শিরোনামঃ কলিকাতা মিশনের দৃষ্টিতে অপূর্ব
সংবাদপত্রঃ দি নেশন ভলিউম ১ নং ৩
তারিখঃ ২২ অক্টোবর, ১৯৭১
কলকাতা মিশনের অবিস্মরণীয় বিদ্রোহ
জাতীয় পররাষ্ট্র ডেস্ক থেকে
এটা ছিল কর্তব্যের ডাক, মাতৃভূমির আহ্বান। সমগ্র বাঙালি সমাজের উপর ঝড় বয়ে যাচ্ছিল। স্বাধীনতার উত্তাপ শুধু বাংলাদেশ নয়, দেশপ্রেমিক প্রবাসীদের মাঝেও ছড়িয়ে পড়েছে।
স্বাধীনতার চেতনা ও মাতৃভূমির প্রতি সহজাত ভালোবাসায় উদ্বুদ্ধ হয়ে প্রবাসী বাঙালিরা, বিশেষত কূটনৈতিক মিশনের বাঙালিরা, প্রকাশ্যে বাংলাদেশ সরকারের সাথে তাঁদের একাত্মতা ঘোষণা করেছেন। বাংলাদেশি রাষ্ট্রদূত, কর্মকর্তা এবং কর্মচারীদের কূটনৈতিক মিশন ত্যাগ করা নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ। এটা কোন সাধারণ ঘটনা বা খামখেয়ালিপনা নয়, বরং সাহসী,সুচিন্তিত ও বিচক্ষণ পদক্ষেপ যা মিশনে কর্মরত ব্যাক্তিদের দেশপ্রেম ও গভীর ভাবাবেগের বহিঃপ্রকাশ।
পক্ষত্যাগ করা মিশনগুলোর মাঝে, জনাব হোসেন আলীর নেতৃত্বে এগিয়ে আসা কলকাতার প্রাক্তন পাকিস্তানী দূতাবাসের কথা বিভিন্ন কারণে উল্লেখ্য।
প্রথমত,শুধু এই মিশনেই অবাঙালি ব্যাতীত সকল কর্মচারী পাকিস্তানি সরকারের কর্তৃত্ব অস্বীকার করেছে।
দ্বিতীয়ত, পাকিস্তানি কর্তৃত্ব নাকচের পরেও এই মিশন তাঁদের অবস্থান ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে। বাংলাদেশ সরকারের সমর্থকদের কাছে পরাজয় মেনে নিয়ে মিশনের ৩১ জন অবাঙালি কর্মচারি বেরিয়ে এসেছেন।
তৃতীয়ত, পক্ষত্যাগের পর কলকাতা মিশন বৈদেশিক যোগাযোগের মাধ্যম হয়ে উঠছে। সেই সাথে, একমাত্র পূর্ণ কর্মক্ষম কূটনৈতিক সেল হিসেবে এটি ব্যাবহারের মাধ্যমে এখান থেকে বিদেশের মিশনের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে।
চতুর্থত, যুদ্ধকালীন রাজধানী মুজিবনগরের কাছাকাছি অবস্থানের জন্য এটি অনন্যসাধারণ। কাছাকাছি অবস্থানের সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে এখান থেকে প্রতিনিয়ত বাংলাদেশ সরকারের নেতাদের সাথে যোগাযোগ রাখা এবং বিভিন্ন বিষয়ে তাঁদের মতামত ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের দ্বারা ছড়িয়ে দেয়া সম্ভব হচ্ছে।
পঞ্চম কারণ, যুদ্ধের প্রাথমিক পর্যায়ে, কলকাতার বাংলাদেশ মিশন-ই ছিল একমাত্র স্থান, যেখানে বাংলাদেশের শরনার্থীরা যথাযথ দিকনির্দেশনা বা অন্তত দুটি সান্ত্বনার কথা শুনতে পেত।
সুতরাং, স্পষ্টতই লক্ষ্যণীয়, এই দূতাবাস স্বাধীনতা সংগ্রামে কেবল নৈতিকভাবেই নয়, রাজনৈতিক ভাবেও সাহায্য করে যাচ্ছে। সেই সাথে শরণার্থীদের প্রতি তাঁদের মানবিক সাহায্যের দিকটিও ভোলার নয়।
যুদ্ধের প্রারম্ভিক পর্যায় শেষ হয়ে এলেও জনাব হোসেন আলীর নেতৃত্বে দূতাবাসের কর্মকর্তা কর্মচারীগণ প্রতিনিয়ত কাজ করে যাচ্ছেন। তাঁদের সব কার্যক্রমের প্রমাণ থাকছে। এসকল প্রশংসণীয় কার্যক্রম পুরস্কৃত হবেই।
উৎসাহজনক ব্যাপার হল,অসাধারণ কার্যক্রমের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ সরকার উক্ত দূতাবাসের মর্যাধা বৃদ্ধি করেছে এবং জনাব হোসেন আলীকে বাংলাদেশ সরকারের ভারতীয় হাই কমিশনার হিসেবে নিয়োগ করেছে। এ সম্মান তিনি অর্জন করে নিয়েছেন, এ পুরস্কার তাঁর প্রাপ্য।
নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে জানা যায়, হাই কমিশনার সমগ্র দূতাবাসের কর্মচারীদের বড় এক পরিবারের সদস্য হিসেবে বিবেচনা করেন, এবং স্বভাবতই এই পরিবারের অভিভাবক তিনি।
এবং একথা স্পষ্টই বোঝা যায়, তিনি তাঁদের জন্য যথাযথ পুরস্কারের ব্যাবস্থাও করবেন।
এই ‘বড় পরিবারে’র প্রতি মনোযোগের পাশাপাশি, অন্যান্য বাঙালির মতই জনাব হোসেন আলী তাঁর গভীর মমত্বের সাথে তাঁর মূল লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে চলেছেন। এই লক্ষ্য হল মুক্তি- পশ্চিম পাকিস্তানি দখলদারী বাহিনীর থেকে মুক্তি।বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রতি গভীর বিশ্বাস রেখে জনাব হোসেন আলী, সম্প্রতি কলকাতার এক সমাবেশে গভীর প্রত্যয়ের সাথে বলেন,
“এখন পর্যন্ত মুক্তিসংগ্রামে, সভ্যজগতের জানা আছে, বাংলাদেশে এখন কি চলছে। একটা বিশাল জনগোষ্ঠী কিভাবে সামরিক জান্তার দুঃসহ বর্বরতার স্বীকার হয়, সেকথা আমি পুনর্ব্যাক্ত করবো না। এ গল্প সবার পরিচিত। নিরস্ত্র অসহায় জনগণের উপর চালানো গণহত্যা সম্পর্কে বিশ্ব সচেতন।
তবে, বাংলাদেশের খোদা-ভীরু সাধারণ জনগণের উপর উপর গণহত্যা চালিয়ে, পাকিস্তানের সামরিক জান্তারা একটি ঘটনার শৃঙ্খল চালু করে দিয়ে গেল, যেই শৃঙ্খল সময়ের ব্যাবধানে শুধু বাংলাদেশকেই স্বাধীন করবে না, বর্তমান পশ্চিম পাকিস্তানের ভাঙনও নিশ্চিত করবে।
ইয়াহিয়া খানের সামরিক বাহিনী এ ব্যাপারে অবগত যে, বিশাল সামরিক শক্তি আর আগ্নেয়াস্ত্র ব্যাবহার করে বাংলাদেশের বিশাল জনগণকে বন্দী করে রাখার তাঁদের এই চেষ্টা সফল হবার নয়।
সভ্য সমাজের কাছে এটি স্পষ্টতই দৃশ্যমান যে, বাংলাদেশের সম্পদ শোষণ করে যে অর্থনৈতিক উন্নয়ন তাঁরা করেছে, অবিবেচনাপ্রসূত এ যুদ্ধের মুখে তা টিকে থাকতে পারছে না। পশ্চিম পাকিস্তানের প্রদেশগুলো ইতিমধ্যে রাজনৈতিকভাবে এই সামরিক আগ্রাসন ও নাগরিক স্বাধীনতা হরণের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলেছে। পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনীতি ও সামরিক বাহিনীকে গড়ে তোলার জন্য যে মোটা অঙ্কের বৈদেশিক সাহায্য তারা পেয়েছে, তাও শেষের পথে।
বাংলাদেশে সামরিক আগ্রাসন শেষ হওয়ার সাথে সাথেই পশ্চিম পাকিস্তানের ক্ষয়িষ্ণু অর্থনীতির ব্যাপারেও তারা সচেতন হবে, যে অর্থনীতির ভিত্তি সামরিক শিল্প, যা আপাতদৃষ্টিতে ভারতের সাথে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত, তবে মুলত এর লক্ষ্য জনগণের স্বার্থ শোষণ করে ক্ষমতায় টিকে থাকা এবং ‘সামরিক জাতে’র জন্য চাকরির ব্যাবস্থা করা।
মৃত্যু ভয়কে পরোয়া না করে আমাদের মুক্তি বাহিনী শত্রুর মোকাবিলা করে চলেছে। স্বাধীনতা যুদ্ধে ক্রমেই এগিয়ে চলেছে।শত্রুর নিধনের পাশাপাশি অস্ত্র ও সৈন্য পরিবহনের জন্য পশ্চিম পাকিস্তানিরা যেই ব্রিজ, রেল আর রাস্তা বায়বহার করত মুক্তিবাহিনীরা তা ধ্বংস করছে, সেই সাথে তাঁদের নৌযানও ডুবিয়ে দিচ্ছে। সেই সাথে আমাদের গেরিলারা দেশের অভ্যন্তরের পাকিস্তানিদের সাহায্যকারীদেরও নির্মূল করে চলছে।
ক্রমাগত সৈন্য ও সরঞ্জামাদি হারিয়ে এবং কিছু স্থানে পিছু হটে পাকিস্তানি বাহিনীর মনোবল ভেঙ্গে পড়ছে। ইতিমধ্যে মুক্তিবাহিনী দেশের বিশাল অংশ নিজেদের নিয়ন্ত্রণে এনেছে এবং তথাকথিত ‘সামরিক জাত’ ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পিছু হটছে।
রাজনইতিকভাবে অতীতের যেকোন সময়ের চেয়ে বেশি ঐক্যবদ্ধ আমরা। যদিও নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পূর্ণ সংখ্যাগরিষ্ঠটা পেয়েছে, দেশের বৃহত্তর স্বাধীনতাকামী সকল রাজনৈতিক দলের সহযোগীতার মাধ্যমে এবং সকল স্তরের ও মতের সমঅংশগ্রহণের মাধ্যমে স্বাধীনতা সংগ্রামের বিজয়ালোকিত সমাপ্তি আনা এখন সময়ের দাবী।