শিরোনাম | সংবাদপত্র | তারিখ |
সম্পাদকীয়ঃ জাতীয় জীবনের এই পরম লগ্নে | মুক্তিযুদ্ধ
১ম বর্ষঃ ২৩শ সংখ্যা |
১২ ডিসেম্বর,১৯৭১ |
সম্পাদকীয়
জাতীয় জীবনের এই পরম লগ্নে
আট মাসের এবং বলিতে গেলে ২৪ বৎসরের অমনিশার পরে বাংলাদেশের আকাশে আজ নব-অরুণোদয় ঘটিতেছে।
পাকিস্তানের মুষ্টিমেয় একচেটিয়া পুঁজিপতি ও বৃহৎ সামন্তবাদী ভূস্বামীদের জাতিগত নিপীড়ন ও শোষণ এবং তাঁর সাথে মার্কিনী পুঁজির নয়া ঔপনিবেশিক জাঁতাকলে নিষ্পেষিত বাংলাদেশের শ্রমিক, কৃষক, ছাত্র, মধ্যবিত্ত তথা গোটা বাঙালী জাতি নিজেদের ন্যায্য জাতীয় ও গণতান্ত্রিক অধিকারের জন্য গত ২৪ বৎসর বহু গৌরবময় সংগ্রাম করিয়াছেন। গত ২৫শে মার্চের পর জনগণের এই ন্যায্য সংগ্রামই ইয়াহিয়া চক্রের বর্বর বাহিনীর বিরুদ্ধে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের জন্য সশস্ত্র সংগ্রামের রূপ পরিগ্রহণ করিয়াছে। মাতৃভূমির স্বাধীনতা এবং জাতীয় মুক্তির জন্য জনগণের এই বীরত্বপূর্ণ সংগ্রাম আজ সাফল্যের দ্বারে আসিয়া উপনীত হইয়াছে। ঘৃণ্য দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে কৃত্রিমভাবে রচিত প্রতিক্রিয়াশীল পাকিস্তান রাষ্ট্র আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের আঘাতে আজ ভাঙ্গিয়া পড়িতেছে। দুনিয়ার বুকে জন্ম নিয়াছে এক নবীন রাষ্ট্র- গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ। প্রতিক্রিয়াশীল সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র পাকিস্তানের অভিশাপ হইতে বাঙালী জাতি আজ মুক্ত হইতেছে।
আমাদের এই স্বাধীনতা সংগ্রামকে স্তব্ধ করার জন্য নরঘাতক ইয়াহিয়া চক্র গণহত্যা, পাইকারী নারী ধর্ষণ, গৃহদাহ, লুণ্ঠন প্রভৃতি কোন অপরাধমূলক কাজই বাকি রাখে নাই। কিন্তু, আমাদের মুক্তিযুদ্ধ তাহাতে দমিত হওয়ার বদলে আরো দুর্বার হইয়াছে। দুর্ধর্ষ মুক্তিবাহিনী ও গেরিলা বাহিনীর প্রচণ্ড- মারের চোটে দিশাহারা হইয়া ইয়াহিয়া চক্র অবশেষে আমাদের দেশে মার্কিনী হস্তক্ষেপ ডাকিয়া আনার জন্য পাক-ভারত যুদ্ধ বাধাইয়াছে। ইয়াহিয়া চক্রকে বাঁচাইবার জন্য মার্কিনী সাম্রাজ্যবাদীরাও এই যুদ্ধের সুযোগে নিরাপত্তা পরিষদের মাধ্যমে আমাদের দেশে হস্তক্ষেপের চেষ্টা করিয়াছিল। সমাজতন্ত্রের দাবীদার চীনও সমাজতন্ত্রের নীতি হইতে বিচ্যুত হইয়া নরঘাতক ইয়াহিয়া চক্রের পক্ষ নিয়া মার্কিনী সাম্রাজ্যবাদের ঐ চক্রান্ত সমর্থন করিয়াছিল। কিন্তু, দুনিয়ার নিপীড়িত জাতিসমূহ ও জনগণের অকৃত্রিম বন্ধু মহান সোভিয়েত ইউনিয়ন মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও চীনের সে চক্রান্ত জাল ছিন্নভিন্ন করিয়া দিয়া আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সাফল্যে এক বিরাট অবদান রাখিয়াছে।
পক্ষান্তরে ইয়াহিয়া চক্রের আগ্রাসী আক্রমণের বিরুদ্ধ ভারত সরকার প্রতিরক্ষার জন্য যে পাল্টা ব্যবস্থা গ্রহণ করিয়াছেন , তাতে বাংলাদেশে ঐ খুনীর দলের অন্তিম দশা উপস্থিত হইয়াছে। ভারত সরকার বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দিয়া নিজের সেনাবাহিনীকে আমাদের মুক্তিবাহিনীর সহিত একযোগে কাজ করার নির্দেশ দিয়াছেন। আমাদের মুক্তিবাহিনী ও মিত্র ভারতীয় বাহিনীর যৌথ আক্রমণে বাংলাদেশে শত্রুর ঘাটিগুলির একটার পর একটা দ্রুত পতন ঘটিতেছে। নিরস্ত্র মানুষকে পাইকারী হত্যা, অসহায়া নারীকে ধর্ষণ ও এক কোটি নরনারীকে দেশছাড়া করিয়া যে নরপিশাচরা একদা বীরত্ব দেখাইয়াছিল, আজ মুক্তিবাহিনী ও মিত্র বাহিনীর দুর্বার অগ্রগতির সামনে তারা প্রাণভয়ে পলায়ন করিতেছে। বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ এলাকা ইতিমধ্যেই শত্রুর কবল হইতে মুক্ত হইয়াছে। সে শুভদিনও আজ আর বেশী দূরে নয়, যেদিন ঢাকার সরকারী দপ্তরেও স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড্ডীন হইবে। বাঙালী জাতির জীবনে আজ নতুন দিন আগত।
জাতীয় জীবনের এই শুভলগ্নে নুতন দায়িত্বের কথাও আমরা সমস্ত মুক্তিযোদ্ধা ও দেশবাসীকে স্মরণ করাইয়া দিতে চাই। মার্কিনী সাম্রাজ্যবাদীদের চক্রান্ত এখনো থামে নাই। কাজেই আত্মসন্তুষ্টিরও অবকাশ নাই।
তাই, দেশবাসীর কাছে আমাদের আবেদনঃ (১) মুক্তি সংগ্রামের ত্বরিত ও চূড়ান্ত বিজয়ের জন্য সকলে মিলিয়া আরও প্রবল বেগে শত্রুর বিরুদ্ধে আঘাত হানুন, শত্রুর পলায়নের পথ রুদ্ধ করুন। (২) বাংলাদেশ সরকারের প্রতি অটুট আনুগত্য রাখুন ও নির্দেশ মানিয়া চলুন। (৩) মুক্তিবাহিনী ও মিত্র ভারতীয় বাহিনীর সহিত সকল প্রকারের সহযোগিতা করুন (৪) সর্বত্র মুক্ত এলাকা গড়িয়া তুলুন। মুক্ত এলাকার স্বাধীনতা সংগ্রামী সকল দলমতের লোক নিয়া গণ- কমিটি গঠন করিয়া তার উপর অসামরিক প্রশাসনের দায়িত্ব ন্যস্ত করুন। (৫) মুক্ত এলাকায় শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষা করুন। জাতি ধর্ম ভাষা নির্বেশেষে সকলের নিরাপত্তা বিধান করুন। আইনশৃঙ্খলা নিজের হাতে নিবেন না। অবাঙালী বিরোধী বা অন্য কোন প্রকার দাঙ্গা না ঘটিতে পারে সে দিকে লক্ষ্য রাখুন। (৬) খাদ্য ও নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের সুষ্ঠু বিতরণের ব্যবস্থা করুন। স্কুল কলেজ খোলার ব্যবস্থা করুন। স্বাভাবিক জীবন গড়িয়া তুলিতে উদ্যোগী হউন। (৭) শ্রমিক কৃষক মেহনতি জনতার দুঃখ দুর্দশা লাঘব করার চেষ্টা করুন।
সকল দলমতের সংগ্রামী দেশবাসীর প্রতি আমাদের আহবানঃ আসুন, সকল প্রকার দলীয় সঙ্কীর্ণতা ভুলিয়া সকলে মিলিয়া রক্তমূল্যে অর্জিত স্বাধীনতার নবীন সূর্যোদয়কে স্বাগত জানাই। বাংলাদেশে সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কায়েম করি এবং সত্যকারের সুখী সুন্দর প্রগতিশীল নুতন বাংলা গড়িয়া তুলি।