You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.09.17 | আজকের সংগ্রামী বাংলাদেশ ও বিশ্ব বিবেক | বাংলার মুখ - সংগ্রামের নোটবুক

শিরোনামঃ বাংলাদেশ ও বিশ্ব বিবেক
সংবাদপত্রঃ বাংলার মুখ ( ১ম বর্ষঃ ৬ষ্ঠ সংখ্যা )
তারিখঃ ১৭ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১

আজকের সংগ্রামী বাংলাদেশ ও বিশ্ব বিবেক

দি ইকনমিষ্ট পত্রিকার চলতি সংখ্যায় বলা হয়েছে যে, অবশেষে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া কিছু একটা করলেন। গত সপ্তাহে পূর্ব পাকিস্তানে ফেরত পাঠিয়েছেন এবং তার দায়িত্ব বাঙ্গালী বেসামরিক ব্যক্তি ডাঃ আব্দুল মালিক গভর্নর হিসাবে ও জেনারেল আমীর নিয়াজী সামরিক প্রশাসক হিসাবে ভাগ করে নেবে। একজন সরকারী মুখপাত্র বলেছেন যে, “সেনাবাহিনী এখন বেসামরিক প্রশাসন ব্যবস্থাকে কেবল সাহায্য করেছে।” এবং রোববার ১লা মার্চ হতে ৫ই সেপ্টেম্বরের মধ্যে যারা অপরাধ করেছিল তাদের ব্যাপক ক্ষমা প্রদর্শন করেছেন। অপ্রকাশিত সংখ্যক আটক বাঙ্গালী পুলিশ ও সেনাবাহিনীসহ বহু ব্যক্তিকে মুক্তিও দেওয়া হয়েছে।

পশ্চিম পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা মিঃ ভূট্টো যিনি সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে আপন সজাতিতে আক্রমণ রচনা করেছে, বলেছেন যে, একজন অসামরিক গভর্নর নিয়োগ লোক দেখানো মাত্র। অবশ্য এ মন্তব্য কতখানী সত্য এখন বলা কঠিন। ডাঃ মালিকের মন্ত্রিপরিষদে মুজিবের আওয়ামী লীগের সদস্য গ্রহণ এবং সামরিক কর্তৃপক্ষ তাকে কতখানি ক্ষমতা ব্যবহারের সুযোগ দেবে তার ওপরই নির্ভর করবে অনেকখানি। ডাঃ মালিক মনেপ্রানে বাঙ্গালী নন, ১৯৬৯ সালে ইয়াহিয়ার মন্ত্রিপরিষদে কাজ করার ফলে অধিকাংশ বাঙ্গালী তাকে সন্দেহের চোখে দেখতো।

পত্রিকাটিতে আরও বলা হয় যে, নতুন বেসামরিক শাসনকর্তা যদি সাচ্চা হন তাহলে তার এ ভয় দূর করা উচিত যে সাহায্য সামগ্রী মুক্তিফৌজের প্রতি বাঙ্গালীদের সমর্থন নষ্ট করা জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে। কোন কোন প্রতিষ্ঠান অবশ্য ঝুঁকি নিয়ে কাজ করেছেন। কিন্ত একটা দাতব্য প্রতিষ্ঠান, অপারেশন ওমেগা, সরকারকে তাদের সামগ্রী দিতে সাহস পাচ্ছে না। এবং তাই তারা পূর্ব পাকিস্তান সীমান্তে নিজেরাই গিয়ে কাজ করতে সচেষ্ট হয়েছে। গত মাসে এদের ফেরত পাঠানো হয়েছিল। এবং রোববার চারজন সদস্য প্রোটিনযুক্ত খাদ্যাদি নিয়ে আবার পূর্ব পাকিস্তানে ঢোকার চেষ্টা করতে তাদের গ্রেফতার করা হয়।

পত্রিকাটি মন্তব্য করে যে, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া এই পন্থা গ্রহণ করেছেন বিভিন্ন কারণে। মার্কিন অস্ত্র সরবরাহে দ্বিধা দূর করতে হবে তবে পাশ্চাত্য সাহায্য কোনসর্টিয়ামের সাহায্য পাওয়ার জন্য তাকে তাদের অনুরোধ করতে হবে এবং শেখ মুজিবুর রহমানের বিচারের থেকেও সবার দৃষ্টি অন্যদিকে সরানোর চেষ্টা করছেন। কিন্ত আসল ব্যাপার রয়ে যাবে ভারতে আগত ৮৫ লক্ষ শরণার্থীর প্রত্যাবর্তন ও মুক্তিফৌজের সংগ্রাম থামার পর।

বৃটিশ গিয়ানার বিরোধীদল পিপলস প্রোগ্রেসিভ পার্টির নেতা ডঃ চেণ্ডি জগলের স্ত্রী ও উক্ত দলের আন্তর্জাতিক সংক্রান্ত বিষয়ের সেক্রেটারী মিসেস জালে জগল বলেন যে, ভারত উপমহাদেশে মানবিক দুর্দশার যে কাহিনী প্রকাশিত হচ্ছে তার গুরুত্ব পশ্চিম দেশগুলো উপলব্ধি করতে পারেনি।

তিনি ফোরবেস বানটাহম সরকারকে এ ব্যাপারে ব্যর্থতার জন্য তীব্র সমালোচনা করেন।

এক সাংবাদিক সাক্ষাতকারে তিনি বলেন যে, এ মুহূর্তে গিয়ানার উচিত ভারতে আগত ৮০ লক্ষ শরণার্থী প্রত্যাবর্তনের জন্য পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থা স্বাভাবিক করার নিমিত্তে পাকিস্তান সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করা ও বিশ্বজনমত সৃষ্টিতে সাহায্য করা।

মিসেস জগল বলেন যে অনুষ্ঠিতব্য জতিসংঘের সাধারণ অধিবেশন গিয়ানার উচিত শান্তিকামী দেশগুলোর সাথে এক হয়ে রাজনৈতিক সমাধান ও গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত পাকিস্তানী নেতাদের হাতে শাসনক্ষমতা ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য চাপ সৃষ্টি করা।

বিশ্ব শান্তি পরিষদ রাষ্ট্রসংঘের সাধারণ সম্পাদক উ থানটের কাছে এক স্মারকলিপিতে এই অভিমত প্রকাশ করেছেন যে, বাংলাদেশ সমস্যার একটা রাজনৈতিক সমাধান সম্ভব, যদি তা নিয়ে জনগণের সত্তিকারের প্রতিনিধিদের সঙ্গে এবং বাংলাদেশের জনগণের ভাগ্য নির্ধারণে তাদের অবিচ্ছেদ্য অধিকারের ভিত্তিতে আলোচনা করা হয়।

৯ই সেপ্টেম্বর নিউয়র্ক পরিষদের মহাসচিব শ্রী রমেশচন্দ্রের নেতৃত্বাধীন পরিষদের এক প্রতিনিধি দল এবং সমস্ত মহাদেশের অন্যান্য প্রতিনিধিরা উ থানটের হাতে স্মারকলিপিটি অর্পণ করেন।

স্মারকলিপিতে বাংলাদেশের নিরস্ত্র অসামরিক নাগরিকদের ব্যাপক হারে হত্যা করার তীব্র নিন্দা করা হয়েছে। স্মারকলিপিতে বাংলাদেশের জনগণের ক্রমবর্ধমান প্রতিরোধ এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রতি পরিষদের সমর্থন জ্ঞাপন করা হয়েছে।

নেপালস্থ পূর্ববঙ্গ শরণার্থী সহায়ক কমিটি এক প্রস্তাবে অবিলম্বে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের মুক্তি এবং নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে বাংলাদেশের শাসনভার তুলে দেবার দাবী জানিয়েছে। কারণ এই ব্যবস্থার দ্বারাই শরণার্থীদের আবার স্বদেশে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে।

আর এক প্রস্তাবে বাংলাদেশে পাকিস্তানের জঙ্গীশাহীর বর্বরতা তীব্র নিন্দা করা হয়েছে। নেপালের খ্যাতনামা নেতারা এই সভায় যোগ দেন এবং বাংলাদেশের জনগণের প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন জানান।

প্রাত্তন পররাষ্ট্রমন্ত্রী শ্রী ঋষিকেশ সাহা এই সভায় সভাপতিত্ব করেন। বাংলাদেশ সহায়ক তহবিলে ডাঃ কামার্জি একশত টাকা দিয়ে অর্থ সংগ্রহ শুরু করান।

যে ঘটনায় কোন দেশের ৮০ লক্ষ মানুষকে পররাষ্ট্রে আশ্রয়ের জন্য চলে যেতে হয় আর সে দেশের আভ্যন্তরীণ সমস্যা বলা যায় না। ভারতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রাত্তন রাষ্ট্রদূত অধ্যাপক জন কেনেথ গলব্রেথ এক সংবাদিক বৈঠকে বলেন, পূর্ববঙ্গের বর্তমান পরিস্তিতি আর ভারতে শরণার্থী আসার ঘটনাকে ভিন্ন করে দেখা যায় না।

অধ্যাপক গলব্রেথ বলেন, তাঁর ভারত সফর পুরোপুরি বেসরকারী। এর সঙ্গে কূটনৈতিক গুরুত্ব আরোপ করা ঠিক নয়। নিজের সফর সম্পর্কে তিনি বলেছেন, একজন প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত এসেছেন ভালোভাবে শরণার্থী সমস্যা অনুধাবন করতে। বাংলাদেশে পাকিস্তানের ভূমিকা সম্পর্কে পর পর কয়েকটি প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেছেন, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে নতুন কোন ‘ফ্রন্ট’ খোলার উদ্দেশ্যে তিনি ভারতে আসেন নি তবে তিনি বলেছেন, জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে পূর্ববঙ্গে শাসন চালাবার চেষ্টা করলে পাকিস্তানের অর্থনীতির শোচনীয় পরিস্তিতি হবে। শেখ মুজিব সম্পর্কে এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, শেখ মুজিব গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত হয়েছেন তাঁর বিচারকে গণতান্ত্রিক বলে চালানো হলে গণতন্ত্রের ওপর মানুষের আস্থা হারিয়ে যাবে।

অধ্যাপক গলব্রেথ বলেন, তাঁর ধারণা, নিরাপত্তা বোধ করলে শরণার্থীরা দেশে ফিরে যাবেন। তাঁর মতে নিরাপত্তার ভাব তখনই ফিরে আসবে যখন তাঁরা নিজেদের শাসনের অধিকার হাতে পাবে এবং নিজেদের ভাগ্য নিজেরাই নিয়ন্ত্রন করতে পারবে। তিনি জানান, তিনি এ ব্যাপারে বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী, হাইকমিশনার ও সরকারের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা করে এ সিদ্ধান্তে এসেছেন।