শিরোনামঃ সম্পাদকীয় শোষণ অবসানের অভিযান
সংবাদপত্রঃ বিপ্লবী বাংলাদেশ ১ম বর্ষঃ ১৫শ সংখ্যা
তারিখঃ ২৮ নভেম্বর, ১৯৭১
সম্পাদকীয়
শোষণ অবসানের অভিযান
একদিকে সারা বাংলাদেশ ভারমুক্ত হবে, বাংলাদেশের সূচাগ্র ভূমিতেও পাকিস্তানী শোষকের অবৈধ অধিকার থাকবে না, সর্বত্র উড়বে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা। সর্বত্র প্রতিষ্ঠিত হবে সার্বভৌম, গণতান্ত্রিক, সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ সরকারের শাসন।
কবে আসবে সেদিন?
কয়েক মাস আগেও মনে হয়েছিল, সেদিন বুঝি বহুদূর। কিন্তু আজ শুধু বাংলাদেশের বাঙ্গালী নয়, বিদেশীরাও, শুধু বন্ধুরা নয়, শত্রুও ভাবছে এ ঘটবে অদূর ভবিষ্যতেই।
কী করে ঘটল এই পরিবর্তন? কোন গোপন অস্ত্র এল বাঙ্গালীর হাতে? কে যোগাল সেই অস্ত্র?
বিদেশী কোন মহাশক্তি কি? দুনিয়া জানে পাকিস্তানী জল্লাদেরা কার অস্ত্রের বলে বাংলার রক্ত বইয়ে দিয়েছে। যারা দিয়েছে সেই অস্ত্র তাদের না সবাই জানে। তারা মহাশক্তি, সাম্রাজ্যবাদী শক্তি যান্ত্রিক উন্নতিতে যারা জগতের শীর্ষস্থানে অধিকার করেছে। তেমন কোন শক্তি মহাপরাক্রমাশালী মারণাস্ত্র বাঙ্গালীর হাতে তুলে দেয়নি, যার বলে আজ পাক পশুশক্তি সন্ত্রস্ত, আতঙ্কগ্রস্ত।
যে শক্তির প্রয়োগে এই সামান্য সময়ে বাঙ্গালী জাতি পাক রক্তপায়ীদের রাক্ষস উল্লাসকে ত্রাসে পরিণত করেছে সে হল সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালীর শোষণ মুক্তির আকাংখা, মুষ্টিমেয় বাঙ্গালীর ক্ষমতা লোলুপতা নয়। সেই আকাংখা অনুপ্রাণিত করেছে সামান্য অস্ত্রে সজ্জিত, সুশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত, বৃদ্ধ, যুবক, শিশু, নারী-পুরুষ মুক্তিসেনাকে। শোষণ মুক্তির উন্মাদনায় মুক্তিযোদ্ধারা রক্তবীজের মত এক থেকে অনেক স্বল্প থেকে বহু হয়ে উঠেছে। সেই উন্মাদনায় ছড়িয়ে পড়েছে দিকে দিকে অঞ্চলে অঞ্চলে, সীমান্তে ও কেন্দ্রে যেখানেই শোষিত বাঙ্গালী সেখানেই মুক্তিসংগ্রামের বীজ অঙ্কুরিত হয়েছে-মুক্তির তীব্র আকুতি তার দ্রুত বৃদ্ধি অব্যাহত রেখেছে।
অপপ্রচারে বাংলাদেশের জনসাধারণ বিভ্রান্ত হয়নি। কেন? কারণ তারা মুক্তিবাহিনীর কার্যকলাপ প্রত্যক্ষ করেছে। তারা দেখেছে, মুক্তিযোদ্ধারা শুধু অস্ত্রবলে বলীয়ান নয়। তাদের মনোবল অটুট আর তাদের মনোবলের উৎস জনসাধারণের প্রতি তাদের সহানুভূতি, সৌহারদ্য, আত্মবোধ। তারা দেখেছে যে তারা জনসাধারণের জন্য, তাদের শোষণ মুক্তির জন্য দিতে পারে সব কিছুই, দিতে পারে প্রাণ- অথচ চায় না কিছুই। তাদের মুক্ত চিত্তে ক্ষমতালোভের কলুষ নেই, বিলাস বসনে আগ্রহ নেই, নেই ক্ষুদ্র স্বার্থবুদ্ধি। একটা মহৎ আদর্শ-সাধারণ মানুষের শোষণের অবসান-তাদের অন্তরকেও মহৎ করেছে। তাদের শৌর্যের মূলে আছে অগ্নিশুদ্ধ, স্বার্থলেশহীন স্বাধীনতা, শোষণমুক্তির যজ্ঞে নিবেদিত নিষ্কলুষ মন।
এ যদি না হতো, তবে সমগ্র দেশে এত শীঘ্র মুক্তিযুদ্ধ এত তীব্ররুপ ধারণ করত না। জনসাধারনের স্বচ্ছ দৃষ্টিতে স্বাধীনতা যুদ্ধের ত্রুটি, তার অন্ধকার রুপ অনাবৃত হয়ে পড়ত। এ যুদ্ধ হয়ে পড়ত শীর্ণ, সংকীর্ণ হত শুধুই অস্ত্র ঝঞ্জনা।
জনসাধারণের শোষণমুক্তি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের হৃৎপিন্ডস্বরুপ। স্বাধীনতার সংকল্পের প্রথম মুহূর্তেই শুধু বাঙ্গালী নয়, দুনিয়ার লোক শুনেছে সেই বজ্রকন্ঠঃ আমাদের সংগ্রাম, শোষিতজনের সংগ্রাম, দুনিয়ার শোষিতজনের মুক্তির সংগ্রাম। শোষণের স্পর্শমাত্র ও যদি এই সংগ্রামে থাকত তবে সারা দুনিয়ার লোক বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে তাদের একান্ত আন্তরিক সহায়তা জ্ঞাপন করত না। তারা ভাবত, এ লড়াই বুঝি ক্ষমতার লড়াই, পশ্চিম পাকিস্তানী ধনিক-ভূস্বামীর সঙ্গে বাঙ্গালী ধনিক-ভূস্বামীর লড়াই।
কিন্তু মুক্তি সংগ্রামের এ কয়েকমাসের সংগ্রামে যুদ্ধক্ষেত্রে কোথাও স্বার্থবৃদ্ধির, লোভের, ক্ষমতার আকাংখার প্রকাশ ঘটেনি। তাই দেশে বাঙ্গালী এবং বিদেশে জনসাধারণ এবং শ্রেষ্ঠ বুদ্ধিজীবীরা বাংলার স্বাদীনতা সংগ্রামকে প্রকৃতই শোষণমুক্তির সংগ্রাম বলে গ্রহণ করেছে এবং অকুন্ঠ সমর্থন করেছে।
আজ সারাদেশে জোড় এই সংগ্রাম দৃঢ় পদক্ষেপে অগ্রসর হচ্ছে। এই পদক্ষেপ আরও বলিষ্ঠ, আরও দ্রুত হবে- কিন্তু পদে পদেই আমাদের সাধারণ সৈনিক যারা তাঁদেরও, নেতৃস্থানীয় যারা তাঁদেরও প্রমাণ দিতে হবে বাংলাদেশের ও দুনিয়ার জনসাধারণের কাছে যে এ যুদ্ধ শোষণ শেষের, এ যুদ্ধের তরবার শোষণমুক্তির পবিত্র আদর্শ শাণিত এবং তাই দুর্বার। এ সংগ্রাম ক্ষমতার লড়াই নয়, নতুন আরেক শোষণের প্রতিষ্ঠার প্রয়াস নয়। সহস্রের আত্মদানের আহুতি উজ্জ্বল এই আগুনে স্বার্থবুদ্ধি বিসর্জন দিয়ে বাংলাদেশ হবে মুক্ত। তাই লক্ষ মানুষের এই আমৃত্যু পণ, অপূর্ব আত্মদান।