You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.09.04 | স্বাধীন বাংলা পত্রিকার সম্পাদকীয়: সামরিক দিক হইতেও ঐক্যজোটের অনিবার্য তাগিদ | স্বাধীন বাংলা - সংগ্রামের নোটবুক
শিরোনাম সংবাদপত্র তারিখ
সম্পাদকীয়: সামরিক দিক হইতেও ঐক্যজোটের অনিবার্য তাগিদ স্বাধীন বাংলা

১ম বর্ষঃ ৯ম সংখ্যা

৪ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১

 

সম্পাদকীয়
সামরিক দিক হইতেও
ঐক্যজোটের অনিবার্য তাগিদ

আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের সঠিক পরিচালনা ও সাফল্যের জন্য জাতীয় মুক্তিফ্রণ্ট গঠনের জরুরী আবশ্যিকতার কথা আমরা ইতিপূর্বে একাধিকবার আলোচনা করিয়াছি । আমরা বার বার এ কথাটাই বলিয়াছি যে, বিগত নির্বাচনে কোন দল কত ভোট পাইয়াছিল, কোন দল নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করিয়াছিল প্রভৃতি কথা দুর্ধর্ষ শত্রুর বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামের পরিস্থিতে অবাস্তব । আজিকার পরিস্থিতিতেই সবচেয়ে বড় কথা হইল হানাদার পাক সেনাদলকে পরাজিত করা, অধিকৃত বাংলাদেশকে মুক্ত করা, বাস্তুত্যাগীদের পুনবার্সন করা এবং ধর্ম-জাতি-ভাষা নির্বিশেষে বাংলাদেশের জনগণের সামনে নতুন জীবনের পথ খুলিয়া দেওয়া এই মহান কর্তব্য সাধনের জন্যই শত্রুর বিরুদ্ধে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিসংগ্রামে অংশগ্রহণকারী ছোট বড় সমস্ত দলও গ্রুপের একতা জরুরী প্রয়োজন । এই সোজা, সরল কথাটা আমরা ইতিপূর্বে বাংলাদেশের সমস্ত জনগণ ও আওয়ামীলীগসহ সমস্ত গণতন্তিক শক্তির নিকট একাধিকবার পেশ করিয়াছি এবং একতার জন্য আবেদনও জানাইয়াছি । এই প্রসঙ্গে আমরা ভিয়েতনামের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত তুলিয়া ধরিয়া দেখাইয়াছি যে, সেখানে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী কোন দলই “আমরা বড় দল” বা আমরা “বেশী বিপ্লবী” বলিয়া বড়াই করিয়া জাতীয় মুক্তিফ্রন্ট গঠনে অস্বীকার করে নাই । বরং সমস্ত দেশপ্রেমিক দল ও সংস্থা অহমিকা, সংকীর্তনা, প্রভৃতি পরিহার করিয়া শত্রুর বিরুদ্ধে এক ব্যাপক একতা গড়িয়া তুলিয়াছেন । ইহাই হইল মূল রাজনৈতিক কারণ যার জন্য ভিয়েতনামের মুক্তিযুদ্ধ এত দুর্বার, এত সাফল্যমণ্ডিত ।

ভিয়েতনামের এই উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত দেখাইয়া আমরা বলিয়াছি যে, বাংলাদেশে সমস্ত গণতান্তিক ও সংগ্রামী শক্তির সমবায়ে জাতীয় মুক্তিফ্রন্ট গঠন দেশের জনগণের মনে সৃষ্টি করিবে নতুন প্রেরনা, সংগ্রাম হইবে অধিকতর সংঘটিত, দুনিয়ার প্রগতিশীল শক্তির সাহায্য ও সমর্থন পাইতে অধিকতর সুবিধা হইবে এবং এগুলির ফলে আমাদের স্বাধীনতা ও মুক্তির সংগ্রাম এমন দুর্বার শক্তি সমর্থন করিবে যে, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীদের অস্ত্রেশস্ত্রে সজ্জিত হইয়া চক্রের পশু সেনাদলের পরাজয় নিশ্চিত ও ত্বরান্বিত হইবে ।

দুঃখের বিষয়, কোন কোন দলের নেতৃত্বের অহমিকা ও বুর্জোয়াসুলভ সংকীর্নতার জন্য জাতীয় মুক্তিফ্রন্ট গঠিত হয় নাই । কিন্তু ফ্রন্ট আজও গঠিত হয় নাই বলিয়া উহার প্রয়োজনীয়তা ফুরাইয়া যায় নাই ।

বরং আজ আমাদের স্বাধীনতা ও মুক্তিসংগ্রাম এমন একটি পর্যায়ে আসিয়া পৌঁছিয়াছে যে, জাতীয় মুক্তিফ্রন্ট গঠন আরও অপরিহার্য হইয়া উঠিয়াছে । গত পাঁচ মাসে আমাদের মুক্তিবাহিনী সংখ্যায় বাড়িয়াছে, তাহারা অধিকতর সংগটিত হইয়াছেন এবং সামরিক দিক হইতে তাহারা আজ অধিকতর দক্ষ । এসবের বাস্তব প্রমাণ আমরা প্রতিদিন পাইতেছি রণক্ষেত্রে- যেখানে শত্রুসৈন্য ক্রমাগত মার খাইতেছে ।

ইহা ছাড়া, বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে আজ গড়িয়া উঠিয়াছে বহু গেরিলা দল । তাহারাও শত্রুপক্ষকে অবিরত নাজেহাল করিতেছেন ।

কিন্তু এই ক্ষেত্রে একটা সমস্যাও দেখা যাইতেছে । অধিকাংশ গেরিলা দলই স্বাধীনতার আদর্শে উদ্ধুদ্ধ এবং অনেক অসম সাহসিক কাজ তাহারা দক্ষতার সহিত করিতেছেন । কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে এই গেরিলা দলগুলির ভিতর পারস্পরিক কোনও যোগাযোগ, কোন সমন্বয় প্রভৃতি নাই । অনেক ক্ষেত্রে মুক্তিবাহিনীর সহিতও গেরিলা দলের কাজের সমন্বয়ের অভাব আছে । তাছাড়া, গেরিলা দলগুলি শুধু কোন একটি রাজনৈতিক পার্টির অনুগামী নহে । আওয়ামীলীগ, কমিউনিষ্ট পার্টি, ন্যাপ ও অন্যান্য গণতান্ত্রিক দলের স্থানীয় নেতৃত্বে পরিচালিত গেরিলা দলসমূহ বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে রহিয়াছে ।

কিন্তু যেহেতু ঐ সব দল ও গ্রুপ নিয়া কেন্দ্রীয়ভাবে কোন জাতীয় মুক্তিফ্রন্ট গড়িয়া উঠে নাই এবং বহু স্থানে গেরিলা দলগুলির ভিতর এলাকা ভিত্তিতেও যোগাযোগ, সমন্বয় প্রভৃতি নাই, সেই হেতু এরূপ বিপদের আশঙ্কা আছে যে, রাজনৈতিক মতভেদ হেতু কোন কোন স্থানে বিভিন্ন গেরিলা দলের ভিতর পারস্পরিক গোলমাল বাধিতে পারে । ইহা ছাড়া, উপরোক্ত কারণগুলির জন্যই বিভিন্ন স্থানে গেরিলা দলগুলির কাজের ক্ষেত্রে বিভিন্নতা ঘটিয়া শক্তির অপচয়ও ঘটিতে পারে ।

এইসব অবাঞ্জিত ঘটনা ঘটিলে, উহার ফলশ্রুতিতে জনগণের মনে সমস্ত গেরিলা দল তথা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতি বিরূপ মনোভাব দেখা যাবে, ক্ষতিগ্রস্ত হইবে আমাদের স্বাধীনতা ও মুক্তির সংগ্রাম এবং লাভ হইবে নরঘাতক ইয়াহিয়া চক্রের ।

বাংলাদেশ সরকার ও আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব এই বিপদের আশঙ্কা সম্পর্কে অবহিত কিনা এবং অবহিত হইলে সেগুলি দূর করার জন্য কোনও ব্যবস্থা অবলম্বন করিতেছেন কিনা, তা আমরা জানি না । কিন্তু ঐ বিপদের আশঙ্কা আজ বাস্তব ।

আমরা মনে করি যে, স্বাধীনতা ও মুক্তি সংগ্রামের বর্তমান পর্যায়ে উপরে উল্লেখিত যে সমস্যা দেখা দিয়াছে, তার সমাধানের প্রশস্ত পথ হইল সমস্ত গণতান্ত্রিক ও সংগ্রামী শক্তির সমবায়ে কেন্দ্রীয়ভাবে একটি জাতীয় মুক্তিফ্রন্ট গঠন করা এবং সমস্ত পর্যায়ে সেরূপ ফ্রন্ট গঠনের নির্দেশ দেওয়া এই কাজ করা হইলে বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন গেরিলা দলের ভিতর গড়িয়া উঠিবে সমন্বয়, ঐক্যবোধ প্রভৃতি এবং রণদক্ষতা বৃদ্ধি পাইয়া তাহারা শত্রুকে আরও বেশী আঘাত করিতে পারিবেন ।

তাই, শুধু রাজনৈতিক প্রয়োজনেই নয়, বাস্তব সামরিক প্রয়োজনে ও জাতীয় মুক্তিফ্রন্ট গঠন আজ অপরিহার্য । ইহা গঠনের বিলম্বে সমূহ ক্ষতি হইবে ।