শিরোনাম | সংবাদপত্র | তারিখ |
এ যুদ্ধ আর কতদিন চলবে? | দ্যা ন্যাশন, ভলিউমঃ ১, নম্বর ১ | ২৪ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ |
এ যুদ্ধ আর কতদিন চলবে?
দ্যা ন্যাশনের বিশেষ প্রতিবেদন
পৃথিবীর প্রতিটি শান্তিপ্রিয় মানুষের কাছে এখন একটিই প্রশ্ন, বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে পাকিস্তানি সামরিক জান্তার এ কাণ্ডজ্ঞানহীন যুদ্ধ আর কতদিন চলবে? এ উদ্বেগের কারণ ইয়াহিয়ার এই দক্ষ ও সুপ্রশিক্ষিত দলটি ইতিমধ্যে দেশটির শান্তি, নিরাপত্তা এবং স্থিতিশীলতা যথেষ্ট পরিমানে বিপন্ন করেছে।
যুদ্ধ ও যুদ্ধ পরবর্তী নির্মম গনহত্যা বিষয়ে একটি স্ন্যাপ বিশ্লেষণ বলছে যে, নিরস্ত্র বেসামরিক নাগরিকদের উপর পশ্চিম পাকিস্তানিরা যে নৃশংস গণহত্যা শুরু করেছিল সেটি প্রতিহত করতে বাংলাদেশের মানুষ যথেষ্ট সাহসের প্রমাণ দিয়েছে। বিশ্লেষণটি আরও বলছে, শেষ চার মাসে বাংলাদেশী মুক্তিযোদ্ধারা এতটাই মরিয়া হয়ে উঠেছিল যে, পশ্চিম পাকিস্তানিদেরকে যেন তারা এ দেশ থেকে নিশ্চিহ্ন করেই ছাড়বেই।
তবে অন্যভাবে বলতে গেলে এই যুদ্ধটা যেন অনেকটা আশীর্বাদও বটে, যেটা বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের প্রত্যেককে এক সাহসী যোদ্ধায় পরিণত করেছিলো। বাংলার মাটির প্রতিটি মানুষ হয় সম্মুখ যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছে না হয় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করেছে। তরুন এবং ছাত্ররা গেরিলা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিয়েছে। এবং প্রশিক্ষিত এই তরুনেরা যারা যুদ্ধে নেমেছে, পশ্চিম পাকিস্তানিদের ঘায়েল করে ছেড়েছে।
ঢাকা শহর যেটি ইয়াহিয়ার দলবলের নিয়ন্ত্রণে ছিল একসময়, সেটি এখন হয়েছে গেরিলাদের শহর এবং এই গেরিলারা সামরিক জান্তাদের কাছ থেকে রাতের ঢাকার দখল কেড়ে নিজেদের অধীনে নিয়েছে।
সম্মুখ যুদ্ধের ছবিগুলো ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য খুবই উৎসাহব্যঞ্জক। ইতিমধ্যে কুষ্টিয়া, যশোর, খুলনা এবং সিলেট জেলার সুনামগঞ্জের একটা বড় অংশ মুক্তি বাহিনীরা দখলে নিয়েছে। বাংলাদেশের শহরগুলোতে বাংলাদেশ সরকারকে সমর্থন করা শুরু হয়ে গিয়েছে এবং শহুরে জনগোষ্ঠীর মনোভব এখন এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে যে চরম নিপীড়ন ও নির্যাতনের হুমকি যাই থাকুক পশ্চিম পাকিস্তানকে তারা দমন করে ছাড়বেই।
যে পাকবাহিনী নির্বিচারে গুলি চালানো ছাড়া কিছুই বুঝত না। তারাই এখন অস্ত্র ফেলে পালাচ্ছে। দেশের মানুষ ক্রমশ এদের প্রতি শত্রু ভাবাপন্ন এবং স্বাধীনতা পাগল হয়ে উঠছে। দুই দেশের বিভক্তি টেনে এই যে স্বাধীনতা অর্জনের চেষ্টা, এটা সত্যিই ছিল একটা বুমেরাং এর মত। স্বাধীনতা পাগল এই মানুষগুলো এত বিপুল সংখ্যক রাজাকার নিধন করেছে যে প্রকাশ্যে রাজকার তখন খুব কম দেখা যেতো। রাজাকার নিধনের এই বিরুপ পরিস্থিতির কারনে যুদ্ধকে নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য পাকবাহিনী পশ্চিম পাকিস্তান থেকে অবাঙালী সৈন্যদেরকে আনার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে ।
কিন্তু প্রচলিত প্রবাদই বলে দেয় যে পাপী কখনও শাস্তি থেকে মুক্তি পেতে পারে না এবং যেই পাপী পাকিস্তানিদের ইচ্ছে পুরনে পাশে দাঁড়িয়েছে। অবাঙালি যাদেরকে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আনা হয়েছিল পাকিস্তান বাহিনী তাদেরকে রাজাকার হিসেবে দলে অভিষিক্ত করে। এবং সন্ত্রাস ছড়ানোর জন্য দেশের অভ্যন্তরে পাঠায় যাতে সাধারণ লোকেরা ভয় পেয়ে সামরিক জান্তার কাছে আত্মসমর্পণ করতে শুরু করে। কিন্তু ব্যাপারটা উল্টো এমন হিতে বিপরীত হলো, যা পশ্চিম পাকিস্তানি ক্ষমতাসীনদেরকে ভীষণ মর্মাহত করল। অভিষিক্ত রাজাকারদের সাথে সহযোগিতার পরিবর্তে বাঙালিরা বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত হয়ে বরং রাজাকার নিধন করতে লাগলো। এমনকি গেরিলা প্রশিক্ষণ ছাড়াই সাধারণ জনগণ নিজেদেরকে সফল গেরিলা হিসেবে প্রমাণ করেছিল এবং প্রকাশ্য দিবালোকে তারা রাজাকার নিধন চালিয়ে যেতে লাগলো।
ইয়হিয়ার দখলদারবাহিনীর জন্য সম্মুখ যুদ্ধ একেবারেই কম ঝুঁকিপূর্ণ ছিল না এবং এমনকি সে তাদের দখলে থাকা অঞ্চলগুলোতে থেকেও। মুক্তিবাহিনীর ২৫ মার্চ রাতের হার্ড কোর চ্যালেঞ্জ গ্রহণ ছাড়াও অনেক দৃঢ় প্রতিজ্ঞ তরুনকে বিভিন্ন মুক্তি ক্যাম্পে প্রশিক্ষন দিয়ে সারা বাংলাদেশে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছিল। ব্যাচের পর ব্যাচ প্রশিক্ষণ নিচ্ছিল এবং প্রশিক্ষণ শেষে যুদ্ধে পাঠানো হচ্ছিলো। এবং সেইসব তরুন প্রশিক্ষিত যুবাদের মুখেই যেন তাদের সংকল্পের ছবি ভয়ানক ভাবে আঁকা ছিল। শত্রুর বিরুদ্ধে প্রতিটি অপারেশনে তারা মাতৃভূমি বাংলাদেশের স্বাধীনতা রক্ষার এক প্রেরনা নিয়েছিল। আর এভাবেই তারা একটার পর একটা ব্যাটালিয়ান দল গড়ে তুলছিল। দুই ব্যাটালিয়ান এবং এক কোম্পানি সৈন্য ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থেকে আর এক আর্টিলারি ব্যাটালিয়ান এর সাথে যারা বের হয়েছিল যাদের ৪০০ জন পরবর্তীতে হতাহত হয়েছিলো।
পাকবাহিনীর মনোবল ভেঙ্গে চূর্ণ বিচূর্ণ। ইতিমধ্যে মুক্তি বাহিনীর সাথে চার মাসের যুদ্ধে তাদের ৪২,০০০ লোক হতাহত হয়েছে। একজন নিয়মিত এবং আধুনিক সৈন্যকে শক্তি সুবিধাহীন এমন পরাজিতের ভাগ্য বরণ করতে হবে, তা ছিল চিন্তারও বাইরে। এটি ছিল মুক্তিবাহিনীর জন্য একটি দুর্লভ অর্জন এবং এই যুদ্ধের স্মরণীয় স্মৃতি। মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে দুর্দশার শিকার হয়ে পাকিস্তানী বাহিনীর মনোবল একেবারে ভেঙে গিয়েছিল এবং তারা প্রচণ্ড একটি টলায়মান অবস্থার মধ্যে ছিল। ইয়াহিয়ার লোকদের জন্য এ যুদ্ধ ছিল নিশ্চিত পরাজয় এবং প্রচণ্ড অপমানজনক।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিভিন্ন দলের মধ্যে অবিশ্বাস ছড়িয়ে পড়েছিল। পাঞ্জাবীরা পাঠান ও বেলুচিদের বিশ্বাস করত না এবং আবার ওরাও পাঞ্জাবীদের করত না। এক প্লাটুন বেলুচি সৈন্য তাদের সাথে পাঞ্জাবী কমান্ডারদের মতবিরোধ থাকায় ভারত অতিক্রম করে আত্মসমর্পণ করেছিলো। এই পাঞ্জাবী কমান্ডাররা চেয়েছিল বেলুচি অফিসাররা যেন সাধারণ বাঙালীদের হত্যা করে কিন্তু তারা তাতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল। এবং এটা হয়েছিল এক পাঞ্জাবী জওয়ান এক বেলুচি সৈন্যকে হত্যা করার জন্য।
বেলুচিদেরকে তখন খুবই সন্দেহের চোখে দেখা হতো। এমনকি বেলুচি গান্ধী, খান আব্দুস সামাদ আছাকজাইকে জেলে ঢোকানো হয়। মিলিটারি বাহিনী থেকে মোবাইল সামরিক কোর্ট গঠন করা হয় যাতে লোকেরা তাদের ভিন্নমতগুলো জানাতে পারে। যারা এই সামরিক বাহিনীকে সমর্থন করেনি তাদেরকে নিদারুণ নির্যাতনের মধ্যে দিয়ে যেতে হতো। উচ্চ পর্যায়ের সিন্ধি নেতা জি এম সৈয়দ সাহবকে জেলে পোরা হয় শুধু বাংলাদেশ যুদ্ধের নিন্দা করার জন্য। এবং ঠিক এই কারনে প্রচণ্ড বিতৃষ্ণায় জনপ্রিয় সীমান্ত প্রদেশ নেতা খান ওয়ালি খান দেশ ত্যাগ করেন।
যেটা দাঁড়ালো, পাকিস্তানী আর্মি পুরোপুরি বিশৃঙ্খল অবস্থায় আছে। তাদের জওয়ান এবং অফিসাররা টাকা এবং মূল্যবান দ্রব্যাদি লুটপাট এবং দখলে লিপ্ত। তার উপর, যুদ্ধ করার চেয়ে, তাদের বেশী মনোযোগ বিভিন্ন সেনানিবাস এবং ক্যাম্পে বন্দী মেয়েদের অত্যাচার করা। ভগ্ন মনোবল এবং হীন চরিত্রের একটি সেনাবাহিনী যুদ্ধ করতে যাচ্ছে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে যাদের একমাত্র লক্ষ্য স্বীয় মাতৃভূমিকে রক্ষা করা। বাংলাদেশ সরকার তাঁদের বিমানবাহিনী এবং নৌবাহিনী সংগঠিত করার পর পর ই পুরোদমে আক্রমণ শুরু হবে। এখন এটাই দেখার বিষয়, ভগ্ন মনোবল এবং হীন চরিত্রের পাকিস্তানী বাহিনী এ মাটিতে টিকে থাকতে পারে কি না। যখন বাংলাদেশের মাটি, বাতাস এবং পানি এই লুটেরা বাহিনীকে সহ্য করবেনা, যখন মুক্তি বাহিনী ভারি অস্ত্র এবং এয়ার কাভার পাবে, তখন পশ্চিম পাকিস্তানী দস্যুদের বাংলাদেশ থেকে ছুঁড়ে ফেলে না দেওয়ার কোন কারণ খুজে পাই না। আজকে, প্রত্যেক বাংলাদেশী একেকজন বিশ্বস্ত সৈনিক, নিজ মাতৃভূমিকে স্বাধীন করতে বদ্ধপরিকর। সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালীর স্বাধীনতার জন্য যে অপরাজেয় আকাঙ্ক্ষা, তাঁদের এই সঠিক এবং মহান আন্দোলন অবশ্যই যুদ্ধের ফলাফল তাঁদের দিকে নিয়ে যাবে। শহিদের রক্তমাখা স্বাধীনতার পতাকা থাকবে চির উন্নত। বাঙ্গালী স্বাধীন হবেই।