শিরোনামঃ ভন্ড নায়ক ইয়াহিয়া।
সংবাদপত্রঃ বাংলাদেশ ১ম বর্ষঃ ১৯শ সংখ্যা।
তারিখঃ ২৫ অক্টোবর, ১৯৭১।
ভন্ড নায়ক ইয়াহিয়া
ইয়াহিয়া খান যুদ্ধ চান না। আলোচনার মাধ্যমে তিনি পাক-ভারত মীমাংসার পক্ষপাতী। তাঁর মতে যুদ্ধ বাধলে উভয় রাষ্ট্রের জনগণের দুঃখ দুর্দশা বাড়বে শরনার্থী সমস্যার ও হবে না কোন সামাধান। পাক-ভারত বিরোধের কতটা ফয়সালার জন্য যে কোন সময়, যে কোন স্থানে এবং যে কোন নেতার সঙ্গে তিনি শান্তি বৈঠকে বসতে রাজি। পাক প্রেসিডেন্ট এ কথাগুলা বলছেন ফরাসী পত্রিকা লা মদের প্রতিনিধির সঙ্গে। এত সুবোধ বালক ইয়াহিয়া খান তা হয়ত ফরাসীরা আগে জানতেন না। এখন হয়ত তারা হাফ ছেড়ে বাচবেন। পাক-ভারত যুদ্ধটা আর হল না, হবেই বা কি করে ? ইয়াহিয়া নিজেই বলছেন, পাকিস্তানের চেয়ে পাচগুন ভারত। তাঁর সমর শক্তিও পাচগুন বেশি। এ অবস্থায় কি করে ভারতের উপর ধাপিয়ে পড়তে পারে পাকিস্তান? এখন যে উত্তেজনা চলছে তা প্রশমনের জন্য যে কোনো সালিশীতে তিনি সম্মত। ইয়াহিয়ার অভিযোগ-পাক-ভারত উত্তেজনার জন্য দায়ী নয়াদিল্লী। আট ডিভিশন সৈন্য দিয়ে তারা ঘিরে রেখেছেন পূর্ব বাংলা। দলে দলে পাঠাচ্ছেন অনুপ্রবেশকারী। ওরা ধ্বংস করছে যোগাযোগ ব্যবস্থা, অসার করে ফেলছে পাক অর্থনীতি। পাকিস্তানের অভ্যন্তরীন সমস্যায় ভারতীয় হস্তক্ষেপ সহ্য করা চলে না। বর্তমান সংকটের পরিণতি কি হবে তা নির্ভর করছে নয়াদিল্লীর মতি গতির উপর।
চমৎকার অভিনেতা ইয়াহিয়া খান। কয়েক সপ্তাহ আগে তিনি দিয়েছিলেন ভারতের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক সংগ্রামের হুমকি। সীমান্ত বরাবর তিনি আগে করেছেন সৈন্য সমাবেশ।
ইয়াহিয়ার আসল মতলব প্রায় সবারই জানা। তিনি চান বাংলাদেশ সমস্যাকে পাক-ভারত বিরোধে পরিণত করতে। তাই ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে সাক্ষাতকারেও তাঁর এত আগ্রহ-সালিশীর জন্য এতো আকুতি। এক সময় তিনি বলতেন ভারতে যাওয়া শরনার্থীরা আসলে পাক-শরনার্থী নয়। ওরা কলকাতা এবং অন্যান্য শহরের ফুটপাতের বাসিন্দা। পাকিস্তানকে জব্দ করার জন্য তাদের ঝেটিয়ে পাঠানো হয়েছে সীমান্তের শিবিরগুলোতে। পরে মতটা একটু পাল্টে বললেন দু’রকমের শরনার্থী আছে। আসল এবং নকল। আসলদের ফিরিয়ে নেবো। নকলরা যথাস্থানে থাকবে। এখন বলছেন সব শরনার্থীকেই তিনি গ্রহণ করবেন তার জন্য দরকার পাক-ভারত আলোচনা। আর মুক্তিবাহিনী ? ওরা পূর্ব বাংলায় ভারতীয় অনুপ্রবেশকারী। এদের আস্কারা দিচ্ছেন নয়াদিল্লী। তাঁর জন্যই পাক-ভারত সামরিক উত্তেজনা। বাংলাদেশের শতকরা তেরজন নাগরিক এখন দিন কাটাচ্ছেন ভারতের আশ্রয় শিবিরগুলোতে। এরা কেন গেলেন তা খতিয়ে দেখলে ইয়াহিয়া ধরতে পারতেন নিজের নারকীয় কীর্তি। যে বীভৎসতার কাহিনী জানে বিশ্ববাসী তা জানেন না এই স্বৈরাচারী মানবদ্রোহী। মুক্তি বাহিনী বাংলাদেশের জনগণের মুক্তি সাধনার বলিষ্ঠ প্রকাশ। তাদের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। স্বেচ্ছাচারী এবং মানবদ্রোহীর পূর্ণ উচ্ছেদ ছাড়া হবে না এ সংগ্রামের বিরতি। রক্ততিলকে শপথ নিয়েছেন বাংলার সন্তানরা। মারার চোটে একটু একটু করে নির্মম সত্য বুঝতে পারছেন ইয়াহিয়া খান। আগে তিনি বলতেন মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রদ্রোহী। এখন বলছেন জনগণ চাইলেই তাঁকে মুক্তি দেয়া হবে। এত রক্তপাতের পর স্বাধীনতার দ্বারপ্রান্তে এসে বাঙালী জনতা মহানুভব পাক সম্রাট ইয়াহিয়ার কাছে দাসখত লিখে মুজিবের মুক্তি চাইবে ?
বাংলাদেশের হৃদয়ের কতখানি জায়গা জুড়ে বসে আছেন বঙ্গবন্ধু তা কি তিনি জানেন না? ১৯৭০ সালের নির্বাচনের ফলাফল কি তিনি ভুলে গেছেন ? শুধুমাত্র বাংলাদেশ কেন, গোটা দুনিয়া আজ দাবী করছে বঙ্গবন্ধুর মুক্তি । ইয়াহিয়া খান বলদর্পিত বধির। তার কানে পৌঁছায় না মানুষের ভাষা। তিনি বুঝেন অস্ত্রের ভাষা। তাই মুক্তিবাহিনী ধরেছে অস্ত্র। খতম করছে পাক সৈন্য। এ ভাষা যত জোরালো হবে ইয়াহিয়া বধিরত্ব তত ঘুচবে। চালাকি দিয়ে ঢাকা যাবে না আহম্মকী। দেয়ালের লিখন পড়তে চেষ্টা করুন ইয়াহিয়া খান।