শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
পাকিস্তানের সরকারী চাকুরী ত্যাগ করে বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য জ্ঞাপনের কারণ সংবলিত বাঙলি কূটনীতিক এ. এম. এ. মুহিতের বিবৃতি | এ, এম, এ, মুহিতের সংকলিত “Thoughts in Exile” | ২৭ জু্লাই,১৯৭১ |
কেন আমি অব্যাহতি দিলাম
জুলাই ২৭, ১৯৭১।
যে প্রশ্নটি আমি আজ সন্ধ্যায় উত্তর দিতে চেয়েছিলাম, “কী আমাকে পাকিস্তান সরকার থেকে পৃথক করেছে এবং বাংলাদেশের পক্ষাবলম্বন করিয়েছে।” ২৫শে মার্চ থেকে আমি এ সিদ্ধান্ত গ্রহণে বিলম্ব করে আসছি এ আশাতে যে, রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খান হয়তো এ সংকটপূর্ণ অবস্থার একটি শান্তিপূর্ণ নিষ্পত্তি করবেন। কোন আশারই আর কোন ভিত্তি নেই এবং আত্মবিধ্বংসী সরকারের পক্ষে কাজ করা অসম্ভব হয়ে পড়েছে।
তাসত্ত্বেও, আমি স্বীকার করতেই হবে,আমার দেশের সরকারের সাথে পনের বছরের কর্মজীবন, যা ছিল কিশোর বয়সে আমার স্বপ্নজগৎ, তা আমি সহজে চাইলেই ঝেড়ে ফেলতে পারি না। মনে রাখার মত কিছু ঘটনা এবং পরিচিতি আমার আছে,তার মধ্যে একটিস্বয়ং প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার জন্য কাজ করা।
ক্ষমতায় থাকা বর্তমান সরকারের বৈধতা, ঔপনিবেশিক উচ্চাশা, অসভ্যতা, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ভ্রান্তি, মানবিক চিন্তার অভাব এ সম্পর্কিত প্রশ্নগুলোই আমাকেসরকারের প্রতি বিক্ষুব্ধ করে তুলছে
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া তার সরকারকে বলতেন তত্ত্বাবধায়ক সরকার, যারা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করার জন্য অপেক্ষা করছেন। কিন্তু তিনি এখন দেশের ইতিহাসের সবথেকেনিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ নির্বাচনে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের উপর চাপ প্রয়োগ করে দমিয়ে রাখছেন, এমনকি তিনি এদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করেছেন এবং তিনি নির্দেশ দিয়েছেন যে সুদূর ভবিষ্যতে এ সামরিক আইন প্রত্যাহার করা হবে না। একারণেই তার সরকার বৈধতার সকল অধিকার হারিয়েছে।
নাগরিকদের জীবন এবং সম্পদের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দেয়ার পরিবর্তেপাকিস্তান সরকারপূর্ব পাকিস্তানের জনগণের “বেঁচে থাকা”কেই তাদের বিলাশিতা জ্ঞান করছে। সরকার পুর্ব পাকিস্তানে যে নৃশংসতা দেখাচ্ছে তার কারণে বাংলাদেশীরা দেশ থেকে চলে যেতে বাধ্য হচ্ছে এবং এর ফলে দুই অংশে ভিন্নমত তৈরি হয়েছে যা সভ্য বিশ্বে এ সরকারের অধিকারকেই শুধু বাজেয়াপ্ত করেনি বরং এই বিভাজনের জন্যও এই মতানৈক্যকেই দায়ী করেছে।
এই সরকার সন্ত্রাস রাজত্বের দ্বারা পশ্চিম পাকিস্তানের কর্মকর্তা এবং শ্রমিকের একটি বিশাল দল স্থানান্তরিত করেপূর্ব পাকিস্তানে উপনিবেশ স্থাপন করতে সবধরনের চেষ্টা করে যাচ্ছে। বিভিন্ন ধরণের সমস্যায় জর্জরিত একটি গরির দেশের প্রতি এ ধরণের প্রয়াস নিছক উন্মত্ততা।
সরকার বিপদজনক কিছু পদক্ষেপ হাতে নিয়েছিল এবং তা নিরলসভাবে অনুসরণ করা হচ্ছিল। এটা খুবই ভয়ানক কারণ এটা হচ্ছে বুদ্ধিবৃত্তিশূণ্য। এই পদক্ষেপ শুধুমাত্র দক্ষিণ এশিয়ায় যুদ্ধের পরিস্থিতিই ছড়িয়ে দেয়নি বরং এই অঞ্চলে সহিংস সামাজিক অভ্যুত্থানের বীজও বপন করেছে। যা পূর্ব পাকিস্তানকে রক্তশূন্য করেছে পাশাপাশি পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনীতিকেও।
বর্তমানে পূর্ব পাকিস্তানে মানুষের দুর্দশার সীমা অবর্ণনাতীত। সেনাবাহিনী কর্তৃক আক্রমণের ফলে মৃত্যুর আশংকা এবং ধনসম্পদের ধ্বংসকে এক পাশে সরিয়ে রাখলেও, দুর্ভিক্ষের আশংকা আসলেই ভয়ানক। সমস্ত যোগাযোগ মাধ্যমের অচলাবস্থার সাথেক্রমেই আঁকড়ে ধরা সন্ত্রাসপ্রবণতার কবলে পরে সকল অর্থনৈতিক কার্যক্রম এবং খাদ্যশস্য ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির গতিবিধি থামিয়েদিয়েছে।
সাত লক্ষ শরণার্থী থাকা সত্ত্বেও পূর্ব পাকিস্তানেরপ্রত্যন্ত এলাকায় অনাহার এখন প্রশ্নাতীত। গত অর্থ বছরের খাদ্যের চাহিদা ও যোগানের মধ্যে ২.৩ মিলিয়ন টন পার্থক্য থাকা সত্ত্বেওএ বছর মাত্র ১.৩ মিলিয়ন টন খাদ্য আমদানি করা সম্ভব হচ্ছেএবংদেশের অভ্যন্তরে মজুদকৃত খাদ্য ভান্ডারে উদ্বৃত্ত খাদ্য প্রত্যন্ত এলাকায় পৌছে দেয়ার কাজওগত মার্চ মাস থেকেবন্ধ আছে।
নিকট ভবিষ্যতেও এ সম্ভাবনা ক্ষীণ। সবকিছু আশাতীত ভাবে ঠিক থাকলেও এই বছর প্রতি বছরের গড়ে ৩.৫ মিলিয়ন টন খাদ্য ঘাটতির থেকেও ৩০% কম উৎপাদন হবে। এমনকি যদি শরণার্থীরা ফিরে নাও আসে, তবেপূর্ব পাকিস্তানে বর্তমান সময় থেকে জুন ১৯৭২ পর্যন্ত ২.৫ মিলিয়ন টন খাদ্যশস্য প্রয়োজন।গতমাসে বিদ্রোহ কম থাকা সত্ত্বেও অভ্যন্তরীণ পরিবহন ব্যবস্থায়সকল সম্ভাব্য নৌযান একত্রিত করেও গত মাসে ১ মিলিয়ন টনের বেশি পরিবহন করতে পারেনি। যাইহোক,এত প্রতিবন্ধকতার পরেও এসব কর্মকান্ডের তীব্রতার প্রমাণ রয়েছে। এ ব্যাপারটা আমার মাথায় আসছে না যে বর্তমান পরিস্থিতিতে কিভাবে ১.২ মিলিয়ন টনের বেশি খাদ্যশস্য এ বছর পূর্ব পাকিস্তানে যোগান দেয়া হবে। যদি লক্ষাধিক ক্ষুধার্ত মানুষদের বাঁচিয়ে রাখতে হয় তবে প্রথম অপরিহার্য শর্ত হলো পূর্ব পাকিস্তানে পুনরায় শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আমি বুঝাতে চাইছি প্রকৃত শান্তি এবং বন্দুক বা বেয়নেটের ভয় দেখিয়ে চুপ করিয়ে দেয়া নীরবতা নয়। দ্বিতীয় শর্ত হলো খাদ্য বন্টন কার্যক্রমে সমস্ত জনসাধারণের অংশগ্রহণ করা। যতদিন পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তান সরকারের অভিযান অব্যাহত থাকবে এবং যতদিন বাঙ্গালিরা তাঁদের রাগ ও অসন্তোষ নিজেদের ভিতরে পুষে রাখবে এবং যতদিন না তারা সরাসরি অথবা অন্তর্ঘাত ও অহিংস যুদ্ধে লিপ্ত না হয় ততদিনে আমার কোন শর্তই পূরণ হবে না।
১৯৪৩ সালে বাংলাদেশের ইতিহাসে স্মরণকালের সবচেয়ে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ হয়। যুদ্ধের কারণে পরিবহন ব্যবস্থা নষ্ট হয়ে যায় এবং খাদ্যের ঘাটতিপ্রায় ৬% হয়ে গিয়েছিল। সে দুর্ভিক্ষে প্রায় ২.৫ থেকে ৫ মিলিয়ন মানুষ মারা যায়। বর্তমান সময়ে মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় তিন গুণ। তার মানে আগামী তিন মাসে ৭.৪ থেকে ১৫ মিলিয়ন মানুষ মারা যাবে অনাহারে।
আমি নিয়তিকে মেনে নিচ্ছি না। আমি বিশ্বাস করি যে এই অবস্থার উন্নয়ন করা সম্ভব। বৈশ্বিক শক্তি নিশ্চয়ই মানুষ ধ্বংসের সাক্ষী হয়ে অসহায়ের মতো বসে থাকবে না। বাঙালিদের নির্যাতিত হতে দেয়া সত্যিই বিপদজনক। রাজনৈতিক আচরণে উন্মত্ততাকে প্রাধান্য দেয়াও খুবই মারাত্মক।
পাকিস্তানের উন্মত্ততার বিপক্ষে বলিষ্ঠ আওয়াজ তুলতে বিশ্ব বিবেকের কাছে সনিবন্ধ অনুরোধ জানিয়ে আমি এই বক্তব্য শেষ করছি।
-এ, এম, এ, মুহিত