ইতিহাসের সিঁড়িতে জাপান-বাংলাদেশ সম্পর্ক
বঙ্গবন্ধুর সাথে সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখা হবে ভেবে ঘুমিয়ে ছিলাম, আর সকালে ঘুম ভাঙ্গতেই তার মৃত্যুর খবর কোনাে ভাবেই মেনে নিতে পারছিলাম না। আমার কাছে বঙ্গবন্ধু শুধু রাষ্ট্রপতি নন, তিনি জাতির পিতা, আমার নেতা। তার প্রতি আমার আনুগত্য অপরিসীম। সে সময়ের বাংলাদেশের প্রায় আট কোটি মানুষের মধ্যে আমি একজন সাধারণ মানুষ। সরকার বা দলের কোনাে নেতা নই। বঙ্গবন্ধুর একজন সাধারণ কর্মী এবং সমর্থক। কিন্তু তার সাথে আমার সম্পর্ক অনেক গভীর, প্রকাশ করার ভাষা আমার জানা নেই।
বঙ্গবন্ধুর প্রতি আমার আনুগত্য অপরিসীম। তার সঙ্গে যে সামান্য স্মৃতি রয়েছে, তা আমার মনের স্মৃতির ভাণ্ডারে পরিপূর্ণভাবে দখল করে আছে। সেদিন অন্য কিছুই চিন্তা করতে পারছিলাম না। স্মৃতিগুলাে খুবই সাদামাটা। অসাধারণ কিছু নয়। কিন্তু সেদিন সেই স্মৃতিগুলাে হিমালয় পর্বতের মতাে বিশাল আকারে সামনে আসছিল।
সেদিন দুপুরের মধ্যে পরিষ্কার হয়ে গেল মেজর ফারুক এবং মেজর রশিদ এই হত্যাকাণ্ডে নেতৃত্ব দিয়েছে। তারা বঙ্গবন্ধুর সহযােগী বিশ্বাসঘাতক মুশতাক আহমেদকে রাষ্ট্রপতির পদে বসিয়েছে। কিছু দিনের মধ্যে আরও পরিষ্কার হলাে, এই হত্যাকাণ্ডের পিছনে মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত দেশী বিদেশী শক্তি জড়িত ছিল, যদিও মেজর ফারুক ও মেজর রশিদ এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছিল।
বাংলাদেশের প্রতি জাপানের সমর্থন পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ২৫শে মার্চের রাত্রি থেকে পরবর্তী নয় মাস বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধ সংগঠিত করতে থাকে। দেশী বিদেশী গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে এটা ঐকমত্য যে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী প্রায় তিরিশ লক্ষ বাঙালিকে হত্যা করে, দু’লক্ষ মহিলাদেরকে ধর্ষণ করে এবং এক কোটি বাঙালিকে ভারতে শরণার্থী হতে বাধ্য করে।
পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর এসব মানবতাবিরােধী যুদ্ধাপরাধের বিরুদ্ধে। সারা বিশ্বে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছিল। যদিও আমেরিকার সিনেট, কংগ্রেস এবং জনসাধারণ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকে সমর্থন করে এবং পাকিস্তানিদের যুদ্ধাপরাধের নিন্দা করে, কিন্তু আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নিক্সন। ও তাঁর প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা কিসিঙ্গার পাকিস্তানকে সমর্থন করে এবং বাংলাদেশে পাকিস্তানিদের যুদ্ধাপরাধ নিন্দা করেনি। চীনও যুক্তরাষ্ট্রকে অনুসরণ করে পাকিস্তানকে সমর্থন করে। অন্যদিকে সােভিয়েত ইউনিয়ন ১৫২ জাপানিদের চোখে বাঙালি বীর
২৫২
এবং ভারত বাংলাদেশে পাকিস্তানিদের যুদ্ধাপরাধের কঠোর নিন্দা করে, বঙ্গবন্ধুর প্রাণরক্ষার জন্য পাকিস্তান সরকারের উপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করে এবং মুক্তিবাহিনীদেরকে অস্ত্রশস্ত্র এবং প্রশিক্ষণ দিয়ে নানাভাবে সাহায্য করে।
কিন্তু জাপান আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক পরিমণ্ডলে আমেরিকার প্রভাবের বলয়ে থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করে এবং বাংলাদেশে পাকিস্তানিদের যুদ্ধাপরাধের তীব্র নিন্দা করে।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে জাপান আমেরিকার কাছে পরাজিত হয়েছিল এবং আমেরিকা কর্তৃক অধিকৃত হয়েছিল। এই পরাজয়ের গ্লানি জাপানিরা ভুলেনি। তাই আমেরিকা সমর্থিত পাকিস্তানের বাংলাদেশের কাছে পরাজয়ে জাপানিরা আমেরিকার পরাজয় হয়েছিল বলে আনন্দিত হয়েছিল। আমেরিকার ন্যায় চীনও বাংলাদেশের বিরুদ্ধে পাকিস্তানকে সমর্থন করেছিল। পাকিস্তানের পরাজয়কে চীনের পরাজয়, তাই জাপানিরা আনন্দিত হয়েছিল।
অর্থনৈতিক অবস্থানের দিক দিয়ে ব্যাপক ব্যবধান সত্ত্বেও এশিয়ার এ দুটি দেশের সরকার ও জনগণের মধ্যে বিদ্যমান রয়েছে ভ্রাতৃত্বপূর্ণ সম্পর্ক। নেতাজির সামরিক অভিযান ব্যর্থ হওয়ায় জাপানিরা যেমন নিরাশ হয়েছিল, তেমনি নিরাশ হয়েছিল ১৯৪৭ সালে ভারতের স্বাধীনতার সময় যুক্তবাংলার বিভক্তি এবং পূর্ববাংলাকে নিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের সৃষ্টি। তাই বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম যেমন বাংলাদেশীদের জন্য আনন্দের, ঠিক তেমনি আনন্দের ছিল জাপানিদের জন্যও।
জাপান আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক পরিমণ্ডলে আমেরিকার প্রভাবের বলয়ে থাকা সত্ত্বেও কেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করেছিল এবং বাংলাদেশে পাকিস্তানিদের যুদ্ধাপরাধের তীব্র নিন্দা করেছিল তার কারণ রয়েছে।
বহু যুগ আগে থেকে জাপান ভারতের অবিভক্ত বাংলার ভাষা, সংস্কৃতি এবং রাজনীতির সাথে পরিচিত ছিল। এই সম্পর্কের সূচনা হয় ১৯০২ সালে যখন জাপানি মনীষী শিল্পাচার্য, তেনশিন ওকাকুরার ভারত সফরকালে কলকাতায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে ঐতিহাসিক সাক্ষাৎ হয়। তেনশিন ওকাকুরা রবীন্দ্রনাথের প্রতিভা দেখে খুব মুগ্ধ হয়েছিলেন। তিনি জাপানে ফিরে গিয়ে এই অসাধারণ প্রতিভাসম্পন্ন বাঙালি কবি ও দার্শনিক সম্পর্কে টোকিও ইম্পেরিয়াল বিশ্ববিদ্যালয়ে আয়ােজিত এক অনুষ্ঠানে উপস্থাপন করেন। এর ফলে, জাপানি পণ্ডিতমহলে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে বিস্তর আলােচনা শুরু হয়।
১৫৩
সেই সম্পর্কের সূচনার জের ধরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পাঁচবার জাপান ভ্রমণ করেন। তাঁর এই ভ্রমণের মাধ্যমে জাপান এবং বাংলার মধ্যে ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি এবং রাজনীতির বিষয়ে আদান প্রদানের বিকাশ ঘটে।
১৯১৬ সালে রবীন্দ্রনাথের প্রথম জাপান ভ্রমণ অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। এই ভ্রমণকে কেন্দ্র করে ভারতের ব্রিটিশবিরােধী বাঙালি বিপ্লবী রাসবিহারী বােস জাপানে নির্বাসনে আসেন। তিনি ভারতকে স্বাধীন করার লক্ষে ব্রিটিশরাজের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করেছিলেন। তিনি ১৯১২ সালের ২৩ ডিসেম্বর দিল্লিতে ভারতের নবনিযুক্ত লর্ড হার্ডিঞ্জের শােভাযাত্রায় তাঁকে হত্যার উদ্দেশ্যে বােমা নিক্ষেপের আয়ােজন করেন। বােমাটি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়, লর্ড হার্ডিঞ্জ প্রাণে বেঁচে গেলও মারাত্মক ভাবে আহত হন এবং তাঁর। একজন সহকর্মী নিহত হয়।
লর্ড হার্ডিঞ্জের হত্যার চেষ্টা ব্যর্থ হবার পর রাসবিহারী বােস ১৯১৫ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ১৮৫৭ সালের ব্রিটিশবিরােধী সশস্ত্র সিপাহি বিপ্লবের মতাে একটি সশস্ত্র সিপাহি বিপ্লবের পরিকল্পনা করেন যা লাহােরে ষড়যন্ত্র। নামে খ্যাত হয়। সারা ভারত এমন কি ভারতের বাইরে বার্মা, সিঙ্গাপুর এবং মালয়ব্যাপী সিপাহি বিপ্লবের সমস্ত প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়।
রাসবিহারীর নেতৃত্বে ২১ ফেব্রুয়ারিতে আসন্ন এই বিশাল প্যান-ইন্ডিয়া অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা কৃপাল সিং ও নবাব খান নামে দু’জন বিশ্বাসঘাতক ব্রিটিশ সরকারকে ফাঁস করেছিল। ব্রিটিশ সরকার ২১ ফেব্রুয়ারির পূর্বে ভারতের সব সেনানিবাসে হানা দিয়ে ভারতীয় সৈন্যদের হত্যা, গ্রেফতার করে, বিপ্লবী কর্মী এবং নেতাদের গ্রেফতার করে। অভ্যুথান ব্যর্থ হয়। রাসবিহারী বােস গ্রেফতার এড়াতে সক্ষম হন। দিল্লি বােমা হামলা এবং লাহােরে ষড়যন্ত্রের পরিকল্পনাকারী রাসবিহারীকে গ্রেফতারের জন্য ব্রিটিশ সরকার হন্যে হয়ে খোঁজে এবং আর্থিক পুরস্কার ঘােষণা করে। ভারতে রাসবিহারীর জীবন নিরাপদ নয় বিধায় তিনি জাপানে নির্বাসনে যান এবং ব্রিটিশবিরােধী আন্দোলন অব্যাহত রাখেন। তিনি প্রগতিশীল জাপানি এবং জাপান সরকারের সহায়তায় আজাদ হিন্দ ফৌজ এবং ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেস লীগ গড়ে তােলেন। তাঁর একান্ত প্রচেষ্টায় জাপানিরা ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের আন্দোলনের বিষয়ে অবগত হন এবং উৎসাহিত হন।
এদিকে অক্লান্ত পরিশ্রম এবং বয়সের জন্য রাসবিহারী বােসের স্বাস্থ্য দিনে দিনে খারাপের দিকে যাচ্ছিল। তিনি তার দীর্ঘ বিপ্লবী জীবনের অবসান ঘটিয়ে অবসরে যাওয়ার পথ খুঁজছিলেন। পথ পেয়ে গেলেন। জাপান সরকার এবং তাঁর আমন্ত্রণে জার্মানিতে অবস্থিত ভারতের সুপরিচিত
১৫৪
এবং জনপ্রিয় জাতীয়তাবাদী বিপ্লবী নেতাজি সুভাষচন্দ্র বােস এক ঝুঁকিপূর্ণ সাবমেরিন ভ্রমণের মাধ্যমে জাপানে পৌছান। রাসবিহারী বােস ১৯৪৩ সালের জুলাইয়ের ৪ তারিখের ঐতিহাসিক দিনে ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্স লীগ ও আজাদ হিন্দ ফৌজের সভাপতি পদ থেকে পদত্যাগ করেন এবং নেতাজি সুভাষচন্দ্র বােসের হাতে সমস্ত নেতৃত্ব বুঝিয়ে দিয়ে বিপ্লবী জীবনের ইতি টানেন।
নেতাজি সুভাষচন্দ্র বােস দায়িত্ব নিয়ে জাপান সরকারের সহায়তায় স্বাধীন ভারত সরকার গঠন করেন, আজাদ হিন্দ ফৌজ পুনর্গঠন করেন এবং ব্রিটিশ এবং আমেরিকার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘােষণা করেন।
কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জাপান ভ্রমণ, জাপানে রাসবিহারী বােস এবং নেতাজি সুভাষচন্দ্র বােসের ভারতের স্বাধীনতার সংগ্রামের কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে জাপানিরা ভারতবর্যের ইতিহাস, বিশেষ করে বাঙালি বীরদের সম্পর্কে জানতে পারে, যা এই গ্রন্থের পূর্ববর্তী অধ্যায়ে বিস্তারিত লিপিবদ্ধ করা হয়েছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানিদের পরাজয় হয়। যুদ্ধের পরে মিত্রশক্তি ১৯৪৬ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সংঘটিত জাপানি যুদ্ধাপরাধের বিচারের জন্য টোকিও ট্রায়ালস নামে আন্তর্জাতিক ট্রাইবুনাল গঠন করে। এই ট্রাইবুনালের ১১ জন সদস্যদের মধ্যে ১ জন ছিলেন ব্রিটিশ ভারতের প্রতিনিধিত্বকারী । বাংলাদেশের কুষ্টিয়ায় জন্মগ্রহণকারী বাঙালি বিচারপতি রাধাবিনােদ পাল। অন্য দশ বিচারপতি ছিলেন কানাডা, ব্রিটেন, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডস, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, সােভিয়েত ইউনিয়ন, চীন এবং ফিলিপাইনস থেকে।
বিচার শেষে ১৯৪৮ সালের ১২ নভেম্বর আদালত ২৫ জন আসামিকে দোষী সাব্যস্ত করে, জাপানের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী হিদেকী তােজোসহ ৭ জনকে মৃত্যুদণ্ড, ১৬ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং দু’জনকে যথাক্রমে ২০ বছর ও ৭ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত করে।
একজন বিচারপতি ব্যতীত সকল বিচারক ‘দোষী’ বলে ঘােষণা করেছিলেন, ভিন্নমত পােষণের কণ্ঠটি ভারতীয় বিচারপতি রাধাবিনােদ পালের কাছ থেকে এসেছিল, ‘দোষী নয়!’। তিনিই একমাত্র ভিন্নমত পােষণকারী রায় লিখিতভাবে পেশ করেছিলেন যে সমস্ত আসামিরা দোষী নয়।।
বিচারপতি পালের কাছে প্রতীয়মান হয়েছিল, সত্যিকারে এই ট্রাইবুনালটি একটি রাজনৈতিক ট্রাইবুনাল, আইনি ট্রাইবুনাল নয়। তিনি
১৫৫
ট্রাইবুনালের সভায় বিচার প্রক্রিয়া সম্পর্কে তার মতামত খােলামেলা এবং স্পষ্টভাবে ব্যক্ত করলেন। তাঁর বক্তব্য শুনে অন্য ১০ জন বিচারপতি বিস্ময়, চমকিত, ব্রিত ও রাগান্বিত হয়েছিলেন।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে জাপানিদের লজ্জাজনক পরাজয় হয়েছিল, আমেরিকা জাপান দখল করে শাসন করছিল, এবং জাপানের যুদ্ধকালীন সব নেতা যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্ত। এই অপমানজনক এবং নাকাল জাতীয় পরিস্থিতিতে বিচারপতি পালের ভিন্নমত পােষণকারী রায় জাপানিদেরকে স্বস্তি দিয়েছিল। অপমানবােধ এবং দায়বােধ হাল্কা করতে সাহায্য করেছিল। জাপানিরা বিচারপতি পালের ভিন্নমত পােষণকারী রায়ের প্রতি আন্তরিকভাবে শ্রদ্ধাশীল।
বাংলাদেশের কুষ্টিয়া জেলায় জন্মগ্রহণকারী বিচারপতি পালের ঐতিহাসিক সাহসী রায়ের জন্য বাংলাদেশ তথা বাঙালিদের প্রতি জাপানিরা চিরকৃতজ্ঞ। যেহেতু বিচারপতি পাল জাপানিদের অপহৃত মানসম্মানকে উদ্ধার করার জন্য বিশেষ এক সাহসী ভূমিকা পালন করেছেন, সেই কৃতজ্ঞতাবােধ থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে মূল্যায়ন করতে স্বাধীনতার। স্থপতি বঙ্গবন্ধুকে সার্বিক সাহায্য-সহযােগিতার হাত প্রসারিত করেছিল জাপানের সরকার। বিচারপতি পালের জাপানিদের পক্ষে রায়ের বিষয়ে বিস্তারিত লিপিবদ্ধ করা হয়েছে এই গ্রন্থের পূর্ববর্তী অধ্যায়ে।
কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিপ্লবী রাসবিহারী বােস, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বােস এবং বিচারপতি রাধাবিনােদ পাল—এই চারজন বিশিষ্ট বাঙালিদের মাধ্যমে জাপানি এবং বাঙালিদের মধ্যে বন্ধুত্বের যে সূচনা হয়েছিল তা সময়ের সাথে অনেক গভীরে স্থায়িত্বলাভ করে।
এই সম্পর্কের ধারাবাহিকতায় জাপানের প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা ও বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী যারা গুরু তােওয়ামার স্নেহধন্য বিপ্লবী রাসবিহারী বসুর ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও সমর্থক ছিলেন, তাঁদের অনুসারীরাই পরবর্তীকালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও স্বাধীনতা যুদ্ধের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। জানতে পারে। ১৯৬৮ সালের ৩ জানুয়ারি আইয়ুব সরকার মােট ৩৫ জন। বাঙালির (রাজনীতিবিদ, সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমান বাহিনী, সরকারি অফিসার) বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযােগ এনে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা করে। সে সময় বাংলাদেশের বাইরে একমাত্র জাপানেই প্রগতিশীল ছাত্র সমাজ শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির জন্য আন্দোলন করে। পরবর্তী সময় এই গােষ্ঠীটিই বাংলাদেশের জন্য জাপানে জনমত গঠন, অর্থ সংগ্রহ এবং বিভিন্ন সহযােগিতার মাধ্যমে বাঙালিকে সমর্থন করেছেন।
১৫৬
বাংলাদেশের এই জাপানি বন্ধুদের নেতা ছিলেন তাকাশি হায়াকাওয়া (১৯১৭-১৯৮২)। তাঁর অন্য সঙ্গীদের মধ্যে ছিলেন অধ্যাপক-গবেষক সুয়ােশি নারা, বিশিষ্ট রবীন্দ্রগবেষক অধ্যাপক কাজুও আজুমা, শ্রীমতি হায়াশি তাকাকো, তানাকা তােশিহিসা, তিব্বতি নাগরিক পেমা গিয়ালপাে, লায়ন তাসুগি কিয়ােশি প্রমুখ। তাদের উদ্যোগে একাধিক প্রচারমূলক প্রকাশনাও প্রকাশিত হয়েছিল।
জাপান-বাংলাদেশের সম্পর্ক জোরদার করার ক্ষেত্রে জাপানিদের মধ্যে তাকাশি হায়াকাওয়া অবদানের কথা চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। হায়াকাওয়ার তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালনের বিষয়টিকে বিশেষ সম্মান ও গুরুত্বের সঙ্গে অনুসরণ ও অনুধাবন করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাকাশি হায়াকাওয়া একটানা ৪০ বছর জাপানের জাতীয় সংসদ ডায়েটে নির্বাচিত সদস্য ছিলেন এবং ‘ফাদার অব দ্য ডায়েট’ উপাধিতে ভূষিত হয়েছিলেন। তিনি তিন দফায় মন্ত্রিসভার সদস্য ছিলেন।
১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ে অবর্ণনীয় ক্ষয়ক্ষতির সংবাদে এবং ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের জনগণ তাকাশি হায়াকাওয়ার চিন্তা-চেতনার কেন্দ্রবিন্দুতে আসে। জাপানের ডায়েটে প্রভাবশালী সদস্য হিসেবে হায়াকাওয়া বাংলাদেশের জনগণের মুক্তিসংগ্রামের প্রতি জাপানি জনগণ ও সরকারের সমর্থন সম্প্রসারণের নেপথ্যে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন।
১৯৭১ সালের মার্চ মাসে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে যে নৃশংস হত্যাযজ্ঞ শুরু করে, হায়াকাওয়া তার প্রতি জাপান সরকারের উদ্বেগ প্রকাশ এবং বিশেষ করে জাপানি জনগণের প্রতিবাদ জানানাের প্রেক্ষাপট তৈরিতে সাংগঠনিক উদ্যোগ নেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ জাপানি মিডিয়ায় বিশেষ গুরুত্ব পায়। বাংলাদেশের শরণার্থীদের সাহায্যার্থে অর্থ সংগ্রহে এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রতি জাপানিদের সমর্থন সমন্বয়ে জাপানের বুদ্ধিজীবী, শিল্পমালিক, শ্রমিক, ছাত্রসমাজকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছিলেন তিনি। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালে বাঙালিদের প্রতি জাপানিদের অকুণ্ঠ সমর্থনের কারণে পাকিস্তানের সঙ্গে সে সময় জাপানের কূটনৈতিক সম্পর্কের টানাপড়েনের হতাশাজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর আমেরিকা বলয়ের দেশ হওয়া সত্ত্বেও উন্নত বিশ্বের শিল্পসমৃদ্ধ দেশগুলাের মধ্যে জাপানই প্রথম বাংলাদেশকে
১৫৭
স্বীকৃতি দেয় হায়াকাওয়ারই প্রচেষ্টায় ১৯৭২ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি। স্বীকৃতিদানের এক মাসের মধ্যে ঢাকায় জাপানি দূতাবাসের কার্যক্রম শুরু হয়।
স্বাধীনতার পর পর ১৯৭২ সালের ১৩-১৪ মার্চ হায়াকাওয়ার নেতৃত্বে তিন সদস্যের জাপানি সংসদীয় প্রতিনিধি দল প্রথম বাংলাদেশ সফরে আসে। বঙ্গবন্ধুকে জাপান সফরের জন্য আমন্ত্রণ জানাতে। তাঁরা হলেন প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ, সাংসদ ও প্রাক্তন শ্রমমন্ত্রী হায়াকাওয়া তাকাশি, নেতাজির সহযােদ্ধা জেনারেল ফুজিওয়ারা ইওয়াইচি এবং বিশিষ্ট সাংবাদিক, লেখক ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব তানাকা মাসাআকি। এই প্রতিনিধি দলে নেতাজির সহযােদ্ধা জেনারেল ফুজিওয়ারা ইওয়াইচির অন্তর্ভুক্তি ছিল তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ জাপানিরা জানতাে বঙ্গবন্ধু নেতাজি সুভাষচন্দ্র বােসের একজন একনিষ্ঠ ভক্ত।
এই প্রতিনিধিদল দেশে ফিরে ২৪ মার্চ প্রধানমন্ত্রী সাতাের কাছে পেশ করা রিপাের্টে প্রস্তাব রাখেন বাংলাদেশকে ১০ মিলিয়ন ডলারের জরুরি অনুদান অবিলম্বে প্রদান এবং পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের হিস্যা আদায়ে জাপানের মধ্যস্থতা! হায়াকাওয়ার সুপারিশ অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী সাতাের নির্দেশে ২৮ মার্চ ১৯৭২ জাপান বাংলাদেশে প্রথম অর্থনৈতিক সার্ভে মিশন পাঠায়। ওই বছর ৬ জুন জাপান বাংলাদেশ অ্যাসােসিয়েশন এবং কিছুকাল পরে জাপান বাংলাদেশ পার্লামেন্টারি অ্যাসােসিয়েশন গঠিত হলে হায়াকাওয়া তার প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হন এবং আমৃত্যু এর নেতৃত্বে ছিলেন।
১৯৭৩ সালের ১৬ ডিসেম্বর হায়াকাওয়া সস্ত্রীক বাংলাদেশ সফরে এলে রাষ্ট্রাচার উপেক্ষা করে বাংলাদেশের সরকারপ্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মন্ত্রিসভার সিনিয়র সদস্যদের নিয়ে পদ্মা গেস্ট হাউজে তার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ ও সম্মান প্রদর্শনে আসার ঘটনাটিকে জাপান-বাংলাদেশের মধ্যে সুদূরপ্রসারী সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠার সােপান বলে হায়াকাওয়া তার স্মৃতিকথায় উল্লেখ করেছেন।
এ সফরের সময় হায়াকাওয়ার নেতৃত্বে সফরকারী জাপানি প্রতিনিধি দলের কাছে যমুনা নদীর ওপর সেতু নির্মাণে জাপানি সহায়তা আহ্বান করা হয়। এ সফরের এক পর্যায়ে প্রতিনিধি দল ভােলায় গেলে সেখানে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক উপদেষ্টা এবং সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী তােফায়েল আহমেদ এবং তৎকালীন কৃষিমন্ত্রী আবদুস সামাদ আজাদ হায়াকাওয়া সাহেবকে ‘মি. বাংলাদেশ’ নামে অভিহিত করলে তিনি অভিভূত হন। স্মৃতিকথায় তিনি উল্লেখ করেছেন এ যেন নিজের নির্বাচনী এলাকায় সংবর্ধিত হচ্ছি।
১৫৮
পরবর্তীকালে জাপানের জনগণ ও সরকারের কাছে তিনি ‘মি. বাংলাদেশ’ হিসেবেই আমৃত্যু পরিচিতি পেয়ে গর্ববােধ করেছেন এবং যখনই জাপানের কাছে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কিংবা যেকোনাে সহায়তার ব্যাপারে দেনদরবারের বা নেগােসিয়েশনের প্রসঙ্গ উপস্থিত হয়েছে তিনিই বলতে গেলে বাংলাদেশের পক্ষ নিয়ে কথা বলেছেন। ১৯৮২ সালে তার তিরােধানের পর বাংলাদেশ জাপানের সঙ্গে যখনই কোনাে দেনদরবার করেছে, হায়াকাওয়ার অনুপস্থিতি অনুভব করা হয়েছে।
Reference – জাপনিদের চোখে বাঙালি বীর – ড. নূরুন নবী