শিরোনাম | সংবাদ পত্র | তারিখ |
সম্পাদকীয়
জাতিসংঘের অগ্নিপরীক্ষা |
বাংলার বাণী
মুজিবনগরঃ ৪র্থ সংখ্যা |
২১ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ |
সম্পাদকীয়
জাতিসংঘের অগ্নিপরীক্ষা
আজ ২১ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সাধারন পরিষদের অধিবেশন শুরু হইতেছে।
জাতিসংঘ সাধারন পরিষদ আজ বৈঠকে মিলিত হইয়াই সর্ব্রাগ্রে যে জটিল রাজনৈতিক ইস্যুটির জ্বলন্ত সূর্যের মখোমুখি হইবে উহা হইতেছে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রসঙ্গ। মানবাধিকার সংরক্ষনের সুমহান ওয়াদাবদ্ধ জাতিসংঘের আঙ্গিনায় পাশাপাশি উপবিষ্ট হইয়া দলমত নির্বিশেষে সুশভ্য পৃথিবীর সকল জাতি চোখ মেলিলেই দেখিতে পাইবে বিশ্বের একান্তে এই বাংলাদেশে কিভাবে এক পররাজ্যলোভী হানাদার দস্যুর হিংশ্র বর্বরতায় দশ লক্ষ মানুষের রক্তের গঙ্গা প্রবাহিত হইতেছে, কিভাবে সাড়ে সাত কোটি মানুষের আত্মার আমোঘ বাণীকে, মৌলিক মানবিক অধিকারকে, শাশ্বত স্বাধীনতার দুরন্ত স্পৃহাকে শক্তির জোরে পিষিয়া মারার উন্মত্ত প্রচেষ্টা চলিতেছে, কিভাবে কারারুদ্ধ করিয়া রাখা হইয়াছে বাংলার মুকুটহীন সম্রাট স্বাধীন বাংলার জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে, কিভাবে তাকে পৃথিবী হইতে সরাইয়া দেওয়ার ঘৃণ্য প্রয়াশে উদ্যত হইয়া আছে জল্লাদের হাতিয়ার।
গত ছয় মাসে বাংলাদেশে যা ঘটিয়া গিয়াছে, বাংলাদেশে আজও যা ঘটিতেছে হানাদার পশ্চিম পাকিস্তানী কসাই বাহিনী বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকে ভন্ডুল করিয়া দেওয়ার জন্য যে হিংশ্র বর্বরতা, যে জঘন্য পোড়া মাটি নীতির আশ্রয় গ্রহন করিয়াছে, যেভাবে বাংলাদেশে বলদর্পী অক্রমনকারীর ঔদদ্ধত্যপূর্ণ পদচারনায় মানবাধিকার ভুলুন্ঠিত হইতেছে, ধর্ষিত নিগৃহিত হইতেছে মৌলিক মানবিক মূল্যবোধ, অসহায় মানবতা, সভ্য মানুষের ইতিহাসে ইহার কোন নজির নাই। তাই জাতিসংঘের ইতিহাসেও বাংলাদেশের ইস্যুটি এক নজিরবিহীন তাৎপর্যপূর্ণ অদ্বিতীয় ইস্যু। বাংলাদেশে মানব ইতিহাসের ঘৃণ্যতম বর্বরতা এবং ভয়াভহতম গণহত্যার রক্তাক্ত পটভূমিতে আজ জাতিসংঘ সাধারন পরিষদের অধিবেশন শুরু হইতেছে। সুতরাং বলিলে এতটুকু অত্যুক্তি হইবেনা যে, জাতিসংঘের চলতি অধিবেশন হইবে বিশ্ব সংস্থার ইতিহাসের সব চাইতে সংকটজনক অধিবেশন। এই অধিবেশনে বাংলাদেশ ইস্যুটি জাতিসংঘের জন্য ডাকিয়া আনিয়াছে এক অগ্নিপরীক্ষা। বাংরাদেশ ইস্যু কেন্দ্রিক এই অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ন হওয়া না হওয়ার উপর নির্ভর করে জাতিসংঘের ভবিষ্যৎ।
বলাবাহুল্য, একটি আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক আড্ডাখানা হিসেবে বা সাম্রাজ্যবাদী, উপনিবেশবাদী শক্তির খেয়াল খুশীমত কেতুর নাচ নাচিবার জন্য ও জাতিসংঘের জন্ম হয় নাই। মানব জাতির স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব ও মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ, বিশ্ব শান্তির নিশ্চয়তা এবং মানবিক মূল্যবোধের নিরাপত্তা বিধানের পবিত্র প্রতিশ্রুতিতেই সৃষ্টি হইয়াছে এই বিশ্ব সংস্থার। জাতিসংঘ সনদে সুস্পষ্ট ভাবেই গণহত্যা প্রতিরোধ এবং এক দেশ কর্তৃক অন্য দেশে সশস্ত্র হামলা বন্ধের ব্যাপারে কার্যকরী ব্যাবস্থা গ্রহণের দ্ব্যর্থহীন ওয়াদা লিপিবদ্ধ রহিয়াছে।
কিন্তু গভীর দুঃখের সঙ্গে এ কথাও না বলিয়া পারা যায় না যে বাংলাদেশে হানাদার পশ্চিম পাকিস্তানী সেনাবাহিণীর সশস্ত্র আক্রমন এবং গণহত্যা প্রতিরোধের ব্যাপারে জাতিসংঘ উহার বিঘোষিত দ্বায়িত্ব পালনে চুড়ান্ত ব্যর্থতার পরিচয় দিয়াছে। জাতিসংঘের এই ব্যর্থতা জাতিসংঘের সুমহান ভূমিকা সম্পর্কে আস্থাবান স্বান্তিকামী মানবজাতির প্রতি চরম বিশ্বাসঘাতকতারই শমিল।
বিগত মার্চ মাসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে বাংলাদেশে অতুলনীয় অহিংস অসহযোগ আন্দোলন শুরু হইলে জল্লাদ ইহাহিয়া বাংলাদেশে ব্যাপকহারে সৈন্য সমাবেশ করিতে শুরু করে। ২৫শে মার্চ রাত্রে কসাই বাহিনী যে গণহত্যাযজ্ঞ শুরু করে সম্ভবত উহারই অগ্রিম আভাস পাইয়া উথান্ট তৎপূর্বে ঢাকায় কর্মরত জাতিসংঘের কর্মচারীদের ঢাকা ত্যাগের অনুমতি প্রদান করেন। এই সময় বঙ্গবন্ধু উথান্টকে উদ্দ্যেশ্য করিয়া বলিয়াছেন, জাতিসংঘের কর্মচারীদের ঢাকা ত্যাগের অনুমতি দানের মধ্যে জাতিসংঘ সেক্রেটারী জেনারেলের কর্তব্য শেষ হইয়া যায়না। শক্তিমত্ত জঙ্গী শাষকের বিরুদ্ধে সংগ্রামরত বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষের প্রতি জাতিসংঘের যে দায়িত্ব রহিয়াছে উহা বিস্মৃত হইলে চলিবেনা।
কিন্তু ইহাতেও জাতিসংঘের চৈতন্যদয় হয়নাই। যদি হইত বাংলাদেশে মানব সভ্যতার ভয়াভহতম ট্রাজেডির বিভীষিকা সম্ভবতঃ অপেক্ষাকৃত কম হিংশ্রতা লইয়া দেখা দিতে পারিত। তারপর বহু দিন কাটিয়া গিয়াছে। বাংলাদেশে জল্লাদ ইহাহিয়ার নিধনধযঞ্জ চলিয়াছে অব্যাহত গতিতে, বিপন্ন মানবতা অসহায় আর্তনাদে বার বার মুখ থুবড়াইয়া পড়িয়াছে বাংলার রক্তপিচ্ছিল মাটিতে। ইহাহিয়া খান বাঙ্গালী জাতিকে নিশ্চিহ্ন করার উদ্দ্যেশ্যে ভয়াভহতম গণহত্যা অভিযান চালাইয়াই ক্ষান্ত হয়নাই, মাতিয়া উঠিয়াছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের জীবননাশের ঘৃন্যতম ষড়যন্ত্রে। বিশ্ব বিবেক জঙ্গী বর্বরতার বিরুদ্ধে ঘৃনা আর ধিক্কারে প্রমত্ত সাগরের ভয়াল গর্জন হইয়া ফাটিয়া পড়িয়াছে বারবার। কিন্তু তবু জাতিসংঘ নামক কুম্ভকর্ণের নিদ্রাভঙ্গ হয়নাই। স্বাধীনতা সংগ্রামে লীপ্ত বাংলার নেতা ও জনতার প্রতি স্বীয় দ্বায়িত্ব পালনে জাতিসংঘ অগ্রণী হইয়া আসে নাই। বরং উল্টা হানাদার জঙ্গীশাহীর সুবিধাজনক অনুরোধে বিগলিত হইয়া বাঙ্গালী জাতির মুক্তি সংগ্রাম বিঘ্নিত ও বানচাল করার জঘন্য উদ্দ্যেশ্য সাধনের নিমিত্তে ভারত বাংলাদেশ সীমান্তে জাতিসংঘ পর্যবেক্ষক নিয়োগের অবাঞ্চিত উদ্যেগ গ্রহন করিয়া বিশ্ব সংস্থা হিসেবে নিজের গৌরবমন্ডিত ছবিটাকেই তস্করবৃত্তির কলঙ্কে কালিমালিপ্ত করিয়া তুলিয়াছে। বুঝিতে কষ্ট হইবার কথা নয় যে, কঙ্গোর লুমুম্বা ট্রাজেডির নেপথ্য নায়ক ভিয়েতনামে অন্যায় যুদ্ধের ঘৃনিত দস্যু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকারের ইঙ্গিতেই জাতিসংঘ বাংলাদেশের প্রশ্নে স্বীয় দায়িত্ব পালনে ইচ্ছাকৃত ব্যর্থতার পরিচয় দিয়াছে। অর এই ব্যর্থতা বাংলাদেশের মানুষের সামনে, বিশ্বের শ্বান্তিকামী মানুষের সামনে জাতিসংঘকে লক্ষচ্যুত কার্যকারিতাবিহীন রাজনৈতিক আড্ডাখানা হিসাবেই উপস্থিত করিয়াছে।
এই পরিস্থিতির পটভূমিতেই আজ জাতিসংঘ সাধারন পরিষদের অধিবেশন বসিতেছে। জাতিসংঘের সকল ব্যর্থতা, উহার সকল শক্তির সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে সম্যক অবহিত থাকিয়াও আমরা শেষবারের মত মানবতার নামে এই বিশ্ব সংস্থার প্রতি আকুল আবেদন জানাইতেছি, মানুষের স্বাধীনতা, স্বার্বভৌমত্ব মানবিক মুল্যবোধ আর মানবজাতির প্রতি যদি উহার বিন্দুমাত্রও আস্থা এবং দ্বায়িত্ব থাকিয়া থাকে তবে এখনো সময় আছে। সমস্ত শক্তি লইয়া জাতিসংঘকে বাংলাদেশের পার্শ্বে আসিয়া দাড়াইতে হইবে সমস্ত শক্তি লইয়া রুখিয়া দাঁড়াইতে হইবে হানাদার পশ্চিম পাকিস্তানী উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে।
পৃথিবীর দিক-দিগন্ত হইতে যেসব দেশ ও জাতি আজ নিউইয়র্কে আসিয়া জাতিসংঘ সদর দপ্তরে বৈঠকে মিলিত হইতেছেন, তাহাদের কাছে মাতৃভূমির স্বাধীনতা রক্ষার জীবনপণ সংগ্রামে লিপ্ত, সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালীর পক্ষ হইতে আমাদের একটি মাত্র বক্তব্য আছে। বাংলাদেশে কি ঘটিয়াছে আপনারা জানেন। তাই যদি সভ্য জাতি বলিয়া দাবি করিতে চান, যদি গণতন্ত্র স্বাধীনতা ও মানবতায় বিশ্বাসী বলিয়া নিজেদের পরিচয় অক্ষুন্ন রাখিতে চান, তবে জাতিসংঘের এই অধিবেশনকালে একটিমাত্র পথই আপনাদের সামনে খোলা আছে। আর তাহা হইতেছে সকলের ঐক্যবদ্ধ চাপের দ্বারা ইহাহিয়ার জিন্দানখানা হইতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ছিনাইয়া আনা এবং স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়া জাতিসংঘে বাংলাদেশকে পৃথিবীর নবীনতম রাষ্ট্র হিসাবে আসন প্রদান করা। এইবারও যদি আপনারা বাঙ্গালী জাতির প্রতি দ্বায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হন, ইতিহাস আপনাদের চিহ্নিত করিবে মানবতা ও স্বাধীনতার দুশমন হিসাবে আর জাতিসংঘ পরিণত হইবে ব্যর্থ লীগ অব নেশনসের প্রেতাত্মায়।