বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও জাপান
(Heavy fighting, including the cold-bloded shooting of unarmed citizens, erupted in Dacca last Thursday night (25 March 1971) within two hours of Sheikh Mujibur Rahman’s call for a fight for East Pakistan’s Independence. – Osamu Takeda; Yomiuri Correspondent; Daily Yomiuri, 29 March 1971.)
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বহির্বিশ্বের অন্যান্য দেশের ন্যায় জাপানের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জাপান ও চীন এশিয়ার অন্যতম শক্তিশালী দেশ হিসেবে বিবেচিত হতাে। চীন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানপন্থি নীতি গ্রহণ করলেও জাপান বাংলাদেশের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করে। বহির্বিশ্বের অন্য দেশগুলাে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ প্রসঙ্গে স্পষ্টত দুই বলয়ে বিভক্ত হয়ে পড়ে। বিশেষ করে দুই পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র এবং সােভিয়েত ইউনিয়নের কারণে। এই দুই বলয়ের সাথে যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে চীন এবং সােভিয়েত ইউনিয়নের সাথে ভারত যুক্ত হয়। এদের মধ্যে সােভিয়েত ইউনিয়ন এবং ভারত ছিল আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সরাসরি সমর্থনকারী দেশ। ইউরােপের দেশগুলাের মধ্যে ব্রিটেন, ফ্রান্সসহ অন্য দেশগুলাে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করেছিল। অপরপক্ষে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চীন ছিল মুক্তিযুদ্ধের বিরােধিতাকারী দেশ। তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাধারণ নাগরিক, কংগ্রেস এবং সিনেটের অনেক সদস্য মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করেছিল এবং সাহায্য সহযােগিতার হাত বাড়িয়েছিল। জাপান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বলয়ের দেশ হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করেছিল।
জাপান বরাবরই বাঙালির প্রতি সহানুভূতিশীল ছিল। জাপান বাঙালি জাতীয়তাবাদের দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে সাহায্যের জন্য এগিয়ে এসেছিল। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে জাপানের ভূমিকা কেমন ছিল সে বিষয়ে অনেক গবেষকই মূল্যবান গবেষণাকর্ম সম্পন্ন করেছেন। এতে দেখা যায় জাপানের ইতিবাচক ভূমিকা ছিল। সুকুমার বিশ্বাস লিখেছেন: During the Bangladesh Liberation War the Japanese Media, journalists, intellectuals, politicians, the government and the people played a highly
৪৮
praiseworthy role. The exclusive press coverage, programs in the Radio Japan, NHK, editorials, political commentaries, etc., both in English and Japanese did not only help to gain the support of the Japanese nation, but also contributed in formulating a pro-Bangladesh opinion of the international community.৭৪
সরকারি নীতির সাথে জাপানের বুদ্ধিজীবী, ছাত্র সমাজ, পত্র-পত্রিকাগুলাের ভূমিকা ছিল বাংলাদেশের পক্ষে। পাকিস্তান বাহিনীর গণহত্যা, শরণার্থী সমস্যা, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না করা এ সকল বিষয় নিয়ে জাপানে বেশ জনমত তৈরি হয়েছিল। বাংলাদেশের প্রতি সহানুভূতির প্রকাশ পেয়েছিল সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের দ্বারা। প্রবাসী কতিপয় বাঙালি ও। তাদের উদ্যোগে গঠিত বাঙালিদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসােসিয়েশন জাপানে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত সৃষ্টিতে যথেষ্ট ভূমিকা রাখে।
পাকিস্তান ছিল জাপানের সাহায্যভুক্ত দেশ। ১৯৬১-১৯৭১-এক দশকে পাকিস্তান জাপানের ওডিএ বা অফিসিয়াল ডেভেলপমেন্ট অ্যাসিসট্যান্ট প্রােগ্রামের আওতায়। মােট বিদেশি সাহায্যের ১৮ ভাগ পেয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের কারণে জাপান ১৯৭১ সালের মে মাসে পাকিস্তানে সাহায্য বন্ধ রাখে। Japan viewed the crisis in East Pakistan on the basis of Bengali nationalism and supported it. মুক্তিযুদ্ধে ত্বরিৎ সহযােগিতার কারণে জাপান ঢাকায় কনসাল জেনারেল অফিস বন্ধ করে দেয় এবং পাকিস্তানে দেয়া সাহায্য বন্ধ করে দেয়। পাকিস্তান সরকার প্রথম থেকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে অভ্যন্তরীণ সংকট এবং পরিস্থিতি স্বাভাবিক-এ অভিমত প্রকাশ করলেও পূর্ব পাকিস্তানের জন্য তিনটি জাপানি জাহাজভর্তি চাল অশান্ত পরিস্থিতির কারণে চট্টগ্রাম থেকে ফিরে এলে তা করাচিতে খালাস করতে বলা হলে জাহাজ কর্তৃপক্ষ তা অস্বীকার করে। অবশ্য পরে তা জাকার্তায় এসে খালাস করে।৭৫
অন্যান্য দেশের মতাে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের শরণার্থী সমস্যাটি প্রথমেই জাপানের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়। জাপান অত্যন্ত মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে এ বিষয়ে এগিয়ে আসে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের পর থেকে লক্ষ লক্ষ বাঙালি প্রাণভয়ে পূর্ব বাংলা থেকে পালিয়ে ভারতের বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় গ্রহণ করে।
———————————————
৭৪ . Sukumar Biswas, Japan and the Emergence of Bangladesh, Dhaka: Agamee Prakashani, 1998, p.269.
৭৫ . আবু মােহাম্মদ দেলােয়ার হােসেন, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও মুসলিম বিশ্ব, ঢাকা: সাহিত্য প্রকাশ, ২০১৪, পৃ. ৩৫।
———————————————
৪৯
শরণার্থীর সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে। আশফাক হােসেন লিখেছেন, আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার ও স্বাধীনতার প্রশ্নে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এত বিপুল মানুষ | কোথাও বাস্তুচ্যুত হয়নি। ২৫ মার্চের মধ্যরাতে বাঙালি নিধনযজ্ঞ শুরু হলে প্রাণভয়ে ও নিরাপত্তার সন্ধানে লাখ লাখ মানুষ বিভিন্ন পথে পাশের দেশ ভারতের সীমান্তবর্তী গ্রাম ও শহরগুলােতে আশ্রয় নেয়। শরণার্থীদের বড় অংশ আশ্রয় নিয়েছিল পশ্চিমবঙ্গে; বাকিরা ত্রিপুরা ও আসামে। অবস্থা এতটাই নাজুক হয়ে পড়ে যে, ১৯৭১ সালে শরণার্থীদের সংখ্যা ত্রিপুরার মােট জনসংখ্যার সমান হয়ে যায়। ১৯৭১ সালের ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত শরণার্থীর সংখ্যা জ্যামিতিক হারে বৃদ্ধি পেয়ে ৯৮ লাখ ৯৯ হাজার ৩০৫ জনে এসে দাঁড়ায়। শরণার্থীদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ ছিল হিন্দু। আগস্ট ১৯৭১ পর্যন্ত হিন্দুদের সংখ্যা ছিল ৬৯ লাখ ৭১ হাজার এবং মুসলিম ও অন্য ধর্মাবলম্বীর সংখ্যা ছিল প্রায় ছয় লাখ।৭৬ শরণার্থীদের সাহায্যের ব্যাপারে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতাে জাপান অত্যন্ত উদার হস্তে এগিয়ে আসে। শরণার্থী বিষয়ক আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী ১৯৭২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত শরণার্থীদের জন্য জাতিসংঘের মাধ্যমে জাপান সরকারের সাহায্যের পরিমাণ ছিল ৫০০০০০০ ইউএস ডলার। ওই তারিখ পর্যন্ত জাতিসংঘের মাধ্যমে বিভিন্ন দেশগুলাে মিলিয়ে সাহায্যের পরিমাণ ছিল ১৯২৯৩৫১৩৬ ইউএস ডলার।৭৭ DOMEI ও অন্যান্য সাহায্য সংস্থা মিলে জাপান থেকে পাওয়া যায় আরাে ৯৫০০০ ইউএস ডলার।৭৮
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে জাপানের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন এইসাকু সাতাে (Eisaku Sato )।৭৯ জাপানের অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে তিনি শান্তির পক্ষে ছিলেন। তাঁর রাজনৈতিক দর্শন ছিল love of freedom and devotion to peace’ ( Jiyu o ai shi, heiwa ni tessuru)| প্রধানমন্ত্রী সাতাের প্রশাসন সম্পর্কে আরাে বলা হয়ে থাকে—
‘the Sato cabinet based its actions on principles of “tolerance and harmony and pursued policies whose primary goals were to further both ‘respect for human dignity and social development. Lasting for seven years and eight months, it was the longest administration in Japanese history and left a number of important legacies. Perhaps the
——————————————
৭৬. আশফাক হােসেন, একাত্তরের শরণার্থী, দৈনিক প্রথম আলাে, ৭ ডিসেম্বর, ২০১২।
৭৭. Bangladesh Documents, Vol. II, p. 82-84.
৭৮ . ঐ, পৃ. ৮৭।
৭৯ . জাপানের ইতিহাসে এইসাকু সাতাে দীর্ঘদিন প্রধানমন্ত্রী পদে নিয়ােজিত ছিলেন। বলা যায়, তাঁর নেতৃত্বেই জাপান অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী এবং রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়।
——————————————
৫০
most notable of these was the return of Okinawa to Japan, something that had been a cherished desire of the Japanese people for a quarter century since the end of the Second World War. Building upon the legacies of the Ikeda administration, the Sato Cabinet was distinguished in domestic politics by its efforts to maintain high levels of economic growth and develop Japan into world’s second largest “economic superpower.”৮০
এ কারণে নিক্সন প্রশাসনের সাথে মৈত্রীবদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও তিনি পাকিস্তানের পক্ষাবলম্বন করেন নি। তাঁর প্রশাসন জুন মাস থেকে ভারতে আশ্রয় গ্রহণকারী শরণার্থীদের জন্য সাহায্য-সহযােগিতা শুরু করে। অবশ্য ওই সময়ে জাপানে নিযুক্ত ভারতের রাষ্ট্রদূত ভি এইচ কোয়েলহাে এবং জাপানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী Mr. Kiichi Aichi গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। জাপানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী Mr. Kiichi Aichi জাপানে নিযুক্ত ভারতের রাষ্ট্রদূত ভি এইচ কোয়েলহােকে জাপানের প্রধানমন্ত্রী এইসাকু সাতাের লেখা একটি পত্র হস্তান্তর করে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে লেখা ওই চিঠিতে পূর্ব বাংলা থেকে ভারতে আশ্রয়গ্রহণকারী লাখ লাখ উদ্বাস্তুদের সহযােগিতার কথা বলা হয়। সুকুমার বিশ্বাস লিখেছেন : “The Indian Ambassador to Japan Mr. V. H. Coelho today called on the Japanese Foreign Minister, Mr. Kiichi Aichi and handed him a letter from Mrs. Indira Gandhi addressed to Premier Eisaku Sato seeking Japanese cooperation regarding relief for millions of refugees who have poured into India from East Bengal…. The foreign office sources said Mr. Coelho explained to Mr. Aichi the pressing problem created by a large influx of refugees and the burden India had to face. Mr. Aichi is understood to have promised to give the matter the most careful consideration.৮১
জাপানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী Mr. Kiichi Aichi একজন ঝানু কূটনীতিবিদ ছিলেন।৮২ ১৯৭০ সালের ১৭ আগস্ট ভারত সফরে এসেছিলেন। ওই সফরের সময় তিনি ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শরণ সিং, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এবং রাষ্ট্রপতি ভি ভি গিরির
—————————————————————————
৮০. A History of the Liberal Democratic Party , Chapter Five Period of President Sato’s Lead, https://www.jimin.jp/english/about-ldp/history/104280.html.
৮১. Sukumar, Ibid, p.244.
৮২. কাইইচি আইচি যুদ্ধোত্তর জাপানে (post-war Japan) একজন ক্ষমতাধর রাজনীতিবিদ ছিলেন। তিনি অনেক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীপদ অলংকৃত করেছিলেন। জাপানের পররাষ্ট্র, অর্থ এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে বিভিন্ন সময়ে নিয়ােজিত ছিলেন।
—————————————————————————
৫১
সাথে দেখা করেছিলেন। সুতরাং জাপানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী Mr. Kiichi Aichi ভারতের খুব কাছের এবং পরিচিত ছিলেন। তাঁর ওই সফর সম্পর্কে দি হিন্দু পত্রিকা লিখেছিল :
“The Japanese Foreign Minister, Mr. Kiichi Aichi, who arrived here [New Delhi] last night [August 17] on a goodwill mission, had his first round of talks to-day with the External Affairs Minister, Mr. Swaran Singh, before calling on the President, Mr. V. V. Giri and the Prime Minister, Mrs. Indira Gandhi, with special messages of greetings from Emperor Hirohito and Premier, Mr. Eisaku Sato, to them. Mr. Aichi’s talks with Mrs. Gandhi lasted 45 minutes. To-day’s talks with Mr. Swaran Singh which lasted 2 12 hours were in the nature of a tour-dehorizon of South East Asia and the Pacific region I with the accent on what India and Japan could do to bring about a peaceful settlement of the Indo-China war. The two Foreign Ministers and their advisers will get down to detailed discussion on both regional and bilateral issues tomorrow before Mr. Aichi leaves for Pakistan on Thursday morning by the land route from Amritsar to Lahore. He will be the first foreign dignitary to cross the Indo-Pakistan border at the sensitive WagahAttari check-point after the 1965 conflict.”৮৩
১৯৭১ সালের জুন মাসে ভারতের তদানীন্তন শিক্ষামন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর অত্যন্ত বিশ্বস্ত সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায় জাপান সফর করেন। এই সময়ে জাপানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন তাকাও ফুদুকা।৮৪ অভিজ্ঞ পররাষ্ট্রমন্ত্রী তাকাও ফুদুকাকে জাপানের রাজনীতিতে এডওয়ার্ড হিথের সাথে তুলনা করা হতাে। তিনিও বাংলাদেশের বিষয়ে অত্যন্ত নমনীয় ছিলেন। সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায় প্রথমে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ফুদুকা এবং পরে প্রধানমন্ত্রী এইসাকু সাতাে-এর সাথে দেখা করেন। বাংলাদেশকে সর্বাত্মক সহযােগিতার জন্য এই বৈঠক অত্যন্ত ফলপ্রসূ হয়েছিল বলে সিদ্ধার্থ শঙ্কর সংবাদপত্রকে জানিয়েছিলেন।৮৫
জাপান সরকার শরণার্থীদের অবস্থা স্বচক্ষে দেখা এবং পরিস্থিতি বােঝার জন্য জাপান পার্লামেন্ট (ডায়েট) এর কয়েকজন বিরােধী দলীয় সদস্যকে ভারতে প্রেরণ। করেন। ১৯৭১ সালের জুলাই মাসে কে নিশিমুরার নেতৃত্বে ভারতে আসেন। তিনি
———————————————-
৮৩. The Hindu, 19 August 1970; Quoted from thehindu.com
৮৪ . তাকাও ফুকেদা জাপানের লিবারেল ডেমােক্রেটিক পার্টির সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তিনি জাপানের অর্থমন্ত্রী এবং স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবার সময় জাপানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন।
৮৫. Sukumar Biswas, Ibid, p.245.
———————————————-
৫২
বেশ কয়েকটি রিফিউজি ক্যাম্প পরিদর্শন করেন এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাথে দেখা করেন। জাপানিজ সােসালিস্ট নেতা কে নিশিমুরা পূর্ব পাকিস্তানে সংঘটিত সেনাবাহিনীর পৈশাচিক আক্রমণের তীব্র নিন্দা করেন। এজন্য তিনি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে দায়ী করেন। তিনি বেশ কয়টি রিফিউজি ক্যাম্প পরিদর্শন করেন। মানবিকতার বিপর্যয় এড়ানাের জন্য তিনি জাতিসংঘের হস্তক্ষেপ কামনা করেন।
একইভাবে ভারতের বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ যেমন জয়প্রকাশ নারায়ণ জাপান সফর করেন এবং তাঁরা জাপান সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী, এবং প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সাথে বৈঠক করেন। অপরপক্ষে জাপানও তাঁদের প্রতিনিধিদল ভারতে প্রেরণ করেন। তাঁরা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং শরণার্থী বিষয়ে ভারতের সরকার, রাজনৈতিক দল এবং প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সাথে সাক্ষাৎ করেন। এ সময় তারা বেশ কিছু শরণার্থী শিবির পরিদর্শন করেন। ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে জাপান সংসদের লিবারেল ডেমােক্রেটিক পার্টির চার প্রতিনিধিদলের সদস্য ভারতে আসেন। ইয়েশিও সাকুরাচি৮৬ এই দলের নেতৃত্ব দেন। তারা ভারত সরকারের গুরুত্বপূর্ণ শীর্ষ পর্যায়ের সাথে বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের বিষয়ে আলােচনা করেন। “In September A four member parliamentary delegation of the liberal democratic party, led by Yoshio Sakurauchi visited India at the invitation of Indian Government for æ a better understanding of the situation resulting out of the East Pakistan problem”. ৮৭
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি জাপানিদের আগ্রহের কারণ ছিল বাঙালিদের প্রতি পাকিস্তানিদের বৈষম্য ও নির্যাতন। জাপানের প্রবীণ রাজনীতিবিদ ও প্রাক্তন মন্ত্রী হায়াকাওয়ার লেখাতে সুস্পষ্টভাবে তা চলে এসেছে। হায়াকাওয়া যেমনটি বলেছেন, “ভারতকে মাঝখানে রেখে কয়েক হাজার কিলােমিটারের ব্যবধানে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের অবস্থান। ধর্ম এক হলেও জাতি, ভাষা ও আচার-আচরণ সবই ভিন্ন। আমার মনে সন্দেহের উদ্রেক হয়েছিল যে এমন দেশ গড়া আদৌ সম্ভব কি না। পশ্চিম পাকিস্তানের শাসনের অধীনে বাঙালিদের তাদের নিজের ভাষায় কথা বলারও
———————————————-
৮৬. ইয়েশিও সাকুরাউচি লিবারেল ডেমােক্রেটিক পার্টির একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন। জাপানের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়ােজিত ছাড়াও হাউস অব রিপ্রেজেনটেটিভ-এর স্পীকার পদে আসীন ছিলেন। বাংলাদেশের সমর্থনে তিনি অনেক ভূমিকা পালন করেছেন।
৮৭. Sukumar Biswas, Ibid, p.245.
———————————————-
৫৩
অনুমতি দেওয়া হয়নি। তারা কার্যত ঔপনিবেশিক শাসনের অধীনে ছিলেন। এসব জানতে পেরে আমার মনের মধ্যে বাঙালিদের স্বাধীনতাসংগ্রামের প্রতি সহানুভূতি জেগে ওঠে।৮৮
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সমর্থন এবং জাপানের স্বীকৃতিদানের জন্য হায়াকাওয়া অন্য সাংসদদের নিয়ে একযােগে কাজ করেন। তিনি নিজেই বলেছেন, ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে আমি আমার অন্তর থেকে অভিনন্দন জানাই এবং অন্য কয়েকজন সাংসদের সঙ্গে মিলে বাংলাদেশকে অবিলম্বে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য জাপান সরকারের প্রতি আমি আহ্বান জানাতে থাকি। সরকারও এ বিষয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয়। এবং শিল্পোন্নত দেশগুলাের মধ্যে সবার আগেই জাপান নবগঠিত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়।৮৯
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধচলাকালীন সময়ে ভারত শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়ে মানবিকতার এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল। পরিসংখ্যান অনুযায়ী মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রতিদিন ২০ হাজার হতে ৪৫ হাজার অসহায় নিরস্ত্র বাঙালি ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করেছিল। সব মিলিয়ে প্রায় এক কোটির মত লােক ভারতে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নিয়েছিল। ভারতের পাশাপাশি বিশ্বের বিভিন্ন দেশ হতে এসব শরণার্থীদের জন্য সাহায্য সহযােগিতা এসেছে। জাপান বেঙ্গল ফ্রেন্ডশিপ সােসাইটি শরণার্থীদের দুঃখ দুর্দশা ও কিভাবে তাদের সহযােগিতা করা যেতে পারে এজন্য তিন সদস্যের একটি টিম প্রেরণ করে। টিমের সদস্যবৃন্দ হলেন— Setsurei Tsurushima, Ryoichi Tomizuka, Takamasa Suzuki। তারা যে সকল স্থান পরিদর্শন করে সেগুলাে। হলাে বাংলাদেশ মিশন কলকাতা, সল্টলেক শরণার্থী শিবির , দমদম শরণার্থী শিবির এবং বনগা শরণার্থী শিবির।
ইতিমধ্যে পূর্ব বাংলা থেকে ভারতে যাওয়া শরণার্থীদের দুঃখ-দুর্দশার চিত্র সমগ্র। পৃথিবীতে আলােচিত হয়। নানা দেশে শরণার্থীদের জন্য ত্রাণ সংগ্রহের কার্যক্রম হাতে নেয়া হয়। স্বেচ্ছাসেবক সংগঠন, ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান সকলেই এগিয়ে আসেন। ১৯৭১ সালের আগস্ট মাসে আন্তর্জাতিকভাবে আমেরিকাতে দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ আয়ােজন করা হয়। উইকিপিডিয়ায় বলা হয়েছে, ‘দ্য কনসার্ট ফর। বাংলাদেশ (বা বাঙলা দেশ, দেশের পূর্ব বানান অনুসারে) ছিল ১ আগস্ট ১৯৭১ সালের রবিবার ২.৩০ এবং ৮.০০ অপরাহ্নে নিউ ইয়র্ক সিটির ম্যাডিসন স্কোয়ার গার্ডেনে প্রায় ৪০,০০০ দর্শকের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত, সাবেক বিটলস
—————————————–
৮৮. তাকাশি হায়াকাওয়া, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৪।
৮৯. ঐ, পৃ. ১৪।
—————————————–
৫৪
সংগীতদলের লিড গিটার বাদক জর্জ হ্যারিসন এবং ভারতীয় সেতারবাদক রবিশঙ্কর কর্তৃক সংগঠিত দুটি বেনিফিট কনসার্ট। এই প্রদর্শনী পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমানে বাংলাদেশ) শরণার্থীদের জন্য আন্তর্জাতিক সচেতনতা এবং তহবিল ত্রাণ প্রচেষ্টা বাড়াতে, মূলত বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ-সম্পর্কিত বাংলাদেশের নৃশংসতার ফলে সাহায্যের উদ্দেশ্যে আয়ােজন করা হয়েছিল। এই কনসার্টের একটি শ্রেষ্ঠ বিক্রিত লাইভ অ্যালবাম, একটি বক্স-থ্রি রেকর্ড সেট এবং অ্যাপল ফিল্মসের কনসার্টের তথ্যচিত্র নিয়ে ১৯৭২ সালের বসন্তে চলচ্চিত্রাকারে প্রকাশ করা হয়। এই অনুষ্ঠানে বিশ্ববিখ্যাত সংগীতশিল্পীদের এক বিশাল দল অংশ নিয়েছিলেন, যাদের মধ্যে বব ডিলান, এরিক ক্ল্যাপটন, জর্জ হ্যারিসন, বিলি প্রিস্টন, লিয়ন রাসেল, ব্যাড ফিঙ্গার এবং রিঙ্গো রকস্টার ছিলেন উল্লেখযােগ্য। এই অনুষ্ঠানের গানের একটি সংকলন কিছুদিন পরেই ১৯৭১ সালে বের হয় এবং ১৯৭২ সালে এই অনুষ্ঠানের চলচ্চিত্রও বের হয়। …কনসার্ট ও অন্যান্য অনুষঙ্গ হতে প্রাপ্ত অর্থ সাহায্যের পরিমাণ ছিলাে প্রায় ২,৪৩,৪১৮.৫১ মার্কিন ডলার, যা ইউনিসেফের মাধ্যমে শরণার্থীদের সাহায্যার্থে ব্যয়ীত হয়।৯০ এই কনসার্টে জর্জ হ্যারিসনের গাওয়া গানটি সমগ্র বিশ্বে আলােড়ন সৃষ্টি করে।
একটি স্বাধীন দেশের জনগণের জন্য চাওয়া আবেগময়ী গানটি জাপানের রাস্তাতেও বাজানাে হয়। জাপানেও শরণার্থী শিবিরের শিশুদের জন্য ফান্ড কালেকশনের জন্য জাপান বেঙ্গল ফ্রেন্ডশিপ সােসাইটি ক্রস ক্যানট্রি প্রােগ্রামের আয়ােজন করে। শিনজুকু স্টেশন থেকে এই প্রােগ্রামের যাত্রা শুরু হয় এতে অংশ নেন Tsuyoshi Nara, Takaaki Suzuki, Kenji Nanasawa, Tatsuko Ikeda, Yoshiaki Yamada, Hajime Takada, Noriko Konishi প্রমুখ নেত্রীবৃন্দ। জর্জ হ্যারিসনের গাওয়া জনপ্রিয় বাংলাদেশ গানটি জাপানের রাস্তায় বাজানাে হয়।
এভাবে এই সংগঠনের পক্ষ থেকে জাপানের রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে সাধারণ মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন শরণার্থীদের সাহায্য করার জন্য। সংগঠনের কর্মীরা বিভিন্ন স্কুলকলেজ সহ প্রতিষ্ঠানে ঘুরে অর্থ সংগ্রহ করেছেন। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে এই সংগঠন বাংলাদেশের শরণার্থীদের সাহায্যের জন্য জাপান রেড ক্রস সােসাইটিকে ১.১৩ মিলিয়ন ইয়েন দান করে।
জাপান রেডক্রস সােসাইটি বাঙালি শরণার্থীদের সাহায্যে এগিয়ে এসেছিল। ১৯৭১ সালের এপ্রিল থেকে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত ভারতে আশ্রিত বাঙালি শরণার্থীদের জন্য ১২৭ মিলিয়ন ইয়েন পাঠিয়েছিল।
—————————————
৯০ https://bn.wikipedia.org/wiki//দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ
—————————————
৫৫
বাংলাদেশের বিষয়টি আন্তর্জাতিকভাবে তুলে ধরার জন্য ১৯৭১ সালের ১৮-২০। সেপ্টেম্বর তারিখে নতুন দিল্লিতে জয়প্রকাশ নারায়ণ আন্তর্জাতিক সম্মেলনের আয়ােজন করেছিলেন। পৃথিবীর চব্বিশটি দেশ হতে দেড় শ জনের মতাে ডেলিগেট উপস্থিত ছিলেন। সম্মেলনে পাকিস্তান দূতাবাসের বিরােধিতা সত্ত্বেও জাপান বেঙল অ্যাসোসিয়শনের পক্ষ থেকে Tsuyoshi Nara অংশ নেন। সম্মেলনে Tsuyoshi Nara বক্তব্য দিতে গিয়ে বলেন:
Mr. Chairman, Ladies and Gentlemen :
This is my second visit to this great country. I have this time two definite purposes; one is of course to attend this Conference in order to apprise myself of the present situation. It is useful to listen to the opinions of the people of other countries on the solution of the refugee problem and the restoration of peaceful conditions in the East Bengal region which otherwise may lead to a conflict not only between India and Pakistan but also in the Asian world supported by other big powers.
The other purpose of my visit is to inspect the camps and visit the border to witness as a whole the incoming refugees from East Pakistan and hear what the evacuees, the Bangla Mission and the Indian people have to say about this problem.
All the experience that I have obtained during my short stay in India this time may provide sufficient data which enables me and the JapanBengal Friendship Association to take what further action is needed to help the affected people. In Japan I have heard a lot of pathetic stories about the people of Bangladesh. It is most cowardly and uncivilized for anyone or any nation to use military measures against unarmed civilians just because they have a different opinion or demand human rights in a democratic way. But at the same time I do hope and believe that this Conference is not meant to create hatred among the people of the world against the people of West Pakistan. It should remind the leaders of West Pakistan of the need to respect human rights and to arouse the world opinion to take practical measures for helping the suffering people of Bangladesh so that real prosperity and permanent peace is established very soon in Asia which had been perpetually suffering from exploitation and conflict. It is very significant that this Conference is sponsored by the Gandhi Peace Foundation. What I did first when I come here was to visit Rajghat and pay my homage to
৫৬
Gandhi. Recognition of Bangladesh must also be studied from this viewpoint, of human rights and dignity. I think I have already succeeded in focusing Japan’s attention on this Conference because the Pakistan Embassy in Tokyo has protested to the Japanese government regarding my coming here.৯১
তিনি বাংলাদেশ ইস্যুকে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয় হিসেবে না দেখে বিশ্ব শান্তির জন্য হুমকিস্বরূপ চিহ্নিত করেন। সম্মেলন শেষে দিল্লি থেকে জাপান ফেরার পথে তিনি সল্ট লেক শরণার্থী শিবির পরিদর্শন করেন। প্রফেসর Tsuyoshi Nara জাপানে ফিরে গিয়ে শরণার্থীদের জন্য ফান্ড সংগ্রহ এবং মুক্তিযােদ্ধাদের জন্য কিছু হালকা সরঞ্জামাদি প্রেরণ করেন। বাংলাদেশের মুক্তিযােদ্ধাদের জন্য তাঁর এই অবদান অবিস্মরণীয়।
এভাবে জাপান সরকার, জাপানি সংবাদপত্র, বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিবিদসহ বেসরকারি পর্যায়ে প্রায় সর্বস্তরের জাপানি জনগণ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।
জাপানি বুদ্ধিজীবীরা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে একটি সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। এক্ষেত্রে যাদের নাম বিশেষভাবে স্মরণীয় তাঁরা হলেন Professor Tsuyoshi Nara, Tadamasa Fukiura, Professor Minoru Kiriyu, Takamasa Suzuki, Midori Yamanaka, Takashi Oyamada, Kinchi Takenaka, Lt. Gen. Fujiwara, Takashi Hayakawa প্রমুখ। জাপানের প্রথিতযশা এই সকল বুদ্ধিজীবীগণ বিভিন্ন বিবৃতি বক্তৃতা ও সম্মেলনের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন। তাঁরা পাকিস্তানিদের গণহত্যা, রিফিউজি সমস্যা এবং স্বাধীন বাংলাদেশকে সমর্থন দানের জন্য আন্তর্জাতিক মহলের ওপর চাপ সৃষ্টি করেছিল।
জাপানি বুদ্ধিজীবী মহলে এর আগেই বাংলাদেশের বিষয়টি গণমাধ্যমের সহায়তায়। দৃষ্টিগােচর হয়। বিশেষ করে ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনের প্রাক্কালে উপকূলে ঘটে যাওয়া প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ের বিষয়টি জাপানিদের দৃষ্টি আকর্ষন করে। জাপানও যেহেতু দুর্যোগ কবলিত দেশ। ভূমিকম্প ঘূর্ণিঝড় তারা প্রতিনিয়তই দেখে থাকে। ফলে ঘূর্ণিঝড়ে সাহায্যের কারণে বাংলাদেশ সম্পর্কে জাপানিদের আগ্রহ বাড়তে থাকে। এই অভিজ্ঞতার স্মৃতি লিখেছেন জাপান প্রবাসী সাংবাদিক জালাল
————————————
৯১. বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ: দলিলপত্র, ত্রয়ােদশ খণ্ড, পৃ. ৬৭৪।
————————————
৫৭
আহমেদ। তাঁকে জাপানি এম.পি. হায়াকাওয়া বাঙালিদের ঘূর্ণিঝড়ে সাহায্যের জন্য ডেকে পাঠান।৯২ তিনি লিখেছেন, ‘Mr. Tachibana was waiting at the lobby of Hotel Okura and he took me upstairs to a suite where Mr. Takashi Hayakawa M.P. was waiting to meet me…. In my first meeting with Mr. Hayakawa on 22nd November 1970. I found him fatherly, very gentle and cordial. ..I explained to him why East Pakistan is geographically prone to cyclone, which originates in the Indian ocean similar to that of typhoon which originates in the Pacific ocean and hits Japan every year.৯৩
মূলত ১৯৭০ সালের পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনকালীন সময়ে ঘূর্ণিঝড়ের ঘটনার সাথে পূর্ব পাকিস্তানের বৈষম্য-দুর্দশার চিত্র ফুটে উঠে। জাপানি জনগণ বুঝতে পারে বাঙালিদের প্রতি অন্যায় এবং অবিচার চলছে। হায়াকাওয়া তিনি নিজেও এই ঘটনার মাধ্যমেই বাংলাদেশকে জানতে পারেন। হায়াকাওয়া তাঁর স্মৃতিতে লিখেছেন, “১৯৭০ সালের নভেম্বর মাস। মানব ইতিহাসে সবচেয়ে প্রলয়ংকর বলে কথিত এক ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ওপর। এতে লাখ লাখ মানুষের প্রাণহানি ঘটে। এই খবর শুনে আমি মানবপ্রেমের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে টোকিওর রাস্তায় দাঁড়িয়ে চাঁদা সংগ্রহ অভিযানে শরিক হলাম। … প্রায় একই সময় আমি জানতে পারলাম, সেই পূর্ব পাকিস্তানে জাতিগত মুক্তি আন্দোলন তখন তুঙ্গে উঠেছে। গত কয়েক শতাব্দী ধরে দক্ষিণ এশিয়ায় চলে আসা মুক্তি-আন্দোলনের শেষ পর্যায় এটি। ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের জন্য সাহায্যের অর্থ সংগ্রহের মাধ্যমে বাংলার ভূমি ও সেখানকার মানুষ সম্বন্ধে আমার জানার আগ্রহ যতই বেড়ে যেতে থাকে, শাসক পশ্চিম পাকিস্তান এবং পরাধীন পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যে বিরােধ ততই যেন তীব্রতর আকার ধারণ করে।”৯৪
বস্তুত এই সময় থেকেই জাপানি বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিবিদ এবং বাংলাভাষা চেনাজানা জাপানিদের সাথে জাপানপ্রবাসী বাঙালিদের একটা গভীর যােগাযােগ গড়ে ওঠে। বিশেষ করে জাপান প্রবাসী বাঙালি এস্কান্দর আহমেদ চৌধুরী এবং এস এ জালাল এ ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ থেকে
————————————
৯২. হায়াকাওয়া বাংলাদেশের ঘূর্ণিঝড়ে আর্থিক সহযােগিতার জন্য তাঁর রাজনৈতিক সহকর্মীদের নিয়ে পরদিনই টোকিওয়ের কাছে শিবুওয়া রেলওয়ে স্টেশনে ফান্ড সংগ্রহের অভিযানে নেমে পড়েন।
৯৩. Sheikh Ahmed Jalal, Japan’s Contribution in the Independence of Bangladesh, Dhaka: Hakkani Publishers, 2002,p. 5.
৯৪. হায়াকাওয়া প্রাগুক্ত, পৃ. ১৩।
————————————
৫৮
জাপানের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত প্রায় ত্রিশ জনের মতাে ছাত্র অধ্যয়ন করত।৯৫ এরাও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
… by the sympathetic local activists and intellectuals, in case of japan, the public opinion mobilization campaign was unique from the fact that there were only about 30 students and trainees from East Pakistan throught Japan.৯৬
এদের সহায়তায় জাপানি বুদ্ধিজীবীগণ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় ভূমিকা পালনের জন্য বেশ কয়েকটি সভা সমিতি প্রতিষ্ঠা করেছিল। জাপান বেঙ্গল ফ্রেন্ডশিপ অ্যাসােসিয়েশন, জাপান বাংলাদেশ সলিডিটারি ফন্ট, বাংলাদেশ অ্যাসােসিয়েশন উল্লেখযােগ্য।
১৯৭১ সালের ১১ এপ্রিল জাপান বেঙ্গল ফ্রেন্ডশিপ অ্যাসােসিয়েশন গঠিত হয়। অপারেশন সার্চ লাইট এবং বাঙালিদের ওপর পাকিস্তানিদের অত্যাচার-নিপীড়নের প্রতিবাদে এবং আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না করা এবং বাংলাদেশকে। সমর্থন করার জন্য প্রফেসর নারার উদ্যোগে এই অ্যাসােসিয়েশন গঠিত হয়। জাপান বেঙ্গল ফ্রেন্ডশিপ অ্যাসােসিয়েশন গঠন করার সময় আরাে যারা সহযােগিতা করেছিলেন ‘Mr. Kinichi Takenaka, Yasuaki Nara, Heiji Nakamura, Kenji Nanasawa, Fujimura, Numasawa, Masao Naito, Shinkichi Taniguchi, Miss Junko Asano এবং আরাে কিছু বাঙালি ছাত্র উপস্থিত ছিল। বাঙালিদের মধ্যে এস এ জালাল এবং এস্কান্দর আহমেদ চৌধুরী উপস্থিত ছিলেন।৯৭
প্রফেসর নারা ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাস থেকে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত জাপান বেঙ্গল ফ্রেন্ডশিপ অ্যাসােসিয়েশনের কার্যক্রম নিয়ে দিনপঞ্জিকা লিখে রাখতেন। জাপানি ভাষায় লেখা ওই দিনপঞ্জিকা সম্পর্কে সুকুমার বিশ্বাস মন্তব্য করেছেন, “Prof. Tsuyoshi Nara used to maintain a diary in 1971. That diary is indeed an invaluable documentary evidence of our liberation movement as it provides details of the activities in Bangladesh from April to December 1971 and organizational activities of ‘Japan Bengal Friendship Association.৯৮
—————————————————–
৯৫ . Sheikh_Ahmed_Jalal, Japan’s Contribution in the Independence of Bangladesh, Dhaka: Hakkani Publishers, 2002, p.73
৯৬. ঐ।
৯৭. Sheikh Ahmed Jalal, Japan’s Contribution in the Independence of Bangladesh, Dhaka: Hakkani Publishers, 2002, p. 145.
৯৮. Sukumar Biswas, Ibid, p. 220.
—————————————————–
৫৯
জাপান বেঙ্গল ফ্রেন্ডশিপ অ্যাসােসিয়েশনের কার্যালয়ের ঠিকানা ছিল : Minami Nagasaki 5-4-1-509, Toshima-ku, Tokyo. জাপান বেঙল ফ্রেন্ডশীপ অ্যাসােসিয়েশনের বার্ষিক সদস্য ফি ৫০০ ইয়েন দিয়ে যেকোনাে দেশের নাগরিক (Anyone of any nationality) এর সদস্য হতে পারতেন। কিন্তু শর্ত ছিল তাঁকে অবশ্যই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের চেতনায় বিশ্বাসী এবং পূর্ব পাকিস্তানে সংঘটিত পাকিস্তানি সামরিক জান্তা বিরােধী মনােভাবাপন্ন হতে হবে।
১৯৭১ সালের ২০ মে টোকিওতে জাপান বেঙ্গল ফ্রেন্ডশিপ অ্যাসােসিয়েশন। বাংলাদেশ সম্পর্কে একটি গণ সেমিনারের আয়ােজন করে। সেমিনারে দুইজন বক্তা প্রবন্ধ পাঠ করেন। ইয়াসুয়াকি নারার সভাপতিত্বে সেমিনারে প্রথম প্রবন্ধ পাঠ করেন হেইজি নাকামুরা। তাঁর প্রবন্ধের বিষয়বস্তু ছিল Historical Background of East Pakistan Problem। দ্বিতীয় প্রবন্ধটি পাঠ করেন ইউজু সাকুরাই। তাঁর প্রবন্ধের বিষয়বস্তু ছিল The Present Conditions of East Pakistan।
১৯৭১ সালের ১৮ জুন তারিখে জাপান বেঙ্গল ফ্রেন্ডশিপ এসােসিয়েশন গান্ধী পিস লীগ, জাপান ইন্ডিয়া সােসাইটি, জাপান ইন্ডিয়া কালচারাল সােসাইটি, সর্বোদয়া ইন্দো জাপানিজ অ্যাসােসিয়েশন সম্মিলিতভাবে একটি গণ বক্তৃতার আয়ােজন করে। জয়প্রকাশ নারায়ণ বক্তৃতা দেন। বক্তৃতায় জয়প্রকাশ নারায়ণ পূর্ব পাকিস্তান সমস্যায় উপস্থিত সকলকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।
১৯৭১ সালের ২৯ জুন তারিখে পূর্ব পাকিস্তানের সমস্যা নিয়ে জাপান বেঙ্গল ফ্রেন্ডশিপ অ্যাসােসিয়েশন টোকিও ইউনিভার্সিটি অব টেকনােলােজিতে বক্তৃতার আয়ােজন করে। সংগঠনের পক্ষ থেকে প্রফেসর নারা বক্তৃতা করেন।
১৯৭১ সালের আগস্ট মাসে কানসাই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক Professor Setsurei Tsurushima বাংলাদেশ সলিডিটারফ্রন্ট প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীকালে টোকিও থেকে এর সাংগঠনিক কার্যক্রম শুরু হয়। এতে সহযােগিতা করেন Momoyama Gakuin University বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক Hajime Katsube । সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক পদে দায়িত্ব পালন করেন কেন আরিমিৎসু (Ken Arimitsu)। এ ছাড়াও সদস্য হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন Hideso Takano। সংগঠনটি বাংলাদেশ নিউজ নামে জাপানি ভাষায় একটি বুলেটিন প্রকাশ করে। ১৯৭১ সালের ১৫ নভেম্বর উদ্বোধনী সংখ্যা প্রকাশিত হয় এবং ১৯৭২
———————————–
* Sukumar Biswas, Ibid, p. 212.
———————————–
৬০
সালের ১০ ফেব্রুয়ারি তারিখে দ্বিতীয় সংখ্যা প্রকাশিত হয়। উদ্বোধনী সংখ্যাটি জাপানি বুদ্ধিজীবী মহলে বেশ আলােড়ন সৃষ্টি করেছিল। ওই সংখ্যায় যারা লিখেছিলেন তাঁরা হলেন: অধ্যাপক Tsurushima, Minoru Kiryu এবং জালাল আহমদ। সংখ্যাটিতে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের বিভিন্ন ক্ষেত্র নিয়ে নিবন্ধ প্রকাশ করা হয়।
জাপানের বিখ্যাত সব বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকবৃন্দ জাপানে সংগঠিত নানান অ্যাসােসিয়েশনের মাধ্যমে বাংলাদেশ সম্বন্ধে অত্যন্ত ইতিবাচক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। বলা যায় শিক্ষাঙ্গনে জাপানি পণ্ডিত ব্যক্তির মধ্যে পাকিস্তানের সমর্থক পাওয়া দুষ্কর ছিল। এসব পণ্ডিতগণ বিভিন্ন বিবৃতি বক্তৃতা ও সম্মেলনের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে দাঁড়িয়ে ছিলেন।
তাঁদের চিন্তা ও ধ্যান জ্ঞান হয়ে ওঠে বাংলাদেশের স্বাধীনতা। ১৯৭১ সালের নয় মাসব্যাপী মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে টোকিওসহ জাপানের গুরুত্বপূর্ণ শহরে অনেকেরই বাসা এবং অফিস হয়ে ওঠে বাংলাদেশ সহায়ক কার্যালয়।
বাংলাদেশ অ্যাসােসিয়েশন প্রতিষ্ঠায় প্রায় ৫০ জনের মতাে জাপান প্রবাসী বাঙালি এগিয়ে এসেছিল। আসাহি ইভিনিং নিউজ পত্রিকার ১৯৭১ সালের ২৯ মার্চ লিখেছিলেন: “The Bangla Desh ( Bengali Nation) Association of Japan, consisting of about 50 Pakistani residents in Japan – mostly students from East Pakistan.” ৯৯
বাংলাদেশ এসােসিয়েশন প্রতিষ্ঠায় যারা এগিয়ে এসেছিলেন তাঁরা হলেন:
জালাল আহমেদ
এস্কান্দর আহমদ চৌধুরী
এম শফিউল আলম
আবদুর রহমান
এ টি আবু আহমেদ
সৈয়দ মকবুল মর্তুজা নূরুল ইসলাম
মাে. আমিনুল ইসলাম মমতাজ ভূঁইয়া
ওয়াজির আহমেদ শেখ
এস ইফতেখার আহমেদ
———————————-
৯০ The Asahi Evening News, 29 March 1971; Quoted form Sheikh Ahmed Jalal, Japan’s contribution in the Independence of Bangladesh, Dhaka: Hakkani Publishers, 2002, p.69
———————————-
৬১
এদের মধ্যে এস্কান্দার আহমেদ চৌধুরীর ভূমিকা ছিল উল্লেখযােগ্য। জালাল আহমেদ মন্তব্য করেছেন, ‘… Mr. Eskander Ahmed Chowdhury, who took one leadership role in our public opinion mobilization campaign in Japan during the War of Liberation.১০০
মুক্তিযুদ্ধের নয়মাস জাপানে জনমত সৃষ্টি, গণমাধ্যমে তথ্য সরবরাহ, মুজিবনগর সরকারের সঙ্গে যােগাযােগ রক্ষা করে মুক্তিযুদ্ধকে সাফল্যের দিকে নিয়ে যেতে বাংলাদেশ অ্যাসােসিয়েশন অসামান্য অবদান রাখে।
জাপানের সংবাদমাধ্যম ছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পরম বন্ধু। জাপানি সংবাদপত্র যেমন জাপান টাইমস, মেইনিচি ডেইলি, সানডে মেইনিচি, ডেইলি ইয়েমুরি, আসাহি শিম্বুন, আসাহি ইভিনিং নিউজ ইত্যাদি সংবাদপত্র বাংলাদেশের ঘটনাবলি সম্পর্কে বিস্তারিত সংবাদ পরিবেশন করত। The Asahi Shimbun and The Asahi Evening News পত্রিকার সাংবাদিক Tetsuo Kawamura ব্যাংকক থেকে ঢাকার ওপর নিউজ ও প্রতিবেদন পাঠাতেন। সানডে মেইনিচিতে Minoru Kiryu প্রতিবেদন লিখতেন।
১৯৭১ সালের মার্চের ঘটনাবলি ছিল খুবই উত্তেজনাপূর্ণ। পাকিস্তান অখন্ড থাকবে কি না এ নিয়ে সকল মহলের সংশয় ছিল। জাপানের বহুল প্রচারিত দৈনিক ইয়েমুরি শিম্বুন ঢাকার পরিস্থিতি জানার জন্য সংবাদদাতা হিসেবে ওসামু তাকেদাকে ঢাকায় পাঠানাে হয়। অপারেশন সার্চলাইটের পর পাকিস্তানি সৈন্যদের হাতে বিদেশি নাগরিকগণও হেনস্তা হয়েছেন। সাংবাদিক ওসামু তাকেদাকে দিল্লি যাবার পথে ঢাকা এয়ারপাের্টে কয়েকবার সার্চ করা হয়েছে। পাকিস্তানি সৈনিকদের স্পর্ধিত এই বিষয়টি নিয়ে ওসামু তাকেদা জাপানি পত্রিকা ডেইলি ইয়েমুরিতে লিখেছেন। ‘before leaving Dacca airport, I was searched twice and memos and film, exposed or not, were seized.’
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বাঙালির ওপর হামলা চালানাের পর জাপানের পত্রিকাগুলাে পাকিস্তান সঙ্কট নিয়ে মন্তব্য করে। ১৯৭১ সালের ডেইলি ইয়েমুরি ২৯ মার্চের সংখ্যার হেডলাইন ছিল: ‘Unarmed citizens shot in cold blood in blazing Dacca.’ ভারতের নিউ দিল্লি থেকে ডেইলি ইয়েমুরির সংবাদদাতা ওসামু তাকেদা (Osamu Takeda) নিউজটি পাঠিয়েছিলেন। অপারেশন সার্চ লাইটের বিবরণ তিনি ওই সংখ্যার প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছেন।
———————————
১০০. Sheikh Ahmed Jalal, Japan’s Contribution in the Independence of Bangladesh, Dhaka: Hakkani Publishers, 2002, p. 32.
———————————
৬২
সাংবাদিক ওসামু তাকেদা ২৫ মার্চ [১৯৭১ তারিখে ঢাকায় ইন্টারকন্টিনেন্টাল হােটেলে অবস্থান করছিলেন। তাঁর ভাষ্য অনুযায়ী অপারেশন সার্চ লাইটের বিবরণ:
“… The first report on the armed oppression came at about 11 pm when West Pakistan army troopers stationed at the Intercontinental Hotel pulled down the flag of Bangla Desh (Bengali) that symbolizes independent East Pakistan and burned it. An uneasy tension already prevailed outside a hotel where I was staying as I went to the telegraph office. But I was not able to send any dispatch due to army censorship which lasted until Saturday morning when I was ordered to leave Dacca with other foreign newsmen. Near midnight Thursday there was a temporary silence which was broken by three rifles shots. This started a full scale exchange of fire. West Pakistan troopers used automatic weapons, tank cannons and even rockets. As I ran up to the roof of my nine-story hotel, I saw streaks of tracers bullets. The lights at the central Dacca Station were soon extinguished. Then tongues of flames lighted the night skies as fires started by street fighting started at numerous places in the city of 411,000. Gunfire became more intense and raged all night. Before daybreak, Dacca broadcasting station had been occupied by the West Pakistan troops. Several West Pakistan soldiers opened fire from the roof of the broadcasting station, which killed at least three laborers at a construction site next to the hotel where I was virtually confined. They apparently had not been able to move from the construction site due to the street fighting the previous night. As I went out to the veranda from my room on the ninth floor to take a better look at this brutal killing, a bullet pierced a large windowpane nearby and I knew snipers had been deployed. The bodies were left as they were during the whole day. Lines of four or five trucks each carring about 10 West Pakistan soldiers, slowly patrolled the streets sporadically firing warning shots.”*
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক স্বাধীনতার ঘােষণার কথাও পত্রিকাতে লেখা হয়েছিল। দৈনিক ইয়েমুরিতে লেখা হয়েছিল: “New Delhi, Mar 28 (By Yomiuri Correspondent Osamu Takeda) – Heavy fighting, including the cold blooded shooting of unarmed citizens, erupted in Dacca last Thursday night within two hours of Sheikh Mujibur Rahman’s call for a fight for East Pakistan’s independence.”**
———————————-
* The daily. Yomiuri, 29 March, 1971; Quoted from, Sheikh Ahmed Jalal, Ibid, P. 56.
**ঐ
———————————-
৬৩
অপারেশন সার্চ লাইটের পর জাপানিরা খুবই উদ্বিগ্ন ছিলেন। শেখ আহমেদ জালাল এ প্রসঙ্গে লিখেছিলেন: ‘on March 26, 1971 the morning newspapers of Japan missed the news of what happened in the midnight of March 25 [1971] in Dhaka and in other cities of East Pakistan mainly because of the time difference and Pakistans successful act of deceiving. However, NHK and commercial stations, from the morning of 26 March started broadcasting the news of eruption of æcivil war” in East Pakistan quoting all India radio and Reuter. At noon, the television stations also gave sketchy pictures of the Pakistan army’s æcrackdown” on the civilian population, mainly of Dhaka city. These radio and television stations broadcast the news that the Pakistani military as ordered by Pakistan president Yahya khan had started “action” and Sheikh Mujibur Rahman on 25th night proclaimed east Pakistan, the sovereign independent people’s republic of Bangla Desh.১০১
আসাহি শিম্বুন পত্রিকার বরাত দিয়ে আসাহি ইভিনিং নিউজ পত্রিকায় এক সংবাদে জানা যায় ঢাকায় প্রায় ৪১ জনের মতাে জাপানি তখনাে অবস্থান করছিলেন। Forty one Japanese Still in E. Pakistan শীর্ষক শিরােনামে পত্রিকাতে লেখা হয়: “According to a Japanese Consulate-General check Japanese residents in the troubled region numbered about 45 as of Friday. Of them, four pressmen were later forced to leave the country bringing the number down to 41, including a woman. Most of them are officials of the consulate-General’s office and trading firm employes.”***
আসাহি এবং মেইনিচি শিম্বুন পত্রিকায় পাকিস্তান সরকার এবং নীতির কঠোর সমালােচনা করা হয়। মেইনিচি মার্চের ঘটনাবলী নিয়ে মন্তব্য করেছিল পাকিস্তানের আক্রমণাত্বক ও হিংসাত্বক ঘটনা আন্তর্জাতিক বিরােধে জড়িয়ে পড়বে এবং দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতেও বিরােধ সৃষ্টি করবে। জাপানি পত্রিকাগুলাে পূর্ব পাকিস্তানে। সংঘটিত পাকিস্তানের সামরিক অভিযানের ঘটনা বিশ্লেষণে মন্তব্য করে যা চীন পাকিস্তান ভারত ও সােভিয়েত ইউনিয়নের রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করবে। ঘটনা বিশ্লেষণে মেইনিচি শিম্বুন সােভিয়েত প্রেসিডেন্ট পােদগনি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে জরুরি ভিত্তিতে পূর্ব পাকিস্তানে ধ্বংসযজ্ঞ বন্ধ করার যে আহ্বান জানিয়েছিল তাও উল্লেখ করে। পত্রিকাটি আরাে জানায় সােভিয়েত ইউনিয়ন পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের প্রতি আন্তরিক।
—————————————
১০১ Sheikh Ahmed Jalal, Ibid, p. 31.
*** Quoted from Sheikh Ahmed Jalal, Ibid, P. 69.
—————————————
৬৪
১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ জাপানি দৈনিক পত্রিকা আসাহী ইভিনিং নিউজ এর শিরোনাম ছিল: ‘E. Pakistan Cut off From World/ As Heavy Fighting Rocks Cities/ Sheikh Mujib Goes Underground.’ নিউজের নিচেই পত্রিকাটি ক্যাপশন আকারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একটি ছবি ছাপে। তাতে দেখা যায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হাত উঁচু করে বিজয় চিহ্ন ( ভি সাইন ) দেখাচ্ছেন। ক্যাপশনের শিরােনাম করা হয়: Mujib Waves to Crowed. ক্যাপসনের নিচে লেখা ছিল: “Sheikh Mujibur Rahman, East Pakistan’s Awami League leader, gestures to the waiting crowed as he leaves a recent meeting at the residence of Pakistan President Yahya Khan in Dacca Friday. Current reports indicate heavy casualties and fierce fighting in East Pakistan which is seeking greater Independence from the central Government.”১০২
১৯৭১ সালের ৪ এপ্রিল তারিখে ইয়েমুরি শিম্বুন পত্রিকা ঢাকা থেকে পাঠানাে রঙিন ছবি দিয়ে অর্ধপৃষ্ঠাব্যাপী বেশ কিছু শিরােনাম করেছিল। শিরােনাম:
“People demonstrating against Pakistan with Bamboo bow and arrow.
Awami League President Mujib speaking in front of his residence and black smoke over Dacca city”.”*
জাপান টাইমস, ইয়েমুরি শিম্বুন, আসাহী শিম্বুন, মেইনিচি শিম্বুন পত্রিকায় বিভিন্ন প্রতিবেদন, সম্পাদকীয়, প্রবন্ধ প্রকাশ করে যাতে বাংলাদেশে গণহত্যা, ধ্বংসযজ্ঞ, সহ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ আওয়ামী লীগের ন্যায্য দাবির যৌক্তিকতা ফুটে ওঠে। জাপানি পত্রিকায় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে নিয়মিত সংবাদ প্রতিবেদন সম্পাদকীয় মতামত প্রকাশিত হবার ফলে টোকিওতে পাকিস্তান দূতাবাসকে ভাবিয়ে তােলে। জাপানে নিযুক্ত পাকিস্তানি রাষ্ট্রদূত জাপানের পত্র পত্রিকাগুলােকে পূর্ব পাকিস্তানে পরিস্থিতি স্বাভাবিক আছে এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে অভিযুক্ত করে মতামত প্রচার করেন। জাপানি পত্র-পত্রিকার প্রতিক্রিয়ায় ওই সময়ে জাপানে। নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত সৈয়দ মােতাহার হােসেন মেইনিচি শিম্বুন পত্রিকার সম্পাদকের সাথে দেখা করেন এবং একজন বাঙালি হয়েও নির্লজ্জভাবে পাকিস্তানের পক্ষাবলম্বন করেন। এতে জাপানি পত্রিকাগুলােও বিস্ময় প্রকাশ করে! মেইনিচি শিম্বুন পত্রিকায়
——————————————–
১০২. আসাহি ইভিনিং নিউজ, ২৭ মার্চ ১৯৭১। Sheikh Ahmed Jalal, Ibid, p. 26।
* Quoted from Shikh Ahmed Jalal, Ibid, P. 28.
——————————————–
৬৫
পাকিস্তানি রাষ্ট্রদূতের উদ্ধৃতি দিয়ে ১৯৭১ সালের ২৮ এপ্রিল লিখেছিল: “Pakistan May Try Rahman, Says Pakistan’s Ambassador in Tokyo
Pakistan Ambassador to Japan Syed Motahar Hossain Saturday indicated the probability of trial of Sheikh Mujibur Rahman.
The Ambassador while visiting the Mainchi Shimbun/ Mainchi daily news office in Tokyo briefed the editor in chief and the managing director. He stressed that “the unfortunate situation in Pakistan is purely an internal problem and could best be solved if it were left to the people of Pakistan without any foreign interference.” The best thing, the Ambassador added “for friendly nations like Japan is to use influence so that foreign interference will not take place.” He said every town in East Pakistan was calmn and that the situation would soon improve.”-103
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে পাকিস্তানি রাষ্ট্রদূত এটি পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয় বলে উল্লেখ করেন এবং পূর্ব পাকিস্তানে অস্ত্র সরবরাহের জন্য ভারতকে দায়ী করেন। পাকিস্তানি রাষ্টদূত সাক্ষাৎকারে উল্লেখ করেন, “the unfortunate situation in Pakistan is purely an internal problem and could best be solved if it were left to the people of Pakistan without any foreign interference.”104
পাকিস্তানি রাষ্টদূত সাক্ষাৎকারে আরাে উল্লেখ করেন, “Arms and ammunitions of Indian origin were captured in Pakistan.”105
পাকিস্তানি রাষ্ট্রদূতের সাক্ষাৎ এবং তার ভিত্তিতে প্রকাশিত প্রতিবেদনের তীব্র প্রতিক্রিয়া জানায় ভারতীয় রাষ্ট্রদূত। “No Indian Weapons to E. Bengal শিরােনামে বিবৃতিটি প্রকাশিত হয়। বিবৃতিতে ভারতীয় রাষ্ট্রদূত এক ব্যাখ্যায়। বলেন, “The Pakistani Ambassador cannot but be aware of the atrocities being perpetrated by the armed forces of Pakistan who are predominantly from West Pakistan on the people of East Bengal. The
————————————–
১০৩. Sheikh Ahmed Jalal, Ibid, p. 47.
১০৪ ঐ।
১০৫, ঐ।
————————————–
৬৬
allegations by the Pakistani Ambassador are therefore as baseless as they are mischievous.106
জাপানি পত্রিকা মেইনিচি ১৯৭১ সালের ১৮ এপ্রিল তারিখে উইকলি সানডে তে শরণার্থীদের উপর একটি বিশেষ সংখ্যা বের করে। জাপানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী কোচি আইচি শরণার্থীদের জন্য সাহায্য বৃদ্ধির নানান উদ্যোগ গ্রহণ করেন। আন্তর্জাতিক সাহায্যের মাধ্যমে তিনি জাপানি ত্রাণ দেওয়ার ব্যবস্থা নেন। জাপান টাইমসের একাধিক রিপাের্টে তার প্রমাণ মেলে। ১৯৭১ সালের ৪ জুন তারিখের সংখ্যায় জাপান টাইমসে বলা হয়েছিল “…direct aid to India would jeopardize Japan’s political neutrality in the current internal strife in East Pakistan. The officials hinted that Japan would probably join in multilateral aid being extended through the high commissioner’s office of the United Nations in Geneva.”107
জাপানের পাকিস্তান দূতাবাসে বাঙালি অফিসার এস এম মাসউদ এবং কিউ এ এম এ রহিম পাকিস্তান দূতাবাস ছেড়ে আনুষ্ঠানিকভাবে মুজিবনগর সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করেন। ১৯৭১ সালের নভেম্বর মাসে সাংবাদিকদের সাথে সাক্ষাৎ করে এই ঘােষণা দেন। জাপানি পত্র-পত্রিকায় তাদের সাক্ষাৎকারের উদ্ধৃতি দিয়ে সংবাদ প্রকাশিত হয়। 2 Diplomats Defect to Bangla Desh শিরােনামে প্রকাশিত মেইনিচি ডেইলি নিউজের সংবাদে বলা হয়:
“Press attaché S M Maswood and third secretary QAMA Rahim of the Pakistani Embassy in Tokyo announced their action to Japanese newsmen and went immediately to the Foreign Ministry to seek special permission to stay in Japan. Looking tense Maswood and Rahim both from East Pakistan met newsmen at Maswood’s residence and said they were not seeking a political asylum in japan. Maswood and Rahim said “we are employees of the Government of Pakistan no more. From today our allegiance is to the government of Bangla Desh.”108
মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে দেশে-বিদেশে জনমত গড়ে তুলতে জাপানের পত্রিকা রাখে অসামান্য ভূমিকা।
————————————–
১০৬. ঐ।
১০৭. Sukumar Biswas, Ibid, p. 245.
১০৮. Quoted from Sheikh Ahmed Jalal, Ibid, p. 241.
————————————–
৬৭
[জাপানি পত্রিকায় যশাের রণাঙ্গণে মুক্তিবাহিনীর বিজয়ােল্লাস। ছবি Sheikh Ahmed Jalal Contribution in the Independence of Bangladesh, Dhaka : Hakkani Publishers, 2002, P. 245.]
বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন কার্যকলাপ, রণাঙ্গনের খবরা খবর , মুক্তিযােদ্ধাদের বিভিন্ন অঞ্চলে বিজয়ের সংবাদ, শরণার্থী শিবিরের দূর্দশা ইত্যাদি মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক নানা ধরনের তথ্য প্রকাশের মাধ্যমে জাপান ও বর্হিবিশ্বের জনগণকে উৎসাহিত করেছে।
রেডিও জাপান, টেলিভিশন থেকেও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিষয়ে অনেকে আলােচনা করেছেন। এতে করে জাপানে বাংলাদেশের পক্ষে জনমত সু সংগঠিত হয়েছে। সবাই বুঝতে পেরেছে পাকিস্তানি সামরিক চক্রের দমন নীতি সত্ত্বেও বাংলাদেশের অভ্যুদয় অবধারিত। সেটা প্রমাণ হয়েছে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয় অর্জনের মাধ্যমে। বাংলাদেশের বিজয় অর্জনে জাপানি পত্র-পত্রিকায় শিরােনাম করল ‘Pakistanis Ink Surrender Papers.১০৯
———————————-
১০৯. The Daily Youmuri, 17 December 1971, quoted from Sukumer Biswas, Ibid, p.55.
———————————-
৬৮
Reference: বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ জাপান সম্পর্ক – ড. মো. আনোয়ারুল ইসলাম