You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.12.17 | কারও করুণা নয়- একটি জাতি রক্তের বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জন করতে পারে | অভিযান - সংগ্রামের নোটবুক
শিরোনাম সংবাদপত্র তারিখ
কারও করুণা নয়- একটি জাতি রক্তের বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জন করতে পারে অভিযান

১ম বর্ষঃ ৪র্থ সংখ্যা

১৭ ডিসেম্বর, ১৯৭১

 

কারও করুণা নয়- একটি জাতি রক্তের
বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জন করতে পারে
(অভিযান রাজনৈতিক পর্যালোচক)

বাংলাদেশে পাকিস্তানি ফ্যাসিস্ট অবরোধ সমাপ্তির সময় আসন্ন হয়ে এসেছে। পাকিস্তানি জঙ্গিচক্র, নয় মাসেরও আগে বাংলাদেশের নিরীহ গণতন্ত্রকামী মানুষের উপর এই যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছে। বাংলাদেশের জনগণ পাকিস্তানি সৈন্য কিংবা সমরসম্ভারের প্রাচুর্যে ভয় না পেয়ে বীরের মত যুদ্ধ করার পথ বেছে নিয়েছে। সেদিন বাংলাদেশের এ যুদ্ধ ঘোষণাকে অনেক সমর বিশেষজ্ঞ অবিমৃষ্যকারিতা বলে উপহাস করেছিলেন। বাংলাদেশের জনগণের সেদিন সত্যি সত্যি ভরসা প্রদানকারী কোন বন্ধু ছিল না, বৃহৎ শক্তিবর্গের কাছ থেকে সাহায্যের কোন প্রতিশ্রুতি ছিল না, সর্বোপরি নিজেরাও ছিল চূড়ান্তভাবে অসংগঠিত। তবু তারা যুদ্ধ ঘোষণা করেছিল, কারণ বাংলার জনগণের সংগ্রামী অভিজ্ঞতা এবং আত্মবিশ্বাসের বলে তারা ঐতিহাসিক সত্যে আস্থা স্থাপন করতে পেরেছিল যে একটা গোটা সংগ্রামী জাতির দাবী ঠেকিয়ে রাখার ক্ষমতা পৃথিবীর রাষ্ট্রগুলোর নেই।
বাংলার মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্ব, ত্যাগ, সাহস এবং জ্বলন্ত দেশপ্রেম পৃথিবীর দেশগুলোর ও বিশ্বমানবের শ্রদ্ধা এবং সহানুভূতি আকর্ষণ করেছে। ভারতের মহান জনগণ এবং ভারত সরকারকে ধন্যবাদ। তাঁরা বাংলার জনগণের এই মুক্তিসংগ্রামকে যথাযোগ্য মর্যাদা দিয়েছেন। বাংলার স্বাধীনতার দাবী যে ন্যায়সঙ্গত দাবী তা মেনে নিয়ে শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়েছেন। মুক্তিযোদ্ধাদের সবরকমের সহযোগিতা প্রদান করেছেন, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি জানিয়েছেন। অপরপক্ষে পাকিস্তানের শক্তিশালী মিত্ররা পাকিস্তানের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে চেষ্টার কসুর করেনি। সাম্রাজ্যবাদী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিম ইউরোপের প্রতিটি মার্কিন তল্পিবাহক দেশ এবং তথাকথিত মুসলিম দেশসমূহ পাকিস্তানকে নৈতিক সমর্থন জানিয়েছে অথবা অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করেছে। জিন্নাহর কিংখাবে মোড়া পাকিস্তানের খসে পরা অস্তিত্ব সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ইনজেকশনে যে টিকে থাকতে পারে না, বাংলার সংগ্রামী জনগণ, মুক্তিযোদ্ধারা তাই প্রমাণ করেছে। সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো এতদিনে নিশ্চয়ই উপলব্ধি করতে পেরেছে, অস্ত্র নয় মানুষের সংগ্রাম এবং শুভেচ্ছাই মানুষের ভবিষ্যৎ নির্ধারন করে। বাংলাদেশে এই ঐতিহাসিক সত্য প্রমাণিত হতে যাচ্ছিলো। মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে চূড়ান্ত পরাজয় বরণ করার পূর্বমুহূর্তে পাকিস্তানের সামরিক জান্তা সাম্রাজ্যবাদী প্রভুদের পরামর্শে ভারতের উপর নগ্ন হামলা চালায়। সীমান্ত অতিক্রম করে নিরীহ জনসাধারণের উপর গোলাবর্ষন করে, নগরে জনপদে বোমা ফেলে এবং এইভাবে পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের যুদ্ধে ভারতকে জড়িয়ে ফেলে। এরই মধ্যে ভারত দাঁতভাঙ্গা জবাব দিয়েছে। পাকিস্তান নিশ্চয়ই অস্ত্র ও সেনাবলে বহুগুণ শক্তিশালী ভারতের সঙ্গে যুদ্ধ করে এঁটে ওঠা তার পথে স্বপ্নেরও অগোচর। তবু ভারতকে আক্রমণ করে তাকে সম্মুখযুদ্ধে নামতে বাধ্য করেছে। এটা পাকিস্তানি সমরনায়কদের ঘোলা জলে মৎস্য শিকার করার আরেকটি ফন্দী। এ সম্বন্ধে বাংলাদেশের জনমত বহুদিন আগে থেকেই সজাগ ছিল। কয়দিন যুদ্ধ চালিয়ে জাতিসংঘের সাম্রাজ্যবাদী মামা-কাকাদের ডেকে বলবে আমরা আর পারলাম না, এবার তোমরা ঠ্যালা সামলাও। ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের একটা যুদ্ধ বিরতি চুক্তি হবে এবং মাঝখান থেকে বাংলার জনগণের স্বাধীনতার দাবী ফসকে যাবে। পাকিস্তান বাস্তবে করেছেও তাই। কিন্তু ইয়াহিয়া খান ভুল করেছিলেন, তাসখন্দ একবারই হয়, বার বার না। আমেরিকা যুদ্ধ বিরতির প্রস্তাব দিয়েছিলো। তার তল্পীবাহকরা প্রস্তাব সমর্থন করেছে, বলেছে ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের বিরোধ মিটিয়ে ফেলা উচিত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অভিসন্ধি ভন্ডুল করেছে রাশিয়ান ভেটো। রাশিয়ান প্রতিনিধি বলেছেন, জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ভারত পাকিস্তান বিরোধের প্রশ্ন আলোচনার সময় বাংলাদেশের প্রতিনিধিকেও বক্তব্য পেশ করার সুযোগ দেয়া হোক। সব মিলিয়ে এমন অবস্থা দাঁড়িয়েছে, ভেতরে বাইরে পাকিস্তানের অস্তিত্ব আজ চূড়ান্ত ধ্বংসের মুখোমুখি। গোটা বাংলাদেশ ভারতীয় বাহিনীর সহায়তায় মুক্তিবাহিনীর করতলগত প্রায়ই হয়ে এসেছে। পশ্চিম রণাঙ্গনে ভারতের দুর্ধর্ষ আক্রমণের মুখে পাকিস্তান মারের পর মার খাচ্ছে। বাংলার পাললিক মাটিতে একটি নতুন দেশ একটি নতুন শক্তি প্রবুদ্ধ স্বাধীন জাতি মাথা তুলেছে। ভারত এই জাতিকে স্বাধীন বলে স্বীকৃতি জানিয়েছেন। শিগগির আমরা আশা করছি বিশ্বের অন্য দেশগুলো স্বীকৃতি জানাতে বাধ্য হবেন। এটা অনুকম্পা বা করুণা নয়, বৈদেশিক নীতি কূটনীতি নয়- একটি জাতি মেরে মরে, প্রাণ দিয়ে, রক্ত দিয়ে স্বাধীন হতে পারে, শক্তি বলে বিজয় ছিনিয়ে আনতে পারে বিশ্ব রাষ্ট্রগুলো এই সহজ সত্যটি স্বীকার করে নিবেন, এটুকু শুভবুদ্ধি তাঁদের আছে বলে আমরা মনে করি।