শিরোনামঃ ১১৮। নিরাপত্তা পরিষদে পাকিস্তানী প্রতিনিধি আগাশাহীর বিবৃতি
সূত্রঃ জাতিসংঘ দলিলপত্র উদ্ধৃতিঃ বাংলাদেশ ডকুমেন্টেস
তারিখঃ ৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১
.
পাকিস্তানের প্রতিনিধি জনাব আগাশাহী’র ভাষণ
৬ ডিসেম্বর,১৯৭১
পুনরায় কথা বলার সুযোগ নেয়া আমার উদ্দেশ্য ছিল না,কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়নের দূত আমার উদ্দেশ্যে একটি সরাসরি প্রশ্ন করেছেন,যেটি উত্থাপিত হয়েছে,সোভিয়েত খসড়া সমাধান প্রস্তাব দলিল-S/10428 থেকে, যেটি তিনিই প্রচার করেছেন।
প্রশ্নটি ছিল,কেন আপনারা পূর্ব পাকিস্তানের জনগনের ইচ্ছার প্রকাশকে ভয় পান?আমি বিশ্বাস করি এই প্রশ্নের উত্তর তার প্রাপ্য এবং আমি তাকে সত্য কথাই বলব।কিন্তু সেটা করার আগে,আমি তার উপস্থাপিত খসড়া প্রস্তাবের ব্যাপারে দুটি কথা বলব।
যেহেতু সাধারণ নীতি হচ্ছে,যখন কোন দেশ দখলদার কতৃক আক্রান্ত হয় সেখানে কোন রাজনৈতিক সমাধান হতে পারেনা এবং দুঃখজনকভাবে আমরা জাতিসংঘের নীতিতে সেটা সেই সাধারণ নীতি খুঁজে পেতে ব্যর্থ হয়েছি-সেটা সোভিয়েতের খসড়া প্রস্তাব দ্বারা প্রত্যাখ্যাত।
জাতিসঙ্ঘের যতগুলো খসড়া সমাধান বিবেচনা করা হয়েছে,প্রত্যেকটিতে আমার এই ব্যাপারটা নজরে আনা উচিত।অপসারণ এর সাথে অস্ত্র-সংবরণ একটি অলঙ্ঘনীয় চর্চা এবং আমরা এখন পর্যন্ত সোভিয়েতের নীতির অবস্থানকে স্বাগত জানাই,কারণ তারা সর্বদা যুদ্ধবিরতি এবং অপসারণ এর মধ্যে একটি স্বাভাবিক সম্পর্ক স্বীকার করে এসেছে।কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে আমরা বর্তমান প্রেক্ষাপটে সোভিয়েতের সেই নীতির ধারাবাহিকতা খুজে পাইনি।
যেমন আমি বলেছিলাম,পূর্ব পাকিস্তান যে পাকিস্তানের অংশ এটি সকল সদস্য রাষ্ট্রদ্বারা স্বীকৃত, ২১ নভেম্বর থেকে পুর্ব পাকিস্তানের উপর সামরিক আক্রমণ সম্পূর্ণ পাকিস্তানের উপর আক্রমন।
সোভিয়েতের প্রতিনিধি এই অভিযোগ এনেছেন যে ,পাকিস্তান এইসব ৩ ডিসেম্বর শুরু করেছে।কিন্তু আমাদের অবশ্যই এই তারিখের পূর্বে নজর দিতে হবে।আমার মনে করিয়ে দেয়া উচিত যে ২১ নভেম্বর পাকিস্তানের উপর আক্রমন শুরু হয়েছে যেটি কিনা একটি একক রাষ্ট্র।
আমাদের অভ্যন্তরীণ সংকটের ব্যাপারে আমি যা বলেছিলাম তা পরিষ্কার করতে চাই।আমাদের অভ্যন্তরীণ সঙ্কটটি একটি রাজনৈতিক সংকট।এই রাজনৈতিক সঙ্কটটি আমাদের ঘরোয়া ব্যাপার।এই সঙ্কটটির আন্তর্জাতিক দিক
হলো-এর একটি মানবিক দিক আছে,সম্পূর্ণভাবে মানবিক দিক এবং এর আরেকটি আন্তর্জাতিক দিক আছে যেটা ভারতের তৈরি করা-সশস্ত্র বিদ্রোহীদের উত্থান ঘটানো এবং পুর্ব পাকিস্তানে তাদের ঢুকিয়ে দেয়া এবং শেষ পর্যন্ত পুর্ব পাকিস্তানে তাদের(ভারতের)হামলা।আমার আরো একবার সবার কাছে পরিষ্কার করা উচিত যে,কোনটা আমাদের সঙ্কটের অভ্যন্তরীণ দিক ও কোনটা আন্তর্জাতিক দিক,যাতে আর কোন ভুল বোঝাবুঝি না থাকে।
এখন এই প্রশ্নে আসা যাক আমরা পাকিস্তানের জনগনের ইচ্ছার প্রকাশে ভীত কী না। না,এটি একটি বিরাট ট্র্যাজেডি যে, এই ইচ্ছার রাজনৈতিক প্রকাশ সংসদ অধিবেশনে হতে পারে নি,যেখানে রাজনৈতিক দলগুলোর মতবিভেদ নিষ্পন্ন হতে পারত।কিন্তু কিছু সময়ের জন্য সেটা্র বিরতির ফল হিসেবে পূর্ব পাকিস্তানে বিচ্ছিন্নতাবাদীতার উত্থান হয় সরকারকে কর প্রদানে অস্বীকার,কর্তৃপক্ষের কর্তৃত্ব অস্বীকার এবং ১৮,০০০ অপরাধীকে মুক্ত করার মাধ্যমে । যেকাজগুলো নিয়ে গেছে একটি নৃশংস হত্যার উৎসবে।
এই হচ্ছে সত্য।যদি প্রমাণের প্রয়োজন হয়,তাহলে যে কেউ সঙ্কট এর শুরুর মুহূর্ত ,জানুয়ারী-ফেব্রুয়ারী থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তান থেকে প্রকাশিত সংবাদপত্গুলো ঘাটলেই পেয়ে যাবে।এটি একটি তিক্ত সত্য যা শুধু জাতিসঙ্ঘের সদস্যরাই নন,সেই হাজার হাজার সশস্ত্র অপরাধী যারা নৃশংস হত্যাকান্ড ঘটিয়েছে –তারাও অবগত এবং দুঃখজনকভাবে কিছু নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিও এই অপরাধের সাথে জড়িত।কোন সংসদ সদস্য তার রাজনৈতিক ভিন্নমতের জন্য বহিষ্কৃত হয়নি।
খুনিদের কসাইখানাগুলোর প্রমাণ আছে,আমি বিস্তারিত এখানে বলতে চাই না।আর যারা এর জন্য দায়ী তাদের অনুরোধ করা হয়েছে এখানে আসতে এবং তাদের এই অভিযোগ গুলোর বিপরীতে নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করতে।বর্তমান পরিস্থিতিতে,যেখানে রাজনৈতিক অপরাধীদের দায়মুক্তির সুযোগ দেয়া হচ্ছে,আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কি দাবি করবে যে এই সংঘবদ্ধ অপরাধীদেরও এই সুযোগ দেয়া হোক?
সোভিয়েত খসড়া সমাধান প্রস্তাবের অভ্যন্তরীণ বৈপরীত্য এর ব্যাপারে আমার আরো নজরে কিছু ব্যাপার আনা উচিত।তাহলো,সশস্ত্র বিচ্ছিন্নতাবাদ কিছু বিশেষ উদ্দেশ্যে একটি দল তৈরি করেছে, এবং এরপরে সেখানে পূর্ব পাকিস্তানের জনগনের ইচ্ছার স্বীকৃতি পাওয়ার চাহিদা তৈরি হয়েছে।যদি বিচ্ছিন্নতাবাদীরা তাদের বিচ্ছিন্ন হওয়ার উদ্দেশ্য ত্যাগ করে এবং পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের যে ইচ্ছা নির্বাচনের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে তাতে আস্থা রাখে,তাহলে আমরা হয়ত এই অন্ধকার সময় ও বিষন্নতা থেকে উদ্ধার পাব,যদি নিরাপত্তা পরিষদের প্রত্যেক সদস্য খসড়া সমাধান প্রস্তাবে ভোট প্রদানের আগে নিজেকে একবার জিজ্ঞেস করেন।