শিরোনামঃ যুক্তরাজ্য ডায়েরী
সংবাদপত্রঃ বাংলাদেশ নিউজ লেটার লন্ডনঃ নং ৮
তারিখঃ ৭ জুলাই, ১৯৭১
যুক্তরাজ্যের দিনপঞ্জী
বৃটিশ মিডিয়ার চোখে
দ্য টাইমস সতর্ক করেছে: “ভবিষ্যৎ নিয়ে কোনো পরিকল্পনাই সফল হবে না যদি সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালির মতের পরিপন্থী না হয়। উদ্যোগী যারা নিজেদেরকে গাদ্দার বা রাজাকার হিসেবে দেখতে পাচ্ছেন তারা ক্ষমতাহীন হয়ে পড়বেন, পূর্ব পাকিস্তানে (পূর্ব বাংলায়) প্রেসিডেন্ট যে ঘোষণা দিয়েছেন তাকে অধিকাংশ লোক নিজ জনগোষ্ঠীর প্রতি গাদ্দারি হিসেবেই দেখছেন পূর্ব পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী এমন ঘোষণায় সাড়া দেবে তা কারও কষ্ট কল্পনায়ও সম্ভব নয়। গতকাল এমন কিছুই বলা হয়নি যা সৃষ্ট অসন্তোষকে প্রশমিত করতে পারে। বাঙালি জনগোষ্ঠী কোনো বিবৃতিতে তুষ্ট হবে না, তবে ঘোষণাটিকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে সামরিক কারও দ্বারা যুদ্ধের ঘোষণার মতই মনে হবে। “
দ্য গার্ডিয়ান, তাদের স্বভাবসুলভ উদারমনাভাবে স্পষ্টতই জানিয়েছে, “বিশ্ব ইয়াহিয়া খানের দু:স্বপ্ন দূরীভূত হবার কোনো লক্ষ্মণই দেখছে না। এই সৈনিকের জন্য সন্তুষ্টির ব্যাপার এটিই যে, আমাদের উদ্ভুত পরিস্থিতি এবং যে সমস্যাগুলো আমরা মোকাবেলা করছি এবং সমাধানের চেষ্টা করে যাচ্ছি, পুরো বিশ্বের দেশগুলো ব্যাপকভাবেই তাতে উদ্বেগ এবং সমবেদনা জ্ঞাপন করছে।
যদি ইয়াহিয়া বিশ্বাস করে যে, সে তাবৎ পশ্চিমা বিশ্বের বিবমিষাপ্রদ প্রতিক্রিয়াকে পাশ কাটিয়ে চলবে যদি সে সত্যিই কিছু বিশ্বাস করে থাকে: বাংলার মাটি থেকে তার জেনারেলরা তাকে যে রিপোর্টগুলো জানাচ্ছে। তার পক্ষের লোকেরা তার কাছে এখন যা বলছে তার উপর তার বিশ্বাস সত্যিই করুণ। এ মুহূর্তে তার সত্যিকারের কোনো পরিকল্পনা নেই। গতকাল গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থায় ফেরৎ যাবার যে অভিপ্রায় সে ব্যক্ত করেছে তা সত্যিই লজ্জাকর। বিশ্বের সাহায্যকারি দেশগুলো যদি তাদের বিস্ময়ভরা অবজ্ঞা নিয়ে পাশে আসেও তা ঢাকাকে আবার বশে আনার জন্য কোনো বিশেষজ্ঞ প্যানেল হিসেবে নয়। গতকাল বিশ্বব্যাংক তাদের সংকল্পে জানিয়েছে তারা চাতুরিপূর্ণ প্রতিশ্রুতিতে মত পাল্টাবে না। সংকল্প যতই দৃঢ় হবে, রাওয়ালপিন্ডির ক্ষমতাও তত দুর্বল হবে।
গার্ডিয়ান কিছু প্রশ্নও রেখেছে: ইয়াহিয়ার মাস্টারপ্লানের নর্দমার কোথাও এই মূল প্রশ্নটির উত্তর নেই। পাকিস্তানের কি আর কোনো অস্তিত্ব আছে? ঐক্যের কি আর কোনো প্রয়োজন আছে? পাঞ্জাবি সেনারা আসলে কতটুকু কী অর্জন করতে পেরেছে?
বিচারপতি চৌধুরীর মন্তব্য
২৯ জুন ইয়াহিয়ার বক্তব্যের প্রেক্ষিতে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার যুক্তরাজ্যের বিশেষ প্রতিনিধি বিচারপতি এ এস চৌধুরী বলেন – “ বাংলাদেশের ৭৫ কোটি মানুষ ইতোমধ্যে স্বাধীনতা ঘোষণা করেছে। তারা এখন বাংলাদেশ থেকে পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে বিতাড়িত করতে সচেষ্ট। স্বাধীনতা ব্যতিরেকে অন্য কোন রাজনৈতিক সমাধান এখন কোনভাবেই সম্ভব নয়। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান কেবল জনগণেরনির্বাচিতপ্রতিনিধিগণের দ্বারাই প্রণীত হবে।আজ ইয়াহিয়া তার মনোনীত বিশেষ কমিটির মাধ্যমে সংবিধান প্রণয়নের যে ঘোষণা দিয়েছেন সে ব্যাপারে বাংলাদেশের কিছুই করার নেই। এই বক্তব্যথেকে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান যে সামরিক জান্তা জনগণের নিকট সত্যিকার অর্থে ক্ষমতা হস্তান্তরে ইচ্ছুক নয়, এবং কখনো ছিলও না। যে কোন মূল্যে স্বাধীনতার জন্যলড়াই চলবেই এবং জনগন দ্বারা প্রত্যাখ্যাত সামরিক শাসকদেরকোন বক্তব্যই আমাদের বিবেচ্য নয়। আমার আন্তরিক প্রত্যাশা এই যে, বিশ্বের সকল সরকার এবং তার জনগণ জেনারেল ইয়াহিয়া খান এবং তার সামরিক বাহিনীর এই কূটকৌশল অনুধাবন করতে সমর্থ হবেন, এবং বাংলাদেশেরনিরস্ত্র বেসামরিক মানুষের সাহায্যার্থে এগিয়ে আসবেন”।
সম্প্রতি বিচারপতি চৌধুরী , ডাচ লেবার পার্টির আমন্ত্রণে নেদারল্যান্ডস সফর করেন। তিনি নেদারল্যান্ডের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সদস্য এবং সংসদ সদস্যদের সাথে সাক্ষাৎ করেন। নেদারল্যান্ড সংসদের পররাষ্ট্র বিষয়ক স্থায়ী কমিটির সদস্যরা তাঁর সাথে সাক্ষাত করেন এবং পূর্ব বাংলার সমস্যাবলী নিয়ে আলোচনা করেন। বিচারপতি চৌধুরী এবং তাঁর সফরসঙ্গী , জাতীয় পরিষদের একজন নির্বাচিত প্রতিনিধি জনাব মান্নান নেদারল্যান্ডের পররাষ্ট্র দপ্তরেও একটি সৌজন্য সাক্ষাত করেন।
কার্যক্রম সমিতির সভা
কার্ডিফে এক সভায় বিচারক জনাব এ এস চৌধুরী এবং জাতীয় সংসদ সদস্য জনাব এ মান্নান বক্তব্য রাখেন। সভায় উপস্থিতবৃন্দরা বাংলাদেশের ত্রাণ তহবিলের জন্য নগদ অর্থ সংগ্রহ করেন। পাক্ষিকভাবে আয়োজিত একই ধরণের সভা দেশের সর্বত্র অনুষ্ঠিত হয়। লন্ডনে এসময়ে কার্যক্রম বেশ সক্রিয় ছিল।
পাকিস্তানে দুই জাহাজ ভর্তি অস্ত্র সরবরাহের প্রতিবাদে আমেরিকান দূতাবাসের সামনে মিছিল ও প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়। রাষ্ট্রদূতের অনুপস্থিতিতে একজন কর্মকর্তা একটি চিঠি গ্রহণ করেন এবং তা শীঘ্রই ওয়াশিংটনে হস্তান্তর করার প্রতিশ্রুতি দেন। লন্ডন সমিতি, স্টুডেন্টস অ্যাকশন কমিটি, অ্যাকশন বাংলাদেশ, উইমেনস এ্যাসোসিয়েশন এবং অন্যান্য সহানুভব দলের সমন্বয়ে এই প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়।
পাকিস্তান সেনাবাহিনী কতৃক বাংলাদেশে বিশেষত ঢাকায় ঘটানো গণহত্যার উপর এক চলচ্চিত্র গত ৩০শে জুন কনওয়ে হলঘরে প্রদর্শন করা হয়। স্টুডেন্টস অ্যাকশন কমিটির পৃষ্ঠপোষকতায় আয়োজিত এই প্রদর্শনীতে অসংখ্য দর্শক এবং বৃটিশ সাংবাদিকগণ উপস্থিত ছিলেন।
২৯শে জুন, এইচবিসি তে বাংলাদেশ নিউজলেটার পত্রিকার সম্পাদক, মাশরিক পত্রিকার সম্পাদক জনাব মাহমুদ হাশমি এবং ভুট্টোর পিপলস পার্টির যুক্তরাজ্য শাখার সভাপতি জনাব গাজীর সাথে ইয়াহিয়ার রাজনৈতিক বিবৃতি ও নীতির উপর এক আলোচনায় যোগ দেন। পাকিস্তান, ভারত, মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকায় এই আলোচনা সম্প্রচার করা হয়।
গণহত্যা বন্ধ এবং বাংলাদেশের স্বীকৃতির দাবী
রবিবার ১লা আগস্ট ট্রাফেলগার স্কয়ারে জাতীয় সম্মেলন। সময়- বেলা ২টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা।
এই সম্মেলনের প্রাথমিক পৃষ্ঠপোষক অ্যাকশন বাংলাদেশ ( ৩৪ স্ট্র্যাট ফোড ভিলাস, লন্ডন। এন ডাব্লিয় ১। ফোন- ৪৮৫ ২৮৮৯) এর একজন মুখপাত্র এই সম্মেলনের উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করে বলেন – “সংবাদপত্র পড়তে সক্ষম ও টেলিভিশন দেখতে পারে এমন সকলের কাছেই এখন এ বিষয় পরিস্কার যে পূর্ব বঙ্গের জনগণ গণহত্যার শিকার। পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাদের পরিকল্পিত সন্ত্রাস অভিযানের মাধ্যমে পূর্ব বঙ্গের জনসংখ্যা সীমিত করতে উদ্ভূত, যাতে তা নিয়ন্ত্রণে পশ্চিম পাকিস্তানের কর্মকর্তাদের বেগ পেতে না হয়। আমরা মনে করি, বৃটিশ জনগণের জন্য এখনি সময় যাতে তারা এই ব্যাপারে তাদের অসম্মতি প্রকাশ করতে পারে। এবং আমরা আশা করি, এই সম্মেলনে পূর্ব বঙ্গের গণহত্যা বন্ধে বাংলাদেশের স্বীকৃতির বার্তা পরিষ্কার ও জোরালো ভাবে প্রচারিত হবে। বৃটেনের মত দেশের স্বীকৃতি পাকিস্তানের শাসকদের বাস্তবতার মুখোমুখি করার একমাত্র পন্থা। এবং বাস্তবতা হচ্ছে, তারা যুদ্ধে হেরে গেছে। ২৫শে মার্চের রাতের সেই বর্বরতর আক্রমণের সময় থেকে তারা পূর্ব বঙ্গের মানুষের কাছ থেকে সম্মানও হারিয়েছে। বাকি বিশ্বের উচিৎ এই নির্মম বাস্তবতাকে ক্রমবর্ধমান লাশের পাহাড়ের নিচে দাবিয়ে রাখার পাকিস্তানী প্রচেষ্টা প্রতিহত করা “।