You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.11.06 | স্বাধীন বাংলা পত্রিকার সম্পাদকীয় | স্বাধীন বাংলা - সংগ্রামের নোটবুক
শিরোনাম সংবাদপত্র তারিখ
সম্পাদকীয় স্বাধীন বাংলা

মুজিব নগরঃ ৫ম সংখ্যা

৬ নভেম্বর, ১৯৭১

[*স্বাধীন বাংলাঃ বাংলাদেশের সংগ্রামী জনগণকে সাপ্তাহিক মুখপত্র। সম্পাদক মন্ডলীর সভাপতি-খোন্দকার সামসুল আলম দুদু কর্তৃক মুজিবনগর হতে প্রকাশিত ও স্বাধীন বাংলা প্রেস হতে মুদ্রিত।]

সম্পাদকীয়

বাংলাদেশের সংগ্রামী জনতার জাতিয় মুক্তি আন্দোলন সফল হবে কি-না এই সংশয় জড়ান প্রশ্নে দ্বিধা-গড়তার মেঘ ক্রমশঃ ধীরে ধীরে কেটে যাচ্ছে, রাজনীতির আকাশ মেঘমুক্ত ও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

একদিকে মুক্তিযোদ্ধাদের সংগ্রাম পর্যায়ক্রমে তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে এবং বিচ্ছিন্নতা কাটিয়ে একটা সুসংবদ্ধ রুপ পরিগ্রহ করছে অন্যদিকে বিশ্ববিবেক তার ঔদাসীন্য আর নৈর্ব্যত্তিক ভাব পরিত্যাগ করে ক্রমাগত বাংলাদেশ সরকার ও মুক্তিযোদ্ধাদের সমর্থনে সক্রিয় হয়ে উঠেছে। অবশ্য এই শুভ লক্ষণ স্বাভাবিকভাবে ও সহজেই পরিলক্ষিত হয়নি। সামগ্রিকভাবে বর্তমানে অপেক্ষাকৃত অনুকূল পরিস্থিতি সৃষ্টির পেছনে রয়েছে মুক্তিকামী সংগ্রামী জনতার অভূতপূর্ব দৃষ্টান্ত বিরাট ত্যাগ তিতিক্ষা এবং জীবনপণ সংগ্রাম সাধনা অন্যদিকে তেমনি বন্ধু ও দরদী প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের জনগণের উল্লেখযোগ্য সক্রিয় ভূমিকা। ভারতের জনগণ বাংলাদেশের এই গণ আন্দোলনকে স্বতঃস্ফূর্ত আন্তরিকভাবে শুরু থেকেই সমর্থন জানিয়ে এসেছেন। ভারতের সর্ববস্তরের মানুষ কৃষক, শ্রমিক, ব্যবসায়ী, কেরানী, কর্মচারী, এমনকি ভিন্ন ভিন্ন মতাদর্শে বিশ্বাসী বিভিন্ন রাজনৈতিক দলও বাংলাদেশ সরকারের স্বীকৃতির দাবীতে সোচ্চার হয়ে উঠেছেন। বিভিন্ন বিধানসভা ও আইনসভার সদস্যগণ সকল দেশের সংগ্রামের সমর্থনের অনুকূলে প্রস্তাব গ্রহন করেছেন। এতদিন যে সহমর্মিতার জোয়ার ভারতের জনসমুদ্রকে আন্দোলিত চঞ্চল করে তুলেছিল আজ তার ব্যপ্তি বহুদূর প্রসারিত। তারই প্রতিভাস আমরা লক্ষ্য করেছি। সুদূর লন্ডন, প্যারীস, মস্কো ও ভিয়েতনামে সেখানকার প্রগতিশীল গণতন্ত্রে ও স্বাধীনতা প্রিয় জনগণ বাংলাদেশের এই সংগ্রামকে সমর্থন করে জোরালো বক্তব্য রেখেছন। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও গণসংগঠনের মাধ্যমে আর্থিক সাহায্য প্রেরণ করেছেন আর মুক্তিযুদ্ধকে মদত দিতে ব্যাপক জনমত গঠন করে চলেছেন।

বেহায়া খাঁন সাহেব (ইয়াহিয়া খাঁন না বেহায়া খাঁন) মার্কিন সরকারের প্রচ্ছন্ন প্রশ্রয়ে এবং রাষ্ট্রপুঞ্জের বাংলাদেশের রাজনৈতিক সমাধানের প্রশ্নে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গীর সুযোগ নিয়ে এক অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের মানুষের ন্যায্য স্বাধীনতা আন্দোলনকে আড়াল ও ক্ষুণ্ণ করার জন্য অবিরাম মিথ্যা অপপ্রচার ও নির্লজ্জ চাতুরীর আশ্রয় নিয়ে বিশ্বের জনমতকে ধোঁকা দিতে চাইছে এই অজুহাতে যে- বাংলাদেশের যা কিছু ঘটেছে তার পিছনে ভারতের চক্রান্ত ও হাত আছে এবং ভারতীয় অনুপ্রবেশকারীরা পাকিস্তানকে দ্বিখন্ডিত করার জন্য বাংলাদেশের অভ্যন্তরে এই গোলযোগ সৃষ্টি করেছে। আর এই উছিলায় পুরো ঘটনাকে পাক-ভারত বিরোধের আকার দিতে চাইছে এবং সীমান্তে প্রচুর সৈন্য সমাবেশ করে ভারতের প্রতি রণহুংকার ছাড়ছে। আশ্চর্য এই বেহায়া খাঁন। নির্লজ্জতারও একটা সীমা থাকা উচিত।

বিশ্বের বিভিন্ন ঘটনাবলীর অন্যতম স্মরণীয় ঘটনা সদ্য মহাচীনের রাষ্ট্রপুঞ্জে আসন লাভ। সমাজতান্ত্রিক দুনিয়ার অন্যতম শ্রেষ্ঠ রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপুঞ্জে স্থায়ীভাবে প্রতিনিধিত্ব করার পরিপ্রেক্ষিতে এই আশা প্রকাশ করা যায় যে এবার হয়ত রাষ্ট্রপুঞ্জে তার নৈর্বত্তিক নির্লিপ্তভব ত্যাগ করে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সমাধানে সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করবে।

রাজনৈতিক সমাধানের রূপরেখা অবশ্যই বাংলাদেশ সরকারের প্রধান্মন্ত্রী জনাব তাজউদ্দিন আহমদ আরোপিত চারটি মৌল দাবির উপর ভিত্তি করেই নির্ধারিত হবে। যেমন –প্রথমতঃ স্বাধীন বাংলাদেশ, দ্বিতীয়তঃ বাংলাদেশের প্রিয়তম নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের মুক্তি, তৃতীয়তঃ বিনা শর্তে সমস্ত সৈন্য অপসারণ। বাংলাদেশের সংগ্রামী জনতা ও মুক্তিবাহিনী এ বিষয়ে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ যে বহিপ্রচেষ্টা যতই প্রতিকূল কিংবা অনুকূলেই হোক না কেন বাংলাদেশের পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জন ও জাতীয় মুক্তি একমাত্র নিরলস একনিষ্ঠ সংগ্রামের মাধ্যমে সম্ভব। কারন স্বাধীনতা অর্জিত হয়, প্রদত্ত হয় না।

-জয় বাংলা