You dont have javascript enabled! Please enable it! 1972.02.11 | জাপানযাত্রী বঙ্গবন্ধু | বঙ্গবন্ধুর জাপান সফর | ড. মো. আনোয়ারুল ইসলাম - সংগ্রামের নোটবুক

জাপানযাত্রী বঙ্গবন্ধু

[‘জাপান- বাংলাদেশ সহযােগিতার ক্ষেত্র সম্প্রসারিত হইবে’- বঙ্গবন্ধু , দৈনিক ইত্তেফাক, ১১ ফেব্রুয়ারী ১৯৭২।]

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীকে পরাজিত করে বিশ্বের মানচিত্রে নবীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ অভ্যুদয় লাভ করে। এরপর ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তান কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন এবং দেশের শাসনভার গ্রহণ করেন। বিশ্বের মানচিত্রে নতুন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের যাত্রা শুরু হয়। ১৯৭২ সালের ১১ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অস্থায়ী সংবিধান আদেশ অনুযায়ী দেশে সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন। সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশ তাও আবার যুদ্ধবিধ্বস্ত। এরকম একটি রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অস্তিত্ব ও উন্নয়ন নিশ্চিত করতে বৈদেশিক সম্পর্ক উন্নয়ন এবং পররাষ্ট্রনীতির ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিষয়টি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বুঝতে পেরেছিলেন। কেননা তখনাে (১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পূর্বে) ভারত ও ভুটান ছাড়া আর কোনাে রাষ্ট্রের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি পায়নি বাংলাদেশ। উপরন্ত পাকিস্তান ও তার মিত্রদের বাংলাদেশবিরােধী প্রচারণায় বিশ্বের অধিকাংশ রাষ্ট্র তখনাে বিভ্রান্ত। এমতাবস্থায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বুঝতে পারেন আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে বাংলাদেশের গ্রহণযােগ্যতা বাড়াতে হবে। এক্ষেত্রে রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের জন্য স্বীকৃতি আদায় করাটাই ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রথম পদক্ষেপ।

অতি অল্পদিনের মধ্যেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের গৃহীত নীতির কারণে বাংলাদেশ এশিয়া, ইউরােপের বিভিন্ন দেশের কাছ থেকে স্বীকৃতি পেতে থাকে। কত মহাদেশ, সমুদ্রপাড়ের দ্বীপদেশ, জর্জরিত নিষ্পেতি স্বাধীনতাকামী বঙ্গবন্ধুর অনুপ্রেরণায় উজ্জীবিত হয়ে বাংলাদেশের সাথে সংযুক্ত হতে চেয়েছে। এসব

৬৯

রাষ্ট্রগুলাে বা দেশগুলােকে গভীর আত্মীয়তাসূত্রে বঙ্গবন্ধু মেলবন্ধন ঘটিয়েছেন। হৃদয় উজার করে মিশেছিলেন সকলের সঙ্গে। শান্তিকামী রাজনীতিবিদ বঙ্গবন্ধু বিশ্ব। মানবের মৈত্রীর কথা এমন সুন্দর করে বলে গেছেন, যা পৃথিবীর কম। রাজনীতিবিদই পেরেছেন। তার কথা ছিল, ধ্বংস নয় সৃষ্টি; যুদ্ধ নয় শান্তি।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পেয়ে তিনি বিশ্ববাসীকে আহ্বান জানালেন বাংলাদেশকে সাহায্য-সহযােগিতা করার জন্য। অনেক দেশই বন্ধুত্বের আহ্বান নিয়ে এগিয়ে আসলেন।

১৯৭২ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি জাপান স্বীকৃতি দেবার আগে বিশ্বের প্রায় ত্রিশটি দেশ বাংলাদেশের বন্ধুত্ব এবং স্বীকৃতি দেয়ার তালিকায় যুক্ত হয়। তন্মেধ্যে ইউরােপ ও এশিয়ার অনেক প্রভাবশালী দেশও ছিল। দেশগুলাে হলাে ভারত, ভুটান, বার্মা, নেপাল, বার্বাডােস, যুগােস্লাভিয়া, টোংগা, সােভিয়েত ইউনিয়ন, চেকোস্লোভিয়া, সাইপ্রাস, হাঙ্গেরি, অস্ট্রেলিয়া, ফিজি, নিউজিল্যান্ড, সেনেগাল, ব্রিটেন পশ্চিম জার্মানি, ফিনল্যান্ড, ডেনমার্ক, সুইডেন, নরওয়ে, আইসল্যান্ড, ইসরায়েল, অস্ট্রিয়া, ওয়েস্টার্ন সামােয়া, কিউবা প্রভৃতি। জাপানই প্রথম শিল্পোন্নত দেশ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়।

যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশ পুনর্গঠনে জাপানের সহযােগিতার প্রয়ােজন ছিল সবচেয়ে বেশি। জাপানের জনগণও চেয়েছিল যত দ্রুত জাপান যেন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। এ প্রসঙ্গে হায়াকাওয়া লিখেছেন, ‘… বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে আমি আমার অন্তর থেকে অভিনন্দন জানাই এবং অন্য কয়েকজন সাংসদের সঙ্গে মিলে বাংলাদেশকে অবিলম্বে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য জাপান সরকারের প্রতি আহ্বান আমি জানাতে থাকি। সরকারও এ বিষয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয় এবং শিল্পোন্নত দেশগুলাের মধ্যে সবার আগেই জাপান নবগঠিত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়।১১০

১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের ১০ তারিখে জাপান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। তখন জাপানের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন এইসাকু সাতাে এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী ফুকুদা। ভারতের নতুন দিল্লির জাপান রাষ্ট্রদূত থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে টেলিগ্রাম পাঠান।

————————————–

১১০ . তাকাশি হায়াকাওয়া , প্রাগুক্ত, পৃ. ১৪।

————————————–

৭০

টেলিগ্রামে জাপানের প্রধানমন্ত্রী এইসাকু সাতাে সদ্য স্বাধীন দেশ বাংলাদেশ এবং গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে শুভেচ্ছা বার্তা পাঠান। শুভেচ্ছা বার্তায় তিনি উল্লেখ করেন:

Japan has announced its recognition of Bangladesh. The Japanese foreign minister said in Tokyo today that his government will establish full diplomatic relations with Dacca at the ambassadorial level. The decision has been conveyed to the Bangladesh Government through the Japanese Consulate-General in Dacca. Simultaneously, President Bhutto of Pakistan has been informed of the decision. The Japanese Prime Minister, Mr. Sato, has cabled a message of greetings to Sheik [Sheikh] Mujibur Rahman on the birth of the new republic.*

জাপান কর্তৃক বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদান সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী এইসাকু সাতাের নিকট থেকে স্বীকৃতি পাবার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও জাপানি প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানিয়ে একটি বাণী প্রেরণ করেন। বাণীতে বঙ্গবন্ধু উল্লেখ করেন জাপানবাংলাদেশ সহযােগিতার ক্ষেত্র সম্প্রসারিত হইবে’ বাণীতে বঙ্গবন্ধু আরাে বলেন, জাপানের ন্যায় একটি মহান এশীয় দেশের নিকট হইতে আমার দেশের জন্য স্বীকৃতিলাভে আমি সত্যই আনন্দিত। অগ্রগতি, সমৃদ্ধি ও গণতান্ত্রিক মূল্যবােধের প্রতি শ্রদ্ধার জন্য জাপান এশিয়া ও আফ্রিকার বহু দেশের নিকট প্রেরণার উৎস। জনগণের স্বার্থে ভবিষ্যতে আমাদের দুই দেশের মধ্যকার সহযােগিতা ক্রমশ: সম্প্রসারিত হইবে বলিয়া আশা করি। আমার সরকার ও জনগণ এবং আমার। নিজের পক্ষ হইতে জাপান সরকার ও জনগণকে আমাদের আন্তরিক অভিনন্দন জানাইতেছি।১১১

——————————————-

* Songramomernotebook.com/archives/112175 

১১১. দৈনিক ইত্তেফাক, ১১ ফেব্রুয়ারী ১৯৭২।

——————————————-

৭১

জাপান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দান উপলক্ষে জাপানি পত্রিকা ডেইলি ইয়েমুরি পত্রিকার শিরােনাম ছিল ‘Japan Recognizes Bangladesh as Independent Nation’। বাংলাদেশকে জাপানের স্বীকৃতি প্রসঙ্গে পত্রিকাটি থেকে বিস্তারিত জানা যায়। জাপানি পররাষ্ট্রমন্ত্রী ফুকুদার উদ্ধৃতি দিয়ে পত্রিকাটি বলেছিল বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ায় পাকিস্তানের সাথে জাপানের বন্ধুত্ব সম্পর্কের অবনতি হবে না। জাপানের প্রধানমন্ত্রী এইসাকু সাতাে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবার বিষয়টি তিনি পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি জুলফিকার আলী ভুট্টোকে অবহিত করেছেন।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী ফুকুদার ভিত্তিক প্রতিবেদনে ডেইলি ইয়েমুরি উল্লেখ করেছিল: Prime Minister Sato sent a telegram to Prime Minister Sheikh Mujibur Rahman of Bangladesh, congratulating him on the birth of his nation and offering his best wishes for the progress and prosperity of former East Pakistan.

Foreign Minister Fukeda also sent a telegram to the government of Bangladesh, recognizing the country on the Indian subcontinent and expressing Japan’s desire to establish diplomatic relations.

The Foreign office hopes to exchange ambassadors between the two countries and promote the status of the Japanese consulate general in Dacca to that of an embassy at an early date.

In his statement on Japan’s recognation of Bangladesh, foreign Minister Fukeda expressed storng hope for the peace and stability of Bangladesh. Nothing that Pakistan had not recognized the Independence of Bangladesh, Fukeda said Japan’s policy to maintain friendly relations with Pakistan remained unchanged.

Prime Minister Sato had sent his personal telegram to Pakistan President Zulfikar Ali Bhutto on Japan’s recognition of Bangladesh. Fukuda said he also hoped that Pakistan and Bangladesh would soon establish a friendly relationship.

Fukuda told the cabinet meeting that China would not recognize Bangladesh for the time being.

He also said that the US apparantly had great interest in Bangladesh, although it would not recognize the new country at this stage.

———————————————

* Daily Yomiuri, 11 February, 1972

———————————————

৭২

Fukuda predicted that France, Italy, Belgium and the Netherlands would recognize it in the next few days.

He also reported to the cabinet meeting that 60 to 65 percent of Japan’s yen loans to Pakistan totaling the equivalent of $200 million had been granted to East Pakistan, now Bangladesh.

Japan would have to carefully study how to balance its loans and aid to Pakistan and Bangladesh in the future, he said. Japan’s recognition of Bangladesh would not adversely affect Japan’s friendly relations with Pakistan, he explained.

Japan decided to recognize Bangladesh after carefully watching the international situation because it reached the conclusion that its recognition of Bangladesh would not seriously affect Japan’s relations with West Pakistan, observers said.

Establishment of diplomatic relations with Bangladesh would enable Japan to offer food, construction materials and other goods and services in aid to Bangladesh in its postwar reconstruction, the sources sa ion, the sources said. “112

বাংলাদেশকে জাপানের স্বীকৃতি দান প্রসঙ্গে হায়াকাওয়া বলেন, জাপান স্বাধীন বাংলাদেশকে দ্রুত স্বীকৃতি দিয়েছিল। সিদ্ধান্তটি ছিল অতি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর জাপান কূটনীতির ক্ষেত্রে এই প্রথম স্বত:স্ফুর্তভাবে একটা উদ্যোগ নিল।১১৩ জাপান বাংলাদেশ কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হলে ১৯৭২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি জাপান বাংলাদেশে দুতাবাসের কার্যক্রম চালু করে। তাকাশি ওয়ামাদা বাংলাদেশে প্রথম জাপানি রাষ্টদূত নিযুক্ত হন। অবশ্য জাপান বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে যে সাহায্য সহযােগিতা করছিল তা তারা অব্যাহত রাখে। ১৯৭২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি জাপান এয়ার লাইন্সের একটি বিরাট বিমান নানান ধরনের সাহায্য সামগ্রী নিয়ে ঢাকা পৌছায়। সাহায্য সামগ্রীর মধ্যে ছিল ১০ টন দুধ, ৫,০৪০টি কম্বল, ২০০০টি ট্রানজিস্টর এবং টিনজাত খাদ্য। জাপানের জনগণ ও স্কুলের ছেলেমেয়েরা জাপান রেডক্রসের মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণের জন্য এই সাহায্য দান করেন।

জাপান বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেবার পর সবচেয়ে উল্লেখযােগ্য ঘটনা ছিল জাপান পার্লামেন্টারি প্রতিনিধিদলের বাংলাদেশ সফর। ১৯৭২ সালের মার্চ

——————————————

১১২. Quoted from Sheikh Ahmed Jalal, Ibid, p.260।

১১৩. তাকাশি হায়াকাওয়া, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৪।

——————————————

৭৩

মাসে জাপান সরকারের বিশেষ মৈত্রীদূত হিসেবে প্রতিনিধিদল বাংলাদেশ সফর করেন। জাপানি প্রতিনিধি দলের সফরের উদ্দেশ্য ছিল জাপান সফরের আমন্ত্রণ জানিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে জাপানি প্রধানমন্ত্রী এইসাকু সাতাের চিঠি হস্তান্তর এবং যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশ পুনর্গঠনে সহযােগিতা করা। জাপানের সংসদ (ডায়েট] সদস্য ও প্রবীণ রাজনীতিবিদ তাকাশি হায়াকাওয়া বাংলাদেশ সফরে নেতৃত্ব দেন। প্রতিনিধিদলে আরাে ছিলেন তারাে সুগা এবং তাকাশি কাসাওকা। প্রতিনিধি দলে আরাে যুক্ত ছিলেন জাপানের অন্যতম প্রধান সংবাদপত্র দৈনিক মাইনিচি শিম্বুন এর ব্যাংকক অফিসের প্রধান নাগামােতাে। জাপান সরকারের বিশেষ মৈত্রীদূত হিসেবে বাংলাদেশ সফরে এসে ঢাকা বিমানবন্দরে তারা সাংবাদিকদের সাথে আলােচনা প্রসঙ্গে জানান, জাপান সরকার যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশকে সাহায্য করার জন্য সম্ভাব্য সব কিছুই করবেন এমনকি জাতিসংঘে বাংলাদেশের সদস্যভুক্তিসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক বিষয়েও জাপান বাংলাদেশের পাশে থাকবে।১১৪

প্রতিনিধিদলের নেতা হায়াকাওয়া এই মাহেন্দ্রক্ষনের স্মৃতি তুলে ধরেছেন এভাবে, ‘১৪ মার্চ [১৯৭২] প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে তাঁর কার্যালয়ে গিয়েছিলাম। তাকে জাপানি প্রধানমন্ত্রী এইসাকু সাতাের চিঠি দিতে হবে। সন্ধ্যা সাতটার পর প্রধানমন্ত্রীর সরকারি ভবনে পৌঁছে আমাদের অবাক হতে হলাে। প্রচুর লােকের ভিড়। তারা নাকি নানা অনুরােধ নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে এসেছেন। এমন দৃশ্য জাপানে কখনাে দেখা যায় না। প্রধানমন্ত্রীর ঘরে প্রবেশ করলে তিনি মুখভরা হাসি নিয়ে আমাদের স্বাগত জানান।১১৫

—————————————

১১৪ দৈনিক ইত্তেফাক, ১৩ মার্চ ১৯৭২। 

১১৫ . তাকাশি হায়াকাওয়া, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৬।

—————————————

৭৪

প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানকে দেখে দারুণ বিস্মিত হন জাপানি প্রতিনিধিদলের নেতা তাকাশি হায়াকাওয়া। প্রথম দর্শনের অনুভূতি ব্যক্ত করেছেন হায়াকাওয়া এভাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের অর্ধেক জীবন কেটেছে জেলবন্দি হয়ে। তবে তিনি যে এত দুঃখ-কষ্টের মধ্যে জীবন যাপন করে এসেছেন, তার প্রাণবন্ত চেহারা ও আন্তরিক মনােভাব দেখে সে কথা বােঝার উপায় নেই। তাঁর সঙ্গে সাক্ষাতের আগের দিন প্রেসিডেন্ট আবু সাঈদ চৌধুরী আমাদের জানিয়েছিলেন, প্রধানমন্ত্রী কেবল জাতির মুক্তি-আন্দোলনের নেতা নন, তিনি এ দেশের প্রতীকও।১১৬

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও অত্যন্ত হৃদ্যতাপূর্ণ পরিবেশে তাদেরকে অভ্যর্থনা জানান। জাপানি প্রতিনিধিদল সফলতার সাথে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে বৈঠক সমাপ্ত করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে প্রতিনিধিদলের সাথে আলােচনা করেন। এ সময় তিনি তার গৃহীত জোট নিরপেক্ষ ও স্বতন্ত্র নীতির ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেন। বাংলাদেশের মিত্র এবং ঘনিষ্ট দেশ হিসেবে জাপানের সহায়তা কামনা করেন। প্রথম বৈঠকটি সফলতার সাথে সমাপ্ত করে হায়াকাওয়া লিখলেন, “প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আমাদের বৈঠকে প্রথমে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে আলােচনা হলাে। তিনি তাঁর গৃহীত জোটনিরপেক্ষ ও স্বতন্ত্র নীতির ওপর জোর দেন এবং সেটি টিকিয়ে রাখার জন্য একই এশিয়ার মিত্র দেশ হিসেবে জাপানের সহযােগিতা কামনা করেন।… এই বৈঠকে আমি তাকে জাপান সফরের আমন্ত্রণ জানিয়ে জাপানি প্রধানমন্ত্রী এইসাকু সাতাের চিঠি হস্তান্তর করি। শেখ মুজিবুর রহমান সেই আমন্ত্রণের জন্য, সেই সঙ্গে জাপান থেকে ১০ লাখ ডলারের সমপরিমাণের সার সরবরাহ এবং ঘােড়াশাল সার কারখানায় পুনরায় কারিগরি সাহায্য প্রদানের জন্য ধন্যবাদ জানান। এ ছাড়া তিনি বাংলাদেশের কঠিন অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ফেরি জাহাজ, কোষ্টার, ছােট আকারের পরিবহন জাহাজ, ট্রাক, মাছ ধরার জাহাজ এবং টেলিযােগাযােগের সরঞ্জামসহ জরুরি সাহায্য প্রদানের জন্য জোর আবেদন জানিয়েছিলেন।”১১৭

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হায়াকাওয়া অত্যন্ত গভীর শ্রদ্ধার ও সম্মানের চোখে দেখেছেন। হায়াকাওয়াকেও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সবচেয়ে বেশি মুগ্ধ করেছেন। হায়াকাওয়াকে তিনি উল্লেখ করেছেন বন্ধু বলে। হায়াকাওয়ার মতাে অসংখ্য জাপানি তারাও বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশকে ভালােবেসেছেন। এ দেশের উন্নতির জন্য সহযােগিতা করেছেন প্রাণের গভীর থেকে। এজন্যই চারদিনের সফর

—————————————

১১৬ . তাকাশি হায়াকাওয়া, প্রাগুক্ত, পৃ.১৬। 

১১৭ , তাকাশি হায়াকাওয়া, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৭।

—————————————

৭৫

শেষে জাপানি প্রতিনিধিদল উপলদ্ধি করতে সক্ষম হয়েছিলেন-“বাংলাদেশের মতাে জাপানেরও যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার অভিজ্ঞতা আছেজাপানের বাংলাদেশকে সব ক্ষেত্রে সহায়তা দেওয়া প্রয়ােজন।১১৮

বাংলাদেশের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের জোরদার ভূমিকা পালন করে জাপান। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দৃঢ়চেতা মনােভাবের কারণেই এটা সম্ভব হয়েছে। ১৯৭২ সালের ২৮ মার্চ জাপান বাংলাদেশে প্রথম অর্থনৈতিক সার্ভে মিশন পাঠায়। মিশনের অন্যতম একটি কর্মসূচি ছিল যমুনা নদীর ওপর সেতু নির্মাণের সম্ভাবনা সমীক্ষা প্রণয়ন করা। ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে জাপানি প্রতিনিধিদলের সাক্ষাতে তিনি জাপান সরকারের নিকট এই আবেদন জানিয়েছিলেন। ওই সময়েই সাংস্কৃতিক সম্পর্ক জোরদার করতে জাপান থেকে এক বৌদ্ধ প্রতিনিধিদল বাংলাদেশে আসেন। ১৯৭২ সালের ২৭ মার্চ তারিখে প্রতিনিধিদলটি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর সাথে দেখা করেন। জাপান বুদ্ধসংঘের প্রেসিডেন্ট নিচিদাতসু ফুজি তিনি প্রতিনিধিদলটির নেতৃত্ব দেন।

তারা মহামান্য রাষ্ট্রপতিকে একটি দেয়াল ঘড়ি উপহার দেন। নিচিদাতসু ফুজি বাংলাদেশ সফরে খুশি হয়েছেন জানিয়ে মহামান্য রাষ্ট্রপতিকে বলেন, বাংলাদেশে সব ধর্মের লােক শান্তিতে বসবাস করছে দেখে তিনি খুশি হয়েছেন।১১৯ জাপানি বুদ্ধসংঘ বাংলাদেশে বৌদ্ধ মঠ নির্মাণ করবে বলেও তারা উল্লেখ করেন।১২০

———————————————————–

১১৮ ঐ, পৃ. ১৯। 

১১৯. দৈনিক বাংলা, ২৮ মার্চ ১৯৭২।

১২০, ঐ।

———————————————————–

৭৬

মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে খাদ্য সংকট ছিল সবচেয়ে বড় সমস্যা। জাপান বাংলাদেশ বন্ধুত্বের প্রথম পর্যায়ে খাদ্য সহযােগিতা করে। ১৯৭৩ সালের ২৭ জানুয়ারি জাপান বাংলাদেশকে খাদ্য সাহায্য কর্মসূচির আওতায় ১২৫০০ টন চাল সরবরাহের জন্য দুই দেশের মধ্যে এক চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠিত হয়। চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের পক্ষে নেতৃত্ব দেন খাদ্যমন্ত্রী ফণীভূষণ মজুমদার।১২১ ১৯৭৩ সালের ২৪ মার্চ বাংলাদেশে কারিগরি সহায়তা প্রদানের জন্য জাপান ও বাংলাদেশের মধ্যে এক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। দৈনিক বাংলায় এক খবরে বলা হয়। বাংলাদেশের জাপানি রাষ্ট্রদূত মি: তাকাশি ওয়ােমাদা ও বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশনের সচিব এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। ১৯৭৩ সালের ১৩ এপ্রিল তারিখে জাপান বাংলাদেশকে ২২০টি বাস, ১৫০টি ট্রাক প্রদান করে। ঢাকা ক্লাবে আয়ােজিত এক অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানে জাপানি রাষ্ট্রদূত মি. ওয়ােমাদা গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় যােগাযােগমন্ত্রী ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলীর হাতে গাড়ির চাবিগুলাে তুলে দেন। অনুষ্ঠানে জাপানের ট্রাক ও বাস নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান মিৎসুবিশি মােটরস কর্পোরেশনের ম্যানেজিং ডাইরেক্টর মি. মিয়াবারা যােগাযােগমন্ত্রী ক্যাপ্টেন এম. মনসুর আলীকে বাসের একটি প্রতিকৃতি উপহার দেন।১২২

১৯৭৩ সালের ১১ জুন তারিখে জাতিসংঘ ত্রাণ-কার্যক্রমের আওতায় বাংলাদেশকে জাপানের দেওয়া ২২০টি বাসের মধ্যে ১১০টি চট্টগ্রাম এসে পৌছায়।১২৩ ১৯৭৩ সালের ডিসেম্বরে হায়াকাওয়া যখন দ্বিতীয়বার বাংলাদেশ সফরে আসেন, তখন তিনি জাপানের দেয়া বাসগুলাে ঢাকার রাস্তায় চলতে দেখছিলেন। হায়াকাওয়া তার লেখায় উল্লেখ করেছেন, ‘… রাস্তায় সাইকেল-রিকশার ভিড়ের মধ্য দিয়ে জাপান থেকে পাঠানাে নতুন বাসগুলাে ছুটে যেতে দেখেছি। দুই বছর আগে শুধু পুরােনাে বাসগুলাে চোখে পড়ত।১২৪

বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ। বঙ্গবন্ধু কৃষিক্ষেত্রে উন্নয়নের জন্য জাপানি সহযােগিতা কামনা করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে ১৯৭৩ সালে জাপান বাংলাদেশকে কৃষিক্ষেত্রে কারিগরী সহযােগিতার জন্য চুক্তি (Exchange of Notes concerning the Dispatch of Japan Overseas Cooperation Volunteers) স্বাক্ষর করে। এরই আলােকে প্রাথমিক পর্যায়ে জাপান তিনজন ভলান্টিয়ার বাংলাদেশে প্রেরণ করে। তাকেও ওশিমা (Takeo Oshima) ছিলেন প্রথম

——————————————

১২১ দৈনিক বাংলা ২৮ জানুয়ারি ১৯৭৩। 

১২২. দৈনিক বাংলা, ১৪ এপ্রিল ১৯৭৩। 

১২৩, দৈনিক বাংলা (১২ জুন ১৯৭৩। 

১২৪ তাকাশি হায়াকাওয়া, প্রাগুক্ত, পৃ.২২।

——————————————

৭৭

বাংলাদেশে আসা একজন ভলান্টিয়ার। বাংলাদেশকে সহায়তা দেবার জন্য ১৯৭৩ সালের আগস্ট মাসে বাংলাদেশে আসে। সেই সময়ের স্মৃতি উল্লেখ করে তাকেও ওশিমা বলেন, ‘it was 1973 August, that I set foot on Bangladesh as one of three JOCVs (Rice farming, Vegetable and Agricultural Machine) and we were the first batch dispatched to Bangladesh’.125

যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পুনর্গঠনেও জাপান উল্লেখযােগ্য ভূমিকা পালন করে। অতীতেও বাংলাদেশের সাথে জাপানের সম্পর্ক ছিল বন্ধুত্বপূর্ণ। পাকিস্তানি শাসনামলে জাপানি সাহায্য ও সহযােগিতায় বাংলাদেশের সিলেট ও ঘােড়াশালে সার কারখানা, চট্টগ্রামে ইস্পাত কারখানা এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে রেয়ন প্রস্তুত কারখানা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে এসব শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলাে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সুতরাং জাপান পুনরায় স্ব উদ্যোগে এ সকল প্রতিষ্ঠান চালু করতে বিশেষ সহায়তা করে।

বাংলাদেশের প্রতি জাপানের আন্তরিকতা সবসময়েই ছিল অকৃত্রিম। বাংলাদেশে কৃষি ব্যবস্থার আধুনিকীকরণ ও অধিক খাদ্য ফলাও অভিযানসহ সবুজ বিপ্লব বাস্তবায়নের মহাকর্মে জাপান একটি প্রধান সহযােগী ভূমিকা পালন করছে। কৃষি ক্ষেত্রেও জাপান স্বাধীনতা উত্তর কালে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে স্ব নির্ভর হতে সবিশেষ সহায়তা করছে। বাংলাদেশের পরিবহন সংকট নিরসনার্থ জাপান হতে আমদানী করা হয়েছে বাস। খাদ্যাভাবের মােকাবিলাতেও আমদানী করা হয়েছে। চাউল। ১৯৭৩ সালের ২৯ জুন তারিখে জাপানের রাজধানী টোকিওতে উভয় দেশের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তি অনুযায়ী জাপান বাংলাদেশে ৯০ হাজার টন চাল রফতানি করবে বলে জানা যায়।১২৬

বাংলাদেশে স্বাধীনতা উত্তরকালে সৃষ্ট বস্ত্র সংকটের পরিপ্রেক্ষিতে জাপান। সাহায্যস্বরূপ পাঠিয়েছিল ৯ কোটি ৯৬ লক্ষ গজ জাপানি কাপড়। ১৯৭৩ সালের ২৪ এপ্রিল যুদ্ধ বিধ্বস্ত বাংলাদেশকে সহায়তা করার জন্য জাপান সরকার ১ কোটি ৬০ লাখ গজ কাপড় দান করেন।১২৭

————————————-

১২৫. Since 1973, above 1000 Japanese have been dispatched to Bangladesh as the jocv and that has led to a great success of cooperation with Bangladeshi people. JICA BANGLADESH NEWSLETTER, October, 2009, 5.

১২৬. দৈনিক বাংলা, ৩০ জুন ১৯৭৩। 

১২৭. দৈনিক বাংলা, ২৫ এপ্রিল ১৯৭৩।

————————————-

৭৮

যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশ পুনর্গঠনে জাপানের কাছ থেকে অর্থনৈতিক সহযােগিতা খুবই প্রয়ােজন ছিল। বিশেষ করে বাংলাদেশের প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা এবং যমুনা নদীর ওপর প্রস্তাবিত সেতু নির্মাণ, পেট্রো কেমিক্যাল কমপ্লেক্স , বস্ত্র ও রেয়ন মিল এবং ইউরিয়া সার কারখানা নির্মান আশু প্রয়ােজন হয়ে পড়ে। এ ছাড়াও জাতিসংঘে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তিতে এশিয়ার অন্যতম দেশ হিসেবে জাপানের সহযােগিতা কাম্য ছিল। সমস্ত দিক বিবেচনা করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৩ সালের অক্টোবরে জাপান সফরের প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। এ ছাড়াও ইতিপূর্বে জাপানের প্রধানমন্ত্রী এইসাকু সাতাে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে অক্টোবর মাসে জাপান সফরের আমন্ত্রণ জানিয়েছিল।

অক্টোবর মাস জাপান বেড়ানাের জন্য উপযুক্ত সময় ও সকলের কাছে প্রিয়। কারণ বৃষ্টিহীন ঝলমলে দিনে মৃদু শীতল বাতাসের পরশ, পরিষ্কার নীলাকাশ আর সেইসাথে সারা জাপানজুড়ে পাহাড়, টিলা, রাস্তার দুপাশে এবং উদ্যানগুলাের গাছে গাছে রঙিন পাতার উদ্দীপ্ততা ভ্রমণ পিপাসুদের অভিভুত ও আমােদিত করে । প্রকৃতি প্রেমীদের কাছে এ সৌন্দর্য্য যেন কোনাে দক্ষ শিল্পীর কল্পনা আর আকাঙ্খর মিশেলে এক অনন্য মাধুর্য্যে ধরা দেয় ।

অক্টোবরে জাপান ভ্রমণকারী বিদেশি অতিথিদেরও আন্তরিকতার সাথে জানানাে হয় যে তারা উৎকৃষ্ট সময়ে ভ্রমণ করছেন । একথা বিবেচনা করেই জাপান সরকার। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে অক্টোবর মাসে সফরে আসার আহ্বান জানান। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জাপানযাত্রার উৎসবে দৈনিক ইত্তেফাক যথার্থই লিখেছিল: “আঠারই অক্টোবর জাপানে জাগবে আর এক চেরি ফুলের উৎসব। উৎসবের বর্ণাঢ্যতায় মােহনীয় হয়ে উঠবে জাপান। সাম্রাজ্যবাদী শক্তির নগ্ন ছােবলে দংশিত ও বর্তমান নতুন প্রাণ সত্তার জাগ্রত এই দেশে সপ্তাহব্যাপী রাষ্ট্রীয় সফরে যাবেন সাম্রাজ্যবাদীদের দোসর এক শক্তির বিষাক্ত দংশনে দংশিত, ক্ষত-বিক্ষত এবং বর্তমানে মুক্ত ও স্বাধীন এক দেশের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। যার নাম।”১২৮

বঙ্গবন্ধুর জাপান সফর বাংলাদেশ ও জাপান দুই দেশেই অনেক উৎসাহ ও উদ্দীপনার সৃষ্টি করে। জাপান বঙ্গবন্ধুকে কিভাবে গ্রহণ করবে? এ প্রশ্নের উত্তর ছিল খুবই সােজা। একান্ত আপনজনের অকৃত্রিম অনুভূতি স্বাগত জানাবে বঙ্গবন্ধুকে। বাংলাদেশের সাথে জাপানের অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও আন্তর্জাতিক প্রশ্নে সব সুসম্পর্ক ছাড়াও এক বিশেষ অনুভূতি ও চেতনার দিক দিয়ে এই দুই দেশের মধ্যে

——————————————

১২৮ জাপান- বাংলাদেশ মৈত্রী অনন্য চেতনায় সমৃদ্ধ, দৈনিক ইত্তেফাক, ১৭ অক্টোবর ১৯৭৩।

——————————————

৭৯

অনন্য প্রীতি ও শুভেচ্ছার সম্পর্ক বিদ্যমান। অনেকেই মনে করেন, বাংলাদেশ ও জাপানের মধ্যে অনন্য মিল এখানেই দুই দেশের মানুষেরই হৃদয়ে লক্ষ স্বজন প্রিয়জন হারাবার ব্যথা জন্ম দিয়েছে সমমর্মিতার। দুটি দেশই মানবতা বিরােধী, বর্বরতা ও মহাধ্বংসযজ্ঞের শিকার। আণবিক বােমা ও দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের অভিজ্ঞতাকে কাটিয়ে জাপান যেমন আজ কৃষি, শিল্প-বাণিজ্যসহ অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অগ্রগতি ও সমৃদ্ধির ক্ষেত্রে বিশ্বে অন্যতম শীর্ষস্থানের অধিকারী হয়েছে, তেমনি পাকিস্তানি হানাদারদের বর্বরােচিত কার্যক্রমের অভিঘাতকে কাটিয়ে বাংলাদেশও আজ স্বনির্ভর অর্থনীতি ও প্রগতির লক্ষ্যে অভিযাত্রী।

বাংলাদেশ ও জাপান দুদেশই আন্তরিকভাবে ঘৃণা করে যুদ্ধকে বিশ্বশান্তি দুদেশেরই একান্ত কাম্য। বাংলাদেশ ও জাপানের মধ্যে মৈত্রী সম্পর্ক তাই চির অটুট এবং জাপান সফরকালে বঙ্গবন্ধুকে জাপানিরা যে হৃদয়ের সবটুকু রং ও প্রাণের সব ঐশ্বর্য দিয়েই স্বাগত জানাবে এ বিষয়ে কোনই সন্দেহ ছিল না। এ কারণে যাত্রার প্রারম্ভে সংবাদপত্রে বেশ কয়েকটি বিজ্ঞাপনও চোখে পড়ার মতাে। ঢাকার জাপানি সংঘ এবং জাপান ওল্ড বয়েজ অ্যাসােসিয়েশন (আজিয়া বুংকা। কাইকান দোসােকাই, বাংলাদেশ) তাদের এক বিজ্ঞাপনে বলেছিল: বন ভয়েজ আমাদের প্রিয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সূর্যোদয়ের দেশে। ঐতিহাসিক সফর সাফল্যমণ্ডিত হােক।১২৯

——————————

১২৯. দৈনিক ইত্তেফাক , ১৭ অক্টোবর ১৯৭৩।

——————————

৮০

১৯৭৩ সালের ১৭ অক্টোবর তারিখের দৈনিক ইত্তেফাক জাপান বাংলাদেশ মৈত্রী অনন্য চেতনায় সমৃদ্ধ শিরােনামে লিখেছিল, জাপানের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক যথার্থই আন্তরিক চিরস্থায়ী মৈত্রী, শুভেচ্ছা ও সহযােগিতার আদর্শেই তা সমৃদ্ধ। বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের অব্যবহিত পরেই জাপান জানিয়েছিল স্বীকৃতি। শুধু স্বীকৃতিদানই নয়— যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পুনর্গঠনেও সে বাড়িয়ে দিয়েছে তার সহযােগী হাত।

বাংলাদেশের সাথে জাপানের সম্পর্ক বেশ পুরাতন। অতীতে পাকিস্তানি শাসনামলে জাপানি সাহায্য ও সহযােগিতায় বাংলাদেশের সিলেট ও ঘােড়াশালে সার কারখানা, চট্টগ্রামে ইস্পাত কারখানা এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে রেয়ন প্রস্তুত কারখানা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং এসব শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলাে স্বাধীনতা-উত্তরকালে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে স্বনির্ভর হতে সবিশেষ সহায়তা করছে। বাংলাদেশের পরিবহন সংকট নিরসনার্থ জাপান হতে আমদানি করা হয়েছে বাস। খাদ্যাভাবের মােকাবিলাতেও আমদানি করা হয়েছে চাউল। বাংলাদেশে কৃষি ব্যবস্থার আধুনিকীকরণ ও অধিক খাদ্য ফলাও অভিযানসহ সবুজ বিপ্লব বাস্তবায়নের মহাকর্মে জাপান একটি প্রধান সহযােগী ভূমিকা পালন করছে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জাপানযাত্রা উপলক্ষে বাংলাদেশের অন্যতম পত্রিকা দৈনিক ইত্তেফাক বঙ্গবন্ধুর জাপান সফর’ শীর্ষক এক সম্পাদকীয়তে আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেছিল:

“আজ প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব নির্ধারিত এক রাষ্ট্রীয় সফরে জাপান অভিমুখে যাত্রা করিবেন। ইতিপূর্বে বঙ্গবন্ধু মিত্ররাষ্ট্র ভারত সফর করিয়াছেন। সফর করিয়াছেন সােভিয়েট ইউনিয়ন ও যুগােশ্লোভিয়া। কমনওয়েলথ প্রধানমন্ত্রী সম্মেলন উপলক্ষে কানাডা এবং জোটনিরপেক্ষ রাষ্ট্রীয় সম্মেলন উপলক্ষে আলজিরিয়াও সফর করিয়াছেন বঙ্গবন্ধু। তবে ফ্রি ইকোনমির অনন্য দেশ বলিয়া পরিচিত জাপানে ইহাই হইবে বঙ্গবন্ধুর প্রথম রাষ্ট্রীয় সফর। নানা কারণে বঙ্গবন্ধুর জাপান সফর গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যমণ্ডিত।”১৩০

বঙ্গবন্ধুর জাপান সফরের ফলে বাংলাদেশের অর্থনীতির সফলতা বৃদ্ধি পাবে এমন মন্তব্য করে দৈনিক ইত্তেফাক ওই সম্পাদকীয়তে আরাে মন্তব্য করেছিল:

“জাপান আজ বাণিজ্যিক সংগঠন ও তৎপরতার দিক দিয়া এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রবল প্রতিদ্বন্ধি। জাপানি ইয়েনের জয়যাত্রা ক্রমেই সম্প্রসারিত হইয়া

————————————

১৩০ দৈনিক ইত্তেফাক, ১৭ অক্টোবর ১৯৭৩।

————————————

৮১

চলিয়াছে। বৃহৎ পুঁজির সংগঠনে জাপান আজ আন্তর্জাতিক পর্যায়ে উপস্থিত ও বিরাজমান। তুলনামূলক বিচারে বাংলাদেশ মাত্র উহার অর্থনৈতিক পুনর্গঠন ও অগ্রযাত্রার পদক্ষেপ সূচিত করিয়াছে। তবে পারস্পারিক সম্প্রীতি, মৈত্রী ও সাহায্যসহযােগিতার যেটুকু সুযােগ অবকাশ সর্বদিক দিয়া এশিয়ার এই দুইটি ঐতিহ্যপূর্ণ জাতির মধ্যে বিরাজমান, তাহাতে সুনিশ্চিতভাবেই আশা করা যাইতে পারে যে, বঙ্গবন্ধুর বর্তমান জাপান সফর বাংলাদেশের অর্থনীতি সংগঠন ও পুনরুজ্জীবনের ক্ষেত্রে অত্যন্ত ফলপ্রসু হইয়া দেখা দিতে পারে।… দুইটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের ভিতর সাহায্য-সহযােগিতা দেওয়া নেওয়া ব্যাপারটা আন্তর্জাতিক সম্প্রীতি ও সহঅবস্থান নীতিরই সম্পূরক। এই দিক দিয়া জাপান যেমন বাংলাদেশের পুঁজি, শিল্প ও অর্থনীতি সংগঠনে অত্যন্ত ফলপ্রসূ সাহায্য সহযােগিতা প্রদান করিতে পারে, বাংলাদেশও তেমনি পাট, চা, চামড়া ইত্যাকার পণ্যসম্ভার রফতানির মাধ্যমে জাপানের কাঁচামালের বিরাট চাহিদার একটা উল্লেখযােগ্য অংশ মিটাইতে সক্ষম। যাহা বর্তমানে দুই পক্ষের জন্যই প্রয়ােজন, তাহা হইল দৃঢ়ভিত্তিক পারস্পরিক সমঝােতা। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর বর্তমান জাপান সফর সেই সমঝােতার অবয়বকে পূর্ণতারূপ দিতে সক্ষম হইবে, এই আশা নিশ্চিতই করা যাইতে পারে।”১৩১

—————————————————–

১৩১  ঐ।

—————————————————–

৮২

জাপানের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্কের যােগসূত্র অত্যন্ত গভীর। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জাপান সফরের ওপর আশাবাদ ব্যক্ত করে দৈনিক পূর্বদেশ লিখেছিল, “বাংলাদেশের মানুষের প্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জাপান পরিভ্রমণের মধ্য দিয়ে দুই দেশের এই সংস্কৃতি, সভ্যতা ও ঐতিহ্যের যােগাযােগ আরাে ঘনিষ্ঠ হবে। দুই দেশের মধ্যে স্থাপিত হবে আরাে নিবিড় ও অবিচ্ছেদ্য মৈত্রীর যােগসূত্র। এ কারণেই বঙ্গবন্ধুর এই জাপান পরিভ্রমণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।”*

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জাপান যাত্রা উপলক্ষে দৈনিক পূর্বদেশ পত্রিকার সম্পাদকীয়তে আরাে লেখা হয়েছিল: বঙ্গবন্ধুর জাপান সফর কেবল একজন রাষ্ট্রনেতার মামুলি শুভেচ্ছা সফর নয়। এই সফরের তাৎপর্য ও গুরুত্ব আরাে অধিক। বঙ্গবন্ধুর এই সফরের মধ্যদিয়ে বিপ্লবী বাংলার সংগ্রামী ঐতিহ্য যেমন জাপানিদের কাছে তুলে ধরা সম্ভব হবে, সম্ভব হবে আমাদের কর্মসূচী ও রাষ্ট্রাদর্শ সম্পর্কে আরাে সম্যক পরিচয় তুলে ধরা, তেমনি জাপানিদের সংগে আরাে বৃহত্তর যােগাযােগ ও পরিচয়ের যােগসূত্রও রচিত হতে পারবে।**

১৯৭৩ সালের ১৭ অক্টোবর সন্ধ্যা ৬টা ৩৫ মিনিটে বাংলাদেশ বিমানের বােয়িং ৭০৭ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে টোকিওয়ের উদ্দেশে ছেড়ে যায়। সপ্তাহব্যাপী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জাপান সফরে সঙ্গীদের তালিকায় বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ রেহানা, ছােট ছেলে শেখ রাসেল ছাড়াও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. কামাল। হােসেন, মিসেস হােসেন, পরিকল্পনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান ড. নূরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক সচিব জনাব তােফায়েল আহমেদ, প্রধান সচিব জনাব রুহুল কুদুস, পরিকল্পনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান ড. নূরুল ইসলাম, পররাষ্ট্রসচিব জনাব এনায়েত করিম, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ডাইরেক্টর জেনারেল জনাব এ, ডব্লিউ, শামসুল আলম, তাঁহার ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও ব্যক্তিগত কর্মচারীবৃন্দ। সাংবাদিকদের মধ্যে দৈনিক পূর্বদেশ সম্পাদক এহতেশাম হায়দার চৌধুরী ও দৈনিক ইত্তেফাক সম্পাদক আনােয়ার হােসেন মঞ্জু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের এই রাষ্ট্রীয় সফরের সহযাত্রী ছিলেন।

জাপান যাত্রার পূর্বে তেজগাঁও বিমানবন্দরে জাতির জনক বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে এক সংক্ষিপ্ত ও আন্তরিকতাপূর্ণ বিদায় সংবর্ধনা জানানাে হয়। এই সংবর্ধনা জানাতে জাতীয় সংসদের স্পিকার, অস্থায়ী প্রধানমন্ত্রী সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও অর্থমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমদসহ মন্ত্রিপরিষদের সদস্য, জাতীয় সংসদ-সদস্য, বিদেশি কূটনীতিক, আওয়ামী লীগের সিনিয়র

—————————————-

* দৈনিক পূর্বদেশ, ১৭ অক্টোবর ১৯৭২।

** ঐ

—————————————-

৮৩

সহসভাপতি জনাব কোরবান আলী, সাধারণ সম্পাদক জনাব জিল্লুর রহমান, সাংগঠনিক সম্পাদক জনাব আবদুর রাজ্জাক, দফতর সম্পাদক জনাব আনােয়ার চৌধুরী, সমাজ কল্যাণ ও সাংস্কৃতিক সম্পাদক জনাব মােস্তফা সারওয়ার, আওয়ামী যুবলীগ প্রধান শেখ ফজলুল হক মণি, বাংলাদেশের কম্যুনিস্ট পার্টির প্রবীণ নেতা কমরেড মণি সিং, কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দ, পদস্থ সামরিক ও বেসামরিক কর্মচারীবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। এছাড়া ঢাকায় বসবাসকারী বেশ কিছু সংখ্যক জাপানি নাগরিক দু দেশের জাতীয় পতাকা নেড়ে বঙ্গবন্ধুকে সংবর্ধনা জানান।

বঙ্গবন্ধুকে ফুলের তােড়া উপহার দেয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তথা বাংলাদেশের মানুষের জন্যে জাপান সরকার ও জনসাধারণের গভীর সহানুভূতি সব সময়ে বিদ্যমান তার প্রমাণ পাওয়া যায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জাপান যাত্রার প্রাক্কালে। এই দিন ঢাকা বিমানবন্দরে অনেক বাংলাদেশ প্রবাসী জাপানি নাগরিক উপস্থিত ছিল। এ ছাড়াও ঢাকা বিমান বন্দরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে দুইজন জাপানি বালিকা ফুলের তােড়া উপহার দেয়।

বাংলাদেশ ও জাপানের মধ্যে মৈত্রী-সম্পর্ক ও সমঝােতা আরাে বৃদ্ধি এবং বিশেষ করে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সম্পর্ক আরাে জোরদার করার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর

৮৪

রহমান জাপান সরকারের সাথে নিম্নোক্ত বিষয়ে আলােচনাকে অগ্রাধিকার দেবেন বলে তিনি সাংবাদিকদের জানান। বিষয়গুলাে হলাে— 

* বাংলাদেশের প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় জাপানের অংশগ্রহণ, 

* যমুনা নদীর ওপর প্রস্তাবিত সেতু নির্মাণের বিষয়, 

* বাংলাদেশের জাতিসংঘর্ভুক্তি, 

* ত্রিমুখী লােক বিনিময় সংক্রান্ত সাম্প্রতিক দিল্লি চুক্তি, 

* পেট্রোকেমিক্যাল কমপ্লেক্স, 

* বস্ত্র ও রেয়ন মিল, 

* ইউরিয়া সার কারখানা, 

* স্টিল মিল ও পাওয়ার টিলার প্রকল্প স্থাপন 

* মধ্যপ্রাচ্য যুদ্ধ, আন্তর্জাতিক বিষয় এবং এশিয়ায় একটি শান্তি এলাকা প্রতিষ্ঠার বিষয়ও পর্যালােচনা করা। ( তথ্যসূত্র: দৈনিক ইত্তেফাক, ১৭ অক্টোবর ১৯৭৩)

বিমানবন্দরে উপস্থিত সাংবাদিকদের উদ্দেশ্যে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, তার এই সফরের ফলে জাপান-বাংলাদেশের মৈত্রী আরাে দৃঢ়তর হবে। ঢাকা ত্যাগের প্রাক্কালে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সাংবাদিকদের নিকট বলেন, তাঁহার এই সফরের ফলে জাপান-বাংলাদেশের মৈত্রী আরও দৃঢ়তর হইবে। আমি জাপানের জনগণের জন্য আমার দেশবাসীর শুভেচ্ছা লইয়া যাইতেছি এবং তথা হইতে বাংলাদেশের জন্যও জাপানিদের শুভেচ্ছা লইয়া আসিব।১৩২ দৈনিক বাংলার ভাষায়, এ সময় বঙ্গবন্ধুকে বেশ উৎফুল্ল দেখাচ্ছিল।… বিমানের সিড়িতে উঠার আগে বঙ্গবন্ধু তার জ্যেষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনা ও নাতনী নিতি] জয়কে আদর করেন।১৩৩

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সূর্যোদয়ের দেশ জাপানযাত্রা অর্থনৈতিক সহযােগিতার ক্ষেত্রে বাংলাদেশেও এক নুতন যুগের সূচনা বলে সকল মহল আশাবাদ ব্যক্ত করে। কোটি বাঙালির হৃদয়ের উৎফুল্লতা প্রকাশ পেয়েছিল পত্রপত্রিকায়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জাপানযাত্রায় অত্যন্ত উচ্ছ্বসিত ভাষায় পত্রিকা লিখেছিল সেখানে জাগবে আর এক চেরী ফুলের উৎসব। বাস্তবিক অর্থে তাই হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জাপানযাত্রায় জাপান বাংলাদেশ নতুনভাবে বন্ধুত্ব ও সম্পর্কের মাত্রা আরাে বৃদ্ধি পায়।

——————————————-

১৩২. দৈনিক ইত্তেফাক, ১৮ অক্টোবর ১৯৭৩। 

১৩৩, দৈনিক বাংলা, ১৮ অক্টোবর ১৯৭৩।

——————————————-

৮৫

অধ্যায় : চার

সূর্যোদয়ের দেশে বঙ্গবন্ধু

[‘… ক্ষুধা, দারিদ্র্য এবং ব্যাধির বিরুদ্ধে জয়ী হইতে হইলে বিশ্বের ধনী-দরিদ্র সকল রাষ্ট্রের সমন্বিত প্রচেষ্টা চালাইতে হইবে এবং একমাত্র এই পন্থায়ই একটা সুসামঞ্জস্য আন্তর্জাতিক সম্পর্ক এবং শান্তির স্থায়ী কাঠামাে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হইবে।’- বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, টোকিও বিমানবন্দরে আয়ােজিত সংবর্ধনা সভা, ১৮ অক্টোবর,১৯৭৩]

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৩ সালের ১৮ অক্টোবর সকালে টোকিও বিমানবন্দরে পৌঁছেন। জাপানের রাজধানী টোকিও এশিয়ার এক বৃহৎ অর্থনীতির দেশ। পৃথিবীর অনেক দেশই জাপানকে সভ্যতা ও উন্নতির মানদণ্ড হিসেবে বিবেচনা করে। বলা চলে নতুন এশিয়ার ইতিহাস শুরু হয়েছে পুবের দেশ জাপান থেকে। তাইতাে প্রচলিত কথায় বলা হয় সূর্যোদয়ের দেশ জাপান। রুশ জাপান যুদ্ধে জয়লাভের পর জাপান সহসা একদিন বিশ্বের বিস্ফারিত চোখের সামনে আত্মপ্রকাশ করল। বিশ্ব আর তাকে অবহেলা বা অস্বীকার করতে পারলাে না।

বাংলাদেশের জাতির পিতার সম্মানে টোকিও বিমানবন্দরে স্বাগত জানানাের জন্য জাপানের ঐতিহ্যবাহী নানা অনুষ্ঠান আয়ােজন করা হয়। প্রাণঢালা সংবর্ধনা জ্ঞাপন করা হয়। বাংলাদেশ বিমানের বােয়িং ৭০৭ থেকে অবতরণের পর জাপানি প্রধানমন্ত্রী কাকুই তানাকা সবার আগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বাগত জানান। উল্লেখ করা প্রয়ােজন যে ইতােমধ্যে জাপানের প্রধানমন্ত্রী পদে রদবদল হয়েছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ১৯৭২ সালের মার্চ মাসে যখন আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন তখন জাপানের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন এইসাকু সাতাে। কিন্তু ১৯৭২ সালের ৭ জুলাই তারিখে জাপানের ৪০তম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন লিবারেল ডেমােক্রেটিক পার্টির সদস্য কাকুই তানাকা।

সাড়ে সাত কোটি বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে টোকিও আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে স্বাগত জানানাের জন্য প্রধানমন্ত্রী কাকুই তানাকার সাথে আরাে অন্যান্য যারা ছিলেন তাঁরা হলেন মিসেস তানাকা, মন্ত্রিসভার ও জাপানের পার্লামেন্ট ডায়েট এর সদস্যবৃন্দ, কূটনৈতিক মিশন ও বাংলাদেশ

৮৬

দূতাবাসের কর্মকর্তাগণ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সৌজন্যে বিমানবন্দরে আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে ছিল তার সম্মানে প্রদত্ত গার্ড অব অনার পরিদর্শন করা এবং একুশবার তােপধ্বনি করা হয়। সেই সাথে জাপান এবং বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত পরিবেশন করা হয়। এই প্রথম জাপানি প্রধানমন্ত্রী কাকুই তানাকার সাথে বঙ্গবন্ধুর পরিচয় ঘটে। দুতিয়ালি পরিচয় থেকে গড়ে উঠল আত্মিক সম্পর্ক, গভীর বন্ধুত্ব।

১৮ অক্টোবর ১৯৭৩ সালের বিমানবন্দরে জাপানের জনগণ বঙ্গবন্ধুকে স্বাগত জানিয়ে সংবর্ধনার আয়ােজন করে। জাপানের প্রথম জনসমক্ষে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শােনালেন শান্তি ও মৈত্রীর বাণী। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টোকিও বিমানবন্দরের সংবর্ধনা সভায় আরাে বললেন, ক্ষুধা, দারিদ্র্য এবং ব্যাধির বিরুদ্ধে জয়ী হইতে হইলে বিশ্বের ধনী-দরিদ্র সকল রাষ্ট্রের সমন্বিত প্রচেষ্টা চালাইতে হইবে এবং একমাত্র এই পন্থায়ই একটা সুসামঞ্জস্য আন্তর্জাতিক সম্পর্ক এবং শান্তির স্থায়ী কাঠামাে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হইবে। দৈনিক ইত্তেফাকে ফলাও করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের টোকিও বিমানবন্দরে স্বাগত জানানাের খবর প্রচার করা হয়। দৈনিক ইত্তেফাকের প্রথম পাতায় শিরােনাম করা হয়, ‘টোকিও বিমানবন্দরে বঙ্গবন্ধুর বিপুল সম্বর্ধনা। ক্ষুধা দারিদ্র্য ও ব্যাধির বিরুদ্ধে সমম্বিত প্রচেষ্টাই স্থায়ী শান্তির কাঠামাে।*

————————————-

* দৈনিক ইত্তেফাক, ১৯ অক্টোবর ১৯৭৩।

————————————-

৮৭

সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের জাপান সফরের বিষয়টি আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও বেশ গুরুত্ব পেয়েছিল। সমগ্র বিশ্ববাসীকে হতবাক করে দিয়ে এশিয়ার অন্যতম পরাশক্তি ও উন্নয়নশীল দেশ জাপানের হৃদয় ছয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আন্তর্জাতিক মিডিয়াতেও বঙ্গবন্ধু শেখ

৮৮

মুজিবুর রহমানের জাপান সফর গুরুত্ব সহকারে তুলে ধরে। নিউ ইয়র্ক থেকে প্রকাশিত বাংলাদেশ নিউজ পত্রিকাতে শিরােনাম করা হয় : “Tokyo accords hearty welcome to Bangabandhu. Prime Minister Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman was accorded a red carpet reception when he arrived at the ‘land of the rising sun’ on a six day state visit this morning. As the Bangladesh Biman Boeing carrying the undisputed leader of 75 million Bangalees touched down at the Tokyo International Haneda Airport with the huge golden sun rising majestically from behind the skyscrapers dotting the skyline, a large number of people present at the airport burst into prolonged applause. Japanese Prime Minister Kakuei Tanaka, flanked by Mrs. Tanaka and Foreign Minister M. Ohira, came to the ramp to greet the Bangabandhu”*.

জাপান বাংলাদেশ সমিতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সম্মানে এক ভােজসভার আয়ােজন করে। বাংলাদেশ জাপান সমিতির সভাপতি ছিলেন তাকাশি হায়াকাওয়া। বলাবাহুল্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের উন্নয়নের জন্য হায়াকাওয়াকে পরামর্শ দিয়েছিলেন জাপান বাংলাদেশ সমিতি প্রতিষ্ঠা করার জন্য। হায়াকাওয়া সেই স্মৃতি উল্লেখ করে লিখেছেন, “… শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে আমার বন্ধুত্বের সূত্রপাত ঘটে এখন থেকে চার বছর আগে। বাঙালি জাতির মুক্তির আন্দোলনে প্রণােদিত হয়ে ১৯৭২ সালের ১৪ মার্চে আমি সদ্য স্বাধীনতা অর্জনকারী বাংলাদেশে গিয়েছিলাম জাপান সরকারের মৈত্রীদূত হিসেবে।… আমি তার অনুরােধ মতাে জাপানে ফিরে জাপান-বাংলাদেশ সমিতি প্রতিষ্ঠা করি এবং দুই লাখ টন চাল সরবরাহ ও অন্যান্য অর্থনৈতিক সাহায্য দেওয়ার পথ সুগম করি।”১৩৪

জাপান-বাংলাদেশ সমিতি কর্তৃক আয়ােজিত ভােজসভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শুধু বাংলাদেশ কিংবা জাপান নয়, সমগ্র এশিয়ার শান্তি কামনা করেন। ভােজসভার বক্তৃতাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এশিয়ার শক্তিশালী দেশ হিসেবে জাপানের কাছে আহ্বান রাখেন ক্ষুধা ও দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে মিলিত প্রচেষ্টা চালানাের। ১৯৭৩ সালের ১৮ অক্টোবর সন্ধ্যায় তাঁর সম্মানে দেওয়া ভােজসভার শুরুতেই বঙ্গবন্ধু জাপানি বন্ধুত্বের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন। আমার দেশ এবং আমার উদ্দেশ্যে আপনারা যে সাদর সম্ভাষণ জানিয়েছেন এজন্য আমি

————————————-

* Bangladesh : Afortnightly News Bulletin, Vol 3, No. 21, November 2, 1973. 

১৩৪ . তাকাশি হায়াকাওয়া, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৬।

————————————-

৮৯

নিজেকে সম্মানিত বােধ করছি। আপনাদের অতুলনীয় আতিথেয়তায় আমি অভিভূত। আমার জাপান অবস্থানের প্রথম সন্ধ্যাতেই বাংলাদেশের এত শুভাকাঙ্ক্ষী এবং এত সম্মানিত বন্ধুদের মধ্যে নিজেকে পেয়ে আমি গভীর আনন্দ অনুভব করছি।”১৩৫

জাপান বাংলাদেশ সমিতির প্রেসিডেন্ট (তাকাশি হায়াকাওয়া] কে সম্বােধন করে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে জাপানি সহযােগিতার কথা কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করে বলেন, “… স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ে আপনারা যে সাহায্য সহানুভূতি, বাংলাদেশ সৃষ্টিতে বিরাট ভূমিকা পালন করেছে। বাংলাদেশের জনগণ এবং তার সমস্যা সম্পর্কে জাপানের জনগণ ভালােভাবেই জানেন। তাই, স্বাধীনতার পর থেকেই বাংলাদেশের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের জন্য আপনারা সমবেতভাবে বিভিন্ন মহৎ উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। আপনাদের এসব মহান কার্যক্রম দুদেশের মধ্যে একটি ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক সৃষ্টি করতে সহায়ক হয়েছে। আর এই বন্ধুত্বপূর্ণ ঘনিষ্ঠ সম্পর্কই হচ্ছে আমাদের দুদেশের সম্পর্কের মূল বৈশিষ্ট্য।”১৩৬

১৯৭২ সালের মার্চ মাসে জাপানি প্রতিনিধিদল বাংলাদেশে গিয়ে যে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন সেটাও বঙ্গবন্ধু তাঁর বক্তৃতায় তুলে ধরেন। তিনি বলেন, “গত বছর

——————————————-

১৩৫. উদ্ধৃত: দৈনিক বাংলা, ২০ অক্টোবর,১৯৭৩। 

১৩৬, ঐ।

——————————————-

৯০

বাংলাদেশ সফরে গিয়ে আপনি ব্যক্তিগতভাবে আমাদের সম্মানিত করেছেন। স্বাধীনতার মাত্র তিন মাসের মধ্যে আপনি স্বচক্ষে আমার দেশের মানুষের অবস্থা জানতে গিয়েছেন। এতে বাংলাদেশের মানুষের প্রতি আপনার সহানুভূতি কত গভীর তার পরিচয় পাওয়া যায়। আমি এবং আমার দলের সদস্যরা এতদিন ধরে আপনাদের এই মনােরম দেশ দেখার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। কারণ, এর মাধ্যমে আমরা মহামান্য সম্রাটের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করতে পারব এবং একই সঙ্গে মহাসম্মানিত প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আমাদের দুদেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে আলাপ-আলােচনা করতে পারব। একই সঙ্গে দেখতে পারব অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে জাপানের জনগণের অভূতপূর্ব সাফল্য। তাঁদের প্রতি জানাতে পারব আমাদের অকৃত্রিম শুভেচ্ছা।”১৩৭

জাপান এবং বাংলাদেশ উভয়ই এশীয় দেশ হিসেবে এশিয়ায় শান্তি, প্রগতি ও স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রে একই মনােভাব পােষণ করে। এই ভােজসভায় আগত অতিথিদেরকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে জাপান তার অভিজ্ঞতা দিয়ে উপকার করবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।

জাপান সম্পর্কে বাংলাদেশের আগ্রহের কথা তুলে ধরে বঙ্গবন্ধু আরাে বলেন, “জাপান এবং জাপানের জনগণের সম্পর্কে জানতে আমরা খুবই আগ্রহী। দুদেশের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ের ক্ষেত্রে দুদেশের সম্পর্ক আরাে ঘনিষ্ঠ হােক আমরা তা চাই। অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এবং জাপানের অবস্থিতি হচ্ছে বিপরীত দুই প্রান্তে। আপনাদের দেশ যখন আজ বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ অর্থনৈতিক শক্তি তখন আমার দেশ বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলাের মধ্যে সবচেয়ে কম উন্নত। তবু বাংলাদেশ এবং জাপানের মধ্যে বহু ক্ষেত্রে সাদৃশ্যের ঐক্য রয়েছে। আমরা দুদেশই এশীয়। এশিয়াতে শান্তি, প্রগতি এবং স্থিতিশীলতার প্রশ্নে আমাদের দু’দেশের লক্ষ্যও এক। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন বিষয়ে জাপানের মতােই আমরা সমন্বিত নিয়ম-শৃঙ্খলার পক্ষপাতী। আবার ভাষা, সংস্কৃতি এবং জাতিগত উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে জাপানের জনগণের মতােই আমরা ঐক্যের বন্ধনে আবদ্ধ। জনগণের মধ্যে এই ঐক্যবােধ আমাদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অগ্রগতির সহায়ক হবে। আমাদের সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার সংরক্ষণের জন্যও আমরা উদগ্রীব। এসব বিভিন্ন ক্ষেত্রে দুদেশের এত সাদৃশ্যের জন্যই আমরা আমাদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে জাপানের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাতে চাই।”১৩৮

———————————–

১৩৭ , ঐ। 

১৩৮ ঐ।

———————————–

৯১

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আরাে বলেন,

“আমার দেশের মানুষের কী অবস্থা স্বাধীনতাযুদ্ধের পর পরই তা আপনি নিজে দেখে এসেছেন। আপনি দেখেছেন পাকিস্তানি শাসকদের চব্বিশ বছরের নির্দয় ঔপনিবেশিক শাসনের ফলে আমার দেশের মানুষ কী দারিদ্র্যের মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। আপনি দেখেছেন স্বাধীনতাযুদ্ধের ফলে আমাদের অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে কী বিপর্যয় এবং ধ্বংস নেমে এসেছে। আপনি এও দেখেছেন আমার দেশের মানুষ নতুন উদ্দীপনা নিয়ে কীভাবে বিধ্বস্ত অর্থনীতির পুনর্গঠনের জন্যে কাজ করে যাচ্ছে। চেষ্টা করছে শতাব্দীর পুরনাে দারিদ্র্য, ক্ষুধা, অশিক্ষা, ব্যাধি এবং বেকারত্বের অভিশাপ দূর করতে। এতসব সমস্যা মােকাবিলা করতে গিয়েও আমরা সব সময়েই একটা কথা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেছি যে, আমাদের জনগণের আন্তরিক আশা-আকাঙ্খা পূর্ণ করতে আমাদেরকে প্রথমে এ ধরণের একটি রাজনৈতিক পদ্ধতির ভিত্তি স্থাপন করতে হবে। এটা নি:সন্দেহে একটি দুরূহ চ্যালেঞ্জ। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমরা এই চ্যালেঞ্জের মােকাবিলা করেছি। আমরা একটি সংবিধান রচনা করেছি এবং স্বাধীনতার এক বছরের মধ্যেই সেই সংবিধান গ্রহণ করেছি। একটি কার্যকর গণতান্ত্রিক কাঠামাের মধ্য দিয়ে অর্থনৈতিক উন্নয়নের কাজ শুরু করার জন্য সংবিধান অনুযায়ী নতুন করে নির্বাচন সম্পন্ন করেছি। একই সঙ্গে অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য যেন সামাজিক ন্যায়বিচারকে জলাঞ্জলি দিতে না হয় আমরা তার নিশ্চয়তার ব্যবস্থাও করেছি। রাজনৈতিক স্বাধীনতার এবং সামাজিক ন্যায় বিচারের সঙ্গে অর্থনৈতিক উন্নয়নের এই সংযুক্তি সম্পর্কে আমাদের জনগণের নৈতিক আকাঙ্খ আমাদের কাজকে আরাে জটিল এবং কঠিন করেছে সন্দেহ নেই। কিন্তু আপনাদের মতাে বিশ্বের বিভিন্ন উন্নত দেশের সরকার এবং সেসব দেশের জনসাধারণ যখন আমাদের মতাে উন্নয়নশীল দেশের এ ধরণের কঠিন কাজ সম্পন্ন করার কাজে উত্তরােত্তর গভীর আগ্রহ প্রকাশ করেন, তখন আমরা উৎসাহ বােধ করি।”*

আমরা বিশ্বাস করি, বিশ্বের ধনী এবং দরিদ্র দেশগুলাে যদি ঐক্যবদ্ধ সহযােগিতার মাধ্যমে ক্ষুধা, ব্যাধি ও দারিদ্র্যকে জয় করার কর্মসূচি গ্রহণ করতে পারে এক মাত্র। তখনই শুধু একটি সুসামঞ্জস্যপূর্ণ আন্তর্জাতিক শৃঙ্খলা এবং শান্তির জন্য স্থায়ী একটি কাঠামাে সৃষ্টি হওয়া সম্ভব। উন্নয়নশীল দেশগুলাের সমস্যা দূরীকরণে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি নেওয়া দরকার। আমার বিশ্বাস, এই ক্ষেত্রে জাপান মহৎ এবং নেতৃস্থানীয় ভূমিকা। গ্রহণ করতে পারে। আমার দৃঢ়বিশ্বাস, আপনার যারা বাংলাদেশের মতাে দেশের

——————————————

* জাপান-বাংলাদেশ সমিতির ভােজ সভায় প্রদত্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বক্তৃতা। ১৮ অক্টোবর ১৯৭৩।

——————————————

৯২

জনগণের কল্যাণার্থে মহৎ ভূমিকা নিয়েছেন, তাঁরা সময়ের আহ্বানে সাড়া দিয়ে উন্নত দেশগুলাের নীতি পরিবর্তনের ব্যাপারেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারেন।

মি. প্রেসিডেন্ট, শেষ করার আগে, জাপান এবং বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে সমঝােতা, সহযােগিতা ও বন্ধুত্ব সম্প্রসারণের জন্য আপনি এবং আপনার সমিতি। যে মূল্যবান পদক্ষেপ নিয়েছেন এবং আমাদের প্রতি সৌহার্দ্য দেখিয়েছেন তার জন্য আমি আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি। দুদেশের জনগণের মধ্যে সৌহার্দের সম্পর্ক আরাে ঘনিষ্ঠ করার জন্য আপনি আরাে সার্থক কার্যক্রম পরিচালনা করবেন বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস।

মি. প্রেসিডেন্ট, মান্যবৃন্দ, ভদ্র মহিলা এবং ভদ্রমহােদয়গণ! মহামান্য সম্রাট এবং সম্রাজ্ঞীর স্বাস্থ্য সুখ, দীর্ঘায়ু ও জাপানের জনগণের শ্রীবৃদ্ধি ও কল্যাণ এবং বাংলাদেশ ও জাপানের মধ্যে উত্তরােত্তর গভীর সৌহার্দ্য কামনা করে আপনাদের স্বাস্থ্যপানের জন্য আহ্বান জানাচ্ছি।”*

একই ধরনের প্রত্যয় তিনি মালয়েশিয়াতে ব্যক্ত করেছিলেন। ইতিপূর্বে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টোকিও, যাওয়ার পথে রাতে মালয়েশিয়ায় যাত্রা বিরতি করেন। যাত্রাবিরতিকালে বঙ্গবন্ধুকে বিমানবন্দরে অভ্যর্থনা জানান মালয়েশিয়ার মৎস্য ও কৃষিমন্ত্রী গাজালী জাবীর এসময় কুয়ালালামপুরে নিযুক্ত ভারতের রাষ্ট্রদূত এবং সিঙ্গাপুরের হাইকমিশনার উপস্থিত ছিলেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিমানবন্দরে উপস্থিত সাংবাদিকদের বলেন, ‘বাংলাদেশ দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দেশগুলির সাথে বন্ধুত্ব করিতে এবং উহাদের সহিত নিবিড় সম্পর্ক গড়িয়া তুলিতে ইচ্ছুক।** বিমানবন্দরে এক সাংবাদিক সম্মেলনে দক্ষিণ পূর্ব এশীয় জাতি সমিতিতে (এশিয়ান) বাংলাদেশকে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য তাঁর কোনাে পরিকল্পনা আছে কি না— প্রশ্ন করা হলে বঙ্গবন্ধু বলেন, বিশেষ অবস্থা ও পরিবেশের উপর ইহা নির্ভরশীল। সকল আন্তর্জাতিক সম্মেলনে বা বিশ্বসংস্থায় বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তির বিষয়ে সমর্থন জ্ঞাপনের জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মালয়েশিয়ার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান।***

জাপানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অফিসিয়াল কার্যক্রম শুরু হয় ১৯৭৩ সালের ১৯ অক্টোবর তারিখ হতে। এদিন তিনি জাপানের প্রধানমন্ত্রী কাকুই

——————————-

*ঐ

** দৈনিক ইত্তেফাক, ১৮ অক্টোবর ১৯৭৩।

***ঐ

——————————-

৯৩

তানাকার সরকারি বাসভবনে আমন্ত্রিত হয়ে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে অংশ নেন। জাপানের প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবনকে Sori Daijin Kantei, Shusho Kantei, or simply Kantei বলা হয়। জাপান। পার্লামেন্ট যাকে ডায়েট বলা হয় তার সংলগ্নেই প্রধানমন্ত্রীর বাসস্থান। এটির অবস্থান হলাে- (Located at 2-3-1 Nagata-cho, Chiyoda-ku, Tokyo 100-8968| এই ভবনেই জাপান এবং বাংলাদেশ এর দুই প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে সৌহার্দপূর্ণ পরিবেশে এক ঘণ্টাব্যাপী আলােচনা অনুষ্ঠিত হয়। দ্বিপক্ষীয় এই বৈঠকে আন্তর্জাতিক বিষয় এবং বাংলাদেশের উন্নয়নের বিষয়ে জাপানি সাহায্য সহযােগিতার ব্যাপারে আলাপ আলােচনা প্রাধান্য লাভ করে।

আন্তর্জাতিক বিষয়ের মধ্যে ছিল দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার পরিস্থিতি এবং বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সম্পদ উন্নয়নে জাপানি সহযােগিতা বৃদ্ধি করার জন্য জাপান সরকারকে আহ্বান জানান। বাংলাদেশকে প্রদত্ত জাপানি সাহায্যের জন্য ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন। যমুনা নদীর ওপর প্রস্তাবিত সেতু নির্মাণের বিষয়েও আলােচিত হয়। দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় গুরুত্বপূর্ণ এই বৈঠকের শিরােনাম ছিল: বঙ্গবন্ধু-তানাকা। আলােচনায় পূর্ণ সমঝােতা; সহজ শর্তে বাংলাদেশের ২৪ কোটি টাকার ঋণ লাভ। পত্রিকার বিস্তারিত সংবাদে বলা হয়, বাংলাদেশ প্রায় ২৪ কোটি টাকার (৯০০ কোটি ইয়েন) সহজতম জাপানি পণ্য ঋণ লাভ করিবে। প্রধানমন্ত্রী কাকুই তানাকা আজ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে এই ঋণ দানের প্রতিশ্রুতি দেন।… এই ঋণের জন্য বার্ষিক মাত্র ১ দশমিক ৮৭৫ হারে সুদ দিতে হইবে এবং ১০ বৎসরের রেয়াতী মেয়াদসহ ৩০ বৎসরের মধ্যে এই ঋণ পরিশােধযােগ্য। এই ঋণ জাপানি সরকারের সহজ ঋণদান তহবিল এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সরাসরি নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত বৈদেশিক অর্থনৈতিক সহযােগিতা (ওই সি এফ) তহবিল হতে প্রদান করা হবে।

বাংলাদেশকে প্রদত্ত সাহায্য প্রসঙ্গে জাপানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাশিয়ােশি ওহিরা এক সাংবাদিক সম্মেলনে ঋণের শর্তাবলি ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বলেন জাপান সরকার সহজতম ও অত্যন্ত অনুকূল শর্তে বাংলাদেশকে এই অর্থনৈতিক সাহায্য দানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন। ইতিপূর্বে এমন সহজতম শর্তে জাপান আর কোনাে দেশকে ঋণ প্রদান করেনি। উল্লেখ্য যে ১৯৭২ সালের অক্টোবর পর্যন্ত জাপান বাংলাদেশকে মােট প্রায় পাঁচ কোটি ডলার সাহায্য দিয়েছে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাপান সফরে তিনি জাপানের সম্রাট হিরােহিতাের সাথে সৌজন্য সাক্ষাত করেন। জাপানের রাজপ্রাসাদ যাকে বলা হয় The Tokyo

৯৪

Imperial Palace ( Kõkyo, literally ‘Imperial Residence’) is the primary residence of the Emperor of Japan সেখানে সম্রাট হিরােহিতাে এর সাথে সাক্ষাৎ করেন। সম্রাট হিরােহিতাে জাপানের ইতিহাসের সবচেয়ে আলােচিত। কেননা তিনি ১৯২৬ সালের ২৫ ডিসেম্বর ক্ষমতায় আরােহণ করে ১৯৮৯ সালে। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত ম্রাট ছিলেন।১৩৯ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকাল ও যুদ্ধ পরবর্তীতে গণতান্ত্রিক জাপানের শাসনামলেও তিনি শাসনকার্য পরিচালনা করেছিলেন।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন সময় হিরােহিতাের ভূমিকা ছিল যথেষ্ট বিতর্কিত। বিশ্বযুদ্ধে জাপান পরাজিত হয় ও সম্রাটের ক্ষমতা যথেষ্ট পরিবর্তিত হয়। রাষ্ট্রের প্রধান হিসেবে সম্রাটের হিরােহিতাে’র ভূমিকা অনেকাংশেই প্রতীকী পর্যায়ে চলে আসে।

জাপানের সম্রাট হলেন জাপান রাষ্ট্রের প্রধান। ১৯৪৭ সালের সংবিধান অনুযায়ী, তিনি রাষ্ট্র ও জনগণের ঐক্যের প্রতীক এবং তার সরকার সম্পর্কিত কোনাে ক্ষমতা। নেই। ১৯৪৭ সালের যুদ্ধ-পরবর্তী সংবিধান অনুযায়ী জাপান সম্রাটের কোনাে রাজনৈতিক ক্ষমতা নেই। তবে দেশটির রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বহু দায়িত্ব সম্রাটকে পালন করতে হয়। প্রধানমন্ত্রী, সাংসদ ও সুপ্রিম কোর্টের প্রেসিডেন্ট মনােনয়নের যাবতীয় আনুষ্ঠানিক নথিপত্র স্বাক্ষর করতে হয় তাকে। সম্রাট হিরােহিতাের সাথে সাক্ষাৎকারের সময় বঙ্গবন্ধুর সাথে তার সফরসঙ্গীরাও উপস্থিত ছিলেন।

বাংলাদেশে বিদ্যুৎ শিল্পের কথা চিন্তা করে বঙ্গবন্ধু জাপানের বৃহত্তম বিদ্যুৎ সরঞ্জাম শিল্প পরিদর্শন করেন এবং জাপানের শিল্প উন্নয়নে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেন। প্রায় এক ঘণ্টাব্যাপী সময় ধরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিদ্যুৎ সরঞ্জাম শিল্পের বিভিন্ন বিভাগ পরিদর্শন করেন।

জাপানের প্রতিটি অনুষ্ঠানেই বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে এক নজর দেখার জন্য সবাই উন্মুখ হয়ে থাকতেন। তিনিও প্রতিটি সভা

————————————–

১৩৯ . সম্রাট হিরােহিতের রাজ্যভার গ্রহণের সময় জাপান বৃহৎ শক্তিধর দেশসমূহের একটি ছিল। বিশ্ব অর্থনীতিতে দেশটির অবস্থান ছিল নবম। নৌশক্তিতে ছিল তৃতীয়। এ ছাড়াও, জাতিপুঞ্জে পাঁচটি স্থায়ী সদস্য দেশের একটি ছিল জাপান। জাপান সাম্রাজ্যের সংবিধানমাফিক রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে তার নির্দেশনায় সামাজ্যের সম্প্রসারণ, সামরিকীকরণ এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার ঘটনা ঘটে। যুদ্ধশেষে অন্যান্য অনেক দেশের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গের ন্যায় তিনিও যুদ্ধাপরাধী হিসেবে আখ্যায়িত হয়ে বিচারের সম্মুখীন হতে হয়নি। কিন্তু, যুদ্ধ পরবর্তীকালে নতুন দেশে হিরােহিতাে প্রতীকি সম্রাটে পরিণত হন।

————————————–

৯৫

সমাবেশে বন্ধুত্বের আহ্বান জানিয়েছেন। সাম্য, মৈত্রী এবং ভ্রাতৃত্বের কথা বলেছেন।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সৌজন্যে আয়ােজিত জাপানের বাণিজ্য সংস্থাসমূহের ফেডারেশন, জাপানের বৈদেশিক বাণিজ্য কাউন্সিল এবং জাপান শিল্প ও বণিক সমিতির প্রদত্ত এক ভােজসভায় তিনি অংশগ্রহণ করেন। এই ভােজসভাতেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এক চমৎকার বক্তৃতা দেন। যেখানে তিনি ক্ষুধা, দারিদ্র্য, পুষ্টিহীনতা, রােগ, অশিক্ষা ও বেকারত্বের বিরুদ্ধে সংগ্রামরত উন্নয়নগামী দেশসমূহের সাথে অর্থনৈতিক সহযােগিতা সম্প্রসারণ করার জন্য জাপানের প্রতি আহ্বান জানান। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান চেয়েছিলেন যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশকে জাপানের দৃষ্টান্ত ধরে নিয়ে দেশের পুনর্গঠন করতে। এ কারণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাপানের কাছে অর্থনৈতিক সহযােগিতার পাশাপাশি সব রকমের সহযােগিতা আশা করেছিলেন। জাপানের বাণিজ্য সংস্থাসমূহের ফেডারেশন, জাপানের বৈদেশিক বাণিজ্য কাউন্সিল এবং জাপান শিল্প ও বণিক সমিতির প্রদত্ত এক ভােজসভায় জাপানের গণ্যমাণ্য ব্যক্তিদের উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, “শুধু আর্থিক সহায়তার ক্ষেত্রেই আমরা আপনাদের সাহায্য প্রত্যাশা করি না; আপনাদের উন্নততর কারিগরি ও প্রযুক্তিবিদ্যা, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে আপনাদের মূল্যবান অভিজ্ঞতা, কৃষিতে উৎপাদনের হার বৃদ্ধির কর্মকৌশল এবং আপনাদের অনবদ্য শিক্ষা ব্যবস্থা ইহার সবকিছু হইতেই আমরা ব্যাপকভাবে উপকৃত হইতে চাই। আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সংস্থার কাঠামােতে দ্বিপক্ষীয় ভিত্তিতেই আপনাদের সহায়তা আমাদের প্রয়ােজন।”১৪০ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মনে করতেন বিশ্বের অন্যতম সেরা অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে জাপান উন্নয়নগামী দেশসমূহের প্রতি সহযােগিতার হাত আরাে সম্প্রসারিত করে এ ব্যাপারে প্রধান ভূমিকা পালন করতে পারে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জাপান সফরের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল যমুনা নদীর ওপর সেতু নির্মাণে সাহায্য-সহযােগিতা লাভ করা। পাকিস্তান আমল থেকেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান উত্তরবঙ্গের উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন প্রকার দাবি-দাওয়া জানিয়ে এসেছেন। তার দাবি দাওয়ার মধ্যে ছিল এই দরিদ্রপীড়িত অঞ্চলের মানুষের ভাগ্য

——————————————

১৪০ . জাপানের বাণিজ্য সংস্থা সমূহের ফেডারেশন, জাপানের বৈদেশিক বাণিজ্য কাউন্সিল এবং জাপান শিল্প ও বণিক সমিতির প্রদত্ত ভােজসভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বক্তৃতা, টোকিও, ১৯ অক্টোবর ১৯৭৩।

——————————————

৯৬

উন্নয়নের জন্য কিছু করা। এ কারণেই আমরা দেখতে পাই ১৯৬৪ সালের পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সম্মেলনে ২৬টি প্রস্তাব গৃহীত হয়েছিল তন্মেধ্যে ২৬ নম্বর প্রস্তাব ছিল যমুনা নদীর পশ্চিম তীর বরাবর রংপুর থেকে সিরাজগঞ্জ পর্যন্ত বাঁধ নির্মাণ।১৪১

উত্তরবঙ্গ বললেই একসময় চোখের সামনে ভেসে ওঠে বন্যা, খরা, দুর্ভিক্ষ, মঙ্গা ইত্যাদি। দারিদ্র্যপীড়িত কৃষক, দিনমজুরদের অগ্রিম মজুরি বিক্রি সবই ছিল দারিদ্র্যের ঘন কুয়াশার চাদরে লুকোচুরি খেলার মতাে। উত্তরবঙ্গে সফরে এসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এগুলাে স্বচোখে দেখেছেন। পাকিস্তানি শাসনামলে বাংলাদেশের বুকে শােষণ ও বঞ্চনার যে স্টিম রােলার চালানাে হয়েছিল সে ইতিহাস সবারই জানা। তন্মেধ্যে উত্তরবঙ্গের কাহিনি ছিল আরাে করুণ ও মর্মন্তদ। যমুনাপাড়ের বিস্তীর্ণ এলাকায় কোটি কোটি মানুষের অনুন্নত অবস্থা ছিল নিয়তির নিদারুণ পরিহাসের মতােই। বিষয়টি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অনুভব করেছিলেন। যমুনায় সেতুর অভাবে উত্তরবঙ্গের বিস্তীর্ণ এলাকায় উৎপাদিত বিভিন্ন কাঁচামাল ও শিল্প উপাদান কোনাে সময়ই উপযুক্ত বাজার পায়নি। ফলে একদিকে দেশের সম্পদের অপচয় ঘটেছে অন্যদিকে জনসম্পদেরও সদ্ব্যবহার হতে পারেনি। এর দরুণ উত্তরবঙ্গের সচেতন নাগরিক মাত্রকেই সে সময়ে নিদারুণ বঞ্চনা এবং হতাশায় ভুগতে হয়েছে। যমুনা নদীতে সেতু দেয়ার বিষয়টি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রথম থেকেই গুরুত্বের সাথে দেখেছেন।

১৯৭০ সালের পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনের প্রাক্কালে বেতার-টেলিভিশনে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণদান কালে তিনি আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ওয়াদা হিসেবে যমুনা। সেতু নির্মাণের কথা উত্থাপন করেছিলেন। পাক হানাদার বাহিনীর হত্যাযজ্ঞ ও ধ্বংসলীলায় গােটা বাংলাদেশ যখন শ্মশান হয়ে পড়েছিল, সে অবস্থায় সম্পূর্ণ খালি হাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশের শাসনভার গ্রহণ করেই যমুনায় সেতু নির্মাণের উদ্যোগের কথা জাপান সফরে এসে জাপান সরকারকে জানিয়েছিলেন। এ কারণেই আমরা দেখতে পাই ১৯৭৩ সালের ২০ অক্টোবর তারিখে সকালে বঙ্গবন্ধু। শেখ মুজিবুর রহমান যমুনা নদীর ওপর প্রস্তাবিত সেতু নির্মাণের সাথে সংশ্লিষ্ট কোম্পানির একটি গবেষণা ইনস্টিটিউট পরিদর্শন করেন। ইনস্টিটিউটের কর্মকর্তা ও প্রকৌশলীদের সাথে আলাপ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু বলেন যে, যমুনা নদীর ওপর সেতু

——————————————

১৪১. নূহউলআলম লেনিন (সম্পাদিত), বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সংক্ষিপ্ত ইতিহাস নির্বাচিত দলিল , ঢাকা: সময় প্রকাশন, ২০১৫, পৃ.২১২।

——————————————

৯৭

নির্মাণে বাংলাদেশ জাপানি বিশেষজ্ঞদের মূল্যবান অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাতে আগ্রহী। এ ছাড়াও ওই দিনই বঙ্গবন্ধু সিবা শিল্প কমপ্লেক্স এলাকায় সােমিটোমাে কেমিক্যাল কোম্পানির একটি পেট্রোকেমিক্যাল কারখানা পরিদর্শন করেন।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের জন্য জাপানে এসেছিলেন। এই অভিজ্ঞতা হলাে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসাত্মক অবস্থা থেকে কিভাবে জাপান ঘুরে দাঁড়িয়েছে এটা দেখার ও জানার ছিল। জাপান থেকে দেখে শেখার কথা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর জাপানযাত্রীতে লিখেছেন- “আমরা অনেক আচার, অনেক আসবাব য়ুরােপের কাছ থেকে নিয়েছি সব সময়ে প্রয়ােজনের খাতিরে নয়, কেবলমাত্র সেগুলাে য়ুরােপীয় বলেই। য়ুরােপের কাছে আমাদের মনের এই যে পরাভব ঘটেছে। অভ্যাসবশত সেজন্যে আমরা লজ্জা করতেও ভুলে গেছি। য়ুরােপের যত বিদ্যা আছে সবই যে আমাদের শেখবার, এ কথা মানি; কিন্তু যত ব্যবহার আছে সবই যে। আমাদের নেবার , এ কথা আমি মানি নে। তবু, যা নেবার যােগ্য জিনিস তা সব দেশ থেকেই নিতে হবে, এ কথা বলতে আমার আপত্তি নেই। কিন্তু সেইজন্যেই, জাপানে যে-সব ভারতবাসী এসেছে তাদের সম্বন্ধে একটা কথা আমি বুঝতে পারি নে। দেখতে পাই, তারা তাে য়ুরােপের নানা অনাবশ্যক নানা কুশ্রী জিনিসও নকল করেছে, কিন্তু তারা কি জাপানের কোনাে জিনিসই চোখে দেখতে পায় না।”১৪২

হয়তাে এ কারণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সফর শুধু টোকিওতে সীমাবদ্ধ ছিল না। মাত্র এক সপ্তাহেই তিনি জাপানের বেশ কয়েকটি প্রদেশ ঘুরে বেরিয়েছেন। অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছেন, যা তিনি বাংলাদেশের উন্নয়নে ব্যয় করেছেন।

১৯৭৩ সালের ২০ অক্টোবর তারিখে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাপানের সানফ্লাওয়ার কোম্পানির ডক পরিদর্শন করেন। এ কোম্পানিতে অনেক বাঙালি দেখে বঙ্গবন্ধু অনেক খুশি হয়েছিলেন। পরের দিন তিনি নাচিকাতসুরায় ফেরিযােগে প্রমােদ ভ্রমণে যান। অত্যন্ত মনােরম এবং দ্রুতগামী ফেরিবােট সানফ্লাওয়ার যােগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার সফরসঙ্গীরা হায়াকাওয়ায়ের নির্বাচনী এলাকা তানাবে সিটিতে গমন করেন। তিনি ফেরীতে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান উপভােগ করেন। মধ্যাহ্নভােজে তাঁকে জাপানি খাদ্য দ্বারা আপ্যায়িত করা হয়। নাচি কাতসুরায় ফেরি ঘাটে পৌছালে সেখানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তাঁর সফর সঙ্গীদের উষ্ণ

———————————————-

  1. https://rabindra-rachanabali.nltr.org/node/8934

———————————————-

৯৮

সম্বর্ধনা দেয়া হয়। হাজার হাজার উদ্বেলিত জনতা জয় বাংলা জাপান বাংলাদেশ মৈত্রী দীর্ঘস্থায়ী হউক’ শীর্ষ ধ্বনির মাধ্যমে বাংলাদেশের জাতির পিতাকে বরণ করেন। সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে সেখানকার গভর্নর ওহাশি (Ohashi) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে মানপত্র প্রদান করেন এবং স্বাগত ভাষণ দেন। এই সময় আহমেদ জালাল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দোভাষী হিসেবে কাজ করছিলেন এবং গভর্নর ওহাশির বক্তৃতা অনুবাদ করে দেন।১৪৩

তিনি জাপানের শিল্পাঞ্চল ওয়াকায়ামার ওসাকা এবং কিয়াটোতেও গেছেন। দুই দিন অবস্থান করেছেন। তিনি প্রশান্ত মহাসাগর দিয়ে ওয়াকায়ামা যান এবং উপভােগ করেছেন পুরাে উপত্যকা, যেখানে পুবদিকে উন্মুক্ত হয়ে দিগন্তে মিশেছে এক ফালি সমুদ্রের সাথে। তিনি এসময় তীর্থভূমি নাচি পর্বতের ধর্মীয় স্থানগুলাে পরিদর্শন করেন।

ওসাকার শিল্পনগরীর অনেক শিল্পপ্রতিষ্ঠান পরিদর্শন শেষে জাপানের প্রাচীন শহর কিয়ােটোতে রাত যাপন করেন। এ যেন পশ্চিমদিকে দেয়াল হয়ে আড়াল দেয়া আকাশছোঁয়া পাহাড়ের সারি। যে শহরটি ৭৯৪ থেকে ১৮৬৮ সাল পর্যন্ত জাপানের রাজধানী ছিল। কিয়ােটোর প্রকৃতি সব সময়েই অপরূপ। সেখানে রয়েছে মন্দির আর প্রাচীন জাপানি স্থপতির নকশার অপরূপ নিদর্শন। উনিশ শতাব্দী থেকে এটি জাপানের সম্পদশালী শহর।

প্রতি বছর পৃথিবীর নানা দেশের মানুষেরা কিয়ােটোর সুন্দর প্রকৃতি উপভােগ করে। জাপানি লােকেরা বসন্তকালে চেরি ব্লোমস এবং শরৎকালের পাতার রং পরিবর্তন দেখতে এখানে আসে। টোকিওয়ের বাইরে বঙ্গবন্ধু এখানে দুই দিন অবস্থান করে জাপানের অন্যতম প্রধান নগর ওসাকাতেও গেছেন। পরে ২২ অক্টোবর (১৯৭৩) পুনরায় টোকিওতে প্রত্যাবর্তন করেন।

জাপানের সংবাদপত্র বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন। তাঁর জাপান সফর নিয়ে ১৯৭৩ সালের ২২ অক্টোবর টোকিওর প্রভাবশালী দৈনিক শিমবুনসহ আরাে তিনটি পত্রিকার প্রতিনিধির সাথে এক সাক্ষাৎকার প্রদান করেন।

রঙ্গবন্ধুর জাপান সফর উপলক্ষে জাপানি পত্র-পত্রিকায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভূয়সী প্রশংসা করা হয়। ২২ অক্টোবর ১৯৭৩ তারিখের জাপানের বিভিন্ন

————————————

১৪৩ . Sheikh Ahmed Jalal, Ibid, p.327.

————————————

৯৯

দৈনিক পত্র-পত্রিকায় জাপানের বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সফরের খবর বিশেষ গুরুত্ব সহকারে প্রকাশ করা হয়।

পত্রিকাগুলােতে প্রকাশিত খবরের সারমর্মে বঙ্গবন্ধুকে সাড়ে সাত কোটি লােকের মুক্তিদাতা ও মহান ব্যক্তিত্বের অধিকারী বলে অভিহিত করা হয়। পত্রিকাগুলাের মধ্যে উল্লেখযােগ্য ছিল আশাহি শিমবুন, মাইনিচি শিমবুন ইত্যাদি।

মাইনিচি শিমবুন পত্রিকা জাপানি প্রধানমন্ত্রী মি. তানাকার একটি ভাষণের উদ্ধৃতি দিয়ে উল্লেখ করে যে, মুজিব একটি জাতির মহান প্রতিষ্ঠাতা পিতা। তিনি বাংলাদেশের হাকুবুন। উল্লেখ্য যে, হাকুবুন মেইজি আমলের একজন কৃতী রাজনীতিক। তিনি মেইজি শাসনতন্ত্রের অন্যতম রচয়িতা ছিলেন। ১৯৭৩ সালের ২২ অক্টোবর তারিখে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। টোকিওতে টিভি সাক্ষাঙ্কার প্রদান করেন। সাক্ষাৎকারে তিনি বাংলাদেশের যুদ্ধ বিধ্বস্ত অর্থনীতি পুনর্গঠনে জাপানের নিকট হতে অর্থনৈতিক সহযােগিতা আশা করেন। তিনি আরাে বলেন, “বাংলাদেশ যুদ্ধ বিধ্বস্ত অবস্থার মধ্যে উহার প্রথম পঞ্চবার্ষিকী অর্থনৈতিক কর্মসূচী বাস্তবায়ন করিতেছে।… তাঁহার দেশ সকল দেশের

১০০

সহিত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক কামনা করে।… ইহা দুঃখজনক যে, চীন জাতিসঙ্ঘে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তির বিরােধিতা করিয়াছে।”* 

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যখন জাপান সফর করেন তখন জাপানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন মাসায়ােশি ওহিরা। তিনি জাপানের প্রধানমন্ত্রী কাকুই তানাকার খুবই বিশ্বস্ত ছিলেন। ২২ অক্টোবর ১৯৭৩ তারিখে জাপানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাসায়েশী ওহিরার। সাথে এক বৈঠকে মিলিত হন। তারা জাপানের প্রধানমন্ত্রী কাকুই তানাকার সাথে আলােচনার সূত্র ধরে কথাবার্তা বলেন। আন্তর্জাতিক বিষয় ছাড়াও তারা মূলত বাংলাদেশ-জাপান দুই দেশের মধ্যে অর্থনৈতিক সহযােগিতা সম্পর্কে আলােচনা করেন। জাপানের প্রধানমন্ত্রী কাকুই তানাকা বাংলাদেশকে অর্থনৈতিক সাহায্য দানের আশ্বাস দেন। জাপানে সফররত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সম্মানে জাপানের প্রধানমন্ত্রী তানাকার নৈশভােজে দেয়া বক্তব্যে তিনি আরাে দৃঢ় অভিমত প্রকাশ করে বলেন যে, প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের যােগ্য নেতৃত্বে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ দৃঢ় সংকল্প নিয়ে এগিয়ে যাবে। জাপান কীভাবে অতীতে মানবিক সাহায্যের আকারে বাংলাদেশের খাদ্য ও বস্ত্রের অভাব পূরণে এগিয়ে এসেছিল জাপানি প্রধানমন্ত্রী সে কথা স্মরণ করেন। গত বৎসর ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলাদেশের সাথে জাপানের কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার কথা স্মরণ করে মিঃ তানাকা ভােজ সভায় আরাে বলেন জাপানের জনগণ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সফরের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন। জাপানি প্রধানমন্ত্রী কাকুইয়ে তানাকা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ব্যক্তিগতভাবে খুবই পছন্দ করতেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দৃঢ়চেতা মনােভাব, ব্যক্তিত্ব ছিল মুগ্ধ করার মতাে। জাপানি প্রধানমন্ত্রীর সরকারি ভবনে অনুষ্ঠিত ভােজসভায় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী কাকুইয়ে তানাকা শেখ মুজিবুর রহমান সম্বন্ধে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছিলেন। ভােজসভার টেবিলে জাপানি প্রধানমন্ত্রী কাকুইয়ে তানাকার প্রশংসা সূচক বাক্য নিয়ে হায়াকাওয়া লিখেছেনপ্রধানমন্ত্রী কাকুইয়ে তানাকা শেখ মুজিবুর রহমান সম্বন্ধে যখন বললেন, আধুনিক জাপানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হিরােবুমি ইতাের সঙ্গে তার মিল আছে, তখন তার পাশে থাকা জাপান শিল্প ও বণিক সমিতির প্রধান শিগেও নাগানাে বলে উঠেছিলেন, না শুধু তা-ই নয়, জাপানের আধুনিকায়নে অন্যতম নেতা তাকামােরি সাইগাের সঙ্গেও তার চেহারার মিল আছে।১৪৪

১৯৭৩ সালের ২৩ অক্টোবর তারিখে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সম্মানে জাপান বাংলাদেশ মৈত্রী সমিতি এক অনুষ্ঠানের আয়ােজন করে। অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছাড়াও অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন।

————————————————

* দৈনিক ইত্তেফাক, ২৪ অক্টোবর ১৯৭৩। 

১৪৪ . তাকাশি হায়াকাওয়া, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৭।

————————————————

১০১

সফরসঙ্গী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. কামাল হােসেন, পরিকল্পনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান। ড. নুরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক সচিব তােফায়েল আহমেদ, বঙ্গবন্ধুকন্যা। শেখ রেহানা, বঙ্গবন্ধুপুত্র শেখ রাসেল এবং আরাে অতিথিবর্গ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান উক্ত অনুষ্ঠানে জাপানকে বিশ্বের দরিদ্র দেশসমূহকে সহযােগিতার আহ্বান জানান। তিনি বক্তৃতায় বলেন, “যদি বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশের জনগণ অসহায় আর দরিদ্রে জর্জরিত হয় তবে বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে না। অস্ত্র প্রতিযােগিতা বন্ধ করে উন্নয়নশীল দেশের জনগণের কল্যাণে অর্থ বিনিয়ােগের পক্ষে সােচ্চার হওয়ার জন্য জাপানের জনসাধারণের প্রতি আহ্বান জানান।*

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাপানিদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করে বলেন, বাংলাদেশের চরম দুর্দিনে স্বাধীনতাসংগ্রামের দিনগুলিতে জাপানের সাহায্য সহযােগিতার কথা বাঙালিরা কখনাে ভুলতে পারে না। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের ক্ষয়-ক্ষতির বিবরণও তুলে ধরেন। তিনি তার বক্তৃতায় বলেন, “পাকিস্তান বাংলাদেশের সবকিছুই ধ্বংস করে দিয়েছে। পাকিস্তানিরা ত্রিশ লাখ লােককে হত্যা করেছে, শত শত গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছে, দু’লাখ মহিলার মর্যাদাহানী করেছে। তাছাড়া এক কোটি লােক শরণার্থী হয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল।”*** এই প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী নাগাসাকি ও হিরােশিমার ধ্বংসযজ্ঞের কথা উল্লেখ করে বলেন, বাংলাদেশ বিপুল ত্যাগের বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জন করেছে। অনুষ্ঠানে তিনি মি. হায়াকাওয়ার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলেন, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর জাপান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছে। জাপানবাংলাদেশ মৈত্রী সমিতির সভাপতি মি. হায়াকাওয়া স্বাধীনতা লাভের কিছুদিন পর বাংলাদেশ সফর করে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ধ্বংসযজ্ঞের দৃশ্য সচক্ষে দেখে এসেছিলেন।*

জাপান-বাংলাদেশ মৈত্রী সমিতির অনুষ্ঠানে সভাপতি মি. হায়াকাওয়া জাপান বাংলাদেশ মৈত্রী সমিতির পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধুকে একটি মেডিক্যাল লঞ্চের মডেল উপহার দেন। লঞ্চটির নামকরণ করা হয় সূর্যোদয়। এ উপলক্ষে মি. হায়াকাওয়া তার বক্তৃতায় বলেন, “এই লঞ্চ বাংলাদেশের জনসাধারণের দুঃখদুর্দশা কিছুটা লাঘবের সহায়ক হবে।** বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের প্রতি হায়াকাওয়ার ছিল অপরিসীম শ্রদ্ধা। এ থেকেই তিনি ওই অনুষ্ঠানে যথার্থই বলেছিলেন, তাঁর নেতৃত্বে বাংলাদেশ সমৃদ্ধশালী হয়ে উঠবে। *** 

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কৃতিত্ব তুলে ধরে মি. হায়াকাওয়া আরাে বলেন, তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের অব্যবহিত পরে বাংলাদেশ সফর করেন।

—————————————–

* দৈনিক ইত্তেফাক, ২৪ অক্টোবর ১৯৭৩।

** ঐ।

*** ঐ।

* ঐ।

** ঐ।

*** ঐ।

—————————————–

১০২

তখন তিনি বাংলাদেশের জনসাধারণের কল্যাণে ও দেশ পুনর্গঠনে বঙ্গবন্ধুকে রাতদিন কঠোর পরিশ্রম করতে দেখেছেন।**** জাপান-বাংলাদেশ মৈত্রী সমিতি আয়ােজিত অনুষ্ঠানে জাপানের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী মি. ফুকুদাও বক্তৃতা করেন। তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভূয়সী প্রশংসা করে বলেন, তিনি জীবনের প্রায় অর্ধাংশ কারাগারে অতিবাহিত করেছেন। বঙ্গবন্ধু সংগ্রামে সফল হয়েছেন। বাংলার নেতা বাকি জীবন দেশকে প্রকৃত সমৃদ্ধশালী রাষ্ট্র হিসেবে গড়ার কাজে অতিবাহিত করবেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান এই মিশনেও সফলকাম হবেন। উল্লেখ্য যে জাপানের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী মি. ফুকুদা বাংলাদেশের ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একজন পরম হিতৈষী ছিলেন। তাঁর সময়কালেই জাপান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাষ্ট্রীয় সফর হলেও তাঁর জাপানের অনেক গুণমুগ্ধ ভক্ত দেখা করে সেহধন্য হয়েছিলেন। তাঁরা আজীবন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অকৃত্রিম বন্ধুত্বে পরিণত হন। তাদের মধ্যে অধ্যাপক ড. সুয়ােশি নারা, অধ্যাপক কাজুও আজুমা, তানাকা তােশিহিসা প্রমুখ। অধ্যাপক নারা ও অধ্যাপক আজুমা দুজনই বঙ্গবন্ধুর জাপান সফরে দোভাষীর কাজ করেছিলেন। অবশ্য আরেকজন বাঙালি শেখ আহমেদ জালালও দোভাষীর কাজ করেছিলেন। জাপান রেডক্রসের প্রাক্তন প্রধান ফুকিউরা তাদামাসা বঙ্গবন্ধুর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ছিলেন। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের সংবর্ধনা মঞ্চে ফুকিউরা বঙ্গবন্ধুর সাথে আলিঙ্গনাবদ্ধ হন। সেই থেকে গভীর বন্ধুত্ব নিয়ে একে অপরকে দেখতেন। ফুকিউরা মনে করতেন বঙ্গবন্ধু হলেন ‘এশিয়ার সিংহ হৃদয়। জাপানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাসাইয়ােশি ও ওহিরার মুখেও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা শুনতে পাওয়া যায়। জাপান সফর শেষে বিমানবন্দরে তাকে বিদায় জানাতে আসা এই জাপানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছিলেন, নিঃসন্দেহে শেখ মুজিব বর্তমানে বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম তিনজন রাজনীতিবিদের মধ্যে একজন।১৪৫

—————————————

**** তাকাশি হায়াকাত্তয়া, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৬। 

১৪৫ . তাকাশি হায়াকাওয়া, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৭।

—————————————

১০৩

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সুহৃদ জাপানি বন্ধুদের সাথে পরিচিত হয়ে বঙ্গবন্ধু কৃতার্থ হন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে জাপানিদের সাহায্য সহযােগিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব কখনােই ভুলেননি। এজন্য আমরা দেখতে পাই তাঁর জাপান সফরে জাপানবাংলাদেশ সমিতিতে দেয়া বক্তৃতায় তিনি যথার্থই বলেছিলেন, “আমার জাপানি বন্ধুরা, বাংলাদেশের জন্য আপনারা যা কিছু করেছেন, আজ এখানে আমার সরকার এবং দেশের পক্ষ থেকে তার জন্য আমি আপনাদের আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি। স্বাধীনতাযুদ্ধের সময়ে আপনারা যে সাহায্য এবং সহায়তা দিয়েছেন, তা ছিল আমাদের শক্তির উৎস। আপনাদের দেওয়া সেই সাহায্য সহানুভূতি, বাংলাদেশ সৃষ্টিতে বিরাট ভূমিকা পালন করছে।”১৪৬

সামগ্রিকভাবে বলা যায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জাপান সফর ছিল কূটনৈতিক ক্ষেত্রে এক বিশাল সাফল্য। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে জাপানে যেভাবে সম্মানিত করা হয়েছিল, এমন সৌভাগ্য ও সম্মান খুব কম রাজনীতিবিদের ভাগ্যেই জুটেছে। তৃতীয় বিশ্বের তাও আবার সদ্য স্বাধীনপ্রাপ্ত একটি দেশের প্রধানমন্ত্রী হয়েও জাপানে অনেক সম্মান ও মর্যাদা পেয়েছেন। এ ধরনের সম্মান অদ্যাবধি কোনাে বাঙালি বা এশিয়াবাসীর পক্ষে জুটেছে কি না সন্দেহ। জাপানের প্রবীণ রাজনীতিবিদ ও সাবেক মন্ত্রী তাকাশি হায়াকাওয়া যথার্থই বলেছেন, আমরা জাপানে শেখ মুজিবুর রহমান ও তার সফরসঙ্গীদের আন্তরিকভাবে আপ্যায়ন করেছিলাম। দেশ আলাদা হলেও মানুষের মনে কোনাে প্রভেদ নেই। আমাদের মন তারাও বুঝতে পেরেছেন। অত্যন্ত আনন্দের কথা এটি। বাংলাদেশ এখন বিশ্বের সবচেয়ে জাপানপ্রিয় দেশের একটি। এর আগে জাপান এশীয় দেশগুলাের সঙ্গে যেভাবে কূটনৈতিক সম্পর্ক গড়ার চেষ্টা করে এসেছিল, সেটি ছিল অনেক বেশি অর্থকেন্দ্রিক আর তাতে মনের সঙ্গে মনের যােগাযােগ ও মানবিকতার অভাব রয়ে গিয়েছিল।১৪৭ 

বাংলাদেশের জাঁদরেল কূটনীতিবিদ ফারুক চৌধুরী বঙ্গবন্ধুর জাপান সফরকে মূল্যায়ন করতে গিয়ে বলেছেন, অর্থনৈতিক কূটনীতির ক্ষেত্রে ১৯৭৩-এর অক্টোবরে বঙ্গবন্ধুর জাপান সফর সেই শিল্পোন্নত সমৃদ্ধ এশীয় দেশের সঙ্গে করেছিল আমাদের অর্থবহ সম্পর্কের সূচনা।১৪৮

—————————————

১৪৬. দৈনিক বাংলা, ২০ অক্টোবর, ১৯৭৩। আরাে দেখুন, ড. মাে. আনােয়ারুল ইসলাম, আমাদের বঙ্গবন্ধু, পাবনা: বীর বাঙ্গালী প্রকাশনী, ২০১৮, পৃ. ১৩। 

১৪৭. তাকাশি হায়াকাওয়া, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৬। 

১৪৮. ফারুক চৌধুরী, স্মরণে বঙ্গবন্ধু, ঢাকা: মাওলা ব্রাদার্স, ২০১৭, পৃ. ১৩৪।

—————————————

১০৪

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার জাপান সফরের যে শ্রদ্ধার অর্ঘ্য পেয়েছিলেন তা কখনাে ভােলেননি। বাংলাদেশ ফিরে এসে ১৯৭৩ সালের ৯ নভেম্বর তিনি জাপান বাংলাদেশ সমিতির সভাপতি হায়াকাওয়াকে চিঠি লিখলেন। তাতে উল্লেখ করলেন …আমাদের সাম্প্রতিক জাপান সফরের সময় আপনি আমাদের জন্য যা করেছেন। তার জন্য আমার সহগামী প্রতিনিধিদল ও নিজের পক্ষ থেকে আপনাকে জানাই। অশেষ ধন্যবাদ। আপনার সমিতি ও জাপানের অন্যান্য জনসাধারণ তাদের। স্বতস্ফূর্ত অভ্যর্থনা জ্ঞাপন করে হৃদয়ের যে অনুভূতির নিদর্শন দেখিয়েছেন তা আমাকে গভীরভাবে স্পর্শ করেছে। আমার সফর উপলক্ষে বিভিন্ন অনুষ্ঠান আয়ােজনের ব্যাপারে আপনি যে ব্যক্তিগত অবদান রেখেছেন তাতে একথাই প্রমাণিত হয়েছে যে, আপনার মধ্যে সত্যিই বাংলাদেশ একটি পরম বন্ধুর সন্ধান পেয়েছে।১৪৯ জাপান প্রবাসী গবেষক দিলদার হােসেন মনে করেন, জাপানে বঙ্গবন্ধুর সরকারি সফর ছিল খুবই সাফল্যমণ্ডিত যা হায়াকাওয়া ও ওয়েমাদার যৌথ প্রচেষ্টায় বঙ্গবন্ধুর এই সফরকে উদাত্তচিত্তে তুলে ধরেছে জাপানের জনগণের কাছে, যা ছিল বিশেষভাবে বাংলাদেশ ও জাপানের বন্ধুত্বপূর্ণ ও সহযােগিতার প্রথম সূচনার দ্বার উন্মােচন।১৫০

এভাবে বঙ্গবন্ধুর জাপান সফরের ফলে বাংলাদেশ ও জাপান দুই দেশের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক আরাে উন্নত হয়ে মানুষে মানুষে মনের সম্পর্কের পর্যায়েও তা পৌছে যায়। এ যেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জাপানযাত্রীর সেই কথাটি। জাপানের যেটা শ্রেষ্ঠ প্রকাশ সেটা অহংকারের প্রকাশ নয়, আত্মনিবেদনের প্রকাশ, সেইজন্যে এই প্রকাশ মানুষকে আহ্বান করে, আঘাত করে না।১৫১

——————————————

১৪৯ . Sheikh Ahmed Jalal, Ibid, p.328. 

১৫০. দিলদার হােসেন, জাপানে বঙ্গবন্ধু রবীন্দ্রনাথ, ঢাকা: ভাষাপ্রকাশ বাংলাদেশ,২০১৮, পৃ. ৯। 

১৫১. জাপানযাত্রী, পৃ. ৫৫।

——————————————

১০৫

Reference: বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ জাপান সম্পর্ক – ড. মো. আনোয়ারুল ইসলাম