শিরোনাম | সংবাদপত্র | তারিখ |
সম্পাদকীয়
হিন্দু না ওরা মুসলিম, জিজ্ঞাসে কোন জন ? |
দেশ বাংলা
১ম বর্ষঃ ৪র্থ সংখ্যা |
১৮ নভেম্বর , ১৯৭১ |
সম্পাদকীয়
হিন্দু না ওরা মুসলিম
জিজ্ঞাসে কোন জন ?
পশ্চিম পাঞ্জাবী দস্যুবৃত্তির শিকার হয়ে বাংলাদেশ থেকে যারা ( চন্দ্রবিন্দু) ভারতে চলে গিয়েছেন, তাঁদের অধিকাংশই হিন্দু, এই ধুয়া তুলে জনৈক পশ্চিমা সাংবাদিক দিল্লীতে মিসেস গান্ধীকে প্রস্তাব দিয়েছেন, এদের সবাইকে ভারতের নাগরিক করে নিলে কেমন হয় ?
প্রস্তাবটি ওই সাংবাদিকের নিজস্ব হলে ক্ষতি ছিল না। শোনা যায়, মহল বিশেষ থেকে পরিকল্পিতভাবে এই “ফিলার” পরিবেশন করা হচ্ছে।
বাংলাদেশের নব্বই লক্ষ মানুষ গৃহহারা, সর্বহারা হয়ে প্রাণভয়ে সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে চলে গেছে। তাঁদের অপরাধ তারা নিজ দেশে পরবাসী হয়ে থাকতে চায়নি। তাদের অপরাধ তারা তাঁদের স্বদেশের মাটিতে বিদেশী বেনিয়া প্রভুত্ব মেনে নিতে পারেনি। সেই অপরাধের খেসারত দিতেই তাদের আজ স্বদেশ স্বজন থেকে দূরে অপরিসীম দুঃখ- দুর্দশাকে বরণ করে নিতে হয়েছে। কিন্তু দূর-দুরান্তে বসে যারা চিরকাল এই উপমহাদেশের মানুষের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিন খেলছে, তারা কি এই পরিস্থিতিতেও নতুন করে ঘোলাপানিতে মাছ শিকারের স্বপ্ন দেখছে ? বাংলাদেশের এক কোটি মানুষকে বিদেশী বানিয়ে, তথাকথিত পাকিস্তানের কাঠামোর মধ্যে বাঙালীদের সংখ্যালঘিষ্ঠ করে চিরদিনের মত ভারত- পাকিস্তান সংঘাত জিইয়ে রাখার নতুনতর ফন্দি আঁটা হচ্ছে কি ?
শরণার্থীরা বেশীর ভাগ হিন্দু। বিভেদকামী পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদ ( এখানে সামাজ্যবাদ) সঠিক জায়গাতেই ঘা দিয়েছে। কিন্তু তাদের মনে রাখা উচিৎ আজকের বাংলাদেশ ১৯৪৬-এর বাংলাদেশ নয়। সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প থেকে মুক্ত বাঙালী জাতীয়তার মূর্ত পীঠস্থান এই বাংলাদেশ। বাংলার মুসলমান, বাংলার হিন্দু, বাংলার বৌদ্ধ, বাংলার খৃষ্টান, বাংলার আদিবাসী তাদের নিজ নিজ বিশ্বাস নিয়ে বেঁচে থাকবে সন্দেহ নেই, কিন্তু জাতীয়তা এবং রাষ্ট্রীয়তার প্রশ্নে তাদের একমাত্র পরিচয় তারা বাঙালী, বাংলাদেশের নাগরিক।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম প্রমাণ করে দিয়েছে ধর্ম জাতীয়তার একমাত্র নিয়ামক হতে পারে না, ভাষা- সংস্কৃতি এবং অর্থনৈতিক- রাজনৈতিক একাত্মতাই জাতীয়তার মৌল ভিত্তি। এই নবলব্ধ অভিজ্ঞতা কেবল এই উপমহাদেশের জন্য নয়, গোটা পৃথিবীর জন্যই এক অভিনব শিক্ষা। বাংলাদেশের মানুষ নিজেদের জন্মগত অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আপন ইচ্ছায় আপন শক্তিতে শক্তিমান হয়ে স্বাধীনতার পতাকা উর্ধেব তুলে ধরেছে। আজও গোটা পৃথিবীর তাবৎ বৃহৎ শক্তির ভ্রূকুটি উপেক্ষা করে বাংলার দামাল ছেলেরা শত্রুর সাথে অসমযুদ্ধে পাঞ্জা লড়ছে। এ যুদ্ধে তাদের বিজয় অবশ্যম্ভাবী জেনেই কি পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদীরা নতুন নতুন ফন্দি আবিষ্কারের চেষ্টায় মেতেছে ?
বাংলাদেশ সরকার ইতিমধ্যেই ঘোষণা করেছেন যে, শরণার্থীদের সকলকেই স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরিয়ে নেওয়া হবে। শরণার্থীরাও দ্যার্থহীন ভাষায় বলেছেন, তাঁদের মাতৃভূমি বাংলাদেশ। ভারতে তাঁদের অবস্থান স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রয়োজনেই। অধিকৃত বাংলা থেকে হানাদার সৈন্যরা বিতাড়িত হলে দেশে ফিরে যেতে তাঁদের এতটুকুও বিলম্ব হবে না। মনে রাখতে হবে, বাঙালী শরণার্থীদের ভারতীয় নাগরিকত্ব দেবার অধিকার ভারতেরও নেই । তারা হিন্দু, না মুসলিম, সে প্রশ্নের সমাধি রচিত হয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে। এ প্রশ্ন নতুন করে যারা তুলতে চাইবে, তাঁদের “লাল মুখ” কারো করে দেবে সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর ইস্পাত ঐক্য। অতএব, সাধু সাবধান !