শিরোনাম:ঢাকা আমাদের
সংবাদপত্র”: জয় বাংলা(১ম বর্ষঃ ৩৩শ সংখ্যা)
তারিখ:১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১
[মহানগরীর সরকারী বেসরকারি ভবনে স্বাধীন বাংলার পতাকা, বঙ্গবন্ধু দীর্ঘজীবী হোন ধ্বনিতে আকাশ বাতাস প্রকম্পিত]
আজ (বৃহস্পতিবার) বিকেলে ঢাকায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ করেছে। অগ্রসরমান মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় জোয়ানদের সম্মিলিত অভিযানে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা নগরী মুক্ত হয়েছে এবং সকল সরকারী বেসরকারি ভবনে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড্ডীন হয়েছে। মুজিব নগর থেকে শীঘ্রই স্বাধীন বাংলার প্রশাসনিক সদর দপ্তর স্থানান্তরিত হচ্ছে বলে জানা গেছে। তাবেদার গভর্নর মালেকের পদত্যাগের পর সেনারা নিজেরাই যুদ্ধ বিরতির আর্জি জানায়।
আজ বাংলাদেশের বীর মুক্তিবাহিনীর ও ভারতীয় জোয়ানগণ পাকিস্তানী ও হানাদারদের পশ্চাৎধাবন করে মহানগরী ঢাকায় প্রবেশ করলে বিরান ও ধ্বংসস্তূপ নগরী আবার সজীব হয়ে ওঠে এবং জয় বাংলা ও বঙ্গবন্ধু দীর্ঘজীবী হোক, বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী স্থায়ী হোক ধ্বনিতে ঢাকার আকাশ বাতাস প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। খান সেনারা এবং তাদের তাবেদারেরা সদলে আত্মসমর্পণ করেছে। আত্মসমর্পণের পর তাঁরা জেনারেল মানেক শ’র কাছে যুদ্ধ বিরতির প্রস্তাব জানালে ভারতের সেনাপতি তাদের আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেন।
ঢাকা শহর মুক্ত হওয়ার খবরে অশ্রুজল কণ্ঠে আমাদের অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট এক বানীতে বলেছে, আমাদের বিজয় লাভ সম্পূর্ণ হল। এখন আমাদের সামনে আরো কঠিন কাজ বাকী। তা হল ধ্বংসস্তূপের মধ্যে একটা জাতির পুনর্বাসন এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক পূর্ণগঠন।
প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমদ বলেছেন, স্বাধীন বাংলাদেশ বিশ্ব নিপীড়িত ও লাঞ্ছিত মানবতার একটি অকৃত্রিম বন্ধু জাতি হিসেবে গড়ে উঠবে। আমরা দেশ ও জাতিকে মুক্ত করার সংগ্রামে জয়ী হয়েছি। কিন্তু এখন জাতির পিতাকে মুক্ত করার সংগ্রামে অবতীর্ণ হতে হবে।
বিচারের বাণী…… কাঁদে
বিশ্ববাসীর নিকট আমাদের আকুল প্রার্থনা- তাঁর ইয়াহিয়া চক্রের বিচার করুন। অন্যায়ের যদি বিচার না হয়, তাহলে সত্যতা, মানবতা, ন্যায়বিচার- এসব বলে আর বিভ্রান্তির সৃষ্টি করা যেন না হয়। কারণ এই শব্দগুলি যদি শুধু মুখেই বলা হয়- কিন্তু সেগুলিকে যদি কর্মে ব্যবহার তা বাস্তবে প্রয়োগ না করা হয়, তাহলে সেই বলা কথাগুলি শুধু বিভ্রান্তির সৃষ্টি করে না- প্রহসনে রূপান্তরিত হয়। তখন সেই ভাল ভাল কথাগুলির উপর মানুষ ক্রমে আস্থা হারিয়ে ফেলে। অপরদিকে এই ভাল কথাগুলির বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়াশীল চক্র নির্মম হয়ে উঠে। ফলে তাদের অত্যাচারের মাত্রাও যায় বেড়ে। এ পর্যন্ত পৃথিবীর বৃহৎ শক্তিগুলি মানুষের মঙ্গলের জন্য প্রতিষ্ঠান করেছেন- বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য বহু মানবতার বাণী প্রচার করেছেন। মানুষের বেঁচে থাকার অধিকারের কথা বলেছেন। গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের বড় বড় বুলি আওড়িয়েছেন। বিশ্ববাসীকে আশার কথ শুনিয়েছেন।এখন দেখা যাচ্ছে তা শুধু কথায় রয়ে গেছে- বাস্তব রূপায়িত হয়নি। বাংলাদেশের স্বাধীনতা, এখানকার মানুষের উপর বর্বরোচিত নির্যাতনের জন্য ( একমাত্র ভারত ছাড়া ) কেউ কিছু করলেন না বললেই হয়। যেটুকু ও বা কেউ কেউ করলেন তা বাংলাদেশের শত্রুকে তারিয়ে দেওয়ার পক্ষে উপযুক্ত নয়। বরং এই মৃদু প্রতিবাদে ইয়াহিয়া চক্রের অত্যাচার আরও বেড়ে গেল। নির্বিচারে নির্যাতন ও গণহত্যায় বাংলার আকাশ বাতাস বিষাক্ত করে তুলল।
গত দুই মাসের যুদ্ধে বাংলা প্রায় ১০ লক্ষ সাধারণ মানুষ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছে। প্রায় ৪০/৫০ লক্ষ জনগণ ছিন্নমূল লতার মত ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন। আশ্চর্য হতে হয় এ বিষয় নিয়ে বিশ্বের বৃহৎ শক্তি মাথা ঘামাচ্ছে না। লক্ষ লক্ষ সাধারণ মানুষকে নির্বিচারে নির্লজ্জ হত্যার নজির এক ইয়াহিয়া ছাড়া অন্য কোন ইতিহাসে পাওয়া যায় না। লক্ষ লক্ষ নারীর সতীত্বকে বিনষ্ট করা, তাদের উলঙ্গ করে মাঠে ছেড়ে দেওয়া ও ঘরে আবদ্ধ করে রাখা, একই মেয়ের উপর পর পর কয়েকজন নরপশুর আত্মীয়ের সামনে অত্যাচার, স্তন কেটে ফেলে পিতাকে উপহার দেওয়া, স্ত্রী-লিঙ্গে বেয়োনেট দিয়ে খোঁচান, শিশুকে ধরে পা চিরে বা গাছে আছাড় দিয়ে নির্মমভাবে হত্যা, হাজার হাজার নিরীহ মানুষকে দাঁড় করিয়ে রেখে গুলি করে হত্যা, শহর ও গ্রামের বাড়িঘর নির্বিচারে ধ্বংস করা ও জ্বালিয়ে দেওয়া, মানুষের ধান-চাল, সোনা অর্থাৎ যা কিছু সম্পদ, সবই লুণ্ঠন করা। এসবেও যদি বিশ্ব বিবেক কাতর হয়ে না ওঠে এবং প্রতিকারের জন্য কার্যকারী ভূমিকা গ্রহণ না করে- তা হলে মানবতা, বিশ্বশান্তি, বিশ্বপ্রেম প্রভৃতি শব্দের মূল্য কোথায় ? আজ মানবতা পৃথিবীর দ্বারে কেঁদে মরছে। এরপরও কেউ যদি action না দিয়ে শুধু শান্তির কথা বলে- তা প্রহসন ছাড়া আর কি হতে পারে?
তাই আমি বিশ্বকে আহ্বান করে বলতে চাই- মানবতা ও বিশ্বশান্তিই যদি সকলের নিকট শ্রেয় ও আদর্শ হয়- তাহলে অত্যাচারী ইয়াহিয়া বিচার করুন। মানবতার আহ্বানকে যদি আপনারা মর্যাদা দেন তাহলে শয়তান-রুপী ইয়াহিয়ার অত্যাচারে বাস্তব চেহারা বাংলায় এসে দেখে শুনে যান এবং সেই বাস্তব অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে আপনারা ন্যায় বিচার করুন। এবং এই জঘন্য নির্যাতন ও গণহত্যা বন্ধ করুন।তা না হলে পৃথিবীতে মানবতার মৃত্যু ঘটবে এবং ‘বিশ্বশান্তি’ ‘বিশ্বপ্রেম’ শব্দগুলির ভাবার্থের কোন মর্যাদাই থাকবে না। যে ন্যায় বিচার স্বর্গীয়- তা কেঁদে মরবে। বিশ্বের বিবেক সম্পন্ন ব্যক্তির আকুল আবেদনে বৃহৎ শক্তিগুলির কোন মর্যাদা দেবেন না ? আমার সোনার বাংলার এ দশা দেখে শুধু মনে পড়ে- “আমি যে দেখেছি প্রতিকার শক্তি অপরাধে- বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে।
আড়াই ডিভিশন পাঞ্জাবী ফৌজ বাংলার স্বাধীনতা রুখতে পারবে না
অচিরেই বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে যাচ্ছে। পৃথিবীর মানচিত্রে সংযোজিত হচ্ছে নদীমাতৃক বাংলাদেশ, একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসাবে।
ইদানীং ইয়াহিয়া জঙ্গী সরকারের বেতার বার্তায় প্রচারিত হয়েছে যে বাংলার বিদ্রোহ দমন করতে আরও আড়াই ডিভিশন (৩৫ হাজার) খান সেনা বাংলায় পাঠান হচ্ছে। এখন স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে তবে আগের ৩ ডিভিশন পাঞ্জাবী গেল কোথায় ? তারা কি বাড়ী যেয়ে ছুটি যাপন করছে ? না, বাঙ্গালী বীরেরা তাদেরকে পাতালপুরীতে নিমন্ত্রণ খাওয়াতে নিয়ে গেছেন ? স্বাধীন বাংলার বেতার কেন্দ্রের ঘোষণা ও বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া খবর হতে স্পষ্টই বুঝা যাচ্ছে যে, বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু হওয়া থেকে আজ পর্যন্ত কমপক্ষে ২৫০০০ (পঁচিশ হাজার) পাক সেনা নিহত ও বহু আহত হয়েছে।
যুদ্ধবাজ টিক্কা খাঁ যে বাংলাদেশের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে আয়ত্তে আনবেন- আজ ৪৮ ঘণ্টার স্থলে ৮০ দিন অর্থাৎ ১৯২০ ঘণ্টা বিলীন হয়ে গেল, এর মদ্যে না পারলেন বাংলাদেশকে দমন করতে না পারলেন ২৫০০০ খান সৈন্যের জীবন রক্ষা করতে। বর্তমান হালে আর পানি পাচ্ছে না পাঞ্জাবীদের। অবস্থা বেগতিক দেখে সামরিক কর্তৃপক্ষ সাধারণ ক্ষমা প্রদর্শন করেছেন দেশবাসীকে এবং তারাও দেশবাসীর নিকট হতে ক্ষমা চেয়েছেন। কথাটি ঠিক মানানসই হল না কার কাছে। বাংলা বাসীকে প্রশ্ন করি তারা কি কার করুণার পাত্র হতে চান অথবা ক্ষমা করতে চান জালেম, অগ্নিসংযোগকারী, লুণ্ঠনকারী, লক্ষ লক্ষ নিরস্ত্র নরনারী, বৃদ্ধ, শিশু হত্যাকারী মা-ভগিনীর ইজ্জত বিনষ্টকারী ইয়াহিয়ার পশু পাঞ্জাবী সেনাদেরকে? কিন্তু এর উত্তর বাংলা বাসী বহু পূর্বেই দিয়েছেন কোন “আপোষ নেই” নেই কোন রাজনৈতিক সমাধান।
এর একমাত্র সমাধান “অস্ত্র” অথবা বাংলার “স্বাধীনতা”। ওয়াদা খেলাপ কারীদের আজ আর কোনও কথায় বিশ্বাস নেই। দেশকে স্বাধীন আমরা করবোই। লক্ষ লক্ষ রক্তস্রোত বৃথায় যেতে দিবো না। আজ পূর্বের আকাশে রাঙা প্রভাতের বিজয় কেতন নিয়ে ধীরে জেগে উঠেছে সোনার সূর্য। ওই শোনা যায় জয়ভেরির নিনাদ “স্বাধীন বাংলা’
আমাদের লক্ষ্য মৃত্যু অথবা জয়লাভ
দশ লক্ষ শহীদের তাজা রক্তের বন্যায় ভেসে গেছে “পাকিস্তান”- এর শবদেহ। বীর প্রসবিনী। বাংলার লক্ষ লক্ষ দামাল ছেলেরা এখন সুদূর চট্টল থেকে দিনাজপুরের রোদ্র-ক্ষরা মালভূমি পর্যন্ত পঁয়ষট্টি হাজার গ্রাম গড়ে তুলেছে এক একটি দুর্জয় দুর্গ।
পদ্মা-মেঘনা-যমুনা আর তিস্তার কূলে কূলে গড়ে ওঠা জনপদে আজ শুধুমাত্র একটি শপথই প্রতিধ্বনিত হচ্ছে- ‘এবার আর শহীদ নয় গাজী হবো।” পাক জঙ্গী চক্র সোনার বাংলাকে শ্মশানে পরিণত করার পর, বাংলাদেশে আবার পাকিস্তানের পতাকা ওড়াতে চায়। তারা ইসলাম ও সংহতি রক্ষা করতে গিয়ে হত্যা করেছে লক্ষ লক্ষ নিরপরাধ অসহায় নর-নারী আর শিশুদের, ধ্বংস করেছে মসজিদ, মন্দির স্কুল কলেজ, কলকারখানা। ক্ষেত- খামার, জমা-জমি আর গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়ে রচনা করেছে পাকিস্তানের সমাধিস্থল- সে সমাধির পড়ে একমাত্র স্বাধীন বাংলার পতাকাই উড়বে।
দশ লক্ষ শহীদের রক্তে সিক্ত পাকিস্তানের পতাকার সাথে আমাদের কোন মিত্রতা নেই- কোন সম্পর্ক নেই- নেই কোন আপোষ। যে কোন মূল্যেই হোক না কেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা রক্ষা আমরাই করবই। আমাদের লক্ষ্য মৃত্যু অথবা জয়লাভ।