You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.08.05 | ‘পূর্ব পাকিস্তানে’ সামরিক হস্তক্ষেপের পটভূমিকার ওপর পাকিস্তান সরকারের শ্বেতপত্র | পাকিস্তান সরকারের প্রচার পুস্তিকা - সংগ্রামের নোটবুক

শিরোনামঃ ১৩৯। ‘পূর্ব পাকিস্তানে’ সামরিক হস্তক্ষেপের পটভূমিকার ওপর পাকিস্তান সরকারের শ্বেতপত্র
সূত্রঃ পাকিস্তান সরকারের প্রচার পুস্তিকা
তারিখ ৫ আগষ্ট ১৯৭১

পাকিস্তান সরকার
পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্কট সম্পর্কে
শ্বেতপত্র
৫ আগষ্ট, ১৯৭১
ভূমিকা
.
এই শ্বেতপত্র পূর্ব পাকিস্তানের বর্তমান সঙ্কটের ঘটনাবলীর সর্বপ্রথম পূর্ণ বিবরণ। আওয়ামী লীগ নেতাদের মনোভাবের দরুন নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিরা একটি ফেডারেল শাসনতন্ত্রের মূল বিষয়সমূহের ব্যাপারে একটা মতৈক্যে পৌঁছুতে ব্যর্থ হলে এই সঙ্কটের উদ্ভব হয়। আওয়ামী লীগ নেতারা স্বায়ত্তশাসনের পক্ষে জনগণের রায়কে একটা বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনে পরিবর্তিত করার প্রয়াস পান।
এ-সব ঘটনার প্রতি বহির্বিশ্বের দৃষ্টি আকৃষ্ট হছে। অবশ্য, এ পর্যন্ত বিশ্বকে অসম্পূর্ণ এবং পক্ষপাতদুষ্ট তথ্যই সরবরাহ করা হয়েছে। এই শ্বেতপত্রে সেইসব ঘটনাবলীর বিস্তারিত পটভূমিকা দেওয়া হয়েছে বা শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানকে খন্ড-বিখন্ড করার উদ্দেশ্যে একটি সশস্ত্র বিদ্রোহের রূপ নেয়।
পূর্ব পাকিস্তান সঙ্কট হৃদয়ঙ্গম করার জন্য অপরিহার্য মূল বিষয়গুলো হচ্ছে:
(১) ১৯৭০ সালের আইনকাঠামো আদেশের ভিত্তিতেই পাকিস্তানের সাম্প্রতিক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। আওয়ামী লীগসহ সব রাজনৈতিক দলই এই আইন-কাঠামো গ্রহণ করেছিলেন। এই আদেশ থেকে সন্দেহাতীতভাবে বোঝা যায় যে, পাকিস্তানের সংহতি ও অখন্ডতা হচ্ছে যে কোন ভবিষ্যত শাসনতান্ত্রিক ব্যবস্থার মৌলিক পূর্ব-শর্ত।
(২) ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ ফেডারেল সরকার যে ব্যবস্থা শুরু করেন তার লক্ষ্য ছিলো আইন-শৃঙ্খলা পুন:প্রতিষ্ঠা, কারণ আওয়ামী লীগের ‘অহিংস-অসহযোগ’ আন্দোলনের সময় আইন-শৃঙ্খলার কাঠামো সম্পূর্ণরূপে ভেঙ্গে পড়েছিলো। এই সময়ে যে গোলযোগ এবং নৃশংস কার্যকলাপ চালানো হয় এই শ্বেতপত্রে তা বিবৃত করা হয়েছে।
(৩) হিন্দুস্তান হস্তক্ষেপ না করলে এবং প্ররোচনা না যোগালে পরিস্থিতি বেশ শিগগিরই স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে যেতো।

প্রথম অধ্যায়
সংঘর্ষ অভিমুখে
১৯৬২ সালের শাসনতন্ত্রের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক আন্দোলনের পরিণতিতে জাতি এক মারাত্মক সঙ্কটের সম্মুখীন হয় যার ফলে ১৯৬৯ সালের ২৬শে মার্চ সামরিক আইন জারী করা প্রয়োজন হয়ে পড়ে। জাতির উদ্দেশ্যে তাঁর সর্বপ্রথম ভাষণে, প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক জেনারেল এ. এম. ইয়াহিয়া খান বলেন, “আমি আপনাদের কাছে সম্পূর্ণ পরিষ্কার করে দিতে চাই যে, একটি শাসনতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার অনুকূল পরিবেশ গড়ে তোলা ছাড়া আমার অন্য কোন উচ্চাকাঙ্খা নেই। আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে, সুস্থ ও গঠনমূলক রাজনৈতিক জীবন এবং প্রাপ্ত বয়স্ক ভোটাধিকারের ভিত্তিতে অবাধে ও নিরপেক্ষভাবে নির্বাচিত গণ প্রতনিধিদের কাছে নির্বিঘ্নে ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য অপরিহার্য পূর্ব শর্ত হচ্ছে একটি সুষ্ঠু, নিষ্কলঙ্ক এবং সৎ সরকার। এই নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাজ হবে দেশকে একটি ব্যবহারযোগ্য শাসনতন্ত্র দেয়া এবং যে-সব রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সমস্যা গণমনকে আলোড়িত করছে তার একটা সমাধান বের করা”।
এই লক্ষ্য অর্জনের উদ্দেশ্যে রাজনৈতিক তৎপরতা চালানোর অনুমতি দেয়া হয় এবং প্রেসিডেন্ট সব রাজনৈতিক দল ও ব্যক্তিকে আশ্বাস দিয়ে বলেন, “আমার সরকার আপনাদের ব্যাপারে সম্পূর্ণ নিরপেক্ষতার নীতি অনুসরণ অব্যাহত রাখবেন”। তিনি অবশ্য জোর দিয়ে বলেন, “কোন ব্যক্তি, দল কিংবা গোষ্ঠী যারাই ইসলামের মূলনীতিসমূহ এবং পাকিস্তানের আদর্শ ও সংহতি বিরোধী প্রচারণা চালাবে কিংবা আমাদের জনগণের ঐক্যে ফাটল ধরানোর চেষ্টা করবে, তারাই জনগণ ও তাদের সশস্ত্র বাহিনীর ক্রোধভাজন হবে”।
এরপর কয়েকমাস ধরে প্রেসিডেন্ট সারাদেশে রাজনীতিবিদ এবং জনমতের প্রতিনিধিত্বকারী নেতাদের সঙ্গে ব্যাপক আলোচনা-পরামর্শ চালান। কিন্তু ১৯৬৯ সালের ২৮শে নভেম্বর তিনি দু:খ প্রকাশ করেন যে, রাজনৈতিক নেতাদের প্রতি পরিস্থিতির গুরুত্ব উপলদ্ধি করে জাতীয় রাষ্ট্রনেতার মতো শাসনতান্ত্রিক প্রশ্নটির সমাধানের জন্য তাঁর জরুরী আবেদন সত্ত্বেও এ ব্যাপারে কোনরকম মতৈক্য দেখা যাচ্ছে না।
তিনি দুটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্তও ঘোষণা করেন। প্রথমটি হচ্ছে পশ্চিম পাকিস্তানে এক ইউনিট বাতিল করে দেয়া এবং দ্বিতীয়টি হচ্ছে ভবিষ্যত জাতীয পরিষদের নির্বাচনের জন্য “একজন লোক – একটি ভোট” এই নীতি গ্রহণ। এর ফলে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে Parity বা সমতার যে নীতি আওয়ামী লীগসহ সব রাজনৈতিক দলই মেনে নিয়েছিলেন এবং যা ১৯৫৬ এবং ১৯৬২ সালের শাসনতন্ত্রেও গৃহীত হয়েছিল তা পরিত্যক্ত হলো। প্রেসিডেন্টের সিদ্ধান্তের ফলে এই প্রথমবারের মত জাতীয় পরিষদের পূর্ব পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠতা স্থায়ীভাবে কায়েম হলো। রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে এবং জনগণের সুস্পষ্ট ইচ্ছে অনুসারে প্রেসিডেন্ট কতকগুলো বিষয়কে স্থিরীকৃত বলে ঘোষণা করেন। এসব বিষয় হচ্ছে:
(১) ফেডারেল পার্লামেন্টারী ধরণের সরকার।
(২) প্রাপ্তবয়স্ক ভোটাধিকারভিত্তিক প্রত্যক্ষ নির্বাচন।
(৩) নাগরিকদের মৌলিক অধিকার দান এবং আইন-আদালতের মাধ্যমে এই অধিকার-রক্ষার নিশ্চয়তাবিধানের ব্যবস্থা।
(৪) বিচার বিভাগের স্বাধীনতা এবং তাকে শাসনতন্ত্র-রক্ষকের ভূমিকা নেয়া।
(৫) যে আদর্শের ভিত্তিতে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তা অক্ষুন্ন রাখার জন্য একটি ইসলামী ভাবাদর্শভিত্তিক শাসনতন্ত্র প্রণয়ন।
প্রেসিডেন্ট আরো প্রকাশ করেন যে, ১৯৭০ সালের ৩১শে মার্চ নাগাদ একটি আইন কাঠামো এবং জুন মাস নাগাদ ভোটার তালিকা তৈরী করে ১৯৭৩ সালের ৫ই অক্টোবর সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করা হবে। জাতীয় পরিষদকে তার প্রথম অধিবেশন থেকে শুরু করে ১২০ দিনের মধ্যে একটি শাসনতন্ত্র তৈরী করতে হবে।
প্রেসিডেন্ট বলেন, তাঁরা যদি এই কাজ সম্পন্ন করেন তাহলেও আমি সুখী হবো। কিন্তু তাঁরা যদি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে এই কাজ সম্পন্ন করতে ব্যর্থ হন, তাহলে পরিষদ ভেঙ্গে দেয়া হবে এবং আবার নতুন করে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। আমি আশা করি এবং কামনা করি যেনো তা না ঘটে এবং এই জন্যই আমি ভবিষ্যত গণপ্রতিনিধিদের পূর্ণ দায়িত্ববোধ এবং দেশপ্রেমের সঙ্গে এই কাজ হাতে নেয়ার অনুরোধ জানাচ্ছি।
১৯৭০ সালের পয়লা জুন সারাদেশে সাধারণ নির্বাচনের জন্য নির্বাচনী অভিযান শুরু হয়। এই সময় প্রেসিডেন্ট সংকীর্ণ দলীয় স্বার্থ এবং ব্যক্তিগত ও স্থানীয় বিবেচনার উর্ধ্বে ওঠার জন্য সব দলের প্রতি আবেদন জানান। সংবাদপত্র, রেডিও টেলিভিশনকে প্রতিদ্বন্ধিতায় অবতীর্ণ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মতামত প্রকাশের পূর্ণ স্বাধীনতা দেয়া হয়। সব সরকারী কর্মচারীকেই পূর্ণ নিরপেক্ষতা বজায় রাখার কড়া নির্দেশ দেয়া হয়। ১৯৭০ সালের ২৮শে মার্চ জাতির উদ্দেশ্যে এক ভাষণে প্রেসিডেন্ট বলেন, “আমি আরেকবার আপনাদের আশ্বাস দিতে চাই যে, যতদুর পর্যন্ত নির্বাচনী অভিযানের সম্পর্ক রয়েছে, বর্তমান সরকার আগেও সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ ছিলেন এবং ভবিষ্যতেও থাকবেন। সরকার অবশ্য আশা করেন যে, কোন রাজনৈতিক দল কিংবা ব্যক্তি পাকিস্তানের আদর্শ ও সংহতি বিরোধী প্রচারণা কিংবা কার্যকলাপ চালাবেন না”।
একই ভাষণে প্রেসিডেন্ট আইনকাঠামো আদেশ (১৯৭০)-এর মুল ধারাগুলো ঘোষণা করেন। এই আদেশের ভিত্তিতেই সব রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশ নেন। এই “আইনকাঠামো আদেশ”-এর উপক্রমণিকায় বলা হয় যে, জাতীয় পরিষদের প্রথম কর্তব্য হচ্ছে “এই আদেশের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র তৈরী করা”। আদেশের ১৪(১) অনুচ্ছেদে বলা হয়, “জাতীয় পরিষদ-সদস্যদের সাধারণ নির্বাচন শেষ হওয়ার পর পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র তৈরীর কাজ সম্পাদনের উদ্দেশ্যে প্রেসিডেন্ট তাঁর বিবেচনা মতো উপযুক্ত তারিখ, সময় ও স্থানে পরিষদের অধিবেশন ডাকবেন”। আরো ঠিক করা হয় যে, জাতীয় পরিষদ তার প্রথম অধিবেশনের ১২০ দিনের মধ্যে “শাসনতন্ত্র বিল” নামে একটি বিলের আকারে শাসনতন্ত্র তৈরী করবেন এবং তা করতে ব্যার্থ হলে পরিষদ ভেঙ্গে যাবে। জাতীয় পরিষদের পাশ করা শাসনতন্ত্র-বিল প্রেসিডেন্টের অনুমোদন লাভ না করা পর্যন্ত জাতীয় পরিষদ ফেডারেশনের প্রথম আইন পরিষদ হিসেবে তার কাজ শুরু করতে পারবেন না এবং প্রাদেশিক পরিষদগুলোর অধিবেশনও ডাকা হবে না।
ফেডারেল শাসনতন্ত্র তৈরীর একটা ঐতিহাসিক রীতি এই যে, শাসনতন্ত্রের পেছনে হয় ফেডারেটিং ইউনিটগুলোর সর্বসম্মত সমর্থন কিংবা ফেডারেটিং ইউনিটগুলোর বেশীরভাগের সম্মতি থাকতে হবে। এটাই বোঝাতে চাওয়া হয়েছিলো প্রেসিডেন্টের নিম্নোক্ত মন্তব্যে- “শাসনতন্ত্র হচ্ছে একটা পবিত্র দলিল এবং একত্রে বসবাসের মৌলিক চুক্তি। কোন সাধারণ আইনের সঙ্গে তার তুলনা করা চলেনা”।
আইন-কাঠামো আদেশ শাসনতন্ত্রে অন্তর্ভুক্ত করার কতকগুলো মূলনীতি দেয়া হয়। এসব মূলনীতির মধ্যে ছিলো:
(১) “জনসংখ্যা এবং প্রাপ্তবয়স্ক ভোটাধিকারের ভিত্তিতে নির্দিষ্ট মেয়াদ পর পর ফেডারেল ও প্রাদেশিক পরিষদসমূহের অবাদ প্রত্যক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে গণতন্ত্রের মূলনীতিসমূহ অনুসরণের নিশ্চয়তা বিধান করা হবে।”
(২) “নাগরিকদের অধিকার বিধিবদ্ধ করা হবে এবং এই অধিকার ভোগের নিশ্চয়তা বিধান করা হবে।”
(৩) “মামলা-মকদ্দমার বিচার এবং মৌলিক অধিকার রক্ষার ব্যাপারে বিচার-বিভাগকে স্বাধীনতা দেয়া হবে।”
(৪) “আইন-তৈরী সংক্রান্ত, প্রশাসনিক এবং আর্থিক ক্ষমতাসহ সব রকম ক্ষমতাই ফেডারেল সরকার এবং প্রদেশগুলোর মধ্যে এমনভাবে ভাগ করা হবে যে, প্রদেশগুলো সর্বাধিক স্বায়ত্তশাসন অর্থাৎ সর্বাধিক পরিমাণ আইন-প্রণয়ন সংক্রান্ত, প্রশাসনিক এবং আর্থিক ক্ষমতা ভোগ করবেন কিন্তু একইসঙ্গে ফেডারেল সরকারও বাইরের ও অভ্যন্তরীণ বিষয়াদিতে তার দায়িত্ব পালন এবং দেশের স্বাধীনতা ও আঞ্চলিক অখন্ডতা অক্ষুণ্ন রাখার জন্য পর্যাপ্ত আইন-প্রণয়ন ক্ষমতা, প্রশাসনিক ক্ষমতা ও আর্থিক ক্ষমতা পাবেন।”
(৫) “নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে যেনো-
ক) পাকিস্তানের সব এলাকার জনগণ সব রকম জাতীয় প্রচেষ্টায় পুরোপুরি অংশগ্রহণ করতে সক্ষম হয়।
এবং
খ ) একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে আইন করে এবং অন্যান্য ব্যবস্থার মাধ্যমে বিভিন্ন প্রদেশের মধ্যে এবং প্রদেশের অন্তর্ভুক্ত বিভিন্ন এলাকার মধ্যে অর্থনৈতিক এবং অন্য সবরকম বৈষম্য দুর করা হয়।”
(৬) “শাসনতন্ত্রের উপক্রমণিকায় এই মর্মে ঘোষণা থাকতে হবে যে-
ক)পাকিস্তানের মুসলমানরা ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত পর্যায়ে, পবিত্র কোরান ও সুন্না মোতাবেক ইসলামের শিক্ষা অনুসারে তাদের জীবন গড়ে তুলতে পারবেন।
এবং
খ)সংখ্যালঘুরা অবাধে তাদের ধর্ম-পালন এবং পাকিস্তানের নাগরিক হিসেবে সব রকম অধিকার, সুযোগ-সুবিধা এবং নিরাপত্তা ভোগ করতে পারবেন।”
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এই যে, এই আদেশে বলে দেয়া হয়, “পাকিস্তানে বর্তমানে যে সব প্রদেশ ও এলাকা রয়েছে কিংবা পরে যে সব প্রদেশ ও এলাকা অন্তর্ভুক্ত হতে পারে তারা সবাই একটি ফেডারেশনের অধীনে এমনভাবে ঐক্যবদ্ধ হবে যেনো পাকিস্তানের স্বাধীনতা, আঞ্চলিক অখন্ডতা এবং জাতীয় সংহতি নিশ্চিত হয় এবং ফেডারেশনের সংহতি কোন রকমেই ব্যাহত না হয়।”
প্রেসিডেন্ট তাঁর ২৮শে মার্চের ভাষণে বলেন, আমাদের জনগণ গভীর দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ। সুতরাং তারা পাকিস্তানের অখন্ডতার বিরুদ্ধে কোন কাজ ছাড়া প্রায় সব জিনিষই বরদাশত করবে। যদি কেউ মনে করে যে, সে দেশ কিংবা জনগণের স্বার্থবিরোধী কাজ করতে পারবে কিংবা কেউ যদি আমাদের জনগণের মৌলিক ঐক্য নষ্ট করতে পারবে মনে করে, তবে সে বড় ভুল করবে। জনগণ এটা কোন প্রকারেই বরাদশত করবে না। … দেশের শাসনতান্ত্রিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক সমস্যার সমাধান দেয়ার অধিকার প্রত্যেকেরই রয়েছে। কিন্তু পাকিস্তানের জনগণের সংহতির উপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে এমন কোন সমাধান দেয়ার অধিকার কারুরই নেই। কেউই তা বরদাশত করবে না।”
আওয়ামী লীগ তাদের ৬ দফা যেভাবে জনগণের কাছে পেশ করেন তাতে পাকিস্তানের সার্বভৌম মর্যাদায় কোনরকম পরিবর্তন সাধনের দাবী ছিলনা। প্রথম দফায় বলা হয়, “সরকারের ধরণ হবে ফেডারেল ও পার্লামেন্টারী পদ্ধতির”। শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর নির্বাচনী বক্তৃতাসমূহে বারবার জোর দিয়ে বলেন যে, তিনি কেবল প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন চাচ্ছেন, দেশকে ভাগ করা কিংবা তার ইসলামী আদর্শকে দুর্বল করা তাঁর লক্ষ্য নয়। ১৯৭০ সালের ২১শে সেপ্টেম্বর নারায়ণগঞ্জে এক বক্তৃতায় তিনি বলেন, “৬ দফা কার্যক্রম বাস্তবায়িত করা হবে এবং তাতে পাকিস্তানের সংহতি কিংবা ইসলাম বিপন্ন হবেনা”। ১৯৭০ সালের ২৪শে সেপ্টেম্বর তিনি নির্বাচনকে “প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নে একটি গণভোট” বলে অভিহিত করেন। ৬ই নভেম্বর ১৯৭০ সিলেটে আরেক ভাষণে তিনি বলেন, “আওয়ামী লীগের ৬ দফা কার্যক্রমের উদ্দেশ্য হচ্ছে কেবল আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের মাধ্যমে শাসনতন্ত্রে পূর্ববঙ্গের স্বার্থরক্ষার নিশ্চয়তাবিধান করা”। আওয়ামী লীগের অন্যান্য নেতারাও একই ধরণের কথা বলেন। পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগের সেক্রেটারী জনাব তাজউদ্দিন আহমদ ১৯৭০ সালের ২১শে সেপ্টেম্বর নারায়ণগঞ্জে বলেন যে, “৬ দফা আদায়ের প্রশ্নটি অখন্ডতা ও সংহতির সঙ্গে বিশেষভাবে জড়িত”।
নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জনাব এ. এইচ. এম. কামরুজ্জামান ১৯৭০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে লাহোরে এক জনসভায় স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেন যে, পাকিস্তানকে খন্ড-বিখন্ড করা তাঁর দলের উদ্দেশ্য নয়। এর আগে ১৯৭০ সালের ২১শে জুন রাজশাহীতে এক জনসভায় বক্তৃতাদানকালে তিনি বলেন, পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান অচ্ছেদ্য বন্ধনে আবদ্ধ। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি খন্দকার মুশতাক আহমদ ১৯৭০ সালের ২০শে মার্চ ফেনীতে এক জনসভায় বলেন, আওয়ামী লীগের লক্ষ্য হচ্ছে একটি শক্তিশালী পাকিস্তান গঠন করা। তিনি বলেন, পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন একটি শক্তিশালী জাতি গঠন সহায়ক হবে।
যাহোক, শেখ মুজিবুর রহমান এবং তাঁর সহযোগীদের এসব বক্তৃতার মধ্যে এমন সব কথা ছিল বা অত্যন্ত আবেগপ্রসূত এবং তথ্যের দিক দিয়ে ত্রুটিপূর্ণ যার উদ্দেশ্যে ছিল পূর্ব পাকিস্তানীদেরকে তাদের পশ্চিম পাকিস্তান ভাইদের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করে তোলা। ১৯৭০ সালের ১১ই মার্চ পূর্ব পাকিস্তানের হাজারিবাগ পার্কে এক জনসভায় শেখ মুজিবুর রহমান নওয়াবজাদা নসরুল্লাহ খান, মওলানা মওদুদী, খান আবদুল কাইয়ুম খান প্রমুখের কাছে জানতে চান যে তাঁরা তাঁদের প্রভুদের মাধ্যমে বাংলার যে সম্পদ লুন্ঠন করেছেন তা ফিরিয়ে দিতে আর কত সময় নিবেন।
তিনি বাঙালীদেরকে এই মাহেন্দ্রক্ষণে তার এবং বাংলার পবিত্র মাটি থেকে রাজনৈতিক মীরজাফর এবং পরগাছাদের নির্মুল করার আহ্বান জানান। ১৯৭০ সালের ১০ই মার্চ পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জনাব তাজউদ্দীন আহমদ ঢাকায় এক জনসভায বলেন, “বিগত বৎসরগুলোতে শোষক এবং ডাকাতরা বাঙালীদের রক্ত মাংস চিবিয়ে খেয়েছে। আসন্ন নির্বাচনের মাধ্যমে দেশের রাজনৈতিক গগন থেকে তাদেরকে বিদায় করতে হবে”।
পরদিন ঢাকা জেলার কাপাসিয়ায় কালালেশ্বর হাই স্কুলে আরেক জনসভায় তিনি বলেন “পশ্চিম পাকিস্তানের এক শ্রেণীর শোষণকারী পূর্ব বাংলাকে গত ২৩ বছর ধরে শোষণ করেছে। পাকিস্তানের ইতিহাস একটি ষড়যন্ত্রের ইতিহাস, অব্যাহত নির্যাতন ও শোষণের ইতিহাস”।
এরপর পূর্ব পাকিস্তানে যে নির্বাচনী অভিযান শুরু হয় তাতে আওয়ামী লীগ এমন অসংযমের পরিচয় দেয় যে তার বিরুদ্ধে অন্য সব দল অভিযোগমুখর হয়ে ওঠে।
আওয়ামী লীগের নির্বাচনী অভিযানের বিরুদ্ধে যারা প্রকাশ্যে প্রতিবাদ জানান তাদের মধ্যে রয়েছেন:
(১)জনাব নুরুল আমীন, পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টির সভাপতি এবং পূর্ব পাকিস্তানের সাবেক মূখ্য উজীর।
(২)জনাব আবদুস সালাম, পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টির পূর্ব পাকিস্তান শাখার সভাপতি।
(৩)জনাব মাহমুদ আলী, পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টির পূর্ব পাকিস্তান শাখার সহ-সভাপতি।
(৪)প্রফেসর গোলাম আযম, পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর আমীর।
(৫)সৈয়দ আলতাফ হোসেন, পূর্ব পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি ওয়ালী গ্রুপের সাধারণ সম্পাদক।
(৬)পীর মহসিন উদ্দিন, পূর্ব পাকিস্তান জমিয়তে উলেমায়ে ইসলামের সভাপতি। এবং
(৭)মিসেস আমেনা বেগম, পাকিস্তান ন্যাশনাল লীগের উর্ধ্বতন সহ-সভানেত্রী এবং আওয়ামী লীগের সাবেক ভারপ্রাপ্ত সভানেত্রী।
১৯৭০ সালে এঁরা এবং অন্যান্য নেতারা জনগণের উদ্দেশ্যে তাঁদের বিবৃতিতে আওয়ামী লীগের জবরদস্তিমূলক পদ্ধতি, জনসভা পন্ড করে দেওয়া, রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের উপর দৈহিক আক্রমণ এবং পার্টির দফতর লুট ও বিনষ্ট করার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছেন। এই সমালোচনা দিন দিন বাড়তেই থাকে। কিন্তু পাছে নির্বাচন অভিযানে সরকার হস্তক্ষেপ করেছেন বলে মনে করা হয়, এ জন্য সরকার এ ব্যাপারে কিছু বলেননি।
ঢাকার পুরানা পল্টন ময়দানে ১৯৭০ সালের ১৮ই জানুয়ারী পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্য একটি দলের প্রথম জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। এই জনসভা জনতা কর্তৃক আক্রান্ত হয়। ফলে, একজন লোক নিহত এবং পাঁচ শতাধিক লোক আহত হয়। জামাত-ই-ইসলামী এই সভার আয়োজন করেছিল। জামাত-ই-ইসলামী প্রমাণ করেছিলো যে, “ময়দানে ঢুকে যারা শ্রোতাদের উপর হামলা চালিয়েছিলো, তাদের মধ্যে আওয়ামী লীগ কর্মীরা ছিলো এবং গুন্ডাদের হাতে অস্ত্রশস্ত্র এবং হাতবোমা ছিলো”।
ঢাকা দৈনিক পত্রিকা পাকিস্তান অবজারভার এ ঘটনাকে নিন্দা করে ১৯৭০ সালের ২০শে জানুয়ারী প্রকাশ করে যে, “সন্ধ্যার পর ঘটনাস্থলে দলে দলে লোকের পুনরাগমন, সভা পন্ড করা, মঞ্চ পুড়িয়ে ফেলা এবং কয়েক হাজার শ্রোতাকে তাড়িয়ে দেওয়ার ঘটনাটা প্রমাণ করে যে, এটা একটা সুপরিকল্পিত এবং সংকল্পবদ্ধ প্রচেষ্টা। তা না হলে এতো অল্প সময়ের মধ্যে সবকিছু বিনষ্ট করা সম্ভব হত না”।
যারা হিংসাত্মক কার্যকলাপের আশ্রয় নেয় পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট তাদের নিন্দা করেন এবং সতর্ক করে দিয়ে বলেন:- রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে সাধনের জন্য যদি কেউ হিংসাত্মক কার্যকলাপের সাহায্য নেয়, তাহলে মনে করা হবে যে সে জনসাধারণের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যাপারে বাঁধার সৃষ্টি করছে। সুতরাং তাকে জনমতের সামনে জবাবদিহি করতে হবে। তিনি আরো বলেন:- যারা হিংসাত্মক কার্যকলাপ দিয়ে তর্কের মীমাংসায় পৌঁছুতে চায়, তারা যে শুধু তাদের দাবীর প্রতি বিশ্বাসের অভাব প্রমাণ করে তাই নয়, গণতন্ত্রের প্রতিও তাদের আস্থার অভাব প্রমাণ করে- একথা তারা যতোই অস্বীকার করুক না কেনো।
এই ঘটনার এক সপ্তাহ পর পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টি নামে আর একটি দলের একটা জনসভায় মারপিট হয়। ১৭ জন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ যুক্ত এশতেহারে এর নিন্দা করে বলেন, “কিছু সংখ্যক দুষ্কৃতিকারী এবং গুন্ডারা সুসংবদ্ধভাবে ১৯৭০ সালের ২১শে জানুয়ারী নারায়ণগঞ্জে অনুষ্ঠিত জনসভা পন্ড করে দেবার চেষ্টা করে”। সেই একই দিন (২১শে জানুয়ারি ১৯৭০) পৃথক একটি যুক্ত বিবৃতিতে এই নেতৃবৃন্দ আওয়ামী লীগকে গুন্ডামী এবং সন্ত্রাসনীতি অবলম্বন করার জন্য বিশেষভাবে দোষারোপ করেন।
১৯৭০ সালের ২২শে জানুয়ারী ঢাকায় জামাত-ই-ইসলামীর দফতরে হামলা করা হয়। পার্টির জেনারেল সেক্রেটারী এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলেন, “আমাদের দফতরে হামলা চালানোকালে আওয়ামী লীগ কর্মীদের দ্বারা পরিচালিত গুন্ডারা দরজা ভেঙ্গে ঢুকে আসবাবপত্রাদি ভেঙ্গে তছনছ করেছে, সাইনবোর্ড সরিয়ে ফেলে এবং পার্টির কাগজপত্র, দলিল এবং পতাকায় আগুন ধরিয়ে দেয়”।
১৯৭০ সালের ১লা ফেব্রুয়ারী ঢাকায় পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত পাকিস্তান ডেমোক্র্যাটিক পার্টির এক জনসভায়ও আওয়ামী লীগ কর্মীরা গোলাযোগ সৃষ্টির চেষ্টা করে। তারা ‘জয় বাংলা’ শ্লোগান দেয় গোলযোগের মধ্যে নিজাম-ই-ইসলাম পার্টির নেতা, মৌলবী ফরিদ আহমদ প্রমুখসহ কিছু লোক আহত হন। পিডিপি’র প্রেসিডেন্ট মি: নুরুল আমীন এক বিবৃতিতে বলেন: “আওয়ামী লীগের এসব কার্যকলাপের নিন্দা করার মতো ভাষাও আমার নেই। পরিষ্কার মনে হচ্ছে- আওয়ামী লীগ ফ্যাসিবাদী পদ্ধতি অনুসারে তাদের নিজেদের পরিকল্পনা অন্যের উপর চাপানোর সংকল্প করেছে। আওয়ামী লীগ এই প্রথমবার নীতি অনুসরণ করেনি”।
১৯৭০ সালের ২৮শে ফেব্রুয়ারী চট্টগ্রামে দৈনিক “বুনিয়াদ” এবং দৈনিক “সংগ্রাম” পত্রিকার দফতর দুটির উপর হামলা করা হয়। এই দুটি পত্রিকার আওয়ামী লীগ বিরোধী বলে পরিচিত ছিলো। পাকিস্তান ডেমোক্র্যাটিক পার্টির ভাইস প্রেসিডেন্ট মি: মাহমুদ আলী এই হামলা সম্পর্কে মন্তব্য করে বলেন: “সংবাদপত্রের স্বাধীনতার উপর হীন একটা হামলা”। তিনি আরও বলেন “যদি ‘বুনিয়াদ’ ও ‘সংগ্রামের’ সঙ্গে আওয়ামী লীগের আদর্শের মিল না হয়, তাহলেই কি তাকে ধ্বংস করেতে হবে? এই কি পাকিস্তানের জনগণের কাছে আওয়ামী লীগের প্রদত্ত গণতন্ত্রের নমুনা”।
১৯৭০ সালের ৩১শে জুলাই ঢাকার পাকিস্তান অবজারভারসহ কয়েকটি পত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয় যে, “আওয়ামী লীগের পাঁচ শতাধিক সশস্ত্র কর্মীরা হালি শহর হাউসিং এস্টেটের অধিবাসীদের আক্রমণ করে। এর ফলে ২২ জন আহত হয়। তার মধ্যে ৭ জনের অবস্থা গুরুতর। খবরে জানা যায় যে, আওয়ামী কর্মীরা চেয়েছিলেন যে উল্লেখিত লোকেরা ধর্মঘট পালন করুক। কিন্তু সে এলাকার অধিবাসীরা তা করতে অস্বীকার করে”।
১৯৭০ সালের ৭ই আগষ্ট দৈনিক “পূর্বদেশ” এর খবর প্রকাশ “২রা আগষ্ট ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ টাউন ময়দানে পিডিপি’র এক জনসভা হয়। সে সভায় আওয়ামী লীগের একটি দল এবং ছাত্রলীগ কর্মীরা গোলযোগ বাধাবার চেষ্টা করে। খবরে প্রকাশ সন্নিকটে শেখ মুজিবুর রহমানের গোপালগঞ্জের বাসভবন থেকে, সভায় গোলযোগ সৃষ্টিকারী আওয়ামী লীগ কর্মীদের বের হয়ে আসতে দেখা যায়”।
১৯৭০ সালের ২৩শে আগষ্ট দৈনিক “সংগ্রাম” পত্রিকার খবরে জানা যায় যে “চট্টগ্রামের দৈনিক ‘আজান’ পত্রিকার দফতর এর পূর্বদিন ছাত্র বলে পরিচিত একদল যুবক কর্তৃক আক্রান্ত হয়। দৃষ্কৃতিকারীরা ৬ দফার সমর্থনে এবং “জয় বাংলা’র শ্লোগান দিচ্ছিলো। ‘আজান’ কর্তৃপক্ষকে তারা ৬ দফা সমর্থন করে তাদের পত্রিকায় লেখার হুকুম করে। পত্রিকার একজন কর্মচারী হামলার সময় আহত হন”।
ঈশ্বরদীর ইসলামী ছাত্র সংঘের জেনারেল সেক্রেটারীকে ১৯৭০ সারের ১৯শে সেপ্টেম্বর আওয়ামী লীগ কর্মীরা আক্রমণ করে। চাঁদপুর শহরের কাছে বাহুরীবাজারে ১৯৭০ সালের ২৪শে সেপ্টেম্বর আওয়ামী লীগ কর্মীরা নিজাম-ই-ইসলামের অফিসে হামলা করে এবং অফিসের আসবাবাদি বিনষ্ট করে বলে খবর পাওয়া যায়।
ঢাকার দৈনিক পত্রিকা “সংবাদ” এর ১৯৭০ সালের ২০শে অক্টোবর খবরে প্রকাশ যে, “১৯৭০ সালের ১৮ই অক্টোবর ঢাকার হাজারীবাগ এলাকার ১৩ নং রাস্তার বাচ্চু মিয়ার বাসভবন আওয়ামী লীগের একদল দুষ্কৃতিকারী আক্রমণ করে। দুষ্কৃতিকারীরা বাড়ির উপর পাথর নিক্ষেপ করে, বাড়ীর মেয়েদেরকে গালিগালাজ করে এবং দুটি নাবালক ছেলের উপর দৈহিক নির্যাতন চালায়।
১৯৭০ সালের ৫ই নভেম্বর, পাকিস্তান ন্যাশনাল লীগের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং আওয়ামী লীগের এক প্রাক্তন অ্যাকটিং প্রেসিডেন্ট মিসেস আমেনা বেগম, এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে আওয়ামী লীগ সমর্থকদের দ্বারা তাঁর মাতুয়াইলস্থ নির্বাচন দফতর আক্রমণের নিন্দা করেন। এক সপ্তাহ পরে (১৯৭০ সালের ১০ই নভেম্বর) “পূর্বদেশ”এর এক খবরে প্রকাশ যে, ঢাকার অন্তর্গত জিঞ্জিরার কাউন্সিল মুসলিম লীগ প্রার্থী খাজা খয়েরউদ্দিনের সমর্থকগণ বিরাট এক মিছিল বের করেন। গত রাতে আরামবাগ গ্রামে আওয়ামী লীগ কর্মীরা মিছিলের উপর হামলা চালায়। ফলে ৫ ব্যক্তি আহত হয়”।
জাতীয় পরিষদের নির্বাচন ১৯৭০ সালের ৫ অক্টোবর হওয়ার কথা ছিলো। সেপ্টেম্বর মাসে প্রবল বন্যায় পূর্ব পাকিস্তান ভীষণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। লক্ষ লক্ষ লোক গৃহহীন হয়, যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়। বন্যার জন্য পূর্ব পাকিস্তানের ভোটারদের যাতে ভোটদানে কোন অসুবিধার সৃষ্টি না হয়, সে জন্য জনসাধারণ নির্বাচন পিছিয়ে দেবার দাবী জানায়। সে দাবীর পরিপ্রেক্ষিতে প্রেসিডেন্ট জাতীয় পরিষদের নির্বাচনের তারিখ ঠিক করলেন ১৯৭০ সালের ৭ই ডিসেম্বর। আর প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনের তারিখ নির্দিষ্ট হলো ১৭ই ডিসেম্বর। ১৯৭০ সালের ১২ই নভেম্বর ঘুর্ণিঝড়-দুর্যোগের কবলে পড়ে। বর্তমানে যুগের সর্বাপেক্ষা বৃহৎ প্রাকৃতিক বিপর্যয় বলে অভিহিত এই ঘুর্ণিঝড় পূর্ব পাকিস্তানের উপকূলীয় বাঁধকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। পূর্ব পাকিস্তানের প্রায় সকল নেতাগণ সাহায্য এবং পুনর্বাসনের কাজে মনোযোগ দেয়ার জন্য নির্বাচন আরো পিছিয়ে দেবার জন্য আবেদন জানান। নির্বাচন অভিযান স্থগিত করার নানা অসুবিধা থাকলেও পশ্চিম পাকিস্তানের প্রধান প্রধান নেতৃবৃন্দ নির্বাচন স্থগিত করায় তাদের সম্মতি প্রকাশ্যভাবে ঘোষণা করেন। শেখ মুজিবুর রহমান কিছুকাল একেবারে নীরব থাকার পর, প্রস্তাবিত স্থগিতের বিরুদ্ধে শুধু যে প্রতিবাদ জানালেন তাই নয়, কেন্দ্রীয় সরকারকে তীব্র আক্রমণ করে বললেন – পূর্ব পাকিস্তান জনগণের আশা-আকাঙ্খা বাস্তব রূপায়ণের জন্য আরো লক্ষ লক্ষ জীবন উৎসর্গ করা হবে।
প্রেসিডেন্ট নির্বাচন স্থগিত করলেন না। ১৯৭০ সালের ৩রা ডিসেম্বর এক ভাষণে তিনি বলেন – “এই সরকারের উদ্দেশ্য ও আন্তরিকতা নিয়ে অনেকে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। কিন্তু দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করাই আমাদের লক্ষ্য আর সে লক্ষ্যে আমরা অটল থাকবো”।
সেই একই ভাষণে তিনি জোর দিয়ে বলেন যে তিনি বরাবরই বলে এসেছেন যে শাসনতন্ত্র একটা সাধারণ আইন নয় বরং “একসঙ্গে বসবাস করা একটা চুক্তি”। আর সেইজন্যই শাসনতন্ত্রের প্রশ্নে মতৈক্য বিশেষ প্রয়োজন। তিনি বলেন, নির্বাচিত প্রতিনিধিদের এবং বিশেষ করে রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দকে আমি এ কথাই বলতে চাই যে, তারা তাদের নির্বাচন ও জাতীয় পরিষদের প্রথম অধিবেশনের অন্তবর্তী সময় বেশ কাজে লাগাতে পারেন। তারা সকলে একত্রিত হয়ে আমাদের ভবিষ্যত শাসনতন্ত্রের প্রধান বিধানগুলোর ব্যাপারে একমত হতে পারেন। এজন্য কিছুটা আদান-প্রদান দরকার, দরকার পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস। আমাদের জাতীয় ইতিহাসের এই বিশেষ যুগসন্ধিক্ষণের গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজনীয়তার বিষয় উপলদ্ধি করারও দরকার”।
জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনগুলো অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭০ সালের ডিসেম্বরে* জাতীয় পরিষদের ভোটে দুটি রাজনৈতিক দল প্রধান হয়ে দেখা দেয়। তাদের একটি হচ্ছে আওয়ামী লীগ, যে ১৬৭টি আসন লাভ করে। অন্যটি হচ্ছে পাকিস্তান পিপলস পার্টি, যে ৮৫টি আসন লাভ করে। দুটি দলই
*জাতীয় পরিষদের ৯ টি এবং প্রাদেশিক পরিষদের ২১ টি ঘুর্ণি উপদ্রুত নির্বাচনী এলাকার নির্বাচন এক মাস পর অর্থাৎ ১৯৭১ সালের জানুয়ারী মাসে অনুষ্ঠিত হয়
সংগঠনের দিক থেকে আঞ্চলিক। আওয়ামী লীগের প্রতিনিধিরা সবাই পূর্ব পাকিস্তানী এবং পিপিপি’র সকলেই পশ্চিম পাকিস্তানী।
নির্বাচনের শেষে আশা করা হয়েছিল যে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন শুরু হওয়ার আগেই আইনগত কাঠামো আদেশে একটি শাসনতন্ত্র প্রণয়নের ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলি নিজেদের মধ্যে একটা সমঝোতায় এসে পৌঁছুবেন। আওয়ামী লীগ জোর দিয়ে একথাটাই বোঝাতে চাইছিলো যে এক পাকিস্তান কাঠামোর বাইরে ৬ দফায় কোন কিছুর পরিকল্পনা করা হয়নি। প্রেসিডেন্টকেও তারা এই ধারণা দিয়েছিলো। ১৯৭১ সালে ২৮শে জুনের বেতার ভাষণে প্রেসিডেন্ট বলেন: “আমাদের আলাপ আলোচনা চলাকালে আমি যখন মুজিবুর রহমানকে আওয়ামী লীগের ৬ দফা সম্বন্ধে প্রশ্ন করেছিলাম তিনি আমার কাছে স্বীকার করেছিলেন যে সেগুলোর রদবদল সম্ভব। তিনি পরিষ্কার বলেছিলেন যে, শাসনতন্ত্রের প্রধান প্রধান বিধানগুলো পরিষদের বাইরে ছোট ছোট বৈঠকে দেশের রাজনৈতিক দলগুলো মীমাংসা করবেন”। পশ্চিম পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজনৈতিক দলের নেতা মি: ভুট্টো সমেত, পশ্চিম পাকিস্তানের প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে একটা সমঝোতায় পৌঁছুনোর জন্য ঢাকায় যান। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ফলপ্রসু শাসনতন্ত্র সংক্রান্ত আলাপ-আলোচনার জন্যই পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টও বেশ কয়েকবার পূর্ব পাকিস্তান সফরে যান। তিনি শেখ মুজিবুর রহমানকে পাকিস্তানের ভবিষ্যত প্রধানমন্ত্রী বলে প্রকাশ্যভাবে উল্লেখ করেন। শেখ মুজিবুর রহমানকে পশ্চিম পাকিস্তান সফর করার জন্য কয়েকবার আমন্ত্রণ জানানো হয়। কিন্তু তিনি সে আমন্ত্রণ গ্রহণ করেননি। তিনি ৬ দফা সম্বন্ধেও আলাপ-আলোচনা করতে অস্বীকার করেন। তিনি বলেন যে, ৬ দফা এখন জনসাধারণের সম্পত্তি এবং তার রদবদল করা সম্ভব নয়।
নির্বাচন শেষ হওয়ার পরই আওয়ামী লীগের ভোল সম্পূর্ণরূপে পাল্টে গেলো। ১৯৮১ সালের ৭ই জানুয়ারির প্রকাশিত “অটোয়া, গ্লোব ও মেল” পত্রিকার খবরে প্রকাশ: “মুজিবুর রহমান ঘোষণা করেছেন যে প্রয়োজন হলে আমি বিপ্লবের আহ্বান জানাবো”। ১৯৭১ সালের ২২শে ফেব্রুয়ারি, “ব্যাঙ্কক পোষ্ট”-এর এক খবরে জানা যায় “আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান বলেছেন যে ৩১৩টি আসনবিশিষ্ট জাতীয় পরিষদের মধ্যে তাঁর দলটির স্পষ্ট সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে। যদি পশ্চিম পাকিস্তান তার দলের ৬ দফা কার্যসূচী পুরোপুরি মেনে না নেয়, তাহলে তিনি একাই শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করবেন।
১৯৭১ সালের ১৩ই ফেব্রুয়ারি জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করা হয়। এতে বলা হয় যে আগামী ৩রা মার্চ ঢাকায় অধিবেশন শুরু হবে। ১৯৭১ সালের ১৪ই ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান পিপল্স পার্টির চেয়ারম্যান ঘোষণা করেন যে, “সংখ্যাগরিষ্ট দলের কাছ থেকে কিছুটা পারস্পরিক আদান-প্রদানের” আশ্বাস না পেলে তাঁর দল অধিবেশনে যোগদান করবে না।
তিনি আরো বলেন: “আমার মনে হয় আমরা এমন কিছু করতে পারি যা আমাদের উভয়কেই খুশী করবে। কিন্তু যে শাসনতন্ত্র ইতিমধ্যেই আওয়ামী লীগ প্রণয়ন করে ফেলেছে এবং যে শাসনতন্ত্রের কোথাও এক চুল পরিমাণ কোন অদলবদল করা চলবে না, সেই শাসনতন্ত্রকে শুধু মেনে নেওয়ার জন্যই যদি আমাদের ঢাকায় যেতে বলা হয়, তাহলে আপনারা আমাদের ঢাকায় দেখবেন না”। ১৯৭১ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমান বলেন- “আমাদের ভূমিকা অত্যন্ত পরিষ্কার। ৬ দফা ভিত্তি করেই শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করা হবে”।
পাঁচটি ফেডারেটিং ইউনিট সমন্বিত পাকিস্তান ফেডারেশনের জন্য জাতীয় পরিষদ একটি শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করবে। কোন ইউনিটের পক্ষে শাসনতন্ত্রটি গ্রহণযোগ্য করতে হলে শাসনতন্ত্র প্রণয়নের মূল নীতিগুলোর ব্যাপারে সব ইউনিটের মধ্যে মতৈক্যের একটা ব্যাপক ভিত্তি থাকা দরকার।
পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে শাসনতান্ত্রিক অচলাবস্থা সৃষ্টি হওয়ার ফলে, এমন এক পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে যে, রাজনৈতিক দলগুলো যদি কোন সমঝোতায় না আসেন, তাহলে জাতীয় পরিষদের পক্ষে কোন শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করা সম্ভব হবে না এবং জাতীয় পরিষদ বাতিল হয়ে যাবে। আর তাহলে ভোটদাতাদের আশা-আকাঙ্খা ও ক্ষমতা হস্তান্তরের সুপরিকল্পিত কার্যসূচী উভয়ই নিস্ফল হয়ে যাবে।
১৯৭১ সালের ১লা মার্চ প্রেসিডেন্ট একটি বিবৃতি দেন। সে বিবৃতিতে তিনি বলেন, পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দের রাজনৈতিক মোকাবিলা সারাদেশের উপর একটা বিষাদের ছায়া ফেলেছে। তিনি আরো বলেন যে, “সংক্ষেপে পরিস্থিতিটা এই যে পশ্চিম পাকিস্তানের প্রধান দলটি এবং অন্যান্য কয়েকটি রাজনৈতিক দল ১৯৭১ সালের ৩রা মার্চ ঢাকায় অনুষ্ঠিত জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যোগদান করার ইচ্ছে নেই বলে ঘোষণা করেছেন। এর মধ্যে আবার হিন্দুস্থান যে উত্তেজনাপূর্ব পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে তা গোটা ব্যাপারটাকে আরো জটিল করে তুলেছে। সে জন্য আমি জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বানের তারিখ পিছিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি”।
“আমি বার বার বলেছি যে, শাসনতন্ত্র একটা সাধারণ আইন নয় বরং এক সঙ্গে বসবাস করার একটা চুক্তি। সুতরাং সুষ্ঠু ও প্রয়োগযোগ্য একটি শাসনতন্ত্রের জন্য যা প্রয়োজন তা হচ্ছে- শাসনতন্ত্র প্রণয়নে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের যথাযথ পরিমাণে অংশগ্রহণের উপলদ্ধি”।
জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করার সাথে পরিষ্কারভাবে আশ্বাসও দেওয়া হলো যে, শাসনতন্ত্র প্রণয়নের জন্য পূর্ব উল্লেখিত পরিস্থিতি অনুকূল হলেই জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ডাকা হবে। ক্ষমতা হস্তান্তরই আমাদের চরম লক্ষ্য- আর তা সবকিছুর উর্ধ্বে।
শেখ মুজিবুর রহমান এর জবাব দিলেন সাধারণ ধর্মঘট আহ্বান করে। ১৯৭১ সালের ২রা মার্চের বিবৃতিতে তিনি বলেন- “এই গুরুত্বপূর্ণ সময়ে সরকারী কর্মচারীসহ, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে বাঙালীর পবিত্র কর্তব্য হচ্ছে- গণবিরোধী শক্তির সঙ্গে সহযোগিতা না করা। অধিকন্তু তাদের উচিত সবটুকু শক্তি দিয়ে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে দেওয়া”।
আওয়ামী লীগের ধর্মঘটের আহ্বান ও ভীতি প্রদর্শনের অভিযান সারা পূর্ব পাকিস্তানের স্বাভাবিক জীবনকে পঙ্গু করে দিলো। আইন ও শৃঙ্খলার দ্রুত অবনতি ঘটতে লাগলো। (এসব ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ এই শ্বেতপত্রের তৃতীয় অধ্যায়ে পাওয়া যাবে)
শাসনতান্ত্রিক সঙ্কটের সমাধান করার উদ্দেশ্যে, ১৯৭১ সালের ৩রা মার্চ- প্রেসিডেন্ট জাতীয় পরিষদের পার্লামেন্টারী গ্রুপের ১২ জন নির্বাচিত সদস্যকে ১৯৭১ সালের ১০ই মার্চ ঢাকায় মিলিত হবার আমন্ত্রণ জানালেন। সে সম্মেলনে যেসব নেতৃবৃন্দকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল তাঁরা হচ্ছেনঃ
১. শেখ মুজিবুর রহমান (আওয়ামী লীগ)।
২. জনাব জুলফিকার আলী ভুট্টো (পাকিস্তান পিপলস পার্টি)।
৩. খান আবদুল কাইয়ুম খান (পাকিস্তান মুসলিম লীগ)।
৪. জনাব নুরুল আমীন (পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টি)।
৫. মিয়া মমতাজ দৌলতানা (কাউন্সিল মুসলিম লীগ)।
৬. খান আবদুল ওয়ালী খান (ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি)।
৭. মওলানা মুফতী আহমদ (জমিয়াত-উল-উলামা-ইসলাম)।
৮. মওলানা শাহ আহমদ নূরানী (জামিয়াত-উল-উলামা-ই-পাকিস্তান)।
৯. জনাব আবদুল গফুর আহমদ (জামাত-ই-ইসলামী)।
১০. জনাব মোহাম্মদ জামাল কোরেজা (পাকিস্তান মুসলীম লীগ – কনভেনশন)।
১১. মেজর জেনারেল জামাল দার (সীমান্ত এলাকার)।
১২. মালিক জাহাঙ্গীর খান প্রতিনিধি।
প্রেসিডেন্ট ভবন থেকে ঘোষণায় আরো বলা হয়- “সম্মেলনের পর সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যে জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে বসা কেন যে সম্ভব হবে না প্রেসিডেন্ট তার কারণ দেখছেন না”।
শেখ মুজিবুর রহমান একই দিন সন্ধ্যায় প্রেসিডেন্টের আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যানের কথা ঘোষণা করেন।
সারা পূর্ব পাকিস্তানে অরাজকতা বৃদ্ধি এবং জান-মালের বিপুল ক্ষতি সাধিত হতে থাকে। শেখ মুজিবুর রহমান “সহিংস অসহযোগ আন্দোলন” সাফল্যমন্ডিত করার জন্যে বিভিন্ন নির্দেশ জারী করা শুরু করেন। তিনি খাজনা-বন্ধ অভিযানের কথাও ঘোষণা করেন।
১৯৭১ সালের ৬ই মার্চ তারিখে জাতির উদ্দেশ্যে প্রদত্ত বেতার ভাষণে প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করেন যে, জাতীয় পরিষদের উদ্বোধনী অধিবেশন ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চে অনুষ্ঠিত হবে। ব্যাপক ঐকমত্য ছাড়া পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র প্রণীত হলে তার কর্মক্ষমতা সম্পর্কে যারা সন্দেহ পোষণ করেন তাঁদের উদ্দেশ্যে প্রেসিডেন্ট বলেন, “আমি এ কথা পরিষ্কার বলে দিতে চাই যে, পরে কি ঘটবে তাতে কিছু যায় আসেনা কিন্তু পাকিস্তান সশস্ত্রবাহিনী যতদিন আমার কমান্ডে আছে এবং যতদিন আমি রাষ্ট্রপ্রধান আছি ততদিন আমি পাকিস্তানের পূর্ব এবং পশ্চিম পাকিস্তানের লক্ষ লক্ষ মানুষের কাছে এ দেশ রক্ষা করার দায়িত্ব আমার রয়েছে। দেশবাসী আমার কাছ থেকে তা আশা করে এবং আমি তাদের নিরাশা করবো না।
১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ তারিখে ঢাকায় এক জনসভায় শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর চার দফা দাবী পেশ করেন এবং তা আওয়ামী লীগ কর্তৃক ২৫ মার্চ জাতীয় পরিষদ অধিবেশনে যোগদানের প্রশ্ন বিবেচনার পূর্বশর্ত হিসেবে আরোপ করেন।
বিদেশী পত্র-পত্রিকায় ১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারি মার্চ মাসে পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি সম্পর্কে যে সব খবর বেরিয়েছে তাতে তার একটা পরিষ্কার চিত্র পাওয়া যায়। ২৩শে ফেব্রুয়ারিতে “লন্ডন টাইমস” লিখেছেন, শেখ মুজিবুর রহমান জনগণের উদ্দেশ্যে প্রদত্ত বিবৃতিতে “পূর্ব পাকিস্তানে”র পরিবর্তে “বাঙালী” জাতীর কথা উল্লেখ করেন। “লিভারপুল ডেইলি পোষ্ট” ১৯৭১ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি সংখ্যায় লিখেছেন “হোয়াইট হলে এখন আশঙ্কা করা হচ্ছে যে, পাকিস্তান দ্বিখন্ডিত হয়ে যেতে পারে অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তান নিজেকে স্বাধীন বাঙালী মুসলিম প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করবে। আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিব জাতীয় পরিষদে ৩০০টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি লাভ করে এখন আর পূর্ব পাকিস্তানের কথা বলছেন না, বলছেন বাঙলা প্রজাতন্ত্রের কথা। হোয়াইট হলে এটা অনুধাবন করা হচ্ছে যে, ব্রিটিশ সরকার একটি কমনওয়েলথভুক্ত দেশবিভক্তির মারাত্মক সম্ভাবনার মুখোমুখি হচ্ছেন”।
“ওয়াশিংটন পোষ্ট” ১৯৭১ সালের ৩রা মার্চ তারিখে শেখ মুজিবর রহমানের ২রা মার্চের সাংবাদিক সম্মেলনের খবর প্রকাশ করেন। পত্রিকাটি তাতে লিখেছেন “আওয়ামী লীগের প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকায় তাড়াহুড়ো করে এক সাংবাদিক সম্মেলন ডেকে বলেন, আওয়ামী লীগ মার্চ মাসের ৭ তারিখে একটি জনসভা অনুষ্ঠান করবে এবং এই সভায় তিনি বাংলার জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার অর্জনের কর্মসূচী প্রদান করবেন। তিনি স্বাধীনতা দাবী করবেন কিনা একথা জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন “অপেক্ষা করুন”। এমন কি এর আগেও ১৯৭০ সারের ২৭ নভেম্বর তারিখে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলোচনা প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন “স্বাধীনতা, না এক্ষুণি নয়”।
লন্ডনের “ডেইলি টেলিগ্রাফ” ১৯৭১ সালের ৯ মার্চ সংখ্যায় লিখলেন, “শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা এক রকম ঘোষণাই করেছেন, ২৫শে মার্চ জাতীয় পরিষদ অধিবেশনে যোগদানের পূর্বশর্ত হিসেবে প্রদত্ত ৪ দফা দাবীর মধ্যেই এ কথা লুক্কায়িত রয়েছে, কাজেই প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান পারেন না এসব দাবী পূরণ করতে। আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিব তাঁর আন্দোলনকে “স্বাধীনতার আন্দোলন” বলে অভিহিত করে জাতীয় পরিষদে সহযোগিতার জন্য বিভিন্ন শর্ত আরোপ করেন যা প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান মেনে নিতে পারেন না”। একইদিনে “ডেইলি টেলিগ্রাফ” এক সম্পাদকীয় নিবন্ধে বলেন, “আমরা ইতিমধ্যেই পৃথক রাষ্ট্র হিসেবে পূর্ব পাকিস্তানের সম্ভাব্য নামকরণ শুনছি যা “বাংলাদেশ” কিংবা “বঙ্গভূমি” হতে পারে। এর পতাকাও বানানো হয়ে গেছে।
১৯৭১ সালের ১৩ই মার্চে “লন্ডন ইকোনোমিস্ট” লিখেছেন, প্রেসিডেন্ট কর্তৃক ২৫শে মার্চ তারিখে গণপরিষদের অধিবেশন আহ্বানের জবাবে তিনি (শেখ মুজিব) চারটি শর্ত আরোপ করেন যা তাঁর এবং আওয়ামী লীগের অধিবেশনে যোগদানের পূর্বেই পূরণ করতে হবে। এর মধ্যে দুটি শর্ত যেমন, “অবিলম্বে সামরিক আইন প্রত্যাহার” এবং নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর” কার্যত প্রেসিডেন্ট কর্তৃক মেনে নেয়া অসম্ভব। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া এর পরিস্থিতির একটা নিষ্পত্তি করার উদ্দেশ্যে শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে আলোচনায় মিলিত হবার জন্যে (যেটা হয়তো তাঁর শেষ বৈঠকও হতে পারে) খুব শিঘঘিরই ঢাকা যাচ্ছেন”।
১৯৭১ সালের ১৫ই মার্চ অর্থাৎ যেদিন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান আওয়ামী লীগের সঙ্গে শাসনতান্ত্রিক ব্যাপারে আরো আলাপ-আলোচনার জন্যে ঢাকা গমন করলেন সেদিন “টাইম” সাময়িকী নিউইয়র্ক থেকে লিখলেন, আসন্ন বিভক্তির (পাকিস্তানকে দুটি পৃথক রাষ্ট্রে পরিণতকরণ) পশ্চাতে যে মানবটি রয়েছেন তিনি হচ্ছেন শেখ মুজিবুর রহমান (মুজিব)। গত সপ্তাহে ঢাকায় শেখ মুজিব “টাইম”-এর সংবাদদাতা ডন কগিনকে বলেন, বর্তমানে পাকিস্তানের মৃত্যু হয়েছে, সমঝোতার আর কোন আশা নেই। তিনি পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জন্যে পৃথক পৃথক শাসনতন্ত্র প্রণয়নের কথা বলেন এবং জানান যে তার অনুগামীরা কেন্দ্রীয় সরকারের কর দিতে অস্বীকার করছে যা কিনা পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থিত। মনে হচ্ছে তিনি তাঁর ভাষায় ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা’ ঘোষণার দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়েছেন।
এর দুদিন আগে পূর্ব পাকিস্তানের এই নেতা পশ্চিম পাকিস্তানীদের সম্পর্কে বলেন, “আমি তাদেরকে পঙ্গু করে দেব এবং তাদেরকে নতি স্বীকার করতে বাধ্য করবো”। এই ধরণের একটি বিবৃতির পর সোজাসুজি স্বাধীনতা ঘোষণা আর অতি নাটকীয় কিছু নয়।
.
.
দ্বিতীয় অধ্যায়
.
সংকট ঘনীভূত হলো
১৯৭১ সালের ১৫ই মার্চ পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থা ছিলো এইঃ
(১) আওয়ামী লীগের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের কার্যকলাপের দরুন আইন-শৃঙ্খলা সম্পূর্নভাবে বিশৃংখল হয়ে পড়েছিলো।
(২) ব্যাপক অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট ছাড়াও, আওয়ামী লীগের হিংসাত্মক কার্যকলাপ আরও বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়ালো। ভিন্নমত পোষণকারীদের তারা আক্রমণ করলো। ৩রা মার্চ চট্রগ্রামে ও ৫ই মার্চ খুলনায় আক্রমণের ফলে শত শত লোক হতাহত হলো।
(৩) শেখ মুজিবুর রহমান কেন্দ্রীয় সরকার ও প্রাদেশিক সরকারকে প্রকাশ্যভাবে চ্যালেঞ্জ করে, একের পর এক এমন কতকগুলো নির্দেশ জারী করলেন, যার ফলে প্রশাসন, যোগাযোগ ও ব্যবসা-বানিজ্য ব্যাহত হলো।
(৪) পূর্ব পাকিস্তানের পূর্ব ও পশ্চিম উভয় সীমান্তে হিন্দুস্তানী সৈন্য সমাবেশ বৃদ্ধি পেলো।
এই শ্বেতপত্রের পরবর্তী অধ্যায়ে এই ঘটনাবলীর বিশদ বিবরণ দেওয়া হলো। শেখ মুজিবুর রহমান ৭ই মার্চের ৪ দফা দাবী তার বিচ্ছিন্নতার স্পষ্ট অভিপ্রায়কে আরও স্পষ্টতর করলো। তা সত্ত্বেও পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আর একদফা শাসনতান্ত্রিক আলোচনা জন্যে ১৫ই মার্চ ঢাকা গেলেন।
শেখ মুজিবের ৭ই মার্চের ৪ দফা দাবী ছিলো এইঃ
(১) অবিলম্বে সামরিক শাসন প্রত্যাহার করা;
(২) অবিলম্বে সব সৈন্যবাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নেওয়া;
(৩) প্রাণহানি সম্পর্কে তদন্ত, এবং
(৪) জনগনের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে অবিলম্বে ক্ষমতা হস্তান্তর (জাতীয় পরিষদের অধিবেশনের পূর্বেই)।
এখানে উল্লেখযোগ্য যে আওয়ামী লীগ নেতা কিন্তু এমন কোন আশ্বাস দেননি যে এই দাবীগুলো মেনে নিলেই তিনি ২৫শে মার্চ তারিখে প্রেসিডেন্ট কর্তৃক আহূত জাতীয় পরিষদ অধিবেশনে যোগ দেবেন। এক বিবৃতিতে তিনি বলেনঃ এই শর্তগুলো গ্রহণ করা হলে, তখন আমরা বিবেচনা করে দেখবো যে আমরা অধিবেশনে যোগ দেবো কিনা’’।
১৬ই মার্চ ১৯৭১
শেখ মুজিবুর রহমান প্রেসিডেন্টের সংগে সাক্ষাৎ করলেন এবং তার ৪ দফা দাবী পেশ করলেন। এরপর তিনি আওয়ামী লীগ “হাই কমান্ড” – এর সঙ্গে এক বৈঠকে মিলিত হলেন। সেইদিনই তিনি একটি বিবৃতি দিলেন। তাতে “পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিটি গৃহকে এক একটি দুর্গে পরিণত করার জন্য” পুনরায় আহ্বান জানানো হলো।
১৭ই মার্চ ১৯৭১
প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে দ্বিতীয় দফা বৈঠকে মিলিত হলেন। প্রেসিডেন্ট বললেন, যথাসম্ভব শীঘ্র জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের মত তিনি সর্বদাই পোষণ করে আসছেন।
সেইদিন সন্ধ্যায় আওয়ামী লীগের একটি টীম প্রেসিডেন্টের সাহায্যকারীদের সংগে সাক্ষাৎ করলেন। আওয়ামী লীগের এই টীমে ছিলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম, জনাব তাজউদ্দীন আহমদ ও ডক্টর কামাল হোসেন। ক্ষমতা হস্তান্তরের পদ্ধতি এই বৈঠকে আলোচিত হলো। এতে একটি সামরিক আইন বিধির খসড়া প্রস্তুত করা হলো। এই আইন বিধিতে ব্যবস্থা করা হলো যে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মধ্য থেকে সদস্য বাছাই করে একটি উজীর-সভা গঠিত হবে। এই উজীর-সভা প্রাদেশিক গভর্নরকে তাঁর কর্তব্যপালনে সাহায্য করবেন এবং পরামর্শ দেবেন। এই সামরিক আইন বিধিতে এমন ব্যবস্থাও রাখা হলো যে সামরিক আইন কার্যকারী থাকবে অন্তরাল থেকে।
এই সময়ে ‘খ’ অঞ্চলের সামরিক আইন প্রশাসক একটি আদেশ জারী করলেন। এই আদেশ বলে একটি তদন্ত কমিশন নিয়োগ করা হলো। ১৯৭১ সালের ১ লা মার্চ তারিখে কোন পরিস্থিতিতে বেসামরিক কর্তৃপক্ষের সাহায্যের জন্য সৈন্যবাহিনী তলব করা হয়েছিল- সে সম্পর্কে তদন্ত করার জন্য এই কমিশন নিয়োগ করা হলো। শেখ মুজিবের ৪ দফা দাবীর অন্তর্গত তৃতীয় দফার পরিপ্রেক্ষিতে এই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলো।
সামরিক আইন বিধিতে ব্যবস্থা করা হলো যে পূর্ব পাকিস্তান হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি কর্তৃক মনোনীত একজন বিচারপতি এই কমিশনের প্রধান হবেন। এতে ৪ জন সদস্য থাকবেন। এই ৪ জন সদস্য নেওয়া হবে পাকিস্তান সিভিল সার্ভিস, পাকিস্তান পুলিশ সার্ভিস, পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও পূর্ব পাকিস্তান রাইফেল বাহিনী থেকে।
১৮ই মার্চ, ১৯৭১
শেখ মুজিব তদন্ত কমিশন প্রত্যাখ্যান করে একটি বিবৃতি দিলেন। এই তদন্ত কমিশন ছিলো তাঁর ৭ই মার্চের ৪ দফা দাবীর তৃতীয় দফা। শেখ মুজিব বললেনঃ “ আমরা এ ধরনের একটি কমিশনকে গ্রহণ করতে পারি না। বাংলাদেশের লোকেরা এমন একটি কমিশনের সঙ্গে সহযোগিতা করবে না এবং এর সদস্যও হবে না”। তিনি আরও বললেনঃ “ একটি সামরিক আইনবিধির অধীনে এই কমিশনের নিয়োগ, এবং সামরিক কর্তৃপক্ষের নিকট কমিশনের রিপোর্ট পেশ করার বিধান- দুটোই আপত্তিজনক”।
১৯শে মার্চ, ১৯৭১
শেখ মুজিবুর রহমান বেলা ১১টায় প্রেসিডেন্টের সংগে সাক্ষাৎ করলেন। তিনি পীড়াপীড়ি করলেন যে খসড়া সামরিক আইন বিধি চালু থাকাকালীন অন্তর্বর্তী সময়ের জন্য জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের হাতে আইন প্রণয়নের ক্ষমতা থাকতে হবে এবং কেন্দ্র ও প্রদেশে থাকবে একটি পূর্ণাঙ্গ প্রতিনিধিত্ব মূলক সরকার। তিনি সামরিক আইন সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাহার করারও দাবী জানালেন।
সেইদিন সন্ধ্যায় প্রেসিডেন্ট ও শেখ মুজিবুর রহমানের সহকারীদের মধ্যে একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হলো। আওয়ামী লীগ টীমকে জানানো হলো যে ১৯৬৯ সালের ২৫শে মার্চের সামরিক আইন ঘোষনা যদি বাতিল করা হয় তাহলে যে দলিলের বলে কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তার কোন আইনগত বৈধতা থাকবে না। সুতরাং দেশে সৃষ্টি হবে একটি শাসনতান্ত্রিক শূন্যতা। একথাও ব্যাখ্যা করা হলো যে জেনারেল আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান প্রধান সামরিক শাসনকর্তার অধিকার বলেই প্রেসিডেন্টের পদেও অধিষ্ঠিত রয়েছেন।
জনাব তাজউদ্দিন আহমদ বললেন যে এগুলো রাজনৈতিক বিষয় এবং “রাজনৈতিক পদ্ধতিতেই” এগুলোর সমাধান হওয়া উচিত। ডক্টর কামাল হোসেন প্রস্তাব দিলেন যে জেনারেল এ এম, ইয়াহিয়া খান প্রধান সামরিক শাসনকর্তার ক্ষমতাবলী ত্যাগ করে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের পদবী ও ক্ষমতাবলী গ্রহণ করতে পারেন।
এই বৈঠকের পর, আওয়ামী লীগের দাবী আইনগতভাবে যথাসম্ভব পুরনের উদ্দেশ্যে প্রেসিডেন্টের টীম অন্য একটি সামরিক আইন বিধির খসড়া প্রণয়ন করলেন। এই সামরিক আইন বিধিতে নিন্মলিখিত বিধানগুলো ছিলোঃ
(১) কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক উজীর-সভা গঠন।
(২) জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ সমূহকে ১৯৬২ সালের শাসনতন্ত্রের অধীনে আইন প্রণয়নের ক্ষমতা দান।
(৩) সামরিক আইন প্রশাসকের পদ ও সামরিক বিচারালয় ইত্যাদির বিলোপ সাধন।
কিন্তু আইনগত শূন্যতা যাতে ঘটতে না পারে, সে জন্য প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের পদ বহাল থাকবে। শাসনতান্ত্রিক অচলাবস্থা দূরীকরণের প্রচেষ্টায় প্রেসিডেন্ট ও শেখ মুজিবুর রহমানের সংগে সাক্ষাতের জন্য তিনজন পশ্চিম পাকিস্তানী নেতা সেইদিন ঢাকা পৌঁছলেন। এই নেতৃবৃন্দ হচ্ছেন- কাউন্সিল মুসলিম লীগের মিয়া মমতাজ মোহাম্মদ খান দৌলতানা ও সর্দার শওকত হায়াত খান এবং জমিয়তে উলেমায়ে ইসলামের মওলানা মুফতী মাহমুদ।
২০শে মার্চ, ১৯৭১
আওয়ামী লীগ জয়দেবপুর সামরিক সরবরাহ বহনকারী একটি কনভয়কে বাধা দিয়ে এবং চট্রগ্রামে পাকিস্তানী জাহাজ “এম ভি, সোয়াভ’ এর চলাচল ব্যাহত করে যে সাংঘাতিক উস্কানীকে প্রশ্রয় দিলো- তা সত্ত্বেও প্রেসিডেন্ট তাঁদের সংগে রাজনৈতিক আলোচনা অব্যাহত রাখলেন। বেলা ১০ টায় প্রেসিডেন্টের সংগে শেখ মুজিবুর রহমানের একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হলো। প্রেসিডেন্টের সংগে ছিলেন তাঁর উপদেষ্টাবৃন্দ। শেখ মুজিবুর রহমানের সংগে ছিলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম, খন্দকার মুশতাক আহমদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, জনাব তাজউদ্দিন আহমদ, জনাব এ,এইচ,এম, কামরুজ্জামান ও ডক্টর কামাল হোসেন।
প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবুর রহমানকে স্পষ্টভাবে জানালেন যে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের উদ্দেশ্যে কোন পরিকল্পনা নীতিগতভাবে গৃহীত হওয়ার পূর্বে সে বিষয়ে সকল রাজনৈতিক নেতার দ্ব্যর্থহীন ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হওয়া একান্ত প্রয়োজন। তাহলেই তিনি কোন পরিকল্পনার ব্যাপারে নীতিগতভাবে সম্মত হওয়ার কথা বিবেচনা করতে পারেন।
প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টারা মত প্রকাশ করলেন যে, কোন দলিলের বলে সামরিক আইনের সম্পূর্ন বিলোপ সাধন করে জেনারেল এ,এম, ইয়াহিয়া খান পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের পদবী ও ক্ষমতাবলী গ্রহণ করলে- সে দলিলটির কোন আইনগত বৈধতা থাকবে না। প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিব ও তাঁর সহকারীদের কাছে ব্যাখ্যা করলেন যে, প্রস্তাবিত ঘোষনাটির পেছনে কোন আইনগত বৈধতা থাকবে কিনা তা আইন বিশেষজ্ঞদের দ্বারা পরীক্ষা করিয়ে নিতে হবে। আওয়ামী লীগ তাদের মতের সমর্থনে একজন শাসনতান্ত্রিক বিশেষজ্ঞকে (জনাব এ কে ব্রোহী) পেশ করার ভার নিলেন। প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টাবৃন্দ ও শেখ মুজিবের সহকারীদের মধ্যে পরবর্তী আলোচনার জন্য নিন্মলিখিত নীতিগুলো গৃহীত হলোঃ
১. সামরিক আইন প্রত্যাহার করা হবে।
২. কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক উজীর-সভা গঠনের ব্যবস্থা করতে হবে।
৩. পূর্ব ও প্রাদেশিক পরিষদ সমূহের হাতে আইন প্রণয়নের ক্ষমতাও থাকতে হবে।
৪. পূর্বপাকিস্তানের ভৌগলিক অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিতে, অন্যান্য প্রদেশের তুলনায় পূর্ব পাকিস্তানকে অধিকতর স্বায়ত্তশাসন দিতে হবে।
৫. এই সব ব্যবস্থার বাস্তবায়নের পদ্ধতি সম্পর্কে আরও আলোচনা অনুষ্ঠিত হবে।
একথা উল্লেখ করা হলো যে, যে দলিলটির দ্বারা এইসব ব্যবস্থার বাস্তবায়ন কার্যকরী করা হবে, সে দলিলটি জাতীয় পরিষদ কর্তৃক অনুমোদিত না হওয়া পর্যন্ত সামরিক আইন বলবত রাখতে হবে। এটা আইনগত প্রয়োজন। শেখ মুজিবুর রহমান এতে সম্মত হলেন না।
সেই দিন প্রেসিডেন্টের পক্ষ থেকে জারী করার উদ্দেশ্যে একটি ঘোষনার খসড়া প্রস্তুত করা হলো। প্রস্তাবিত দলিলটি যাতে একটি সামরিক আইনবিধির আকারে জারী না করা হয়, এটা আওয়ামী লীগের দাবী ছিলো। আওয়ামী লীগের এই দাবী পূরনের উদ্দেশ্যে প্রেসিডেন্টের ঘোষনার খসড়া প্রস্তুত করা হলো। নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর সম্পর্কিত অন্যান্য গুরুতবপূর্ন বিষয়ের সমাধানের জন্যও খসড়া ঘোষনাটিকে একটি মৌখিক দলিল হিসেবে গণ্য করা হবে বলে সাব্যস্ত করা হলো। এই ধরনের একটি ঘোষনার কোন আইনগত বৈধতা থাকবে কিনা, এই মূল প্রশ্নটি আওয়ামী লীগের শাসনতান্ত্রিক বিশেষজ্ঞের সংগে আলোচনার পর নির্ধারন করা হবে বলে স্থির করা হলো।
সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ন আইনগত বৈধতাসূচক প্রশ্নটির সমাধানসাপেক্ষ, খসড়া ঘোষনার অন্তর্ভূক্ত প্রধান বিষয়গুলো ছিলঃ
(১) প্রাদেশিক উজীর-সভার সদস্য যেদিন শপথ গ্রহণ করবেন, সেইদিন থেকে ১৯৬৯ সালের ২৫শে মার্চের সামরিক আইন ঘোষনা বাতিল বলে গণ্য হবে।
(২) ঘোষনার জন্য প্রয়োজনীয় সংশোধনের পর, ১৯৬৯ সালের ৪ঠা এপ্রিলের অস্থায়ী শাসনতন্ত্র আদেশ অন্তর্বর্তীকালীন সময়ের জন্য পাকিস্তানের শাসনতন্ত্ররুপে গণ্য হবে।
(৩) ঘোষণা জারী হওয়ার অব্যবহিত পূর্বে যিনি প্রেসিডেন্টের পদে অধিষ্ঠিত থাকবেন, অন্তর্বর্তীকালীন সময়েও তিনিই প্রেসিডেন্টের পদে অধিষ্ঠিত থাকবেন।
(৪) প্রেসিডেন্ট হবেন রাষ্ট্রের প্রশাসনিক প্রধান। ১৯৬২ সালের শাসনতন্ত্রের সংগে সামঞ্জস্যপূর্ন অস্থায়ী শাসনতন্ত্র আদেশের বিধানসমূহের আওতায় তিনি প্রেসিডেন্টের সমস্ত ক্ষমতা প্রয়োগ করবেন ও কর্তব্য পালন করবেন। ১৯৬২-এর শাসনতন্ত্রকে এরপর ‘প্রাক্তন শাসনতন্ত্র’ রূপে উল্লেখ করা হয়েছে।
(৫) পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক দলসমূহ থেকে সদস্য বাছাই করে একটি কেন্দ্রীয় উজির-সভা গঠন করা হবে।
(৬) প্রাক্তন শাসনতন্ত্রের অধীনে জাতীয় পরিষদের দায়িত্বসমূহ, আইন কাঠামো আদেশে উল্লিখিত জাতীয় পরিষদ কর্তৃক পালিত হবে।
(৭) প্রাক্তন শাসনতন্ত্রে সন্নিবিষ্ট তৃতীয় তফশীলে উল্লেখিত সমস্ত বিষয়ে আইন প্রণয়নের নিরঙ্কুশ ক্ষমতা থাকবে কেন্দ্রীয় আইন পরিষদের হাতে। তবে এ ব্যাপারে পূর্ব পাকিস্তানের ক্ষেত্রে কিছু ব্যাতিক্রম থাকবে। এ সম্পর্কে সীমারেখা ও পরিবর্তন স্থির করা হবে। তৃতীয় তফশীলে আইন প্রনয়নে কেন্দ্রের নিরঙ্কুশ ক্ষমতা ও কেন্দ্রীয় বিষয় সমূহের তালিকা আছে।
(৮) প্রাক্তন শাসনতন্ত্রের অধীনে প্রাদেশিক পরিষদের দায়িত্বসমূহ, আইন কাঠামো আদেশের অধীনে নির্বাচিত প্রাদেশিক পরিষদ সদস্যগণ কর্তৃক পালিত হবে ও পরে পূর্ব পাকিস্তানের ক্ষেত্রে জাতীয় পরিষদ কর্তৃক আইন প্রণয়নের ব্যাপারে যে ব্যাতিক্রমের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, সেই অনুসারে, যেসব বিষয়ে আইন প্রণয়নে জাতীয় পরিষদের ওপর সীমারেখা আরোপ করা হবে সেই সব বিষয়ে আইন প্রণয়নের অতিরিক্ত ক্ষমতা থাকবে পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের হাতে।
(৯) প্রেসিডেন্ট প্রদেশের পার্লামেন্টারী গ্রুপসমূহের নেতাদের সঙ্গে পরামর্শক্রমে প্রাদেশিক গভর্ণর নিযুক্ত করবেন। প্রেসিডেন্ট যতদিন গভর্ণরের প্রতি তুষ্ট থাকবেন, ততোদিন পর্যন্ত গভর্ণর তাঁর পদে বহাল থাকবেন।
(১০) প্রত্যেক প্রদেশে গভর্নরকে তাঁর কর্তব্য পালনে সাহায্য করার জন্য একটি উজীর সভা থাকবে এবং মুখ্য-উজীর এই উজীর সভার প্রধান থাকবেন। অবশ্য প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য কিংবা জাতীয় পরিষদের সদস্য পদে নির্বাচিত কোন ব্যাক্তি ছাড়া কাউকেই উজীর নিযুক্ত করা যাবে না।
(১১) ঘোষনা প্রচারের ৭ দিনের মধ্যে ঢাকা ও ইসলামাবাদে একটি করে দুটি কমিটি গঠন করা হবে। কমিটি দুটো পাকিস্তানের প্রত্যেক প্রদেশের জন্য যেসব বিশেষ ধারার প্রয়োজন রয়েছে তা তৈরী করবেন এবং এসব ধারা পরে জাতীয় পরিষদের তৈরী করা শাসনতন্ত্রের অন্তর্ভূক্ত করা হবে।
(১২) উপরোক্ত কমিটি দুটোর রিপোর্ট পাওয়ার পর প্রেসিডেন্ট পাকিস্তানের জন্য একটি শাসনতন্ত্র তৈরীর উদ্দেশ্য তাঁর বিবেচনামত উপযুক্ত তারিখ সময় ও স্থানে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ডাকবেন।
(১৩) কোন প্রদেশের গভর্ণরের রিপোর্টের মাধ্যমে কিংবা অন্য কোন উপায়ে যখনই প্রেসিডেন্টের মনে হবে যে, এমন একটা পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে যে সেই প্রদেশের সরকারকে দিয়ে কাজ চালানো যাচ্ছে না প্রেসিডেন্ট এক ঘোষনার মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট প্রদেশের কার্যনির্বাহী সরকারের সব কিংবা যে কোন ক্ষমতা নিজে গ্রহণ করতে পারবেন।
একই দিন (২০শে মার্চ, ১৯৭১) কাউন্সিল মুসলিম লীগ এবং জমিয়তে উলামার নেতারা শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে পৃথক পৃথক বৈঠকে মিলিত হন।
২১শে মার্চ, ১৯৭১
শেখ মুজিবুর রহমান জনাব তাজউদ্দীনকে সঙ্গে নিয়ে প্রেসিডেন্টের সঙ্গে এক অনির্ধারিত বৈঠকে মিলিত হন। তিনি উল্লেখ করেন যে, কেন্দ্রীয় উজীর সভা গঠিত হোক এটা তিনি এখন আর চান না। উদ্দেশ্য ও বক্তব্য পেশের এই পরিবর্তন অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। আওয়ামী লীগ তাদের খসড়া ঘোষনার আইনগত বৈধতা প্রতিষ্ঠার জন্য শাসনতান্ত্রিক বিশেষজ্ঞ আনার যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তাও কার্যকরী করতে ব্যর্থ হন।
প্রেসিডেন্টের আমন্ত্রণে পাকিস্তান পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জনাব জুলফিকার আলী ভূট্টো তাঁর সহকারীদের সঙ্গে নিয়ে ঢাকায় এলেন।
২২শে মার্চ, ১৯৭১
যদিও শেখ মুজিবুর রহমান ভুট্টোর সঙ্গে আলাপ-আলোচনার জন্য মিলিত হতে প্রকাশ্যভাবে অস্বীকৃতি ঘোষনা করেন তবুও প্রেসিডেন্ট তাঁর সঙ্গে একটি যৌথ বৈঠক অনুষ্ঠানের জন্য উভয় নেতার উপর তাঁর প্রভাব খাটান। বৈঠক শেষে শেখ মুজিবুর রহমানের অনুরোধ ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন শুরু করার যে আদেশ প্রেসিডেন্ট দিয়েছিলেন তা বাতিল করা হয়। এটা সাব্যস্ত হয় যে, প্রস্তাবিত ঘোষনাকে আইনগত দিক থেকে বৈধ করার জন্য ১৯৭১ সালের ২ এপ্রিল জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ডাকা যেতে পারে। কিন্তু আওয়ামী লীগ তা গ্রহণ করেননি।
একই দিন সন্ধ্যায় বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ঘোষনা করেন যে, সারা পাকিস্তানে ২৩শে মার্চ তারিখে যে পাকিস্তান দিবস পালন করা হয় তা এবার পূর্ব পাকিস্তানের ‘প্রতিরোধ দিবস’ হিসেবে পালিত হবে।
প্রেসিডেন্ট মিয়া মমতাজ মুহম্মদ খান দৌলতানা, সরদার শওকত হায়াৎ, মাওলানা মুফতি মাহমুদ, খান আবদুল ওয়ালী খান এবং মীর গৌস বক্স বিজেঞ্জোর সঙ্গেও মিলিত হন। তিনি তাঁদেরকে একটা রাজনৈতিক সমঝোতায় উপনীত হওয়ার চেষ্টা করার জন্য শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে দেখা করতে বলেন।
এদিকে সংশোধিত খসড়া ঘোষনাটির বিভিন্ন বিষয় বিবেচনার কাজকে সহজতর করার উদ্দেশ্য ঘোষনাটি পূর্বাহ্নেই জনাব জুলফিকার আলী ভুট্টো এবং জনাব তাজুদ্দিনের হাতে দেয়া হয়। বিকেল ৬টায় জনাব জুলফিকার আলী ভুট্টো তাঁর সহকারী জনাব মাহমুদ আলী কাসুরী, জনাব জে এ রহিম, ডক্টর মোবাশির হাসান, জনাব হাফিজ পীরজাদা এবং জনাব রফি রাজাকে নিয়ে প্রেসিডেন্টের সাহায্যকারীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। পিপিপি প্রতিনিধিরা নিন্মোক্ত যুক্তিসমূহ পেশ করেনঃ
(১) সামরিক আইন প্রত্যাহারের পর জাতীয় পরিষদের অনুমোদন না থাকলে প্রস্তাবিত ঘোষনার পেছনে কোন আইনগত সমর্থন থাকবে না। সুতরাং তাঁরা প্রস্তাব করেন যে, হয় ঘোষনাটিকে জাতীয় পরিষদকে দিয়ে অনুমোদন করিয়ে নেয়া হোক কিংবা ঘোষনাটি প্রকাশ করা হোক কিন্তু জাতীয় পরিষদ কর্তৃক অনুমোদিত হওয়ার পর তা কার্যকরী করা হবে। অথবা বিক্লপ-মূলক ব্যবস্থা হিসেবে, জাতীয় পরিষদ কর্তৃক অনুমোদনের আগ পর্যন্ত ঘোষনাটিকে প্রয়োজনীয় আইনগত বৈধতা দেয়ার জন্য প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা অক্ষুন্ন রাখা হোক।
(২) পিপিপি মত প্রকাশ করেন যে, প্রয়োজনীয় আইনগত বৈধতা ছাড়া এই ঘোষনার কোন মূল্যই থাকবে না। এবং আওয়ামী লীগ একতরফা ভাবে স্বাধীনতা ঘোষনা করতে চাইলে এই ঘোষনা তার পরে একটি আইনগত বাধাও হবে না।
(৩) অবশেষে যখন জাতীয় পরিষদের যুক্ত অধিবেশন হবে তখন আওয়ামী লীগ কর্তৃক বেপরোয়াভাবে তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রয়োগের সম্ভাবনা এড়ানোর উদ্দেশ্য পিপিপি প্রতিনিধিরা প্রস্তাব করেন যে, ঘোষনার এই ব্যবস্থা থাকতে হবে যে, আলাদা আলাদাভাবে দেশের দুই অংশের জাতীয় পরিষদ সদস্যদের বেশিরভাগ সদস্যের অনুমোদন ছাড়া কোন আইন কিংবা শাসনতন্ত্র জাতীয় পরিষদে পেশ করা যাবে না।
(৪) তাঁরা মনে করেন যে, ১৯৬২ সালের শাসনতন্ত্রের তৃতীয় তালিকা পরিবর্তনের ক্ষমতা কেবল তালিকাটি সংশোধনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকা উচিত এবং তালিকার প্রতিটি বিষয়ই পরিবর্তনের ক্ষমতা থাকা উচিত নয়। দেশ রক্ষার মতো যে সব বিষয় কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রনে থাকবে বলে মতৈক্য হয়েছে সে সব বিষয়ে রদবদল করার ক্ষমতা থাকা উচিত নয়।
(৫) প্রাদেশিক গভর্ণরদের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের “সঙ্গে পরামর্শ করে নয়” বরং কেবল তাদের “সুপারিশ অনুসারে” নিযুক্ত করতে হবে। কতিপয় ক্ষেত্রে প্রাদেশিক গভর্ণর নিজ বিবেচনা অনুসারে কাজ করতে পারবেন এই মর্মে যে ধারাটি রয়েছে তা সংশোধন করতে হবে কেননা তা প্রতিনিধিত্বমূলক সরকারের ধারনার পরিপন্থী।
(৬) পিপিপি জানতে চান ঘোষনা জারী করার পর LFO-র মর্যাদা কী হবে? এই জিজ্ঞাসার উদ্দেশ্য ছিল LFO-কে টিকিয়ে রাখা হবে কিনা তা জানা।
(৭) পরিশেষে, পিপিপি মনে করেন যে, প্রথমে একক পরিষদ হিসেবে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনুষ্ঠিত হওয়া উচিত এবং পরে দুটি কমিটি গঠিত হওয়া উচিত।

২৩শে মার্চ, ১৯৭১
২৩শে মার্চ তারিখে বিভিন্ন সশস্ত্র সমাবেশ এবং শেখ মুজিবুর রহমানের বাসভবনে বাংলাদেশ পতাকা উড়ানোসহ এই দিনের ঘটনাবলী অন্যত্র বর্ণনা করা হয়েছে।
বেলা ১১টা ৪৫ মিনিটের সময় প্রেসিডেন্টের সহকারীবৃন্দ এবং আওয়ামী লীগ টিমের মধ্যে একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ডক্টর কামাল হোসেন আওয়ামী লীগের পক্ষে তাঁর তৈরী করা একটি খসড়া ঘোষণাপত্র পেশ করেন। আওয়ামী লীগ টিমকে বলা হয় যে, বর্ধিত উত্তেজনা এবং পরিস্থিতির চাপের পরিপ্রেক্ষিতে এবং পিপিপি ও জাতীয় পরিষদের অন্যান্য দলের সঙ্গে পরামর্শ করা প্রয়োজন বিধায় আগের খসড়া ঘোষণাপত্রের ভিত্তিতেই আলোচনার অগ্রগতি হওয়া উচিত। কিন্তু আওয়ামী লীগ টীম এ কথা মানতে অস্বীকার করেন। আওয়ামী লীগ টীমকে বলা হয় যে, তাঁরা ইচ্ছে করলে মুল খসড়াটিতে আরো কিছু যোগ করা কিংবা তাতে রদবদলের প্রস্তাব করতে পারেন। কিন্তু আওয়ামী লীগ এ কথাও মেনে নেননি।
এই পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগের খসড়াটি পরীক্ষা করে দেখা শুরু করা হলো এবং সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত আলোচনা স্থগিত করা হলো। তারপর একটি সান্ধ্য বৈঠক অনুষ্ঠিত হলো এবং আওয়ামী লীগের সঙ্গে নিচে বর্ণিত বিষয়সমূহ আলোচনা করা হলোঃ
(১) আইনগত বাধ্যবাধকতা হচ্ছে যে, এই ধরনের যে কোন ঘোষনা সামরিক আইন প্রত্যাহারের আগে জাতীয় পরিষদ কর্তৃক অনুমোদিত হওয়া উচিত।
(২) আওয়ামী লীগের খসড়ায় বলা হয় যে, একটি প্রদেশে গভর্ণরের শপথ গ্রহণের তারিখেই সেই প্রদেশ থেকে সামরিক আইন উঠে যাবে এবং ঘোষনার তারিখের পর ৭ দিন পার হলে সারা পাকিস্তান থেকে সামরিক আইন উঠে যাবে। স্মরণ রাখতে হবে যে, গভর্ণরকে বরখাস্ত করা যাবে না। আওয়ামী লীগকে বলা হয় যে, এতে প্রশাসনিক বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে এবং সামরিক আইন যদি প্রত্যাহার করতে হয় তাহলে যে তারিখে সব প্রদেশের প্রাদেশিক উজীররা শপথ নেবেন সে তারিখে সামরিক আইন প্রত্যাহার করাটাই সঙ্গত হবে।
(৩) দেশের দুই অংশের জাতীয় পরিষদ সদস্যদের পৃথক পৃথক কমিটি গঠন-সংক্রান্ত যে ধারনাটি আগের ঘোষনার ছিল তা আওয়ামী লীগের নতুন খসড়ায় সংশোধন করে বলা হয়, “বাংলাদেশ রাজ্য এবং পশ্চিম পাকিস্তানের রাজ্যসমূহ থেকে নির্বাচিত জাতীয় পরিষদ সদস্যরা শপথ নেবেন এবং “বাংলাদেশ” রাজ্য ও পশ্চিম পাকিস্তানের রাজ্যসমূহের জন্য শাসনতন্ত্র তৈরীর উদ্দেশ্য তাদেরকে নিয়ে পৃথক পৃথক শাসনতান্ত্রিক কনভেনশন গঠন করা হবে।” আওয়ামী লীগ টীমকে বলা হয় যে, এর অর্থ হচ্ছে পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদকে পশ্চিম পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদ এবং পূর্ব পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদ এবং পূর্ব পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদ এই দুই জাতীয় পরিষদকে ভাগ করা এবং ফলতঃ তা বিচ্ছিন্নতার এক শাসনতান্ত্রিক ফর্মুলা হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
(৪) আওয়ামী লীগের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলা হয় যে, জাতীয় পরিষদ সদস্যদের যে শপথ নেয়ার কথা ছিল তাঁরা তাও বদলেছেন। আইন কাঠামো আদেশ যার অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং যার অধীনে পরিষদের অধিবেশন ডাকার কথা তার ১২ নম্বর অনুচ্ছেদে পরিস্কারভাবে একটি শপথ দেয়া হয়েছে। শপথটি এইঃ
“আমি সর্বান্তকরণে শপথ করছি (বা, ঘোষনা করছি) যে, আমি পাকিস্তানের প্রতি সাত্যিকারভাবে বিশ্বস্ত ও অনুগত থাকবো এবং যেসব কর্তব্য সম্পাদনের ভার আমি নিতে যাচ্ছি তা আইন কাঠামো আদেশ, ১৯৭০-এর ধারা সমূহ ও এই আদেশে বর্নিত পরিষদের আইন-কানুন অনুসারে এবং সব সময়ই পাকিস্তানের অখন্ডতা সংহতি কল্যান ও সমৃদ্ধির প্রতি লক্ষ্য রেখে সততা, আমার সর্বোত্তম যোগ্যতা এবং বিশ্বস্ততার সঙ্গে পালন করবো।”
আওয়ামী লীগের খসড়ার ১৭ (৫) অনুচ্ছেদে যে শপথ দেয়া হয় তা এই ” আমি সর্বান্তকরনে শপথ (ঘোষনা) করছি যে আমি আইন বলে গঠিত পাকিস্তানের শাসনতন্ত্রের প্রতি বিশ্বস্ত ও সত্যিকারভাবে অনুগত থাকবো।”
(১) প্রেসিডেন্টের টীম আওয়ামী লীগের টীমের সঙ্গে তাদের খসড়ার একটি ধারার মারাত্মক তাৎপর্য নিয়ে আলোচনা করেন। এই ধারায় বলা হয় যে, পরিষদ “পাকিস্তান কনফডারেশন”-এর জন্য একটি শাসনতন্ত্র তৈরী করবেন। আওয়ামী লীগ টিমকে স্পষ্ট করে বলা হয় যে, কনফেডারেশনের মানে হচ্ছে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রসমূহের একটি জোট এবং এই কনফেডারেশনের ধারনা ‘আইন কাঠামো আদেশ’ এবং আওয়ামী লীগের “৬দফা”-র বিরোধী কারন, ” আইন কাঠামো আদেশ” এবং ৬ দফা দুটোতেই সুনির্দিষ্ট করে বলা হয়েছে যে, পাকিস্তান একটি ফেডারেল প্রজাতন্ত্র হবে।
(২) আওয়ামী লীগের খসড়ার ১৭ (৭) অনুচ্ছেদে বলা হয়, “প্রেসিডেন্টের কাছে শাসনতন্ত্র বিলটি পেশ করা হলে তিনি তা অনুমোদন করবেন এবং যেকোন অবস্থায় বিলটি পেশের তারিখের পর ৭ দিন অতিক্রান্ত হলেই মনে করা হবে যে প্রেসিডেন্ট তা অনুমোদন করেছেন।” আওয়ামী লীগ টীমের দৃষ্টি আকর্ষন করে বলা হয় যে এই ধারাটি আইন কাঠামো আদেশের পরিপন্থী এবং এতে করে LFO-তে যে ৫টি শাসনতান্ত্রিক মূলনীতির কথা বলা হয়েছে তার পরিপন্থী একটা শাসনতন্ত্র তৈরীর সম্ভাবনা দেখা দেবে।
আওয়ামী লীগের খসড়ার আর্থিক ও অর্থনৈতিক দিক দিয়েও আলোচনা করা হয়। আলোচিত প্রধান বিষয়গুলো হচ্ছেঃ
(০১) আওয়ামী লীগ খসড়ায় ১৯৬২ সালের শাসনতন্ত্রের তৃতীয় তালিকার ৪৯টি বিষয়ের পরিবর্তে ১২টি বিষয়ের নাম ছিল। এর অর্থ এই ছিল যে পূর্ব পাকিস্তানের ক্ষেত্রে এই ১২টি বিষয়ই হবে কেন্দ্রীয় বিষয় এবং বাদবাকী সব বিষয়ই হবে প্রাদেশিক বিষয়।
(০২) এমন কি তৃতীয় তালিকার এই ১২টি বিষয়ের ব্যাপারেও আওয়ামী লীগ গুরুত্বপূর্ণ সংশোধনের প্রস্তাব করেন যে, আওয়ামী লীগ খসড়ায় তৃতীয় তালিকার প্রথম নম্বরে শুধু লেখা ছিল “পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা”। ১৯৬২ সালের শাসনতন্ত্রে এই বিষয়ের অধীনে ৫টি উপ-বিষয় ছিল। আওয়ামী লীগ টীমকে বলা হয় যে এই বিষয়ের অধীনে রয়েছে সামরিক, নৌ ও বিমানবাহিনীর কারখানাসমূহ, প্রতিরক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শিল্পসমূহ, অস্ত্র উৎপাদন, ক্যান্টনমেন্ট এলাকাসমূহের কর্তৃক প্রভৃতি।
(০৩) বৈদেশিক বিষয়াদি সম্পর্কে আওয়ামী লীগের ব্যবস্থা ছিল, “বৈদেশিক বাণিজ্য ও বৈদেশিক সাহায্য বাদ দিয়ে বৈদেশেক বিষয়াদি।” এক্ষেত্রেও আওয়ামী লীগ খসড়ায় ১৯৬২ সালের শাসনতন্ত্রের ৭টি উপ-বিষয় বাদ দেয়া হয়।
আওয়ামী লীগ টীমকে বলা হয় যে তাঁরা বৈদেশিক বিষয়াদির সঙ্গে বৈদেশিক বাণিজ্য ও সাহায্যের সবরকম সম্পর্ক ছিন্ন করে তাদের প্রকাশ্যে ভাবে ঘোষিত নীতিকে পরিবর্তন করেছেন। আওয়ামী লীগ টীম বিদেশে আলাদা আলাদা বাণিজ্য প্রতিনিধি নিয়োগেরও প্রস্তাব করেন।
আওয়ামী লীগ খসড়ায় ১৪ (১) অনুচ্ছেদে কেন্দ্রীয় বিষয়সমূহের বিবেচনা ছিল। এতে বহু গুরুত্বপূর্ন জিনিস বাদ দেয়া হয়েছিল। বাদ দেয়া জিনিসগুলোর মধ্যে ছিলঃ
(১) এতে কেন্দ্রীয় পাবলিক সার্ভিস কমিশন কিংবা কেন্দ্রের কাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট চাকুরি সমূহ বা পদসমূহের কোন উল্লেখ ছিল না।
(২) খসড়ায় জাতীয় আদমশুমারি অনুষ্ঠানের জন্য কোন প্রতিষ্ঠানের উল্লেখ ছিল না। (” একজন লোক একটি ভোট”- এই নীতি চালু হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে এই জিনিসটির বাদ পড়া তাৎপর্যপূর্ণ)।
(৩) দেশের দু’অংশের মধ্যেকার পরিবহন এবং দু’অংশের মধ্যেকার ডাক-সার্ভিস, আন্তর্জাতিক ডাক সার্ভিসের কোন উল্লেখ ছিল না।
এসব বিষয়ে আওয়ামী লীগ টীম তাদের মনোভাব পরিবর্তনের অনিচ্ছা প্রকাশ করেন।
কর ব্যবস্থা সম্পর্কে আওয়ামী লীগ খসড়ায় কেন্দ্র কর্তৃক কর আদায়ের কোন বযবস্থাই ছিল না। এমন কি তাদের নিজের খসড়ায় উল্লেখ করা কেন্দ্রীয় বিষয়সমূহের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দায়িত্ব পালনের জন্যও কেন্দ্র কর্তৃক কর আদায়ের কোন ব্যবস্থা ছিল না। আওয়ামী লীগ আরো দুটি ধারাও যোগ করেছিলেন। ধারা দুটি হচ্ছেঃ
(১) প্রস্তাব করা হয় যে, ১৯৭০-৭১ সালের বার্ষিক উন্নয়ন কার্যক্রমে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি কেন্দ্রের বরাদ্দ এবং প্রদেশের সম্পদের মধ্যে যে ব্যবধান রয়েছে কেন্দ্রকে তা পূরন করতে হবে। যদিও কেন্দ্র পূর্ব পাকিস্তানে কর আদায় করবেন না।
(২) আওয়ামী লীগ টীম আরো বলেন যে, অন্তর্বতীকালীন মেয়াদ যদি ১৯৭১ সালের ৩০শে জুনের বাইরে যায় তাহলে প্রদেশসমূহ কর্তৃক নির্দিষ্ট শতকরা হারে কেন্দ্রকে অর্থ সরবরাহের নীতিও মেনে নেয়া হবে না।
প্রেসিডেন্টের টীম আরো বলেন যে, স্বীকৃত ফেডারেল পদ্ধতি এই যে, কেন্দ্রের শাসনতান্ত্রিক দায়িত্বসমূহ পালনের জন্য যতটা প্রয়োজন ততটা কর বসানোর ক্ষমতা কেন্দ্রের হাতে থাকা উচিত।
আওয়ামী লীগ খসড়ায় আরো বলা হয় যে, পূর্ব পাকিস্তানের জন্য একটি স্বতন্ত্র স্টেট ব্যাংক থাকবে এবং তা প্রদেশিক আইন পরিষদের তৈরী আইনের নিয়ন্ত্রণাধীন হবে। ফেডারেল স্টেট ব্যাংকের হাতে মাত্র কতকগুলো নির্দিষ্ট কর্তব্য রাখার প্রস্তাব করা হয়। এসব কর্তব্য হচ্ছেঃ
(১) টাকার বৈদেশিক বিনিময় হার সুপারিশ করা।
(২) পূর্ব পাকিস্তান স্টেট ব্যাংকের অনুরোধক্রমে নোট ইস্যু করা।
(৩) টাকশাল এবং সিকিউরিটি ছাপাখানা সম্পর্কে ব্যবস্থা করা এবং এগুলো নিয়ন্ত্রন করা।
(৪) আন্তর্জাতিক অর্থ সংক্রান্ত প্রতিষ্ঠানসমূহের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে ফেডারেল স্টেট ব্যাংক সেই সব কর্তব্য পালন করবেন যা সচরাচর করা হয়ে থাকে-এই শর্তে যে, পূর্ব পাকিস্তানের স্টেট ব্যাংকের নির্দেশের সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই এ সব কর্তব্য পালন করা হবে।
(৫) আওয়ামী লীগ খসড়ার অনুচ্ছেদ ১৬ এবং অনুচ্ছেদ ১৭ (১) একত্রে পাঠ করলে বোঝা যাচ্ছে যে তাঁরা ৯ই এপ্রিল নাগাদ অর্থাৎ মাত্র দু’সপ্তাহের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তান স্টেট ব্যাংক স্থাপনের প্রস্তাব করেন।
আওয়ামী লীগ এই প্রস্তাবের কোন রকম সংশোধন বিবেচনা করতে রাজি ছিলেন না।
আওয়ামী লীগের ঘোষনায় ১৯৬২ সালের শাসনতন্ত্রের ১৪টি অনুচ্ছেদ বাদ দেয়ার প্রস্তাব ছিল। অনুচ্ছেদগুলো হচ্ছে ৯৯, ১০৩, ১০৪, ১০৫, ১০৭, ১০৮, ১১২, ১১৩, ১১৪, ১১৯, ১২০, ১২১, ১২২ এবং ১৩১-এর ২ নম্বর ধারা। এতে ১৯৬২ সালের শাসনতন্ত্রের অনুচ্ছেদ নম্বর ৬৭, ৬৮, ৭০, ৮০, ৮১, ৮২, ৮৪, ৮৬ এবং ২৯২ সংশোধন করা হয় এবং ফেডারেল সরকারের ক্ষমতা আরো দুর্বল উদ্দেশ্যে ৯০-ক থেকে ৯০-চ পর্যন্ত নতুন কতকগুলো অনুচ্ছেদ যোগ করা হয়।
১৩১ নম্বর অনুচ্ছেদের ২ নম্বর ধারাটির বিশেষ গুরুত্ব ছিল। এতে এই ব্যবস্থা ছিল যে কেন্দ্রীয় আইন পরিষদ কতকগুলো বিশেষ ক্ষেত্রে প্রাদেশিক বিষয়েও আইন পাস করতে পারেন। এসব ক্ষেত্র হচ্ছেঃ
(ক) যখন পাকিস্তানের অর্থনৈতিক ও আর্থিক স্থিতিশীলতাসহ পাকিস্তানের নিরাপত্তা বিপন্ন হয়ে পড়ে।
(খ) পরিকল্পনা ও সমন্বয় সাধনের প্রয়োজন।
(গ) যে কোন ব্যাপারে পাকিস্তানের বিভিন্ন অংশের মধ্যে সমতা অর্জনের প্রয়োজন।
এমন কি উপরোক্ত “ক” ক্ষেত্রের বেলায়ও তাদের মত পরিবর্ত্ন করতে আওয়ামী লীগ সুস্পষ্ট অস্বীকৃতি জানান।
প্রেসিডেন্টের টীম উল্লেখ করেন যে ঘোষনার উদ্দেশ্য ছিল একটি অন্তর্বর্তীকালীন শাসনতন্ত্র হিসেবে কাজ করা। আওয়ামী লীগের সব দাবীই এতে মেনে নেয়া হয়নি। এর উপর জনাব তাজুদ্দীন আহমদ বলেন, সময় চলে যাচ্ছে, তাই ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ঘোষনা প্রকাশ করতে হবে। তিনি আরো বলেন, এই সময়ের শেষে ঘোষনা প্রকাশ করা হলে তা হবে অতি বিলম্বিত। তাঁকে জানানো হয় যে, আওয়ামী লীগের প্রস্তাবসমূহের ব্যাপারে অন্যান্য ফেডারেটিং ইউনিটের বিভিন্ন পার্লামেন্টারী দলের সঙ্গে পরামর্শ হওয়া উচিত। বস্তুতঃ প্রেসিডেন্ট ১৯৭১ সালের ২০শে মার্চ আওয়ামী লীগ নেতাদের বলেন যে, সব রাজনৈতিক নেতার মতৈক্য অত্যাবশ্যক।
একই দিনে খান আবদুল কাইয়ুম খান প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। সন্ধ্যায় জনাব মমতাজ মুহম্মদ খান দৌলতানা, জনাব সরদার শওকত হায়াৎ, জনাব মুফতি মাহমুদ, খান আবদুল ওয়ালী খান এবং শাহ আহমদ নূরানীও প্রেসিডেন্টের সঙ্গে দেখা করেন। তাঁরা শেখ মুজিবুর রহমানকে যুক্তিতে আনার ব্যাপারে তাঁদের ব্যর্থতার কথা প্রেসিডেন্টকে অবহিত করেন এবং বলেন যে, তিনি (শেখ মুজিব) আওয়ামী লীগের স্কীমের কোন পরিবর্তন মেনে নিতে পারবেন না।
এর আগে সকালের দিকে শেখ মুজিবুর রহমান সশস্ত্র স্বেচ্ছাসেবকদের মার্চপাস্টে বাংলাদেশের পতাকা উড়ান এবং বলেন, ” আমাদের সংগ্রাম মুক্তি ও স্বাধীনতার সংগ্রাম।”
২৪ শে মার্চ, ১৯৭১
জনাব জুলফিকার আলী ভুট্টো ঘোষনার যথার্থতা এবং বৈধতার ব্যাপারে আলোচনার জন্যে আবার প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এই ঘোষনার মাধ্যমে সামরিক আইন প্রত্যাহার এবং জেনারেল ইয়াহিয়া খান কর্তৃক প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা ও কর্তব্য গ্রহন করার কথা ছিল।
আওয়ামী লীগের সহকারীরা সন্ধ্যা ছ’টায় প্রেসিডেন্টের টীমের সঙ্গে আবার বৈঠকে মিলিত হন। এই বৈঠকের পর জনাব তাজুদ্দীন আহমদ সাংবাদিকদের কাছে এক বিবৃতিতে বলেন, “বৈঠকে আমাদের যা বক্তব্য তা আমরা সবই বলেছি।” তিনি আরো বলেন, “আমাদের দিক থেকে আর কোন বৈঠকের প্রয়োজন নেই।” (দি পিপল’ ঢাকা ২৫শে মার্চ।১৯৭১)।
২৫ শে মার্চ, ১৯৭১
আওয়ামী লীগ প্রকাশ্যভাবে জানিয়ে দিলেন যে, তাঁরা আর বৈঠক অনুষ্ঠানের ব্যাপারে আগ্রহী নন। তাঁরা যে খসড়া ঘোষনা পেশ করেন তাতে পরিস্কার বোঝা যায় যে, শেখ মুজিবুর রহমান কেন্দ্র কিংবা পাকিস্তান ফেডারেশন সংক্রান্ত কোন বন্দোবস্তের ব্যাপারে উৎসাহী নন। এর অর্থ হচ্ছে, এই খসড়া ঘোষণাটি ফেডারেশনের পরিবর্তে একটি কনফেডারেশন তৈরী করে কেন্দ্র কর্তৃক বিলোপ করবে, শেখ মুজিব পয়লা মার্চ থেকে যে প্রতিদ্বন্দ্বী সরকার চালাচ্ছিলেন এই ঘোষনা তাকে আইনগত বৈধতা প্রদান করবে এবং আইনসিদ্ধ কোন বৈধতা ছাড়াই ঘোষণাটি জারী করে শাসনতান্ত্রিক শূন্যতা সৃষ্টি করবে।
প্রেসিডেন্ট নিম্নোক্ত কথায় বিষয়টির সংক্ষিপ্তসার প্রকাশ করেনঃ
“এটা অত্যন্ত পরিস্কার হয়ে গেছে যে, শেখ মুজিবুর রহমান এবং তাঁর উপদেষ্টারা এক পাকিস্তানের ভিত্তিতে কোন সমঝোতায় আসবেন না বরং কোনক্রমে আমার কাছ থেকে এমন একটা ঘোষনা প্রকাশ করিয়ে নিতে চান যা কার্যতঃ জাতীয় পরিষদকে দুইটি পৃথক গণপরিষদে পরিণত করবে, ফেডারেশনের পরিবর্তে একটি কনফেডারেশনের জন্ম দিবে এবং সামরিক আইনের ক্ষমতা বিলোপ করে দেশে একটা অরাজকতার সৃষ্টি করবে। এই পরিকল্পনার মাধ্যমে তারা পৃথক ‘বাংলাদেশ’ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিল পরিণত করবে, বলাবাহুল্য, তার অর্থই হচ্ছে জাতির পিতা যে অর্থে পাকিস্তান তৈরী করেছিলেন তার সমাপ্তি টানা।”
এই সময়ে আওয়ামী লীগ কর্তৃক ২৬শে মার্চ ভোরে একটি সশস্ত্র বিদ্রোহ করার পরিকল্পনার কথা জানা গেল।
.
.
তৃতীয় অধ্যায়
.
পূর্ব পাকিস্তান সন্ত্রাস
রাজনৈতিক কথাবার্তা ও আলাপ-আলোচনার সঙ্গে সঙ্গে আওয়ামী লীগ কর্মীরা তাদের প্রস্তুতিও সমাপ্তির পথে নিয়ে যাচ্ছিল। যা তারা শাসনতান্ত্রিক পন্থায় পেতে ব্যর্থ হতে পারে, তাকে জোর করে আদায় করাই ছিল তাদের উদ্দেশ্য।
নির্বাচনে সন্ত্রাসবাদীদের কলাকৌশলের সাফল্য শেখ মুজিবুর রহমান এবং তাঁর দলের সাহস বাড়িয়ে দিলো। তারা বেসামরিক প্রশাসন ব্যবস্থাকে বানচাল, ছাত্রসমাজকে উত্তেজিত এবং পুলিশ ও সেনাবাহিনীর বাঙালীদের দলভুক্ত করার জন্য আন্দোলন শুরু করলেন। বিভিন্ন শহরে “সংগ্রাম পরিষদ” গড়ে উঠলো এবং কলেজের প্রাঙ্গণসমূহ সন্ত্রাসবাদীদের শিক্ষা শিবিরে পরিণত হলো। কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মচারী এবং সংস্থাগুলোর বিরুদ্ধে ভীতি প্রদর্শন এবং আন্দোলন শুরু করা হলো। বহু পূর্ব থেকেই অর্থাৎ ১৯৭০ সালের ১৪ই ডিসেম্বর ঢাকার আওয়ামী লীগ সমর্থক দৈনিক “দি পিপল” রাজশাহী জেলা আওয়ামী লীগের প্রেসিডেন্টের কথা উল্লেখ করে বলেছিলেন যে, তিনি প্রকাশ্যভাবেই মুক্তি ও স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পক্ষপাতী।
এইভাবে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের সব প্রস্তুতি নিয়ে শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালের ১লা মার্চ প্রেসিডেন্ট কর্তৃক জাতীয় পরিষদের বৈঠক সাময়িকভাবে স্থগিত ঘোষোণাকে ছুতা হিসেবে ব্যবহার করে আরম্ভ করলেন এক অরাজকতার আন্দোলন। এরপর অহিংস ও অসহযোগ আন্দোলনের নামে আওয়ামী লীগ শুরু করলো এক সন্ত্রাসের রাজত্ব।
১লা মার্চ, ১৯৭১
এক সাংবাদিক সম্মেলনে শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকার এক ধর্মঘট আহ্বান করলেন। তাঁর ধর্মঘট আহ্বানের পর পরই আওয়ামী লীগের চরমপন্থীরা শহরের বিভিন্ন এলাকা লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগ এবং অন্যান্য বর্বরোচিত কার্যকলাপে মেতে উঠলো। তারা নারায়নগঞ্জে রাইফেল ক্লাব আক্রমণ করে সব অস্ত্রশস্ত্র লুট করে নিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হল ও জগন্নাথ হলে সশস্ত্র দল গড়ে উঠলো- তাদের কাজ ছিল শহরে ছড়িয়ে পড়ে অস্ত্রশস্ত্র, গাড়ী এবং অর্থ সংগ্রহ করা। ১লা মার্চ তারিখের রাত্রে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের সর্বত্র হিংসাত্মক কার্যকলাপের তীব্রতা ও সংখ্যা বেড়ে গেল।
২রা মার্চ, ১৯৭১
বায়তুল মোকাররমে দুটি এবং নিউ মার্কেটে একটি অস্ত্রের দোকান লুট করা হলো। লুণ্ঠিত অস্ত্রশস্ত্র গুলো তারপর ঢাকা বিশবিদ্যালয় প্রাঙ্গণে নিয়ে যাওয়া হয়। আগেই সেখানে একটি “গুলী চালানোর অনুশীলন কেন্দ্র” খোলা হয়েছিল, সেখান থেকে সারা দিন গুলী ছোড়ার আওয়াজ শোনা যেতো। রাস্তায় জনতা পাকিস্তানবিরোধী শ্লোগান দিয়ে হাতে বন্দুক, লোহার ডাণ্ডা, এবং লাঠি নিয়ে ঘুড়ে বেড়াতো। জিন্নাহ এভিন্যুর ও বায়তুল মোকাররমের কয়েকটি দোকানপাট ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, শালিমার হোটেল এবং গুলিস্তান সিনেমা হল আক্রান্ত হলো। চালু রিক্সার উপর ইটপাটকেল ছোড়া হয়। নারায়ণগঞ্জে একটি পাটকল এবং ঢাকার ফার্মগেট এলাকায় বেসরকারী আবাসিক গৃহে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়।
৩রা মার্চ শেখ মুজিবুর রহমান আর একটি সাংবাদিক সম্মেলনে সারা প্রদেশব্যপী ধর্মঘট পালনের আহ্বান জানান। তাঁর সাংবাদিক সম্মেলন চলাকালীনই আওয়ামী লীগ সমর্থক ছাত্রদল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাকিস্তানী জাতীয় পতাকার অবমাননা করে এবং পুড়িয়ে দেয়। এ ব্যাপারে শেখ মুজিবুর রহমানের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি জবাব দেন, “আমার কোন মন্তব্য নেই।” তিনি আবার জোর দিয়ে বলেন যে ক্রেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে তিনি এক অসহযোগ আন্দোলন শুরু করবেন। তিনি আরও ঘোষণা করেছিলেন যে, ৭ই মার্চের জনসভায় তিনি তার কার্য পরিকল্পনা প্রকাশ করবেন।
ইতিমধ্যেই হিংসাত্মক কার্যকলাপ বাড়তেই থাকলো। বেসরকারী আইন রক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো শহরের ব্যাপক গোলযোগ আয়ত্তে আনতে ব্যর্থ হলো। তাদের অনুরোধেই ব্যারাকে অবস্থিত সেনাবাহিনীকে ডাকা হলো এবং রাতে কারফিউ জারী করা হয়।
৩রা মার্চ, ১৯৭১
ইসলামপুর, পাটুয়াটুলী এবং নবাবপুরসহ ঢাকার কয়েকটি এলাকায় অরাজকতা ছড়িয়ে পড়ার দরুন বিক্ষুদ্ধ জনতার হাতে ৫ জন লোক নিহত এবং ৬২ জন লোক আহত হয়। বেশকিছুসংখ্যক দোকানপাট ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং আবাসিক গৃহে আগুল ধরিয়ে দেওয়া হয়। এছাড়া কিছু শহরবাসীকে আগুনে পুড়িয়ে মারা হয়। জিন্নাহ এভিন্যুয়ের উপর একটা জেনারেল স্টোর ও একটি ঘড়ির দোকান আক্রমণ করা হয়। অস্ত্রের দোকানগুলো থেকে আরও অস্ত্রশস্ত্র লুট করা হয়। গোটা পঞ্চাশেক ঘরে আগুনও ধরিয়ে দেয়া হয়েছিল।
ইতিমধ্যে প্রদেশের অন্যান্য অংশে জনতার আক্রমণাত্মক কার্যকলাপ ছড়িয়ে পড়েছে। যশোরে লাঠিসোঁটা বর্শায় সজ্জিত হয়ে জনতা স্থানীয় টেলিফোন এক্সচেঞ্জ আক্রমণ করে। টেলিফোন এক্সচেঞ্জের রক্ষীরা জনতাকে ছত্রভঙ্গ করার জন্য গুলী ছুড়লে দুজন নিহত এবং ৯ জন আহত হয়।
সকালে ভৈরব থেকে লাকসামগামী একটা স্থানীয় ট্রেন কুমিল্লায় থামিয়ে তাতে আগুন ধরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হয়।
লাকসামের কাছে দৌলতগঞ্জ টেলিফোন এক্সচেঞ্জও হামলাকারীদের হাতে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। কুমিল্লা টেলিফোন এক্সচেঞ্জকে প্রদেশের অন্যান্য অংশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়। আখাউড়া, সিলেট, হবিগঞ্জ এবং বিয়ানীবাজার এক্সচেঞ্জগুলোকেও জোর করে বন্ধ করে দেয়া হয়।
আওয়ামী লীগের নির্দেশ মতো ঢাকার রেডিও এবিং টেলিভিশন নতুন এক বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত প্রচার করতে শুরু করে।
শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের জনগণের অধিকার আদায়ের নামে সারা প্রদেশব্যাপী এক অসহযোগ আন্দোলন চালাবার ঘোষণা করেন।
৪ঠা মার্চ, ১৯৭১
১৯৭১ সালের ৩রা মার্চ ও ৪ঠা মার্চ রাতে চট্টগ্রাম ও খুলনায় গোলযোগ ছড়িয়ে পড়ে। চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের অতর্কিত আক্রমণকারীদের দ্বারা পরিচালিত বিক্ষুদ্ধ জনতা Wireless colony এবং শহরের অন্যান্য এলাকা আক্রমণ করে যথেচ্ছা লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগ, হত্যা এবং ধর্ষণ করেছিল। ফিরোজশাহ কলোনীতে ৭০০ ঘরে আগুন ধরিয়ে দিয়ে সেখানকার অধিবাসী পুরুষ, মেয়ে ও শিশুদের পুড়িয়ে মারা হয়। যারা পালিয়ে যাবার চেষ্টা করেছিলো তাদের হত্যা কিংবা গুরুতররূপে আহত করা হয়। ৩রা ও ৪ঠা মার্চে যারা জীবন্ত দগ্ধ হয়েছিল এবং যাদের ভস্মীভূত দেহ পরে পাওয়া যায়, তারা ছাড়াও ৩শ’র বেশি লোক হত্যা ও আহত হয়।
যশোর খুলনা হতে আগত একটি ট্রেনকে লাইনচ্যুত করে যাত্রীদের টেনে বের করে হত্যা করা হয়েছিল। যশোরে ডেপুটি কমিশনারের অসিফে জনতা পাকিস্তানের পতাকা অবমাননা করে এবং পুড়িয়ে দেয় এবং একটা হাতবোমা নিক্ষেপ করে।
খুলনায় টেলিফোন এক্সচেঞ্জ আক্রমণ করে কিছুসংখ্যক কর্মচারীদের নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।
ঢাকার ধানমন্ডি ও নবাবপুর রোড থেকে বেশকিছু লুটতরাজের খবর পাওয়া যায়। একটা অস্ত্রের দোকান আক্রমণ করে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে যাওয়া হয়।
৫ই মার্চ, ১৯৭১
চট্টগ্রাম থেকে হত্যা এবং বাড়িঘর পুড়িয়ে দেবার খবর পাওয়া যায়। খুলনায় খালিশপুর ও দৌলতপুর এলাকায় ৭জন লোককে হাতবোমা, দা এবং বর্শা দিয়ে হত্যা করা হয়। তাদের মৃতদেহ খণ্ড-বিখণ্ডিত অবস্থায় পাওয়া যায়। খুলনা শহরে লাটি ও বন্দুক নিয়ে জনতা একটি হোটেলে আগুন ধরিয়ে দেয়।
প্রদেশের অভ্যন্তরের অন্যান্য এলাকা থেকে প্রাপ্ত খবরে জানা যায় যে, ব্যাপক গোলযোগ ছড়িয়ে পড়েছে ও সারা প্রদেশের বেসামরিক প্রশাসন ব্যবস্থা পঙ্গু হয়ে পড়েছে।
পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে টেলিযোগাযোগ বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো, টেলিফোন ও টেলিগ্রাম বিভাগের কর্মচারীরা বার্তা গ্রহণ ও প্রেরণ বন্ধ করে পূর্ব পাকিস্তানকে বহির্জগত থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে।
৬ই মার্চ, ১৯৭১
১৯৭১ সালের ৫ ও ৬ই মার্চের রাতে সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের ছাত্ররা বৃটিশ কাউন্সিল ভবনে ঢুকে কেরোসিন তেল ঢেলে আগুন জ্বালিয়ে দেবার চেষ্টা করে। কিন্তু সময় মতো সেনাবাহিনী পোঁছায় এবং গুলী ছুড়ে অবস্থা আয়ত্তে আনে।
ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগার ভেঙ্গে ৩৪১ জন কয়েদী পালিয়ে যায়। পুলিশ গুলী ছোড়ার ফলে ৭ জন কয়েদী নিহত হয়। ১ জন পুলিশ সার্জেন্ট এবং ৬ জন ওয়ার্ডার আহত হয়। পরে পলায়নকারী কয়েদীরা আওয়ামী লীগ উগ্রপন্থী এবং ছাত্রদলের সহযোগিতায় মারাত্মক শ্লোগান দিতে দিতে ঢাকার রাস্তাগুলো প্রদক্ষিণ করে।
আওয়ামী লীগ এবং পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের কর্মীরা এসিড এবং অন্যান্য রাসায়নিক পদার্থ সংগ্রহ করার জন্য বিজ্ঞান গবেষণাগারগুলো লুট করা শুরু করে। ঢাকায় সরকারী বিজ্ঞান গবেষণাগার থেকে সব বিস্ফোরক রাসায়নিক লুট করে নেয়া হয়।
এই একই উদ্দেশ্যে পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটও আক্রমণ করা হয়। যখন গুলী ছোড়া হয়, তখন গুণ্ডারা পালিয়ে যায়। কুমিল্লা ও যশোরসহ পূর্ব পাকিস্তানের সব প্রধান প্রধান শহর থেকে বোমা বিস্ফোরণের খবর পাওয়া যায়। ফরিদপুরের ‘রাজেন্দ্র কালেজ ট্রেনিং কোর’-এ ১০টা রাইফেল এবং ১৫ টি বেয়নেট চুরি হয়।
চট্টগ্রামে লুটত্রাজ, অগ্নিসংযোগ চলতেই থাকে। দুটো দালান এবং কিছুসংখ্যক কুঁড়েঘর পোড়ানো হয়। আড়াল থেকে অতর্কিতভাবে গুলী ছোড়ার ঘটনাও বেশ কয়েক জায়গায় ঘটে।
রাজশাহীতে সদর ম্যাজিস্ট্রেটের অফিসে আগুন লাগানো হয়। খুলনায় জাতি এবং রাষ্ট্রবিরোধী শ্লোগান দিতে দিতে বিক্ষুদ্ধ মিছিলসমূহ অস্ত্রের দোকানগুলো লুট করার চেষ্টা করে। দোকানের মালিক গুলী ছোড়ার ফলে ১ জন নিয়ত ও ৭ জন আহত হয়।
৭ই মার্চ, ১৯৭১
শেখ মুজিবুর রহমান একটি প্রতিদ্বন্দী সরকার চালাবার কথা ঘোষণা করেন এবং আনুষ্ঠানিকভাবে কয়েকটি নির্দেশ জারী করেন। অহিংস এবং অসহযোগ আন্দোলন চালিয়ে যাবার জন্য তিনি সপ্তাহব্যাপী এক কার্যসূচী প্রকাশ করেন। (যেটা ২রা মার্চ শুরু হয়েছিল।) কার্যসূচীর অন্তর্ভূক্ত ছিলো (১) কর না দেওয়া আন্দোলন (২) সারা “বাংলাদেশের” শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহ, সরকারী ও আধা সরকারী অফিসগুলো, হাইকোর্ট এবং অন্যান্য কোর্ট বন্ধ করে দেওয়া হবে। রেডিও, টেলিভিশন এবং সংবাদপত্রসমূহকে আওয়ামী লীগের কর্মপন্থা অনুযায়ী নির্দেশ দেওয়া হলো এবং এও জানানো হলো যে, এ নির্দেশ অমান্য করলে মনে করা হবে যে এই সকল প্রতিষ্ঠানসমূহে কর্মরত বাঙালীরা সহযোগিতা করছে না। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে টেলিযোগাযোগ বন্ধ করা হলো। এক নির্দেশে বলা হলো “স্টেট ব্যাংক বা অন্য কোন কিছুর মাধ্যমে ব্যাংক পশ্চিম পাকিস্তানে টাকা-পয়সা পাঠাতে পারবে না।“ আর এক নির্দেশে বিশেষ করে উল্লেখ করা হলো যে প্রত্যাক ইউনিয়ন, মহল্লা, থানা, মহকুমা এবং জেলায় স্থানীয় আওয়ামী লীগ ইউনিটের নেতৃত্বে একটা করে সংগ্রাম পরিষদ সংগঠন করা হবে।
ঢাকায় রেডিও পাকিস্তান ভবনের মধ্যে বোমা নিক্ষেপ করা হয়।
শহরের বিভিন্ন এলাকা থেকে খবর পাওয়া যায় যে আওয়ামী লীগ ছাত্রদলরা জোর করে জীপ, পিকআপ এবং মাইক্রোবাস নিয়ে যাচ্ছে।
যশোর জেলায় বারগানায় পাকিস্তান জাতীয় পতাকা পুড়িয়ে ফেলা হয়।
৮ই মার্চ, ১৯৭১
ঢাকায় যাদের লাইসেন্স রয়েছে তাদের কাছ থেকে জোর-জবরদস্তি করে আওয়ামী লীগ স্বেচ্ছাসেবীরা অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাগুলী সংগ্রহ করতে লাগলো। পূর্ব পাকিস্তানের অন্যান্য শহর থেকেও অনুরূপ ঘটনার খবর পাওয়া যায়।
আওয়ামী লীগ সারা প্রদেশ জুড়ে মিটিং এবং উন্মুক্ত মিছিলের ব্যবস্থা করলো। জাতীয়বাদ এবং পাকিস্তানবিরোধী শ্লোগান ছিলো তাদের মুখে।
পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের জেনারেল সেক্রেটারী জনাব তাজুদ্দীন আহমেদ শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশের কতকগুলি ব্যতিক্রম ব্যাখ্যা ও ঘোষণা করলেন। এর মধ্যে ছিল “স্টেট ব্যাংক বা অন্য কোনভাবে বাংলাদেশের বাইরে টাকা পাঠানো যাবে না।“
৯ই মার্চ, ১৯৭১
বাংলাদেশের বাইরে যাতে ধনসম্পদ না যায়, সে জন্য আওয়ামী লীগ স্বেচ্ছাসেবীরা এবং ছাত্রদল ঢাকার বিভিন্ন অংশে তল্লাশী ফাঁড়ি বসালো। তল্লাশী করার অজুহাতে এসব স্বেচ্ছাসেবীরা যাদের তল্লাশী করলো তাদের কাছ থেকে টাকা পয়সা এবং অন্যান্য জিনিসপত্র বাংলাদেশের নামে হস্তগত করলো।
রংপুরের লালমনিরহাটে এক উন্মুক্ত জনতা একটি ট্রেন থামিয়ে তার অনেক ক্ষতি করে। জাতিগত এবং রাজনৈতিক কারণে ট্রেনের কিছু যাত্রীদের হয়রানি এবং মারপিট করে। শহরের বিভিন্ন এলাকায় অধিবাসীদের আওয়ামী লীগ কর্মীরা আক্রমণও করেছিলো।
রাজশাহীতে নিটি টাউন হলে একটি ‘স্বাধীনতা পতাকা’ উত্তোলন করা হয়।
লন্ডন ‘ডেলী টেলিগ্রাফ’ পত্রিকার সাংবাদিক কেলিথ ক্লার্ক-এর পাঠানো একটি বিবরণ ১৯৭১ সালের ৯ই মার্চ উক্ত পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। তিনি বলেন, ‘খবরে প্রকাশ যে রোববার ৭ই মার্চ রাতে যখন শেখ মুজিবুর রহমান প্রদেশকে বিচ্ছিন্নতাবাদের শেষ প্রান্তে এনে ফেলেছিলেন তখন ঢাকা সম্পূর্বভাবে অরাজকতার কবলে গিয়ে পড়েছিলো।’ উক্ত পত্রিকায় আরও বলা হয়, ‘আওয়ামী লীগ নেতা শেখ তাঁর আন্দোলনকে ‘স্বাধীনতা আন্দোলন’ বলে নাম দিয়েছিল। তিনি জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে সহযোগিতা করার জন্য এমন সব শর্ত আরোপ করেন, যা প্রেসিডেন্ট খানের পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব ছিলো না।’ এ পত্রিকায় শেখ মুজিবুর রহমানের আর একটি নির্দেশেরও ব্যাখ্যা উল্লেখ ছিলো। নির্দেশটি ছিলো- “গ্রামে গ্রামে আওয়ামী লীগ নেতাদের নেতৃত্বে মুক্তি কমিটি গঠন করা”
১০ই মার্চ, ১৯৭১
আওয়ামী লীগ ঘোষণা করলো যে “ব্যাংকের লকারগুলোর কাজ বন্ধ থাকবে” এবং শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশের বাইরে বন্দর কর্তৃপক্ষ কোন সহযোগিতা করবেন না। কুমিল্লার চা বাগানে গোলযোগ ও সন্ত্রাসের খবর পাওয়া গেলো।
১২ই মার্চ, ১৯৭১
১১ই-১২ই মার্চ রাতে বরিশালের জেল ভেঙ্গে কিছু কয়েদী পালিয়ে যায়। বগুড়ার জেল ভেঙ্গে ৭ জন কয়েদী পালিয়ে যাবার খবরও পাওয়া যায়। কুমিল্লায় ৩০০ কয়েদী পালিয়ে যাবার চেষ্টা করে। পুলিশ গুলী চালায়। পুলিশের গুলিতে ২ জন কয়েদী নিহত ও ১৮ জন কয়েদী আহত হয়।
‘মুক্তি ফ্রন্ট’ এবং আধা সামারিক সংস্থাগুলি প্রদেশে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। ‘মুক্তি ফ্রন্ট’ এর পক্ষ থেকে ‘সাইক্লোস্টাইলড’ এবং হাতে লেখা প্রচারপত্র গোপনে গোপনে বিলি করা হলো। এ সবেরই উদ্দেশ্য ছিল জাতিগত বিদ্বেষ সৃষ্টি এবং হিংসাত্মক কার্যকলাপ উস্কানিদান।
৫টি সামরিক ট্রাকের একটি দল রেশন নেবার জন্য কুমিল্লা থেকে সিলেট যাওয়ার পথে, ব্রাক্ষণবাড়িয়ার সশস্ত্র জনতা কর্তৃক আক্রান্ত হয়।
১৩ই মার্চ, ১৯৭১
ঢাকার রেল স্টেশনে আওয়ামী লীগ স্বেচ্ছাসেবীরা যাত্রীদের ঘেরাও করে পশ্চিম ‘পাকিস্তানের’ দালাল বলে অভিযুক্ত করে জেরা করতো। কাকরাইলের কাছে এক সরকারী অফিসে দুই বোতল এসিড নিক্ষেপ করা হয়। ফলে সে অফিসে আগুন ধরে যায়।
যশোর ডেপুটি কমিশনারের অফিসে পাকিস্তান জাতীয় পতাকার জায়গায় বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়।
কুমিল্লায় আওয়ামী লীগ নেতারা দুজন কয়েদীর মুক্তির জন্য জেল ভাঙ্গার হুমকি দেয়। উল্লেখিত কয়েদী দুজনকে জাতীয় পতাকা পুড়িয়ে ফেলার জন্য শমসের নগরে গ্রেফতার করা হয়।
১৪ই মার্চ, ১৯৭১
শেখ মুজিবুর রহমান পূর্বের সব নির্দেশগুলো বাতিল করে দেন এবং ১৯৭১ সালের ১৫ই মার্চ থেকে নতুন নির্দেশ সম্বলিত এক কার্যক্রম ঘোষণা করেন। এর একটি নির্দেশে বলা হয় যে, ডেপুটি কমিশনার এবং মহকুমা হাকিমগণ তাদের নিজ নিজ কর্তব্য ও দায়িত্ব পালনে স্ব স্ব পর্যায়ে আওয়ামী লীগ সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রাখবেন এবং সহযোগিতা করে কাজ করবেন।
আর একটি নির্দেশে বলা হয় যে, “কাস্টম বিভাগ তাঁর দায়িত্ব পালন করে যাবে এবং যে পরিমাণ কর ধার্য করা হয়েছে তা পুরো জমা দেয়া হলে মাল বের করতে অনুমতি দেবে। এই উদ্দেশ্য ইস্টার্ন ব্যাংকিং কর্পোরেশন লিমিটেড এবং ইস্টার্ন মার্কেন্টাইল ব্যাংক লিমিটেড (বেসরকারী ব্যাংক) এ কাস্টমস কালেক্টর দ্বারা পরিচালিত বিশেষ একাউন্ট খুলতে হবে। কাস্টমস কালেক্টরগণ আওয়ামী লীগের মাঝে মাঝে প্রকাশিত নির্দেশ অনুযায়ী এই একাউন্টগুলো পরিচালনা করবেন। এইভাবে যে কর আদায় হবে সেগুলো কেন্দ্রীয় সরকারের একাউন্টে জমা করা হবে না।
১৫ই মার্চ, ১৯৭১
এক যুক্ত বিবৃতিতে ‘স্বাধীন বাংলাদেশ’ কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ৪ জন স্বীকার করেন যা, “গাড়ী নিয়ে কিছু দুষ্কৃতিকারীরা বিভিন্ন বাড়িঘর এখনও লুটপাট করছে এবং সংগ্রাম পরিষদের নামে জোরজবরদস্তি করে টাকা আদায় করছে।” কিছু সংখ্যক এলাকা থেকে খবর আসছিলো যে, ঢাকার বিভিন্ন আওয়ামী লীগ তল্লাশী ফাঁড়ী জাতিগত এবং রাজনৈতিক কারণে যে তল্লাশী চালাচ্ছে তাতে জনসাধারণ বর্বরোচিত ব্যবহারের শিকারে পরিণত হয়েছে।
কুমিল্লার এক সশস্ত্র জনতা ফেনীর একটি আর্মি ফিল্ড ইউনিট ঘেরাও করে আক্রমণ চালায়।
১৯৭১ সালের ১৫ই মার্চ লন্ডন-এর বিবিসির খবরে বলা হয়ঃ আজ কাজে যোগ দেবার জন্য যে সামরিক হুকুম জারী হয়েছে, তা অমান্য করার জন্য বেসামরিক প্রতিরক্ষা কর্মীদের অনুরোধ জানিয়ে শেখ মুজিবুর রহমান একটি বিবৃতি দেন। শেখ মুজিবুর রহমানের আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানের জন্য বৃহত্তর স্বায়ত্তশাসন চান। এই নির্দেশগুলোর অন্তর্ভূক্ত একটি আদেশ হচ্ছে যে, কর কেন্দ্রীয় সরকারকে না দিয়ে তাঁর সরকারকেই দিতে হবে।
১৬ই মার্চ, ১৯৭১
রাজশাহীতে নাটোরের মহারাজ হাইস্কুল থেকে রাসায়নিক দ্রব্য এবং এসিড চুরি হয়।
চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগ স্বেচ্ছাসেবকরা একটি অস্ত্রশস্ত্রের দোকান লুট করে।
১৯৭১ সালের ১৬ই মার্চ লন্ডনের গার্ডিয়ান পত্রিকায় সংবাদদাতা মার্টীন এডেনির পাঠানো এক রিপোর্টে আওয়ামী লীগের একটি সংগ্রাম কমিটির বৈঠকের বর্ণনা দেয়া হয়, সারা প্রদেশে গঠিত এ ধরনণের অন্যান্য কমিটির মতো এই কমিটিরও আলোচনার বিষয় ছিলঃ তাদের বিবেচনায় ইতিমধ্যেই স্বাধীন হয়ে যাওয়া পূর্ববঙ্গে অর্থাৎ ‘বাংলাদেশে’ তাদের পরবর্তী পদক্ষেপ কি হবে। ৫৮টি গ্রাম থেকে প্রায় শ তিনেক লোক এই সংগ্রাম কমিটিতে একত্রিত হয়েছে। তারা প্রয়োজনবোধে সেনাবাহিনীর মোকাবেলা করতে প্রস্তুত এবং এ জন্য তারা এমন একজন গ্রামবাসীর কাছে ট্রেনিং নিচ্ছে, যুদ্ধবিদ্যা যার একমাত্র অধিকার, যে রাজকীয় ভারতীয় সেনাবাহিনী সার্ভিস কোরে একজন ল্যান্স কর্পোরাল ছিল।
হিন্দুস্তানের দৈনিক পত্রিকা স্টেটম্যান (১৯৭১ সালের ১৬ই মার্চ সংখ্যা) আওয়ামী লীগের ১৪ই মার্চ তারিখে জারী করা নির্দেশসমূহের খবর দিয়ে বলেন, “মিস্টার মুজিবুর রহমান, এসব নির্দেশ জারী করে বলেছেন যে, তিনি ‘বাংলাদেশ’-এর নিয়ন্ত্রণভার গ্রহণ করেছেন।” পত্রিকা আরো জানায়, “শেখ মুজিবুর রহমান বলেছেন, প্রেসিডেন্ট আমাদের অতিথি হবেন। ঢাকায় পর্যবেক্ষকরা এর এই অর্থ নিয়েছেন যে, পূর্ব পাকিস্তান নিজেকে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে স্বতন্ত্র একটি এলাকা বলে মনে করে।”
১৭ই মার্চ, ১৯৭১
১৬ ও ১৭ই মার্চের মধ্যবর্তী রাতে ঢাকার আজিমপুরায় একটি সরকারী অফিসের উপর দুইটি এসিড বোতল নিক্ষেপ করা হয়।
ঢাকায় মতিঝিল কেন্দ্রীয় সরকারী হাইস্কুলের উপর হামলা চালানো হয় এবং এসিড ও রাসায়নিক দ্রব্য লুট করে নিয়ে যাওয়া হয়।
১৮ই মার্চ, ১৯৭১
যশোরে সেনাবাহিনীর একটি শিবিরে দুজন সামরিক করমচারীর উপর এসিডের বোতল নিক্ষেপ করা হয়।
১৯ই মার্চ, ১৯৭১
ঢাকায় একটি লেভেল ক্রসিংয়ের উপর ময়মনসিংহ থেকে প্রত্যাবর্তনকারী একটি সামরিক যানের উপর এক জনতা অতর্কিত আক্রমণ চালায়। আক্রমণকারীরা অস্ত্রশস্ত্রসহ ৬ জন লোককে নিয়ে পালিয়ে যায়।
যশোরে বিজলী কেন্দ্রের ক্ষতিসাধন করে বিজলী সরবরাহ ব্যাহত করে দেয়া হয়। যশোর-খুলনা সড়কের বিভিন্ন স্থানে প্রতিবন্ধকতা আরোপ করা হয়। খুলনায় ৫ই মার্চের হত্যাকাণ্ড থেকে বেঁচে যাওয়া প্রায় ৩শ লোকের উপর নতুন করে হামলা চালানোর হুমকি দেয়া হয়।
রংপুরে ছাত্ররা কালিগঞ্জ থানার লালিবাড়ী গ্রামে ১২টি বাড়ী পুড়িয়ে দেয়। ঢাকা থেকে ২২ মাইল দূরে জয়দেবপুর বাজারে লেভেল করসিংয়ের উপর একটি ট্রেন রেখে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করা হলে জনতা এবং সেনাবাহিনীর লোকদের মধ্যে গোলাগুলি বিনিময় হয়। এরপর সেখানে সন্ধ্যা আইন জারী করা হয়। সৈন্যরা ট্রেনটি একদিকে সরিয়ে দিয়ে তাদের যাওয়ার পথ করার চেষ্টা করলে জনতা তাদের উপর গুলি চালায়। এতে তিনজন সৈন্য মারাত্মকভাবে জখম হয়। সৈন্যরা পাল্টা গুলি চালালে দুজন লোক নিহত এবং অন্য ৫ জন আহত হয়। ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়কে আরো আধাডজন প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করা হয়।
২০ ও ২১শে মার্চ, ১৯৭১
যশোরে, হিন্দুস্তান থেকে সাতক্ষীরা হয়ে বিপুল পরিমাণ হিন্দুস্তানী অস্ত্রশস্ত্র চোরাপথে সীমান্তের এপারে আসে বলে খবর পাওয়া যায়। চোরা পথে আনীত অস্ত্রশস্ত্র চট্টগ্রাম থেকে কুমিল্লা পাঠানো হয় বলেও খবর পাওয়া যায়।
হংকং-এর দি ফার ইস্টার্ন রিভিউ ২০শে মার্চ (১৯৭১ সাল) সংখ্যায় লিখেছেন, ‘প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান যখন পাশ্চিম পাকিস্তানে তাঁর পরবর্তী উদ্বেগের কথা ভাবছিলেন, তখন শেখ মুজিবুর রহমান তার ঢাকার বাড়ীতে আমাদের প্রতিনিধিকে বলেন, ‘এটাই শেষ দফা।‘ শেখ মুজিবুরের বাসভবন বাংলাদেশের পতাকা এবং বিভিন্ন প্রতীক দিয়ে সুসজ্জিত ছিল। এ কথার অর্থ কি তা জিজ্ঞাসা করায় তিনি সেই শ্লোগানটি দিয়ে তার জবাব দিলেন, যা তিনি হাজার বার জনতার সামনে উচ্চারণ করেছেন- “জয় স্বাধীন বাংলা, স্বাধীন বাংলা দীর্ঘজীবী হোক।”
২২শে মার্চ, ১৯৭১
দিনাজপুর আওয়ামী লীগের কর্মীরা প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার একটি কুশপুত্তলিকাসহ এক উন্মুক্ত মিছিল বের করে। কুশপুত্তলিকাটির বুকে তীর বসানো ছিল। সিলেটের কয়েকটি চা বাগানে অস্ত্রশস্ত্র এনে রাখা হয়েছে বলে খবর পাওয়া যায়।
২৩শে মার্চ, ১৯৭১
‘পাকিস্তান দিবসের’ নাম পরিবর্তন করে ‘প্রতিরোধ দিবস’ করা হয়। ঢাকা এবং পূর্ব পাকিস্তানের অন্যান্য শহরে বিভিন্ন সরকারী ভবনের চূড়ায় পাকিস্তানের জাতীয় পতাকার পরিবর্তে ‘বাংলাদেশের’ নয়া পতাকা উড়তে দেখা যায়। মুক্তিফ্রন্টের আধা সামরিক বাহিনী এবং অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মচারীদের মার্চ পাস্ট এবং কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠিত হয়। মিরপুর এবং অন্যান্য কয়েকটি এলাকার অধিবাসীরা নয়া বাংলাদেশ পতাকা উড়াতে অস্বীকার করে। পাকিস্তানী পতাকা উত্তোলনের চেষ্টা করলে এসব জায়গায় তাদের উপর হামলা চালানো হয়।
শেখ মুজিবুর রহমান তার বাসভবনে সশস্ত্র মার্চ পাস্টের সালাম গ্রহণ করেন। এখানেও আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়।
বিভিন্ন ছত্রদল পশ্চিম পাকিস্তানী ব্যবসায়ীদের অপহরণ করে এবং মুক্তিপণ দাবী করে। সশস্ত্র জনতা ঢাকা বিমানবন্দরের কাছে বহির্গামী যাত্রীদের উপর ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে এবং তাদেরকে হয়রানী করে।
২৪শে মার্চ, ১৯৭১
যুদ্ধংদেহী ছত্র এবং শ্রমিকরা জনগণকে হিংসাত্মক কাজের উস্কানী দিয়ে প্রদেশের বিভিন্ন জায়গায় হাতে লেখা এবং সাইক্লোস্টাইল করা প্রচারপত্র বিলি করা শুরু করে। পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলনের জেলা কমিটি ঐ ধরণের একটি প্রচারপত্র বিলি করে, যাতে লেখা ছিলঃ
“পূর্ব বাংলার জাতীয় মুক্তি আন্দোলন এগিয়ে চলছে। এই দাবানলকে দিকে দিকে ছড়িয়ে দিন। দেশপ্রেমিক বিপ্লবী জনগণ, হাতিয়ার তুলে নিন। শত্রুসৈন্যকে বাধা দিন এবং তাদেরকে নির্মূল করুন। সশস্ত্র প্রতিরোধের মাধ্যমে মুক্ত এলাকাগুলো রক্ষা করুন।”
“দেশবাসী বন্ধুগণ! হাতের কাছে যে অস্ত্র পান তাই হাতে তুল নিন এবং শত্রুদের অগ্রগতি বন্ধ করুন। যে সব জায়গা শত্রুদের নিয়ন্ত্রণে নেই, সেসব জায়গায় সড়ক, সেতু রেলযোগাযোগ প্রভৃতি বিচ্ছিন্ন করে দিন। ঘরে ঘরে হাত বোমা ও মলোটোভ বোমা (Molotov Cocktail) প্রস্তুত রাখুন। যদি আমাদেরকে আত্মসমর্পণ করতে হয় কিংবা আমরা শত্রুকর্তৃক আক্রান্ত হয়ে পড়ি তাহলে আমাদেরকে রক্তক্ষয়ী প্রতিরোধ সংগ্রাম শুরু করতে হবে।”
“মনে রাখবেন, পূর্ব বাংলার জাতীয় মুক্তি কেবল সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমেই অর্জিত হতে পারে, যার জন্য দীর্ঘ সময়ও প্রয়োজন হতে পারে। কাজেই গেরিলা যুদ্ধ কৌশল ছাড়া আমরা শত্রুদের প্রতিহত করতে সক্ষম হবো না। যে কোনো মূল্যে মুক্ত এলাকাগুলো রক্ষা করার জন্য প্রস্তুত থাকুন।”
“পূর্ব বাংলার দীর্ঘ সংগ্রাম শেষ পর্যায়ে উপনীত হয়নি, বরং এটাই কেবল শুরু। আমাদেরকে দুর্বল করার জন্য শত্রুরা অর্থনৈতিক অবরোধ সৃষ্টি করতে পারে। পূর্ব বাংলার জন্য অবশ্যম্ভাবী। আমরা পাকিস্তানী উপনিবেশের জিঞ্জির ছিঁড়ে ফেলবো। স্বাধীন পূর্ব বাংলা জিন্দাবাদ।”
রংপুরে উত্তর সৈয়দপুরের গোলাহাট থেকে অগ্নিসংযোগের খবর পাওয়া যায়। লাঠি, সড়কি অন্যান্য অস্ত্রশস্ত্র সজ্জিত ৮ হাজার লোকের এক উন্মুক্ত জনতা সৈয়দপুর অভিমুখে যাত্রা করে সেখানকার অধিবাসীদের উপর আক্রমণ করার জন্য ৫০টি বাড়ীতে আগুন লাগিয়ে দেয়।
২৫শে মার্চ, ১৯৭১
ঢাকার ইঞ্জিয়ারিং কলেজ, ইকবাল হল ও জগন্নাথ হলে ব্যাপকভাবে এসিড বোমা তৈরীর খবর পাওয়া যায়। ঢাকা শহরের সর্বত্র ব্যারিকেড এবং বিভিন্ন রাস্তায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয়।
লন্ডনের টাইমস পত্রিকার ২৫শে মার্চ ১৯৭১ সংখ্যায় প্রকাশিত পাল মার্টিন-এর পাঠানো এক বার্তায় বলা হয়, ঢাকা বিশ্বাবিদ্যালয় মাঠে বিভিন্ন বিপ্লবীবাদী দল ছাত্রদেরকে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারের ট্রেনিং দেয়া শুরু করেছে। পূর্ব পাকিস্তানের বহু গ্রামে একটি গণবাহিনীর সূচনা হিসেবে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠন করা হয়েছে। এই গণবাহিনীর ভবিষ্যৎ কাজ হবে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মোকাবেলা করা। ইতিমধ্যেই গত কয়েক সপ্তাহে বিভিন্ন ল্যাবরেটরী থেকে চুরি করা রাসায়নিক দ্রব্য থেকে তৈরী করা পেট্রোল বোমা ও অন্যান্য হাতে তৈরী বোমা পূর্বাঞ্চলীয় রাজধানী ঢাকায় প্রথমবারের মতো দেখতে পাওয়া যাচ্ছে।
সৈয়দপুরে আশেপাশের বিভিন্ন গ্রাম থেকে রাইফেল, গাদাবন্দুক, দা, ছোরা প্রভৃতি অস্ত্রে সজ্জিত জনতার চারটি দল সৈয়দপুর অভিমুখে যাত্রা করে এবং স্থানীয় এলাকা কোলাহাটের উপর আক্রমণ চালায়। এতে তিনজন লোক নিহত ও ১৭ (সতের) জন আহত হয়। আহতদের মধ্যে দুজন বুলেট আঘাতপ্রাপ্ত এবং অন্য ৭ জন বন্দুকের গুলিতে আঘত পায়। বাকী কয়জন আহত হয় লাঠিসোঁটার আঘাতে। ৫০টি বাড়ীও জ্বালিয়ে দেয়া হয়। সৈন্যবাহিনী গুলি ছুড়তে বাধ্য হয়। ফলে তিনজন লোক জখম হয়। পরে আরেক উন্মুক্ত জনতা সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্টের উপর আক্রমণ চালায়। তারা সৈন্যদেরকে লক্ষ্য করে বন্দুকের গুলি ছোড়ে। সৈন্যরা পাল্টা গুলি চালালে ৫ জন লোক আহত হয়।
অপরদিকে আরেক জনতা সৈয়দপুর-দিনাজপুর সড়কে ডাক বিভাগের একটি গাড়ীর উপর হামলা চালায় তারা ড্রাইভার এবং কন্ডাক্টরকে গাড়ী থেকে টেনে নামায়। কন্ডাক্টরকে ঘটনাস্থলেই পিটিয়ে হত্যা করা হয়, আর ড্রাইভারটি মারাত্মকভাবে আহত হয়।
চট্টগ্রামে ক্যান্টনমেন্টের সামরিক বাহিনীর লোকদের যাতায়াত এবং অস্ত্রশস্ত্র আনা-নেয়া করার জন্য চট্টগ্রাম বন্দর থেকে আগ্রাবাদগামী রাস্তায় অসংখ্য ব্যারিকেড সৃষ্টি করা হয়। প্রধান সড়কে কয়েকটি ট্রেঞ্চ খনন করা হয় এবং যানবাহন চলাচলে বিঘ্ন সৃষ্টির জন্য রাস্তার উপর ট্রক ও লরি, পিচের ড্রাম, ডাস্টবিন ও ইটপাটকেল ফেলে রাখা হয়।
আওয়ামী লীগের ব্যাপক সশস্ত্র প্রস্তুতি আরেক ধাপ এগিয়ে যায়। শেখ মুজিবুর রহমান সাবেক কর্নেল ওসমানীকে ‘বিপ্লবী বাহিনীর অধিনায়ক’ নিযুক্ত করেন এবং তিনি সরাসরিভাবে শেখ মুজিবের কর্তৃত্বাধীনে থাকবেন। শেখ মুজিবুর রহমান প্রাক্তন সামরিক কর্মচারীদেরকে নিজ পক্ষে তালিকাভূক্ত করার জন্য অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল মজিদ এবং অবসরপ্রাপ্ত লেফটেনেন্ট কমান্ডার ময়াজ্জেমকে নিয়োগ করেন। তালিকা সুষ্ঠুভাবে প্রণয়ন করা হয় এবং তা আওয়ামী লীগের সদর দফতরে রাখা হয়। অন্যদিকে তাদের হাতে অস্ত্র দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। আর এ জন্য ঢাকা, নারায়নগঞ্জ, খুলনা এবং যশোরের অস্ত্র দোকানগুলী লুট করা হয় এবং তা বিদ্রোহীদের ব্যবহারের জন্য সব বড় বড় শহরের মওজুত করা হয়। একমাত্র ঢাকা পুলিশ স্টেশনেই গুলিভর্তি ১৫ হাজার রাইফেল জমা করা হয়।
বিভিন্ন ইপিআর এবং ইবিআর বহিঃফাঁড়ীর মধ্যে অয়্যারলেস ট্রন্সমিটারের সাহায্যে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করা হয় এবং এক নিউনিট থেকে দ্রুত অন্য ইউনিটে নির্দেশ পাঠানো হয়। বৃহত্তম পরিচালনা সদর দফতর ছিলো চট্টগ্রামে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট সেন্টার।
পরিচালনা কার্যক্রম অত্যন্ত সুষ্ঠভাবে তৈরী করা হয় এবং এমন ব্যবস্থা রাখা হয় যে, ঢাকার আওয়ামী লীগ সদর দফতর থেকে নির্দেশ পাওয়া মাত্রই সশস্ত্র বিদ্রোহ শুরু হয়ে যাবে। যেসব ব্যবস্থা নেয়া হয় সেগুলো হচ্ছেঃ
(ক) আকাশ কিংবা সমুদ্রপথে পাকিস্তানী সৈন্যের আগমন রোধ করার জন্য ইবিআর বাহিনী ঢাকা এবং চট্টগ্রাম দখল করবে।
(খ) ইপিআর, পুলিশ এবং সশস্ত্র রাজাকারদের সাহায্যে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অবশিষ্ট সৈন্যরা বিভিন্ন ক্যান্টনমেন্ট এবং ফাঁড়ীতে সশস্ত্র সৈন্যদের নির্মূল করবে।
(গ) ইপিআর সীমান্তের সব গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটিগুলো দখল করবে এবং তা বহির্সাহায্যের জন্য খোলা থাকবে।
(ঘ) অবশিষ্ট অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ সংগ্রহ করা হবে হিন্দুস্তান থেকে।
(ঙ) আওয়ামী লীগ বিদ্রোহী বাহিনী গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রগুলো দখল এবং পাকিস্তানী সেনাবাহিনীকে পর্যদুস্ত করার প্রথম পর্যায়ে সাফল্য লাভ করা মাত্রই হিন্দুস্তানী সৈন্যরা তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসবে।
শুক্রবার দিন খুব ভোরে এই বিদ্রোহ শুরু হবে বলে সময় ধার্য করা হয়। ২৫শে মার্চ দিনগত রাতে আওয়ামী লীগের পরিকল্পনা অনুযায়ী সশস্ত্র বিদ্রোহ সংগঠন এবং স্বাধীন বাংলাদেশ প্রজাতন্ত্রের অভ্যুত্থান বাস্তবায়িত করার মাত্র কয়েক ঘন্টা আগে প্রেসিডেন্ট পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীকে তাদের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ার এবং সরকারের কর্তৃত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার আহ্বান জানান। সেনাবাহিনী তৎপর হয়ে ওঠে এবং তারা হিন্দুস্তানের সশস্ত্র অনুপ্রবেশকারী এবং ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস, ইস্ট পাকিস্তান পুলিশ ও আধা সামরিক বাহিনীর বিদ্রোহী লোকদের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের পূর্ব পাকিস্তান দখলের সশস্ত্র পরিকল্পনা বানচাল করে দেয়। পরবর্তী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে বিদ্রোহীদের দমন এবং হিন্দুস্তানী অনুপ্রবেশকারীদেরকে তাড়িয়ে দেয়ার জন্য হিন্দুস্তান সংলগ্ন সীমান্ত বরাবর পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে মোতায়েন করা হয়। এই সময় যেসব এলাকা সাময়িকভাবে বিদ্রোহী এবং হিন্দুস্তানী অনুপ্রবেশকারীদের নিয়ন্ত্রণে আসে সেসব জায়গায় আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসের রাজত্ব যা পহেলা মার্চ থেকে শুরু হয়েছিল তা অব্যাহতভাবে চলতে থাকে। এর ফলে এক লাখেরও বেশী পুরুষ, মহিলা ও শিশুর জীবননাশ হয়। তা ছাড়া বিপুলসংখ্যক সরকারী ও বেসরকারী ভবন, শিল্প প্রতিষ্ঠান প্রভৃতি বিনষ্ট এবং পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার ক্ষতিসাধিত হয়।
আওয়ামী লীগের যুদ্ধবাজ কর্মী এবং ইপিআর ও ইবিআর- এর বিদ্রোহীরা নরঘাতকের ভূমিকা গ্রহণ করে। আওয়ামী লীগের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের অশুভ ইচ্ছার যারা বিরোধীতা করে তারাই তাদের হত্যার শিকারে পরিণত হয়। অবর্ণনীয় বর্বরোচিত কাজ সংঘটিত হয়। বগুড়া জেলার শান্তাহারের একটি এলাকায় ১৫ হাজারেরও বেশী লোককে ঘেরাও করা হয় এবং মাকে তার নিজ সন্তানের রক্ত পান করতে বাধ্য করা হয়। চট্টগ্রামে ১০ হাজারেরও বেশী লোককে হত্যা করা হয়। সিরাজগঞ্জে সাড়ে তিনশ মহিলা ও শিশুকে একটি হলঘরে তালাবদ্ধ করে আগুন লাগিয়ে দেয়া হয়। ফলে তারা জীবন্ত দগ্ধ হয়ে মারা যায়। ময়মনসিংহে সানকিপাড়া এলাকায় ২ হাজার পরিবারের একটি কলোনীকে সম্পূর্ণ নির্মূল করা হয়। পুরুষদেরকে ঘর থেকে টেনে বের করে গুলি করে মারা হয় এবং মহিলাদের দিয়ে কবর খোঁড়ানো হয় ও তাদেরকে ধর্ষণ করা হয়। তারপর বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই তাদেরকে হত্যা করা হয়। ঐ ধরণের বর্বরোচিত ও অমানুষিক কয়েকটি ঘটনার কথা বিদেশী পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। তার কয়েকটির অংশবিশেষ নিচে উদ্ধৃত কর হলোঃ
‘বর্তমান পূর্ব পাকিস্তানে বসবাসরত লক্ষ লক্ষ অবাঙ্গালী মুসলমান প্রতি মুহূর্তে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যেকার উত্তেজনার প্রতিক্রিয়ার কথা অনুধাবন করছে এবং আশংকা করা যাচ্ছে যে, বাঙ্গালীরা এই বিরাট সংখ্যক সংখ্যালঘুদের উপর প্রতিশোধ নেবার উদ্দেশ্যে তাদের উপর চড়াও হয়েছে।’
‘স্টেটম্যান’, নয়াদিল্লী ৪ঠা এপ্রিল, ১৯৭১ (পিটার হাজেলহার্ষ্ট)

“দেশ বিভাগের সময় যেসব হাজার হাজার অসহায় মুসলিম উদ্বাস্তু পূর্ব বাংলায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন তাদেরকে গত কয়েক সপ্তাহে পূর্ব পাকিস্তানের ক্রুদ্ধ বাঙালীরা হত্যা করেছে।”
এ সপ্তাহে যেসব বিহারী মুসলমান উদ্বাস্তু সীমান্ত অতিক্রাম হিন্দুস্তানে চলে আসে তারা এই হত্যার কথা জানিয়েছে। আজ একজন তরূণ বৃটিশ টেকনিশিয়ান হিলিতে হিন্দুস্তান পাকিস্তান সীমান্ত অতিক্রম করে। তিনি এই হত্যাকাণ্ডের সত্যতা প্রকাশ করেন।
‘দি টাইমস’ লন্ডন, ৬ই এপ্রিল, ১৯৭১।

‘গতকাল কোলকাতায় যে বৃটিশ জাহাজ নোঙর করা হয় তার যাত্রীরা পূর্ব পাকিস্তানের বন্দরনগরী চট্টগ্রামে ব্যাপক নরহত্যা এবং অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনার কথা জানিয়েছেন’
লেয়ন লামসডেন নামে মার্কিন সাহায্য পরিকল্পনার একজন ইঞ্জিনিয়ার বলেছেন, প্রধানত বাঙালী অধ্যুষিত চট্টগ্রাম শহরে গত সপ্তাহে সেনাবাহিনীর লোক আসার আগে একটানা দুই সপ্তাহ ধরে বাঙলীরা পশ্চিম পাকিস্তানীদের উপর হত্যাযজ্ঞ চালায়।
‘নর্দান ইকো’ ডারলিংটন, ডারহাম, ৬ই এপ্রিল, ১৯৭১।

“যখন ইপিআর (ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস) বিদ্রোহ করলো তখন তারা প্রথম যে কাজে হাত দিলো তা হচ্ছে বিভিন্ন ব্যাংকে অবাঙালীদের উৎখাত করা।”
“১০ থেকে ১৫ হাজার লোক নিয়ে গঠিত ইপিআর-এর শতকরা ৪০ জন হচ্ছে পশ্চিম পাকিস্তানী। তাদের বেশীর ভাগই অফিসার”
“ইপিআর-এর লোকেরা হিন্দুস্তানের সীমান্ত তল্লাশী শহর হরিদাসপুরের কাছে সীমান্ত বরাবর এক গরুর গাড়ী বোঝাই লাশ খালাস করে।”
‘ফার ইস্টার্ন ইকনোমিক রিভিউ’, হংকং, ২৪শে এপ্রিল, ১৯৭১। টি আই এস জর্জ।

“শত শত প্রত্যক্ষদর্শীর কাছ থেকে যে বিবরণ পাওয়া গেছে তাতে ধারণা করা যায় যে, আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে যাচ্ছে, তখন কিছু বাঙালী বিহারীদের ঘরবাড়ী লুট করে এবং তাদেরকে হত্যা করে।”
‘নিউইয়র্ক টাইমস’, ইউইয়র্ক ১০ই মে, ১৯৭১ (ম্যালকম ডব্লিউ ব্রাউন)

“স্থানীয় একটি ব্যাংকের ইউরোপীয় ম্যানেজার বলেন, অত্যন্ত সৈভাগ্যের বিষয় যে সেনাবাহিনীর সময় মতো উপস্থিতির জন্য প্রতিটি ইউরোপীয় জীবিত আছেন, না হলে এ কাহিনী বলার জন্য আমি বেঁচে থাকতাম না।”
‘নিউইয়র্ক টাইমস’, নিউইয়র্ক ১১ই মে, ১৯৭১ (ম্যালকম ব্রাউন)

“এমন প্রমাণ পাওয়া গেছে যে, উন্মুক্ত জনতা অবাঙালীদের উপর আক্রমণ চালিয়ে তাদেরকে হত্যা করে এবং তাদের ঘরবাড়ী জ্বালিয়ে দেয়। এসব অবাঙালীদের অধিকাংশই ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের সময় হিন্দুস্তান থেকে পাকিস্তানে আসে। প্রত্যক্ষদর্শীরা দেড় হাজার বিধবা ও এতিম শিশুর নিদারুণ কাহিনীর কথা উল্লেখ করেন। ময়মনসিংহের উত্তরাঞ্চলের একটি মসজিদে আশ্রয় নিতে যাওয়ার সময় বিচ্ছিন্নতাবাদী বলে শনাক্তকৃত সশস্ত্র লোকেরা তাদের স্বামী ও পিতাদের হত্যা করে।”
‘সিলোন ডেইলী নিউজ’, কলম্বো ১৫ই মে, ১৯৭১ (মরিস কুয়েনট্যান্স)

“গতকাল এই গুরুত্বপূর্ণ বন্দর নগরীতে সফরকারী সাংবাদিকরা বলেছেন, গোলাগুলির ফলে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে এবং বিদ্রোহীরা যে বেসামরিক লোককে বিপুল সংখ্যায় হত্যা করেছে তার প্রমাণ পাওয়া গেছে।”
“সাংবাদিকরা ইস্পাহানী পরিবারের একজন প্রভাবশালী ব্যক্তির মালিকানাধীন পাটকলে একটি বিরাট কবর দেখতে পান, যেখানে ১৫২ জন অবাঙালী মহিলা ও শিশুকে একযোগে সমাহিত করা হয়েছে। বিচ্ছিন্নতাবাদী বিদ্রোহীরা তাদেরকে গত মাসে কারখানার চিত্তবিনোদন কেন্দ্রে হত্যা করে।”
“বুলেট ঝাঁঝরা এই ক্লাব কক্ষের মেঝেতে এখনো রক্তমাখা জামা-কাপড় ও বাচ্চাদের খেলনা ছড়িয়ে আছে। দায়িত্বশীল মহল বলেন, চট্টগ্রামে হাজার হাজার পশ্চিম পাকিস্তানী এবং ১৯৪৭ সাল থেকে পূর্ব পাকিস্তানে আগত হিন্দুস্তানী মুসলমানদেরকে ২৫শে মার্চ অর্থাৎ যেদিন পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার আন্দোলন শুরু হয় সেদিন থেকে ১১ই এপ্রিল সেনাবাহিনী কর্তৃক শহর পুনর্দখল করার দিন পর্যন্ত পাইকারীভাবে হত্যা করা হয়।”
“স্থানীয় বাসিন্দা সাংবাদিকদের একটি অগ্নিদগ্ধ ভবন দেখায়। তারা জানায়, বাঙালীরা এখানে পশ্চিম পাকিস্তানের সাড়ে তিন শ পাঠানকে পুড়িয়ে মেরেছে।”
‘ওয়াশিংটন পোস্ট’, ওয়াশিংটন, ১২ই মে, ১৯৭১।

(এসোসিয়েটেড প্রেস রিপোর্ট)
“বন্দর শহর চট্টগ্রামে একটি পাটকলের চিত্তবিনোদন ক্লাবে রক্ত মাখানো খেলার পুতুল এবং মলমূত্র দেখতে পাওয়া যায়। বাঙালীরা এখানে ৮০ জন মহিলা ও শিশুকে হত্যা করে। উগ্র স্বদেশিকতার উন্মাদনায় বাঙালীরা কিছুসংখ্যক পশ্চিম পাকিস্তানীকে খুন করে।”
বাঙালী বেসামরিক লোক এবং মুক্তি সৈন্যরা হিন্দুস্তানের বিহার রাজ্য থেকে আগত মোহাজিরদের পাইকারী হারে হত্যা করা শুরু করে এবং বাজার ও অন্যান্য এলাকায় ব্যাপকভাবে ছুরি মারা, গুলি চালনা এবং আগুন লাগানো প্রভৃতি হিংসাত্মক কাজ চালায় আর নারী ধর্ষণ ও লুটতরাজ করে।
.
.
চতুর্থ অধ্যায়
.
হিন্দুস্তানের ভূমিকা
পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রবিরোধী ব্যাক্তিদের সঙ্গে হিন্দুস্তানী যোগসাজশের প্রত্যক্ষ পরিচয় পাওয়া গেলো ১৯৬৭-তে যখন আগরতলা ষড়যন্ত্র উদঘাটিত হলো। কয়েকজন সাক্ষী সাক্ষ্য দিলেন যে শেখ মুজিবুর রহমান এই ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জড়িত ছিলেন ১৯৬৪-র সেপ্টেম্বর থেকেই যখন দেশের অবশিষ্ট অংশ থেকে পূর্ব পাকিস্তানকে পৃথক করার উদ্দেশ্যে একটি বিপ্লবী সংস্থা গঠিত হয়েছিলো। আগরতলা ষড়যন্ত্রের কর্মপরিকল্পনার প্রধান বিষয় ছিলো সামরিক ইউনিটগুলোর অস্ত্রাগারগুলো দখল করে সেগুলোকে অচল করে দেওয়া। পরিকল্পনা করা হয়েছিল যে এ কাজ করা হবে কমান্ডো কায়দায় এবং দলের লোকসংখ্যা কম বলে আক্রমণ করা হবে অতর্কিতভাবে। এই উদ্দেশ্য সাধনের জন্য ষড়যন্ত্রকারীদের প্রতিনিধিদের সঙ্গে হিন্দুস্তানের প্রতিনিধিদের এক বৈঠকের ব্যবস্থা করা হয়। হিন্দুস্তানের অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহ করার কথা ছিলো। ১৯৬৭ সালের ১২ই জুলাই তারিখে হিন্দুস্তানের আগরতলায় এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
১৯৬৭-র ডিসেম্বরে ষড়যন্ত্রকারীদের গ্রেফতার করা হয়। তাদের একজন প্রকাশ করে যে, হিন্দুস্তান পূর্ব পাকিস্তানে সশস্ত্র বিপ্লব গড়ে তোলার জন্য অস্ত্র ও অর্থ সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। তা ছাড়াও হিন্দুস্তান বলেছে যে হিন্দুস্তান সরকার ‘চূড়ান্ত দিনে’ পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধে যোগাযোগকারী আকাশপথ ও সমুদ্রপথ বন্ধ করে ফেলবে।
হিন্দুস্তান এই পরিকল্পনা কার্যকরী করলো ১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে। হিন্দুস্তান বিমান লাইনের একটি ফকার ফ্রেন্ডশিপ বিমানের গতি জোর করে পরিবর্তন করে তাকে লাহোরে নিয়ে যাওয়া হলো। গতি পরিবর্তনকারীরা পরে বিমানটিকে ধ্বংস করে ফেললো। এই ঘটনাকে ছুতো হিসেবে অবলম্বন করে হিন্দুস্তান সরকার তার এলাকার উপর দিয়ে পাকিস্তানী বেসামরিক বিমানের চলাচল বন্ধ করে দিল। এতে দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনার সৃষ্টি হলো।
সংশ্লিষ্ট বিমানের যাত্রীদের নিরাপত্তা ও হিন্দুস্তান তাদের আশু প্রত্যাবর্তনের নিশ্চয়তা বিধানের জন্য পাকিস্তান সরকার সম্ভব সব ব্যবস্থা গ্রহণ করলেন। পুরো ঘটনাটি তদন্ত করে দেখার জন্য একটি তদন্ত কমিশন নিয়োগ করা হলো। তদন্ত কমিশনের রিপোর্টে উদঘাটিত হলো যে, এ ঘটনাটি হিন্দুস্তানী এজেন্টরা ইচ্ছা করেই ঘটিয়েছে। এর পিছনে উদ্দেশ্য ছিল হিন্দুস্তানী সীমানার উপর দিয়ে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে বিমান চলাচল বন্ধ করার জন্য একটি ছুতো বের করা এবং পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে অসুবিধা ও উত্তেজনা আরও বাড়িয়ে তোলা। এ জন্য তারা এক সময়ের অপেক্ষায় ছিলো যা পাকিস্তানের রাজনৈতিক ও শাসনতান্ত্রিক আলোচনার সংকটকাল।
‘গার্ডিয়ান’ পত্রিকার ১৯৭১ সালের ২৪শে ফেব্রুয়ারীর সংখ্যায় পরকাশিত হলোঃ ‘তিনি (মুজিব) প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ও তার জেনারেলদের বলেছেনঃ জনসাধারণ আমাকে ভালবাসে, সুতরাং আমাকে স্পর্শ করবেন না। তিনি এ কথা বলেছেন, কারণ তিনি জানেন যে, পূর্ব পাকিস্তানে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সৈন্য এতো কম যে তারা বড় রকমের কিছু করার সাহস পাবে না। আর যেহেতু হিন্দুস্তানের ওপর দিয়ে বিমান চলাচল বন্ধ, কাজেই সৈন্য সংখ্যা বাড়ানোও অসম্ভব।
পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হিন্দুস্তানের হস্তক্ষেপের কারণ বহু। আর এই সমস্যার মূল নিহিত রয়েছে অতীত ইতিহাসে। হিন্দুস্তান পাকিস্তানের সমস্যার মূল কারণ হচ্ছে এই যে হিন্দুস্তান কখনো পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাকে সত্যি সত্যি মেনে নেয়নি। এমনকি বল্লভভাই প্যাটেলের মতো শীর্ষস্থানী দায়িত্বশীল নেতারাও আশা পোষণ করতেন যে, হিন্দু মাতৃভূমিরুপে ভারত পুনরায় যুক্ত হবে। এই আশা চরিতার্থ করার উদ্দেশ্যে হিন্দুস্তান পাকিস্তানকে ক্ষতিগ্রস্থ করার জন্য চেষ্টায় কোনো ত্রুটি করেনি। যে হঠাৎ পাকিস্তানের জমিতে পানির প্রবাহ বন্ধ করে দিলো পাকিস্তানের অর্থনীতিকে ব্যাহত করার জন্য লাখ লাখ মুসলমানকে ঘরছাড়া করে পাকিস্তানে ঠেলে দিলো। যে জুনাগড় দখল করে নিলো এই অজুহাত দেখিয়ে যে তার অধিবাসীরা হিন্দু আবার কাশ্মীর দখল করার পেছনে সে অজুহাত দেখালো যে তার শাসনকর্তা হিন্দু। ১৯৬৫ সালে যে পশ্চিম পাকিস্তানের আন্তর্জাতিক সীমানায় সরাসরি আক্রমণ চালিয়ে পাকিস্তানকে আঘাত হানলো। ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের সমাপ্তি ত্বরান্বিত করে সে পূর্ব পাকিস্তানের ২ কোটি ৩০ লাখ লোকের জীবনযাত্রা এবং সারা দেশের অর্থনীতিকে বিপদাপন্ন করে তুললো। এখন পূর্ব পাকিস্তানের ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপের মাধ্যমে সে আবার পাকিস্তানের সংহতিকে ক্ষুণ্ন করতে চায়।
১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারী মাসের শেষের দিকে হিন্দুস্তানী সেনাবাহিনীর একটি উল্লেখযোগ্য অংশকে পশ্চিমবঙ্গে মোতায়েন করা হলো। আপাতদৃষ্টিতে উদ্দেশ্য ছিলো নির্বাচনের সময় অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা রক্ষা করা। নির্বাচন শেষ হয়ে যাওয়ার পর সৈন্য পরিস্থিতি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনার পরিবর্তে ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের শেষার্ধে অতিরিক্ত সৈন্য সমাবেশ করা হলো পূর্ব পাকিস্তান সীমান্তে। এদের সাহায্যের জন্য নিয়োগ করা হলো মাউন্টেন ব্রিগেড, প্যাসুট ব্রিগেড, জঙ্গী বোমারু বিমান এবং বিমান পরিবহন ইউনিট।
সঙ্গে সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রবিরোধীদের সাহায্যের জন্য হিন্দুস্তান সেনাবাহিনীর বহু সৈন্যকে বিভিন্ন দিক থেকে পূর্ব পাকিস্তানের সীমান্তের আরও কাছাকাছি নিয়ে যাওয়া হলো। জেট জঙ্গী বিমান এবং পরিবহন বিমানও সীমান্ত এলাকার বিভিন্ন বিমান ক্ষেত্রে নিয়ে যাওয়া হলো।
পশ্চিম বাংলায় পাঁচ ডিভিশনের ওপর সৈন্য সমাবেশ ছাড়াও সীমান্তরক্ষী বাহিনীর অতিরিক্ত ব্যাটেলিয়ানও মোতায়েন করা হলো। এর আগেই কয়েকটি ব্যাটেলিয়ান পূর্ব পাকিস্তান সীমান্তে মোতায়েন করা হয়েছিল। এই ভাবে পূর্ব পাকিস্তান সীমান্তে সমাবিষ্ট হলো প্রায় পচিশটি হিন্দুস্তানী ব্যাটেলিয়ান। এইসব ব্যাটেলিয়ান যাতে বিদ্রোহী ও বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সাহায্যের জন্য পূর্ব পাকিস্তানে ঢুকতে পারে সে জন্য B.S.F এর (বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স) চিহ্ন সরিয়ে ফেলা হলো। জীপ এবং অন্যান্য যানবাহনের রং বদলে দেওয়া হলো। দিল্লী থেকে বিমানযোগে আরও B.S.F সৈন্য আনানো হলো সব B.S.F কোর্স বাতিল করে দেয়া হলও, পুলিশ বিভাগে ছুটি বন্ধ করে দেওয়া হলো।
হিন্দুস্তানী এলাকার ওপর দিয়ে পাকিস্তানী বিমান চলাচল বন্ধ করেও হিন্দুস্তান ক্ষান্ত হলো না। সে পূর্ব পাকিস্তানের সমুদ্র পথেও বাধা সৃষ্টি করতে চাইলো। ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসের দুই তারিখ হিন্দুস্তানী নৌঘাঁটি দেয়ারকার ৭০ মাইল পশ্চিমে যুদ্ধ জাহাজ The ocean Endurance নামক একটি পাকিস্তানী সওদাগরী জাহাজকে হয়রান করলো। হয়রানির থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য জাহাজটিকে করাচী ফিরতে হলো। তিন দিন পর হিন্দুস্তানী যুদ্ধজাহাজ আর একটি পাকিস্তানী জাহাজকে হয়রান করলো। এটি ছিল সফিনায়ে আরব। জাহাজটি হাজীদের নিয়ে চট্টগ্রাম যাচ্ছিল। হিন্দুস্তানের দক্ষিণ সীমান্তে কার্যরত আকাশ ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপকারী একটি নতুন ইউনিট অনুশীলন চালাতে গিয়ে উপকূল থেকে ১২৩ মাইল দূর পর্যন্ত ক্ষেপণাস্ত্র ছড়তে থাকে। এইভাবে তারা পাকিস্তানী বেসামরিক বিমানকে আরও দক্ষিণ দিক দিয়ে যেতে বাধ্য করে।
হিন্দুস্তানী বিমানবাহিনীও এমন সব ব্যবস্থা গ্রহণ করতে থাকে, যা থেকে স্পষ্ট হয়ে উঠে যে তারা একটি সম্ভাব্য যুদ্ধের প্রস্তুতি চালিয়ে যাচ্ছে। পূর্ব পাকিস্তানের পূর্ব সীমান্তে শিকারী জঙ্গীবিমান ও অতিরিক্ত পরিবহন বিমান মোতায়েন করা হলো, পূর্ব পাকিস্তানের পশ্চিম ও উত্তর সীমান্তসংলগ্ল ঘাঁটিগুলোতে প্রস্তুতি আরও জোরদার করা হলো। বঙ্গোপসাগরে পাকিস্তানী জাহাজগুলোর চলাচল পর্যবেক্ষণ করার জন্য কোলকাতার কাছে ব্যারাকপুরে কয়েকটি পর্যবেক্ষণ বিমান মোতায়েন করা হলো। পূর্ব পাকিস্তানের সীমান্ত এলাকা জুড়ে ব্যাপকভাবে ফটো গ্রহণের কাজ চালানো হয়।
হিন্দুস্তানী সীমান্ত বাহিনীর লোকেরা স্থলপথে পূর্ব পাকিস্তানের ঢুকতে শুরু করলো এবং এই উদ্দেশ্য যোগাযোগ ও পরিবহন ব্যবস্থার পুনর্বিন্যাস করা হলো। হিন্দুস্তান বিচ্ছিন্নতাবাদীদের কাছে গোপনে অস্ত্রশস্ত্র পাঠাতে লাগলো। এমন বহুসংখ্যক রাইফেল হস্তগত করা হয়, যাতে হিন্দুস্তানী রাইফেল ফ্যাক্টরি ইসাপুরের ছাপ রয়েছে। গোলাবারুদে পাওয়া গেছে হিন্দুস্তানের ফিরকী ফ্যাক্টরীর ছাপ।
এটা প্রমাণিত হয়েছে যে, হিন্দুস্তানের সীমান্ত রক্ষীবাহিনীর ৭৬, ৮১, ৮৩, ১০১, ১০৩ ও ১০৪ নম্বর ব্যাটেলিয়ানকে ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের শেষের দিক থেকে পূর্ব পাকিস্তানে কাজে লাগানো হয়েছিলো। পরবর্তী তথ্য থেকে প্রমাণিত হয়েছে যে, এছাড়া আরও দুটি ব্যাটেলিয়ানকে কাজে লাগানো হয়েছিলো। ৭৩ নম্বর B.S.F ব্যাটেলিয়ানকে কুচবিহারের মোখিলগঞ্জ এলাকায়, ৭৭ নম্বর B.S.F ব্যাটেলিয়ানকে দিনাজপুরের পশ্চিমাঞ্চলে এবং ১৮ নম্বর B.S.F ব্যাটেলিয়ানকে যশোরের পশ্চিম বনগাঁও নিযুক্ত করা হয়েছিল। হিন্দুস্তান সেনাবাহিনীর সিনিয়র কমান্ডাররা যুদ্ধাকার্য পরিচালনা করতো। এদের মধ্যে একজন ছিল ৬১ নম্বর মাউন্টেন ব্রিগেডের কমান্ডার। সম্প্রতি এই ব্রিগেডিটিকে পূর্ব পাকিস্তানের রাঙামাটির ২৫ মাইল উত্তর-পূর্বে ডিমগিরিতে মোতায়েন করা হয়েছে।
হিন্দুস্তানী অনুপ্রবেশ শুরু হওয়ার পরবর্তী সপ্তাহগুলোতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী বহু পরিমাণ হিন্দুস্তানী অস্ত্রশস্ত্র হস্তগত করেছে। নওয়াবগঞ্জ এলাকায় সেনাবাহিনী এখটি গোপন পত্র পেয়েছে। পত্রটি ‘ভারী অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহ’ সম্পর্কে সীমান্তের ওপারে হিন্দুস্তানী এজেন্টের সঙ্গে আলোচনা বৈঠকের বিষয়ে লিখিত। লেখক আওয়ামী লীগের একজন নেতা।
পূর্ব পাকিস্তান সংকটের একেবারে গোড়া থেকেই যে হিন্দুস্তান এর সঙ্গে জড়িত ছিল, তার প্রমাণ এখন হিন্দুস্তান ও অন্যান্য বিদেশী তথ্য মাধ্যমের পরিবেশিত সংবাদ থেকে পাওয়া যাচ্ছে। একজন হিন্দুস্তানী সাংবাদিক ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে ২৯ তারিখে কোলকাতা থেকে প্রেরিত এক রিপোর্টে বলেন যে, বিদ্রোহীরা (তথাকথিত মুক্তিবাহিনী) হিন্দুস্তানের সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপন করেছিলো। বোম্বাই-এর ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস প্রকাশিত খবরে সাংবাদিক কুষ্টিয়ায় শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তিবাহিনী কমান্ডারের উদ্বৃতি দিয়েছেন। কমান্ডার তার নাম প্রকাশ করতে চায়নি। কমান্ডার বলেছে, নদীয়ার সীমান্তবর্তী কুষ্টিয়ায় বিদেশী সৈনুদের দুটি ইউনিট নিহত হওয়ার পর অথবা কুষ্টিয়া থেকে তাদের অপসারণের পর কমান্ডার সঙ্গে সঙ্গে কোলকাতায় টেলিফোন করে। সে প্রথমে বলে মিঃ অজয় মুখার্জীর সঙ্গে সেই সপ্তাহেরই শেষের দিকে যার পশ্চিম বাংলার নতুন মুখ্য উজীর হওয়ার কথা। এরপর কমান্ডার কয়েকজন সাংবাদিকের সঙ্গে কথা বলে।
‘বাংলাদেশ’-এর প্রতি সমর্থন জানিয়ে হিন্দুস্তানের কয়েকটি প্রাদেশিক পরিষদে সরকারীভাবে প্রস্তাব গ্রহণ করা হলো। এই প্রদেশেগুলোর মধ্যে রয়েছে তামিলনাড়ু, পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, কেরালা, রাজস্থান, উত্তর প্রদেশ, গুজরাট ও ত্রিপুরা। পশ্চিম বাংলার ডেপুটি মুখ্য উজীর বললেন, যদিও কেন্দ্রীয় সরকার এখনও বাংলাদেশের প্রতি স্বীকৃতি জানায়নি কিন্তু পশ্চিম বাংলায় আমরা বাংলাদেশের প্রতি এখন থেকেই স্বীকৃতি জানাচ্ছি।
এদিকে পূর্ব পাকিস্তান পরিস্থিতি সম্পর্কে হিন্দুস্তানী প্রধান উজীর নিজেই একটি প্রস্তাব উপস্থাপন করলেন। ১৯৭১ সালের ৩০শে মার্চ তারিখে হিন্দুস্তানী পার্লামেন্টের উভয় পরিষদেই প্রস্তাবটি গৃহীত হলো। এই প্রস্তাবে ‘পূর্ব বাংলার জনগণের প্রতি গভীর সহানুভূতি ও সংহতি প্রকাশ করা হয় এবং তাদের (বিচ্ছিন্নতাবাদীদের) আশ্বাস দেওয়া হয় যে, ‘হিন্দুস্তানের জনগণ তাদের সংগ্রাম সর্বান্তঃকরণে সহানুভূতি জানাবে ও সমর্থন যোগাবে।’
হিন্দুস্তানের পার্লামেন্টে গৃহীত ‘বাংলাদেশ’ সম্পর্কিত প্রস্তাবটি বক্তৃতা প্রসঙ্গে অল ইন্ডিয়া কংগ্রেস কর্তৃক ‘সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত’ হয়। এই প্রস্তাব সম্পর্কে বক্তৃতা প্রসঙ্গে কংগ্রেস কমিটির পশ্চিম বাংলা ইউনিটের জেনারেল সেক্রেটারী মিঃ কে, কে, শুকলা বললেন, ‘শেখ মুজিবুর রহমান যে যুদ্ধ করছেন সেটা হিন্দুস্তানেরই যুদ্ধ।’
হিন্দুস্তানী প্রধান উজীর শেখ মুজিবুর রহমানের সাহায্যের জন্য তহবিল সংগ্রহের আবেদন জানালেন। হিন্দুস্তানের সর্বত্র সরকারী সমর্থনপুষ্ট কমিটি গঠিত হলো। পূর্ব পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সাহায্যের জন্য তারা চাঁদা তুলতে শুরু করলো। বিহার প্রদেশের মুখ্য উজীর কর্পুরী ঠাকুর ঘোষণা করলেন যে, তার সরকার এই তহবিলে ২৫ লাখ টাকা দান করবে। মুখ্য উজীর ঠাকুরের উদ্বৃতি দিয়ে বোম্বাই ‘ইন্ডিয়ান নেশন’ পত্রিকার ১৯৭১ সালের ৬ই এপ্রিলের সংখ্যায় একটি খবর প্রকাশিত হয়। এই খবর অনুসারে “বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর প্রতি অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহসহ সম্ভব সর্বপ্রকার সাহায্যদানের দৃঢ় সংকল্পের কথা ঠাকুর মহাশয় পুনরায় দৃঢ়তার সঙ্গে উল্লেখ করেন। তিনি আরো বলেন, পরিণতি যাই হোক না কেন, বাংলাদেশের প্রতি অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহের ব্যাপারে আমি অটল।”
শেখ মুজিবের মুক্তিবাহিনীর জন্য অস্ত্রশস্ত্র ক্রয় এবং পূর্ব পাকিস্তানে সশস্ত্র অনুপ্রবেশকারী পাঠানোর জন্য এই সব অর্থ সংগ্রহ করা হলো।
এপ্রিল মাসের ৫ তারিখে সাংবাদিকরা হিন্দুস্তানী প্রধান উজীরকে প্রশ্ন করেছিলেন যে এসব অস্ত্রশস্ত্র পূর্ব পাকিস্তানে পাঠানোর জন্য কোনো ব্যবস্থা করা হয়েছে কি না। এর জবাবে তিনি বলেছিলেন, তিনি এ ব্যাপারে প্রকাশ্যভাবে কিছু বলতে পারেন না। কারণ এটা একটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। স্টেটম্যান এবং অন্যান্য কয়েকটি হিন্দুস্তানী সংবাদপত্রে এ খবর প্রকাশিত হয়েছিলো।
পূর্ব পাকিস্তানের গোলযোগ সৃষ্টির জন্য হিন্দুস্তানী এখনো বিদ্রোহীদের নিযুক্ত করে যাচ্ছে এবং তাদের ট্রেনিং দিয়ে চলেছে। লন্ডন টাইমস এর একজন প্রতিনিধি ব্যক্তিগতভাবে এই ধরনের একটি রিক্রুটিং সেন্টার পরিদর্শন করেছেন।
১৯৭১ সালের ১৮ই জুন তারিখে প্রেরিত এক খবরে তিনি বলেন যে, শিক্ষা কেন্দ্রের অফিসার ইন চার্জ দাবী করেন যে তথাকথিত ‘বাংলাদেশ’ বাহিনীর সবগুলো ট্রেনিং কেন্দ্রেই বাংলাদেশের কোথাও অবস্থিত। কিন্তু লন্ডন টাইমস-এর প্রতিনিধি যখন জানতে চান যে, এটা একটা সামরিক গোপনীয় তথ্য। লন্ডন টাইমস এর প্রতিনিধি আরও জানান, হিন্দুস্তানের পশ্চিমবঙ্গের অভ্যন্তরে এরকমের প্রায় শ’খানের কেন্দ্র রয়েছে। তিনি আরও বলেন যে, রিক্রুটিং সেন্টারগুলোর এমন সব জায়গায় অবস্থিত, যেগুলো বাইরে থেকে দেখলে মনে হয় যে এগুলো উদ্বাস্তুদের রেজিস্ট্রেশন অফিস। লন্ডন টাইমস-এর প্রতিনিধি খবর অনুসারে যাদের রিক্রুটিং সেন্টারে নিয়োগের নেই। পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে তাদের গুলি করে মারা হবে। লন্ডন বৃটিশ দৈনিক গার্ডিয়ানে প্রকাশিত এক খবরে বলা হয়েছে যে পূর্ব পাকিস্তান থেকে যেসব সশস্ত্র বিদ্রোহীরা সম্প্রতি সীমান্তের ঐ পারে চলে গেছে হিন্দুস্তানীরা প্রকাশ্যভাবে তাদের আশ্রয় দিচ্ছে। এইসব বিদ্রোহীদের মধ্যে রয়েছে পূর্ব পাকিস্তান রাইফেল বাহিনীর লোক, সামরিক বাহিনীর লোক এবং অন্যান্য লোক এবং অন্যান্যরা।’ গার্ডিয়ান প্রতিনিধি একটি বর্ডার ক্রসিং পয়েন্টে হিন্দুস্তানী সীমান্তবর্তী বাহিনীর অবস্থানের পাশে তাঁবু খাটানো একটি শিবির রাইফেলধারী সশস্ত্র ব্যক্তিদের স্বচক্ষে দেখেছেন।
লাগোসের নাইজেরিয়ান ট্রিবিউন নামক পত্রিকার মে মাসের ১৪ তারিখের সংখ্যায় বলা হয়েছে, “হিন্দস্তান পূর্ব পাকিস্তান-হিন্দুস্তান সীমান্ত বরাবর ছ’টি রিলিফ কেন্দ্র স্থাপন করেছে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে ব্যবহারের জন্য অস্ত্রশস্ত্র ও অনুপ্রবেশকারীদের এই সব কেন্দ্রের মধ দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে পাঠানো হয়।”
কলম্বিয়া ব্রডকাস্টিং সিস্টেমের প্রতিনিধি আর্নেস্ট ওয়েদাবল ১৯৭১ সালের ৩১ শে মার্চ তারিখে নয়াদিল্লী থেকে প্রেরিত এক রিপোর্টে জানালেনঃ মুজিব ও তার বেআইনী ঘোষিত আওয়ামী লীগ যে আগে থেকে সতর্কতার সঙ্গে সামরিক অভিযানের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিল তার সব রকম আভাসই পাওয়া যাচ্ছে। এই মুক্তিবাহিনীর প্রথম লক্ষ্য ছিল চট্টগ্রাম বা পূর্ব পাকিস্তানের একমাত্র গভীর সামুদ্রিক বন্দর। এই বন্দরটি একবার ধ্বংস হয়ে গেলেই প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান পূর্ব পকিস্তানে সৈন্য সরবরাহের ব্যাপারে মুশকিলে পড়তেন। দ্বিতীয় লক্ষ্য ছিল ঢাকা অধিকার করা। যাতে তা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মূল ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহৃত না হতে পারে।
মুজিব বহু দিন যাবৎ বাইরে থেকে সরবরাহ পেয়ে আসছিলেন বলে বিশ্বাস এবং ১৯৭১ সালের ২৬ শে মার্চ তারিখ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া কর্তৃক ব্যবস্থা গ্রহণের পূর্ব পর্যন্ত এসব লুকিয়ে রাখা হয়েছিল। নয়াদিল্লীতে অবস্থিত বহু বিদেশী কুটনীতিবিদ মনে করেন যে, এসব অস্ত্রশস্ত্র একমাত্র হিন্দুস্তান থেকেই আসা সম্ভব ছিলো।
লন্ডন টাইমস-এর প্রতিনিধি পশ্চিমবঙ্গের ২৪ পরগনা থেকে প্রেরিত এক রিপোর্টে বলেছেন যে, বোমা ও বন্দুক সীমান্ত দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে সরবরাহ করা হচ্ছে এবং পূর্ব বাংলার বেনাপোল সীমান্ত ফাঁড়ির কাছে পশ্চিম বাংলার গেরিলাদের উপস্থিতির প্রমাণ পাওয়া গেছে।
২৮শে এপ্রিল তারিখে নয়াদিল্লী থেকে প্রেরিত এএফপির খবরে বলা হয়েছে- ‘পূর্ব পাকিস্তানে যুদ্ধ করার জন্য ১০ হাজার প্রাক্তন সৈনিককে সংঘবদ্ধ করা হচ্ছে।’
লন্ডন টাইমস ১৯৭১ সালের জুন মাসের ২ তারিখের সংখ্যায় বলা হয়েছে, “হিন্দুস্তান সরকারই প্রায় সব ক্ষেত্রে বাংলাদেশ মতবাদটিকে জিইয়ে রাখছে।” পত্রিকাটির কোলকাতা প্রতিনিধি বলেন যে, “সীমান্তের কাছাকাছি প্রায় ২০টি শিবিরে হিন্দুস্তানী ইনসট্রাকটাররা প্রায় ৩০ হাজার রিক্রুটকে ট্রেনিং দিচ্ছে।” তিনি আরও বলেন যে, “তথাকথিত ‘স্বাধীন বাংলাদেশ বেতার’ হিন্দুস্তানী এলাকায় অবস্থিত। তিনি বলেন, ‘কয়েক সপ্তাহের নীরবতার পর আজ আবার ‘স্বাধীন বাংলাদেশ বেতার’-এর কণ্ঠ শোনা গেলো। বেতার থেকে ঘোষণা করা হলো যে কয়েকটি এলাকায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে পরাজিত করা হয়েছে। আজ সকালে আমি একটি বেতার দিকনির্দেশকযন্ত্রের সাহায্যে ‘স্বাধীন বাংলা বেতার’ কোন দিকে অবস্থিত তা পরীক্ষা করার চেষ্টা করলাম। আশ্চর্যের বিষয়, দিকনির্দেশযন্ত্রে ধরা পড়লো যে স্বাধীন বাংলা বেতারের শক্তিশালী ও স্পষ্ট ধ্বনি যেদিকে বাংলাদেশ অবস্থিত সেই পূর্ব দিক থেকে আসছে না বরং তা আসছে উত্তর দিক থেকে, যেদিক থেকে অল ইন্ডিয়া রেডিওর ধ্বনি আসে। শহরের অন্য কয়েকটি জায়গা থেকেও আমি অনুরূপ পরীক্ষা চালালাম। প্রতিবারই নির্ভুলভাবে ধরা পড়লো উত্তর দিক। উত্তরে চিনশুরা ও মাগুরার কাছে যেখানে অল ইন্ডিয়া রেডিওর ট্রান্সমিটার অবস্থিত সেই দিক থেকেই আসছে স্বাধীন বাংলা বেতার এর ধ্বনি।”
১৯৭১ সালের ১৪ই এপ্রিল তারিখে লন্ডনের গার্ডিয়ান পত্রিকায় কোলকাতা প্রতিনিধি মার্টিন উলাকটের প্রেরিত একটি খবর প্রকাশিত হয়। অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের সদস্যরা বাংলাদেশের কোথাও রয়েছেন বলে হিন্দুস্তানী সংবাদপত্রগুলোতে যে খবর প্রকাশিত হয়, মার্টিন উলাকট তাকে কাল্পনিক বলে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, তাদের সবাই কলকাতাতেই রয়েছেন আর তাদের রাখা হয়েছে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবনে। প্রতিনিধি আরও বলেন যে, গত শুক্রুবার তথাকথিত স্বাধীনতা ঘোষণার যে অনুষ্ঠান হলো, তাতে চেয়ার ও অন্যান্য আসবাবপত্র দিয়ে হিন্দুস্তানীরা এইসব ব্যক্তিদের সাহায্য করেছে। হিন্দুস্তানী সেনাবাহিনীর লোক সাদা পোশাকে সেখানে পাহারায় নিযুক্ত ছিলো।
প্যারিসে যে মণ্ডি নামক ফরাসী দৈনিক পত্রিকার ২০শে এপ্রিলের সংখ্যায় বলা হয়েছে, “অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার ঘোষণা করা হয়েছে হিন্দুস্তানী সীমান্ত থেকে এক মাইল দূরে একটি গাছে নিচে। বিদেশী সাংবাদিকদের দেখানোর জন্য। এই সরকার যে পূর্ব পাকিস্তানী এলাকার মধ্যেই রয়েছে- এ কথা প্রমাণ করাই ছিল এ অনুষ্ঠানের উদ্দেশ্য।”
পূর্ব পাকিস্তানের ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপে সাহায্য করা এবং সেখানে অনুপ্রবেশকারী পাঠানো ছাড়াও হিন্দুস্তান, পাকিস্তানের সীমান্ত বরাবর সর্বত্র উত্তেজনা বৃদ্ধি করেছে। পাকিস্তান এ ব্যাপারে হিন্দুস্তানের কাছে কয়েকটি প্রতিবাদ পত্র পাঠিয়েছে। ১৯৭১ সালের জুন মাসের ২১ ও ২২ তারিখে দুটি প্রতিবাদ পত্র পাঠানো হয়। এগুলোতে নিম্নলিখিত ঘটনাগুলির উল্লেখ করা হয়।
(১) ১৬ই জুন তারিখে সশস্ত্র হিন্দুস্তানীরা কোনরকম উস্কানী ছাড়াই যশোর জেলার বেনাপোলের কাছে পাকিস্তানী এলাকায় (QT 7542) ও (QT 7642) মেশিনগান ও ৩ ইঞ্চি মর্টারের সাহায্যে গোলাবর্ষণ করা।
(২) ১৭ই জুন তারিখে হিন্দুস্তানের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সৈন্যরা বেআইনী ভাবে পাকিস্তানী এলাকায় অনধিকার প্রবেশ করে ময়মনসিংহ জেলার একটি গ্রামের (RF 6898) দুজন লোককে হত্যা করে।
(৩) ১৭ই জুন তারিখে ময়মনসিংহের অন্তর্গত কমলাপুর (QE 8512) সীমান্ত ফাঁড়িতে কোন উস্কানী ছাড়াই একবার সকাল সাড়ে ৫টা থেকে ৬টা পর্যন্ত এবং আবার বেলা ১১টা ৪০ মিনিট থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত ছোটখাটো অস্ত্র ও মর্টারের সাহায্যে গুলি চালানো হয়। এতে ২ জন লোক নিহত ও ৩ জন আহত হন।
(৪) ১৭ই জুন তারিখে যশোর জেলার বেনাপোলের কাছে একটি পাকিস্তানী টহলদার দলের ওপর গুলি চালানো হয়।
(৫) জুন মাসের ১৭ ও ১৮ তারিখের মধ্যবর্তী রাত্রে হিন্দুস্তানী বাহিনী কোন উস্কানী ছাড়াই ময়মনসিংহ জেলার অন্তর্গত কমলাপুর (QE 8512) সীমান্ত ফাঁড়িতে আবার ভারী মর্টার ও ছোটখাট অস্ত্রের সাহায্যে গুলি বর্ষণ করে।
(৬) ১৮ই জুন তারিখে সশস্ত্র হিন্দুস্তানীরা কুমিল্লা (RR 3499) জেলায় মর্টার ও ছোটখাট অস্ত্রের সাহায্যে গোলাগুলি বর্ষণ করে। এতে ৪ জন লোক গুরুতরভাবে আহত হয়।
(৭) ১৮ই জুন তারিখে হিন্দুস্তান সেনাবাহিনী কোন রকম উস্কানী ছাড়াই পূর্ব পাকিস্তানের কুমিল্লা জেলার সালদানদী এলাকা (RM 2818) যশোর জেলার বেনাপোল ও মসলিয়া এলাকা (QT 8665) এবং সিলেট জেলার চাতালপুর এলাকায় (RH 1703) মর্টার ও ছোটখাট অস্ত্রের সাহায্যে গোলাগুলি বর্ষণ করে।
(৮) ১৮ই জুন হিন্দুস্তানের সশস্ত্র লোকজন দিনাজপুর জেলার কিশোরগঞ্জ সীমান্ত ফাঁড়ির (QD 3158) উপর ১ রাউন্ড ৩ ইঞ্চি মর্টার গোলা বর্ষণ করে।
১৯৭১ সালের ৩রা জুলাই, হিন্দুস্তান বিমান বাহিনী পূর্ব পাকিস্তানের দিনাজপুর জেলার অমরখানার উপর হামলা চালায়, সেই তারিখে বেলা সাড়ে বারোটার সময় হিন্দুস্তান বিমান বাহিনীর চারটি জঙ্গী বিমান এবং একটি সশস্ত্র হেলিকপ্টার বেআইনীভাবে পাকিস্তানী আকাশসীমার ৬ মাইল অভ্যন্তরে চলে আসে এবং মেশিনগান ও অন্যান্য অস্ত্রের সাহায্যে গোলাবর্ষণ করে। পরে বিকেলের দিকে (৩রা জুলাই) হিন্দুস্তানী এলাকা থেকে ১২০ মিলিমিটার মর্টারের সাহায্যে অমরখানার উপর প্রচণ্ড গোলাবর্ষণ করে।
হিন্দুস্তানের প্রকৃত উদ্দেশ্য পরিষ্কার, ১৯৭১ সালের পয়লা এপ্রিল “Yorkshire Post” পত্রিকা বলেন, “পাকিস্তানে হিন্দুস্তানের উচ্ছেদমূলক তৎপরতা, পূর্ব পাকিস্তানে একটি বাহিনী গড়ে তোলার প্রয়াস এবং গোটা পাকিস্তানকেই ধ্বংস করার তার চক্রান্ত এ সবের পেছনে দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের জন্মতারিখ থেকেই এ সবের সূচনা। সেদিন থেকেই হিন্দুস্তান কখনো পাকিস্তানের সৃষ্টিকে মেনে নেয়নি এবং সেই রাষ্ট্রকে পঙ্গু করার জন্য যে সব রকম কৌশলই খাটিয়েছে।” লন্ডনের “Daily Telegraph” এ David Loshak বলেন, হিন্দুস্তান তার প্রধান প্রতিপক্ষের খণ্ডবিখণ্ড কিংবা দুর্বল হওয়ার মধ্যে তার নিজের মঙ্গল ছাড়া কিছুই দেখতে পায় না।
তিনি আরো বলেন, “নিরীহ জনগণের দুর্ভাগ্যের জন্য কোন উদ্বেগ নয় বরং তার এই চিন্তাধারাই বাংলাদেশ এর পক্ষে হিন্দুস্তানের প্রচারণা যুদ্ধে পেছনে রয়েছে।” সমসাময়িক এশীয় বিষয়াদির উপর আরেকজন প্রখ্যাত বৃটিশ ভাষ্যকার Michael Edwards, ১৯৭১ সালের পয়লা এপ্রিল BBC-র ‘আজকের বিশ্ব’ অনুষ্ঠানে প্রচারিত এক আলোচনায় বলেন, “পূর্ব পাকিস্তানের গোলযোগ সৃষ্টিকারীদের সমর্থনে বিবৃতি দেয়া এবং বিক্ষোভ সংগঠনের ব্যাপারে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও গোষ্ঠীর মধ্যে যে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলছে তাকে এই পটভূমিকায়ই বিচার করতে হবে। পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে একত্রীকরণের যে উদ্যোগ পশ্চিমবঙ্গে দেখা গিয়েছে তার পেছনে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক উদ্দেশ্য রয়েছে। বাংলা বিভাগকে বানচাল করে দিয়ে পশ্চিম বঙ্গীয় নেতারা পূর্ব পাকিস্তানের উপর তাদের প্রাধান্য চাপানো এবং তাদের কলকারখানার কাঁচামালের উৎস পুনঃপ্রতিষ্ঠার আশা পোষণ করছেন।”
হিন্দুস্তানের নিজের লেখক ও ভাষ্যকাররা পাকিস্তানের ব্যাপারে হিন্দুস্তানের চূড়ান্ত লক্ষ্য সম্পর্কে কোন সন্দেহের অবকাশ রাখনেনি।
১৯৭১ সালের দোসরা এপ্রিল, হিন্দুস্তানী পত্রিকা “Free press Journal” বলেন, “আমাদের হিন্দুস্তানের কার্যকলাপকে সচেতনভাবে এবং বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে পাকিস্তানকে দুর্বল করার লক্ষ্যের দিকে পরিচালিত করতে হবে।”
পত্রিকাটি আরো বলেন, “কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ পূর্ববঙ্গ হয়তো কাশ্মীরের উপর হিন্দুস্তানের সার্বভৌমত্বকে স্থায়ীভাবে স্বীকৃতি দিতে রাজী হবে। এর দুদিন আগে ১৯৭১ সালের ৩০শে মার্চ বোম্বাই এর দৈনিক সংবাদপত্র “The Indian Express” পূর্ব পাকিস্তানের সশস্ত্র হস্তক্ষেপের খোলাখুলিভাবে সমর্থন না করে বলেন, “এটা একটি সত্যিকারের ঐতিহাসিক ক্ষণ এবং ঠিক এই মুহূর্তেই হচ্ছে কাজ করার লগ্ন।” ১৯৭১ সালের ৭ই এপ্রিল হিন্দুস্তানের প্রতিরক্ষা গবেষণা ইনষ্টিটিউটের ডিরেক্টর Mr. Subramaniam পূর্ব পাকিস্তানে হিন্দুস্তানের সমর্থনপুষ্ট বিদ্রোহের প্রসঙ্গে বলেনঃ
“হিন্দুস্তানকে যে জিনিসটি অবশ্যই হৃদয়ঙ্গম করতে হবে তা এই যে পাকিস্তানের খণ্ডবিখণ্ড হওয়া আমাদের স্বার্থের অনুকূল এবং আজ আমাদের সামনে এমন একটি সুযোগ এসেছে যার মতো সুযোগ আর কখনও আসবে না।”
১৯৭১ সালের ১৫ই জুন হিন্দুস্তানী দৈনিক পত্রিকা “Motherland”-এ প্রকাশিত এক প্রবন্ধে আরেকজন হিন্দুস্তানী ভাষ্যকার Subramaniam Swamy যুক্তি পেশ করেন যে, “পাকিস্তানের আঞ্চলিক অখণ্ডতার দিকে লক্ষ্য রাখা আমাদের কাজ নয়। সেটা পাকিস্তানের মাথাব্যথা। আমাদের শুধু দুটো প্রশ্ন বিবেচনা করতে হবে। পাকিস্তানের খণ্ডবিখণ্ড হওয়া কি আমাদের দীর্ঘমেয়াদী অনুকূলে? আর যদি তা সত্যিও আমাদের স্বার্থের অনুকূল হয় তাহলে আমাদের এ ব্যাপারে কি কিছু করার রয়েছে?” ভাষ্যকার এই সিদ্ধান্তে পৌছান যে, “পাকিস্তানের খণ্ডবিখণ্ড কেবল আমাদের বাইরে নিরাপত্তার জন্যই অনুকূল নয়, তা আমাদের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তারও অনুকূলে। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে হিন্দুস্তানের একটি মহাশক্তি রুপে গড়ে উঠা উচিত এবং এই ভূমিকা পালনের জন্য আমাদেরকে জাতীয় পর্যায়ে আমাদের নাগরিকদেরকে সু-সংবদ্ধ করতে হবে। আর এজন্য অপরিহার্য পূর্বশর্ত হচ্ছে পাকিস্তানকে ছিন্নবিচ্ছিন্ন করা।”
সর্বোপরি, ১৯৭১ সালের ১৫ই জুন হিন্দুস্তানের প্রধান উজীর স্বয়ং ঘোষণা করেন, “বাংলাদেশ এর অবসান ঘটিয়ে দেয় এমন একটি রাজনৈতিক মীমাংসা হিন্দুস্তান এক মুহূর্তের জন্যও মেনে নেবে না।”
.
.
[শিরোনাম পড়া যাচ্ছেনা]
পূর্ববর্তী অধ্যায়গুলোর আলোকে আমরা পূর্ব পাকিস্তানের সাম্প্রতিক মর্মান্তিক ঘটনাবলীকে তার যথার্থ পটভূমিকায় দেখতে পারি। ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চর আগে আওয়ামী লীগ উগ্রপন্থীরা যে সব নৃশংস ও অরাজকতা মূলক কার্যকলাপ চালিয়েছে প্রতিশোধমূলক প্রতিক্রিয়া এড়ানোর উদ্দেশ্যে তা প্রচার করা হয়নি। কিন্তু এর ফলে এই ধারণার সৃষ্টি হয়েছে যে, ফেডারেল সরকারের ব্যাবস্থার লক্ষ্য ছিল একটি গণআন্দোলনকে দাবিয়ে দেয়া। এখন অবশ্য বুঝতে পারা যাচ্ছে যে, সশস্ত্রবাহিনী আইন- শৃংখলা এবং সরকারের কর্তৃত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্যই গিয়েছিলেন। কারণ আওয়ামীলীগের ২৫ দিনব্যাপী অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের সময় আইন- শৃংখলা এবং সরকারের কর্তৃত্ব মারাত্মক ভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল।
আবেগ্মুক্ত মন নিয়ে এই শ্বেতপত্রে দেয়া তথ্য প্রমাণাদি বিচার করলে পরিষ্কার হয়ে উঠে যে, প্রেসিডেন্ট তার সাধ্যমত চেষ্টা চালিয়েছিলেন নির্বাচনে গণপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের পরিবেশ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে বিভিন্ন দলের মধ্যে একটি মতৈক্য প্রতিষ্ঠা করতে। কারণ এ ধরণের মতৈক্য ছাড়া একটা সত্যিকারের ফেডারেল ব্যাবস্থা কায়েম করা সম্ভব নয়। তিনি ধর্যসহকারে আওয়ামীলীগের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যান এবং সরকারের সর্বপরি কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠাকে এতটাই বিলম্বিত করেন যে কেউ কেউ এখন মনে করছে যে পরিস্থিতি বিষাদের প্রান্তসীমায় পৌঁছে গিয়েছিল। শেখ মুজিবুর রহমান এবং আওয়ামীলীগের অন্যন্য নেতাদের অবশ্য ক্রমেই তাদের দাবী বাড়িয়ে যেতে থাকেন। তাঁরা সম্পুর্ন ভুলে যান যে, আওয়ামীলীগের ৬ দফা অনুসারেও জনগণ তাদের যে রায় দিয়েছেন তা ছিল একটি ফেডারেশনের অধীনে স্বায়ত্বশাসনের জন্য। আলোচনার শেষের দিকে তাদের খসড়া ঘোষণাপত্রে একটি কনফেডারেশনের কথা বলা হয়। কনফেডারেশন হচ্ছে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রসমূহের একটি জোট। এছাড়াও এই ঘোষণা পত্রে তাদের এই দেশকে ভাগ করার সংকল্পের সুস্পষ্ট আভাস ছিল। এটা একদিকে অন্য ফেডারেটিং ইউনিটগুলোর নেতা ও দলগুলোর কাছে গ্রহণযোগ্য ছিল না। অন্য দিকে, পাকিস্তানের ঐক্য ও সংহতি অক্ষুণ্ণ রাখার মৌলিক প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রেসিডেন্ট যে আইঙ্কাঠামো আদেশ জারী করেন এবং যার অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, সেই আইঙ্কাঠামো আদেশের শর্তাবলীরও এটা ছিল সুস্পষ্ট লংঘন।
আওয়ামীলীগের নেতারা তাদের সাফল্যের জন্য কতগুলো জিনিসের উপর নির্ভর করছিল। তাঁরা মনে করেছিল যে, আলোচনার মাধ্যমে তাদের বিচ্ছিন্নতাবাদী দাবী দাওয়া মেনে নেয়া না হলে একদিকে তাঁরা বেসামরিক প্রশাসনকে অচল করে দেবেন এবং অন্যদিকে সশস্ত্রবাহিনীর অনেকগুলো ইউনিটের আনুগত্য নষ্ট করে হিন্দুস্তানের যোগসাজশে এমন একটা বেকায়দা পরিস্থিতির সৃষ্টি করবেন যে তখন তাদের দাবী মেনে নেয়া ছাড়া আর কোন উপায় থাকবে না।
প্রেসিডেন্ট আপোষ – মিমাংসার জন্য সবরকমের চেষ্টা চালান। কিন্তু তিনি একটি ঐক্যবদ্ধ পাকিস্তানের ধারণার সঙ্গে সংগতিপূর্ন একটি রাজনিতিজ্ঞসুলভ কিংবা একটি আপোষমূলক মনোভাবও দেখতে পাননি। কাজেই প্রেসিডেন্ট যে বারবার সতর্ক করে দিয়েছিলেন যে প্রয়োজন ফলে তিনি দেশের অখন্ডতা রক্ষার জন্য চূড়ান্ত ব্যাবস্থা নেবেন, শেষ পর্যন্ত তার কোন উপায় না দেখে তিনি অতীব দুঃখের সঙ্গে সেই সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হন।
.
.
পরিশিষ্ট ঙ

আওয়ামীলীগের খসড়া ঘোষণাপত্র
ঢাকা, মার্চ ১৯৭১

যেহেতু ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ সামরিক আইন ঘোষণার মাধ্যমে আমি, জেনারেল আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান, এইচ, পিকে, এইচ, জে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক এবং পাকিস্তানের সশস্ত্রবাহিনীর সুপ্রীম কমান্ডার হিসেবে সব ক্ষমতা আমর হাতে নিয়েছি এবং এর ফলে আমি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের দায়িত্বভার গ্রহণ করেছি;
যেহেতু, জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছেঃ
যেহেতু, পাকিস্তানের জন্য অবিলম্বে একটি শাসনতন্ত্র তৈরির সহায়ক যথাযথ পরিবেশ সৃষ্টি করার জন্য এভাবে নির্বাচিত গণ- প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা আবশ্যক;
এবং যেহেতু সামরিক আইন তৎপরতা প্রত্যাহার করা যেতে পারে;
অতএব, আমি জেনারেল আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান, এইচ, পিকে, এইচ, জে, ঘোষণা করছি যে, পাকিস্তানের সামরিক আইন প্রত্যাহার করা হবে এবং ১৯৬৯ সালের ২৫শে মার্চের ঘোষণা একটি প্রদেশে সে দিন থেকে বাতিল করে যেদিন প্রদেশিক গভর্নর তার দায়িত্বভার গ্রহণের শপথ নেবেন, এবং যে কোন অবস্থায় এই ঘোষণার ৭ দিন পর পাকিস্তানের সর্বত্র তা বাতিল হয়ে যাবে।
১. এই ঘোষণা এবং এর অধীনে জারী করা অন্য কোন আদেশ আপাতত বলবৎ অন্য কোন আইনের কোন কিছুর বিপরিতে হওয়া সত্ত্বেও তা কার্যকরী থাকবে।
২. এই ঘোষনার উদ্দেশ্য কিংবা বিষয়বস্তুর পরিপন্থী কোন কিছু না থাকলে-
ক. কেন্দ্রের মানে হচ্ছে প্রজাতন্ত্র;
খ. কেন্দ্রীয় সরজার মানে প্রজাতন্ত্রের কার্যনির্বাহক সরকার;
গ. কেন্দ্র প্রশাসিত এলাকার মানে হচ্ছে ১৯৭০ সালের পশ্চিম পাকিস্তানের প্রদেশ ( ভংগ ) আইন বর্ণিত এলাকাসমূহ;
ঘ. প্রারম্ভিক দিন মানে যেদিন থেকে এই আদেশ কার্যকরী হয়;
ঙ. অন্তবর্তীকালীন সময় শুরু হবে জাতীয় পরিষদে যেদিন শাসনতন্ত্র প্রণয়ন শুরু সেদিন থেকে এবং শেষ হবে যে দিন শাসনতন্ত্র প্রণয়ন শেষ হয়ে যাবে।
………..
[পাকিস্তান সরকারের এই শ্বেতপত্রে আরও কয়েকটি পরিশিষ্ট রয়েছেঃ
পরিশিষ্ট- ক প্রেসিডেন্টের নীতি নির্ধারনী ভাষণ সমূহের অংশবিশেষ
পরিশিষ্ট- খ আইন কাঠামো আদেশ, ১৯৭০
পরিশিষ্ট- গ আওয়ামীলীগের ছয় দফা,
পরিশিষ্ট- ঘ আওয়ামীলীগের নির্দেশাবলী, মার্চ ১৯৭১
পরিশিষ্ট- ঙ পাকিস্তান প্রজাতন্ত্রের শাসনতন্ত্র, ১৯৬২
উল্লেখ্য যে, এই পরিশিষ্টসমূহের বিষয়বিস্তু ‘দলিলপত্রঃ ২য় খন্ড’ এবং এই খন্ডের অন্যত্র অন্তর্ভুক্ত হয়েছে বলে এখানে মুদ্রিত করা হয়নি। ]
.
চ. ইসলামাবাদ রাজধানী এলাকার মানে হচ্ছে ১৯৭০ সালের পশ্চিম পাকিস্তানের প্রদেশ ( ভংগ ) আদেশ বর্নিত এলাকা;
ছ. বিগত শাসনতন্ত্র মানে ১৯৬২ সালের পাকিস্তান ইসলামী প্রজাতন্ত্রের শাসনতন্ত্র।
জ. সামরিক আইন মানে ১৯৬৯ সালের ২রা মার্চের ঘোষণার দ্বারা জারীকৃত সামরিক আইন।
ঝ. সামরিক আইন কর্তৃপক্ষে রয়েছেন- কোন সামরিক আইন বিধি বা সামরিক আইন আদেশের দ্বারা বা অধীনে এ ধরণের বিধি বা আদেশের অধীনে কোন কাজ করার জন্যে বা ক্ষমতা প্রয়গের জন্যে অনুমোদিত কোন ব্যাক্তি বা একাধিক ব্যক্তির সংস্থা কিংবা কোন আদালত;
ঞ. সামরিক আইন মেয়াদের মানে হচ্ছে ১৯৬৯ সালের ২৫শে মার্চ থেকে শুরু করে প্রারম্ভিক দিনের ঠিক আগের দিন পর্যন্ত।
ট. জাতীয় পরিষদের মানে হচ্ছে প্রেসিডেন্টের ১৯৭০ সালের দু নম্বর আদেশের অধীনে নির্বাচিত জাতীয় পরিষদ।
ঠ. প্রেসিডেন্ট মানে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট
ড. প্রজাতন্ত্র মানে পাকিস্তান ইসলামী প্রজাতন্ত্র
ঢ. সময়সূচী মানে এই ঘোষণার সময়সূচী
ণ. বাংলা দেশ রাজ্য মানে প্রারম্ভিক দিনের অব্যবহিত আগে পূর্ব পাকিস্তান প্রদেশ নামে পরিচিত অঞ্চল;
ত. পশ্চিম পাকিস্তানের রাজ্যসমূহ মানে প্রারম্ভিক দিনের অব্যবহিত আগে পাঞ্জাব, সিন্ধু, উত্তর – – পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ ও বেলুচিস্তান প্রদেশ নামে পরিচিত এলাকাসমূহ;
থ. রাজ্য পরিষদ মানে কোন রাজ্যের পরিষদ;
দ. রাজ্য সরকার মানে কোন রাজ্যের কার্যনির্বাহক সরকার;
ধ. রাজ্য আইন পরিষদ মানে একটা রাজ্যের আইন পরিষদ।

৩. ১৯৬৯ সালের ২৫শে মার্চের সামরিক আইন ঘোষণা বাতিল হয়ে যাওয়ার ফলে এই ঘোষণা থেকে কিংবা ঘোষণার অধীনে ক্ষমতা প্রাপ্ত সব লোক ও আদালতসহ সামরিক আইন কর্তৃপক্ষ বাতিল হয়ে যায়।
৪. ক. সব সামরিক আইন বিধি ও সামরিক আইন আদেশ এবং অস্থায়ী শাসনতন্ত্র আদেশ এতদ্বারা বাতিল হয়ে যাবে।
খ. এই ঘোষণাপত্র সাপেক্ষে সব চলতি আইন উপযুক্ত আইন পরিষদ কর্তৃক সংশোধন বা বাতিল না করা পর্যন্ত যতটা প্রযোজ্য এবং প্রয়োজনীয় উপযগীকরণসহ বলবৎ থাকবে।
গ. চলতি কোন আইনের ব্যবস্থাকে এই ঘোষণাপত্রের ব্যবস্থার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ করার উদ্দেশ্যে কেন্দ্রীয় আইন ক্ষেত্র সংক্রান্ত ব্যাপারে প্রেসিডেন্ট এবং রাজ্য আইন ক্ষেত্র সংক্রান্ত ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট রাজ্যের গভর্নর আদেশেক্রমে তা উপযোগী করে নিতে পারে। এই উপযোগীকরণ সংশোধন, সংযোজন বা বর্জনের আকারে হতে পারে এর মধ্য যেটা তিনি প্রয়োজনীয় বা সুবিধাজনক মনে করেন। এভাবে তৈরি কোন আদেশ অন্য আদেশ অন্য কোন রকমের ব্যবস্থা না থাকলে তা প্রারম্ভিক দিন থেকে কার্যকরী হবে কিংবা কার্যকরী বলে মনে করা হবে।
ঘ. চলিতি কোন আইন বলবত করার জন্য প্রয়োজনীয় বা ক্ষমতাপ্রাপ্ত কোন আদালত বা ট্রাইবুনাল বা কর্তৃপক্ষ [গ] উপ – অনুচ্ছেদের অধীনে তৈরি কোন আদেশ দ্বারা এধরণের আইনের সত্যিকার কোন উপযোগিকরণ না হওয়া সত্ত্বেও এই ঘোষণাপত্রের ব্যবস্থার সঙ্গে সামঞ্জস্যে আনার জন্যে এ ধরণের প্রয়োজনীয় উপযোগিকরনসহ আইনের ব্যাক্যা করবেন।
ঙ. এই নিবন্ধে ‘চলতি আইন’ মানে আইন, অর্ডিনেন্স, আদেশ, নিয়ম, বিধি, উপবিধি, বিজ্ঞপ্তি বা অন্য কোন আইনগত ব্যবস্থা বা প্রারম্ভিক দিনের অব্যবহিত আগে পাকিস্তান বা পাকিস্তানের কোন অংশে আইনের শক্তি ছিল বা অঞ্চল বহির্ভূত বৈধতা ছিল।
৫. ক. প্রারম্ভিক দিনের অব্যবহিত আগে কোন সামরিক আদালত কিংবা সংক্ষিপ্ত সামরিক আদালতে অমীমাংসিত প্রত্যেকটি মামলা প্রারম্ভিক দিনে ফৌজদারী আদালতে স্থানাতরিত হয়ে যাবে এবং এই আদালত সাধারণ আইন অনুযায়ী অপরাধের বিচার করতে পারবেন।
খ. উপ অনুচ্ছেদ ক এর অধীনে কোন ফৌজদারী আদালতে স্তানান্তরিত কোন মামলার বেলায় এধরণের কোন মামলার বিচার প্রযোজ্য পদ্ধতি অনুসারে সাধারণ আইনের ব্যবস্থা অনুযায়ী বিচার করা হবে।
গ. প্রারম্ভিক দিনের অব্যবহিত আগে কোন সামরিক আদালত কর্তৃক মীমাংসা করা হয়েছে ও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে অথচ অনুমোদন বাকী রয়েছে এমন সব মামলা এবং এই দিন পর্যন্ত বাকী রয়েছে পর্যালচনা আবেদন ও দরখাস্ত যদি পশ্চিম পাকিস্তানের রাজ্যগুলোর সংশ্লিষ্ট হয় তবে পাকিস্তান সেনাবাহিনী প্রধান এবং বাংলাদেশ রাজ্যের সংশ্লিষ্ট হলে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার জি ও সি প্রারম্ভিক দিনের পরে সেগুলো দেখবেন এবং মীমাংসা করবেন।
ঘ. যদি কোন ব্যক্তি সামরিক আইন কর্তৃপক্ষের কোন রায় বা দন্ডে যদি মনে করেন যে, তার প্রতি অন্যায় করা হয়েছে তবে তিনি এধরনের রায় বা দন্ডের বিরুদ্ধে কোন আবেদন পত্র পেশ না করে থাকলে তা পশ্চিম পাকিস্তানের রাজ্যগুলোর সংশ্লিষ্ট হলে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলিয় কমান্ডার জি ও সির কাছে পাঠানো যেতে পারে। এ ধরণের কোন আবেদনের বেলায় উল্লেখিত কর্তৃপক্ষ ইচ্ছা করলে কোন রকম শর্তসহ কিংবা শর্ত ছাড়া কোন দন্ডের ক্ষমা মঞ্জুর কিংবা মার্জনা, হ্রাস, লঘুদন্ডদান কিংবা দন্ড বাতিল করে দিতে পারেন।
ঙ. এই ঘোষণাপত্রের ব্যবস্থা সাপেক্ষে সামরিক আইন মেয়াদের সময় কোন সামরিক আইন কর্তৃপক্ষের দেয়া কোন দন্ড আইনগতভাবে দেয়া হয়েছে বলে মনে করা হয় এবং তাদের দন্ড মেয়াদ অনুযায়ী কার্যকরী হতে থাকবে।
চ. সামরিক আইন চলাকালে কোন সামরিক কর্তৃপক্ষের দেয়া কারাদন্ড যদি সামরিক আইন মেয়াদে কার্যকরী করা না হয়ে থাকে তবে দণ্ডাদেশ প্রাপ্ত ব্যক্তিকে যে জেলায় পাওয়া যাবে সে জেলার জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের পরওয়ানায় তা কার্যকরী করা যেতে পারে।
ছ. সামরিক আইন চলাকালে কোন সামরিক আইন কর্তৃপক্ষের দেয়া জরিমানা দন্ড যদি কার্যকরী না করা হয়ে থাকে তবে দণ্ডাদেশ প্রাপ্ত ব্যক্তি যে জেলায় থাকে সে জেলার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট তা কার্যকরী করতে পারেন, যেন এটা ১৮৯৮ সালের ফৌজদারী বিধি ( ১৮৯৮ সালের ৫ নম্বর আইন ) অধীনে তারই দেয়া জরিমানা দন্ড। তবে উল্লেখিত আইনের ২৯ নম্বর পরিচ্ছেদের ব্যবস্থাবলী এধরণের কোন দন্ডের বেলায় প্রযোজ্য হবে না।
জ. এই ঘোষণা পত্রের ব্যাবস্থা ছাড়া অন্য কোন আদালত বা কর্তৃপক্ষ সামরিক আইন চলাকালে কোন সামরিক আইন কর্তৃপক্ষ কিংবা কোন সামরিক আইন কর্তৃপক্ষের পক্ষে কোন লোক সামরিক আইন প্রশাসনের ব্যাপারে যদি কিছু করে থাকেন কিংবা কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকেন তবে তার বৈধতা বা যথার্থতার ব্যাপারে কোন প্রশ্ন তুলতে পারবেন না।
ঝ. সামরিক আইন চলাকালে কোন সামরিক আইন কর্তৃপক্ষ কিংবা কোন সামরিক আইন কর্তৃপক্ষের পক্ষে কার্য সম্পাদনকারী কোন লোক সামরিক আইন প্রশাসনের ব্যাপারে যদি কিছু করে থাকেন বা করেছেন বলে বুঝানো হয়ে থাকে তবে তার বিরুদ্ধে কোন আদালত বা কর্তৃপক্ষ কোন রকম মামলা গ্রহণ করবে না।
৬. অস্থায়ী শাসনতন্ত্র আদেশ ( অরেসিডেন্টের ১৯৬৯ সালের আদেশ ২ নম্বর আদেশ ) বাতিল হওয়া সত্ত্বেও অন্তর্বর্তীকালীন মেয়াদে ঘোষণা পত্রের ব্যাবস্থাসাপেক্ষে এবং ঘোষণাপত্র ও সময়সূচীর দ্বারা যে সব বর্জন, সংযোজন, উপযোগীকরণ ও সংশোধন করা হবে সেগুলো সাপেক্ষে যতদুর সম্ভব পাকিস্তান বিগত শাসন্তন্ত্রের ব্যবস্থা অনুযায়ী শাসিত হবে।
৭. প্রারম্ভিক দিনের অব্যবহিত আগে যিনি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট পদে অধিষ্ঠিত থাকবেন প্রারম্ভিক দিন থেকেও তিনি প্রেসিডেন্ট, পাকিস্তান সেনাবাহিনী প্রধান এবং পাকিস্তান সশস্ত্রবাহিনী প্রধানের দায়িত্ব হাতে রাখবেন যতদিন পর্যন্ত না পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদ দ্বারা প্রণীত একটা শাসনতন্ত্র অনুসারে একজন রাষ্ট্র প্রধান দায়িত্বভার গ্রহণ করেন আর তিনি যে নামেই পরিচিত হন না কেন।
৮. ১. অন্ত্ররবর্তীকালীন সময়েঃ
ক. প্রেসিডেন্ট হবেন রাষ্ট্রের কার্যনির্বাহী প্রধান এবং ঘোষণা পত্রের ব্যাবস্থাসাপেক্ষে তিনি সব ক্ষমতা প্রয়োগ করবেন প্রেসিডেন্ট বিগত শাসন্তন্ত্রের দ্বারা কিংবা অধীনে কিংবা আপাতত বলবৎ কোন আইনের দ্বরা কিংবা অধীনে প্রেসিডেন্টের যে ক্ষমতা রয়েছে তা তিনি কার্যকরী করতে পারবেন। প্রেসিডেন্ট এসব কাজ – কর্ম পরিচালনার ব্যাপারে তাকে সাহায্য করা ও পরামর্শ দেয়ার জন্য যতজন উপদেষ্টা নিয়োগের প্রয়োজন মনে করেন ততজন তিনি নিয়োগ করতে পারবেন।
খ. প্রেসিডেন্ট এই ঘোষণাপত্র সাপেক্ষে কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা প্রয়োগ করবেন।
২. জাতীয় পরিষদ কিংবা কোন রাজ্য পরিষদ বাতিল বা ভেঙে দেয়ার ক্ষমতা অরেসিডেন্টের থাকবে না।
৩. অন্তর্বর্তীকালীন মেয়াদে প্রেসিডেন্ট কেন্দ্রীয় সরকারের আইনগত যোগ্যতার আওতার মধ্যে অর্ডিনেন্স জারী করে কোন বিষয়ে আইন তৈরি করতে পারেন।
৯. ১. প্রারম্ভিক দিন থেকে প্রেসিডেন্টের ১৯৭০ সালের ২ নম্বর আদেশের অধীনে নির্বাচিত প্রাদেশিক পরিষদগুলো রাজ্যপরিষদ হিসেবে কাজ করবে।
২. অন্তর্বর্তীকালীন মেয়াদে এই ঘোষণা পত্র অনুসারে একটি রাজ্য সরকার ও একটি রাজ্য আইন পরিষদ কাজ করবে।
১০. ১. কেন্দ্রীয় আইন পরিষদ তফসীল উল্লিখিত কোন কিছুর ব্যাপারে সমগ্র পাকিস্তান কিংবা পাকিস্তানের যে কোন অংশের জন্যে আইন ( অঞ্চলে বহির্ভূত বিষয়ের আইনসহ ) তৈরি করার একচেটিয়া ক্ষমতা থাকবে, এবং ঘোষণা পত্রের ১৩ নম্বর অনুচ্ছেদে উল্লেখিত কোন বিষয়ে পশ্চিম রাজ্যের কোন রাজ্যের সর্বত্র কিংবা রাজ্যের যে কোন অংশের জন্যে আইন তৈরি করার ক্ষমতাও থাকবে।
২. কেন্দ্রীয় আইন পরিষদ বিগত শাসনতন্ত্রের তৃতীয় তফসীল কিংবা এই ঘোষণা পত্রের ১৩ নম্বর অনুচ্ছেদ উল্লেখিত নেই এমন কোন বিষয়ে ইসলামাবাদ ও ঢাকার রাজধানী এলাকার জন্যে আইন ( তবে একচেটিয়া নয় ) তৈরি করতে পারবেন।
১১. বাংলাদেশ রাজ্য আইন পরিষদ এই ঘোষণাপত্রের ১৩ নম্বর অনুচ্ছেদে উল্লিখিত বিষয় ছাড়া অন্য কোন বিষয়ে সমগ্র রাজ্যের বা রাজ্যের যে কোন অংশের জন্য আইন তৈরি করতে পারবেন, পশ্চিম পাকিস্তানের কোন রাজ্যের রাজ্য আইন পরিষদ বিগত শাসনতন্ত্রের ৩য় তফসীলে উল্লেখিত কোন বিষয় ছাড়া অন্য যে কোন বিষয়ে সমগ্র রাজ্যের যে কোন অংশের জন্য আইন তৈরি করতে পারবেন।
১২. রাজ্যের সংখ্যাগরিষ্ঠ পার্লামেন্টারী দলের নেতার পরামর্শে প্রেসিডেন্ট একজন রাজ্য গভর্নর নিযুক্ত করবেন এবং অন্তর্বর্তীকালীন সময়ে তিনি ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকবেন।
১৩. ১. বাংলাদেশ রাজ্যের বেলায় কেন্দ্রীয় আইন পরিষদের কেবলমাত্র নিম্ন লিখিত বিষয়গুলোর ব্যাপারে আইন তৈরি করার একচেটিয়া ক্ষমতা থাকবেঃ
ক. পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা
খ. বৈদেশিক বাণিজ্য ও সাহায্য ছাড়া বৈদেশিক বিষয়
গ. পাকিস্তান থেকে কোন লোকের গমন এবং কোন লোকের পাকিস্তানে প্রবেশসহ নাগরিকত্ব দেশীয়করন ও বিদেশীদের অন্যান্য বিষয়;
ঘ. ঘোষণাপত্রের ১৬ নম্বর অনুচ্ছেদ সাপেক্ষে মুদ্রা, বৈধ নোট ও ষ্টেট ব্যাংক;
ঙ. কেন্দ্রের সরকারী ঋণ
চ. মান এবং ওজন ও পরিমাপ
ছ. কেন্দ্রের সম্পত্তির রাজস্ব তা যেখানেই অবস্থিত হোক না কেন
জ. আন্তঃপ্রাদেশিক ও আন্তর্জাতিক যোগাযোগ সমন্বয়;
ঝ. প্রেসিডেন্ট, জাতীয় পরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন এবং প্রধান নির্বাচন কমিশনার, নির্বাচন কমিশনার, স্পিকার, ডেপুটি স্পীকার ও জাতীয় পরিষদের অন্যান্য ভাতা; জাতীয় পরিষদের ক্ষমতা, অধিকার বাধ্যবাধকতা;
ঞ. সুপ্রিম কোর্ট হব পাকিস্তান
ট. মোকদ্দমা ও বিচার ইত্যাদি যে প্রদেশের বা রাজ্যের হবে তার বাইরে সার্ভিস ও দন্ড বিধান,
ঠ. উপরে উল্লেখিত যে কোন বিষয়ের ব্যাপারে আইন বিরোধী আপরাধ।
২. পশ্চিম পাকিস্তানের রাজ্যগুলোর বেলায় বিগত শাসন্তন্ত্রের তিন নম্বর তফসিলে উল্লেখিত নির্দিষ্ট বিষয়গুলোর ব্যাপারে আইন তৈরি করা ও একচেটিয়া ক্ষমতা কেন্দ্রীয় আইন সভায় থাকবে। পশ্চিম পাকিস্তান আইন সম্মেলনের সদস্যদের মধ্য সম্পাদিত এ ধরণের চুক্তি অনুযায়ী এই ব্যাবস্থা পরিবর্তন সাপেক্ষ। ঘোষণাপত্রের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে এই আইন সম্মেলন গঠন করা হবে।
১৪. ১. প্রারম্ভিক দিনের আগে কেন্দ্রীয় আইন সভার দ্বারা কিংবা এর অধীনে বাংলাদেশ রাজ্যের মধ্যে যে সব শুল্ক ও কর ধার্য ও আদায় করা হত তা বাংলাদেশ সরকার আদায় করবেন এবং কেন্দ্রীয় সরকার ১৯৭০-৭১ সালের কেন্দ্রীয় বাজেটে যেমন ব্যাবস্থা রেখেছেন তেমনি বাংলাদেশে কেন্দ্রীয় সরকারের অর্থনৈতিক বরাদ্দ ও খরচের হিসাবপত্রের পর যে অর্থ অবশিষ্ট থাকবে বাংলাদেশ সরকার তা কেন্দ্রীয় সরকারকে ফেরৎ দেবেন। এধরণের হিসাবে বাংলাদেশ সরকার যদি কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে অর্থ পাওনা হয় তবে কেন্দ্রীয় সরকার সে পরিমাণ অর্থ বাংলাদেশ সরকার কে ফেরৎ দেবেন।
২. বাংলাদেশ রাজ্যের সব বৈদেশিক মুদ্রা আর বাংলাদেশ রিজার্ভ ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণে একটি পৃথক একাউন্ট থাকবে এবং রিজার্ভ ব্যাংক তা বিতরণ করবে।
৩. প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে আলাপ আলোচনার পর ব্যাবস্থা তৈরি করবেন যার ভিত্তিতে বাংলাদেশ সরকার ১৯৭০- ৭১ অর্থ বছরের অবশিষ্ট সময়ের জন্য কেন্দ্রীয় বাজেটের বৈদেশিক মুদ্রে চাহিদায় অর্থ দেবেন।
১৫. ১. ঢাকার ষ্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তানের নাম পরিবর্তন করে রিজার্ভ ব্যাংক অব বাংলাদেশ রাখা হবে এবং বাংলাদেশ ষ্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তানের সব শাখা হবে রিজার্ভ ব্যাংক অব বাংলাদেশের শাখা।
২. রিজার্ভ ব্যাংক অব বাংলাদেশ এবং এর শাখাসমূহ বাংলাদেশের আইন পরিষদের আইনগত নিয়ন্ত্রণে থাকবে।
৩. বাংলাদেশ রিজার্ভ ব্যাংক ধারা ৪. এ বর্ণিত ক্ষমতাসাপেক্ষে বাংলাদেশ রাজ্যের ব্যাপারে এমন সব ক্ষমতা, কাজ ও কর্তব্য প্রয়োগ করবেন যেগুলো প্রারম্ভিক দিনের অব্যবহিত আগে ষ্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তান সমগ্র পাকিস্তানের বেলায় প্রয়োগ করতেন। ষ্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তান ধারা ৪. এ বর্নিত ক্ষমতা প্রয়োগ করতে থাকবেন।
৪. বাংলাদেশ রাজ্যের বেলায় ষ্টেট ব্যাংক নিম্নলিখিত ক্ষমতাগুলো প্রয়োগ করবেন
ক. কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে টাকার বৈদেশিক বিনিময় হার সুপারিশ করবেন।
খ. বাংলাদেশের অবভ্যান্তরে চালু করার জন্য রিজার্ভ ব্যাংক অব বাংলাদেশের অনুরোধে রিজার্ভ ব্যাংকের দেয়া সম্পদের বিনিময়ে নোট ও মুদ্রা ইস্যু করা;
গ. টাকশাল ও সিকিউরিটি প্রেসের রক্ষণাবেক্ষণ ও নিয়ন্ত্রনঃ
ঘ. আন্তর্জাতিক অর্থ সংক্রান্ত প্রতিষ্ঠান গুলোর সম্পর্কে এমন সব কাজ করা যা স্বাভাবিকভাবে ষ্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তান করে থাকেন। তবে এ ধরণের কাজ বাংলাদেশের রিজার্ভ ব্যাংকের নির্দেশ অনুযায়ী হতে হবে।
১৬. ১. ১৯৭১ সালের ৯ই এপ্রিল
ক. বাংলাদেশ রাজ্য থেকে নির্বাচিত জাতীয় পরিষদ সদস্যরা বিকাল ৪টায় ঢাকায় পরিষদ ভবনে এক আইন সম্মেলনে বসবেন এবং সম্মেলনে বসার দিন থেকে ৪৫ দিনের মধ্যে বাংলাদেশ রাজ্যের জন্য একটা শাসনতন্ত্র তৈরির জন্য কাজ চালিয়ে যাবেন;
খ. পশ্চিম পাকিস্তানের রাজ্যগুলো থেকে নির্বাচিত জাতীয় পরিষদের সদস্যরা ১৯৭১ সালের ৯ই এপ্রিল বিকাল ৪টায় ইসলামাবাদে ষ্টেট ব্যাংক ভবনে একটি আইন সম্মেলনে বসবেন এবং বসার দিন থেকে ৪৫ দিনের মধ্যে পশ্চিম পাকিস্তানের রাজ্যগুলোর জন্যে একটি শাসনতন্ত্র তৈরির কাজ চালিয়ে যাবেন।
২. প্রত্যেক আইন সম্মেলন একজন চেয়ারম্যান নির্বাচিত করবেন। তিনি বৈঠকের তারিখ ও সময় এবং সম্মেলনের অধিবেশন পরিচালনার পদ্ধতি সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেবেন। তবে চেয়ারম্যানের নির্বাচনসহ অন্য সব সিদ্ধান্ত সংখ্যাগরিষ্ঠ ভটের দ্বারা নেয়া হবে।
.

.
.
(৩) উপ-অনুচ্ছেদ (১) এর অধীনে বাংলাদেশ রাজ্য এবং পশ্চিম পাকিস্তানের রাজ্যগুলোর শাসনতন্ত্র তৈরী হয়ে যাওয়ার পর এবং নিজ চেয়ারম্যান যখন প্রেসিডেন্ট লিখিতভাবে জানান যে উপ-অনুচ্ছেদ (১) এর শাসনতন্ত্র তৈরী করা হয়েছে তখন প্রেসিডেন্ট জাতীয় পরিষদের এক অধিবেশন ডাকবেন যাতে সব সদস্য পাকিস্তান কনফেডারেশনের জন্য একটি শাসনতন্ত্র তৈরীর উদ্দেশ্যে একটি সার্বভৌম সংস্থা হিসেবে অধিবেশনে মিলিত হবে।

(৪) এই ঘোষনাপত্রের দ্বারা প্রেসিডেন্টের ১৯৭০ সালের ২ নম্বর আদেশ সংশোধনসাপেক্ষে এই আদেশে যে পদ্ধতির ব্যবস্থা রয়েছে উপ-অনুচ্ছেদ (৩) এর অধীনে সমগ্র পাকিস্থানের জন্যে একটি শাসনতন্ত্র তৈরী করার কাজে সে পদ্ধতি অনুসরন করা হবে।

(৫) প্রধান নির্বাচন কমিশনার বা তাঁর দ্বারা নিয়োজিত কোন ব্যক্তির সামনে উপযুক্ত আইন সম্মেলনের প্রথম বৈঠকে নিম্নোক্ত ধরনের শপথ নিয়ে বা প্রতিজ্ঞা করে জাতীউ পরিষদের সদস্যরা প্রেসিডেন্টের ১৯৭০ সালের ২ নম্বর আদেশে ১২ নম্বর অনুচ্ছেদের ব্যবস্থাগুলো মেনে নিয়েছেন বলে মনে করা হবে। শপথ নিম্নরুপ ‘আমি ‘ক,খ’ শপথ নিচ্ছি/প্রতিজ্ঞা করছি যে, আমি আইনগতভাবে প্রতিষ্ঠিত পাকিস্থানের শাসনতন্ত্রের প্রতি বিশ্বাসী হব এবনহ সত্যিকারের আনুগত্য পোষন করব।

(৬) এই অনুচ্ছেদের ‘উপ-অনুচ্ছেদ (৫) এ বর্ণিত শপথ গ্রহন বা প্রতিজ্ঞা করার পর জাতীয় পরিষদের কোন সদস্য সব অধিকার, সুযোগ-সুবিধে, ভাতা ইত্যাদি পাওয়ার যোগ্য হবেন যা আইন অনুসারে জাতীয় পরিষদের একজন সদস্য পেতে পারে।
(৭) প্রেসিডেন্টের ১৯৭০ সালের ২ নম্বর আদেশের ’২৫ নম্বর অনুচ্ছেদের’ পরিবর্তে হবে-
“২৫, জাতীয় পরিষদে পাশ করা শাসনতন্ত্র বিল স্বাক্ষরের জন্য প্রেসিডেন্তের কাছে পেশ করা হবে। এই বিল পেশ করার পর প্রেসিডেন্ট তাতে স্বাক্ষর করবেন এবং কোনক্রমে শাসনতন্ত্র তাঁর কাছে পেশ করার দিন থেকে ৭ দেন শেষ হয়ে গেলে তা স্বাক্ষরিত হয়েছে বলে মনে করা হবে।“
১৭। (১) ঘোষনাপত্রের ব্যবস্থাবলী কার্যকরীভাবে চালু করার জন্যে প্রেসিডেন্ট আদেশক্রমে এমন সব ব্যবস্থা তৈরী করতে পারবেন যা তার কাছে প্রয়োজনী বা উপযোগী বলে মনে হয়।
(২) পূর্বে উল্লেখিত ক্ষমতার সাধারণত্বের প্রতি পূর্ব ধারণা না করে বিশেষ করে নিম্নলিখিত বিষয়সমূহের জন্য ব্যবস্থা রাখা যেতে পারে-
(ক) এই ঘোষনাপত্রের দ্বারা অস্তিত্বে আনা নতুন শাসন্তান্ত্রিক ব্যবস্থাবলী কার্যকরী করার জন্য কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারগুলোর মধ্যে আবশ্যকীয় ক্ষমতা, অধিকার, সম্পদ, কর্তব্য ও দায়িত্ব, ন্যয্যভাবে বন্টন।
(গ) কেন্দ্রিয় সরকারের দায়িত্ব, সম্পদ, অধিকারের অনুগমন ও হস্তান্তর এবং রাজ্যগুলোর মধ্যে এ ধরনের অধিকার ন্যয্যভাবে বন্টন।
(ঘ) কোন রাজ্য এবং তার ক্ষমতা ও কাজের উদ্দেশ্যে অফিসার ও অন্যান্য কর্তৃপক্ষ নিয়োগ ও বদলী এবং রাজ্যগুলোর কাজকর্মের ব্যাপারে কোন সার্ভিসের লোক বরাদ্দ এবং রাজ্যসমূহ ও কেন্দ্রের জন্যে সার্ভিসের গঠনতন্ত্র।
(ঙ) শাসনতান্ত্রিক অবস্থা থেকে এইয় ঘোষনাপত্রের ব্যবস্থাবলীতে স্থানান্তর সম্পর্কিত কোন অসুবিধা দূর করা-যেগুলো এই ঘোষণার প্রারম্ভের আগে পরিলক্ষিত হয়েছিল।
(৩) প্রেসিডেন্ট ‘উপ-অনুচ্ছেদ (২) এ উল্লেখিত বিষয়গুলো বাস্তবায়নের ব্যাপারে কার্যকরী ব্যাবস্থা গ্রহণ এবং এই ঘোষণাপত্র কার্যকরী চালু করার জন্যে প্রয়োজনীয় অন্য সবকিছু করার জন্যে ১১ সদস্যের একটি ‘বাস্তবায়ন পরিষদ’ গঠন অরবেন। এই পরিষদের ৬ জন সদস্য বাংলাদেশ সরকার, ২ জন পাঞ্জাব সরকার এবং সিন্ধু, উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ ও বেলুচিস্থান সরকার একজন করে সদস্য মনোনয়ন করবেন।

তফসীল
.
১। বিগত শাসনতন্ত্রের ৬৭ নম্বর অনুচ্ছেদ পরিবর্তিত হয়ে নিম্ন্রুপ হবে- “৬৭। কোন ব্যক্তি কোন রাজ্যের গভর্নর হিসেবে নিযুক্ত হবেন না যদি তিনি জাতীয় পরিষদের একজন সদস্য হওয়ার যোগ্য না হন।“

২। বিগত শাসনতন্ত্রের ৬৮ নম্বর পরিবর্তিত হয়ে নিম্ন্রুপ হবে-
“৬৭। ক্ষমতায় অদিষ্টিত হওয়ার আগে বাংলাদেশ সরকারের গভর্নর বাংলাদেশের হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতির সামনে এবং পশ্চিম পাকিস্থানের প্রত্যেকটি রাজ্যের গভর্ণর সংশ্লিষ্ট রাজ্যের হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতির সামনে প্রথম তফশীলে উল্লেখিত এমন ধরনের শপথ গ্রহন করবেন যা তাঁর পদের জন্য প্রযোজ্য হয়।“
৩। বিগত শাসনতন্ত্রের ৭০ নম্বর অনুচ্ছেদ পরিবর্তিত হত্যে নিম্নরুপ হবে-
“৭০। বাংলাদেশ রাজ্যের জন্যে একটি আইনসভা থাকবে এবং তা বাংলাদেশ রাজ্য আইন পরিষদ নামে পরিচিত হবে। অনুরুপভাবে পাঞ্জাব, উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, সিন্ধু ও বেলুচিস্তান রাজ্যের প্রত্যেকটির জন্যে একটি করে আইন পরিষদ থাকবে এবং তা নিজ নিজ রাজ্যের রাজ্য পরিষদ নামে পরিচিত হবে।
৪। বিগত শাসনতন্ত্রের ৮০ নম্বর অনুচ্ছেদ পরিবর্তিত হয়ে নিম্নরুপ হবে-
“৮০। (১) রাজ্য সরকার একটি উজির সভা নিয়ে গঠিত হবে এবং উজিরসভার প্রধান হিসেবে থাকবেন মুখ্য উজির; এ ছাড়া থাকবেন ডেপুটি উজিররা। এই অনুচ্ছেদে বর্ণিত পদ্ধতিতে তাদের সবাইকে নিযুক্ত করা হবে।
(২) শাসনতান্ত্রিক ব্যবস্থা সাপেক্ষে কোন রাজ্যের কার্যনির্বাহী ক্ষমতাকে রাজ্য সরকারের কর্তৃপক্ষের দ্বারা কিংবা অধীনে প্রয়োগ করা হবে।
(৩) একটি রাজ্য উজিরসভা রাজ্য আইন পরিষদের কাছে সমবেতভাবে জবাবদিহি থাকবে।
(৪) (ক) গভর্নর রাজ্য আইনসভার একজন সদস্যকে মুখ্য উজির হিসেবে নিয়োগ করবেন যার প্রতি রাজ্য পরিষদের আস্থা রয়েছে।
(খ) মুখ্য উজির নিয়োগের সময় রাজ্য আইন পরিষদের অধিবেশন না বসলে এবং বাতিল থাকলে তখন থেকে দু’মাসের মধ্যে অধিবেশনে মিলিত হওয়ার জন্য আহ্বান জানানো হবে।
(৫) গভর্নর মুখ্য উজিরের পরামর্শ অনুযায়ী অন্যান্য উজির ও সহকারী উজির নিয়োগ করবেন।
(৬) যদি কোন উজির পর পর ছ’মাসের কোন মেয়াদের জন্যে রাজ্য পরিষদের সদস্য না থাকেন তবে এই মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার পর উজির বা সহকারী উজির থাকতে পারবেন না এবং রাজ্য আইনসভা ভেঙ্গে দেয়ার আগে তিনি উজির নিযুক্ত হতে পারবেন না যদি তিনি উপযুক্ত রাজ্য আইন সভার একজন সদস্য নির্বাচিত না হন।
(৭) এই অনুচ্ছেদে এমন কোন ব্যবস্থা থাকবে না যা রাজ্য পরিষদ ভঙ্গ থাকা কালে উজিরসভার সদস্য ও সহকারী উজিরদেরকে দায়িত্বভার চালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে অযো’গ্য ঘোষণা করতে পাবে অথবা এ ধরনের কোন মেয়াদে কোন লোককে মুখ্য উজির বা উজির বা সহ্বমরী উজির হিসেবে নিয়োগ রোধ করতে পারে।
(৮) সন্দেহ মুক্ত হওয়ার জন্যে একথা সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করা হয়েছে যে, গভর্নর তাঁর কজে-কর্ম পরিচালনা করার সময় রাজ্য মুখ্য উজ্যিরর পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করবেন ৷
(৯) মুখ্য উজির গভর্নরের কাছে তাঁর পদত্যাগ পত্র পেশ করে যে কোন সময় পদত্যাগ করতে পারেন ৷
(১০) অন্য কোন উজির কিংবা সহকারী উজির পদত্যাগ করতে চাইলে তাঁকে গভর্নরের কাছে পেশ করার উদ্দেশ্যে মুখ্য উজিরের হাতে পদত্যাগপত্র দিতে হবে ৷
(১১) মুখ্য উজির পরামর্শ দিলে গভর্নর মুখ্য উজির ছাড়া অন্য যে-কোন উজিরের পদত্যাগপত্র গ্রহণ করবেন।
(১২) মুখ্য উজির তাঁর কাছে যথেষ্ট বলে মনে হওয়ার কারণে কোন উজির বা সহকারী উজিরকে পদত্যাগের জন্যে অনুরোধ জানাতে পারেন; সংশ্লিষ্ট উজির এই অনুরোধ মেনে নিতে ব্যর্থ হলে গভর্নর তাঁর নিয়োগ বাতিল করে দেবেন যদি মুখ্য উজির এরকম পরামর্শ দেন।
(১৩) মুখ্য উজির যদি একবার উপযুক্ত রাজ্য আইন পরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের সমর্থন না পান এবং গভর্নর যদি তার পরামর্শ অনুযায়ী এ ধরনের আইন পরিষদ ভেঙ্গে না দেন তবে মুখ্য উজির পদত্যাগ করবেন।
(১8 ) মুখ্য উজির কোন সময় পদত্যাগ করলে অন্য উজির এবং সহকারী উজিররাও পদত্যাগ করেছে বলে মনে করা হবে; তবে তাঁদের স্থলাভিষিক্ত হওয়ার জন্যে নতুন উজির নিয়োগ না করা পর্যন্ত তাঁরা কাজ চালিয়ে যাবেন।
(১৫) আইন সভা ভেঙ্গে দেয়ার দিন ক্ষমতাসীন মুখ্য উজির, অন্য উজির ও ডেপুটি উজিররা তাঁদের স্থলাভিষিক্ত হওয়ার জন্যে নতুন লোক নিয়োগ না করা পর্যন্ত তাঁরা কাজ চালিয়ে যাবেন।“
৫। বিগত শাসনতস্তের ৮১ নম্বর অনুচ্ছেদ পরিবর্তিত করে নিম্নরুপ হবে-৮১। (১) রাজ্য সরকারের সব কার্যনির্বাহী তৎপরতা গভর্নরের নামে নেয়া হয়েছে বলে প্রকাশ করা হবে৷
(২) রাজ্য সরকার আইনের দ্বারা এমন পদ্ধতি নির্দিষ্ট করবেন যাতে গভর্নরের নামে তৈরী ও কার্যকর করা আদেশ ও অন্যান্য ব্যবস্থা স্বাক্ষর করা হবে এবং গভর্নর তা তৈরী বা কার্যকরী করেছেন বলে কোন আদালতে এই স্বাক্ষরিত আদেশ বা ব্যবহার বৈধতা সম্পর্কে কোন প্রশ্ন তোলা যাবে না।
(৩) রাজ্য সরকার তার বরাদ্দ এবং ব্যবসায়িক লেনদেনের জন্যেও আইন তৈরী করবেন।
৬। বিগত শাসনতন্ত্রের ৮২ ও ৮8 নম্বর অনুচ্ছেদ বাদ দেয়া হবে।
৭। বিগত শাসনতন্ত্রের ৮৬ থেকে ৯০ নম্বর পর্যন্ত অনুচ্ছেদ পরিবর্তিত হয়ে নিম্নরুপ হবে-
“৮৬ ৷ এই অংশে “অর্থ বিল” মানে এমন একটি বিল যাতে নীচের বিষয়গুলোর সব কিৎবা যে-কোন একটির কেবলমাত্র ব্যবস্থা সংক্রান্ত ব্যাপার রয়েছে, অর্থাৎ
(ক) কোন কর ধার্য, বিলোপ, লাঘব, পরিবর্তন বা নিয়মিতকরণ;
(খ) রাজ্য সরকার কর্তৃক অর্থ ধার বা কোন গ্যারান্টি দেয়া ৷ কিৎবা সরকারের আর্থিক দায়িত্ব সংক্রান্ত আইনের সংশোধন;
(গ) রাজ্য ‘কনসলিডেটেড’ তহবিলের তত্ত্বাবধান, এই তহবিলে অর্থদান বা এই তহবিল থেকে অর্থ ইস্যু তোলা;
(ঘ) রাজ্য কনসলিডেটেড তহবিলের উপর কোন ভার অর্পণ বা আরোপ কিৎবা এ ধরনের ভার বিলোপ বা পরিবর্তন।

(ঙ) রাজ্যের ‘কনসলিডেটেড’ তহবিলের জ্যন্য অর্থগ্রহণ, কিংবা রাজ্যের ‘পাবলিক একাউন্ট’ বা তত্ত্বাবধান বা এ ধরনের অর্থ ইস্যু; এবং
(চ) উপরের উপধারাগুলোর উল্লিখিত কোন বিষয়ের সঙ্গে কোন বিষয় প্রাসঙ্গিক।
২। কোন বিলকে অর্থবিল হিসেবে মনে করা হবে না কেবল এই কারণেই যে,
(ক) এতে কোন জরিমানা বা অন্য কোন আর্থিক দণ্ড আরোপ বা পরিবর্তন বা লাইসেন্স ফি দাবী কিংবা পরিশোধ বা কোন কাজের জন্যে ফি বা খরচের ব্যবস্থা থাকে; অথবা,
(খ) এতে স্থানীয় উদ্দেশ্যে কোন স্থানীয় কর্তৃপক্ষ বা সংস্থা কর্তৃক কোন কর আরোপ, বিলো’প, মওকুফ বা পরিবর্তনের ব্যবস্থা রয়েছে।
(৩) প্রত্যেকটি অর্থবিল যখন গভর্নরের মতের জ্যন্য পেশ করা হবে তখন তার সঙ্গে স্পীকারের হাতের একটি সার্টিফিকেট থাকবে যে, এটা একটা অর্থ বিল এবং এই সার্টিফিকেট সব উদ্দেশ্যে চূড়ান্ত ও এ ব্যাপারে কোন আদালতে প্রশ্ন তোলা যাবে না।
“৮৭ ৷ এমন কোন বিল বা সংশোধনী ( কেবলমাত্র রাজ্য সরকারের সুপারিশ ছাড়া ) রাজ্য আইন পরিষদে উত্থাপন করা যাবে না বা ৮৬ নম্বর অনুচ্ছেদের (১) নম্বর ধারায় উল্লেখিত কোন বিষয়ের ব্যবস্থার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কিংবা যা আইন সম্মত করে কার্যকরী করা হলে রাজ্যের রাজস্ব, ব্যয় সৃষ্টি করতে পারে।“
“৮৮। রাজ্য আইন পরিষদের কোন আইনের ক্ষমতার দ্বারা বা ক্ষমতার অধীনে ছাড়া কোন রাজ্যের জন্যে কোন কর ধার্য করা যাবে না ৷
“৮৯ ৷ (১) কোন রাজ্য সরকার কর্তৃক সংগৃহীত রাজস্ব, কোন ঋণের পবিশোধের তার দ্বারা সংগৃহীত অর্থ একটা কনসলিডেটেড তহবিলের অংশ বিশেষ হয়ে যাবে এবং এই তহবিল রাজ্য কনসলিডেটেড তহবিল নামে পরিচিত হবে ৷
“৯০। (১) রজ্যে কনসলিডেটেড তহবিলের তত্ত্বাবধান, এই তহবিলে অর্থ দেয়া, এই তহবিল থেকে অর্থ তোলা, রাজ্য সরকারের দ্বারা যা পক্ষে সংগৃহীত জমা দেয়া অর্থ ছাড়া সরকারী অর্থের তত্ত্বাবধান, রাজ্যের ‘পাবলিক একাউন্টে’ অর্থ দেয়া, এ ধরনের একাউন্ট থেকে অর্থ তোলা এব উল্লিখিত বিষয়গুলোর সঙ্গে জড়িত সব বিষয় রাজ্য আইন পরিষদের আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হবে ৷ গভর্নর দ্বারা তৈরী আইনের মাধ্যমে এ ব্যাপারে ব্যবস্থা তৈরী না করা পর্যন্ত চলতে থাকবে ৷
(২) নিম্নোক্ত উপায়ে সংগৃহীত বা জমাকৃত সব অর্থ-
(ক) রাজ্য সরকার কর্তৃক আদায়কৃত বা গৃহীত রাজস্ব ও সরকারী অর্থ ছাড়া রাজ্যের কাজকর্ম পরিচালনার জন্যে নিযুক্ত কোন অফিসার তার ক্ষমতার আওতায় যে অর্থ সংগ্রহ করবেন;
(খ) রাজ্যের কাজ-কর্ম সংক্রান্ত ব্যাপারে কোন বিষয়, লোক বা কারণের জন্যে দেয় কোন কোর্ট ফি রাজ্যের ‘পাবলিক একড়াউন্টে’ দেয়া হবে ৷
৪১। বিগত শাসনতন্ত্রের ৯০ নম্বর অনুচ্ছেদের পর পরই নিম্নোক্ত নূতন অনুচ্ছেদগুলো যোগ করতে হবে এবং সেগুলোর নম্বর হবে ৯০-ক থেকে ৯০-চ পর্যন্ত।
“৯০-ক। (১) রাজ্য সরকার প্রত্যেক অর্থ বছরের ব্যাপারে রাজ্য সরকারের ব্যাপারে ঐ বছরের জন্যে রাজ্য সরকারের আনুমানিক আয় ও ব্যয়ের একটা বিবৃতি রাজ্য আইন পরিষদে পেশ করবেন। এই অংশে তা ‘বার্ষিক আর্থিক বিবৃতি’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
(২) বাৎসরিক আর্থিক বিবৃতি পৃথকভাবে দেখানো হবে-
(ক) শাসনতন্ত্রের ‘ব্যয়’ হিসেবে বর্ণিত ব্যয় মেটানোর জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ রাজ্য কনসলিডেটেড তহবিল দেবেন;
(খ) অন্যান্য যে-সব প্রয়োজন মেটানোর জন্যে রাজ্য কনসলিডেটেড তহবিল থেকে অর্থ দেয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে; এবং
রাজস্ব হিসেবের ব্যয় অন্যান্য ব্যয় থেকে পৃথকভাবে দেখানো হবে।
“৯০-খ। রাজ্য কনসলিডেটেড তহবিলকে নিম্নোক্ত ব্যয় তার বহন করতে হবে-
(ক) গভর্নরের বেতন ও ভাতা এবং তাঁর দফতর সংশ্লিষ্ট অন্যান্য ব্যয়, এবং
(১) হাইকোর্টের বিচারক;
(২) রাজ্য পাবলিক সার্ভিস কমিশনের সদস্য; এবং
(৩) রাজ্য পরিষদের স্পীকার ও ডেপুটি স্পীকারের বেতন ও ভাতা ৷
(খ) রাজ্য আইন পরিষদ সেক্রেটারীয়েট, রাজ্য পাবলিক সার্ভিস কমিশন এবং হাইকোর্টের কর্মচারী ও অফিসারদের দেয় বেতনসহ অন্যান্য প্রশাসনিক ব্যয়;
(গ) সুদ, ‘সিংকিং-ফান্ড’ খরচ, মূলধন পরিশোধ বা ‘সিংকিং তহবিলের’ মাধ্যমে ঋণ হ্রাস ও ঋণ তোলার ব্যাপারে অন্যান্য খরচসহ ঋণ খরচ-যার জন্যে রাজ্য সরকার দায়ী এবং রাজ্য কনসলিডেটেড তহবিলের সিকিউরিটির ওপর ঋণ সার্ভিস ও পুনঃ ক্রয়;
(ঘ) কোন আদালত বা ট্রাইবুনাল কর্তৃক রাজ্যের বিরূদ্ধে কোন বিচার, ডিক্রি বা রায়কে নিঃসন্দেহ করার জন্যে প্রয়োজনীয় অর্থ;
(ঙ) শাসনতন্ত্র বা রাজ্য আইন পরিষদের আইন দ্বারা ঘোষিত অর্থ যে পরিমাণ অর্থ দেয় ৷
.
.
“৯০-গ। (১) বার্ষিক আর্থিক বিবৃতির ততটা নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে যা রাজ্য কনসলিডেটেড তহবিলের ওপর ধার্য করা খরচ সংক্রান্ত, তবে তা রাজ্য আইন পরিষদের ভোটের জন্য পেশ করা হবে না।
(২) বার্ষিক আর্থিক বিবৃতির ততটা পর্যন্ত মঞ্জুরী দাবীর আকারে রাজ্য আইন পরিষদে পেশ করা যেতে পারে যা অন্যান্য ব্যয় সংশ্লিষ্ট এবং আইন পরিষদ তাতে উল্লেখিত অর্থের পরিমাণ হ্রাস সাপেক্ষে কোন দাবীর ব্যাপারে মত দিবে পারবেন।
(৩) রাজ্য সরকারের সুপারিশ ছাড়া কোন মঞ্জুরীর দাবী করা যাবে না।
“ ৯০-ঘ। (১) আগের অনুচ্ছেদের ব্যবস্থার অধীনে আইন পরিষদ কর্তিক মঞ্জুরী দেয়ার পর নিন্মোক্ত বিষয়গুলির সব অর্থ মেটানোর উদ্দেশ্যে রাজ্য কনসলিডেটেড তহবিল থেকে অর্থ তোলার ব্যবস্থা সম্বলিত একটি বিল আইন পরিষোদে উত্থাপন করা হবে-
(ক) রাজ্য আইন পরিষদ কর্তৃক এভাবে মঞ্জুরী; এবং (খ) রাজ্য কনসলিডেটেড তহবিলের ওপর ধার্য করা ব্যয়।
তবে এই অর্থের পরিমাণ কোনক্রমেই রাজ্য আইন পরিষদে আগে পেশ করা বিবৃতিতে দেখানো অর্থের পরিমাণের চেয়ে বেশী হবে না।
(২) এ ধরনের কোন বিলের ওপর সংশোধন প্রস্তাব করা যাবে না যার ফলে এভাবে দেয়া কোন মঞ্জুরীর পরিমাণ বা লক্ষ্য পরিবর্তিত হয়ে যেতে পারে।
(৩) শাসনতন্ত্রের ব্যবস্থা সাপেক্ষে এই অনুচ্ছেদের ব্যবস্থা অনুযায়ী আইন দ্বারা পাশ করা অর্থ তোলার ব্যবস্থা ছাড়া রাজ্য কনসলিডেটেড তহবিল থেকে কোন অর্থ তোলা যাবে না।

৯০- ঙ। কোন অর্থ বছরের বেলায় যদি দেখা যায় যে;
(ক) চলতি অর্থ বছরে কোন একটা কাজের জন্যে ব্যয় করার অনুমোদিত অর্থ যদি অপর্যাপ্ত হয়, বা নতুন কোন কাজের জন্যে ব্যয় করা প্রয়োজন হয়ে পড়ে যা ঐ বছরের বার্ষিক বিবৃতিতে নেই অথবা
(খ) কোন অর্থ বছরে কোন কাজের জন্য মঞ্জুর করা অর্থের চেয়ে যদি বেশী খরচ হয়ে যায়, তবে-
রাজ্য সরকার রাজ্য কনসলিডেটেড তহবিল থেকে খরচ অনুমোদন করতে পারবেন যদি এই খরচ শাসনতন্ত্র অনুযায়ী তহবিলের ওপর ধার্য করা হয় কিংবা ঐ পরিমাণ খরচ সংক্রান্ত একটা অতিরিক্ত আর্থিক বিবৃতি রাজ্য আইন পরিষদে পেশ করতে হবে না। এবং ৯০-ক থেকে ৯০-ঘ অনুচ্ছেদের ব্যবস্থাবলী উল্লিখিত বিবৃতির বেলায় প্রয়োগ করা হবে, যেমন বার্ষিক আর্থিক বিবৃতির বেলায় প্রয়োগ করা হয়।
৯০-চ। (১) এই পরিচ্ছেদের পূর্বে উল্লিখিত ব্যবস্থা গুলোতে কোন কিছু সত্ত্বেও কোন রাজ্য আইন পরিষদের নিন্মোক্ত ক্ষমতা থাকবে,
(ক) কোন অর্থ বছরের কোন অংশের জন্য আনুমানিক ব্যয়ের ব্যাপারে অগ্রিম কোন মঞ্জুরী দেয়া; এই ব্যয়ের ব্যাপারে ৯০-ঘ অনুচ্ছেদের ব্যবস্থা অনুযায়ী আইন পাশ ও এ ধরনের মঞ্জুরের ব্যাপারে ভোট গ্রহণের জন্য ৯০-গ অনুচ্ছেদ বর্ণিত পদ্ধতির সম্পাতি বাকি রেখে এই মঞ্জুরী দেয়া;
(খ) রাজ্যের সম্পদের ওপর একটা অপ্রত্যাশিত দাবি মেটানোর জন্য কোন মঞ্জুরী দেয়া, যখন কাজের গুরুত্ব ও অনির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্যের দরুন বার্ষিক আর্থিক বিবৃতিতে সাধারণভাবে দেয়া বিস্তারিত বিবরণে এই দাবী উল্লেখ করা যায় না।
(গ) কোন অতিরিক্ত মঞ্জুরী দেয়া যা কোন অর্থ বছরের চলতি কোন কাজের অংশ নয়, এবং যে উদ্দেশ্যে এই মঞ্জুরী দেয়া হয়েছে সে উদ্দেশ্যে রাজ্য কনসলিডেটেড তহবিল থেকে অর্থ তোলার ব্যাপারে আইনের অধীনে অনুমোদন দেয়ার ক্ষমতা আইন পরিষদের থাকবে।
(২) ৯০-গ ও ৯০-ঘ অনুচ্ছেদের ব্যবস্থাবলী (১) নম্বর ধারা এবং এই ধারার বলে তৈরী অন্য কোন আইনের অধীনে কোন মঞ্জুরী দেয়ার ব্যাপারে কার্যকরী হবে, কারণ সেগুলোকে বার্ষিক আর্থিক বিবৃতিতে উল্লিখিত কোন ব্যয় এবং রাজ্যের অর্থ থেকে তোলার অনুমোদনের জন্য তৈরী কোন আইনের বেলায় কার্যকরী কনসলিডেটেড তহবিল এ ধরনের ব্যয় মেটাবে।“
৮। ৯১ নম্বর অনুচ্ছেদের ১ নম্বর ধারার পরিবর্তে নিন্মরূপ হবে-
“৯১। বাংলাদেশ রাজ্যের একটি এবং পশ্চিম পাকিস্তানের রাজ্যগুলোর জন্য একটি করা হাইকোর্ট থাকবে।“
৯। (১) বিগত শাসনতন্ত্রের ৯২নম্বর অনুচ্ছেদের ২ নম্বর ধারার উপধারা (খ) বাদ যাবে।
(২) ২ নম্বর ধারার উপধারা (গ) উপধারা (খ) হিসেবে ধরা হবে।
১০। বিগত শাসনতন্ত্রের ৯৯,১০৩,১০৪,১০৫,১০৭,১০৮,১১২,১১৩,১১৪ নম্বর অনুচ্ছেদ এবং ১৩১ নম্বর অনুচ্ছেদের পরিবর্তে নিন্মরূপ হবে।
“১৩৪। কোন আইন পরিষদ কর্তৃক কোন বিষয়ে তৈরী কোন আইন আইন- তৈরীর ক্ষমতার আওতার মধ্যে না হলে তা বাতিল হয়ে যাবে।
১২। বিগত শাসনতন্ত্রের ১৩৭ নম্বর অনুচ্ছেদ বাদ যাবে।
১৩। এই শাসনতন্ত্রের ১৩৮ নম্বর অনুচ্ছেদ পরিবর্তিত হয়ে নিন্মরূপ হবে-
“১৪০। কোন রাজ্যের শাসন ক্ষমতা রাজ্য কনসলিডেটেড তহবিলের সিকিউরিটির বিনিময়ে এমন একটা সীমার মধ্যে অর্থ ধার করতে পারবেন, যদি রাজ্য আইন সভার আইনে এমন কোন সীমার ব্যবস্থা থাকে, এবং এই সীমার মধ্যে গ্যারান্টি দিতে পারবেন, যদি এমন কোন ব্যবস্থা থাকে।“

.
.
পরিশিষ্ট- “ছ”
প্রধান প্রধান নৃশংসতার তালিকা
( ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চের আগে সন্ত্রাস ও অরাজকতার তালিকা তৃতীয় পরিচ্ছেদে “পূর্ব পাকিস্তানে সন্ত্রাস” শীর্ষে বর্ণিত হয়েছে। )

জেলা তারিখ ও এলাকা
ঘটনা

চট্টগ্রাম
১৬-৩০শে মার্চ,
১৯৭১
চট্টগ্রাম শহর
শহরটি, ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট (ইবিআর) ইষ্ট পাকিস্তান রাইফেলস (ইপিআর) এবং আওয়ামী লীগ (এএল) স্বেচ্ছাসেবকদের মতো বিদ্রোহীদের কবলে ছিলো। এই বিদ্রোহীরা শহরে প্রধান অংশের মধ্যে অবস্থিত এবং পার্শবর্তী এলাকার পুরো কলোনীতে লুটতরাজ, হত্যাকাণ্ড ও অগ্নিসংযোগ করে। মানুষ হত্যার “কসাইখানা” স্থাপন করা হয়। এরকম একটা কসাইখানা চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগের দফতরেও ছিল। এই কসাইখানায় পুরুষ, নারী ও শিশুকে নির্বিশেষে হত্যা করা হয়। অনেক ক্ষেত্রেই দেহ থেকে অঙ্গ কেটে ফেলার আগে সিরিঞ্জ দিয়ে রক্ত বের করে নেওয়া হয়েছিল। ( ১০ হাজার লোক নিহত হয়)।

২৭শে মার্চ, ১৯৭১ ওসমানিয়া গ্লাস ওয়ার্কস। ১৫ই মার্চ ১৯৭১, আমিন জুট মিলস, বিবির হাট পশ্চিম পাকিস্তানী কর্মচারীদের নির্যাতন ও হত্যা করা হয় (১৭ জনের মৃত্যু হয়)। ম্যানেজিং পার্টনার এবং ম্যানেজারকে অপহরণ করা হয়। তাদের হত্যা করা হয়েছে বলে বিশ্বাস। অন্যান্য কিছু সংখ্যক কর্মীদের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। অনুমান করা হয় যে তাদের “জামিন” স্বরূপ আটক রাখা হয়েছে। (হতাহতের সংখ্যা জানা যায় নি)।

১৯শে এপ্রিল, ১৯৭১, ইস্পাহানী জুট মিলস এবং তার পার্শবর্তী এলাকা। নারী ও শিশুদের নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। পশ্চিম পাকিস্তানী অনেক অফিসার এবং শ্রমিকদের খোঁজ পাওয়া যায় না। অনেকেকে অপরহরণ করা হয়েছে। (হতাহতের সংখ্যা প্রায় এক হাজার)।

২৯-২৮শে এপ্রিল, ১৯৭১ হাফিজ জুট মিলস। মিল-ভবন আক্রমণ করে কিছু সংখ্যক কর্মচারীকে হত্যা করা হয়।মালিকের গৃহে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। কয়েকজন অপ্রাপ্ত বয়স্ক শিশু যারা প্রাণ ভয়ে পালিয়ে গিয়েছিল, তাছাড়া গৃহের অধীবাসীদের সবাইকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয়েছিল।(হতাহতের সংখ্যা ছিল প্রায় ১৫০ জন)।

২৬-৩০শে এপ্রিল,১৯৭১।
কর্ণফুলী পেপার এবং রেয়ন মিলস চন্দ্রঘোনা ও তার পার্শববর্তী এলাকা।

ব্যাপক লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগ ও হত্যাকাণ্ড অনুষ্ঠিত হয়। মেয়েদের ঘরে তালাবদ্ধ করে রাখা হয়েছিল। উদ্ধার করার পর, তারা বর্ণনীয় ধর্ষণ ও বর্বরতার কাহিনী বর্ণনা করে। (হতাহতের সংখ্যা প্রায় ২ হাজার)।

২৭-৩০ এপ্রিল,১৯৭১ রাঙ্গামাটি। রাঙ্গামাটিতে অবস্থিত পশ্চিম পাকিস্তানীদের একত্রিত করে নির্যাতন ও হত্যা করা হয়।(৫০০ লোক প্রাণ হারায়)
যশোর
২৯-৩০ মার্চ, ১৯৭১ ঝুমঝুমপুর কলোনী। ইষ্ট পাকিস্তান রাইফেলস-এর বিদ্রোহীরা সমগ্র বিহারী জনগণকে সাধারণভাবে হত্যা করে। মেয়ে ও শিশুদের টেনে-হিচড়ে নড়াইলের দিকে নিয়ে যায়। ৪’শ থেকে ৫শ’র মতো মেয়েকে অপরহরণ করে নদীপথে হিন্দুস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়। মানুষের কংকাল ও দেহের অন্যান্য অংশ সমস্ত এলাকায় ছড়ানো রয়েছে দেখতে পাওয়া যায়। (প্রায় ৩ হাজার লোক নিহত হয়। ২ হাজার লোকের কোন খোঁজ পাওয়া যায় নি)।

২৯-৩০শে মার্চ, ১৯৭১ রামনগর কলোনী। ঝুমঝুমপুর কলোনীর লোকেরা এখানে এসে আশ্রয় নিয়েছিলো, এই কলোনীতেও আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। ( ১৫০ জনের ও বেশী লোক নিহত হয়। দুস্থ শিবিরে আশ্রয় নেয় ৪৪৮ জন।)

৩০ শে মার্চ, ১৯৭১ তারাগঞ্জ কলোনী আওয়ামী লীগ স্বেচ্ছসেবকরা ও ইষ্ট পাকিস্তান রাইফেলস-এর বিদ্রোহীরা সমগ্র কলোনীতে বেপরোয়া হত্যাকাণ্ড চালিয়ে যায়। খুব কম লোকই বেঁচেছিল। সমস্ত বারী ঘর ধবংস্প্রাপ্ত হয়। (৫শ’র মতো লক নিহত হয়। নিখোঁজ লোকের সংখ্যা ৪শ’)।

৩০শে মার্চ- ৫ই এপ্রিল, ১৯৭১ হামিদপুর, আমবাগান, বাকাচর এবং যশোর শহরের পুরাতন কসবা এই এলাকার অধিকাংশ জনগণকে হত্যা করে নিশ্চিহ্ন করে ফেলা হয়। ঘর বাড়ী প্রথমে লুট এবং পরে ধবংস করা হয়। ( প্রায় ১ হাজার লোক নিহত ও নিখোঁজ হয়। ১৭৫ জন হাসপাতালে যায় এবং ১৭২ জন দুস্থ শিবিরে আশ্রয় নেয়।)

৩০শে মার্চ- ৫ই এপ্রিল, ১৯৭১, মোবারাকগঞ্জ। পুরুষ, নারী ও শিশুদের নির্যাতন ও হত্যা করা হয়। তাদের বারী ঘরে লুটপাট করে আগুনে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিলো। (২শ রও অধিক লোক নিহত হয়। ১০ জন হাসপাতালে ও ২৭ জন দুঃস্থ শিবিরে যায়।)

৩০শে মার্চ- ৫ই এপ্রিল, ১৯৭১, কালিগঞ্জ বেশ কিছু সংখ্যক এলাকার উপর হামলা চালানো হয়। মেয়েদের ধর্ষণ করা হয়। পুরুষ ও শিশুদের হত্যা করা হয়, ব্যাপক লুটতরাজ ও অগ্নিসংযোগ চলে। ( প্রায় ৩’শ লোক নিহত হয়। ১৩২ জন সাহায্য শিবিরে আশ্রয় নেয়।)

৩০শে মার্চ-১০ই এপ্রিল, ১৯৭১ কোঁটচাঁদপুর। বেপরোয়া হত্যাকাণ্ড ও অগ্নিসংযোগ চলতে থাকে। ( প্রায় ৪শ লোক নিহত ও ৫শ জন আহত হয়। সাহায্য শিবিরে অবস্থানরত লোকের সংখ্যা হচ্ছে ৫৫।)

৩০শে মার্চ-১৯৭১ তাফসিডাঙ্গা। আগে থেকেই চিহ্নিত করা কিছুসংখ্যক বাড়ীঘর সংগ্রাম পরিষদের স্বেচ্ছাসেবকরা আক্রমণ করে। তারা পুরুষ ও বৃদ্ধা নারীদের হত্যা করে এবং যুবতী মেয়েদের ধরে নিয়ে যায়। (প্রায় ২শ লোক নিহত হয়। সাহায্য শিবিরে যায় ৭২ জন।)

৩০শে মার্চ- ১০ই এপ্রিল, ১৯৭১ নড়াইল। এখানে প্রধানতঃ পাঠানদের উপরে নির্যাতন করা হয়। নড়াইলের সমস্ত পাঠানদের একত্রিত করে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। মেয়ে ও শিশুসহ ৬০ থেকে ৭০ জন পাঠানকে হত্যা করা হয়েছিল
২৫শে মার্চ-৪ঠা এপ্রিল,১৯৭১, ঝিনাইদহ, মহকুমা। আওয়ামী লীগ স্বেচ্ছাসেবকগণ কিছুসংখ্যক বাড়ীঘর লুট করে আগুন ধরিয়ে দেয়। জানও মালের প্রচুর ক্ষতি হয়। ২৫০ জনেরও বেশী লোক নিহত ও ৫০ জন নিখোঁজ হয়। ১০ জন হাসপাতালে যায়।

খুলনা
২৮-২৯শে মার্চ, ১৯৭১ খুলনা শহর। ক্রিসেন্ট জুট মিলস খালিশপুর ও স্টার জুট মিলস, চান্দনিমহল খুলনায় আওয়ামী লিগের আধা-সামরিক শিক্ষা শিবির গঠন করা হয়। তথাকথিত পশ্চিম পাকিস্তানী দালালদের বিরুদ্ধে সুসংবদ্ধ হত্যা ও অগ্নিকাণ্ড চলতে থাকে। ঘরবাড়ী ধবংস করা হয় এবং ব্যাপকভাবে হত্যাকাণ্ড চলতে থাকে। গলা কেটে ফেলার আগে হতভাগ্য ব্যক্তিদের উৎপীড়ন করা হতো। নিরপরাধ নারী ও শিশুদের রাস্তায় টেনে এনে হত্যা করা হয়। যারা প্রাণের ভয়ে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল ও বেঁচে ছিলো তাদের নদী থেকে উঠিয়ে আনা হয়। তারপর তাদের পেট চিরে আবার নদীতে ফেলে দেয়া হয়। তাদের রক্তে নদীর পানি লাল হয়েছিল। মিল সম্পত্তির ব্যাপক ক্ষতি সাধন হয়েছিলো। কিছু সংখ্যক অফিসার “মুক্তিপণ” দিয়ে বেঁচে যান । ( হতাহতের সংখ্যা প্রায় ৫ হাজার)।

২৮-২৯ মার্চ, ১৯৭১ পিপলস জুট মিলস, খালিশপুর, খুলনা। ইষ্ট পাকিস্তান রাইফেলস, আনসার এবং আওয়ামী লীগ কর্মীরা বয়সের প্রতি কোন লক্ষ্য না রেখে উচ্ছৃঙ্খল হত্যাকাণ্ডে লিপ্ত হয়। (৪শ ৬৭ জন নিহত হয়)।
২৮-২৯ শে মার্চ ১৯৭১ নিউ কলোনী, খালিশপুর, খুলনা। প্রায় ১০ হাজার আওয়ামী লীগ কর্মী কলোনী ঘেরাও করে ফেলে। বিদ্রোহী পুলিশরাও তাদের সঙ্গে যোগ দেয়। সমানে ৬ ঘন্টারও বেশী গোলাগুলি চলে। (প্রায় ৩শ লোক নিহত হয়)।

.
.
জেলা তারিখ ও এলাকা
৩০ শে এপ্রিল, ১৯৭১
সাতক্ষীরা, মহকুমা, খুলনা

ঘটনা
পশ্চিম অয়াকিস্তানী মহকুমা হাকিমকে আটক করে বন্দী অবস্থায় রাখা হয়। শহরের এলাকা জুড়ে গণহত্যা, নৃশংসতা ও ব্যাপক লুটতরাজ চলতে থাকে। (প্রায়) ১
হাজার লোক নিহত হয়)

কুষ্টিয়া
২৯ শে মার্চ-১লা এপ্রিল ১৯৭১,
চুয়াডাঙ্গা, কুষ্টিয়া

বিহারী ও পশ্চিম পাকিস্তানীদের একত্রিত কত্র হত্যা করা হয়। মেয়েদের সঙ্গে অমানষিল ব্যবহার করা হয়। পশ্চিম পাকিস্তানী মহকুমাআ হাকমের উপর নির্মম অত্যাচার করা হয়। তাঁর সন্তান সম্ভবা স্ত্রীকেও মারধর করা হয়েছিল। (৫শ লোক নিহত এবং ১ শ লোক নিহত হয়)

৩০শে মার্চ-১৩ই এপ্রিল, ১৯৭১
মেহেরপুর, কুষ্টিয়া

প্রায় দ’সপ্তাহ যাবৎ মেহেরপুরে বেপরোয়া হত্যা, অগ্নিসংযোগ এবং ধর্ষণের কব্লে ছিল। ৪শ থেকে ৬শ লোক নিহত ও ২ শ লোক নিখোঁজ হয়। হাসপাতেলে যায়
১০ জন।

বগুড়া
২৬শে মার্চ-২৩শে এপ্রিল ১৯৭১,
বগুড়া শহর।

আওয়ামী লীগ সেচ্ছাসেবকরা জেল ভেঙ্গে কয়েদীদের হিংসাত্নক কার্যকলাপ ও লুটতরাজ করার জন্য ছেড়ে দেয়। ৭ হাজার পুরুষ, নারীও শিশুদের জেল ভবনের মধ্যে ঠাসাঠাসি করে ঢোকানো হয়। জেল ভবন্টি ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দেবার পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু সেনাবাহিনী সময়মত এসে পৌঁছে তাদের উদ্ধার করে। প্রত্যক্ষদর্শীরা গণহত্যা, ধর্ষণ ও অগ্নিসংযোগের কাহিনী বর্ণনা করে। প্রকাশ যে প্রায় ২ হজার লোন নিহত হয়।

২৬ শে মার্চ-২২ শে এপ্রিল, ১৯৭১
নওগাঁ, সান্তাহার

বিহারীদের চলাফেরা বন্ধ করার জন্য আওয়ামী লীগ দুষ্কৃতিকারীরা রাস্তা বন্ধ করে দিলো। ব্যাংকগুলো লুন্ঠিত হল মেয়েরা ধর্ষিত হলো। তাদের গুলী করে হত্যা করার আগে নগ্ন অবস্থায় রাস্তা দিয়ে হাটানো হয়েছিল। সারা শহরের মৃতদেহের ছড়াছড়ি দেখা যায়। অনেককে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয়। কাউকে বা পেরেকে গেঁথে গুলি করা হত্যা করা হয় আহত অবস্থায় যারা বেঁচেছিলো তাদের কাছে থেকে জানা যায় যে, মেয়েদের নিজের সন্তানের রক্ত পান করতে বাধ্য করা হয়েছিলো। বিহারীরা একেবাএ নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় (প্রায় ১৫ হাজার লন নিহত হয়)

পাবনা
২৩ মার্চ-১০ই এপ্রিল, ১৯৭১
পাবনা শহর

দু’সপ্তাহব্যাপী আওয়ামীলীগের সন্ত্রাসের রাজত্ব থেকে শহরকে রক্ষা করলো সেনাহাবিনী এসে। (প্রায় ২য় লোক নিহত হয়)

২৩শে মার্চ-১০ এপ্রিল ১৯৭১
সিরাজগঞ্জ

দুষ্কৃতকারীরা ৩৫০ জন পুরুষ। নারী ও শিশুলে দালানে ঢুলিয়ে তাতে আগুন ধরিয়ে দিলো। (ভেতরে যারা ছিল তাদের সকলকেই এভাবে ফাঁদে ফেলে হত্যা করা হয়)

১০ই এপ্রিল, ১৯৭১ পাকশী।

রেলওয়ে কলোনীর অধিবাসীদের শান্তি কমিটি গঠন করার অজুহাত দেখিয়ে প্রতারিত করা হয়। তাদের একটা হাইস্কুল ভবনে আটকে রেখে জীবিত অবস্থায় পুড়িয়ে মারা হয়েছিল। (প্রায় ২ হাজার ৭ শত লোক নিহত হয়।)

দিনাজপুর ২৮শে মার্চ-১লা এপ্রিল, ১৯৭১
দিনাজপুর শহর

ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট বিদ্রোহ করার সঙ্গে সঙ্গেই নির্যযাতন শুরু হয়ে যায়। আর তার পরেই বেপরোয়া হত্যাকান্ড চলতে থাকে। পুরুষ, মেহ্যে ও শিশুদের হত্যা করা হয় যে দু-চারজন এখানে সেখানে জীবিত ছিলো তারা প্রধানতঃ ছিলো বৃদ্ধা, স্ত্রীলোক ও শিশু। নিহতদের মাতা কেটে নিয়ে হগাছের আগায় ঝোলানো হয়। প্রায় ৪শ মেয়েকে অপহরণ করে নিয়ে যাওয়া হয় হিন্দুস্তানে। (প্রায় ৫ হাজার লোক নিহত হয়)

২৮ শে মার্চ -১৩ এপ্রিল ১৯৭১
ঠাকুরগাঁও

ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট বিদ্রোহ করে। অধিকাংশ বিহারীকে হত্যা করে নিশ্চিহ্ন করে ফেলা হয়। যুবতী মেয়েদের অপহরণ করা হয় মেয়েদের ধর্ষণ করা এবং গর্ভবতী মেয়েদের পেটে সঙ্গীনের খোঁচা মারা হয়। আর তারপর সদ্যজাত মৃত শিশুদের ছিড়ে টুকরো টুকরো করা হয়। উলঙ্গ অবস্থায় মৃতদেহগুলিকে রাস্তায় টেনে নিয়ে বেড়ানোও হয়েছিলো। (প্রায় ৩ হাজার লোক নিহত হয়)

পার্বতীপুর, পঞ্চগড়, কাউরকাই, ফুলবাড়ি ও হিলি

বিদ্রোহী ইষ্ট বেঙ্গল রাইফেলস এবং আওয়ামীলীগ স্বেচ্ছাসেবকদের প্রধান লক্ষ্যই ছিলো রেক কলোনীগুলো। কলোনীর বাসিন্দাদের ভীতি প্রদর্শনের জন্য বোমা, হালকা মেশিন গান এবং ছোট অস্ত্রশস্ত্র ব্যবহার করা হয়। আর তারপরেই শুরু হয়ে যায় ধর্ষণ ও হত্যাকান্ডের তান্ডবলীলা। (যারা রক্ষা পেয়েছিলো তাদের হিসাবে ৫ হাজারের বেশি লোক নিহত হয়েছিলো)

রাজশাহী
২৮শে মার্চ -১৬ই এপ্রিল ১৯৭১
রাজশাহী শহর

পুলিশ এবং ইষ্ট পাকিস্তান রাইফেলস বিদ্রোহ করে। এদের সঙ্গে এসে যোগ দেয় হিন্দুস্তানী অনুপ্রবেশকারী। শুরু হয়ে যায় বেপরোয়া হত্যাকান্ড। ১৯৭১ সালের ১৬ই এপ্রিল সেনাবাহিনী এসে শহরকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করলো। নাটোর এবং সারদা থেকেও নৃশংস হত্যাকান্ডের খবর পাওয়া যায়। (প্রায় ২ হাজার লোক নিহত হয়েছিলো)

২৭শে মার্চ-১৮ ই এপ্রিল ১৯৭১
নবাবগঞ্জ

হিন্দুস্তানী অনুপ্রবেশকারীদের শযোগীতায় বিদ্রোহী ইষ্ট পাকিস্তান রাইফেলসের লোকেরা নবাবগঞ্জ থেকে জেল কয়েদীদের মুক্ত করে দেয়। তারা কয়েদীদের বর্বরোচিত কার্যকলাপ এবং অগ্নীসংযগ করায় উতসাহিত করতে থাকে। একজন একাউন্টস এর কেরানী বাংলাদেশকে স্বীকার করতে অস্বীকার করেছিলো বলে তাকে কোমর পর্যন্ত মাটির নিচে পুঁতে, লাঠি দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। (নিহতদের সংখ্যা প্রায় ১ হাজার বলে অনুমান করা হয়)।

কুমিল্লা
মার্চ-এপ্রিল১৮, ১৯৭১
ব্রাম্মণবাড়িয়া

ব্রাম্মণবাড়িয়া বিহারী পুরুষ, মেয়ে ও শিশুদের একত্রিত করে জেল খানায় রাখা হয়। পরে ১৯৭১ সালের ১৩ ই এপ্রিল ইষ্ট বেঙ্গল রাইফেলস এর বিদ্রোহী দলের প্রধানের আদেশে স্বয়ংক্রিয় বন্দুকের সাহায্যে তাদেরকে হত্যা করা হয়। (প্রায় ৫শ লোককে নিহত করা হয়)

ময়মনসিংহ
২৭শে মার্চ ১৯৭১
ময়মনসিংহ সেনানিবাস

ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও ইষ্ট পাকিস্তান রাইফেলস বিদ্রোহ করে। তারা তাদের পশ্চিম পাকিস্তানী সহকর্মীদের হত্যা করে। নিহতদের মধ্যে অফিসারও ছিলেন তা ছাড়া ছিলো আরও বহু লোক, যারা রাতে তাদের বাস্থান ও ব্যারাকে ঘুমিয়েছিলো।

১৬ই-১৭ই এপ্রিল ১৯৭১
ময়মনসিংহ শহর

প্রাক্তন ইষ্ট পাকিস্তান রাইফেলসের লোকজন মেশিন গান নিয়ে ময়মনসিংহ সদর জেলা চড়াও করে এবং নিরাপত্তার কারণে স্থানান্ত্রিত বহিরাগত লোকদের গুলি করে হত্যা করে।

১৭ই-২০শে এপ্রিল ১৯৭১
সানকীপাড়া ও অন্যান্য কলোনী

উন্মত্ত জনতার হারে রাইফেল, তলোয়ার, বর্শা ছোরা এবং রাম-দা ছিলো। তারা ময়মনসিংহ শহর ও তার আশপাশের সানকীপাড়া ও অন্যান্য ৯টি কলোনী আক্রমণ করে অধিকাংশ পুরুষ অধিবাসিকে হত্যা করে। খবরে প্রকাশ যে, প্রায় ৫ হাজার লোক নিহত হয়। মেয়েরা একটি মসজিত এবং একটি স্কুল ভবনে, জড়ো হয়েছিলো। ২১ শে এপ্রিল ১৯৭১ সাল, সেনাবাহিনী যখন শহর হস্তগত করে তখন তারা মেয়েদের উদ্ধার করে।