শিরোনামঃ মুজিবনগর সংবাদ
সংবাদপত্রঃ দি নেশনঃ ভল্যুম ১ নং ২
তারিখঃ ৮ই অক্টোবর, ১৯৭১
দাবি আদায়ের ডাক
প্রতিবেদক- দেশ পত্রিকা।
বাংলাদেশের ভিন্নমতের নির্দিষ্ট কিছু অংশের ঐক্যবদ্ধভাবে মুক্তির জন্য ত্যাগ স্বীকার করা নিয়ে মনের ভেতরকার একঘেয়ে বিহ্বল সুর অনেকটাই প্রশমিত হয়ে গেছে। স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম দল সম্বন্ধ, বর্ণ বা ধর্মবিশ্বাস নির্বিশেষে সকল বাঙালীর জন্য সংগ্রাম। শত্রুরা কাউকেই ছাড়েনি, যখন ওরা আক্রমন করেছিল, যখন ওরা গণহত্যা আরম্ভ করেছিল বাংলাদেশের মাটিতে।
গোটা বাঙালী জাতির আত্নমর্যাদার জন্য এই রক্ত-স্নান এক্যবদ্ধ হবার দৃঢ়শক্তি হিসেবে কাজ করেছে। গোটা জাতিই একসাথে পশ্চিম পাকিস্তানি লুটেরাদের হাতে নির্যাতিত হয়েছে, এবং একইসাথে তারা শত্রুর বিরুদ্ধে লড়েছে। অনেক মতভেদ আছে এবং এ লড়াই চ্যালেঞ্জিং। সাড়ে সাত কোটি বাঙালি শরীরে শেষ রক্তবিন্দু থাকা পর্যন্ত লড়াই করতে অটল।
তারা একসাথে একটা বিপদসংকুল যাত্রা শুরু করেছে। কিন্তু আওয়ামী লিগের অন্তর্ভুক্ত দল গুলোর বাইরে কৃতিত্বের ভাগের অনুপস্থিতি আওয়ামিলীগের, যারা বাংলাদেশ প্রশাসনের বর্তমান শাসক দল, তাদের বাইরের জনদের নিরুতসাহিত করছে। এটা একটা আনন্দের খবর যে, ৫টা দলের ৮ জন প্রতিনিধি নিয়ে একটা পরামর্শক কমিটি তৈরি করা হয়েছে। কমিটিতে আওয়ামি লীগ ছাড়াও আরও যে চারটি দল প্রতিনিধিত্ব করছে তারা হলঃ ন্যাশনাল আওয়ামি পার্টি ( ন্যাপ- ভাসানী গ্রুপ ), ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি ( ন্যাপ- মুজাফফর গ্রুপ ), বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দল এবং বাংলাদেশ ন্যাশনাল কংগ্রেস পার্টি।
গোটা বাঙালি জাতি একটা সর্বাত্মক স্বাধীনতা যুদ্ধে জড়িয়ে গেছে। এটা গোটা জাতির লড়াই। অন্য চারদলের অবদান স্বীকার একটা শুভ প্রভাব রাখবে এই স্বাধীনতা সংগ্রামে। এই দলগুলো এখন একটা অংশগ্রহণমূলক বোধ অনুভব করবে, যা কোন সন্দেহ ছাড়াই এই মুক্তি সংগ্রামের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে যেতে তাদের মাঝে একটা উদ্দীপনামূলক শক্তি হিসেবে কাজ করবে।
শত্রুরা তখনই সফল হবে যখন তারা এই সংগ্রামরত মানুষগুলোর মাঝে কোনো বিভেদ ঘটাতে পারবে। আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। সময়ের চাহিদার স্বার্থেই নিজেদের মাঝে সোৎসাহে একতা বজায় রাখতে হবে। এটাই সেই সময়, যা আমাদের চালচলনে-কার্যকলাপে সামরিক শৃঙ্খলা চায়। আমাদের বাচনভঙ্গির প্রতিটি খুঁটিনাটি বিবেচনায় নিয়ে এখনই একটা সুরক্ষিত ভাষায় কথা বলা শুরু করতে হবে।
বাঙালি জাতি তাদের ঈর্ষা জাগানিয়া কর্মক্ষমতার মাধ্যমে একটার পর একটা উদাহরণ প্রতিষ্ঠা করে যাচ্ছে। নির্বাচনের ইতিহাসে একটা রেকর্ড স্থাপনের মাধ্যমে বাংলাদেশের গণতন্ত্রকামী মানুষ বিপ্লবীদের ফিরিয়ে এনেছে। তারা ২৫শে মার্চের কঠোর পদক্ষেপের চূড়ান্ত পরিণতিতে আসা স্মরণকালের সবচেয়ে ভয়াবহ গণহত্যার পর উদ্ভুত পরিস্থিতির চাহিদা অনুযায়ী সাড়া দিয়েছে। হ্যাঁ তারা সাড়া দিয়েছে। প্রতিটি সাধারণ বাঙালি এখন যোদ্ধাতে পরিণত হয়েছে, তারা দখলদার বাহিনী দ্বারা আক্রান্ত মাতৃভূমির সম্মান এবং মর্যাদা রক্ষার শপথে দীপ্ত। তারা এখন পশ্চিম পাকিস্তানি সাম্রাজ্যবাদের নিষ্ঠুরতা থেকে মাতৃভূমিকে মুক্ত করার মাধ্যমে আরেকটা উদাহরণ স্থাপনে সংকল্পবদ্ধ।
রাত সত্বর পোহাবে।
******
শব-ই-বরাত, পবিত্র ইসলাম ধর্মীয় উৎসব, মুজিবনগরে যথেষ্ঠ ভাবগাম্ভীর্যের মধ্য দিয়ে পালিত হয়েছে। ইসলাম ধর্মীয় ধর্মগ্রন্থ মতে, এই রাতেই মহান আল্লাহ প্রত্যেক মুসলিমের আসছে বছরগুলোয় তৃপ্তি বা আক্ষেপ, ভাল বা মন্দ দিনগুলো হিসেব করবেন। প্রত্যেক ধর্মপ্রাণ মুসল্লি অন্তরের অন্তস্থল থেকে প্রবল আগ্রহের সাথে সৌভাগ্যের জন্য সারারাত প্রার্থনা করে। বাংলাদেশও সরকারের সকল অফিস ৫ই অক্টোবর একদিনের ছুটি পালন করেছে।
মুজিব নগরে, ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী এবং তাঁদের মন্ত্রীসভা সদস্যেরা বিশেষ প্রার্থনায় শামিল হয়েছেন। তাঁরা মুক্তিযুদ্ধে আত্মত্যাগকারী শহীদদের আত্মার মুক্তির জন্য প্রার্থনা করেন। পশ্চিম পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর বর্বর এবং নিষ্ঠুর আক্রমণে নিহত লক্ষ লক্ষ নিরপরাধ পুরুষ, নারী এবং শিশুদের আত্মার জন্যেও প্রার্থনায় মুক্তি ও শান্তি কামনা করা হয়।