শিরোনাম | সংবাদ পত্র | তারিখ |
সম্পাদকীয়: সংগ্রামী দেশবাসির প্রতি | স্বাধীন বাংলা
১ম বর্ষ: ৪র্থ সংখ্যা |
০১ আগষ্ট ১৯৭১ |
সম্পাদকীয়
সংগ্রামী দেশবাসির প্রতি
বালাদেশের বীর জনগণকে মুক্তিসংগ্রামের একনিষ্ট হিসেবে কমিউনিষ্ট পার্টি জানায় বিপ্লবী অভিনন্দন। দেশপ্রেমের অগ্নিপরিক্ষায় সগৌরবে উত্তির্ণ জনগণের ঐক্য, সাহস ও সংগ্রামী মনোবল বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগামের সবচেয়ে বড় শক্তি।জনগনের বিজয় অবসস্ভাবী, জনগনের ঐক্যবদ্ধ শক্তি অপরাজেয়- এই দৃঢ় প্রত্যয় লইয়াই কমিউনিষ্ট পার্টি অন্যান্য গনতান্ত্রিক শক্তির সহিত কাধে কাধ মিলাইয়া বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে অংশগ্রহন করিতেছে।
দস্যু সর্দার ইয়াহিয়া খানের জল্লাদ বাহিনী গত চারমাস ধরিয়া বাংলাদেশে যে গণহত্যা ও পৈশাচিক বর্বরতা চালাইয়া আসিতেছে ইতিহাসে উহার নজির সত্যিই বিরল।ইতিহাসে আমরা বহু অত্যাচার উৎপীড়নের কাহিণী পড়িয়াছি কিন্তু একটা নিরস্ত্র জাতিকে পৃথিবীর বুক হইতে নিশ্চিহ্ন করিয়া দেবার এই দানবীয় প্রচেষ্টার দৃষ্টান্ত কদাচিৎ দেখা যায়। কিন্তু ইহাহিয়া বাহিনীর অত্যাচারের যেমন তুলনা নাই, তেমনি বাংলাদেশের গণ-জাগরণও অতুলনীয়।স্বাধীনতার দাবিতে এরূপ একতার দৃষ্টান্ত ইতিহাসে বিরল।মুক্তিসংগ্রামের শুরু হইতেই শতকরা একশজনই স্বাধিনতা সংগ্রামের সপক্ষে- প্রতিটি দেশবাসিই স্বাধীনতার সৈনিক। ১৯৪৭ সালে বৃটিশ সরকার এদেশের জনগণের মধ্য হইতে যতটা বিচ্ছিন্ন ছিল, ইহাহিয়া শাহী আজ বাংলাদেশের সকল শ্রেণী, সকল স্তর হইতে ততোধিক বিচ্ছিন্ন।
স্বাধীনতার দাবীতে জনগনের সুদৃঢ় ঐক্যর দরুনই ইহাহিয়া শাহী বিপুল নৈ-সামন্ত ও আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র সত্ত্বেও বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামকে দমন করিতে পারিতেছেনা।ইহাহিয়া বাহিনীর শত অত্যাচারও জনগণের মনোবলকে ভাঙ্গিতে পারেনাই।বরং দস্যুবাহিনীর অত্যাচার ও উৎপীড়ন ইসলামাবাদের জঙ্গী শাসকগোষ্ঠীর প্রতি বাংলাদেশের জনগণের ঘৃনাকে তীব্রতর করিতেছে, তাহাদের সংকল্পকে আরো দৃঢ় করিতেছে। জাতীয় মুক্তির এই সংগামের বিজয়ের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পথ উন্মুক্ত হইবে এই আশা নিয়াই দেশবাসী এই মরণপণ যুদ্ধে ঝাপাইয়া পড়িয়াছেন। ইয়াহিয়া চক্র নৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে আগেই পরাজিত হইয়াছে, সামরিক ক্ষেত্রেও উহাদের পরাজয় অবধারিত হইয়া উঠিয়াছে।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অবস্যম্ভাবী বিজয়ের দৃঢ় আস্থা লইয়া সেই বিজয়কে ত্বরান্বিত করার উদ্দেশ্যে কমিউনিষ্ট পার্টি দেশবাসীর কাছে কয়েকটি আবেদন রাখিতেছেঃ
১।বাংলাদেশের প্রতিটি শহর-বন্দর, গ্রাম-গঞ্জ, প্রতিটি গৃহকে শত্রুর বিরুদ্ধে প্রতিরোধের দুর্ভেদ্য দূর্গ হিসেবে গড়িয়া তুলুন।
২।জনগনের শক্তিকে সংগঠিত করুন। মনে রাখিবেন পূর্বে আমাদের আন্দোলন ছিল নিয়মতান্ত্রিক ধরনের- উহাতে স্বতঃস্ফুর্ততার উপাদান ছিল অধিক। বর্তমান সশস্ত্র শত্রুর বিরুদ্ধে সংগামে জয়লাভের জন্য স্বতঃস্ফুর্ততাকে পরিহার করিয়া জনশক্তিকে সংঘবদ্ধরূপে গড়িয়া তুলিতে হইবে।
৩।ছাত্র যুবক ও শ্রমিকদের পাশাপাশি কৃষক ভাইয়েরাও আরো বেশি সংখ্যায় স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহন করুন।মনে রাখিবেন আমাদের দেশের শতকরা ৮০ জন কৃষিজীবি, কাজে কৃষক সমাজ কত অধিক সংখ্যায় ও কতটা সংগঠিতভাবে অংসগ্রহন করেন উহার উপর অনেকাংশে নির্ভর করে কত শীঘ্র স্বাধীনতার সংগ্রাম সাফল্যজনক পরিসমাপ্তিতে পৌছিবে।
৪।বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীতে হাজারে হাজারে, লাখে লাখে যোগ দিন। নানা অসুবিধা ও কষ্ট সত্ত্বেও মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিয়ে শত্রুর নৃশংস অত্যাচারের প্রতিশোধ দিন, আমাদের সকলের প্রানের চেয়ে প্রিয় মাতৃভূমিকে শত্রুর কবল হইতে মুক্ত করুন।
৫। বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামকে বানচাল করার জন্য ইহাহিয়া চক্র ও উহার অনুচরেরা হিন্দু –মুসলিম, বাঙ্গালী- অবাঙ্গালী প্রভৃতির মধ্যে বিরোধ ও বিভেদ উসকাইয়া সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামা বাধাইতেছে। ইহার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়িয়া তুলুন ও সাম্প্রদায়িক শান্তি বজায় রাখুন।
৬।স্থানীয়ভাবে মুক্তি দংগ্রাম পরিচালনা ও মুক্তিযোদ্ধাদের সহিত সহযোগিতার উদ্দেশ্য দলমত নির্বিশেষে সংগ্রামী কর্মীদের নিয়া গোপন মুক্তি সংগ্রাম কমিটি গড়িয়া তুলুন।দুস্কৃতিকারী ও সমাজবিরোধীদের দমন করুন ও মুক্তিসংগ্রাম কমিটির নেতৃত্বে গ্রামরক্ষা বাহিনী গড়িয়া তুলুন। চোরাকারবার ও মুনাফাখোরী দমন করুন।
৭। শত্রুবাহিনীর সহিত সর্বপ্রকার অসহযোগিতা করুন এবং উহাদের অবস্থান ও চলাচলের খবর মুক্তিবাহিনীর নিকট পৌছাইয়া দিন। মুক্তিবাহিনীর খবর গোপন রাখুন।মুক্তিযোদ্ধাদিগকে আশ্রয়, রশদ প্রভৃতি দিয়া সহায়তা করুন। মনে রাখিবেন মুক্তিযোদ্ধারা আপনাদেরই সন্তান, দেশমাতৃকাকে শত্রুর কবল হইতে মুক্ত করার জন্য তাহারা প্রাণের মায়া তুচ্ছ করি লড়াই করিতেছে।
বিজয় আমদের অবশ্যম্ভাবী। স্বাধীনতার অগ্নিমন্ত্রে উদ্ধুদ্ধ বাংলাদেশের বীর জনগণের সংগ্রামকে চূর্ন করিয়া দিতে পারে পৃথিবীতে এমন কোন শক্তি নাই।
স্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ জিন্দাবাদ।