You dont have javascript enabled! Please enable it! 1952.02.21 | ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারীঃ ভাষা আন্দোলনের ঘটনালী | দৈনিক আজাদ - সংগ্রামের নোটবুক

১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারীঃ ভাষা আন্দোলনের ঘটনালী
দৈনিক আজাদ
২১-২৮ ফেব্রুয়রী, ১৯৫২

ফেব্রুয়ারী ২১ ঢাকায় ১৪৪ ধরা জারী একমাসে জন্য সভা-শোভাযাত্রা নিষিদ্ধ ঢাকার জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট গতকল্য (বুধবার) ১৪৪ ধারার আদেশ জারী করিয়া এক মাসের জন্য ঢাকা শহরে সভা, শোভাযাত্রা প্রভৃতি নিষিদ্ধ করিয়াছেন। আদেশজারীর কারণস্বরূপ তিনি বলেন যে, একদল লোক শহরে সভা, শোভাযাত্রা ও বিক্ষোভ প্রদর্শনের প্রয়াস পাওয়ায় এবং তদ্বারা জনসাধারণের শান্তি ও নিরাপত্তা বিনষ্ট হওয়ার আশংকা থাকায় এই ব্যবসস্থা অবলম্বিত হইয়াছে। কোতোয়ালী, সূত্রাপুর, লালবাগ, রমনা ও তেজগাঁও থানার অন্তর্গত সমুদয় এলাকায় ইহা প্রবর্তিত হইয়াছে। ফেব্রুয়ারী ২২ (স্টাফ রিপোর্টার) গতকল্য (বৃহস্পতিবার) বিকাল প্রায় ৪টায় ঢাকা মেডিক্যার কলেজ হোষ্টেল প্রাঙ্গণে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবীতে বিক্ষোভরত ছাত্রদের উপর পুলিশের গুলি চালনার ফলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এম এ ক্লাশের ছাত্র মোহাম্মদ সালাহউদ্দীন (২৬) ঘটনাস্থলে নিহত এবং বহু সংখ্যক ছাত্র ও পথচারী আহত হয়। আহতদের মধ্যে ২০ জনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। রাত্রি ৮ টার পর আহতদের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবদুল জব্বার (৩০) আবুল বরকত (২৫) ও বাদামতলি কমার্শিয়াল প্রেসের মালিকের পুত্র রফিকুদ্দীন আহমেদের (২৭) মৃত্যু হয়। আহতদের মধ্যে ৫ জনের অবস্থা আশংকাজনক বলিয়া জানা গিয়াছে। এইদিন সকাল ৯টা হইতে শহরের স্কুল-কলেজের ছাত্র ছাত্রীগণ রাষ্ট্রভাষা বাঙলা দাবীতে ও শহরে ১৪৪ ধারা জারীর প্রতিবাদে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে শান্তিপূর্ণভাবে এক সভার আয়োজন করে। পরিষদে চলতি অধিবেশনে যোগদানকারী সদস্যদিগকে রাষ্ট্রভাষার ব্যাপারে পূবর্ব পাকিস্তানের জনগণের মনোভাব সম্পর্কে ওয়াকেফহাল করানোই এই সভার উদেশ্য ছিল বলিয়া সভার উদ্যেক্তাদে নিকট হইতে জানা গিয়াছে।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গনে সভা চলিতে থাকার সময় হইতে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার চতুর্দিকে রাইফেলধারী পুলিশ মোতায়েন থাকিতে দেখা যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইস চ্যান্সেলার ও বিভাগীয় ভীনগণ ঘটনার সময় বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গনে উপসিস্থত ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণ হইতে ছাত্রগণ বেলা ১১টায় গেটে আসিয়া উপস্থিত হয় এবং তাহাদিগকে ছোট ছোট দলে বিভক্ত হইয়া রাস্তায় বাহির হইতে দেখা যায়। এই সময় পাহারারত পুলিশগণ বিশ্ববিদ্যালয গেটে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণে কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করে। ফরে কিছুসংখ্যক ছাত্র দৌড়াইয়া রাস্তার অপর পার্শ্বে বিশ্ববিদ্যালয় ময়দানে আশ্রয় গ্রহন করে এবং কিচু সংখ্যক ছাত্রকে দৌড়াইয়া মেডিকেল কলেজের দিকে যাইতে দেখা যায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে সমবেত অবিশিষ্ট ছাত্রগণ ঘেরাও করা এলাকার মধ্যে কাদানে গ্রাস নিক্ষেপের রুিদ্ধে দারুণ বিক্ষোভ প্রকাশ করে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলরের (যিনি এই ঘটনার সময় ঘটনাসস্থলে উপস্থিত ছিলেন) নিকট পুলিশের এই আচরনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায়। গুলী চালনা সম্পর্কে তদমেত্মর আশ্বাসঃ পরিষদে জনাব নুরুল আমিনের বিবৃতি গতকল্য (বৃহস্পতিবর) পূর্ববঙ্গ পরিষদের অধিবেশন আরম্ভ হওয়ার অব্যবহিত পরে পরিষদে সংগ্রেস দলের ডেপুটি লীডার মিঃ ধীরেন্দ্ৰ নাথ দারী করেন যে, পরিষদের নেতাকে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করিয়া মিঃ দত্ত বলেন যে, ১৪৪ ধারা ভংগ না করিয়া ছাত্রগন যখন মেডিক্যল কলেজ হোষ্টেলের সীমানার মধ্যে দিয়া বিক্ষোভ প্রদর্শন করিতেছিল পুলিশ তখন তাহদের উপর গুলিচালায়। মিঃ মনোরঞ্জন ধর (কংগ্রেস) ও জনাব আবদুর রশিদ তর্কবাগীশ (মোছলেম লীগ) মিঃ মনোরঞ্জন ধরের দাবী সমর্থন করেন। জনাব নুরুর আমীন জওয়াব প্রদানের জন্য দন্ডায়মান হইলে জনাব তর্কবাগীশ দাবী করিতে থাকেন যে, জনাব তর্কবাগীশ স্বীয় আসন গ্রহনে অসম্মত হন। স্পীকার জনাব আবদুল করিম হাঁহাকে বলেন যে, পরিষদের অন্যান্য সদস্যকে তাহার (তর্কবাগীশ) সুযোগদান করা কৰ্ত্তব্য অন্যথায় তাহাকে বাধ্য হইয়া নিয়মানুযায়ী ব্যবস্তা অবলম্বন করতে হইবে। অন্যান্য সদস্রের অনুরোধে তিনি (তর্কবাগীশ) আসন গ্রহণ করেন। প্রধানমন্ত্রী জনাব নুরুল আমীন পরিষদ সদস্যের এই মর্মে আশ্বাস দেন যে, তিনি নিশ্চয়ই বিক্ষোভ প্রদর্শনকরী ছাত্রদের উপর পুলিশের গুলী চালনার দতন্ত করিবেন। ভাইস চ্যান্সেলরে বিবৃতি গতকল্য (বৃহস্পতিবার) বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে চাত্রদের উপর পুলিশ কর্তৃক কাঁদানে গ্রাস প্রয়োগ সম্পর্কে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর আজাদের প্রতিনিধির এ প্রশ্নোত্তরে বলেন যে, ছাত্রদল তাঁহার নিকট আসিয়া চাহেন। পুলিশ কর্তৃপক্ষ ভাইস-চ্যান্সেলরকে বলেন যে, ছাত্রদর তাহদের প্রতি প্রস্তর খন্ড নিক্ষেপ করায় এবং তাহাদের গাড়প্রিস্তর দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত করায় তাহারা কাঁদুনে বোমা নিক্ষেপ করিতে বাধ্য হইয়াছিল। অপর এক প্রশ্নের উত্তরে ভাইস-চ্যান্সেলর বলেন যে, বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে তাঁহার উপস্থিত থাকাকালে তিনি ছাত্রদের মধ্যে কোন…। ঢাকা, ২১ শে ফেব্রুয়ারী। -ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জানাইয়াছেন যে, অভাবিত পূর্ব পরিস্থিতির উদ্ভব হওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন হইবে বলিয়া স্থির হইয়াছিল। তাহা স্থগিত রাখাহইয়াছে, সমাবর্তনের তারিখ পরে ঘোষনা করা হইবে। এ, পি, পি
পুলিশ ও সেনাদের গুলিতে ৪জন নিহত ও শতাধিক ব্যক্তি আহতঃ সাত ঘন্টার জন্য কারফিউ জারী শহীদদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপনার্থে শহরে স্বর্তস্ফুহর্ত হরতাল পালন (স্টাফ রিপোর্টার) বৃহস্পতিবারের শোচনীয় ও ভায়াবহ ঘটনা বিস্মৃত হইতে না হইতে গতকল্য (শুক্রবর) জুম্মার দিন আর একবার ঢাকার মাটি শিশু ও ছাত্রের রক্তে লাল হইয়া উঠে। সেদিনকার ঘটনার নিহত ব্যক্তিদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপনার্থে শান্তিপূর্ণ মিছিল বাহির করিয়া পুলিশ ও সৈন্যদের গুলীর আঘাতে নাগরিকদের ৪ জনকে প্রাণ বিসর্জন দতে হয় এবং শতাদিক আহত ব্যক্তি হাসপাতালে নিতে হয়। ইহাদের মধ্যে ৪৫ জনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তাহদের ১৫ জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক বলিয়া জানা গিয়াছে। গতকল্য সমস্ত ঢাকা শহরে উত্তেজনাময় পরিস্থিতি বিরাজ করিতে থাকে। সারা শহরটি আপাতঃদৃষ্টিতে একটি সামরিক ছাউনী বলিয়া প্রতীয়মান হইতে থাকে বিভিন্ন সস্থানে ছাত্র ও জনসাধারণের মিলিত শোভাযাত্রার উপর পুলিশ ও সৈন্য বাহিনী বারম্বার লাঠিচার্জ ও গুলীবর্ষণ করে। সকাল হইতেই মৃত, আহত ও মুমূর্ষ ব্যক্তিগণকে লইয়া এমুলেন্স গাড়ীগুলি মেডিকেল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতালে আসিতে থাকে। কয়েকটি স্থান হইতে মৃত ও গুরুতররূপে আহত কয়েকজনকে পুলিশ ভ্যানে তুলিয়া লইতে দেখ যায় বলিয়া প্রত্যক্ষদশীর নিকট হইতে জানা গিয়াছে। এইদিন সমগ্র শহরে সমস্ত দোকানপাট বাজার ঘাট সম্পূর্ণভাবে বন্ধ থাকে। অফিস-আদালত এমনকি সেক্রেটারিয়েটের কর্মচারীগণও স্বতঃস্ফূর্তভাবে কর্মে যোগদান হইতে বিরত থাকিয়া বিভিন্ন সস্থানে শোভাযাত্রা ও বিক্ষোভে অংশ গ্রহণ করে। শহীদ ছাত্রদের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের জন্য শহরের আবার বৃদ্ধ সকলে অবিরামভাবে বিভিন্ন মসজিদে জমায়েত হন এবং গায়েবানা জানাজার নামাজ আদায় করেন। পূর্বদিনের ঘটনায় শহরবাসী প্রতিটি নর-নারী বিষন্ন মনে গতকল্যকার প্রতিটি মুহুর্তের ঘটনা-দুর্ঘটনার অপেক্ষা করিতে থাকে। পুলিশ এইদিন মোট ৫২ জনকে গ্রেফতার করেন। এইদিন মেডিক্যাল কলেজ হোষ্টের প্রাঙ্গনে জনাব এ কে, ফজলুর হকের উপস্থিতিতে শহীদদের রুহের মাগফেরাত কামনার পর বেলা প্রায় সাড়ে ৩ টায় ছাত্র ও জনসাধারণের এক বিরাট শোভাযাত্রা হোষ্টেল প্ৰাংগন হইতে হাইকোর্ট পর্যন্ত পৌছিলে পুলিশ ও সৈন্যরা তাহদের উপর লাঠিচার্জ ও পরে গুলীবর্ষণ করে ফলে ঘটনাস্থরে কয়েকজন আহত হয় ছত্ৰভংগ ছাত্রগণ পুনরায় নাজিমুদ্দিন রোডে সমবেত হইয়া শোভাযাত্রা সহকারে চকবাজার, মিটফোর্ড, ইসলামপুর হইয়া সদরঘাটে জগন্নথ কলেজের নিকট পৌছিলে পুলিশ শোভাযাত্রার উপর পরপর তিনবার লাঠি চার্জ করে। চকবাজার এলাকা দিয়া যাইবার সময় স্থানীয় দোকানদার ও জনসাধারন দলে দলে যোগদান করায় শোভাযাত্রার কলেবর বহুগুণে বৃদ্ধি পায়।
মুসলিম হলের দিকে যাইবার সময় শোভাযাত্রাটির কিছু সংখ্যক লোক আজাদ অফিসের কর্মচারীদের উপর প্রস্তর নিক্ষেপ করিয়া শাসাইতে । আজাদ কর্তৃপক্ষ ও কচারীগন কর্তৃক ছাত্রদের দাবী সম্পর্কে যাসাধু চেষ্টা করা কতিপয় ছাত্রকর্মীর হস্তক্ষেপের ফলে ও তাহদের পরামর্শে বিক্ষোভকারীগণ ক্ষান্ত হইয়া সম্মুখে অগ্রসর হয়। পলাশী লেবেল ক্রসিং-এর নিকট পৌঁছিলে পুলিশ হাতাদের উপর লাঠিচার্জ করে। মেডিক্যাল কলেজ গতকল্য (শুক্রবার) সকাল অনুমান দশ ঘটিকার সময় মেডিক্যাল কলেজ প্রাঙ্গণে গত পরশুর নিহত ছাত্রদের গায়েবানা জানাজা সমাপন করা হয় । এই অনুষ্ঠানে জনাব এ, কে, ফজলুল হক উপস্থিত চিলেন। অতঃপর সেখান হইতে প্রায় পাঁচ হাজার ছাত্র ও স্থানীয় জনসাধারণের একটি মিছিল শোভাযাত্রা বাহির করা হয়। উক্ত শোভাযাত্রাকে কোনরূপ বাধা প্রদান করে নাই । ছাত্র ও নাগরিকদের এই শোভাযাত্রীদের মধ্যে কোনরূপ উচ্ছংখলতা দেখা যায় নাই। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার দাবীতে এবং পুলিশের গুলীবর্ষণের বিরুদ্ধে নানারূপ ধ্বনি তাহাদিগকে বাধা প্রদান করে। এই শোভাযাত্রার সহিত বহু সরকারী কর্মচারীকেও অংশ গ্রহন করিতে দেখা যায়। হাইকোর্টের নিকট পুলিশ ও সামরিক বাহিনী শোভাযাত্রার পর লাঠি ও গুলী চালায় এবং তাড়া করিয়া হাইকোর্টের ভিতর লইয়া যায়। এখানে কয়েকজন গুরুতররূপে আঘাত পান। ইহা সত্ত্বেও শোভাযাত্রাটি শান্তিপূর্ণভাবে নওয়াবপুরের দিকে যাইবার চেষ্টা করে এবং শোভাযাত্রাটি সম্মুখভাগ ফজলুল হক হলের পাশ্ববর্তী রাস্তা ধরিয়া বেশ কিছুটা অগ্রসর হয় এই সময় পুলিশ বাহিনী তাহাদিগকে দৃঢ়তার সহিত বাধা প্রদান করে। শোভাযাত্রাটির সম্মুখভাগে নিহত ও আহতদের রক্তমাখা জামা-কাপড় ইত্যাদি দেখান হইতেছিল। শোভাযাত্রাটি প্রতিকারের দাবীসূচক ধ্বনি করিতে করিতে নওয়াবপুর রোড দরিয়া সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে ছাত্রগণ কর্তৃক আহত গায়েবানা জানাজায় যোগদানের জন্য অগ্রসর হইতে থাকে। পথে রায়সাহেব বাজারের নিকটস্থ মসজিদে বহুসংখ্যক নাগরিককে শহীদদের গায়েবানা জানাজা সমাপনের জন্য জমায়েত হইতে দেখা যায় । গতকল্যকার ঘটনার বিশেষত্ব হইল এই যে, সৈন্যগণকে অনেকক্ষেত্রে সঙ্গীনের খোঁচার বিক্ষোভকারীগনকে যালে করিতেও দেখা যায়। রাস্তার মোড়ে দলে দলে সৈন্য ও পুলিশ মোতায়েন থাকিতে দেখা যায়। পরিষদ ভবনের পূর্ব-দক্ষিণ কোণে সৈন্যগণকে দুইটি মেশিনগান পাতিয়া বসিয়া থাকিতে এব অন্যান্য আগ্নেয়াস্ত্র লইয়া ঘোরাফেরা করিতে দেখা যায়। একদল সৈন্যকে একটি মেশিনগান, কতকগুলি করিয়া টমিগান, ব্রেনগান ও বেয়নেটসহ রাইফেল লইয়া মেডিক্যার কলেজ হাসপাতালের সম্মুখে টহল দিতে দেখা যায়। শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের নিদর্শন স্বরূপ শহরের প্রতিটি ছাত্রাবাসে, এমনকি কোন কোন গৃহেও পতাকা অর্ধনমিত রাখা হয় এবং শহরবাসী কালোব্যাজ পরিধান করেন। নওয়াবপুর রোডের ঘটনা গতকল্য সকার হইতেই শহরের প্রদান রাস্তা নওয়াবপুরের উপর লোকের ভীড় জমিতে থাকে। মোড়ে মোড়ে জনসমাগম হয় নওয়াবপুর রোডে যান চলাচলেও বাধা দেওয়া হয়।
সাইকেল ও মোটর-সাইকেলের চাকার হাওয়া ছাড়িয়া দেওয়া হয় পরে দশটা সাড়ে দশটার সময তথায় সামরিক যান ব্যতীত বেসামরিক যান চলাচল একরূপ বন্ধ হইয়া যায়। এই রাস্তায় পুলিশের পরিবর্তে সামরিক লোকদের নিয়োগ করা হইয়াছিল। তাহারা অস্ত্ৰ শস্ত্রসহ পায়ে হাঁটিয়া এবং ট্রাকে করিয়া রাস্তায় টহল দিত থাকে। রথখোলার মোড়ে এক ট্রাক সশস্ত্র রক্ষীকে মোতায়েন করা হয়। এদিকে নওয়াবপুরের জনতা ছোট ছোট শোভাযাত্রাসহ “রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই” শ্লোগান দিয়ে উত্তর দিকে অগ্রসর হইতে থাকে। তাহারা কাপ্তান বাজারের মোড়ে পৌছিলে ঐ সস্থানে অপেক্ষারত সশস্ত্র পুলিশ বাহিনী তাহাদের লক্ষ্য করিয়া এক রাউন্ড গুলী ছুড়ে। প্রকাশ, ঐ গুলবির্ষণের ফলে কেহ হতাহত হয় নাই। নওয়াবপুর রাস্তার উভয় দিকের সমস্ত দোকান সম্পূর্ণরূপে বন্ধ থাকে। প্রতিটি বাড়ীর বারান্দা ও পথিপার্শ্বে জনসাধারণ শান্ত ও বিষাদপূর্ন নেত্ৰে দাঁড়াইয়া রাস্তার হালচাল লক্ষ্য করিতে দেখা যায়। বেলা প্রায় এগারটার সময় রথখোলা ও নিশাত সিনেমা হরের মোড়ের মধ্যবর্তী স্থানে একটি চলতি সামরিক ট্রাক হইতে অপেক্ষামাণ নিরীহ পথচারদদের উপর বেপরোয়াভাবে গুলী চালান হয় বলিয়া জানা গিয়াছে। ফলে একজন যুবক ঘটনাস্থলেই নিহত এবং দুইজন আহত হয়। আহতদের মধ্যে একটি বালককে বেয়নেট দ্বারা মাথায় আঘাত করা হয় বলিয়া জানা গিয়াছে । আরও প্রকাশ, সামরিক ট্রাকে করিয়া তাহদের লইয়া যাওয়া হয়। সকালের দিকে নওয়াবপুরের বিভিন্ন স্থানে সামরিক লোকজন বিক্ষিপ্তভাবে গুলী চালায়। গতকল্য সেক্রেটারিয়েট ভবনে অতি অল্পসংখ্যক কৰ্মচারী কার্য্যে যোগদান করেন। যাহারা উপস্থিতি ছিলেন তাহাদের মধ্যে অনেককে কোন কাজ করিতে দেখা যায় না। গতকল্য রেল হাসপাতালের নিকট একখানি এ্যাম্বুলেন্সে চাপা পড়িয়া এক যুবকের মৃত্যু হয়। অপরাহ্নে মুসলিম হল হইতে এক বিরাট জনতা পরিষদ ভবনের দিকে নানা প্রকার ধ্বনি সহকারে শান্তি পুনভাবে অগ্রসর হয়। তাহারা পরিষদ ভবনের নিকটবর্তী হইলে পুলিশ তাহদের উপর তীব্রভাবে লাঠিচাজ করে। তাহার তখন ইঞ্জনিয়ারিং কলেজ সীমানার মধ্যে প্রবেশ করে এবং তথা হইতে নুরুল আমিন মন্ত্রিসভার বিরুদ্ধে ও পুলিশ জুলুমের বিরুদ্ধে বিক্ষোপ প্রদর্শন করিতে থাকে। বৈকালে মুসলিম হলের নিকটও লাঠিচার্জ হয়। অপরদিকে মেডিক্যাল কলেজ হোষ্টেলের মধ্যে বহু ছাত্র জমায়েত হয় এবং মাইকযোগে বক্তৃতা করিতে শোনা যায়। বৈকালে যখন তাহারা বক্তৃতা করিতেছিলেন, এমন সময় পুলিশ এবং সৈন্যগণ হোষ্টেলের মধ্যে প্রবেশ করিয়া রুমের অধিকারী জনাব আবুল হাশেমকে বেয়নেটের খোঁচার ভয় দেখাইয়া মাইক কাড়িয়া লয় এবং কামরায় প্রবেশ করিয়া পেন, ঘড়ি ও রেডিও সেট লইয়া যায় বলিয়া উক্ত কামরার মালিক জনাব আবুল হাশেম জানান। পুলিশ ও সৈনিক দলের এই জুলুমের প্রতিবাদে গতকল্য সার্জেন জেনারেলের সভাপতিত্বে মেডিকের কলেজে এক সভা হয়। জানা গিয়াছে যে, উক্ত সভায় সার্জেন জেনারেল পুলিশ জুলুমের বিরুদ্ধে যথারীতি ব্যবস্থা অবলম্বন করা হইবে বলিয়া ছাত্রদিগকে আশ্বাস দেন। আরও জানা গিয়োছে যে, গতকল্য সার্জেন জেনারেল ও কলেজের ভাইস প্রিন্সিপাল ডাঃ এ,কে, এম আবদুল ওয়াহেদ এই বিষয়ে আলোচনার জন্য প্রধানমন্ত্রীর সহিত সাক্ষাৎ করেন। জুবিলী প্রেসে অগ্নিসংযোগ গতকাল জনসন রোডস্থ জুবিলী প্রেসে অগ্নিসংযোগ করার দরুন উহা সম্পূর্ণ ভস্মীভহহ হইয়া যায়। দমকল প্রায় দেড়ঘন্টাকাল আগুন নিবাইবার কার্যে নিয়োজিত থাকে। উক্ত প্রেস হইতে মনি নিউজ পত্রিকা মুদ্রিত হইত।
শহীদদের রুহের মাগফেরাৎ কামনা গতকল্য শুক্রবার শহরে প্রত্যেক সমজিদে জুম্মার নামাজের পর শহীদদের আত্মার মাগফেরাত কামনায় হাজার হাজার মুসল্লী শরীক হন। অপরাহ্নে প্রায় ৩/৪ জন মুসল্লী করবস্থান হইয়া সলিমুল্লা মুসলিম হরে জমায়েত হয়। জুম্মার নামাজের পর সলিমুল্লা মুসলিম হলে এক বিরাট জনতার উপস্থিতিতে কোরান তেলাওয়াতের পর এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় বিভিন্ন বক্তা সকাল বেলায় পুলিশ ও সামরিক বাহিনী কর্তৃক এক বিরাট মিলিলে শান্তিপুর্ণভাবে যোগদানকারী জনতা উপর বেপরোয়াভাবে গুলী চালানোর তীব্র প্রতিবাদ করেন। তাঁহারা গতকল্যকার শোচনীয ও মর্মম্ভদ দুর্ঘটনার কথা উল্লেখ করিয়া পুলিশ বাহিনীর অত্যাচারের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জ্ঞাপন করেন এবং জনসাধারণকে এই অত্যাচারের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা অবলম্বন করিতে অনুরোধ করেন। তাঁহারা আরও বলেন যে, বহু ছাত্রকে গুরুতর আহত অবস্থায় মেডিক্যাল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতালে ভর্তি করা হইয়াছে। তাহদের চিকিৎসার জন্য রক্তের প্রয়োজন ব্লাড ব্যাংকে অকাতরে রক্তদান করিতে হাঁহারা অনুরোধ জানান। অতঃপর বক্তাগণ শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন চালাইয়া যাইতে অনুরোধ করেন। বৃহস্পতিবারের ঘটনা সম্পর্কে শহরে প্রবল গুজব রটে যে, ঐদিন ৪ জনেরও বেশী লোক নিহত হয়, কিন্তু ঘটনার সংগে সংগেই তাহদের মৃতদেহ সরাইয়া ফেলা হয় । একটি কিশোর বয়স্ক বালক সম্বন্ধে অনুরূপ গুজব শনিয়া বিশেষ অনুসন্ধানের পর জানা যায় যে বালকটি মেডিক্যাল কলেজ ও পরিষদ ভবনের মধ্যে ফুলার রোডে গুলীর আঘাতে নিহত হয় এবং তার লাশ অপসারিত হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের কতিপয় পোষ্টগ্রাজুয়েট ছাত্রীর নিকট হইতেও ইহার সমর্থন পাওয়া গিয়াছে। পুর্ববংগ সরকারের এশতেহার শহরে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সভায় প্রস্তাব গ্রহণ ঢাক, ২২ শে ফেব্রুয়ারী । -অদ্যকার ঢাকা শহরের অবস্থা সম্পক্তে পূবর্ববংগ সরকারের এক এশতেহারে কলা হইয়াছে যে অদ্য অপরাহ্নের পরে শহরের অবস্থা অনেকটা আয়ত্তে আসে। অদ্য নওয়াবপুর রাস্তায় পুলিশের গুলী চালনার পর মোট ৪৫ জন আহত ব্যক্তিকে হাসপাতারে স্থানান্তরিত করা হয়। ২ জন নিহত হয়। এশতেহারে বলা হইয়াছেঃ অদ্য সকালের দিকেই অবস্থা খারাপ হইয়া উঠে এবং ইসলামপুর ও নওয়াবপুর এলাকায় লোকজনের ভীড় হয় গুন্ডা শ্রেণীর লোকেরা এই অবস্থার সুযোগ গ্রহন করিয়া লুটতরাজের উদ্দেশ্যে জনতার সহিত মিশে। অবস্থা যাহাতে আরও খারাপ না হইতে পারে তদুদ্দেশ্যে পুলিশ বাহিনীর সাহার্য্যার্থে সৈন্য বাহিনী আনয়ন করা হয় মর্নিং নিউজ প্রেসটি জনতা পোড়াইয়া দেয়। কার্জন হল, হাইকোর্ট, নওয়াবপুর রোড, বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা প্রভৃতি স্থানে উচ্ছঙ্খল জনতাকে বিচ্ছিন্ন করার জন্য পুলিশের লাঠিচার্জ ও গুলী চালনার ফলে আহত মোট ৪৫ জনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ২ ব্যক্তি নিহত হয়। নিরস্ত্র ছাত্র সমাবেশের উপর পুলিশের গুলীবর্ষণের নিন্দা গত ২১ শে ফেরুয়ারী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিক্যাল কলেজ প্রাঙ্গনে নিরীহ ও নিরস্ত্র ছাত্রসমাবেশের উপর পুলিশের অমানুষিক অত্যাচার ও গুলীবর্ষণের নিন্দা করিয়া শহরের বিভিন্ন স্থানে ও প্রতিষ্ঠানের সভায় নিন্দাজ্ঞাপক প্রস্তাব গৃহীত হয় । বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কতিপয় প্রস্তাব ও কয়েকজনের বিকৃতি নিমেণ প্রদান করা হইলঃ

হইকোর্ট বার-এসোসিযেশনের সভা গতকল্য (শুক্রবার ) জনাব এ,কে, ফজলুল হকের সভাপতিত্বে ঢাকা হাইকোর্ট বার এসোসিয়েশেনের এক জরুরী সভায় গত ২১ শে ফেব্রুয়ারী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণের মধ্যে নিরস্ত্র ও শান্তিপূর্ণ ছাত্র সমাবেশের উপর পুলিশের গুলীবর্ষণের ফলে উদ্ভহত পরিস্থিতিতে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। বিনা কারণে শহরে ১৪৪ ধারা জারী করায় এই সভা সরকারের নিন্দা করিয়া ও অবীলম্বে ইহার প্রত্যাহার দাবী করিয়াও প্রস্তাব গ্রহন করে। এই সভা জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট ও অন্যান্য পুলিশ কর্মচারীদের অপসারণ এবং রিপেক্ষ তদন্ত কমিশন গঠনের দাবী জানাইয়া আর একটি প্রস্তাব গ্রহণ করে। এই সভা নিহত ও আহতদের শোকসন্তপ্ত পরিবার পরিজনদের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করিয়া ব্যবস্থা পরিষদ ও গনপরিষদের এই প্রদেশের সদস্যদের নিকট বাংরাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্র ভাষা করার জন্য অবিলম্বে ব্যবস্থা গ্রহনের দাবী জানায়। জনাব আবুল হাশেমের বিবৃতি যুক্তবাংলার প্রাক্তন মুসলিম লীগ সেক্রেটারী জনাব আবুল হাশেম এক বিবৃতিতে বলেন যে আজিকার সভ্যজগতে কোন সভ্যদেশের সরকরী অফিসারগণ কি করিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষের বারংবার নিষেধ সত্তেও বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ প্রাঙ্গণের মধ্যে নিরস্ত্র ছাত্র ও যুবকদের উপর বেপরোয়াভাবে গুলী চালাইয়া তাহদের জানা যায় যে, পুলিশই প্রথমে আক্রমন চালায়। ছেলেদের বুলেটের আঘাতে দাবাইয়া রাখার সরকারী সিদ্ধান্তকে নগ্ন বর্বরতারই পরিচায়ক বলা যাইতে পারে। গত বৃহস্পতিবার ও শুক্রবারের মার্মান্তিক ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিরা যে আল্লাহ ও জনসাধারণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষনা করিয়াছেন সে বিষয়ে কোনই সন্দেহ নাই। নির্লজ্জ সরকরী জয়ঢাক ঢাকার মর্নিং নিউজ পত্রিকায় রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের উপর সাম্প্রদায়িকতার ছাপ দেওয়ার জন্য জঘন্যভাবে চেষ্টা করা হইয়াছে। উহাতে বলা হইয়াছে যে ছাত্রদের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি করার জন্য পূর্ববংগের হিন্দু এম-এল-এ রাই দায়ী এবং হিন্দু মারোয়াড়ী ও অন্যান্য ভরতীয় ব্যবসায়ী স্বার্থের প্রভাবেই নারায়ণগঞ্জে হরতাল সাফল্যমন্ডিত হইয়াছে। সত্যকে সাহসের সহিত জনসাধারনের সম্মুখে তুলিয়া দেওয়ার জন্য আমি মিল্লাত, আজাদ ও ইনসাফ পত্রিকার প্রতি অভিনন্দন জানাইতেছি। এই দুই দিনে আমরা দেশের কয়েকজন শ্রেষ্ঠ তরুণ ও ছাত্রকে হারাইয়াছি। তাহদের পবিত্র স্মৃতি পূর্ববংগের জনসাধারনকে চিরদিনই অনুপ্রেরণা যোগাইবে। মাওলানা ভাসানীর বিবৃতি পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের সভাপতি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী তাহার বিবৃতিতে বলেন, কর্তৃপক্ষ কি করিয়া এপ নির্মম ব্যবস্থা অবলম্বন করিতে পারেন তাহা আমার পক্ষে বুঝা শক্ত। প্রতিবাদ দিবসের প্রাক্কালে ১৪৪ ধারা জারী করার কোনই যৌক্তিকতা ছিল না। এই বিষয়ে আর বেশী কিছু আলোচনা না করিয়া ঘটনার জন্য আমি একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত এবং অপরাধীদের প্রকাশ্য বিচারের জন্য দাবী করিতেছি।
নিরাপত্তা বন্দীদের অনশন ধর্মঘটঃ স্বাস্থ্যের অবনতি সম্পর্কে মাওলানা ভাসানী নিরাপত্তা বন্দীদের অনশন ধর্মঘট সম্পক্তে মওলানা আবদুল হামিদ খান বাসানী নিমণলিখিত বিবৃতি দিয়েছেনঃ “আমি জানিতে পারিয়াছি যে, গত ১৬ই ফেব্রুয়ারী হইতে নিরাপত্তা বন্দী শেখ মুজিবুর রহমান ও মহীউদ্দীন আহমদ অনশন ধর্মঘট শুরু করিয়াছেন। জনসাধারণ অবগত আছেন যে, শেখ মুজিবুর রহমান দীর্ঘদিন হইতে মারাত্মক রোগে বুগতে ছিলেন এবং কিছুদিন পূর্বে চিকিৎসার জন্য তাঁহাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালেও স্থানান্তরিত করা হইয়াছিল। কিন্তু তাঁহাকে রোগ মুক্তির পূর্বেই আবার জেরে প্রেরণ করা হয়। মহীউদ্দীনের স্বাস্থ্যও দ্রুত অবনতির দিকে যাইতেছে। এমতাবস্থায় আমরা সকলেই বুঝিতে পারিতেছি যে, এই অনশন ধর্মঘট তাঁহাদের ভগ্ন স্বাস্থ্যের কি পরিনতি ঘটাইবে। তাঁহাদিগকে আটক রাখার সম্বন্ধে কর্তৃপক্ষের অনমনীয় মনোভাব দেখিয়া আমি অতন্ত মৰ্ম্মাহত হইয়াছি। আমি মানবতার নামে সরকারের নিকট এই আবেদন করিতেছি যে, অন্ততঃ আশংকাজনক স্বাস্থ্যের দিকে চাহিয়াও যেন তাঁহারা মুজিবুর রহমান ও মহীউদ্দীনকে মুক্তি দান করেন। পুলিশের গুলীবর্ষণের প্রতিবাদে কুমিল্লায় জনসভা কুমিল্লা, ২২ শে ফেব্রুয়ারী । ঢাকয় ছাত্রদের উপর পুলিশের বেপরোয়া গুলীবর্ষণের প্রতিবাদে অদ্য কুমিল্লা টাউনহল প্রাঙ্গনে জনাব জহিরুল হক বিএল সাহেবের সভাপতিত্বে এক বিরাট জনসভা হয়। সভায় পুলিশের ববর্বরোচিত তীব্র সমালোচনা করা হয়। ইহা ছাড়া কুমিল্লায় শোভাযাত্রী ছাত্রদের উপর স্থানীয় মোহাজেরদের আক্রমন ও ছাত্রদিগকে মারপিটের বিরুদ্ধে তীব্র ঘৃণা ও অসন্তোষ প্রকাশ করা হয়। সভায় নুরুল আমীন মন্ত্রিসভার পদত্যাগ, বাংলাকে রাষ্ট্রভাসার মর্যাদা দান, মোহাজেরদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহন দাবী করা হয়। সভায় মোহাজেরদের সামাজিকভাবে বয়কটের সিন্ধান্ত করা হয়। ঢাকায় সান্ধ্য আইন ঢাকার জিলা ম্যাজিষ্ট্রেট লালবাগ, কোতোয়ালী ও সূত্রাপুর থানায় শুক্রবার রাত্র ১০টা হইতে ভোর ৫টা পর্যন্ত সান্ধ্য আইন জারী করিয়াছেন। বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার জন্য পূবর্ববংগ ব্যবস্থা পরিষদের সুপারিশ গতকল্য (শুক্রবার)অপরাহ্নে ব্যবস্থা পরিষদে সবর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত এক প্রস্তাবে গণপরিষদের নিকট বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করিবার সুপারিশ করা হয় প্রধানমন্ত্রী জনাব নুরুল আমীন প্রস্তাবটি উত্থাপন করেন। এই সম্পর্কে আনীত সমুদয় সংশোধনী প্রস্তাব বাতিল হয়। উক্ত সুপারিশ সংক্রান্ত দুইটি সংশোধনী প্রস্তাব সম্পর্কে পরিষদে ভোট গৃহীত হয় । ইহার মধ্যে একটি মিঃ মনোরঞ্জন ধর (কংগ্রেস ) এবং অপরটি জনাব শামসুদ্দিন আহমদ (অদলীয়) উত্থাপন করেন। এই সময় জনৈক সদস্য জনাব নুরুল আমীনের দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়া বলেন যে, শহরে সান্ধ্য আইন জারী করা হইয়াছে। জনাব নুরুল আমীন বলেন যে, পরিস্থিতিদৃষ্টে প্রয়োজন হইলে সরকার সান্ধ্য আইন জারী করার সিদ্ধান্ত করিয়াছেন। তিনি বলেন যে, দুস্কৃতকারীরা অস্বাভাবিক পরিস্থিতির সুযোগ কে কাজে লাগাইবার উপক্রম করিয়াছে। সুতরাং নাগরিকদের জানমাল রক্ষা করা দরকার।
প্রস্তাব উস্থাপনের চেষ্টা করেন কিন্তু পরিষদ উহার অনুমতি দেন নাই। আগামী সোমবার বেলা ৩-৩০ মিঃ পর্যন্ত পরিষদের অধিবেশন মুলতবী আছে। প্রস্তাব পাশ করিয়া জনাব নুরুল আমীন বলেন যে, বৃহস্পতিবার সরকার যে ব্যবস্থা অবলম্বন করেন, তাহা রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কিত দাবীর বিরোধী বলিয়া মনে করায় নানারূপ ভ্রান্ত ধারণার সৃষ্টি হইয়াছে। তিনি বলেন যে, সেরূপ বিরোধিতা করার ইচ্ছা সরকারের নাই। শহরে ১৪৪ ধারা জারীর কারণ ব্যাখ্যা করিয়া তিনি বলেনঃ সরকার জানিতে পারিয়াছে যে, কোনও কোনও লোক শহরের স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে আচল করিয়া ফেলিতে চায়। তিনি বলেন যে, পূর্ববর্তী অন্যান্য সময়ে ছাত্ররা যখন মিছিল বাহির করে সরকার তখন উহাতে হস্তক্ষেপ করেন নাই। তিনি বলেন যে, উদ্দেশ্য যতই মহৎ এবং বাঞ্চনীয় হউক না কেন, যাহাতে শান্তি ও শৃঙ্খলা ভংগ না হয় তৎপ্রতি সরকারকে দৃষ্টি রাখিতে হইবে। স্বাস্থ্য সচিব জনাব হাবিবুল্লাবাহার এবং জনাব সরফউদ্দিন আহমদ জনাব নুরুল আমীনের বিষেশ প্রস্তাবটি সমর্থন করেন। জনাব আহমদ বলেন যে, প্রস্তাবটি পাশ হইলে বিক্ষোভ প্রশমিত হইবে বলিয়া তিনি আশা করেন। মিঃ মনোরঞ্জন ধর তাঁহার সংশোধনীতে বলেন যে, গণপরিষদের পূর্ব পাকিস্তানী সদস্যগণকে সমস্যাটি সম্পর্কে চাপ দেওয়ার নির্দেশ দিতে হইবে। জনাব শামসুদ্দীন আহমদের সংশোধনীতে বলা হয় যে, গণপরিষদ সুপারিশ প্রত্যাখ্যান করিলে পূর্ব পাকিস্তানী সদস্যগণকে পদত্যাগ করিতে বলিতে হইবে। মিসেস আনোয়ারা খাতুনও একটি সংশোধনী পেশ করেন। তাঁহার সংশোধনীতে বলা হয় যে গণপরিষদকে ইহার পরবর্তী অধিবেশনেই সুপারিশ গ্রহণ করিতে বলিতে হইবে।… মিঃ ধরের সংশোধনী সমর্থন করিয়া বিরোধীদলের নেতা মিঃ বসন্তকুমার দাস বলেন যে, ভাষা আন্দোলনকে দমন করিবার জন্যই ১৪৪ ধারা জারী করা হইয়াছে। পরিষদ হইতে আজাদ সম্পাদকের পদত্যাগ “আজাদ” পত্রিকার সম্পাদক জনাব আবুল কালাম শামসুদিন অদ্য পূর্ব-পাক পরিষদের সদস্যপদে এস্তেফা দিয়াছেন। গভর্ণর ও পরিষদের স্পীকারের নিকট প্রেরিত এক আবেদনে তিনি বলিয়াছেনঃ বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবী করায় ছাত্রদের উপর পুলিশ যে বর্বরতার পরিচয় দিয়াছে তাহার প্রতিবাদে আমি পরিষদে আমরা সদস্যপদ হইতে পদত্যাগ করিতেছি। যে নুরুল আমীন সরকারের আমিও একজন সমর্থক-এ ব্যাপারে তাহদের ভূমিকা এতদর লজ্জাজনক যে, ক্ষমতায় অধিষ্টিত এই দলের সহিত সংযুক্ত থাকিবে এবং পরিষদের সদস্য হিসাবে বহাল থাকিতে আমি লজ্জাবোধ করিতেছি। বার এসোসিয়েশনের সভায় নিন্দা গতকল্য (শুক্রবার) ঢাকা বার লাইব্রেরী হলে জনাব আবদুল লতিফ বিশ্বাসের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ঢাকা বার এসোসিয়েশনের সদস্যদের সভায় নিমেণাক্ত প্রস্তাবগুলি সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। (ক) গত ২১শে ফেব্রুয়ারী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিক্যাল কলেজ প্রাঙ্গণে পুলিশের অমানুষিক ও বর্বরোচিত গুলীবর্ষণ দ্বারা শত শত নিরস্ত্র ও নিপরাধ ছাত্রকে হত্যা ও আহত করার তীব্র নিন্দা এই সভা করিতেছে।
(খ) এই সভা দাবী করিতেছে যে, জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট, সিটি এস,পি,ডি, আই, জি, ও অন্যান্য কর্মচারীদেরকে চাকুরী হইতে অবিলম্বে অপসারিত করিয়া বেসরকারী তদন্ত কমিটি দ্বারা ঘটনার তদন্ত করা হউক। (গ) এই সভা ঢাকা শহরে বিনা কারণে ১৪৪ ধারা জারীর তীব্র নিন্দা করিতেছে এবং অবিলম্বে উহার প্রত্যাহার দাবী করিতেছে। (ঘ) এই সভা অপদার্থ নূরুল আমীন মন্ত্ৰীসভার পদত্যাগ দাবী করিতেছে এবং বর্তমান ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সাধারণ নির্বাচনের সম্মুখীন হইতে দাবী জানাইতেছে। (ঙ) যাহারা পুলিশের গুলীতে শহীদ হইয়াছেন এই সভা তাহদের শোকার্ত পরিবাবগকে সমবেদনা জানাইতেছে। এই সভা শহীদের প্রতি সম্মান জ্ঞাপনার্থে এক মিনিটকাল নিঃশব্দে দন্ডায়মান থাকিয়া তাহাদের রূহের মাগফেরাত কামনা করে। নিখিল পূর্ব-পাক ছাত্রলীগ কর্মীদের নিন্দা নিখিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের সভাপতি জনাব শামছুল হুদা অস্থায়ী সাধারণ সম্পাদক জনাব এ, এস, এম, তওমিদ উদ্দিন, ঢাকা সিটি মুসলিম ছাত্রলীগের সভাপতি কাজী আওলাদ হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক জনাব মনজুরুল হক ঢাকায় ছাত্রদের উপর পুলিশের বেপরোয়া গুলীবর্ষণের তীব্র নিন্দা করিয়া সংবাদপত্রে এক বিবৃতি দিয়াছেন। বিবৃতিতে তাঁহার এ ব্যাপারে নিরপেক্ষ তদন্ত ও এই বর্বরতা কার্যের জন্য যাহারা দায়ী তাহদের সমুচিত শাস্তির দাবী করে। ফেব্রুয়ারী ২৪ গুলিবর্ষণ সম্পর্কে হাইকোর্টের বিচারপতিদের দ্বারা তদন্ত অনুষ্ঠানের দাবী প্রাদেশিক লীগ ওয়ার্কিং কমিটির প্রস্তাব নিহত ছাত্র ও নারিকদের আত্মীয়দের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন লীগ পার্লামেন্টারী পার্টির সভায় ১৪৪ ধারা প্রত্যাহারের দাবী ঢাকা ২৩ ফেব্রুয়ারী- আজ পূর্ব পাকিস্তান মোছলেম লীগ ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে পুলিশের সাম্প্রতিক গুলি চালনা সম্পর্কে হাইকোর্টের জজের দ্বারা তদন্ত অনুষ্ঠান ও অপরাধীদের শাস্তির দাবী করা হইয়াছে। ছাত্র ও নাগরিকদের মধ্যে যাহারা শোচনীয়ভাবে নিহত হইয়াছে তাহাদের জন্য ওয়ার্কিং কমিটির তরফ হইতে গভীর শোক প্রকাশ করা হইয়াছে এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারবর্গ ও আহতদের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করা হইয়াছে। প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় এবং মওলানা আবদুল্লাহেল বাকী ইহাতে সভাপতিত্ব করেন। এই বৈঠকে নিমণলিখিত মৰ্মে প্রস্তাব গৃহীত হইয়াছেঃ পূর্ব পাকিস্তান মোছলেম লীগ ওয়ার্কিং কমিটির এই সভা পুলিশের গুলী চালনার ফলে যে সকল ছাত্র ও নাগরিক শোচনীয়ভাবে নিহত হইয়াছে তাহদের জন্য গভীর দুঃখ ও বেদনা অনুভব করিতেছে এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারবর্গ ও আহতদের প্রতি আন্তরিক সমবেদনা জ্ঞাপন করিতেছে।
এই ঘটনা সম্পর্কে হাইকোর্টের বিচারকদের দ্বারা তদন্ত, অপরাধীদের কঠোর শাস্তিদান এবং নিহতদের পরিবারবর্গের জন্য উপযুক্ত ও যথোচিত ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থার জন্য এই সভা সরকারের নিকট দাবী জানাইতেছে। বাংলা ভাষার সমর্থনে লাহোরের ছাত্রবৃন্দ লাহোর গভর্ণমেন্ট কলেজের ১৪৬নং নিউ হোষ্টেল হইতে পূর্ব পাকিস্তান সাংস্কৃতিক সংঘের লাহোর শাখার সাধারণ সম্পাদক জনাব মোসলেহ উদ্দিন আহমেদ আজাদ” সম্পাদকের নিকট লিখিত এক পত্রে জানাইয়াছেন,”আমি অত্যন্ত আনন্দের সহিত আপনাকে জানাইতেছি যে, পূর্ব পাকিস্তান সর্বদলীয় কর্মপরিষদ বিতরিত কতকগুলি ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই ব্যাজ আমি পাইয়াছি এবং ঐগুলি আমি আমার লাহোরস্থ বাঙ্গালী বন্ধুদের মধ্যে বিতরণ করিয়াছি। আজ প্রাতে বিশ্ববিদ্যলয়ের কতকগুলি অ-বাঙালী ছাত্রকেও এই ব্যাজ পরিহিত দেখিতে পাই। কৌতুহলবশতঃ আমি এ ব্যাজ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করিয়া জানিতে পারি যে, বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করিবার দাবীতে তাঁহারাও ঐ সকল ব্যাজ ধারণ করিয়াছে। তাঁহারা বলেন যে, বাংলা পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হওয়া উচিত” সুতরাং দেখা যাইতেছে যে, শুধুমাত্র বাঙ্গালীরাই রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন করিতেছেন তা না বরং জাগ্রত অবাঙ্গালীরাও আজ পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠদের ভাষা আন্দোলনে ঝাঁপাইয়া পড়িয়াছেন। গভর্ণমেন্ট দুঃখের সহিত জানাইতেছেন যে, সামরিক বাহিনীর লোকে জনতার উপর গুলিবর্ষণ ও বেয়নেট চার্জ এবং লুটতরাজ করিয়াছে বলিয়া কোন কোন সংবাদপত্রে বিবরণ প্রকশিত হইয়াছে। ইহা সম্পূর্ণ মিথ্যা। এ পর্যন্ত কোন দল বা জনসাধারণের সহিত সামরিক বাহিনীর কোনরূপ সংঘর্ষ হয় নাই। বিশ্বস্ত মহল হইতে বলা হইয়াছে যে, এ যাবৎ শহরের বিভিন্ন স্থানে গুলিবর্ষণ ও লাঠি চালনার যেসব সংবাদ প্রকাশিত হইয়াছে সে সবের সাথে সারিক বাহিনীর কোন সংশ্ৰব নাই। শুধু পুলিশই তাদের সাথে সংশ্লিষ্ট বলিয়া জানা গিয়াছে। বাংলাকে উর্দুর সমমৰ্যদা দিতে পশ্চিম পাকিস্তানীদের আপত্তি নাইঢাকার মর্মান্তিক ঘটনার পর্যালোচনাকালে ডন’ পত্রিকার মন্তব্য করাচী, ২৩শে ফেব্রুয়ারী- আজ ডন পত্রিকার “ঢাকার মর্মান্তিক ঘটনা” শীর্ষক সম্পাদকীয় প্রবন্ধে পূর্ব পাকিস্তানের জনসাধারণকে এই মর্মে আশ্বাস দেওয়া হইয়াছে যে, বাংলা ভাষাকে উর্দুর সমমর্যাদা দেওয়া হইলেও পশ্চিম পাকিস্তানের জনসাধারণের মোটেই আপত্তি থাকিতে পারে না। বাংলা ভাষা সম্পর্কে পূর্ব পাকিস্তানবাসীর দাবী অবশেষে আদায় হইয়াছে। উহাতে বলা হইয়াছে, ঢকার এই মর্মান্তিক ঘটনার ফলে সমগ্র পাকিস্তান দুঃখভারাক্রান্ত হইবে এবং আমাদের শক্ররা উল্লসিত হইবে। এক দিকে আপন আপন বিশ্বাসের মর্যাদা রক্ষা এবং অপরদিকে আইন ও শৃঙ্খলা রক্ষার সমস্যা- এই দুই-এর সংঘর্ষে যাঁহারা প্রাণ হারাইল, তাঁহাদের প্রতি আমরা শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করিতেছি। এই সমস্ত তরুণ যে দাবী বলিয়া আন্তরিকতা সহিত বিশ্বাস করিত তাহা প্রতিষ্ঠা করিতে গিয়া প্রাণ বিসর্জন করিয়াছেন তাহদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা কর্তব্য। অন্যান্য অনেকে যাহারা আহত হইয়াছে, তাঁহাদের জন্যও আমরা দুঃখ বোধ করিতেছি এবং সমবেদনা জ্ঞাপন করিতেছি। ছাত্র সমাজের একটা বিরাট অংশ তাহদের আন্তরিক বিশ্বাসের দ্বারা অনুপ্রাণিত হইয়া বিক্ষোভ প্রদর্শন করিয়াছে এবং সত্যিকার পাকিস্তানী হিসাবে তাহারা আপনাদের ধারণা অনুযায়ী কর্মপন্থা অবলম্বন করিয়াছে। অবশ্য তাহদের মধ্যে প্ররাচনাদানকারী হিসাবে কিছুসংখ্যক লোক থাকিতে পারে। কিন্তু এই দুঃখজনক
ঘটনাবলীর মধ্যেও একটা আশার আলো দেখা যাইতেছে। পূর্ব পাকিস্তানে আত্মীয়স্বজনেরা ভাষাগত সমস্যাটিকে কিরূপ গভীরভাবে অনুভব করে, তাহার পরিচয় আমরা এই সকল ঘটনাবলীর মধ্য হইতে লক্ষ্য করিতেছি। উর্দুর ন্যায় বাংলাকেও অন্যতম রাষ্ট্র ভাষার মর্যাদা দান সম্পর্কে একটি প্রস্তাব এক্ষণে প্রাদেশিক ব্যবস্থা পরিষদে প্রধানমন্ত্রী পাশ করাইয়া লইয়াছেন। সুতরাং রাষ্ট্রভাষা সমস্যার এইভাবে একট মীমাংসা হইয়াছে। গণপরিষদও যথাসময়ে ইহা অনুমোদন করিবেন এবং বাংলা ভাষাকে উর্দুর সমমর্যাদা দানের ব্যাপারে পশ্চিম পাকিস্তানেরও কোন ক্ষোভের কারণ থাকিবে না বলিয়া আমরা বিশ্বাস করি। গুলী চালনা সংগত হইয়াছে কিনা, তৎসম্পর্কে প্রতিশ্রুত তদন্ত কার্যের ব্যবস্থা দ্বারা এই মর্মান্তিক ব্যাপারে এইখানেই যবনিকাপাত হউক। সবচেয়ে বড় কথা এই যে, পুলিশ গুলীবর্ষণ না করিলে মোটেই গণপ্রাণহানী ঘটিত না। উপযুক্ত কর্তৃপক্ষকে এ জন্য জওয়াবদিহি করিতেই হইবে। নিতদের জন্য ক্ষতিপূরণ দাবীঃ জনাব ইউসুফ আলী চৌধুরীর বিবৃতি পূর্ব পাক মোছলেম লীগের জেনারেল সেক্রেটারী জনাব ইউসুফ আলী চৌধুরী নিম্নলিখিত মর্মে এক বিবৃতি দান করিয়াছেনঃ ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডে নির্বাচন উপলক্ষে আমি ফরিদপুর থাকালে ঢাকায় ছাত্রদের উপর পুলিশের গুলীবর্ষণ সংবাদ শুনিয়া স্তম্ভিত হই। ছাত্রদের উপর কি কারণে যে গুলীবর্ষণ ও লাঠিচার্জ করিতে হইয়াছিল তাহা আমার জানা ছিল না। নির্দেশ দানের জন্য সরকারের নিকট দাবী জানাইতেছি। আমি নিহতদের পরিবারবর্গকে যথাযথ ক্ষতিপুরণ দানের ব্যবস্থা করিবার জন্যও সরকারকে জানাইয়াছি। বর্তমান মন্ত্রিসভার পদত্যাগ দাবীঃ বিভিন্ন স্থানে জনসভায় প্রস্তাব গৃহীত মোমেনশাহী ২৩শে ফেব্রুয়ারী গতকল্য মোমেনশাহীর জনসভায় গৃহীত প্রস্তাব অনুযায়ী অদ্য সর্বদলীয় একটি রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠিত হয়। অপরাহ্নে সদর মহকুমা মোছলেম লীগের সভাপতি জনাব ফখরুদ্দীন আপমদের সভাপতিত্বে ঢাকায় পুলিশী জুলুমের প্রতিবাদে স্থানীয় টাউন হল প্রাঙ্গণে জেলা ও সদর মহকুমা লীগের উদ্যোগে এক জনসভা হয়। সভার শুরুতেই জনতাকে খুব উত্তেজিত দেখা যায়। তাহারা বর্তমান সভায় কতিপয় প্রস্তাব উন্থাপন করিলে তাহা জনসাধারণের সর্বসম্মত সমর্থন লাভ করে এবং তাহা সভায় গৃহীত হয়। সৈয়দ সুলতান আহমদ বি-এস, রফিকুদ্দিন ভূইয়া, আলতাফুদ্দীন তালুকদার, জেলা ছাত্রলীগ সম্পাদক জনাব শামসুল হক, মোফাজ্জল হোসেন বি-এস, প্রমুখ বক্তৃতা করেন। পুলিশের গুলীবর্ষণের প্রতিবাদে ঢাকার নানা স্থানে সভা অনুষ্ঠান নিহত ব্যক্তিদের রূহের মাগফেরাৎ কামনাঃ ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্ত দাবী ছাত্রদের উপর পুলিশের গুলীবর্ষণের প্রতিবাদে গতকল্য (শনিবার) ঢাকার নানা স্থানে সভা-সমিতি অনুষ্ঠিত হয় এবং অবিলম্বে ১৪৪ ধারার আদেশ প্রত্যাহারের ও নিপেক্ষ তদমেত্মর দাবী জানান হয়। সভায় পূর্ব বঙ্গ সরকার আচরণের তীব্র নিন্দা করা হয়। নিহত ব্যক্তিদের রূহের মাগফেরাত কামনা করতঃ তাঁহাদের শোকসন্ত ও পরিবারবর্গের প্রতি সহানুভূতি জ্ঞাপন করা হয়। গতকল্য (শনিবার) অপরাহ ৫ ঘটিকায় নিখিল পূর্ব পাকিস্তান মোছলেম ছাত্রলীগ ওয়াকিং কমিটির এক (1) সরকারের যে কার্যকলাপের ফলে বহু ছাত্রের জীবন বিনষ্ট হইয়াছে, তাহাতে এই সভা গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করিতেছে এবং সরকারের নিকট হইতে ইহার কৈফিয়ৎ তলব করিতেছে এই নৃশংস হত্যাকান্ডের জন্য যে সকল কর্মচারী দায়ী, এই সভা অবিলম্বে তাহাদের অপসারণ দাবী করিতেছে। মওলানা তর্কবাগীশের পদত্যাগ পূর্ববঙ্গ ব্যবস্থা পরিষদের সদস্য মওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ অদ্য শনিবার লীগ পার্লামেন্টারী পার্টি হইতে পদত্যাগ করিয়াছে। পদত্যাগের কারণ বর্ণনা করিয়া অদ্য (রবিবার) তিনি এক বিবৃতি দান করিবেন বলিয়া জানা গিয়াছে। শনিবার পূর্ণ হরতাল পালনঃ গতকল্য (শনিবার) নাজিরাবাজার পশু হাসপাতালের নিকট এক জনতার উপর পুলিশের লাঠিচার্জের ফলে ৪ ব্যক্তি আহত হয়। তন্মধ্যে ২ ব্যক্তি আঘাত গুরুতর হওয়ায় তাহাদিগকে মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ইহা ছাড়া শহরের আর কোথাও কোন দুর্ঘটনা ঘটিয়াছে বলিয়া সংবাদ পওয়া যায় নাই। পূর্ব দিনের ন্যায় গতকালও পূর্ণ হরতাল পালিত হয়। ঢাকা রেলষ্টেশনের কর্মচারীরাও এদিন হরতাল পালন করেন। কর্মচারীগণ যথারীতি উপস্থিত হইলেও কোন কাজ করেন না। অনেক বিভাগের লোক আদৌ কাজে যোগদানও করেননি। তাদের এই হরতালের বেলা ১টা পর্যন্ত চলে এবং আপডাউন মিলাইয়া মোট ৪টি ট্রেন যাতায়াত করে। প্রাতে যে সকল রেল ইঞ্জিনে কয়লা বোঝাই করা হইয়াছিল, পরে তাহাও ইঞ্জিনে কয়লা বোঝাই করা হইয়াছিল, পরে তাহাও ইঞ্জিন হইতে ফেলিয়া দেওয় হইয়াছিল বলিয়া জানা গিয়াছে। রাত্রি ৮টি হইতে সকাল ৫টা পর্যন্ত সন্ধা আইন জারী হইয়াছে এবং পুনরাদেশ না দেওয়া পর্যন্ত ইহা চলিবে বলিয়া ঘোষণা হইয়াছে। পুলিশ ও সামরিক পাহারা পূর্বের ন্যায়ই আছে। কয়েকটি উল্লেখযোগ্য মোড়ে উহার শক্তি কিছু বৃদ্ধিও করা হইয়াছে। পূর্ব বঙ্গ পরিষদের বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার অনুকূল দাবী গৃহীত হইলে শহীদদের বিয়োগব্যথায় ব্যথিত ছাত্রগণের মধ্যে কোনও উল্লাসের সঞ্চার করিতে পারে নাই। শহরে ১৪৪ ধারর নিষেধাজ্ঞা বলবত থাকিলেও হাজার লোককে রাস্তায় ঘোরাফেরা করিতে দেখা যায়। রাস্তার মোড়ে মোড়ে সমবেত লোকগণকে বর্তমান পরিস্থিতির আলোচনা করিতে দেখা যায়। কালব্যাজ পরিধান করিয়া শত শত লোক সলিমুল্লা মোছলেম হল প্রঙ্গণে সমবেত হইয়া শুক্রবারের নিহত ব্যক্তিদের উদ্দেশ্য গয়েবী জানাজা আদায় করেন। সকাল হইতেই হলে লাউড স্পীকার যোগে বর্তমান পরিস্থিতি এবং ভাষা সমস্যার প্রকৃত বিবরণ সম্পর্কে বিভিন্ন ঘোষণা প্রচার করা হয়। বিভিন্ন বক্তা পুলিশের গুলীবর্ষণ এবং জনসাধরণের কর্তব্য সম্পর্কে বক্তৃতা দেন।
কতিপয় উর্দুভাষী ছাত্রও বক্তৃতা দান করেন। ইহাতে ছাত্রদের মধ্যে উৎসাহের সঞ্চার হয়। তাহারা জনসাধারণের নিকট এই বলিয়া আবেদন জানা যে, তাঁহাদের পথকে কেহ যে ভুল ধারণা না করেন এবং কল্পিত বিরোধের ধুয়া তুলিয়া দুই দলে বিভেদ বাধাইয়া না দেয়। গায়েবানা জানাজা বেলা ২টায় উক্ত হল প্রাঙ্গণে গায়েবানা জানাজা আদায় হয় এবং তাহাতে প্রায় চারি হাজার লোক যোগদান করেন। তন্মধ্যে বিশববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলর, সলিমুল্লা মোছলেম হলের প্রভোষ্ট এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য অধ্যাপকও উপস্থিত ছিলেন। জনাব ফজলুল হকের আবেদন অপরাহ্নে জনাব এ, কে, ফজলুল হক মোছলেম হলের সভায় উপস্থিত হইয়া ছাত্রদিগকে নিজেদের মধ্যে শাস্তি বজায় রাখিতে বলেন। ছাত্রদের দাবীকে জয়যুক্ত করাইবার জন্য তিনি যথাসাধ্য চেষ্টা করিবেন বলিয়াও আশ্বাস দেন। গুলী চালানোর হুকুম আমি দেই নাইঃ মফিজুদ্দিন পূর্ববঙ্গের সাহায্য সচিব জনাব মফিজউদ্দিন আহমদ সংবাদপত্রে নিম্নলিখিত বিবৃতি দান করিয়াছেনঃ ”ছাত্রদের উপর গুলী চালনার জন্য আমি পুলিশকে হুকুম দিয়াছি বলিয়া বাহিরে গুজব উঠিয়াছে জানিতে পারিয়া আমি অত্যন্ত মর্মাহত হইয়াছি। এইরূপ একটি ভিত্তিহীন সংবাদ কি করিয়া রটিতে পারে, তা ভাবিয়া আমি বিষ্ময় বোধ করিতেছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংগ্রাম পরিষদ কর্তৃক প্রকাশিত প্রেসের নামসহ একটি প্রচারপত্র আজ আমার হস্তগত হইয়াছে। প্রচারপত্রটিতে বলা হইয়াছে, আমার আদেশেই পুলিশ গুলী করে। ইহা সত্যের অপলাপ ছাড়া আর কিছুই নাহে সুতারং জনগণ যাহাতে ভুল না বুঝেন তার জন্য সত্য বিকৃত করিতেছি। আমি মেডিক্যাল কলেজের গেট দিয়া মোটেও যাই নাই, ঘটনাস্থলেও ছিলাম না…কোন পুলিশ কর্মচারীর সাথে আমার সাক্ষাৎকাও হয় নাই। সাধারণত যে পথে পরিষদে যাইয়া থাকি ঐ দিনও সেই অর্থাৎ,.(রেসকোর্সের পশ্চিম দিক) পূর্ব দ্বার দিয়া পরিষদ ভবনে প্রবশ করি। পরিষদের অধবেশন ৩-৩০ মিঃ শুরু হয়। পরিষদে বিরোধী দলের সদস্যগণ ছাত্রদের উপর পুলিশের গুলী করার কথা বলিলে প্রথম আমি সংবাদ জানিতে পারি।. গুলীবর্ষণের দুঃখজনক ঘটনায় অত্যন্ত ব্যথিত। কিন্তু রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাছেল করিবার জন্য একটি দুঃখজনক ঘটনাকে কোন ব্যক্তির বিরুদ্ধে ব্যবহার হইবে ইহা আমি ভাবিতেই পারি নাই।” আজাদ সম্পাদক অভিনন্দিত ব্যবস্থা পরিষদের সদস্য পদে এস্তেফা দেওয়ায় আজাদ সম্পাদক জনাব আবুল কালাম শামসুদ্দিনকে অভিনন্দন জানাইয়া আগামসিহ লেনের জনাব কাজী হেদায়েত হোসেন যে পত্র লিখিয়াছেন তাহার একটা অংশ নিম্নে উদ্ধৃত করা হইলঃ “এই বর্তমান সন্ধিক্ষণে আপনি পূর্ববঙ্গ ব্যবস্থা পরিষদের সদস্যপদ ত্যাগ করিয়া যে মমত্ববোধ ও কর্তব্য জ্ঞানের পরিচয় দিয়েছেন তাহা বাস্তবিকই অতুলনীয়। আপনার এই সাহসিকতাপূর্ণ কাজের জন্য উপযুক্ত শোকর
গোজরী কারার ভাষা আমার নাই। খোদার কাছে প্রার্থনা, তিনি যেন আপনাকে সুস্থ শরীরে দীর্ঘজীবী করেন এবং জনগণের সংকটের দিনে তাদের পশ্চাতে দাঁড়াইবার তৌফিক দেন। কুমিল্লায় পূর্ণ হরতাল প্রতিপালিত কুমিল্লা, ২৩ শে ফেব্রুয়ারী। -ঢাকায় পুলিশের গুলীর আঘাতে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধার নিদর্শনস্বরূপ অদ্য এখানে পূর্ণ হরতাল প্রতিপালিত হয়। যানবাহন, দোকানপাট, বাজার-ঘাট এমনকি, নিয়মিত বাস সার্ভিসও সম্পূর্ণ বন্ধ থাকে। রাস্তাগুলি সম্পূর্ণ জনশূন্য এবং সিনেমা হলগুলি বন্ধ থাকে। কুমিল্লার ইতিহাসে এই ধরনের ধর্মঘট ও হরতালের কোন নজীর নাই। সকালে প্রায় এক মাইল দীর্ঘ এক শোভাযাত্রা শহরের বিভিন্ন রাস্তা ও জনপদ প্রদক্ষিণ করে। স্থানীয় টাউন হল প্রাঙ্গণে ৫ হাজার লোকের এক সভা হয়। সভাপতিত্ব করেন মীর জহীরুল হক। সভায় বক্তৃতা প্রসঙ্গে পূর্ব পাকিস্তান কলেজ শিক্ষক সমিতির সম্পাদক প্রফেসর আবুল খায়ের ঢাকার শহীদদের আত্মীয়-স্বজনের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করেন এবং সমিতির পক্ষ হইতে প্রয়োজন হইল যে কোন পরিস্থিতির মোকাবেলা করার প্রস্তুতি প্রকাশ করা হয়। অধ্যাপক শওকত আলী, জনাব হাসান ইমাম, জনাব আবদুল গনি, জনাব আবুল হোসেন প্রমুখ বক্তা পুলিশী জুলুমের তীব্র নিন্দা করেন। সভায় গ্রহীত একটি প্রস্তাবে শহীদদের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন এবং নিরীহ ছাত্র ও জনসাধারণের প্রতি পুলিশের গুলীবর্ষণের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ করা হয়। অপর এক প্রস্তাবে প্রাদেশিক মন্ত্রিসভার পদত্যাগ এবং চীফ সেক্রেটারী ও জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট জনাব কোরায়েশীর অন্যত্র অপসারণ দাবী করা হয়। জেলা লীগের সাধারণ সম্পাদক জনাব আজীজুর রহমান এক বিবৃতি ঢাকার ছাত্রদের প্রতি গুলীবর্ষণের তীব্র নিন্দা করেন এবং বলেন যে, এই সংবাদে তিনি অত্যন্ত মর্মাহত ও বিস্মত হইয়াছেন। নারায়ণগঞ্জে বিরাট জনসভায় মন্ত্ৰীসভার পদত্যাগ দাবী নারায়ণগঞ্জ, ২৩শে ফেব্রুয়ারী। আদ্য-নারায়াণগঞ্জ সিটি মোসলেম লীগ একটি শান্তি স্কোয়াড লইয়া সমগ্র শহর প্রদক্ষিণ করে এবং ঢাকার ছাত্র ও জনসাধারণের উপর পুলিশের গুলীবর্ষণের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানান। অপরাহ্নে চাষাড়ার তুলারাম কলেজের রিকুইজিশন করা জমিনে এক বিরাট জনসভা হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন শ্রমিক নেতা জনাব ফয়েজ আহমদ। শ্রমিক নেতা জনাব সোলায়মান, এফ, রহমান, শফীকুল হোসেন খান, খোরশেদ আহমদ প্রমুখ বক্তাগণ প্রদেশের বর্তমানে মন্ত্রীসভার পদত্যাগ দাবী করেন। পুলিশের গুলীতে নিহতদের রূহের মাগফেরাত কামনা করিয়া সভায় এক প্রস্তাব গৃহীত হয়। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবীতে বগুড়ায় পূর্ণ হরতাল বগুড়া, ২৩শে ফেবব্রুয়ারী। -সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন কর্মপরিষদের আহবানে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবীতে গত ২১শে ফেব্রুয়ারী এখানে পূর্ণ হরতাল পালন করা হয়। ছাত্র ও জনসাধারণের এক বিরাট শোভাযাত্রা শহর পরিভ্রমণ করে ও “রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই” প্রভৃতি ধ্বনি করিতে থাকে।
বৈকালে স্থানীয় আলতাফুন্নেছা ময়দানে এক জনসভা হয়। বিভিন্ন বক্তা বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবী করিয়া বক্তৃতা করেন। সভায় গৃহীত অপর এক প্রস্তাবে পূর্ববঙ্গ পরিষদের সদস্যদের অবিলম্বে পদত্যাগ দাবী করা হয়। আগামী মঙ্গলবার সমগ্র শহরে পূর্ণ ধর্মঘট ও হরতাল পালনের প্রস্তাবও সভায় গ্রহীত হয়। সভায় গ্রহীত এক প্রস্তাবে পূর্ববঙ্গের বর্তমান মন্ত্রীসভার বিরুদ্ধে পূর্ণ অনাস্থা প্রকাশ করা হয় এবং প্রকাশ্য আদালতে তাঁহাদের বিচার দাবী করা হয়। অপর এক প্রস্তাবে ঢাকার শহীদ বীরদের রূহের মাগফেরাতের জন্য দোয়া করা হয় এবং বাংলা ভাষাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসাবে গ্রহণের জন্য সরকারের নিকট তীব্র দাবী জানানো হয়। নুরুল হােসেন খানের প্রতিবাদ হবিগঞ্জ, ২৩শে ফেব্রুয়ারী। -হবিগঞ্জের এম-এল-এ জনাব নূরুল হোসেন খান জানাইতেছেন যে, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন উপলক্ষে সম্প্রতি ঢাকায় ছাত্রদের উপর পুলিশের গুলী চালনার সংবাদে তিনি অত্যন্ত মর্মাহত পুলিশের গুলীবর্ষণের প্রয়োজন হইয়াছিল এমন কোন অবস্থার সৃষ্টি হইয়াছিল বলিয়া আমি কখনও বিশ্বাস করি না। এই গুলী চালনার জন্য যে বা যাহারা দায়ী হউন না কেন অবিলম্বে তাঁহাদিগকে চাকুরী হইতে বরখাস্ত করা উচিত এবং বিচার বিভাগীয় কর্মচারী ও এম-এল-এদের দ্বারা গঠিত কমিটি দ্বারা এই সম্পর্কে তদন্ত হওয়া উচিত। এ যথেচ্ছ ও নিষ্ঠুর কাজের জন্য বর্তমান প্রাদেশিক সরকারের লজ্জিত হওয়া উচিত। তমদ্দুন মজলিম কর্তৃক নিন্দা পাকিস্তান তমদ্দুন মজলিশের কেন্দ্রীয় দফতর এক বিবৃতিযোগে বলিয়াছেনঃ ২১শে ও ২৩শে ফেব্রুয়ারী ছাত্র সমাবেশের উপর যে নৃশংস পুলিশী জুলুম চালানো হইয়াছে তাহার নিন্দা করার ভাষা আমাদের নাই। আমরা এই দুস্কার্যের সহিত জড়িত প্রতিটি অপরাধীর আশু তদন্ত ও কঠোর শাস্তির দাবী জানাইতেছি। শহীদানের শোকসন্তপ্ত ফেব্রুয়ারী ২৫ অপ্রত্যাশিতভাবে পূর্ববংগ পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঢাকা, ২৪শে ফেব্রুয়ারী। -গভর্ণর অদ্য হইতে পূর্ববংগ ব্যবস্থা পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত রাখিয়াছেন। বাজেট সম্পর্কে আগামীকল্য যে অধিবেশন হওয়ার কথা ছিল, তাহা অনুষ্ঠিত হইবে না। – এপিপি শহীদ বীরদের স্মৃতিতে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে যেসব শহীদ বীর গত ২১শে ও ২২শে ফেব্রুয়ারী পুলিশের নিষ্ঠুর গুলীর আঘাতে বুকের রক্তের ঢাকার মাটি রাঙ্গাইয়া গিয়াছেন, তাঁহাদিগকে স্মরণীয় করিয়া রাখিবার উদ্দেশ্যে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ছাত্রগণ তাহদের কলেজ প্রাঙ্গণে নিজ হস্তে এক রাত্রির মধ্যে ১০ ফুট উচ্চ ও ৬ ফুট চওড়া একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করিয়াছেন।
পুলিশের অনধিকার চর্চা তখন পথিমধ্যে জনৈক পুলিশ তাঁহাকে তাঁহার জামায় লাগানো কালো ব্যাজটি খুলিয়া ফেলিতে বলে। তিনি তাঁহাতে অসম্মত হইলে পুলিশটি বলপূর্বক তাঁহার নিকট হইতে উহা ছিনাইয়া লয় বলিয়া জানা গিয়াছে। জনমতের কণ্ঠরোধ করিবার কোন ইচ্ছা সরকারের নাইপূর্ববংগের প্রধানমন্ত্রী জনাব নূরুল আমীনের বেতার বক্তৃতা ঢাকা, ২৪শে ফেব্রুয়ারী। পূর্ব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জনাব নুরুল আমীন অদ্য রাত্রে বলেন যে, “ভাষা বা অপর কোন সমস্য সম্পর্কে শাসনতন্ত্র মোতাবেক জনমত প্রকাশ করা হইলে, তাহার কণ্ঠরোধ করিবার কোন যাইতেছে, যে পরিকল্পনা করা হইয়াছে, বহিৰ্দ্দিক অপেক্ষা তাহার ভিতরে আরও গৃঢ় অর্থ রহিয়াছে এবং পরিকল্পনাকারীরা পাকিস্তানের বাহির হইতে প্রেরণা পাইতেছে।” ঢাকা বেতার কেন্দ্র হইতে বক্তৃতাদানকালে জনাব নুরুল আমীন “পাকিস্তানের শুভাকাঙ্ক্ষীদের” পূর্ণ সমর্থন কামনা করেন এবং বলেন যে, “এই ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করিবার জন্য এবং দেশের নিরাপত্তার প্রতি বিশ্বাঘাতকের ন্যায় যে হুমকী দেওয়া হইতেছে তাহা দমন করিবার জন্য যে ব্যবস্থা অবলম্বন করা প্রয়োজন, সরকার সেই ব্যবস্থাই অবলম্বন করিবেন। প্রধানমন্ত্রী বেতার বক্তৃতার বিবরণ নিমেণ প্রদত্ত হইলঃ আজ ঢাকায় কোন ঘটনা-দুর্ঘটনা হয় নাই। ঢাকার শৃঙ্খলা বিনষ্ট করিবার যে চেষ্টা করা হইয়াছে এবং ইহার ফলে যে ঘটনা-দুর্ঘটনা হইয়াছে ও সরকার যে ব্যবস্থা অবলম্বন করিয়াছেন, সরকারী এতেশহরে এ যাবৎ তাহার সত্য বিবরণই কেবল প্রকাশ করা হইয়াছে। ১৪৪ ধারা জারীর যৌক্তিকতা সম্পর্কে খোলাখুলিভাবেই সন্দেহ প্রকাশ করা হইয়াছে। কলিকাতার সংবাদপত্রে সাধারণতঃ দেশের জনসাধারণকে বিভ্রান্ত করিবার এবং তাহদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করিবার চেষ্টাই করা হইয়া থাকে, কিন্তু শুধু কলিকাতার সংবাদপত্রে নয়, ঢাকায়ও কোন কোন মহলে বলা হইয়াছে যে, বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার জন্য যে দাবী উত্থাপন করা হইয়াছে, তাহার কণ্ঠরোধ করিবার জন্যই এই আদেশ জারী করা হইয়াছে। শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য যে ব্যবস্থা অবলম্বন করা হইয়াছে, তৎসম্পর্কেও কতিপয় উত্তেজনাকর এবং বস্তুতঃপক্ষে সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন বিবৃতি দেওয়া হইয়াছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, স্থানীয় কতিপয় সংবাদপত্রে বলা হইয়াছে যে, শুক্রবার-এ সেনাবাহিনী নিরপরাধ জনসাধারণের উপর গুলীবর্ষণ করে, কয়েকজনকে বেয়নেট দ্বারা ঘায়েল করে এবং লুঠতরাজে যোগদান করে এই বিবরণী সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। গোলযোগের ফলে, দুর্ভাগ্যক্রমে যাহারা আহত বা নিহত হইয়াছিলেন, তাহদের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশের জন্য যানবাহন আচল করিয়া দেওয়ার, দোকানদারগণকে হরতাল পালনের জন্য প্ররোচিত বা বাধ্য করায় এবং কাজেই এই সম্পর্কে আলোচনা করা প্রয়োজন বলিয়া সরকার মনে করেন এবং আশা করেন যে, গত বৃহস্পতিবার হইতে যে সকল ঘটনা ঘটিয়াছে, তাহদের শুধুমাত্র বিবরণ দান করিলেই শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য সরকার ১৪৪ ধারা জারী করাসহ যে সকল সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করিয়াছিলেন জনসাধারণ তাহার যৌক্তিকতা হৃদয়ংগম করিতে পারিবেন।
গত বৃহস্পতিবার হইতে যে পরিস্থিতির উদ্ভব হইয়াছে, তাহতে দেখা যায়, এই ঘটনার তাৎপর্য সম্পর্কে আরও অধিক তথ্য উদঘাটন এবং যাহারা উহার প্ররোচনা দান করিতেছিল তাহাদের উদ্দেশ্যে প্রকাশ করা একান্ত প্রয়োজন। ভাষা সমস্যা সম্পর্কে জনমত চাপা দেওয়ার অভিপ্রায়ে ১৪৪ ধারা জারী করা হইয়াছিল বলিয়া যে অভিযোগ করা হইতেছে, তাহা সম্পূর্ণভাবে ভিত্তিহীন। ১৪৪ ধারা জারী করার সহিত ভাষা সমস্যার কোন সম্পর্ক নাই। একদল স্বার্থাম্বেষী লোক প্রাদেশিক আইন পরিষদ অধিবেশন আরম্ভের দিন এবং যতদিন উহার অধিবেশন চলে ততদিন শৃঙ্খলা নষ্ট করার পরিকল্পনা করিয়াছে বলিয়া সুস্পষ্ট প্রমাণ পাইয়া জেলা কর্তৃপক্ষ সতর্কতা হিসাবে ১৪৪ ধারা জারী করার সিদ্ধান্ত নেন। আইন ও শৃঙ্খলা ভংগ করার যে কোন প্রয়াসের মোকাবেলা করার জন্য জেলা কর্তৃপক্ষ এই নিষেধাজ্ঞা জারী করেন। সরকার আইন ও শৃঙ্খলা ভংগ করার পরিকল্পনার কথা জানিতে পারিয়াছিলেন। ভাষা বা অন্য যে কোন প্রশ্ন সম্পর্কে নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে জনমত প্রকাশে বাধাদানের কোন অভিপ্রায়ই ছিল না। এক পক্ষেরও অনধিককালে পূর্বে সরকার কোন প্রকার হস্তক্ষেপ করে নাই। ভাষার প্রশ্নে ঢাকা ও ঢাকার বাহিরে মিশিল বাহির করিতে এবং সভা শোভাযাত্রার অনুমতি দান করিয়াছিলেন। তাহা হইতে এই উক্তির সত্যতা সুস্পষ্ট হইয়া উঠিবে। ভাষা আন্দোলনের দাবী কিছু নয়, আইন ও শৃঙ্খলা ভংগ করিয়া শান্তিও নষ্ট করার জন্য যে একটা ধ্বংসাত্মক ষড়যন্ত্র করা হইয়াছিল ১৪৪ ধারা জারী করার পরবর্তী ঘটনা পরিস্থিতিই তাহার প্রমাণ। এই যুক্তির সমর্থনের দুইটি বিষয় উল্লেখ করা যাইতে পারে। প্রথমতঃ শোভাযাত্রা ও জনসভা একেবারে নিষিদ্ধ করিয়া দেওয়া হইয়াছে, ১৪৪ ধারা জারীতে তেমন কোন কথা ছিল না। নিষেধাজ্ঞায় বলা হইয়াছিল যে, জেলা ম্যাজিষ্ট্রেটের তবে তাহার জন্য এই অনুমতি লওয়ার পথে কোনই বাধা ছিল না। কিন্তু তাহারা কখনও এরূপ করে নাই। দ্বিতীয়তঃ বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার মৰ্যদা দেওয়ার জন্য প্রাদেশিক সরকারের সোপারিশ সত্ত্বেও এখনও দৃঢ়তার সহিত ছাত্র ও জনসাধারণকে হিংসাত্মক কাজে উত্তেজিত করার ও আইন ভংগের জন্য সংঘবদ্ধ করা প্রচেষ্টা চলিতেছে। এই সকল যুক্তির এবং হাঙ্গামাকারীদের কার্যকলাপ হইতে নিঃসন্দেহে ইহাই প্রতিপন্ন হয় যে, ভীষণ রকমের কোন একটা বিপর্যয় সৃষ্টি করাই ছিল তাহদের প্রধান মতলব, শুধু জনসাধারণের সহানুভূতি লাভের জন্যই তাহারা ইহার সহিত ভাষার প্রশ্ন যোগ করে। ঢাকার সাম্প্রতিক ঘটনাবলী সম্পর্কে মিথ্যা ও ভীষণ উত্তেজনামূলক গুজব শুধু ঢাকা শহরেই প্রচার করা হইতেছে না- সমস্ত প্রদেশেই ইহা ছড়ানো হইতেছে। আইন ভংগকারীদের সমর্থন জানানোর জন্য মোছলেম লীগ এম-এল-এ গণকে এবং স্থানীয় সংবাদপত্রগুলিকেও ভীতি প্রদর্শন করা হইতেছে। স্বাভাবিক শাসন পরিচালন কার্যে বিঘ্ন সৃষ্টির জন্যও চেষ্টা চলিতেছে। স্থানীয় ছাত্র মহলকে উত্তেজিত করার জন্য প্রতি মুহুর্তে সুযোগ গ্রহণ করা হইতেছে। তাহাদিগকে এই বলিয়া উৎসাহিত করা হইতেছে যে ইহা তাহদের জাতীয় আন্দোলন। আইন ভংগের জন্য তাহাদিগকে চাপ দেওয়া হইতেছে। অনুরূপ প্রচেষ্টার জন্য প্রদেশের বিভিন্ন স্থানেও তাহার দল প্রেরণ করিতেছে। উল্লিখিত ঘটনাগুলি এবং সরকারের হাতে যে সমস্ত প্রমাণ রহিয়াছে, তাহাতে ইহাই প্রতিপন্ন হয় যে, এই ষড়যন্ত্রের মূলে গভীর উদ্দেশ্য রহিয়াছে এবং ষড়যন্ত্রের নেতাগণ পাকিস্তানের বাহির হইতে উৎসাহ পাইতেছে। কখনও ইতস্ততঃ করিবেন না। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, পাকিস্তানের শুভাধীগণও এই কাজে সম্পূর্ণরূপে সহায়তা করিবেন। হাসপাতালে আর একজনের মৃত্যু অসমর্থিত সংবাদে প্রকাশ, ঘটনার দ্বিতীয় দিন অর্থাৎ গত শুক্রবার পুলিশের গুলীতে আহত এক ব্যক্তি গত শনিবার ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে এন্তেকাল করিয়াছেন (ইন্নালিল্লাহে……. রাজেউন)
ইহাছাড়া, গতকল্য (রবিবার) লালবাগ পুলিশ হাসপাতাল হইতে পূর্ব দুই দিনের আহত ৫ ব্যক্তিকে মিটফোর্ড হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হইয়াছে বলিয়া জানা গিয়াছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক অদ্য প্রতিবাদ দিবস পালন একজিকিউটিভ কাউন্সিলের সভায় প্রস্তাব গৃহীত বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবীঃ শহীদ ছাত্রদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন গতকল্য (রবিবার) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজিকিউটিভ কাউন্সিল ও অধ্যাপকদের বৈঠক হয়। উভয় বৈঠকের প্রস্তাবে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবী জানান হয়। ঢাকায় ছাত্রদের উপর গুলীবর্ষণের নিন্দা করিয়া এবং গুলীবর্ষণের ফলে নিহত ব্যক্তিদের পরিবারবর্গের শোকে সহানুভূতি জানাইয়া প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। অধ্যাপকের বৈঠকের বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় সমস্ত অধ্যাপকই উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে উপস্থিত অন্যান্যদের মধ্যে সলিমুল্লা, মোছলেম হল, ফজলুল হক হল এবং জগন্নাথ হলের প্রভোষ্টগণ, কলা, বিজ্ঞান ও আইন বিভাগের ভীন এবং ডাঃ জিলানী, মেসার্স প্যাটেল, রিজভী হোসেন, সিদ্দিকী প্রমুখ বহুসংখ্যক অবাঙ্গালী অধ্যাপকের নাম উল্লেখযোগ্য। একটি প্রস্তাবে কাউন্সিল ২১শে ও ২২শে ফেব্রুয়ারী তারিখে গুলীবষণের ফলে হতাহত ছাত্রদের জন্য গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেন। অপর একটি প্রস্তাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রাঙ্গণে পুলিশের প্রবেশের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ করা হয়। ২১শে ও ২২শে ফেব্রুয়ারী যে সমস্ত ছাত্র পুলিশের গুলীবর্ষণে প্রাণ হারাইয়াছে, তাহাদের প্রতি শ্রদ্ধার নিদর্শনস্বরূপ ও তাহাদের প্রতি শ্রদ্ধার নিদর্শনস্বরূপ ও তাহাদের শোসসন্তপ্ত পরিবারবর্গ ও আহতদের প্রতি সহানুভূতি জ্ঞাপনের উদ্দেশ্যে এবং পুলিশের বেপরোয়া গুলীবর্ষণের প্রতিবাদে কাউন্সিল ২৫শে ফেব্রুয়ররী বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত করিয়াছেন। বৈঠকে আসন্ন আইন পরীক্ষাও স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত করা হইয়াছে এবং এ ব্যাপারে চূড়ান্ত তারিখ নির্ধারণ করার জন্য ভাইস চ্যান্সেলরকে ক্ষমতা দেওয়া হইয়াছে। অপর একটি প্রস্তাবে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষারূপে গ্রহণের জন্য গণপরিষদের নিকট দাবী করা হয়। অধ্যাপকদের বৈঠক বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা বিভাগের ডীন ডাঃ আই, এইচ, জুবেরী সভাপতিত্বে গতকল্য (রবিবার) বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের এক বৈঠক হইয়াছে। বৈঠকে সরকারকে অবিলম্বে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষারূপে ঘোষণা করার দাবী জানানো হইয়াছে। বৈঠকে শিক্ষার মাধ্যম হিসাবে যথাসম্ভব বাংলা প্রবর্তনের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়কে অনুরোধ করা হইয়াছে। ২১শে ফেব্রুয়ারী ও পরবর্তী দিনসমূহের পুলিশ ও মিলিটারীর নির্বিচারে ছাত্র সমাবেশের উপর গুলীবর্ষণ এবং নিষ্ঠুর হত্যাকান্ডের তীব্র নিন্দা করা হয়। পুলিশ ও মিলিটারী কর্তৃক বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা লংঘন সম্পর্কেও বৈঠকে নিন্দা করা হয়। একটি প্রস্তাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও অধ্যাপকের উপর কাঁদুনে গ্যাস নিক্ষেপের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জ্ঞাপন করা হয়।
সম্মিলিত অধ্যাপকগণ হাইকোর্টের একজন বিচারপতির নেতৃত্বের গঠিত একটি বিচার বিভাগীয় কমিটির দ্বারা ঢাকার সাম্প্রতিক ঘটনাবলীর তদমেত্মর দাবী করিয়াছেন। অতঃপর তাঁহারা অন্যান্য প্রস্তাবের মধ্যে ঢাকার শোচনীয় ঘটনাবীলর জন্য দায়ী অফিসারদের অপসারণ, ১৪৪ ধারা প্রত্যাহার এবং পুলিশ ও মিলিটারী পাহারা উঠাইয়া দানের জন্য এবং অবিলম্বে বিনা শর্তে বন্দীদের মুক্তিদানের প্রস্তাব গ্রহণ করেন। রবিবারে শহরের অবস্থার আরো উন্নতি দুই স্থানে পুলিশের মৃদু লাঠিচার্জঃ সান্ধ্য আইনের মেয়াদ হ্রাস গতকল্য (রবিবার) ঢাকার অবস্থা অপেক্ষাকৃত শান্ত থাকে। তবে ইছলামপুর রোড ও ঢাকা রেল ষ্টেশনের আর-এম-এস অফিসের নিকট এক জনতার উপর পুলিশ লাঠিচার্জ করে। ফলে কয়েক ব্যক্তি আহত হয়। দুজনকে মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসার পর ছাড়িয়া দেওয়া হয় বলিয়া জানা গিয়াছে। এই দিন শহরে সান্ধ্যা আইন কিছু শিথিল করিয়া রাত্রি ৮টার বদলে ১০টা হইতে ভোর ৫টা করা হয়। সর্বত্র পুলিশ ও সামরিক প্রহরা পূর্ণমাত্রায় বজায় থাকে। এইদিনে শহরের নানাস্থানে সরকারের সমালোচনামূলক নানান নতুন ধরনের প্রচারপত্র বিলি করা হয়। বহু গৃহ ও প্রাচীরপত্র সংলগ্ন অনুরূপ বহু প্রাচীরপত্র পথচারীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। কিছুসংখ্যক পুলিশকে এই দিন বিভিন্ন রাস্তা হইতে প্রাচীরপত্রগুলি তুলিয়া ফেলিতে ব্যস্ত দেখা যায়। এই দিন শহরে রিক্সা, ঘোড়ার গাড়ী ছাড়া অন্যান্য সর্বপ্রকার যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকে। নওয়াবপুরের কয়েকটি ছোটখাটো দোকান ব্যতীত শহরের অন্যান্য এলাকার সমস্ত দোকান বন্ধ থাকে। এই দিন শহীদানের স্মৃতির প্রতি সম্মান প্রদর্শনের জন্য অনেকে রোজা রাখেন। গত চারি দিবস ঢাকা বেতার কেন্দ্রে পূর্ণ হরতাল পালন করা হয়। ফলে কেবলমাত্র সংবাদ বুলেটিন ব্যতীত অন্য কোন অনুষ্ঠান প্রচারিত হয় নাই। গতকল্য সকাল হইতে সলিমুল্লা মোছলেম হলে মাইকযোগে বক্তৃতা দেওয়া হয়। এই বক্তৃতায় উর্দু ভাষার ছাত্ররাও অংশ গ্রহণ করেন। উর্দু ভাষার ছাত্ৰগণ বাঙ্গালী ছাত্রদের বর্তমান আন্দোলনকে মোবারকবাদ জানান এবং বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা বলিয়া অনতিবলিম্বে ঘোষণা করার জন্য সরকারকে মুনরোধ জানান। এক শ্রেণীর দুস্কৃতকারী বাংলা ও উর্দুভাষীদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করিয়া এই আন্দোলনকে বানচাল করিবার যে চেষ্টা করিতেছে; উর্দুভাষী ছাত্রগণ তাহার বিরুদ্ধে দারুণ ক্ষোভ প্রকাশ করেন। করাচীর ছাত্রদের সমবেদনা করাচী মেথরান হোষ্টেলের ছাত্রগণ এক তারযোগে রাষ্ট্রভাষা সংগামী কর্মীদের উপর পুলিশের গুলী চালনায় তীব্র প্রতিবাদ ও শহীদ ছাত্রবৃন্দের আত্মীয়-স্বজনের প্রতি সমবেদনা জানাইয়াছেন। এই ঘটনায় তদন্ত করিয়া প্রকৃত দোষীর শাস্তির বিধানের জন্য এই তারে সরকারকে অনুরোধ করা হয়। পুলিশের কাজের প্রতিবাদঃ বিশিষ্ট লীগ সদস্যদের বিবৃতি ঢাকা, ২৪শে ফেব্রুয়ারী। -গাইবান্ধা লীগের সেক্রেটারী জনাব সৈয়দুর রহমান, বগুড়া লীগের সেক্রেটারী জনাব ফজলুল বারী, নীলফামারী লীগের প্রেসিডেন্ড কাজী আবদুল কাদের, বগুড়া লীগের ভাইস-প্রেসিডেন্ট জনাব আবদুল বারী, যশোর লীগের সেক্রেটারী জনাব শামছুর রহমান এবং বগুড়া লীগের প্রেসিডেন্ট জনাব হাবিবুর রহমান অন্য এক যুক্ত বিবৃতিতে গুলীবর্ষণে নিহত ব্যক্তিগণের শোকসন্তপ্ত পরিজনের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করে এবং বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষারূপে গ্রহণ করিবার দাবী সমর্থন করেন। শহীদ ছাত্রদের প্রতি আন্তরিক শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করাচীর পত্রিকাসমূহে প্ৰবন্ধঃ গুলীবর্ষণ সম্পর্কে তদন্ত দাবী এখানকার ইভনিং ষ্টার’ ও ‘ইভনিং টাইমস’- এই দুইটি দৈনিক পত্রিকাও ঢাকার সাম্প্রতিক গুলীবর্ষণ সম্পর্কে তদন্ত দাবী করিয়াছেন। গুলীবর্ষণের ফলে যাহারা নিহত হইয়াছেন তাহদের জন্য পত্রিকা দুইটিতে গভীর শোক প্রকাশকতরঃ তাঁহাদের পরিবারবর্গের প্রতি সহানুভূতি জ্ঞাপন করা হইয়াছে। অন্যান্য পত্রিকাগুলিতেও এই গুলীবর্ষণ সম্পর্কে তদমেত্মর জন্য সর্বসম্মত দাবী জানাইয়া ছাত্র শহীদদের জন্য আন্তরিক শোক প্রকাশ করা হইয়াছে। “ইভনিং টাইমস’-এ বলা হইয়াছে “উর্দুর সহিত বাংলা ভাষাও যে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা লাভ করিবে, তাহাতে কোনই সন্দেহ নাই। সুতরাং যত শীঘ্ৰ এই প্রশ্নের মীমাংসা হয়, ততই মঙ্গল। বাংলা ভাষার দাবীর সমর্থকগণ দেশপ্রেমিক নন বলিয়া অপবাদ দেওয়া অন্যায়। এই দাবীর জন্য সংগ্রামে যাঁহারা প্রাণ দিয়াছেন, সেই বীর শহীদদের জন্য আমরা গভীর শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করিতেছি। এই বীর শহীদগণ যে আদর্শে বিশ্বাস করিতেন, সেই আদর্শের জন্য প্রাণ দিয়াছেন। বাংলার এই তরুণগণ আত্মদানের ভিতর দিয়া যে সাহসিকতা ও তেজস্বিতার পরিচয় দিলেন, তাহাতে আমরা ইহাই আশা করিতে পারি যে, পাকিস্তান স্থায়ী হইবে। ছাত্রদের উপর গুলীবর্ষণের জন্যও পত্রিকায় তীব্র সংশ্লিষ্ট সরকার ও সরকারের ভ্রান্ত নীতির নিন্দা করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয় কর্মচারীদের সিদ্ধান্ত বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিক্যাল কলেজ প্রাঙ্গণের মধ্যে পুলিশ কর্তৃপক্ষ নিরস্ত্র ছাত্ৰগণের উপর অহেতুক ও অন্যায় জুলুম এবং বেপরোয়া গুলী চালনার ফলে যে তরুণ ছাত্র নিহত ও আহত হইয়াছে, তাহদের শোকসন্তপ্ত পরিবারবর্গের প্রতি এই সভা গভীর সমবেদনা জানাইতেছে। তাহদের মৃত্যুতে আমরা আমাদের পরমাত্রীয়দের মৃত্যুজনিত শোক অনুভব করিতেছি। আমরা নিহতদের রূহের মাগফেরাত কামনা করি। বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিক্যাল কলেজ প্রাঙ্গণের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের প্রতিবাদ সত্ত্বেও পুলিশের অহেতুক ও বেপরোয়া আক্রমণে শিক্ষায়তনের পবিত্রতা বিনষ্ট হইয়াছে। এই সভা উহার তীব্র প্রতিবাদন করিতেছে এবং গভর্ণমেন্টের নিকট ভবিষ্যতে ইহার পুনরুক্তি যাহাতে না হয়, তাহার প্রতিশ্রুতি দিতে এবং সরকারকে তাহদের কৃতকার্যেল জন্য ক্ষমা চাহিতে বলিতেছে। এই প্রস্তাব কার্যকরী করার জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা অবলম্বনের জন্য আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ জানাইতেছি। এই ঘটনার জন্য দায়ী সরকারী কর্মচারীগণকে অবিলম্বে সাসপেন্ড করা হউক এবং… অন্যায়ভাবে আটক ছাত্রদের মুক্তি দেওয়া হউক। ছাত্রদের প্রতি অন্যায় জুলুম ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পবিত্রতা নষ্ট করার প্রতিবাদে বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারীবৃন্দ রবিবার কাজে যোগদান হইতে বিরত থাকেন। লাহোরেও তদন্তের দাবী লাহোর, ২৩ শে ফেব্রুয়ারী।- গণতন্ত্রী ছাত্র ফেডারেশনের কার্যনির্বাহী কমিটি অদ্য এখানে ঢাকার ছাত্রদের উপর পুলিশের গুলীবর্ষণের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জ্ঞাপন করে।
সভায় নিহতদের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন করিয়া গুলীবর্ষণ সম্পর্কে তদন্তের দাবী জানায়। রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে সোহরাওয়াদী হায়দারাবাদ, ২৪ শে ফেব্রুয়ারীঃ জনাব এইচ, এম, সোহরাওয়াদী সংবাদপত্রে এক বিবৃতি দান প্রসঙ্গে ঢাকায় গুলীবর্ষণের ফলে নিহত ব্যক্তিদের শোকসন্তপ্ত পরিবারবর্গের প্রতি সহানুভূতি জ্ঞাপন করেন। তিনি বলেন, “আমি একদিকে শুনিতেছি ছাত্ররা শান্ত ছিল এবং আর একদিকে শুনিতেছি, তাহারা পুলিশের প্রতি ইটপাটকেল নিক্ষেপ করিয়াছিল। সুতরাং স্বভাবতই প্রশ্নে উঠে পুলিশ ঘটনাস্থলে কি করিতেছিল এবং আইনসংগতভাবে বিক্ষোভ প্রদর্শনের জন্য তাহারা কেন শান্তিপূর্ণভাবে শোভাযাত্রা করিতে দেয় নাই। তিনি বলেন, ঘটনা বর্তমানে ঘটিলেও বহু পূর্বেই পূর্ববংগে ভাষা সম্পর্কে বিতর্ক দেখা দিয়াছে। আমি সেই সময় একটি জনসভায়ও এক বিবৃতিতে বলিয়াছিলাম, যে আদর্শের ভিত্তিতে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে তদনুসারে উর্দুই হইবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। কিন্তু সেই সময় আমি ইহাও বলিয়াছিলাম যে, বাংলা পাকিস্তানের জনগণের একটি বিরাট অংশের মাতৃভাষা প্রকৃতপক্ষে ইহা জনসাধারণের সংখ্যাগুরু অংশের মাতৃভাষা। বাংলার বুকে উর্দুকে অবশ্য জোর করিয়া চাপাইয়া দেওয়া হইবে না, তবে বিদ্যালয়ে আবশ্যিক দ্বিতীয় ভাষারূপে ইহা পড়ান হইবে এবং যথাসময়ে এই প্রদেশবাসীগণ এই ভাষার সহিত পরিচিত ইহয়া উঠিলে প্রদেশের শিক্ষিত সমাজ ও সরকারী কর্মচারীগণ আপনা হইতেই ইহা পড়িতে ও লিখিতে শুরু করিবে। তখন উর্দু তাহাদের নিকট গৌরবজনক মর্যাদা লাভ করিবে এবং পূর্ব পাকিস্তানীরাও দুই ভাষাভাষী হইবে। পারস্পরিক সমঝোতা ও সম্প্রীতির ভাব রক্ষার জন্য পশ্চিম পাকিস্তানেরও বাংলা ভাষা শিক্ষা দেওয়া উচিত….. ইহাই সমস্যা সমাধানের বাস্তব উপায়। কিন্তু কর্তৃপক্ষ উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করিবার জন্য বারংবার জেদ করিবার প্রতিক্রিয়া হিসাবে দুর্ভাগ্যজনক পরিণতি ঘটিয়াছে। মোট কথা বাংলায় বা পশ্চিম পাকিস্তান উর্দুর প্রসারের জন্য যখন কোন চেষ্টা কর হইতেছে না তখন এই প্রশ্ন উত্থাপনের হেতু কি? ইহা অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় যে, পশ্চিম পাকিস্তানের জনসাধারন পূর্ব পাকিস্তানের সম্পর্কে কিছুই অবগত নহে। তজ্জন্য অনেক সংবাদপত্রের সম্পাদক ফাঁদে পড়িয়াছেন। উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করা সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রীর এবং প্রচার বিভাগের মতামত অবগত হইবার জন্য আমি পত্র লিখিয়াছিলাম এবং তাঁহাদের অভিমত জানিতে পারিলে একটি বিবৃতি দিবার সিদ্ধান্ত করিয়াছিলাম কিন্তু আমি তাঁহাদের নিকট হইতে কোন জওয়াব পাই নাই। বর্তমান পরিস্থিতির দরুন আমাকে বাধ্য হইয়া এই ক্ষুদ্র বিবৃতি দিতে হইল। জননিরাপত্তা আইন অনুসারে পাঁচজন বিশিষ্ট ব্যক্তি গ্রেফতার (স্টাফ রিপোর্টার) গতকল্য (সোমবার) রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের পঞ্চম দিবসে ঢাকা শহরে সর্বত্র পূর্ণ হরতাল প্রতিপালিত হয়। ঐদিন সকল প্রকার যানবাহন, বাজার, দোকান-পাট, ব্যাংক, সিনেমা ও খেলাধুলা বন্ধ থাকে এবং কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকারের অফিসগুলি ও আদালতসমূহ জনশূন্য বলিয়া প্রতীয়মান হয়।
সোমবারে শহরে উত্তেজনাপূর্ণ আবহাওয়া বিরাজমান থাকিলেও কোনরূপ দুর্ঘটনার সংবাদ পাওয়া যায় নাই। এবং ছাত্রদের মধ্যে কেহ গ্রেফতার হইয়াছে বলিয়াও শোনা যায় নাই। অদ্য মঙ্গলবার হইতে শহরে সম্পূর্ণ সকাল হইতে সলিমুল্লা মুসলিম হল প্রাঙ্গণে ছাত্র ও জনসাধারণকে জমাযেত হইতে দেখা যায় এবং বহু বক্তা মাইকযোগে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার এবং অবিলম্বে ১৪৪ ধারা প্রত্যাহারের দাবীতে বক্তৃতা করেন। বেলা প্রায় ১১টার সময় পুলিশ বাহিনী, ই,পি,আর দল সলিমুল্লা মুসলিম হল হইতে মাইক ছিনাইয়া লইবার জন্য হল প্রাঙ্গণে প্রবেশ করিয়া হলগুহ ঘিরিয়া ফেলে। কিন্তু হলের ভিতরে গেট বন্ধ থাকায় পুলিশ বাহিনী ভিতরে প্রবেশ করিতে সক্ষম হয় না। এই সময় সলিমুল্লা হলের প্রভোক্ট ডঃ ওছমান গণি দুইজন অধ্যাপকসহ ঘটনাস্থলে উপস্থিত জেলাম্যাজিষ্ট্রেটের সহিত আলাপ-আলোচনা করেন। আলোচনার পর ছাত্রগণ ডঃ গণির অনুরোধক্রমে মাইকটি তাঁহার (ডঃ গণির) হাতে দেয়। কিছুক্ষণ পর পুলিশ ও ই,পি,আর বাহিনী ঘটনাস্থলে হইতে চলিয়া যায়। তারপর অনুমান ৪ হাজার লোকের এক সভা হয়…..। বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করিবার দাবী আদায়ের আশ্বাসঃ পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগ ওয়ার্ক কমিটির প্রস্তাব ধ্বংসাত্মক কাৰ্য্য হইতে বিরত থাকার উপদেশ পূবর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগ ওয়াকিং কমিটির বৈঠকে গৃহীত এক প্রস্তাবে জনসাধারণকে দৃঢ় আশ্বাস দেওয়া হইয়াছে যে, গণপরিষদ কর্তৃক যাহাতে বাংলা অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসাবে গৃহীত হয় তজ্জন্য লীগ পার্লামেন্টারী দলের সুপারিশ আদায়ের অভিপ্রায়ে ওয়াকিং কমিটি সবর্বপ্রকার চেষ্টা করিবেন। প্রাদেশিক লীগ ওয়াকিং কমিটির তিন দিনব্যাপী বৈঠক গতকল্য (সোমবার) সমাপ্ত হইয়াছে। ওয়াকিং কমিটি ধ্বংসাত্মক কার্য্যে লিপ্ত লোকদের সহিত সকল সম্পর্ক ছিন্ন করিতে এবং পাকিস্তানের স্বাধীনতা ও সাবর্বভৌমত্ব হরণের জন্য যে সকল শক্র চেষ্টা করিতেছে তাহাদের আক্রমণাত্মক মতলব হইতে পাকিস্তানকে রক্ষা করার ব্যাপারে সাহায্য করিতে জনসাধারণ এবং ছাত্রবৃন্দকে অনুরোধ করেন। মুছলমানদের ঐক্য ও সংহতির জন্যও ওয়াকিং কমিটির প্রস্তাবে আবেগময় আবেদন জানান হয়। ওয়াকিং কমিটির প্রস্তাবে বলা হইয়াছেঃ পুলিশের গুলীবর্ষণের ফলে কয়েকজন ছাত্র ও সাধারণ লোক নিহত হওয়ার গভীর দুঃখ প্রকাশ করিয়া এবং পুলিশের কাজের তদন্তের জন্য বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন ও অপরাধীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের দাবী জানাইয়া ২৩ শে ফেব্রুয়ারী ওয়ার্কিং কমিটির প্রস্তাব গঠন করিয়াছিলেন, তাহার পরে পরিস্থিতির উন্নতি হয় নাই; আইন ও শৃঙ্খলা ভংগের জন্য জনসাধারণ প্রকাশ্যে প্ররোচিত হইতেছে এবং পরিস্থিতিকে আর অবনত করার জন্য আতঙ্ক ও হিংসাংতুক কাজ অবাধে চলিতেছে বলিয়া কমিটির গভীর দুঃখের সহিত লক্ষ্য করিতেছেন।
গভীর উৎকণ্ঠার সহিত কমিটি আরও লক্ষ্য করিতেছেন যে, কমু্যনিষ্ট এবং বিদেশী দালারগণ প্রচুর উপকরণ লইয়া পূবর্ববংগে অনুপ্রবেশ করিতেছে এবং আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও অসন্তুষ্ট রাজনৈতিক সুবিধাবাদীদের সহযোগিতায় নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য আন্দোলনের মোড় ঘুরাইয়া চেষ্টা করিতেছে। তাহারা ট্রেন লাইন তুলিয়া ফেলিয়া, তার ও টেলিফোন যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করিয়া, বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থা বানচাল করিয়া এবং জনসাধারণকে মৃত্যু অথবা মারপিটের ভয় দেখাইয়া সরকারকে অচল করিয়া ফেলার জন্য পরিকল্পনা করিতেছে। দেশে আইন ও শৃঙ্খলা ভংগ করিয়া পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করিতে ও পাকিস্তানকে ধ্বংস করিতে তাহারা ধ্বংসাত্মক অভিযান ও শুরু করিয়াছে……। অদ্য শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ উদ্বোধন অদ্য (মঙ্গলবার) সকাল সাড়ে নয়টায় মেডিক্যাল কলেজ হোষ্টেল প্রাঙ্গণে “আজাদ” সম্পাদক জনাব আবুল কালাম শামসুদ্দিন “শহীদ স্মৃতি স্তম্ভ” উদ্বোধন করিবেন। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করিতে না পারিলে পদত্যাগ করিবঃ গণ-পরিষদের সদস্য জনাব এ, এম, এ, হামিদের প্রতিশ্রুতি পূবর্ব ব্যবস্থা পরিষদ ও পাকিস্তান গণ-পরিষদের সদস্য এ, এম, আবদুল হামিদ সাংবাদপত্রে প্রকাশনার্থে নিমণলিখিত বিবৃতি দিয়াছেনঃ “আমি সম্যক উপলদ্ধি করিয়াছি যে, বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবী প্রতিষ্ঠার জন্য প্রচেষ্টা চালানোই আমার কর্তব্য। বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা মর্যাদাদানের জন্য আমি পাক গণ-পরিষদে যথাসাধ্য চেষ্টা করিব।” “আমি ঘোষণা করিতেছি যে, যদি আমি ইহাতে অসমর্থ হই, তবে আমি অবশ্যই গণ-পরিষদে পদত্যাগ করিব।” সংগ্রাম পরিষদ কর্তৃক প্রধানমন্ত্রীর বেতার বক্তৃতার নিন্দা ব্যক্তি বিশেষকে কেন্দ্র করিয়া ভাষা আন্দোলনের সৃষ্টি নহে বলিয়া আহবায়কের উক্ত জনাব ফজলুল হক সংক্রান্ত সংবাদের সহিত সম্পর্ক অস্বীকার প্রধানমন্ত্রী জনাব নুরুল আমীন তাঁর সাম্প্রতিক বেতার বক্তৃতায় ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে যে মন্তব্য করিয়াছেন তাহার প্রতিবাদে সবর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের কনভেনর জনাব কাজী গোলাম মাহবুব এক বিবৃতি দান করিয়াছেন। মওলবী এ, কে, ফজলুল হককে বাংলার প্রধানমন্ত্রীর গদীতে বসাইবার আহবান জানাইয়া সম্প্রতি যে এশতেহার প্রচারিত হইয়াছে জনাব কাজী গোলাম মাহবুব তাহার উল্লেখ করতঃ জানাইয়াছেন যে, ঐ এশতেহারের সহিত তাঁহার কোনও সংশ্রব নাই।
জনাব কাজী গোলাম মাহবুব বলেনঃ “প্রধানমন্ত্রী জনাব নুরুল আমীন বেতার বক্তৃতায় ভাষা আন্দোলনের উপর যে কটাক্ষ করিয়াছেন, আমরা তাহার তীব্র নিন্দা করি। আমরা জনসাধারণের কাছে তাঁর বক্তব্যের আসল রূপ প্রকাশ করিয়া দেওয়া প্রয়োজন মনে করি। জনাব নুরুল আমীন বলিয়াছেন যে, ভাষা বা অপর কোন সমস্যা সম্পর্কে শাসনতন্ত্র মোতাবেক জনমত প্রকাশ করা হইলে তাহার কণ্ঠরোধ করার কোনও ইচ্ছা সরকারের নাই। তাঁর কার্যকলাপ এবং ঢাকার বুকে অনুষ্ঠিত সাম্প্রতিক হত্যা এবং পুলিশ ও মিলিটারী আচরণই প্রমাণ করিতেছে যে, এই উক্তি সর্বৈব মিথ্যা। যে শাসনতন্ত্রের উপর নুরুল আমীন সরকার প্রতিষ্ঠিত, তাহা বৃটিশ আমলের কুখ্যাত দমনমূলক আইন ও অর্ডিনান্সেরই সমষ্টি। এই দমনমূলক আইনের বলেই তিনি তাঁহার স্বৈরচার শাসন কায়েম রাখিয়াছেন। জনাব নুরুল আমীন আরও বলিয়াছেন যে, আন্দোলনকারীর পাকিস্তানের বাহির হইতে প্ররণা পাইতেছেন। এই উক্তি প্রমাণ করিবার জন্য আমরা তাঁহাকে চ্যালেঞ্জ করিতেছি। বর্তমান আন্দোলন সমগ্র দেশবাসীর আন্দোলন এবং ইহার নেতৃত্ব করিতেছেন বিভিন্ন দল ও মতাবলম্বী কর্মীবৃন্দ। জনাব নুরুল আমীন তাঁহার ঘৃণ্য কার্যকলাপ আজ আর গোপন রাখিতে পারিতেছে না, তাই তিনি এবং লীগ নেতৃবন্দ মিথ্যা রটনার পথ বাছিয়া লইয়াছেন। কিন্তু আমরা বিশ্বাস করি যে, যে জনতা গুলির সম্মুখে বুক পাতিয়া দিয়াছে তাহারা এই সমস্ত অপপ্রচার বিভ্রান্ত হইবে না। তৃতীয়তঃ আইন ও শৃঙ্খলা ভঙ্গ করিয়া শান্তি বিনষ্ট করার জন্য কেন্দ্রীয় সংগ্রাম পরিষদ ও জনসাধারণের উপর তিনি যে দোষারোপ করিয়াছেন তাহার উপর মন্তব্য নিম্প্রয়োজন। আমরা শুধু এইটুকুই বলিতে চাই যে, সরকারের পুলিশ ও মিলিটারীই শান্তিভঙ্গ করিয়াছে এবং বর্তমান বিশৃঙ্খলার জন্য সরকারই দায়ী। সংগ্রাম পরিষদ বরাবরই শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের কথা বলিয়াছেন এবং এখনও শান্তিপূর্ণ হরতালের নির্দেশ দিয়াছেন, আমরা সবৰ্বপ্রকার বিশৃঙ্খলার বিরোধী। জনাব নুরুল আমীন আর বলিয়াছেন যে, ছাত্রগণ জনসভা ও শোভাযাত্রা করার অনুমতি চাহিলে জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট ঐরূপ অনুমতি দিতেন। কিন্তু আসল ব্যাপার এই যে, সংগ্রাম পরিষদ অনুমতি প্রার্থনা করিয়া ব্যর্থকাম হইয়াছেন। অতঃপর জনাব নুরুল আমীন “ব্যবস্থা পরিষদ কর্তৃক বাংলা ভাষার দাবী স্বীকৃত হওয়ার পরও হরতাল পালন” সম্পর্কে যাহা বলিয়াছেন, সে প্রসঙ্গে আমাদের বক্তব্য সুস্পষ্ট… আমাদের দাবী মানিয়া লইলেই আন্দোলন ক্ষান্ত হইবে। অন্যথায় শহীদানের বুকের রক্ত-রঞ্জিত শপথ লইয়া জনসাধারণের আগাইয়া চলার অভিযান কিছুতেই ক্ষান্ত হইবে না। প্রধানমন্ত্রী নুরুল আমীন তাঁহার বক্তৃতায় মিলিটারীর কাজের সমর্থনে যে সমস্ত উক্তি করিয়াছেন, তাহা জনসাধারণের তীব্র ঘৃণারই উদ্রেক করে। এই ব্যাপারে দুইটি বিষয়ে আমরা জনসাধারণকে সর্তক করিয়া দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করিতেছছি। প্রথমতঃ জনাব এ, কে, ফজলুল হককে পূবর্ববঙ্গের প্রধানমন্ত্রীর গদীতে বসাইবার আহবান জানাইয়া প্রকাশিত এশতেহার। রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সহিত এই এশতেহারের কোন সম্পর্ক নাই। আমরা সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করিতেছি যে, আমাদের আন্দোলন কোন বিশেষ ব্যক্তি বা দলকে কেন্দ্র করিয়া নহে, আমাদের আন্দোলন সবর্বদলীয়।

দ্বিতীয়তঃ প্রাদেশিক লীগ ও বিভিন্ন লীগ নেতৃবৃন্দ এখন কুম্ভীরাশ্র বর্ষণ করিয়া জনসাধারণকে বুঝাইতে চাহিতেছেন যে, তাঁহারা ভাষা আন্দোলনের সমর্থক। জনগণ লীগের এই চালে বিভ্রান্ত হইবে না। শহরে যে নরহত্যা সংঘটিত হইয়াছে পুলিশ-মিলিটারী যে জঘন্য আচরণ করিয়াছে তাহার জন্য দায়ী মুসলিম লীগ ও লীগ সরকারই। এই হত্যাকান্ডের জওয়াব মুসলিম লীগকেই দিতে হইবে। সেই কারণেই আমরা দেখিয়াছি যে ব্যবস্থা পরিষদের বহু সদস্য পূবর্ববঙ্গ লীগ পার্লামেন্টারী পার্টি হইতে পদত্যাগ করিয়াছেন। আমরা এই সমস্ত পদত্যাগী সদস্যকে আন্তরিক অভিনন্দন জানাইতেছি। সলিমুল্লা মুসলিম হলে পুলিশ কর্তৃক তল্লাসী বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন অধ্যাপক ও বহু ছাত্র গ্রেফতার মেডিক্যাল হোষ্টেলে নির্মিত শহীদ স্মৃতিস্তম্ভের বিলোপ গতকল্য (মঙ্গলবার) প্রায় বেলা আড়াই ঘটিকায় সলিমুল্লা মুসিলম হলে খানাতল্লাসী হয়। বহু পুলিশ হলে অভ্যন্তরে প্রবেশ করিয়া প্রত্যেকটি কামরা তল্লাসী করে। এই তল্লাসী প্রায় দুই ঘন্টা যাবৎ চলে। পরে অনুমান ৩০ জন ছাত্রকে পুলিশ গ্রেফতার করে। মুসলিম হলের হাউস টিউটর ডঃ মফিউদ্দিন আহমদকেও পুলিশ গ্রেফতার করিয়াছে বলিয়া জানা গিয়াছে। দাঁড়াইয়া থাকিতে দেখা যায়। প্রকাশ, পুলিশ তাঁহাদিগকে ভিতরে প্রবেশ করার অনুমতি দেয় নাই। মেডিক্যাল হোষ্টেল প্রাঙ্গণে নির্মিত শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ পুলিশ ভাঙ্গিয়া দিয়াছে। এই দিন ভোরে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রোক্টর মোজাফফর আহমদ চৌধুরী, অধ্যাপক মুনির চৌধুরী ও অধ্যাপক ডঃ পি, সি, চক্রবর্তীকে পুলিশ গ্রেফতার করে। ইহাদের ছাড়াও জগন্নাথ কলেজের প্রফেসর আজিত কুমার গুহ এবং বরিশালের এম, এল, এ মিঃ সতীন্দ্রনাথ সেনকেও পুলিশ গ্রেফতার করে। বেলা প্রায় আড়াইটার সময় পুলিশ মুসলিম হলের গেটের তালা ভাঙ্গিয়া ভিতরে প্রবেশ করে এবং প্রত্যেক কামরা তন্ন তন্ন করিয়া খানাতল্লাসী করে। এই তল্লাসীর সময় ছাত্রগণ কোন প্রকার বাধা দেন নাই। ছাত্রগণ অভিযোগ করেন যে, তল্লাসীর সময় পুলিশ বহু পুস্তক ও অন্যনাৰ্য জিনিসপত্রও লইয়া গিয়াছে। প্রকাশ, জনৈক ছাত্রের অভিভাবক একটি বন্দুক আনিয়াছিলেন, পুলিশ সেই বন্দুকটিও লইয়া যায়। ভাঙ্গিয়া ফেলিয়াছে। গতকল্য (মঙ্গলবার) শহরে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়া আসে। একমাত্র শিক্ষায়তনসমূহ ছাড়া শহরের প্রতিটি দোকান ও অফিস কাছারী পুনরায় খোলা হয় এবং সেখানে স্বাভাবিকভাবেই কাজ-কর্ম চলে। শহরের রাস্তায় অন্যান্য দিনের চাইতে গতকল্য যানবাহন এবং জনতারও অধিক ভীড় পরিলক্ষিত হয়। শহরে সিনেমা গৃহসমূহ ও সার্কাস পার্টি এই কয়দিন বন্ধ থাকিবার পরে পুনরায় খোলা হয়। জাতীয় ফুটবল প্রতিযোগিতা খেলাও এইদিন অনুষ্ঠিত হয়।
ব্যাংক এবং পোষ্ট অফিস গত কয়েক দিন সম্পূর্ণরূপে বন্ধ থাকিবার ফলে সেখানে গতকল্য অধিক জনতার ভিড় পরিলক্ষিত হয়। বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দানের প্রশ্ন গণপরিষদের আগামী অধিবেশনে আলোচনাজনাব নূর আহমদ কর্তৃক প্রস্তাব উত্থাপনের নোটিশ দান চট্টগ্রাম, ২৬শে ফেব্রুয়ারী- আগামী ২০শে মার্চ পাকিস্তান গণপরিষদের যে অধিবেশন হইবে, জনাব নুর আহমদ তাহাতে উর্দুর সহিত বাংলাকেও পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বলিয়া গ্রহণের জন্য একটি প্রস্তাব উত্থাপন করিবেন। জনাব নূর আহমদ ইতিমধ্যেই পাকিস্তান গণপরিষদের সভাপতির নিকট এ সম্পর্কে একটি নোটিশও পেশ করিয়াছেন। লাহোরস্থ পূর্ব পাক ছাত্রদের প্রস্তাব লাহোর, ২৫ শে ফেব্রুয়ারী।- গত শনিবার লাহোরের উইং হলে জনাব মুস্তাফিজুর রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত লাহোরস্থ পূর্ব পাকিস্তানী ছাত্রদের এক সভায় ঢাকার সাম্প্রতিক দুর্ঘটনার জন্য গভীর দুঃখ প্রকাশ ও ছাত্রদের উপর গুলিবর্ষণের তীব্র নিন্দা করা হয়। সভায় শহীদ দেশপ্রেমিক যুবকদের রুহের মাগফেরাত ও তাদের শোকসন্তপ্ত পরিবারবর্গের এবং পুলিশের ও সশস্ত্র বাহিনীর আক্রমণে আহতদের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করা হয়। সভায় বেসরকারী সদস্যদের দ্বারা গঠিত তদন্ত কমিশন কর্তৃক ঢাকার এই মর্মান্তিক ঘটনার তদন্ত এবং হত্যার জন্য দায়ী কর্মচারীদিগকে অনতিবিলম্বে স্থায়ীভাবে পদচ্যুতি ও বিচার দাবী করা হয়। সভায় পাকিস্তান গণপরিষদকে বাংলা পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার অনুরাধ জানান হইয়াছে। পুলিশ জুলুমের নিন্দা ঢাকার মহিলাদের সভায় প্রস্তাব গ্রহণ ঢাকার নিরীহ ছাত্র ও জনসাধারণের উপর পুলিশের গুলি সম্পর্কে প্রতিবাদে ১২ নং অভয় দাস লেনে মহিলাদের এক বিরাট সভা হয়। সভার বিশেষত্ব ছিল এই যে, শহরে রিক্সা ও ঘোড়ার গাড়ী বন্ধ থাকা সত্ত্বেও বহুদুর হইতে পায়ে হাঁটিয়া বৃদ্ধা ও বয়সী মহিলারা পর্যন্ত এই সভায় যোগদান করেন। সভায় গৃহীত একটি প্রস্তাবে ২১ শে ফেব্রুয়ারী ও পরবর্তী দুইদিনের ছাত্র ও জনসাধারণের উপর পুলিশ ও মিলিটারী নিষ্ঠুর গুলিবর্ষণ, লাঠিচার্জ ও টিয়ার গ্যাস বর্ষণের তীব্র নিন্দা করা হয় এবং হাসপাতালে আহতদের দ্রুত নিরাময় কামনা করা হয়। সভায় ঢাকার হত্যাকান্ডের তদমেত্মর পর দোষী কর্মচারীদের প্রকাশ্য বিচার ও উপযুক্ত শাস্তি দাবী করা হয়। শহরে অকারণে ১৪৪ ধারা জারী করার তীব্র নিন্দা করিয়া সভায় প্রস্তাব গৃহীত হয়।
নুরুল আমীনের কাজের সমালোচনা জনাব এ, সবুরের বিবৃতি প্রাদেশিক লীগ পার্লামেন্টারী পার্টির সদস্য ও খুলনা জেলা লীগের প্রেসিডেন্ট জনাব আবদুস সবুর অসুস্থ অবস্থায় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে আছেন। তিনি পুলিশের সাম্প্রতিক গুলিবর্ষণের নিন্দা করিয়া নিনোক্তরূপ বিবৃতি দান করিয়াছেনঃ গত ২১ শে ফেব্রুয়ারী হইতে ঢাকায় যে সকল কান্ড ঘটিয়াছে, তাহা হাসপাতালের রোগশয্যায় থাকিয়া আমি কিছু কিছু উপলব্ধি করিতেছে। ছাত্রদের উপর যে জুলুম চালিয়াছে তাহা অমানুষিক এবং আকারণে এই জুলুমের অনুষ্ঠান করা হইয়াছে। সরকার ও ছাত্ররা সবাই যখন বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করিতে চায়, তখন বিরোধ কোথায়? ১৪৪ ধারারই বা প্রয়োজন কেন হইয়াছিল? জনাব নুরুল আমিন গত ২৪ শে ফেব্রুয়ারী তারিখে তাহার বেতার বক্তৃতায় ১৪৪ ধারা জারীর যে কারণ দর্শাইয়াছেন, তাহার উৎস কোথায়, অনুমান করা শক্ত নহে। গত কয়েকদিন ধরিয়া ঢাকার একখানি তৃতীয় শ্রেণীর ইংরেজী দৈনিক বিদেশী গুজব ও ভারতীয় এজেন্ট-এর এবং বিশেষ করিয়া হিন্দু ষড়যন্ত্রের আওয়াজ তুলিয়া ছাত্র ও জননেতাদের উপর জুলুমের রথচক্র চালাইবার যে হীন পরামর্শ দিতেছিল, নুরুল আমীন সাহেব তাহার দ্বারা পরিচালিত হইতেছে। ক্ষমতালোলুপতা ত্যাগ করিয়া একটু প্রকৃতিস্থ হইয়া চিন্তা করিলে তিনি বুঝিতে পারবেন যে, অহমিকার বশে দেশকে তিনি কোথায় লইয়া যাইতেছেন। জনাব মোয়াজ্জেম উদ্দীন হোসেন কর্তৃক প্রধানমন্ত্রীর বেতার বক্তৃতার সমালোচনা অবিভক্ত বাংলার প্রাক্তন শিক্ষা সচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন এক বিবৃতিতে বলেন, পূর্ববঙ্গের প্রধানমন্ত্রী জনাব নুরুল আমীনের সর্বশেষ বেতার বক্তৃতায় মনে হয়, যে, ছাত্রগণ রাষ্ট্রবিরোধী কার্যকলাপে উন্মুখ হইয়া আইন ও শৃঙ্খলা ভংগ করিবার ফলেই পুলিশ গুরি করিতে বাধ্য হইয়াছিল। যদি ইহাই সত্য হয় যে, ছাত্রগণ বাহিরের উস্কানীতে আইন ও শৃঙ্খলার ব্যাঘাত ঘটাইতেছিল, তবে তাহাদিগকে পশুপক্ষীর মত হত্যা না করিয়া যথার্থ ব্যবস্থা অবলম্বন বিধেয় ছিল। তিনি আরও বলেনঃ জনাব প্রধানমন্ত্রীর মতে এই আন্দোলন ও বিক্ষোভের পিছনে অন্যের উস্কানী রহিয়াছে। একমাত্র ছাত্রগণই এজন্য দায়ী নহে। যদি তাহাই হয় তবে ছাত্রদের উপর গুলি বর্ষণের হুকুম জারী করা নেহায়েত জনাব নুরুল আমীন যে সমস্ত বিবৃতি দিয়াছেন তাহা দ্বারা জনসাধারণকে আর বিভ্রান্ত করা চলিবে না। গত দুই সপ্তাহে সংবাদপত্র পাঠে ইহা স্পষ্ট বুঝা যাইবে যে, রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কে ছাত্রদের মধ্যে একটি বিশেষ জাগরণের সৃষ্টি হইয়াছে এবং এ ব্যাপারে জনসাধারণ ও স্থানীয় অধিকাংশ সংবাদপত্রের পূর্ণ সমর্থন পাইতেছে। এই আন্দোলন শুরু করিবার জন্য ছাত্র ও জনসাধারণ বাহির হইতে কোন উস্কানী পায় নাই। ইহাতে প্রমাণ হয় যে, সরকার আশংকিত কোন অশান্তি দমনের জন্য ১৪৪ ধারা জারী করেন নাই। জনাব সোহরাওয়াদীর সাম্প্রতিক বিবৃতিঃ পূর্ব পাক আওয়ামী মোছলেম লীগ সেক্রেটারীর তীব্র সমালোচনা ঢাকা, ২৫ শে ফেব্রুয়ারী, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মোছলেম লীগের জেনারেল সেক্রেটারী জনাব শামসুল হক এক বিবৃতি প্রসংগে বলেন, “অন্য কয়েকটি সংবাদপত্রে জনাব শহীদ সোহরাওয়ার্দীর এক বিবৃতি দেখিয়া আমরা অত্যন্ত বিস্মিত হইলাম। উহাতে তিনি পরোক্ষভাবে উর্দুকেই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষারূপে গ্রহণের জন্য ওকালতী করিয়াছেন। তিনি প্রকৃত প্রস্তাবে এরূপ বিবৃতি দিয়াছেন কিনা তাহা আমরা সঠিক জানি না। কিন্তু আমরা ইহা সঠিকভাবে অবগত আছি যে, গত বৎসর আরমানীটোলার এক বিরাট জনসভায় তিনি পরিস্কারভাবে ঘোষণা করিয়াছিলেন যে, বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষারূপে গ্রহণ করা উচিত। এখন কি করিয়া তিনি ইহার বিপরীত বিবৃতি দিতেছেন, যাহা আমরা বুঝিতে পারিতেছি না। আমরা এ সম্পর্কে তাঁহার নিকট হইতে প্রকৃত তথ্য জানিতে চেষ্টা করিতেছি। যদি প্রকৃত প্রস্তাবে তিনি উপরোক্ত মর্মে বিবৃতি দিয়া থাকেন, তবে উহাতে তাঁহার ব্যক্তিগত অভিমতই প্রকাশিত হইয়াছে বলিয়া বুঝিতে হইবে এবং আমরা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করিতেছি যে, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মোছলেম লীগ বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষারূপে গ্রহণ করিবার দাবী করে এবং পাক গণপরিষদে বাংলা রাষ্ট্রভাষারূপে গৃহীত না হওয়া পর্যন্ত এবং সরকার কর্তৃক কার্যকরী না করা পর্যন্ত শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন চালাইবে। আওয়ামী লীগের ঘোষণাপত্রে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষারূপে গ্রহণ করিবার দাবী করা হইয়াছে এবং এই প্রতিষ্ঠান গঠিত হওয়ার পর হইতেই আমরা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষারূপে গ্রহণ করিবার জন্য আন্দোলন করিয়া আসতেছি। ফেব্রুয়ারী ২৮ প্রদেশের শান্তি ও আভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা বজায় রাখার আবেদনঃ জনসাধারণের প্রতি লীগ নেতৃবৃন্দের আহবান গুলিবর্ষণ সম্পর্কে তদমেত্মর জন্য কমিটি গঠনের সোপারেশ “গত সপ্তাহে ঢাকা শহরে গুলি চালনার ফলে যে বেদনাদায়ক ঘটনা সংঘটিত হইয়াছে, তৎসম্পর্কে প্রাদেশিক মুসলিশ লীগ ওয়ার্কিং কমিটি গভীর দুঃখ প্রকাশ করিয়া নিহত ব্যক্তিদের শোকসন্তপ্ত পরিবারবর্গের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করিয়াছেন। হাইকোর্টের বিচারপতি লইয়া একটি নিরপেক্ষ উচ্চক্ষমতাবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করতঃ প্রকৃত দোষী ব্যক্তিদের শাস্তিবিধান এবং নিহত ব্যক্তিদের পরিবারবর্গের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার জন্য ওয়ার্কিং কমিটি সরকারের নিকট দায়ী জানাইয়াছেন। ঢাকা শহরে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়া আসার সংগে সংগেই ১৪৪ ধারা এবং সান্ধ্যা আইন তুলিয়া লওয়ার জন্যও সরকারকে অনুরোধ করা হইয়াছে।’ প্রাদেশিক লীগ ওয়ার্কিং কমিটির প্রেসিডেন্ট মওলানা আবদুল্লাহের বাকী, সেক্রেটারী জনাব ইউসুফ আলী চৌধুরী, ভাইস প্রেসিডেন্ট খাজা হাবিবুল্লা, পাকিস্তান মোছলেম লীগের জয়েন্ট সেক্রেটারী ও প্রাদেশিক লীগ ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য জনাব গিয়াসুদিন পাঠান ও প্রাদেশিক লীগের জয়েন্ট সেক্রেটারী শাহ আজিজুর রহমান এক যুক্ত বিবৃতিতে উপরোক্তরূপ আবেদন করেন। তাহারা আরও বলেন, প্রাদেশিক মুসলিম লীগ ওয়ার্কিং কমিটি, প্রাদেশিক মুসলিম লীগ পার্লামেন্টারী পার্টি এবং প্রাদেশিক আইনসভা বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার যে প্রস্তাব সর্বস্মতিক্রমে গ্রহণ করিয়াছেন তাহা যাহাতে গণপরিষদে গৃহীত হয় তার চেষ্টা করিব। বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব সমর্থনে প্রতিশ্রুতিঃ সাহায্য সচিব জনাব মফিজুদ্দিন আহমদের বিবৃতি ঢাকা, ২৭ শে ফেব্রুয়ারি পূর্ব পাকিস্তানের সাহায্য ও পুনর্বাসিত সচিব জনাব মফিজুদ্দিন আহমদ অদ্য এখানে এই আশ্বাস দেন যে, গণপরিষদে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষারূপে গ্রহণের দাবীকে তিনি পূর্ণভাবে সমর্থন করিবেন।
জনাব মফিজুদিনের বিবৃতি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষারূপে দেখিতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।… পাকিস্তান গণপরিষদ এইরূপ একটি জনপ্রিয় দাবীকে এড়াইয়া চলিবে, তাহা মুহূর্তের জন্যও আমি ধারণা করিতে পারি না। খোদা না করুন যদি গণপরিষদে এ সম্পর্কে আলোচনা করিবার অনুমতি না দেওয়া হয়, তাহা হইলে গণপরিষদের পূর্ব বঙ্গীয় সদস্যগণের উপরই পরবর্তী দায়িত্ব পালিত হইবে। জনাব মফিজুদ্দিন আরও বলেন যে, ব্যবস্থা পরিষদ যখন ভাষা সংক্রান্ত দাবী গৃহীত হইয়া গণপরিষদের বিবেচনাধীন রহিয়াছে, তখন শহরে পূর্ণ শান্তি ও স্বাভাবিক অবস্থা বিরাজ না করার কোন কারণ থাকিতে পারে বলিয়া আমি মনে করি না। তিনি আরও বলেন যে, শহরে পূর্ণ শান্তি ফিরাইয়া আনার জন্য প্রত্যেককে চেষ্টা করিতে আমি অনুরোধ জানাইতেছি। কারণ এই অস্বাভাবিক অবস্থা বর্তমান থাকিলে পাকিস্তানের দুশমনরাই কেবল আনন্দিত হইবে। জনসাধারণ ও ছাত্ৰগণের রাষ্ট্রানুগত্যের উপর আমার পূর্ণ আস্থা রহিয়াছে। তাহারা কোনরূপ অপ্রতিকর ঘটনার পুনরাবৃত্তি হইতে দিবে বলিয়া আমি মনে করি না। পাকিস্তান অবজারভার-এর উপর হইতে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের দাবীঃ সম্পাদক পরিষদের সভায় প্রস্তাব গ্রহণঃ পূর্ব বংগ সরকারের আচরণের নিন্দা লাহোর, ২৪ শে ফেব্রুয়ারী- আদ্য এখানে ‘ডন সম্পাদক জনাব আলতাফ হোসেনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত নিন্দা করিয়া এবং অবিলম্বে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের দাবী জানাইয়া প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়।…… সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদের দফতর হইতে বলা হইয়াছে যে, বিভিন্ন লোক রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের নাম করিয়া জনসাধারণের নিকট হইতে চাঁদা আদায় করিতেছে। এই জন্য জনসাধারণকে অনুরোধ করা হইতেছে যে, তাহারা যেন সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের আহবায়ক (কে.জি মাহবুব)-এর দস্তখতযুক্ত ছাপা রসিদ না লইয়া বা সীলবিহীন চাঁদার বাক্সে চাঁদা না দেন।
শিরোনাম সূত্র তারিখ ভাষা-আন্দোলনকালীন দৈনিক দৈনিক আজাদ ২২ ও ২৪ ফেব্রুয়ারী ১৯৫২ আজাদ-এর দুটি সম্পাদকীয় (>) তদন্ত চাই গতকাল ঢাকার বুকে বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিক্যাল কলেজের নিকটে যে শোচনীয় দুর্ঘটনা ঘটিয়াছে, তাহা যেমন মৰ্মভেদী তেমনি অবাঞ্চিত। আইন অমান্য, নিয়মভংগ, উচ্ছংখলতা সমর্থনযোগ্য নয়, কিন্তু এই সংগে এ কথাও সত্য যে, আইন অমান্য হওয়ার মত ক্ষেত্র সৃষ্টি করাও কোন গণতান্ত্রিক সরকারের উচিত নয়। বিগত দুই দিনের ঘটনা পর্যালোচনা করিলে দেখা যায় যে, বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করিবার দাবীর সমর্থনে ছাত্র প্রতিষ্ঠানের পক্ষ হইতে প্রায় একপক্ষ পূর্বে ধর্মঘট পালন করিবার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা হইয়াছিল। গত পরশু তারিখে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ হঠাৎ ১৪৪ ধারা জারী করিয়া শোভাযাত্রা ও সভা-সমিতি বন্ধ করিয়া দেন। গতকাল এই ব্যাপারকে কেন্দ্র করিয়া ছাত্র বিক্ষোভ হইয়াছে, টিয়ার গ্যাস ও গুলি চলিয়াছে, কতকগুলি হতাহতও হইয়াছে। ১৪৪ ধারা জারী করিবার কোন কারণ ঘটিয়াছে কিনা, এই প্রশ্নই সকলের আগে মনে হয়। কয়েকদিন পূর্বে প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীন যখন এখানে আসিয়াছিলেন, তখন ঢাকার স্কুল-কলেজের ছাত্ররা ধর্মঘট পালন এবং বিরাট শোভাযাত্রা করিয়াছিল, তখন শহরে শান্তিভংগ হয় নাই। গতকল্য ছাত্র ধর্মঘট ও শোভাযাত্রা হইলে শান্তি ভংগের আশংকা সম্পর্কে কর্তৃপক্ষ কতটা নির্ভরযোগ্য সংবাদ পাইয়াছিলেন, বর্তমান মন্ত্ৰীসভা দেশবাসীকে তাহা জানাইতে বাধ্য বলিয়া আমরা মনে করি। গতকল্যকার ঘটনার মধ্যে গুলি চালাইয়া কতকগুলি ছাত্রকে হতাহত করার ব্যাপার সব চাইতে বড় হইয়া উঠিয়াছে। পাকিস্তানে এরূপ ঘটনা ঘটিতে পারে বলিয়া আমরা কখনও ভাবিতে পারি নাই- দেশের জনসাধারণও আশা করে নাই। গুটিকতক বালক ও যুবক যদি নিয়মবিরোধী কার্য করিয়াই থাকে, এমন কি যদি তাহারা কর্তৃপক্ষকে উত্তেজনার কারণও দিয়া থাকে, তাহা হইলেও গুলি চালাইবার মত সংকটাপন্ন অবসস্থা হইয়াছিল কিনা, তাহা বিশেষভাবে বিবেচ্য, হতাহতদের অনেকের আহত স্থান সম্পর্কে যে সংবাদ পাওয়া গিয়াছে, তাহাতে নির্বিচারেও গুলি চালান হইয়াছে বলিয়া আমরা মনে করিতেছি। কেবল টিয়ার গ্যাস ছাড়িয়া জনতাকে ছত্ৰভংগ করা কি সম্ভব ছিল না? দেহের উর্ধ্বাংগে গুলি চালান সুবিবেচনা সংগত কিনা, অথবা উহা সাধারণ নিয়মের ব্যতিক্রম কিনা, তাহাই আজ আমরা কর্তৃপক্ষকে জিজ্ঞাসা করিতেছি। উর্ধ্বাংগে গুলি চালানোর কথা দূরে থাক, মোটেই গুলি চালাইবার প্রয়োজন হইয়াছিল বলিয়া আমরা মনে করিতে পারিতেছি না। সমস্ত অবস্থা বিবেচনা করিয়া আমরা মনে করি, একটা নিরপেক্ষ শক্তিশালী ও জনসাধারণের আস্থাভাজন ব্যক্তিদের লইয়া গঠিত কমিটির দ্বারা এই ঘটনার বিশদ ও প্রকাশ্য তদন্ত হওয়া আবশ্যক। হাইকোর্টের জজ এবং বেসরকারী ব্যক্তিদের লইয়া এই কমিটি গঠিত হওয়া প্রয়োজন। স্বাধীন দেশের নাগরিকগণের ন্যায়্য অধিকার সংরক্ষণের জন্য দেশবাসীর পক্ষ হইতে এই তদন্ত দাবী করিতেছি। তদন্তকালে প্রধানতঃ নিমেণাক্ত বিষয়গুলির বিচার করা আবশ্যক-(১) ১৪৪ ধারা জারী করিবার প্রয়োজন কি ছিল? (২) বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিক্যাল কলেজ এলাকার মধ্যে পুলিশের আক্রমণ চলিয়াছিল কি? (৩) গুলি চালাইবার মত অবস্থা ঘটিয়াছিল কি? উপরে আমরা যে তদন্ত দাবী করিয়াছি, উক্ত প্রস্তাব কার্যকর করিলে সমস্ত ঘটনা এবং জনকয়েক তরুণের মৃত্যুর জন্য কাহারা দায়ী, তাহাও প্রকাশ হইবে বলিয়া আমরা ঘটনা সম্পর্কে বিশদ আলোচনা করিলাম না। গতকল্যকর দুর্ঘটনায় যে সমস্ত পরিবার শোকসন্তপ্ত, তাহদের শোককে আমরা নিজেদের শোক বলিয়া গণ্য করি, আমরা সেই সব পরিবারকে গভীর সমবেদনা জানাইতেছি। (২২শে ফেব্রুয়ারী ১৯৫২) (>) ভুলের মাশুল গত শুক্রবার বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষারূপে গণ্য করার জন্য পাক-গণপরিষদের নিকট সুপারিশ করিয়া প্রধানমন্ত্রী জনাব নুরুল আমীন ব্যবস্থা পরিষদে এক বিশেষ প্রস্তাব উত্থাপন করেন; উহা সৰ্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। বহু বিলম্বে এবং অবাঞ্চিত ঘটনার পর মন্ত্রিসভা ও ব্যবস্থা পরিষদের সদস্যগণের আংশিক শুভবুদ্ধি উদয় হইয়াছে দেখিয়া সকলেই সুখী হইবেন। কিন্তু এই প্রস্তাব কার্যকরী করণে মন্ত্রিসভা ও তাদের সমর্থক দল কতটা দৃঢ়তা দেখাইবেন, এ সম্পর্কে জনমনে সন্দেহের অবসান হয় নাই। বিশেষতঃ যেসব ঘটনার পর উক্ত প্রস্তাব পেশ ও গ্রহণ করা হয় উহাই মন্ত্রিসভার উপর জনসাধানণের আস্থা-হাস করিয়াছে। প্রস্তাব পেশ করবার সময় জনাব নুরুল আমীন বলেন যে, গত বৃহস্পতিবারে সরাকার যে ব্যবস্থা অবলম্বন করেন তাহ রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কিত দাবীর বিরোধী বলিয়া মনে করার নানরূপ ভ্রান্ত ধারণার সৃষ্টি হইয়াছে। তিনি বলেন যে, সেরূপ বিরোধিতা করার ইচ্ছা সরকারের নাই। ইহাই যদি প্রধানমন্ত্রী ও তার মন্ত্ৰীসভার প্রকৃত বক্তব্য হয়, তাহা হইলে তাহারা ২১শে তারিখের পূর্বেই উহা প্রকাশ না করার কারণ দুজ্ঞেয় রহস্যরূপে থাকিয়া যাইতেছে। এমন কি ২১শে তারিখের সমাল বেলাতেও এরূপ একটা বিবৃতি মন্ত্রিসভার তরফ হইতে প্রকাশিত হইলে পরবর্তী মর্মম্ভদ ঘটনা হইত না এবং আমাদের বিশ্বাস, কতকগুলি অমূল্য জীবনেরও অবসান হইত না। সুতরাং নানারূপ ভ্রান্ত ধারণার সৃষ্টি হইয়াই থাকে, তাহা হইলে সেজন্য জনসাধারণকে দোষ দেওয়া যায় না। শহরে ১৪৪ ধারা জারীর কারণ ব্যাখ্যা করিতে গিয়া প্রধানমন্ত্রী বলিয়াছেন, সরকার জানিতে পারিয়াছেন যে, কোনও কোনও লোক শহরের স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে আচল করিতে চায়। ২২শে তারিখে প্রকাশিত সরকারী বিবৃতিতেও এই মর্মে মন্তব্য প্রকাশিত হইয়াছিল যে, যে সকল তথ্য আছে তাতে জানা যায়, বেআইনী কার্যকলাপের দরুন আজকের (অর্থাৎ ২১ শে তারিখের) অবাঞ্চিনীয় ঘটনা ঘটিয়াছে, তাহার জন্য দায়ী এমন একদল লোক, যাহাদের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় বা কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সম্পর্ক নাই। কথাটা যদি সত্য হয় তাহা হইলে এতদিন জনসাধানণের নিকট এসব তথ্য যতদূর সম্ভব উদঘাটন করা হয় নাই কেন? যদি পূর্বান্থেই বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করা সম্পর্কে মন্ত্রিসভার মনোভাব প্রকাশিত হইত এবং দেশবাসীর নিকট রাষ্ট্র-বিরোধীদের কার্যকলাপ প্রকাশিত হইত, তাহা হইলে গুলি চালান বন্ধ হত। ১৪৪ ধারার প্রয়োজন হইত না। মন্ত্রিসভা আজ নিজেদেরে যে অবস্থা করিয়াছেন তাহাকে কেবল সুস্পষ্ট অভিযোগ দ্বারা দেশের জনসাধারণকে স্বীকৃতি বা তাহদের আস্থা অর্জিত করিতে পারবেন বলিয়া মনে হয় না। দেশে জনসাধারণ শান্তি ও শৃংখলাকারী বা রাষ্ট্রবিরোধীদের কখনও সহ্য করিবে না। ছাত্রসমাজের দেশাত্ববোধের উপর আমাদের সম্পূর্ণ আস্থা আছে। সুতরাং সরকার আজ তাঁহাদের খোলা ঢেল টেবিলে রাখুন। সব তথ্য হয়ত প্রকাশ করা সম্ভব নয়। কিন্তু যথাসম্ভব প্রকাশ করুন। আমরা তাহদের এ নিশ্চয়তা দিতে পারি যে, আমাদের ছাত্রসমাজ, আমাদের দেশের জনসাধারণ দুষ্কৃতকারীদের সমূলে উচ্ছেদ করিতে বিন্দুমাত্র দ্বিধাবোধ করিবে না। জনাব নুরুল আমীন ও তাঁর মন্ত্রিসভা ভুলের পর ভূল করিয়া চলিয়াছেন। তাঁহার নিজেদের গণনেতা বলিয়া দাবী করেন। সর্বজনবিদিত যে, জননেতা তাহারাই, যাদের পরিপূর্ণ যোগাযোগ আছে জনতার অন্তরের সঙ্গে, সংকটকালে তাঁহারা ‘সঙ্কটকালে তাঁরা……..জনতাকে সুষ্ঠুপথে চালিত করিতে পারেন। এই মাপকাঠিতে জনাব নুরুল আমীন ও তাঁর মন্ত্রিসভার বিচার করিলে তাহদের সম্পর্কে কি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিতে হয়, তা নিম্প্রয়োজন। সে যাহাই হোক বর্তমান মন্ত্রিসভার বিচার দেশের জনসাধারণই করিবে। কিন্তু আজ তাহারা যে জটিল পরিস্থিতি সৃষ্টি করিয়াছেন, তাহার সমাধান তাহদেরই করিতে হইবে। এখন তাহদেরই ভুলে যে অবাঞ্চিত পরিস্থিতির উদ্ভব হইয়াছে, উহার সমাধানের জন্যই তাহদেরই অগ্রসর হওয়া কর্তব্য। এটা তাহাদের ভুলের মাশুল এবং তাহা দেওয়া হইবে যদি তাহারা অহেতুক প্রেষ্টিজ ত্যাগ করিয়া অনতিবিলম্বে ১৪৪ ধারা প্রত্যাহার করেন এবং উচ্চপর্যায়ের নিরপেক্ষ আস্থাভাজন তদন্ত কমিটি নিয়োগ করেন। শান্তি ও শৃঙ্খলা রক্ষাকল্পে এবং দেশের কল্যাণের জন্য এ ছাড়া অন্য কোন পথ আছে বলিয়া আমরা মনে করি না। (২৪শে ফেব্রুয়ারী ১৯৫২)
———-

পূর্ব বাংলা সরকার
স্বরাষ্ট্র বিভাগ
বিশেষ শাখা
অধ্যাদেশ
ক্রমঃ ৮৪২- ইউ এস. ঢাকা, ২৪শে মার্চ, ১৯৫২।
এই লোক বাস্তবে মুযাফফর আহমেদ চৌধুরী নামে পরিচিত, ইব্রাহীমপুর নিবাসী মৌলভী ওবায়দুল্লাহ এর পুত্র হইতে ডাকঘরঃ লক্ষ্মীপুর, জেলাঃ নোয়াখালী এবং হইতে, বিশ্ববিদ্যালয় কোয়ার্টার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গেট, ঢাকা। তিনি “পূর্ব বাংলা জন নিরাপত্তা অধ্যাদেশ,১৯৫১ (পূর্ব বাংলা অধ্যাদেশ নং XXI,১৯৫১) ” এর অনুচ্ছেদ ৪১ এর বিধান অনুযায়ী দিনাজপুর কারাগারে আটক আছেন যা বহাল এবং চালু আছে “পূর্ব বাংলা মেয়াদ উত্তীর্ণ আইন, ১৯৫১ (পূর্ব বাংলা আইন নং XXXVIII, ১৯৫১)” দ্বারা।
যেহেতু উক্ত ব্যক্তির বিপক্ষে আনা প্রমাণাদি বিবেচনা করে গভর্নর এই বিষয়ে সন্তুষ্ট যে জন নিরাপত্তা এবং জন শৃংখলা বজায়ের ক্ষেত্রে ক্ষতিকর কোনো বিষয়ে উক্ত ব্যাক্তি কে অংশগ্রহণ থেকে বিরত রাখতে, তার আটকাদেশ বজায় রাখার উদ্দেশ্যে নিম্নবর্ণিত আইনগুলো তৈরী করা প্রয়োজনঃ
সুতরাং ক্ষমতা প্রয়োগপূর্বক যা অর্পিত আছে “পূর্ব বাংলা জন নিরাপত্তা অধ্যাদেশ,১৯৫১ (পূর্ব বাংলা অধ্যাদেশ নং XXI,১৯৫১) এর ১৭ নং অনুচ্ছেদের উপ-অনুচ্ছেদ (১) এর ধারা (A) দ্বারা, যা বহাল এবং চালু আছে উক্ত আইন দ্বারা, গভর্নর নির্দেশ দিচ্ছেন যেঃ
(১) উক্ত লোক বর্ণিত অধ্যাদেশের অনুচ্ছেদ ১৮ এর বিধানের অধীনে আটকাদেশ বহাল এবং অব্যাহত থাকবে উক্ত আইনের অধীনে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত;
(২) এই অনুচ্ছেদের ১ নং ধারার বিধান অনুযায়ী উক্ত ব্যক্তি পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত দিনাজপুর কারাগারে আটক অবস্থায় থাকবেন, এবং
(৩) উক্ত ব্যক্তি আটক থাকাকালীন অবস্থায় “পূর্ব বাংলা জন নিরাপত্তা আইন (বন্দী নিরাপত্তা) ,১৯৫১” এ বর্ণীত শর্তাবলীর অধীনে থাকবে।

গভর্নরের আদেশক্রমে
এম এফ বারী
সহকারী সচিব, পূর্ব বাংলা সরকার।

[পূর্ব বাংলা জন নিরাপত্তা অধ্যাদেশ,১৯৫১ (পূর্ব বাংলা অধ্যাদেশ নং XXI,১৯৫১) এর অনুচ্ছেদ ১৯ এর অধীনে আটকাদেশের ভিত্তির বার্তা, পূর্ব বাংলা মেয়াদ উত্তীর্ণ আইন, ১৯৫১ (পূর্ব বাংলা আইন নং XXXVIII, ১৯৫১) দ্বারা বহাল এবং চালু আছে। ]
পূর্ব বাংলা জন নিরাপত্তা অধ্যাদেশ,১৯৫১ (পূর্ব বাংলা অধ্যাদেশ নং XXI,১৯৫১) এর অনুচ্ছেদ ১৯ অনুসারে, পূর্ব বাংলা মেয়াদ উত্তীর্ণ আইন, ১৯৫১ (পূর্ব বাংলা আইন নং XXXVIII, ১৯৫১) দ্বারা বহাল এবং চালুকৃত, আপনি অধ্যাপক মুযাফফর আহমেদ চৌধুরী নামে পরিচিত, ইব্রাহীমপুর নিবাসী মৌলভী ওবায়দুল্লাহ এর পুত্র হইতে ডাকঘরঃ লক্ষ্মীপুর, জেলাঃ নোয়াখালী এবং হইতে, বিশ্ববিদ্যালয় কোয়ার্টার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গেট, ঢাকা, বর্তমানে আদেশ নং-৮৪২-এইচ এস, তারিখ ২৪শে মার্চ ১৯৫২ যা উক্ত অধ্যাদেশের ১৭ নং অনুচ্ছেদের ১ উপধারা অনুযায়ী তৈরী এবং যা উক্ত আইনে বহাল এবিং চালু আছে, এর অধীনে দিনাজপুর কারাগারে আটককৃত, আপনাকে জানানো যাচ্ছে যে নিম্নলিখিত ভিত্তি অনুযায়ী আপনার আটকাবস্থা প্রয়োজনীয় মনে করা হয়েছেঃ
১। আপনি ঢাকা জেলার একটি গোপন সংস্থার অবৈধ কার্যাবলীর সাথে যুক্ত ছিলেন এবং আছেন, যার উদ্দেশ্য এই সরকার কে সহিংস উপায়ে উৎখাত করা (যেমন পূর্ব বাংলা সরকার) এবং তা হয় ১৯৪৭, ১৯৪৮, ১৯৫১ এবং ১৯৫২ সালে ( আপনাকে গ্রেফতারের আগপর্যন্ত আপনি ঢাকা জেলায় সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষতিকর এবং ঐক্যনাশক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত ছিলেন, বিশেষত ১৯৪৭ এর ডিসেম্বর, ১৯৪৮ এর জানুয়ারী, ফেব্রুয়ারী এবং মার্চ, ১৯৫১ এর জুন এবং ১৯৫১ এর ফেব্রুয়ারী মাসে। (গ্রেফতারের আগপর্যন্ত আপনি এবং কিছু রাষ্ট্রবিরোধী লোকজন বৈঠক করেছেন এবং ঢাকা জেলার জনগণ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রিদের মাঝে ক্ষতিকর প্রচারণা চালিয়েছেন এবং তাদের কে সরকারের বিরুদ্ধে প্ররোচিত করেছেন, যার চূড়ান্ত উদ্দেশ্য ছিলো পূর্ব বাংলার সরকার কে উৎখাত করা। উপরোক্ত ঘটনা সমূহ সত্য হলে তা জনস্বার্থ পরিপন্থী বলে গণ্য।
২। উপরে উল্লিখিত আপনার সকল কর্মকাণ্ড জনগণের আইন এবং প্রদেশের অস্তিত্ত্বের প্রতি হুমকি এবং বিপদ স্বরুপ।
৩। আপমাকে আরো জানানো যাচ্ছে যে, আপনার বিরুদ্ধে আটকাদেশের বিরুদ্ধে সরকারের প্রতি লিখিত বক্তব্য উপস্থাপনের অধিকার আপনার রয়েছে। আপনি তা করতে চাইলে, আপনার লিখিত উপস্থাপন দিনাজপুর কারাগারের নিয়ন্ত্রকের মাধ্যমে (যেখানে আপনি বর্তমানে আটক আছেন) নিম্নস্বাক্ষরিত ব্যক্তির কাছে পাঠাতে হবে।
গভর্নরের আদেশক্রমে
এম এফ বারী
সহকারী সচিব, পূর্ব বাংলা সরকার
স্বরাষ্ট্র (বিশেষ) বিভাগ।

পূর্ব বাংলা সরকার
স্বরাষ্ট্র বিভাগ
বিশেষ শাখা
অধ্যাদেশ
ক্রম ১২২০ এইচ.এস. ঢাকা, ৪ঠা এপ্রিল, ১৯৫২
এই লোক বাস্তবে মীর্জা গোলাম হাফিয নামে পরিচিত, আটওয়ারী নিবাসী মরহুম মীর্জা আসিমুদ্দিন এর পুত্র জেলাঃ দিনাজপুর এবং হইতে, ৪০/২ আবদুল হাদী লেন, ডাকঘরঃ কোতোয়ালী, জেলাঃ ঢাকা। তিনি “পূর্ব বাংলা জন নিরাপত্তা অধ্যাদেশ,১৯৫১ (পূর্ব বাংলা অধ্যাদেশ নং XXI,১৯৫১) ” এর অনুচ্ছেদ ৪১ এর বিধান অনুযায়ী ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আটক আছেন যা বহাল এবং চালু রয়েছে “পূর্ব বাংলা মেয়াদ উত্তীর্ণ আইন, ১৯৫১ (পূর্ব বাংলা আইন নং XXXVIII, ১৯৫১)” দ্বারা।
যেহেতু উক্ত ব্যক্তির বিপক্ষে আনা প্রমাণাদি বিবেচনা করে গভর্নর এই বিষয়ে সন্তুষ্ট যে জন নিরাপত্তা এবং জন শৃংখলা বজায়ের ক্ষেত্রে ক্ষতিকর কোনো বিষয়ে উক্ত ব্যাক্তি কে অংশগ্রহণ থেকে বিরত রাখতে, তার আটকাদেশ বজায় রাখার উদ্দেশ্যে নিম্নবর্ণিত আইনগুলো তৈরী করা প্রয়োজনঃ
সুতরাং ক্ষমতা প্রয়োগপূর্বক যা অর্পিত আছে “পূর্ব বাংলা জন নিরাপত্তা অধ্যাদেশ,১৯৫১ (পূর্ব বাংলা অধ্যাদেশ নং XXI,১৯৫১) এর ১৭ নং অনুচ্ছেদের উপ-অনুচ্ছেদ (১) এর ধারা (A) দ্বারা, যা বহাল এবং চালু আছে উক্ত আইন দ্বারা, গভর্নর নির্দেশ দিচ্ছেন যেঃ
(১) উক্ত লোক বর্ণিত অধ্যাদেশের অনুচ্ছেদ ১৮ এর বিধানের অধীনে আটকাদেশ বহাল এবং অব্যাহত থাকবে উক্ত আইনের অধীনে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত;
(২) এই অনুচ্ছেদের ১ নং ধারার বিধান অনুযায়ী উক্ত ব্যক্তি পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত দিনাজপুর কারাগারে আটক অবস্থায় থাকবেন, এবং
(৩) উক্ত ব্যক্তি আটক থাকাকালীন অবস্থায় “পূর্ব বাংলা জন নিরাপত্তা আইন (বন্দী নিরাপত্তা) ,১৯৫১” এ বর্ণীত শর্তাবলীর অধীনে থাকবে।

গভর্নরের আদেশক্রমে
এম এফ বারী
সহকারী সচিব, পূর্ব বাংলা সরকার।

পূর্ব পাকিস্তান গণতন্ত্রী দলের আত্মপ্রকাশঃ দৈনিক আজাদ ১৭ ও ১৮ জানুয়ারী ১৯৫৩ ১৭ জানুয়ারী (স্টাফ রিপোর্টার) গতকল্য (শুক্রবার) আরমানীটোলা ময়দানে প্রস্তাবিত পূর্ব পাকিস্তান গণতন্ত্রী দলের তিন দিনব্যাপী সম্মেলন উদ্বোধন হয়। সম্মেলনে প্রদেশের নয়টি জেলা হইতে আগত প্রতিনিধিগণ যোগদান করেন। অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতি জনাব দেওয়ান মাহবুব আলী সম্মেলনে বক্তৃতা প্রসংগে বলেন যে, দেশের বর্তমান সামাজিক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন সাধনকল্পে অবিলম্বে একটি যুক্তরাষ্ট্র গঠনের প্রয়োজন রহিয়াছে। তিনি মম্ব্য করেন যে, দেশের বর্তমান গঠনতন্ত্র ইংরেজের সাম্রাজ্যবাদ ও সামন্ততন্ত্রেরই নামান্তর মাত্র। মুসলিম লীগ সরকার ধনী শ্রেণীর ধন বৃদ্ধিকেই সহায়তা করিয়াছে শুধু সাধারণ মানুষের দুঃখদুর্দশা লাঘবের কোন চেষ্টাই করে নাই। দেশ হইতে সাম্রাজ্যবাদ ও সামন্ততন্ত্রবাদের উচ্ছেদ করিয়া পাকিস্তানের সমৃদ্ধিতে সকল নাগরিককে সমান অধিকার দানের উদ্দেশ্যই গণতন্ত্রী দল গঠিত হইয়াছে বলিয়া তিনি উল্লেখ করেন। বিভিন্ন দিক সম্পর্কে আলোচনা করিয়া বলেন যে, দেশ শাসনে মুসলিম লীগ সরকার সম্পূর্ণ ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। গত পাঁচ বছর লীগ শাসনের ফলে দেশের বিভিন্ন দিকে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হইয়াছে এবং দেশবাসীর দুর্দশা চরম সীমায় পৌঁছিয়াছে। পাকিস্তানের বৈদেশিক নীতির সমালোচনা করিয়া তিনি কবলেন যে, উহা নিরপেক্ষ নীতি নয় এবং উহা প্রাশ্চাত্য সাম্রাজ্যবাদী ব্লকের প্রভাবাধীন। দৃষ্টান্তস্বরূপ তিনি বৃটিশ কমনওয়েলথের সহিত পাকিস্তানের জড়িত থাকবার কথা উল্লেখ করেন। ১৯ জানুয়ারী (স্টাফ রিপোর্টার) গতকল্য (রবিবার) নবপ্রতিষ্ঠিত গণতন্ত্রী দলের তিন দিবসব্যাপী অধিবেশন শেষ হয়। অপরাহ্নে বিপুল জনসমাবশে প্রকাশ্য অধিবেশন হয়। প্রকাশ্য অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন জনাব দবিরউদ্দীন আহমদ চৌধুরী। সভায় গণপরিষদের সদস্য পাঞ্জাবের জনাব সর্দার শওকত হায়াত খান, জনাব আবদুস সালাম, জনাব মাহমুদ আলী প্রমুখ ব্যক্তি বক্তৃতা করেন। জনাব শওকত হায়াত খান তাঁহার বক্তৃতায় পাকিস্তান সরকার ও মূলনীতি কমিটির রিপোর্টের সমালাচনা করিয়া বলেন যে, উক্ত রিপোর্টে পূর্ব পাকিস্তানের বাসিন্দাদের সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষা করা হইয়াছে। পাকিস্তানে কনফেডারেশন প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি দাবী জানান। তিনি বলে যে পশ্চিম পাকিস্তানের গদীতে আসীন থাকিয়া পূর্ব পাকিস্তানের বাসিন্দাদের অভাব-অভিযোগের সঠিক সন্ধান রাখা এবং তাহা নিরসনের উপযুক্ত উপায় নির্ধারণ করা সম্পূর্ণ অসম্ভব কল্পনা। পূর্ব পাকিস্তানের অধিবাসীর সুবিধা-অসুবিধার প্রতি দৃষ্টি রাখা এই প্রদেশের বিবিধ উন্নতির উপয় নির্ধারণ একমাত্র পূর্ব পাকিস্তানবাসীর দ্বারই সম্ভব। এই কারণে তিনি পূর্ব পাকিস্তানবাসীকে সম্মিলিতভাবে কনফেডারেশন প্রতিষ্ঠার দাবীতে আন্দোলন শুরু করিতে উপদেশ দেন।
গণপরিষদে পূর্ব বংগের যে সকল সদস্য মূলনীতি কমিটির রিপোর্ট মানিয়া লইয়াছেন তাঁহাদের আশু পদত্যাগের দাবীতে জনমত গঠনের জন্যও তিনি পূর্ব পাকিস্তানের অধিবাসীকে উপদেশ দেন। সর্বশেষে তিনি মন্তব্য করেন যে, মূলনীতি কমিটির রিপোর্ট জনস্বার্থের প্রতি লক্ষ্য রাখিয়া গঠন করা হয় পশ্চিম পাকিস্তানের আজাদ পাকিস্থান পার্টি এবং পূর্ব পাকিস্তানের গণতন্ত্রী দলের উদ্দেশ্যে ও কর্মপদ্ধতি ভবিষ্যতে একইরূপ হইবে বলিয়াও তিনি তাঁহার বক্তৃতায় উল্লেখ করেন। সভায় জনাব হাজী মোহাম্মদ দানেশকে নবপ্রতিষ্ঠিত গণতন্ত্রী দলের সভাপতি, জনাব মুজিবর রহমান খান (সম্পাদক, চাষী’), জনাব আব্দুল জববার (খুলনা), জনাব দবির উদ্দীন আহমদ চৌধুরী (সিলেট), জনাব মহিউদ্দীন আহম্মদ (সম্পাদক, আমারদেশ’), ও অধ্যাপক রফিকুল ইসলামকে (চাঁদপুর) সহসভাপতি; জনাব মাহমুদ আলীকে সাধারণ সম্পাদক এবং জনাব আতাউর রহমান (রাজশাহী) ও দেওয়ান মাহবুব আলীকে যুগাসম্পাদক নির্ধারণ করা হয়। ইহা ছাড়া ২১ জনকে সভ্য নির্ধারণ করা হয়। গুরুত্বপূর্ণ বিষয়সমূহ নির্ধারণ এবং তাহার পরিপ্রেক্ষিতে কর্মপন্থা স্থির করিবার জন্য আজাদ পাকিস্থান পার্টির সহিত আলা-আলোচনা চালাইবার ক্ষমতাও নবগঠিত কমিটির হাতে অর্পণ করা হয়।

পাকিস্তান অবজারভার
জুন 1,1954
সারা প্রদেশজুড়ে ১৯০ ব্যাক্তিকে আটক । পশ্চিম পাকিস্তান ৯২-ক ধারা জারিকে সাধুবাদ জানিয়েছে ।
সাধারণ অর্থে প্রদেশজুড়ে 92-ক আরোপের পর থেকে শহরের জনসাধারণ এর মধ্যে হতাশা এবং দুশ্চিন্তা বিরাজ করছে । সেনাবাহিনীর বহর শহরজুড়ে অবিরত টহল এবং কৌশলগত স্থান এ প্রহরা দিচ্ছে।
উল্লেখ করা যেতে পারে যে, আদমজীর দাঙ্গার পর থেকে শহরজুড়ে যেকোন প্রকার বিশৃঙ্খলা মোকাবিলার জন্য পূর্ব প্রস্তুতি মূলক ভাবে সেনাবাহিনীকে নিয়োজিত করা হয়েছে।
গতকাল (সোমবার) সন্ধ্যা পর্যন্ত সারা প্রদেশজুড়ে ১৯০ ব্যাক্তিকে আটক করা হয়েছে তন্মধ্যে রহিয়াছেন সাবেক হক মন্ত্রিসভার অন্যতম সদস্য জনাব শেখ মুজিবুর রহমান, মির্জা গোলাম হাফিজ, এমএলএ, জনাব গোলাম কাদের চৌধুরী, এমএলএ প্রমূখ ।
চট্টগ্রাম থেকে গ্রেপ্তার
চট্টগ্রাম থেকে প্রাপ্ত একটি রিপোর্ট বলছে যে, সোমবার গ্রেপ্তারকৃত ১৭ জনদের মধ্যে জনাব জহুর আহমেদ চৌধুরী, এমএলএ এবং জেলা আওয়ামী লীগ সম্পাদক জনাব এ. আজিজ প্রমূখ রয়েছেন ।
সিলেটে
পাকিস্তান গণতন্ত্রী দল সেক্রেটারি জেনারেল জনাব মাহমুদ আলী, এমএলএ, কে রোববার রাতে সিলেটে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে জানা গেছে।
বগুড়ায়
ঢাকায় প্রাপ্ত রিপোর্ট অনুযায়ী বগুড়ায় সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে এবং কয়েকজনকে গ্রেপ্তারের খবর পাওয়া গেছে।
APP adds : নির্ভরযোগ্য রিপোর্ট অনুযায়ী সন্ধ্যা পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি শান্ত এবং স্বাভাবিক ছিল এবং কোন জেলায় কোন অপ্রীতিকর ঘটনার খবর পাওয়া যায়নি।
ঢাকার শহর জীবন বেশ স্বাভাবিক ছিল এবং মানুষকে ঈদের কেনাকাটায় ব্যস্ত দেখা গেছে।
আদমজী জুটমিল এর সাম্প্রতিক দাঙ্গা নিয়ে উত্তেজনা শেষ হয়েছে এবং মিল ৬ জুন থেকে পুনরায় কাজ শুরু করবে বলে আশা করা হচ্ছে।
এই সন্ধ্যা পর্যন্ত সারা প্রদেশজুড়ে, ১৮৮ ব্যক্তিকে পাবলিক সেফটি অ্যাক্ট এবং অন্যান্য নির্দিষ্ট অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছে।
সকল স্থানীয় পত্র-পত্রিকার উপর প্রাক-সেন্সরশিপ উপর আরোপিত হয়েছে।
আরেকটি A.P.P. করাচি থেকে রিপোর্ট, মে 31 বলেছেন
সিন্ধু আইনসভার স্পিকার এবং নিখিল-পাকিস্তান মুসলিম লীগের ভাইস প্রেসিডেন্ট জনাব গোলাম আলী তালপুর, সংবাদ মাধ্যমকে নিম্নোক্ত বিবৃতি দিয়েছেনঃ

“আমি মহামান্য গভর্নর জেনারেল এবং পাকিস্তানের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কে পূর্ব বাংলার ফজলুল হক মন্ত্রিসভা অপসারণ করার সময়োচিত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আন্তরিকভাবে অভিনন্দন জানাচ্ছি।
আমি জোর দিয়ে জনাব ফজলুল হকের কেন্দ্রীয় সরকার এর সাথে অসহযোগী মনোভাব এবং পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের সংহতি ভাঙার জন্য তার নীল-নকশার নিন্দা জানাই।
আমি মহামান্য গভর্নর জেনারেল ও প্রধানমন্ত্রী আশ্বাস্থ করতে চাই যে, সমগ্র সিন্ধুর মানুষ তাদের সাথে আছে।”
সীমান্ত মুখ্যমন্ত্রী
পেশোয়ার, ৩১ মেঃ
সীমান্ত মুখ্যমন্ত্রী সরদার আবদুর রশিদ যিনি প্রায় দশ দিন পর আজ সকালে করাচি থেকে ফিরেছেন, ঘোষণা করেন যে, সীমান্ত প্রদেশের মানুষ রাষ্ট্রের অখণ্ডতা ও সংহতি বজায় রাখার জন্য কেন্দ্রের যেকোনো সিদ্ধান্তকে সমর্থন করবে।
মুখ্যমন্ত্রী তার আগমনকালে, পূর্ববাংলায় ধারা 92-A আরোপ নিয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেন,
আমি নিশ্চিত যে, সকল প্রকৃত পাকিস্তানীরা খবরটি শুনে মহা স্বস্থি পেয়েছে এবং গভর্নর জেনারেল ও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর এই বিজ্ঞ সিদ্ধান্তকে সাদরে গ্রহণ ও সমর্থন করবে।
আমাদের কাছে কোন কিছুর মূল্যই, পাকিস্তানের অখণ্ডতা এবং সংহতি রক্ষার চেয়ে বেশী হতে পারে না।
আমরা কেন্দ্রের বিবেচনীয় যেকোনো প্রকার চুড়ান্ত সিদ্ধান্তকে সমর্থন করবো এবং সহায়তা প্রদান করবো।

স্টাফ রিপোর্টার
আজ সকাল (মঙ্গলবার) ২.৩০ পর্যন্ত ঢাকা পুলিশ কন্ট্রোল রুম থেকে প্রাপ্ত সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, সারা প্রদেশজুড়ে গ্রেপ্তারের সংখ্যা ২০৯ ছাড়িয়েছে।
এদের মধ্যে ১৪৪ জন ঢাকা শহর ও নারায়ণগঞ্জ জেলা এবং বাকিদের বিভিন্ন জেলা থেকে আটক করা হয়।

জুন ৩, ১৯৫৪
আরও ২ জন বিধায়ক (M.L.A) গ্রেফতার। মোট গ্রেপ্তারঃ ৪৮৪।
স্টাফ রিপোর্টার
ঢাকা পুলিশ কন্ট্রোল রুম থেকে সকাল (বৃহস্পতিবার) ২ টা পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, সারা প্রদেশজুড়ে জারি করা 92-A ধারায় মোট গ্রেপ্তারের সংখ্যা ৪৮৪ ছাড়িয়েছে।
ময়মনসিংহ থেকে জনাব আলতাফ হোসেন এবং রংপুর থেকে জনাব আজিজুর রহমান খন্দকারের গ্রেপ্তারের সাথে সাথে আটককৃত এম.এল.এ. -এর সংখ্যা দাঁড়াল ৯ |
আটককৃতদের মধ্যে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী জনাব এ.কে.ফজলুল হকের সহকারী সচিব জনাব সাজিদ আলীও ছিলেন|
ঢাকার বর্তমান পরিস্থিতি শান্ত| বুধবার মধ্যরাত পর্যন্ত প্রদেশের কোথাও কোন অবাঞ্ছিত ঘটনার খবর পাওয়া যায়নি|
এপিপি থেকে কিছুক্ষণ আগে প্রাপ্ত খবর: গতকাল এক প্রেসনোটে মোট আটককৃতের সংখ্যা বলা হহয়েছে ৪৩৫ |
৬ জুন, ১৯৫৪
জেলাসমূহে আরো আটক
বরিশাল, ৬ জুন: ৩১ মে’র পূর্ববঙ্গ নাগরিক নিরাপত্তা অধ্যাদেশের অধীনে শ্রীমতী মনোরমা বোস, শ্রীমতী সুজাতা দাস গুপ্ত এবং জনাব নুরুল ইসলাম, বি.এল. সহ পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে- ইউপিপি|
খুলনা,৬ জুন: ৩১ মে’র নাগরিক নিরাপত্তা অধ্যাদেশের অধীনে কমিউনিস্ট পার্টির শ্রী নেপাল দাস সহ কতিপয় ব্যক্তিকে আটক করা হয়েছে|
১ জুনের নিরাপত্তা অধ্যাদেশের অধীনে ড. অতুলেন্দ্র নাথ দাসকেও গ্রেপ্তার করা হয়েছে- ইউপিপি |
(সংবাদদাতার কাছ থেকে)
খুলনা, ১ জুন: পূর্ব বঙ্গ বিশেষ ক্ষমতা অধ্যাদেশের অধীনে স্থানীয় পুলিশ শ্রী দেবেন্দ্র নাথ দাস এম.এল.এ. এবং দুইজন কমিউনিস্ট কর্মীকে আটক করেছে|
চট্টগ্রাম,৬ জুন: ৩১ মে’র পূর্ববঙ্গ নাগরিক নিরাপত্তা অধ্যাদেশের অধীনে ১৭ জন ব্যক্তিকে আটক করা হয়েছে|-ইউপিপি
রাজশাহী, ৬ জুন: ১ জুনের পূর্ববঙ্গ নাগরিক নিরাপত্তা অধ্যাদেশের অধীনে জনাব আতাউর রহমান এম.এল.এ. ,শ্রী সান্টু ভাদুড়ী, শ্রীমতী সোনামনি লাহিড়ী এবং জনাব মমতাজউদ্দীনসহ কতিপয় ব্যক্তিকে আটক করা হয়েছে|
এ সপ্তাহের শুরু থেকে জেলা প্রশাসক ১৪৪ ধারা জারি করেছেন|-ইউপিপি
(নিজস্ব সংবাদদাতার কাছ থেকে)
ফরিদপুর, ৩১ মে: সরকারের শান্তি বজায় রাখার প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা হিসেবে মোখলেসুর রহমান,লিয়াকত হোসেন এবং মনোয়ার হোসেন নামক তিনজন কমিউনিস্ট কর্মীকে আটক করা হয়েছে বলে খবর পাওয়া গিয়েছে|
১১ জুন, ১৯৫৪
(এখন পর্যন্ত ৭৭২ জন আটক)
পূর্ববঙ্গ সরকার কর্তৃক গত বৃহস্পতিবার রাতে জারিকৃত এক প্রেসনোটে প্রকাশ পেয়েছে যে, ১০ জুন আরো ৩৮ দিকে আটক করার পর সর্বমোট আটককৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৭৭২ |
৮ জুন ফেনীতে, সুরক্ষা আইনের অধীনে, জনাব খায়ের আহমেদ এম এল এ কে গ্রেফতার করা হয়এবং আরো জানা যায় একই দিনে টিপপাড়া জেলার যুবলীগের সম্পাদক জনাব মোহাম্মদ উল্লাহকে গ্রেপ্তার করা হয়। –
১ জুন ১৯৫৪
এখন পর্যন্ত ৮৯০ জন কে আটক করা হয়েছে –
স্টাফ রিপোর্টার
সরকারী উৎস হতে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী সারা প্রদেশব্যাপী গতকাল সোমবার সন্ধ্যা পর্যন্ত প্রায় ৯১০ জন লোককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এই সংখ্যায় সেই ২০ জন ছাত্রও আছে যাদের পরে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল।
এপিপি যোগ করেনঃ সোমবার রাত পর্যন্ত সরকারি সূত্র অনুযায়ী জানা গেছে, ৯১০ জন আটক হয় ২০ জন ছাত্রসহ যাদেরকে ইতিমধ্যে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে

সম্প্রতি একই সূত্র থেকে জানা গেছে যুক্তফ্রন্টের সেলিনা বানু এম এল একে পাবনা জেলায় গ্রেপ্তার করা হয়।