করাচিতে পাকিস্তান শিক্ষা সম্মেলন
পাকিস্তানের তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমানের উদ্যোগে ১৯৪৭ সালের ২৭ নভেম্বর করাচিতে এক শিক্ষা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এ সম্মেলনে বিভিন্ন প্রদেশের কর্মকর্তা এবং প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করেন। পূর্ববাংলা থেকে স্বাস্থ্যমন্ত্রী হাবিবুল্লাহ বাহার চৌধুরী ও শিক্ষামন্ত্রী আবদুল হামিদ অংশগ্রহণ। করেন। এ সম্মেলনের উদ্দেশ্য, সিদ্ধান্ত ও প্রস্তাব নিয়ে বিভ্রান্তি এবং পরস্পর বিরােধী বক্তব্য পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হতে থাকে।
করাচিতে অনুষ্ঠিত শিক্ষা সম্মেলন শেষে ৫ ডিসেম্বর মন্ত্রী হাবিবুল্লাহ বাহার ও আবদুল হামিদ ঢাকায় এসে পৌঁছেন। বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তারা জানান যে, সম্মেলনে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার একটি সর্বসম্মত প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে। ৬ ডিসেম্বর দৈনিক মর্নিং নিউজ’ পত্রিকায় এ সংবাদ প্রকাশিত হলে সর্বত্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তে বেলা দুটায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে প্রতিবাদ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। ঢাকার বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রীরা এ সমাবেশে অংশ নেয়। তমদুন মজলিসের সম্পাদক আবুল কাসেমের সভাপতিত্বে সমাবেশে বক্তব্য রাখেন মুনীর চৌধুরী, আবদুর রহমান, এ.কে.এম আহসান, কল্যাণ দাশগুপ্ত, এম. আহমদ প্রমুখ। উক্ত সভায় রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে চারটি দাবি উত্থান করেন ডাকসুর ভিপি ফরিদ আহমেদ এবং সেগুলি সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হয়।
ছাত্রসভা শেষে এক বিরাট মিছিল সচিবালয়ে যায় এবং মন্ত্রীদের কাছে এ সম্পর্কিত ব্যাখ্যা দাবি করে। শিক্ষা সম্পর্কিত প্রস্তাব নিয়ে সরকারের মন্ত্রীদের মধ্যে পারস্পরিক দোষারােপ প্রত্যক্ষ করা যায়। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, শিক্ষক, সাংবাদিক এবং সুধীসমাজ কথিত প্রস্তাবের বিপক্ষে বিবৃতি এবং মতামত ব্যক্ত করেন।
১৩
করাচির শিক্ষা সম্মেলনে গৃহীত প্রস্তাব নিয়ে যখন বিভ্রান্তি, সভা-সমাবেশবিক্ষোভ চলছিল সেইসময় কিছু অনাকাক্ষিত হাঙ্গামা বাঙালির মনে সুদূরপ্রসারী প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। আপাতদৃষ্টিতে ঘটনাগুলােকে সামান্য মনে হলেও বাঙালিদের প্রতি অবাঙালি এবং শাসকগােষ্ঠীর বিমাতাসুলভ আচরণের প্রমাণ মেলে। ছাত্র-শিক্ষক এবং সচেতন নাগরিকদের মধ্যে এ ধারণা বদ্ধমূল হতে শুরু করে যে, স্বাধীন পাকিস্তানে সংখ্যাগুরু বাঙালিরা কি বঞ্চিত-লাঞ্ছিত হবে। ন্যায্য দাবির কথা বলতে গেলে কি বাঙালি বলে নির্যাতিত হতে হবে? তাহলে কি জাতিগত মর্যাদা এবং অধিকারের জন্য সদ্য স্বাধীন পাকিস্তানেও নতুন করে সংগ্রাম গড়ে তুলতে হবে-আন্দোলনে নামতে হবে?
এ সময় ৭ ডিসেম্বর ১৯৪৭ ঢাকা রেলকর্মচারীদের এক সভা জনাব ফজলুল হকের সভাপতিত্বে শুরু হয়। বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে সভায় বাঙালি-অবাঙালিদের মাঝে মতপার্থক্য এবং মারামারি সংগঠিত হলে ফজলুল হক সভা ত্যাগ করে চলে যান। এ সময় পরিকল্পিতভাবে প্রচার চালানাে হয় যে, ফজলুল হক। রেলওয়ের হিন্দু কর্মচারীদের নিয়ে পাকিস্তান এবং উর্দুর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে এবং হিন্দুদের বাংলাকে মুসলিম পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার চক্রান্ত চালাচ্ছে। অপপ্রচারের প্রতিবাদে ঐ দিনই সিরাজুদ্দৌলা পার্কে ফজলুল হকের সভাপতিত্বে এক সমাবেশ অনুষ্ঠানের প্রস্তুতিপর্বে পুরানাে ঢাকার একদল লােক চেয়ার ছােড়াছুড়ি করে সভাটি পণ্ড করে দেয়। বেশকিছু ছাত্র সে সময় নিগৃহীত হয়।
১২ ডিসেম্বর ১৯৪৭ এ ঘটে আরেকটি পরিকল্পিত ঘটনা। উর্দুর পক্ষে শ্লোগান দিতে দিতে ৫০/৬০ জনের একটি গ্রুপ বাস ও ট্রাকে করে ঢাকা শহরের পলাশী এলাকায় আসে। এ সময় পলাশী এলাকার বাঙালি কর্মচারী এবং কিছু ছাত্র বিরূপ মন্তব্য করলে গুণ্ডাপ্রকৃতির লােকগুলাে পলাশী ব্যারাকের সরকারি কর্মচারী এবং পার্শ্ববর্তী আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ছাত্রদের উপর ইট-পাটকেল নিক্ষেপ ও কয়েক রাউন্ড গুলিবর্ষণ করে। এতে বেশ কয়েকজন আহত হয়। মুহূর্তের মধ্যে এ সংবাদ শহরময় ছড়িয়ে পড়ে এবং উত্তেজনাকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।
পলাশী ব্যারাকে সরকারি কর্মচারীদের উপর উর্দুভাষার সমর্থক গুণ্ডাদের আক্রমণ এবং বিভিন্নস্থানে বাংলা ভাষার সমর্থক ছাত্রদের উপর হামলার প্রতিবাদে ১৩ ডিসেম্বর সচিবালয়ে ধর্মঘট পালিত হয়। সচিবালয়ের ভেতরে সরকারি কর্মচারীদের ধর্মঘট এবং বাইরে ছাত্র-শিক্ষক এবং সাধারণ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত জাগরণ ও প্রতিবাদ বিক্ষোভ দমনে সরকার কৌশলী অবস্থান গ্রহণ করে। ১৩ ডিসেম্বর থেকে ১৫ দিনের জন্য ঢাকা শহরে ১৪৪ ধারা জারি করে। সভা, সমাবেশ, শােভাযাত্রা নিষিদ্ধ করা হয়। দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান
১৪
প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনকারী অনেক মুসলমান নেতা-কর্মী শুধুমাত্র মাতৃভাষা বাংলার পক্ষে অবস্থান নেয়ার কারণে ষড়যন্ত্রকারী-চক্রান্তকারী হিসেবে চিহ্নিত করার অপচেষ্টা এই সময় থেকেই শুরু হয়। পাকিস্তানি কায়েমী স্বার্থবাদী গােষ্ঠী প্রকাশ্যে এবং পূর্ববঙ্গ মুসলিম লীগের সােহরাওয়ার্দী, আবুল হাশিম গ্রুপের প্রতিপক্ষ গােপনে এই অপপ্রচারে জড়িত হয়। ১২ ডিসেম্বরের ঘটনার পর পূর্ববঙ্গ সরকার একটি প্রেসনােট প্রকাশ করে। উক্ত প্রেসনােটে পূর্ববঙ্গের বাঙালি-অবাঙালি মুসলমানের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির প্রচারণার অভিযােগে ১৫ ডিসেম্বর থেকে ১৫ দিনের জন্য কলকাতা থেকে প্রকাশিত বাংলা সংবাদপত্র ‘আনন্দবাজার’,‘স্বাধীনতা’ ও ‘ইত্তেহাদ এর পূর্ব পাকিস্তানের প্রচার নিষিদ্ধ করা হয়। সেই যে ভারতবিরােধী অকারণ প্রচারণা শুরু হয়েছিল স্বার্থান্বেষী মহল আজও হীন রাজনৈতিক উদ্দেশ্য এবং গােষ্ঠীস্বার্থে সে প্রচারণা অব্যাহত রেখেছে। ব্যক্তি, দল বা গােষ্ঠীর নাম বা চেহারায় হয়তাে এরা আলাদা কিন্তু চিন্তা, উদ্দেশ্য এবং ঘটনার বাস্তবতায় এরা এক ও অভিন্ন।
পাকিস্তান গণপরিষদের দ্বিতীয় অধিবেশন
১৯৪৭ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি করাচিতে পাকিস্তান গণপরিষদের দ্বিতীয় অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা নির্ধারণের ক্ষেত্রে এই অধিবেশনে উত্থাপিত প্রস্তাব এবং এ সম্পর্কিত আলােচনা রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সমগ্র পাকিস্তানে বিশেষ করে পূর্ববাংলার কোনাে কোনাে গণপরিষদ সদস্য রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে এবং বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিল তাও জনগণের কাছে স্পষ্ট হয়ে যায়। পূর্ববাংলার কুমিল্লা থেকে নির্বাচিত কংগ্রেসদলীয় গণপরিষদ সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত এই অধিবেশনেই সর্বপ্রথম উর্দু ও ইংরেজির পাশাপাশি বাংলাকেও পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব করেন। ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত তার প্রস্তাব উত্থাপন করে সংসদে বলেন,
“মি. প্রেসিডেন্ট, এ কথা আমি জানি বাংলা একটি প্রাদেশিক ভাষা। কিন্তু আমাদের রাষ্ট্রের কথা যদি আমরা চিন্তা করি তাহা হইলে দেখিব যে, রাষ্ট্রের অধিকাংশ অধিবাসীর ভাষা হইতেছে বাংলা। কাজেই প্রাদেশিক হইলেও যেহেতু রাষ্ট্রের অধিকাংশ অধিবাসীর ভাষা বাংলা, সেই কারণে বাংলা ভিন্ন মর্যদার দাবিদার। রাষ্ট্রের মােট জনসংখ্যার ৬ কোটি ৯০ লাখ অধিবাসীর মধ্যে ৪ কোটি ৪০ লক্ষ অধিবাসী বাংলা বলে। এই যদি অবস্থা হয় তাহা হলে রাষ্ট্রের রাষ্ট্র ভাষা কী হওয়া উচিত?.. আমাদের ৪ কোটি ৪০ লক্ষ মানুষ এই সংসদের
১৫
কার্যবিবরণীর কিছু বুঝিতে অক্ষম। কারণ যে ভাষাতে ইহা পরিচালিত হয় সে ভাষা তাহাদের অজানা। ২৯ নং রুলে ইংরেজির সম্মানজনক উল্লেখ রহিয়াছে। … তাই যদি হয়, ২৯ নং রুলে যদি লিখিত থাকিতে পারে যে সংসদের কার্যবিবরণী উর্দু অথবা ইংরেজিতে পরিচালিত হইবে, তাহা হইলে ৪ কোটি ৪০ লক্ষ লােকের মুখের ভাষার একটি সম্মানজনক উল্লেখ রুল নং ২৯-এ কেন থাকিতে পারিবে না?
মি. প্রেসিডেন্ট, আমি তাই আমার এই প্রস্তাব দ্বারা লক্ষ লক্ষ মানুষের মনের অনুভূতিকেই প্রকাশ করিতেছি এবং সে কারণেই আমাদের রাষ্ট্রে বাংলা একটি প্রাদেশিক ভাষা নয়। বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রের ভাষা হিসেবে মর্যাদা প্রদান করিতে হইবে। এবং সে কারণে জনাব সভাপতি, আমি প্রস্তাব করিতেছি। :‘ইংলিশ শব্দের পরবর্তীতে ‘বেঙ্গলী’ এই শব্দটিকে ২৯ নং রুলে অন্তর্ভুক্ত করা হউক।”
[সূত্র : আসুন আর একবার ঐ পথে হেঁটে আসি-লেখক সরদার ফজলুল করিম, ভােরের কাগজ, ২০ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৮)।
২৩ ফেব্রুয়ারি ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের উত্থাপিত সংশােধনী প্রস্তাবের উপর আলােচনা অনুষ্ঠিত হয় ২৫ ফেব্রুয়ারি। এইদিন পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান এই সংশােধনী প্রস্তাবের বিরােধিতা করে বলেন, “পাকিস্তানের অধিবাসীদের মধ্যে বিরােধ সৃষ্টি করা এবং একটি সাধারণ ভাষার দ্বারা ঐক্যসূত্র স্থাপনের প্রচেষ্টা হইতে মুসলমানদের বিচ্ছিন্ন করাই এই প্রস্তাবের উদ্দেশ্য।”
[ সূত্র ; একুশে ফেব্রুয়ারি, প্রকাশক-ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, লেখক-ড.রঙ্গলাল সেন, পৃ.১২] ।
পূর্ববঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন প্রস্তাবের বিরােধিতা করে বলেন“উর্দুই একমাত্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হতে পারে বলে পূর্ববঙ্গের অধিকাংশ লােকের অভিমত। বাংলাকে সরকারি ভাষা করার কোনােই যুক্তি নেই। তবে পূর্ববঙ্গে শিক্ষা ও শাসনকার্যের ক্ষেত্রে যথাসময়ে বাংলা ভাষা ব্যবহৃত হইবে।”
[সূত্র : ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস-বশির আল হেলাল, পৃ. ২৪৩]।
গণপরিষদের কংগ্রেস দলের অস্থায়ী নেতা শ্রীশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সংশােধনীপ্রস্তাবটি সমর্থন করে বলেন,
“এতদিন পর্যন্ত আমার ধারণা ছিল পাকিস্তান জনগণের, সংখ্যালঘু ও সংখ্যগুরু উভয় সম্প্রদায়ের রাষ্ট্র। কিন্তু পরিষদের নেতার বিবৃতি সম্পর্কে অ-
১৬
মুসলমানদের বিশেষভাবে বিবেচনা করতে হবে। শাসনতন্ত্র গঠনে অমুসলমানদের কোনাে অধিকার আছে কিনা সে-কথা এখন তাদের ভেবে দেখতে হবে। সংশােধন প্রস্তাবে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিও করা হয়নি। উর্দু ও ইংরেজির সঙ্গে বাংলাকেও পরিষদের ভাষার অন্তর্ভুক্ত করার দাবি করা হয়েছে।
[সূত্র : ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস-বশির আল হেলাল, পৃ. ২৪৩-২৪৪]
গণপরিষদের কংগ্রেস দলের সেক্রেটারি রাজকুমার চক্রবর্তী ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের সংশােধনী প্রস্তাবের সমর্থনে বলেন—“উর্দু পাকিস্তানের কোনাে প্রদেশেরই কথ্য ভাষা নয়। তা হচ্ছে উপরতলার কিছুসংখ্যক মানুষের ভাষা। পূর্ব বাংলা এমনিতেই কেন্দ্রীয় রাজধানী করাচী থেকে অনেক দূরে অবস্থিত, তার উপর এখন তাদের ঘাড়ে একটি ভাষাও আবার চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে। একে গণতন্ত্র বলে না। আসলে এ হলাে অন্যান্যদের উপর উচ্চশ্রেণির আধিপত্য বিস্তারের প্রচেষ্টা। বাংলাকে আমরা দুই অংশের সাধারণ ভাষা করার জন্যে কোনাে চাপ দিচ্ছি না। আমরা শুধু চাই পরিষদের সরকারি ভাষা হিসেবে বাংলার স্বীকৃতি। ইংরেজিকে যদি সে মর্যাদা দেয়া হয় তাহলে বাংলা ভাষাও সে মর্যাদার অধিকারী।”
[সূত্র: ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস-বশির আল হেলাল, পৃ. ২৪৪]
পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী গজনফর আলী খান প্রস্তাবের বিরােধীতা করে বলেন-
“পাকিস্তানের একটিমাত্র সাধারণ ভাষা থাকবে এবং সে ভাষা উচ্ছে উর্দু। আমি আশা করি যে, অচিরেই সমস্ত পাকিস্তানি ভালভাবে উর্দু শিক্ষা করে উর্দুতে কথাবার্তা বলতে সক্ষম হবে। উর্দু কোনাে প্রদেশের ভাষা নয়, তা হচ্ছে মুসলিম সংস্কৃতির ভাষা। এবং উর্দু ভাষাই হচ্ছে মুসলিম সংস্কৃতি।”
[সূত্র: ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস-বশির আল হেলাল, পৃ. ২৪৪]
গণপরিষদের সহ-সভাপতি মুসলিম লীগ দলীয় সদস্য ফরিদপুরের তমিজুদ্দিন খান কংগ্রেস দলীয় সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত উত্থাপিত পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার অন্তর্ভুক্তির সংশােধণী প্রস্তাবের সরাসরি বিরােধিতা করে খাজা নাজিমুদ্দিনকে সমর্থন করেন। গণপরিষদ সদস্য প্রেমহরি বর্মা ও ভূপেন্দ্র কুমার দত্ত তাঁদের বক্তৃতায় নানা বিশ্লেষণ ও যুক্তি দিয়ে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের বক্তব্য সমর্থন করেন। পাকিস্তান গণপরিষদের এই দ্বিতীয় অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেছিলেন পাকিস্তানের গর্ভনর জেনারেল এবং পদাধিকার বলে
১৭
গণপরিষদের প্রেসিডেন্ট মােহাম্মদ আলী জিন্নাহ। তিনি ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত আনীত পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার অন্তর্ভুক্তির জন্য সংশােধনী প্রস্তাব ভােটে প্রদান করলে গণপরিষদের অধিবেশনে তা কণ্ঠভােটে বাতিল হয়ে যায়।
পাকিস্তান গণপরিষদে বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যাত হওয়ায় এবং পূর্ববঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিনের বাংলা ভাষাবিরােধী অবস্থান নেয়ার সংবাদ প্রচারিত হবার সঙ্গে সঙ্গে পূর্ববঙ্গের সর্বত্র স্বতঃস্ফূর্ত বিক্ষোভ দেখা দেয়। ২৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৮ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ এবং ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্কুল-কলেজের ছাত্র-ছাত্রীরা রাস্তায় রাস্তায় মিছিল করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে জমায়েত হয়। সেখানে অনুষ্ঠিত সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন তমদুন মজলিসের নেতা আবুল কাসেম। বক্তব্য রাখেন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের আহ্বায়ক নঈমুদ্দিন আহমদ এবং ফজলুল হক হল ছাত্র ইউনিয়নের সহ-সভাপতি মােহাম্মদ তােয়াহা। নেতৃবৃন্দ তাঁদের বক্তব্যে পাকিস্তানী শাসকগােষ্ঠী কর্তৃক বাংলা ভাষাকে অবহেলা করায় তীব্র নিন্দা ও ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তারা পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন এবং মুসলিম লীগ দলীয় গণপরিষদের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সারা পূর্ববঙ্গে মিছিল, সমাবেশ ও ধর্মঘট পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। ২৮ ফেব্রুয়ারি তমদুন মজলিস এবং পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের এক যৌথসভায় ১১ মার্চ পূর্ববঙ্গে সাধারণ ধর্মঘট পালনের কর্মসূচি ঘােষণা করা হয়। তমদুন মজলিসের সম্পাদক আবুল কাসেম, পূর্ব পাকিস্তান মুসীলম লীগের কাউন্সিল সদস্য শেখ মুজিবুর রহমান, নঈমুদ্দিন আহমদ, দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া যুব সম্মেলনে পাকিস্তানি প্রতিনিধি দলের নেতা আবদুর রহমান চৌধুরী উদ্ভূত। পরিস্থিতিতে ১ মার্চ ১৯৪৮ এক বিবৃতি প্রদান করেন।
Reference – কালের ধ্বনি – গোলাম কুদ্দুস