শিরোনাম | সংবাদ পত্র | তারিখ |
সম্পাদকীয়
মুক্তিযোদ্ধারা হুঁশিয়ার |
স্বাধীন বাংলা
১ম বর্ষ ঃ ৩য় সংখ্যা |
০১ নভেম্বর ১৯৭১ |
[স্বাধীন বাংলাঃ কমিউনিষ্ট বিপ্লবীদের পূর্ব বাংলা সমন্বয় কমিটির চট্টগ্রাম বিভাগের পাক্ষিক মূখপত্র। সমন্বয় কমিটির চট্টগ্রাম বিভাগ কর্তৃক প্রকাশিত ও মুদ্রিত ]
সম্পাদকীয়
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের আকাশে অশুভ কালো মেঘের ছায়া!
মুক্তিযোদ্ধারা হুঁশিয়ার!
বাংলাদেশের জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম আজ এক বিশে ক্রান্তিলগ্নে আসিয়া দাঁড়াইয়াছে। এই সংগ্রাম যাতে তাহার ইস্পিত লক্ষ্যে না পৌছাইতে পারে, তাহার জন্য দেশী –বিদেশী ষড়যন্ত্রের সীমা পরিসীমা নাই। বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের দীর্ঘমেয়াদী টরিত্রটি বিভিন্ন স্বার্থবাদী মহলের চক্ষুশূল হইয়া দাঁড়াইয়াছে। কারণ, লড়াইয়ের মেয়াদ যতই দীর্ঘ হইয়া উঠিতেছে, ততই বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধারা সম্পূর্ণ নিজের পাঁয়ে দাঁড়াইয়া নিজের শক্তিকে সুসংহত করিয়া এবং নিজের শক্তিতে বলীয়ান হইয়াছে এই মুক্তিযুদ্ধকে সাফল্যের তোরণশীর্ষে লইয়া যাওয়ার ক্ষেত্র প্রস্তুত করিতে পারিতেছে। আমরা গত সম্পাদকীয়তে এই কথা উল্লেখ করিয়াছিলাম যে বহু দুর্বলতা ও সীমাবদ্ধতা সত্বেও বর্তমান সংগ্রামে জনযুদ্ধে বিপ্লবী উপাদানগুলি সঞ্চালিত হওয়ার বাস্তব ভিত্তি সৃষ্টি হইতেছ। বাংলাদেশে জনযুদ্ধের আসল চেহারা কি, তাহা আমাদের সুস্পষ্টভাবে উপলব্ধি করিতে হইবে। জনযুদ্ধের বৈশিষ্ট হইতেছেঃ জাতীয় স্বাধীনতার সংগ্রামের সহেত একটি জাতীর বিপুল সংখ্যাগরিষ্ট অংশ মেহনতী মানুষের বিশেষ করিয়া কৃষকের শোষণ মুক্তির সংগ্রামকে যুক্ত করা। জনযুদ্ধে পরিণত কবার জন্য ইহা একান্তভাবেই প্রয়োজন, কারন তাহা না হইলে সোম্রাজ্যবাদ বিশেষ করিয়া মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীদের ক্রমবর্ধমান সাহায্যপুষ্ট, আধুনিক অস্ত্র শস্ত্রে সুসজ্জিত একটি বিসাল সৈন্যবাহিনীর বিরুদ্ধে অপ্রস্তুত, অসংগঠিত এবং প্রায় নিরস্ত্র জনতার অসম যুদ্ধ চলিতে পারেনা। বিভিন্ন দেশের মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাস ইহা নির্ভুলভাবে প্রমাণিত করিয়াছে দীর্ঘমেয়াদী যুদ্ধের নিরবচ্ছিন্ন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়া শত্রুর শক্তিকে ক্রমান্বয়ে ক্ষয় করিয়া এবং জনতার শক্তিকে ক্রমবর্ধমান হারে সংহত ও বৃদ্ধি করিয়াই মুক্তিযুদ্ধ চুড়ান্ত সাফল্য লাভ করিতে পারে। আর দীর্ঘমেয়াদী যুদ্ধকে টিকাইয়া রাখার জন্যই প্রয়োজন শত্রুর দুর্বলতম স্থান বাংলাদেশের বিশাল বিস্তীর্ন গ্রামাঞ্চলে সশস্ত্র সংগামের ঘাঁটি স্থাপন করা। এই সশস্ত্র সংগামের ঘাঁট অঞ্চল প্রতিষ্ঠা এবং তাহাতে মুক্তিফৌজ এবং বিপ্লবী গেরিলা বাহিনীর অবাধ সঞ্চারনে আত্মরক্ষা এবং হানাদার বাহিনীকে আক্রমন করার শক্তি সঞ্চয় এবং বৃদ্ধি করার জন্যই গ্রামের জনসমষ্টির বৃহত্তর অংশ কৃষকের সক্রিয় সমর্থন ও সহযোগিতা প্রয়োজন। তাহা ছাড়া ইহা বলাই বাহুল্য যে, বাংলাদেশের মত একটি আধা ঔপনিবেশিক আধা সামন্তবাদী দেশ যেখানে কৃষকেরা হইতেছে দেশের জনসমষ্টির শতকরা ৮৬ জন, সকলে মুক্তিফৌজ এবং বিপ্লবী গেরিলা বাহিনী মুলত কৃষকদের লইয়াই গঠন করিতে হইবে। কিন্তু বাংলাদেশের কৃষক সমাজ বর্তমান মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করিতেছে কোন সন্দেহ নাই, কিন্তু প্রত্যক্ষভাবে এই সংগ্রামে অংশগ্রহন করিতেছে? নিশ্চয়ই এখনো নয়। প্রশ্ন হইতেছে জাতীয় স্বাধীনতার মধ্য দিয়া কৃষকের বুক হইতে জোতদার মহাজনের প্রত্যক্ষ শাষনের জগদ্দল পাথর যে সরিয়া যাইবে, এই কর্মসূচী স্বাধীনতার কর্মসূচীর সহিত যুক্ত না হইলে তাহারা কেন এই সংগ্রামে প্রত্যক্ষভাবে ঝাঁপাইয়া পড়িবে? শুধুমাত্র নিছক স্বাধীনতার ফাঁকা আওয়াজের আবেদন কৃষক সমাজের মধ্যে কতটুকু রহিয়াছে? তাহারাতো গত ২৪ বছর ধরিয়া তথাকথিত ‘স্বাধীনতার’ বিষাক্ত আস্বাদ পাইয়াছে!
আর একটি কথা শুধু কর্মসূচি গ্রহন করিলেই চলিবেনা। শুধু এই কথা বলিলেই চলিবেনা যে ‘স্বাধীনতার’ পর তোমাদের জীবনে আমরা সুখ সম্পদের বন্যা বহাইয়া দিব। তাই আজ বাংলাদেশের বুক হইতে পাকিস্তানের হানাদার বাহিনীকে উৎখাত করার সংগ্রাম একদিকে যেমন চলিবে আবার অন্যদিকে এই লড়াইকে জনযুদ্ধের মাধ্যমে সফল করিয়া তুলবার স্বার্থেই গ্রামাঞ্চলে জোতদার মহাজনের যে সমস্ত গরীব ও ভূমিহীন কৃষক বর্গাচাষ করে, তাহাদের ফসল পূর্বের তুলনায় বেশী দেওয়া মহাজনের নির্মম শোষন বন্ধ করা, জমির সিলিং নির্দিষ্ট করিয়া দেওয়া, জাতীয় শত্রুদের সম্পত্তি সমপুর্ন বাজেয়াপ্ত করিয়া গরীব ও ভূমিহীন কৃষকদের মধ্যে বিতরন করা প্রভৃতি কর্মসূচি গ্রহণ করা একান্তভাবেই প্রয়োজন। তাহা হইলেই কৃষকের মধ্যে এক প্রচন্ড উৎসাহ ও উদ্দিপনা সৃষ্টি হইবে এবং তাহারা বাধভাঙ্গা শ্রোতের মত স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপইয়া পড়িবে।
তাই ইহা পরিষ্কার যে মুক্তিযুদ্ধকে সফল করিয়া তুলিতে হইলে ইহাকে দীর্ঘমেয়াদী যুদ্ধে পরিণত করা আবশ্যক, আবার অন্যদিকে দীর্ঘমেয়াদী যুদ্ধ চালাইয়া যাইতে হইলে কৃষকের শোষণ মুক্তির কর্মসূচি গ্রহণ এবং তাহাকে কার্যকরী করার প্রক্রিয়া মুরু করার মাধ্যমে কৃষকের মধ্যে জাগরণের উত্তাল জোয়ার সৃষ্টি করা প্রয়োজন। এই জন্যই দীর্ঘমেয়াদী যুদ্ধ এবং জনযুদ্ধ একটি অপরটির সাথে নিবিড় সম্পর্কযুক্ত।এই জন্যই আমরা এই কথা বলি, বর্তমান সংগাম যতই দীর্ঘমেয়াদী হইতেছে, ততই জনযুদ্ধের বিপ্লবী উপাদান ইহার মধ্যে ইতিহাসের স্বাভাবিক গতিধারায় সঞ্চারিত হইয়া চলিতেছে।
এই কারনেই বাংলাদেশের বর্তমান লড়াইকে মাঝপথে থামাইয়া দিয়া একটি ‘রাজনৈতিক সমাধানের’ গগনভেদী আওয়াজ উঠিয়াছে। ইহা অত্যন্ত সহজ কথা যে, বাংলাদেশের বর্তমান লড়াই দীর্ঘমেয়াদী প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়া জনযুদ্ধে পরিণত হইলে বাংলাদেশের ‘স্বাধীনতাকে’ প্রতিহত করার ক্ষমতা পাক হানাদার বাহিণী কেন, দুনিয়ার কোন শক্তিরই থাকবেনা। ভিয়েতনামই তাহার উজ্জলতম প্রমাণ। শুধু তাই নয়, জনযুদ্ধের মাধ্যমে যে স্বাধীনতা আসিবে, সে স্বাধীনতার চেহারাই হবে আলাদা। ইহা হবে কৃষক, শ্রমিক, মধ্যবিত্ত এবং জাতীয় দেশপ্রেমিক ধনিক শ্রেনী তথা সমগ্র জনতার স্বাধীনতা, যেখানে থাকিবে প্রতিটি মানুষের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসার নূন্যতম নিশ্চয়তা। কিন্তু বোধগম্য কারনেই মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ আমাদের পুরাতন ’প্রভু’ বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদ এবং অন্যান্য কায়েমী স্বার্থবাদীরা তাহা পছন্দ করিতে পারেনা।
সোভিয়েত রাশিয়া আমাদের সংগামের প্রতি নৈতিক সমর্থন দিয়াছে। কিন্তু ‘শান্তিপূর্ণ ভাবে সমাজতন্ত্র উত্তরন’ কিংবা একটি স্ফুলিঙ্গই বিশ্বযুদ্ধের দাবানল সৃষ্টি করিয়া দিতে পারে’- এই তত্বে বিশ্বাসী বলিয়া তাহারা স্বভাবিক ভাবেই আমাদের সংগ্রামের প্রতি সমর্থন প্রদান করা সত্বেও ইহাকে ‘রাজনৈতিক সমাধানের’ পথে লইয়া যাইতে চায়। ভারতের জনগন ও সরকার আমাদের নৈতি ও বৈষয়িক সাহায্য প্রদান করিতেছে। কিন্তু ভারত সরকার প্রথম হইতেই এই প্রশ্ন তুলিয়া ধরিতেছে যে তাহারা এককোটি শরনার্থীর বোঝা আর কতদিন বহন করিবে? আর ইহাতো অনস্বীকার্য সত্য যে কোন বিদেশী রাষ্ট্রের উপর সম্পুর্ণ নির্ভরশীল হইয়া একটি দেশের জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ চলিতে পারেনা। তাই বিভিন্ন মহল হইতে বাংলাদেশ প্রশ্নটির একটি রাজনৈতিক সমাধানের বেপরোয়া চেষ্টা শুরু হইয়াছে। এখন প্রশ্ন হইতেছে কোন পথে এই ‘রাজনৈতিক সমাধান’ কার্যকরী করার প্রচেষ্টা চলিতেছে? শান্তিপূর্ণ পথে এই ‘রাজনৈতিক সমাধানে ‘ জন্য ইতিমধ্যেই ওয়াশিংটন, লন্ডন এবং মস্কোতে ব্যাপক সুক্ষ কুটনৈতিক তৎপরতা শুরু হইয়াছে। ইতিমধ্যে এই সমস্ত রাষ্ট্রের কুটনৈতিক প্রতিনিধিদের রাওয়ালপিন্ডি, দিল্লী ও মুজিবনগরে ব্যাপক আনাগোনা চলিয়াছে বলিয়া বিদেশী সংবাদপত্রগুলিতে খবর প্রকাশিত হইয়াছে। বলা বিাহুল্য ‘রাজনৈতিক সমাধানের’ অর্থ হইতেছে পাকিস্তানর রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যে সীমাবদ্ধ স্বায়ত্বশাষনের ভিত্তিতে বাংলাদেশ প্রশ্নটির ‘রাজনৈতিক সমাধান’। কিন্তু এই ধরনের ‘রাজনৈতিক সমাধানের’ পথে বাধা হইতেছে, বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামী জনতা, মুক্তিফৌজ ও গেরিলা বাহিনী, এই জন্য বিভিন্ন রাজনৈতিক ভাষ্যকারেরা এই অভিমত প্রকাশ করিতেছেন যে বিভিন্ন স্বার্থ সংশ্লিস্ট মহল পাক ভারত যুদ্ধের মাধ্যমে রাজনৈতিক সমাধানের একটি জোর প্রচেষ্টা শুরু করিয়াছে। এই সমস্ত রাজনৈতিক ভাষ্যকারের বিশ্ণেষন হইতেছে পাক ভারত যুদ্ধ সংঘঠিত হওয়ার সাথে সাথে এই সমস্ত স্বার্থ সংশ্লিস্ট মহল আন্তর্জাতিক সালিশীর নামে বাংলাদেশের ব্যাপারে প্রত্যক্ষভাবে নাক গলাইবার সুযোগ পাইবে, তাসখন্দ চুক্তির অনুরূপ যুদ্ধবিতি চুক্তি সম্পাদন করাইতে পারিবে এবং পাকিস্তানী রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যে রাখিয়াই শিথিল কনফেডারেশনের ধুয়া তুলিয়া ‘রাজনৈতিক সমাধানের কুইনাইন’ গিলাইতে পারিবে। তাহা ছাড়া তখন এই কথা বলা যাইবে যে, ‘বাংলাদেশ ইস্যুটির মীমাংসার জন্য সকল রকম প্রচেষ্টা চালানো হইয়াছে, এমনকি শেষ পর্যন্ত পাক ভারত যুদ্ধও হইয়া গেল, তাই এখন রাজনৈতিক সমাধান ছাড়া উপায়ই বা কি? এইভাবে বাংলাদেশের জনগনকে বিভ্রান্ত করা যাইবে বলিয়া এই সমস্ত স্বার্থবাদীরা মনে করে। অন্যদিকে একই কারনে পাকিস্তানের শাষকগোষ্টীর পক্ষেও এই ধরনের একটি যুদ্ধ বাধাইবার প্রচেষ্টা চালানো স্বাভাবিক। পাকিস্তানের শাষকগোষ্টীর ক্রমাগত উষ্কানীর মুখে এবং আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের প্রেক্ষিতে ভারতেরও এই ধরনের একটি যুদ্ধে জড়াইয়া পড়িবার আশংকা রহিয়াছে বলিয়া এইসব রাজনৈতিক ভাষ্যকারেরা মনে করেন। এই সমস্ত রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতামত যাহাই হউকনা কেন এবং পাক ভারত যুদ্ধ হউক বা না হউক রাজণৈতিক সমাধানের যে জোর প্রচেষ্টা চলিয়াছে ইহাতে কোন সন্দেহ নাই বলিয়া আমরা মনে করি। তাই আজ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের আকাশে ঘণকালো মেঘের অশুভ ছায়া দেখা দিয়াছে। আগামি দুটি মাস বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অত্যন্ত জটিল ও কঠিন সময়। এই জন্যই বাংলাদেশের সংগ্রামী জনতা সকল, স্বাধীনতাকামী শক্তি মুক্তিফৌজ এবং বিপ্লবী গেরিলা বাহিনীকে এই ষড়যন্ত্র সম্পর্কে আজ হুঁশিয়ার হওয়া ঐতিহাসিক কারনেই মহান দ্বায়িত্ব ও কর্তব্য হইয়া দাঁড়াইয়াছে।
আমরা তাই পুনরায় বাংলাদেশের সরকার ও আওয়ামীলীগসহ সকল সংগামী শক্তিকে নিম্নতম কর্মসূচীর ভিত্তিতে ব্যাপক জনতার আশা আকাঙ্খার পরিপূরক একটি ঐক্যবদ্ধ ও সুসংহত জাতীয় মুক্তিফ্রন্টের পতাকাতলে সমবেত হওয়ার উদাত্ত আহবান জানাই। আমরা সকল সংগামী শক্তি, মুক্তিফৌজ, বিপ্লবী গেরিলা বাহিনীর প্রতি পারস্পরিক সংযোগ ও সমন্বয় সাধনের মাধ্যমে নিজেদের শক্তিকে সুসংহত করার আকুল আবেদন জানাই। সকল বামপন্থী শক্তির প্রতিও আমরা সংগ্রামের মধ্যদিয়া চিন্তাধারা ও কাজের ঐক্যের ভিত্তিতে শ্রমিক শেনীর বিপ্লভী আদর্শে উদ্ধুদ্ধ একটি সুসংহত বিপ্লবী পার্টি গড়িয়া তোলার উদাত্ত আহবান জানাই। আমরা দৃড়ভাবে বিশ্বাস করি, সংগামকে প্রকৃত জনযুদ্ধে পরিণত করিয়া বাংলাদেশের সংগ্রামী জনতাকে শক্তি মূল উৎস করিয়া আত্মনির্ভরশীল হইতে পারিলেই একমাত্র দেশী বিদেশী এই ষড়যস্ত্র ব্যর্থ করা সম্ভব – ইহার বিকল্প কোন পথ নাই।
উপরোক্ত দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে বর্তমান পরিস্থিতিতে আমরা বাংলাদেশের সকল সংগ্রামী শক্তি, মুক্তিফৌজ, বামপন্থী প্রগতিশীল মহল ও বিপ্লবী গেরিলা বাহিনীর নিকট নিম্নোক্ত আশু করনীয় কর্তব্য উপস্থিত করিতেছি।
১। জনগণের পাশে যাইয়া দাঁড়ান
আর এক মূহুর্তও দেরী না করিয়া আমাদের শক্তির একমাত্র উৎস বাংলাদেশের জনগণের পাশে যাইয়া দাঁড়াইতে হইবে। ‘রাজনৈতিক সমাধানের’ যে অশুভ তৎপরতা শুরু হইয়াছে, সে সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করিয়া তুলিতে হইবে। রাজনৈতিক প্রচার আন্দোলন ও রাজনৈতিক সংগঠনের উপর আমাদের বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করিতে হইবে। জনতাকে দীর্ঘমেয়াদী যুদ্ধের অবশ্যম্ভাবী প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে সচেতন করিয়া তুলিতে হইবে।
২। জাতীয় সংগ্রামের সহিত কৃষকের শোষণ মুক্তির সংগ্রাম যুক্ত করুন
গ্রামে গ্রামে জনতার বিভিন্ন অংশের প্রতিনিধি লইয়া সর্বদলীয় গণমুক্তি পরিষদ গঠন করিয়া নিম্নোক্ত কর্মসূচী বাস্তবায়িত করার মাধ্যমে এই সংগ্রামে কৃষককে প্রত্যক্ষভাবে নামাইতে হইবে। ক) জাতীয় শত্রুদের সকল সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করিয়া গরীব ও ভূমিহীন কৃষকদের মধ্যে বিতরন করিতে হইবে। খ) যে সকল জোতদার মহাজন জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের পক্ষে রহিয়াছে তাহাদের প্রতি নমনীয় মনোভাব গ্রহন করিতে হইবে। কিন্তু সাথে সাথে এই সমস্ত জোতদারদের নিকট হইতে জাতীয় মুক্তির বৃহত্তর স্বার্থে কৃষকদের সুযোগ সুবিধা আদায় করিতে হইবেএই জন্য বর্গাচাষীরা পূর্বের তুলনায় ফসলের অংশ বেশী করিয়া যাহাতে পায় তাহার ব্যবস্থা করিতে হইবে। স্থান ও অবস্বথা বিশেষে এই সমস্ত জোতদারদের জমির সিলিংও নির্দিষ্ট করিয়া দিতে হইবে। মহাজনের চড়া হারে সুদ আদায় বন্ধ করিতে হইবে। মজুতদারদের প্রয়োজনাতিরিক্ত খাদ্যশস্য গরিব সাধারনের মধ্যে স্বল্পমূল্যে বিক্রয়ের ব্যবস্থা করিতে হইবে। ক্ষেতমজুরদের মজুরী বৃদ্ধির ব্যবস্থা করিতে হইবে। যাহারা স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি ফেলিয়া দেশত্যাগ করিতে বাধ্য হইয়াছেন, তাহাদের সম্পত্তি গণমুক্তি পরিষদের প্রত্যক্ষনিয়ন্ত্রনে আনিতে হইবে, অন্তর্বর্তীকালীন সময়ের জন্য ইহা কৃষকদের নিকট চাষাবাদের জন্য দিতে হইবে এবং এইভাবে গ্রামে টাউট বদমাইশদের হাত হইতে শরনার্থীদের পরিত্যক্ত সম্পত্তি রক্ষনাবেক্ষণ করিতে হইবে।
৩। নীচের দিক হইতে সংগ্রামী ঐক্য গড়িয়া তুলুন
সকল স্বাধীনতাকামী রাজনৈতিক দল, গণ ও শ্রেনীর সংগঠন, মুক্তিফৌজ এবং বিপ্লবী গেরিলা বাহিনী তাহাদের রাজনৈতিক ও সামরিক কার্যক্রমকে সমন্বিত করুন এবং পরস্পরের মধ্যে অন্তরঙ্গ সংগ্রামী সম্পর্ক গড়িয়া তুলুন। মুক্তিফৌজ এবং বিপ্লবী গেরিলা বাহিনী পরস্পরের মধ্যে সংযোগ ও সমন্বয় সাধন করিয়া শত্রুকে আঘাত করার ঐক্যবদ্ধ কর্মসূচী গ্রহণ করুন। মুক্তিফৌজকে অশ্রয়, খাদ্য ও রসদ দিয়া সাহায্য করুন। এইভাবে সংগ্রামের ময়দানে মুক্তিসংগ্রামের সকল শক্তি নীচের দিক হইতে ঐক্য প্রতিষ্ঠা করিয়া জাতীয় মুক্তিফ্রন্ট গড়িয়া তোলার দৃড় ভিত্তি প্রস্তুত করুন।
৪। পূর্ণ জাতীয় মুক্তি অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত লড়াইকে অব্যাহত রাখুন
যতদিন পর্যন্ত পাকিস্তানের শাষকগোষ্টীর জল্লাদ হানাদার বাহিনীর দস্যু সৈন্য বাংলাদেশের মাটি হইতে উৎখাত না হইতেছে, যতদিন সম্পূর্ণ স্বাধীন, সার্বভৌম জনতার স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত না হইতেছে, ততদিন মুক্তিযুদ্ধকে যে কোন মূল্যের বিনিময়ে অব্যাহত রাখার লৌহ কঠিন সপথ গ্রহন করুন এবং আপেষহীন সংগ্রামের আঘাতের পর আঘাতে মুক্তিযুদ্ধকে আরও দূর্বার করিয়া তুলুন্ কৃষক জনতাকে সশস্ত্র করুন, গ্রমাঞ্চলে রাজনৈতিক ও সশস্ত্র সংগ্রাদের ঘাঁটি প্রস্তুত করুন, গণযুদ্ধকে ক্রমান্বয়ে বিস্তীর্ন গ্রামাঞ্চলে এবং বিশাল জনতার মধ্যে ছড়াইয়া দিন। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে আরো বেশী করিয়া লড়াইয়ের পশ্চাদভূমি (Rear Base) এবং রাজনৈতিক ও সামরিক কার্যক্রম পরিচালনার কেন্দ্র স্থাপন করুন। হানাদার বাহিনী যে সীমান্তে সৈন্য সমাবেশ ঘটাইবে এবং সীমান্ত সংঘর্ষ যত বেশী আত্মস্থ (Absorbed) হইবে, তত বেশী করিয়া শত্রুকে পশ্চাতদিক হইতে আক্রমন করার সুযোগ সৃষ্টি হইবে- এই সুযোগের প্রতিটি অণু পরমাণুর সদ্ব্যবহার করুন।
৫। কৃষক জনতার মধ্য হইতে মুক্তিফৌজের সহায়ক শক্তি হিসাবে বিপ্লবী গেরিলা বাহিনী গড়িয়া তুলুন
কৃষক জনতার মধ্য হইতে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গেরিলা দল গঠনের মাধ্যমে বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামরিক ঘাঁটি এলাকাকে কেন্দ্র করিয়া বিপ্লবী গেরিলা বাহিনী গড়িয়া তুলুন এবং গেরিলা যুদ্ধকে ধাপে ধাপে বিকশিত করুন। গেরিলা যুদ্ধের নীতি ও কৌশলকে লড়াইয়ের বর্তমান পর্যায়ে প্রধান নীতি ও কৌশল হিসাবে গ্রহন করুন। মুক্তিফৌজ ও বিপ্লবী গেরিলা বাহিনী পরস্পরের পরিপূরক ও সহায়ক শক্তি হিসাবে কাজ করার কার্যকরী পন্থা গ্রহন করুন।