You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.10.15 | যুদ্ধক্ষেত্রেই সমাধান নিহিত | জয় বাংলা - সংগ্রামের নোটবুক

শিরোনামঃ (১) যুদ্ধক্ষেত্রেই সমাধান নিহিত
(২) জঙ্গীশাহীর সামরিক পাঁয়তারা
সংবাদপত্রঃ জয় বাংলা ১ম বর্ষ, ২৩শ সংখ্যা
তারিখঃ ১৫ অক্টোবর, ১৯৭১

যুদ্ধক্ষেত্রেই সমাধান নিহিত
বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের কথা বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রনায়কদের মুখে প্রায়ই শোনা যায় । মুক্তি সংগ্রামের আশু লক্ষ্যও হচ্ছে রাষ্ট্রের রাজনৈতিক কর্তৃত্ব অর্থাৎ জনগণের জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠা করা । কিন্তু সেই রাজনৈতিক সমাধানের লক্ষ্যে পৌছানো যাবে কোন পথে? সশস্ত্র সংগ্রামের দ্বারা চূড়ান্ত বিজয়ের পথে, না আলাপ আলোচনার পথে ?
স্বভাবতই যাঁরা রাজনৈতিক সমাধানের কথা বলেন, তাঁরা শান্তিপূর্ণ উপায়ে অর্থাৎ আলাপ আলোচনার পথে সমাধানের কথাই বোঝাতে চান । কিন্তু বাংলাদেশের জাতীয় নেতৃবৃন্দ ১৯৬৯ সালের গোল টেবিল বৈঠক থেকে শুরু করে ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ পর্যন্ত এই শান্তিপূর্ণ উপায়ও আলাপ আলোচনার পথই অনুসরণ করেছিলেন । পাকিস্তানী জঙ্গীশাহীই পথ বন্ধ করে বাংলাদেশের নিরস্ত্র মানুষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে । ফলে অস্ত্রের ভাষায় জবাব দেয়া ছাড়া বাংলাদেশের জনগণ ও নির্বাচিত জাতীয় নেতৃত্বের কাছে আর কোন বিকল্প পথ খোলা থাকেনি । এরই ফলে জন্ম নিয়েছে বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনী ।
সামরিক জান্তা একটা ভাষাই বোঝে । সে ভাষা অস্ত্রের ভাষা । তাই সেই ভাষাতেই তাদের জবাব দেয়া হচ্ছে । সামরিক জান্তা তখনই রাজনৈতিক সমাধানের জন্যে পথে আসতে বাধ্য হবে, যখন তাদের অস্ত্রের ভাষা ফুরিয়ে যাবে । যদি রাজনৈতিক ও সামরিক উদ্যোগ তাদের আয়ত্তে থাকে তাহলে কেন তারা নিজেদের বাড়া ভাতে ছাই দেবে ? শক্তের ভক্ত নরমের যম বলে এদেশে যে প্রবাদটি চালু আছে, অনেকের বেলায় যদি নাও খাটে, সামরিক জান্তার বেলায় তা অবশ্যই খাটে । কাজেই সামরিক জান্তাকে রাজনৈতিক সমাধানের পথে আসতে বাধ্য করার জন্যেও আমাদেরকে পাক হানাদার বাহিনীর ওপর আঘাতের পর আঘাত হানতেই হবে । এটা আমরা ভাল করেই বুঝি । তাই রাজনৈতিক সমাধানের শিখণ্ডী দাড় করিয়ে বাংলাদেশের মুক্তিকামী মানুষকে নিবৃত্ত বা বিভ্রান্ত করা যাবে না ।
আমাদের নিজস্ব প্রতিনিধির সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমদও তাই মন্তব্য করেছেন। “ যুদ্ধক্ষেত্রেই বাংলাদেশ প্রশ্নের সমাধান নিহিত । ” বিশ্বের প্রতিটি গণতন্ত্রকামী ও মানবতাবাদী শক্তি এবং রাজনৈতিক সমাধানে বিশ্বাসী নেতৃবৃন্দ এই সত্যটি যত শীঘ্র উপলব্ধি করেন, সমস্যার সমাধানও তত ত্বরান্বিত হবে ।

জঙ্গীশাহীর সামরিক পাঁয়তারা
পাকিস্তানের জঙ্গীশাহীর বাংলাদেশ-পাকিস্তান বিরোধকে সশস্ত্র পাক-ভারত বিরোধ রূপান্তরিত করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে । অবশ্য তাদের এই প্রচেষ্টা শুরু হয়েছে বেশ কিছুদিন পূর্বেই । তবে এতদিন তা প্রধানত সীমাবদ্ধ ছিল কূটনৈতিক ব্যর্থতা, জঙ্গীশাহীর বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী তীব্র ধিক্কার, অর্থনৈতিক বিপর্যয় ও মুক্তিবাহিনীর গেরিলা যোদ্ধাদের তীব্র আক্রমণের মুখে দিশেহারা ও পাগলা কুকুরের মতই ক্ষিপ্ত এবং হিতাহিত জ্ঞানশূন্য পিণ্ডি ইসলামাবাদের জঙ্গীশাহী এখন ভারতের সঙ্গে একটি যুদ্ধ বাধিয়ে তোলার চেষ্টা করছে ।
বাংলাদেশের দখলীকৃত এলাকা এবং পাকিস্তান থেকে মুক্ত অঞ্চলে পাকিস্তানী জঙ্গীশাহীর ব্যাপক সমর প্রস্তুতির খবর পাওয়া যাচ্ছে । শতদ্রু নদীর দক্ষিণ তীর বরাবর পাকিস্তানের ব্যাপক সামরিক সমাবেশ লক্ষ্য করা গেছে । চাম্ব সীমান্তের কয়েকটি পাকিস্তানী গ্রাম থেকে অসামরিক অধিবাসীরা চলে গিয়েছে । মুক্ত অঞ্চল ও ভারতের সীমান্ত বরাবর দখলীকৃত বাংলাদেশে ব্যাপক সামরিক সমাবেশ, ভারী কামান ও অন্যান্য সমরাস্ত্র স্থাপনের খবর পাওয়া গিয়াছে । তাছাড়া ভারতের নদীয়া জেলার সীমান্তে বিনা প্ররোচনায় পাকিস্তানী সেনারা গোলাগুলীবর্ষণ করেছে । এর একমাত্র উদ্দেশ্য হচ্ছে, কোন রকমে ভারতের সঙ্গে একটা যুদ্ধ বাধিয়ে পাক-ভারতের বিরোধের আবরণে বাংলাদেশ সমস্যাকে চাপা দেয়া এবং এই উপমহাদেশে শান্তি স্থাপনের অজুহাতে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের তদারকির ছত্রছায়ায় বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর তৎপরতা বন্ধ করে পাক জঙ্গীশাহীর আত্মরক্ষার চেষ্টা ।
বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম যে জয়যুক্ত হবেই এবং বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীকে পাততাড়ি ঘটি-বাটি গুটোতে হবেই এটা জঙ্গীশাহী হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করতে পেরেছে । অথচ তাদের দেশবাসীকে কিম্বা মুক্তিবাহিনীর হাতে নিহত সৈনিকদের পরিবার পরিজনকে বাংলাদেশে সামরিক এ্যাডভেঞ্চারের ব্যর্থতার কৈফিয়ত দেয়া সহজ হয় । তাই একান্তপক্ষে তাদের নিজ দেশের অর্থাৎ পশ্চিম পাকিস্তানী জনগণের কাছে মুখ রক্ষার জন্যে পাক ভারত বিরোধের মতো আর একটি সামরিক এ্যাডভেঞ্চারের ঝুকি নেবার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে ।
বাংলাদেশের ঘটনায় পাকিস্তানী জঙ্গীশাহী বিশ্বের কাছে মুখ পায়নি । এখন তাকে পাক ভারত বিরোধে রূপান্তরিত করলে বিশ্বে কিম্বা নিজ দেশের জনগণের কাছে মুখ থাকবে কিনা তা আমাদের গবেষণার বিষয় নয় । তবে সূত্র ধরে যদি এদেশের মাটিতে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক দলের আগমন ঘটে এবং তারা যদি জঙ্গীশাহীকে ভরাডুবির হাত থেকে রক্ষা করার জন্য মুক্তিবাহিনীর জাতীয় কর্তব্যে অন্তরায় হতে চান তাহলে বাংলাদেশের জনগণ, গণপ্রজাতন্ত্রী সরকার ও দেশপ্রেমিক বীর মুক্তিযোদ্ধারা তা সহ্য করবে না । পাকিস্তানের জঙ্গীশাহী যখন বাংলাদেশে নির্মম গণহত্যা চালিয়েছে, মা বোনদের ইজ্জত নষ্ট করেছে, ধন সম্পদ লুন্ঠন করেছে ও ঘরবাড়ী জ্বালিয়ে দিয়েছে, নব্বই লক্ষাধিক মানুষকে দেশছাড়া এবং নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের অধিকার হরণ করেছে তখন জাতিপুঞ্জ কোন মানবিক ও নৈতিক দায়িত্ব পালন করেনি । এখন এই উপমহাদেশে শান্তির নামে বাংলাদেশের মুক্তিকামী মানুষের আশা আকাঙ্কা ও জাতীয় লক্ষ্য অর্জনের পথে কোন অন্তরায় সৃষ্টির চেষ্টাকেই তারা মানবে না । তবে তারা সত্যই যদি এই উপমহাদেশে স্থায়ী শান্তি চান, তাহলে বাংলাদেশে গণহত্যা বন্ধ করতে এবং বাংলাদেশের মাটি থেকে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীকে চলে যেতে বাধ্য করুন । বাধ্য করুন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে মুক্তি দিতে এবং স্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশকে মেনে নিতে । এই উপমহাদেশে স্থায়ী শান্তির এটাই পথ, পাক জঙ্গীশাহীর সামরিক এ্যাডভেঞ্চারিজম নয় ।