত্বশাসনের দাবী পূরণ হবার আগেই যদি পাকিস্তান সরকারকে সাহায্য প্রদান করা আবারো শুরু হয়ে যায় তবে তা আমেরিকাকে সাড়ে সাত কোটি বাঙালির মৌলিক অধিকার দাবিয়ে রাখার স্বপক্ষের একজন হিসেবে তুলে ধরবে।
ফ্রি-ল্যান্স সাংবাদিক মিসেস অ্যান টেইলর, যিনি ইতোপূর্বে ওয়াশিংটনে বাংলাদেশের পক্ষে অনশন করেছিলেন, পূর্ব বাংলার নিরস্ত্র সাধারণ জনগণের উপর পশ্চিম পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর চালানো নৃশংশতা সম্পর্কে অবগত করেন তাঁর নিজের চোখে দেখা ঘটনার বর্ণনা থেকে। সবশেষে তিনি আমেরিকার সুস্থ চিন্তার অধিকারী নাগরিকদের প্রতি বাঙালিদের স্বায়ত্বশাসনের অধিকার পাবার লড়াইয়ে সমর্থন দিতে আবেদন জানান। এর আগে বাংলাদেশ লীগ অফ আমেরিকার ড আলমগীর আমেরিকার নাগরিকদের কাছে আকুল আবেদন জানান যেন তারা নিজ সরকারর উপর চাপ প্রয়োগ করেন; যাতে করে যতদিন না পর্যন্ত বাংলাদেশের স্বাধীনতা নিশ্চিত হচ্ছে এবং শেষ পশ্চিম পাকিস্তানী সেনাটিও বাংলাদেশের ভূভাগ থেকে চলে যাচ্ছে ততদিন পর্যন্ত পাকিস্তান সরকারকে কোনরূপ সাহায্য প্রদান করা না হয়।