শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
বাংলাদেশের পরিস্থিতির উপর বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি প্রতিবেদন | বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি | ………
১৯৭১ |
বাংলাদেশের উপর প্রতিবেদন
বাংলাদেশ যা পূর্বে পূর্ব পাকিস্তান নামে পরিচিত ছিল তার পাকিস্তান সৈন্য পরিচালক ইয়াহিয়া খানের ভাড়াটে দুর্বৃত্তদের করা বিশাল সংখ্যক ধ্বংসলীলা এবং গণহত্যা দেখে পুরো বিশব হতবাক এবং বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। ২৫ শে মার্চ রাতে পাকিস্তানের প্রগতিবিরোধী শাসকগোষ্ঠী সাম্রাজ্যবাদীদের দ্বারা প্রশিক্ষিত এবং সাজানো সৈন্যের সাহায্যে ঘটানো সন্ত্রাসের ঘটনা ইতিহাসে বিরল এবং এটি এখনো অখণ্ডিত। গত তিন মাসে অভাব, অনাহার এবং রোগের কারনে, ৭৫ মিলিয়ন বাঙ্গালীর উপর অমানবিক নিপীড়ন, শত হাজার মানুষ খুন এবং ছয় মিলিয়নের ও বেশি মানুষ দেশ ত্যাগ করে। বাংলাদেশের প্রায় সব শহর এবং ত্রিশ হাজারেরও বেশি গ্রাম লুটপাট করা হয়। এটা এখন পুরোপুরি পরিস্কার যে ইয়হিয়া দল বাঙ্গালী জাতীকে বিলুপ্ত করে দেয়ার চেষ্টা করছে।
কেন এই জেনসাইড?
ইয়াহিয়া খানের করা জঘন্য অপকর্মর শেকড় অতীতের। এমনকি এটি পাকিস্তানের বিরোধে গিয়ে ইন্ডিয়ার সাম্রাজ্যবাদীর বিরুদ্ধে করা গভীর ষড়যন্ত্র।
কিছু মুসলিম প্রধান এলাকাকে একত্রিত করার মাধ্যমে ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান উপমহাদেশে পাকিস্তান গঠন করা হয়এবং ইন্ডিয়া সন্ত্রাসবাদের এক হাজার মাইলেরও বেশি এলাকা জুড়ে দু- ধর্মীদের আলাদা করা হয়। যদিও পাকিস্তান গঠন করা হয় ইন্ডিয়ার সকল মুসলিমদের একটি একক জাতি করার জন্য, আসলে বাঙ্গালী, পূর্ব পক্ষ এবং সিন্ধিস, বেলুচিস, পশ্চিম ভাগের পাঠান এবং পাঞ্জাবী সহ পাঁচটি ভিন্ন ভাষা এবং ভিন্ন ঐতিহ্যের ভিন্ন জাতিকে পাকিস্তান নিজেদের দিকে নিয়ে গিয়েছিল। এই ঘটনা আবার জাহির করা হয় এবং এখনকার বাঙ্গালী, পাঠান, সিন্ধিস এবং বেলুচিস জাতির গতিবিধিতে দ্যোতনা লক্ষ্য করা যায়।
গত ২৪ বছরে, জনগণ উন্নতির পথ সৃষ্টি করেছে, যেখানে শাসকগোষ্ঠী ভালো প্রতিক্রিয়া দেখাতে ব্যর্থ হয়েছে, এবং এটিই সেই অসঙ্গতি যা শাসকগোষ্ঠীর এক দিকে জেনসাইডের বর্তমান সংকটকাল অব্দি গড়িয়েছে এবং অন্যদিকে সাম্যবাদী শক্তির স্বাধীনতা সংগ্রাম অন্যদের উপর আরোপিত হয়েছে।
সরকারের দমনমূলক কর্মপন্থা
চূড়ান্ত প্রতিক্রিয়ার শুরু থেকে পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠী, যা বুর্জোয়া এবং সামন্তবাদীদের করাল গ্রাসের দিকে ঠেলে দেয়, পুরোপুরি দমনের কর্মপন্থা ছিল নিজস্ব, জাতীয় এবং গণতান্ত্রিক অধিকার, কারন এটাই ছিল তাদের শাসনপন্থা প্রশমিত এবং সংরক্ষিত করার একমাত্র উপায়। তাদের নীচু শ্রেণীর আক্রমন সংরক্ষণে পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠী জাতি এবং গনতন্ত্র রক্ষার্থে নির্মম আক্রমন চালায়।
সাম্যবাদের অগ্রগতি বাড়াবাড়ি রকমের বেড়ে যাচ্ছিলো । শত শত দেশপ্রেমিক কে কারাবন্দী করা হচ্ছিলো এবং বিভিন্ন ঘটনায় সেটা বেড়ে হাজারের দিকে যাচ্ছিলো। পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থা অত্যন্ত খারাপ ছিল যেখানে গণতান্ত্রিক সতর্কতা ছিল ওয়েস্টার্নদের থেকেও বেশি।
জাতীয় অপলাপ এবং অসমতা
অনিয়ন্ত্রিত শাসন থেকে সুবিধাভোগের মাধ্যমে পাকিস্তান বুর্জোয়ারা তরতর করে একাধিপত্যবাদী হয়ে যাচ্ছিলো। এটি অর্জিত হয়েছিল শুধুমাত্র গনতান্ত্রিক এবং জাতীয় অধিকার সংকোচনের মাধ্যমে, যতটা রাজনৈতিক শাসন ছাড়া অর্থনৈতিক শাসন বজায় রাখা কষ্টকর হয়ে যাচ্ছিলো এবং বহুমুখী রাষ্ট্রের অধীনে পাকিস্তানের রাজনৈতিক অপলাপ অদ্ভুত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রক জাতীয় অপলাপের স্থান নেয়।
পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়াশীল শাসকগোষ্ঠী তাদের শাসন টিকিয়ে রাখার জন্য, যা শুধুমাত্র তাদের বুর্জোয়া এবং সামন্ততান্ত্রিকদের সাথে জড়িত ছিল এবং মোটেই অর্থনৈতিক এবং ঐতিহ্যের উত্তোলন ছিল না, পাকিস্তানের এবং নির্দিষ্টভাবে পূর্ব পাকিস্তানের ঐতিহ্যে বাধা দিতে বাধ্য করা হয়; কারণ, যদি দেশে গণতান্ত্রিক এবং উন্নত উদ্দেশ্য অনুমোদন করা হয় পুরো আক্রমণ পাকিস্তানে মধ্যযুগীয় অন্ধকার বয়ে আনবে, যার ফলে চরমভাবে সংরাম করা শাসকগোষ্ঠীর পতন ঘটতে পারে।
যখন জাতীয় রাজনীতির অপলাপ ও বৈষম্য দ্বারা চাপ সৃষ্টি করছিলো পাকিস্তানের ভিন্ন শাসকগোষ্ঠীকে সবার পক্ষে সহ্য করা কঠিন ছিল, এটা বিশেষ করে বাঙালীদের পক্ষে দুর্ঘটনার মত ছিল। ইন্ডিয়া এবং পাকিস্তানের মধ্যে অর্থনৈতিক এবং ঐতিহ্যইক বাধা বাঙালীদের অতিতের জন্যে পুরোপুরি বিরোধ ছিল, এটা পাকিস্তানি বাঙালীদের ঐতিহ্যের মৃত্যু প্রমান করে।
পাকিস্তানের ন্যাশনাল মনোপলির উন্নতি পূর্ব পাকিস্তানের অধিপত্য প্রসূত করে, এবং এই অধিপত্য ছিল উপনিবেশীও।
পাকিস্তানে সব বুর্জোয়ারা ছিল অবাঙালী, যাদের হাতে পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনীতি চালনার ভার ছিল। সবথেকে বড় বুর্জোয়ারা পরিচিত ছিল ’২২ মনোপলিসট পরিবার’ হিসেবে, যারা ইন্ডাস্ট্রিয়াল সংস্থান এর ৬৭% এবং ব্যাংক এবং ইনস্যুরেন্স এর ৭০-৮০% নিয়ন্ত্রন করতো।
পাকিস্তানে বিশাল ব্যবসার পুরো নিয়ন্ত্রণ ছিল কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে, অর্থনৈতিক রাজনীতি পশ্চিম পাকিস্তানের দয়া হিসেবে পূর্ব পাকিস্তানে প্রনয়ন করা হয়। সুতরাং পাকিস্তানের স্থিতির চব্বিশ বছরে দুই পক্ষের অর্থনৈতিক অসমতা ছল পাক খাওয়ার মতন। যদিও পাকিস্তানের জনসংখ্যার অনুপাত ছিল পুরো ৫৬%, যা ব্যায়ের ৩৬% (১৯৬৫-৬৬-১৯৬৯-৭০) অংশ ভাগ করে এবং শুরুরদিকে এটা ছিল ২০% এর ও নিচে ছিল (১৯৫০-৫১-৫৫)। বিগত বিশ বছরে পূর্ব পাকিস্তান রপ্তানিমূলক আয় ছিল ৭০% এর থেকেও বেশি এবং যা ছিল ৪৫-৫৫% পরিসরের বাইরে, বর্তমানে যখন আমদানিকৃত আয় বেশি ছিল না, তখন তা ছিল ৩২%।
এসব বছরে পশ্চিম পাকিস্তানের বৈদেশিক ব্যবসা বলিষ্ঠ এবং দীর্ঘস্থায়ী ঘাটতি দেখিয়েছে যা কার্যকরিভাবে সকল সুলভ বৈদেশিক বিনিময় বিলীন করেছে। পূর্ব পাকিস্তানের সকল খরচ, পশ্চিম পাকিস্তানী বুর্জোয়ারা এমন এক পর্যায়ে যেতে পারে যা থেকে তারা পূর্ব পাকিস্তানকে একটি বন্দি হট্টতে পরিণত করতে পারে। এটা বলাটা গুরুত্বপূর্ণ যে, এই ক’বছরে পশ্চিম পাকিস্তানের সকল রপ্তানীর ৪০-৫০% পূর্ব পাকিস্তানে বিক্রি হয়েছে।
পূর্ব পাকিস্তানের উপর অর্থনৈতিক আধিপত্য সম্ভব হয়েছিলো কেন্দ্রীয় সরকারের উপর পশ্চিম পাকিস্তানের বড় ব্যবসার মাধ্যমে, যা পাকিস্তানের নিজেদের ভেতরকার অসমতা প্রকাশ করে। যখন পাকিস্তানে মিলিটারি আইন গঠন করা হয়, তখন প্রশাসনের সকল মিলিটারি সদস্য পশ্চিম পাকিস্তানের ছিল এবং ১৯৬০ এ কেন্দ্রীয় বেসামরিক কর্মচারীদের ৮৭% ছিল পূর্ব পাকিস্তানী (এই সংখ্যা তখন পর্যন্ত তেমন পরিবর্তিত হয় নি এবং যেকোনো কিছু কম সংখ্যক বাঙ্গালী কর্মকর্তা কেন্দ্রীয় সরকারি রাজনীতিতে খুব কমই প্রভাবিত হয়েছিল)
সংক্ষেপে, পশ্চিম পাকিস্তানের বড় বুর্জোয়ার আপাতদৃষ্টিতে ঔপনিবেশিক ব্যখ্যা পূর্ব পাকিস্তানকে একটি অসুস্থ রাজ্যে নামিয়ে আনে। অবশ্যই, প্যান্থাস, বেলুচিস, এবং সিন্দিস নামে পাকিস্তানের অন্যান্য জাতিরাও চেপে যাচ্ছিলো।। কিন্তু বাঙ্গালীদের সাথে বিদেশাতঙ্কিতদের মত ঘৃণিতভাবে আচরন করা হচ্ছিল। এবং ঔপনিবেশিক রকমের শোষণ চলছিলো।
গণতন্ত্র এবং স্বায়ত্তশাসনের জন্য সাম্যবাদী সংগ্রাম
পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের প্রথম সংগ্রাম শুরু হয়েছিল ভাষা নিয়ে। এটা বলা অপ্রয়োজনীয় যে এটি নিঃসন্দেহে গণতান্ত্রিক বিষয়বস্তু, কারণ এটি শুরু হয়েছিল উর্দু ভাষার অগনতান্ত্রিক শোষণের বিরুদ্ধে, মাতৃভাষার আণুবীক্ষণিক নিম্নতা, বাকী মানুষেরা এটিকে শুধুমাত্র প্রদেশিক লীগ বলে উড়িয়ে দিয়েছিল। শোষকদের কার্যকলাপে বাঙ্গালীরা ও অন্যান্য জাতিরা তাদের ঐতিহ্য হারিয়ে ফেলছিল। ১৯৫২ তে এই সংগ্রাম আনুপাতিক রূপ গ্রহন করে। ১৯৫৪ সালে পূর্ব পাকিস্তানের নির্বাচনের পর গণতন্ত্র এবং স্বায়ত্তশাসন পুরনাঙ্গ রূপ পায়। এর ফলে বিপরীত পক্ষের নির্বাচন মুসলিম লীগ পার্টির বিরুদ্ধে একটি অবিচ্ছিন্ন দল গঠন করে । এই অবিচ্ছিন্ন দলই ২১-দফা দাবির সুত্রপাত করে, যা পাকিস্তানের হয়ে লাহোরের ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ এর পক্ষ থেকে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য পুরো স্বায়ত্তশাসন দাবি করে। অবিচ্ছিন্ন দলের নির্বাচনে ৩০০ আসনের ২৯০ টি লাভ করে বিশাল জয় অর্জন করে, যা প্রমান করে জনগন গণতন্ত্র এবং স্বায়ত্তশাসন চায়।
কিন্তু শোষকগোষ্ঠী জনগণের এ রায় প্রত্যাখ্যান করে এবং নির্বাচনের ফল শুন্য বলে বিবেচনা করে। দুই মাসের ভেতর পূর্ব পাকিস্তানের অবিচ্ছিন্ন দল, কেন্দ্রীয় সরকার, আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদীদের সাথে সমঝোতা করে অবিচ্ছিন্ন দল মিথ্যা বলে খারিজ করে । একইসময় পূর্ব পাকিস্তানে বহু রকমের অত্যাচার শুরু করে। হাজার হাজার সাম্যবাদী এবং বামপন্থিদের কারাবন্দী করা হয়।
কিন্তু এসব নির্যাতন পূর্ব পাকিস্তানের জনপ্রিয় স্বায়ত্ত্বশাসনের আন্দোলন থামাতে পারে নি। এটি লক্ষণীয় যে , পাকিস্তানের অন্যান্য জাতি যথা বেলুচিস ,সিন্ধিস এবং পাঠানরা তাদের জাতীয় অধিকারের জন্য যুদ্ধ করেছে । এই সময় , কেন্দ্রীয় সরকার পাকিস্তানের চারটি প্রদেশ কে একিভূত করে এবং দুই অংশের মাঝে সমতা চালু করে, পূর্ব পাকিস্তানের জনসংখ্যা(৫৬%) বেশি থাকা স্বত্তেও যেন সকল বিষয়ে বভত্তর অংশ দাবি করতে পারে। এটি অবশ্যই পাকিস্তানের বিভিন্ন দেশের মাঝে ক্রমবর্ধমান অন্দোলনকে দমন করার পরিকল্পনা। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের একটি ইউনিট পাকিস্তানের জাতীয় অধিকার অর্জনের আন্দোলনে উপরিক্ত সংগ্রামকে জোরদার করতে দায়িত্ব পালন করে।
পাকিস্তান গনপরিষদে ১৯৫৬ সালে প্রনীত সংবিধান যা ১৯৫৫ সালে পরোক্ষ ভোটের দ্বারা নির্বাচিত হয়। তিন বছর পর, জনগনের জনপ্রিয় চাপে , পাকিস্তান সরকার অনেক টালবাহানা করে পাকিস্তানের প্রথম সাধারন নির্বাচনের(ফেব্রুয়ারি-মার্চ,১৯৫৯) তারিখ ঘোষনা করে।
কিন্তু প্রতিক্রিয়াশীল শাসক গোষ্ঠী গনতন্ত্র প্রবর্তনের বিরুদ্ধে চক্রান্ত শুরু করে নির্বাচন বন্ধ করার জন্য যা গনতন্ত্রের পথ সুগম করতো । সাম্রাজ্যবাদ সুবিধার সাথে সাথে সারা দেশে সারা দেশে সামরিক আইন জারি করে। এরপর সামরিক শাসক আয়ুব খানের স্বৈর শাসন শুরু ।
আইয়ুব খান তার সর্বোচ্চ চেষ্টা করে বিভিন্ন জাতির জাতীয়তাবাদি অন্দোলনকে দমন করতে। কিন্তু ১৯৬১ সাল থেকে বাঙ্গালি,বেলুচিস,সিধ্রা তাদের অধিকার আদায়ের জন্য বীরত্বপূর্ণ সংগ্রাম শুরু করে। এমনকি ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময়কাল ও তাদের মনে সংশয় সৃ্ষ্টি করে নি। ১৯৬৬ সালের জুন মাসে বাংলাদেশ আওয়মিলীগ ৬ দফা দাবি উত্থাপন করে। ৬ দফা দাবি মূ্লত ভোটাধিকারসহ সংসদীয় গনতন্ত্রের দাবি। এই প্রস্তাবনাটি বামপন্থি এবং কমিউনিষ্ট দ্বারা সমর্থিত হয় এবং দাবিটির উপর ভিত্তি করে জনগন সম্পূর্ণ অকপটে অন্দোলন শুরু করে , এবং আন্দোলনকে গতিশীল করে।
এই আন্দোলনটিকে ও সাময়িকভাবে দমন করা হয়।
কিন্তু ১৯৬৮ সালের শেষের দিকে এবং ১৯৬৯ সালের শুরুর দিকে পাকিস্তানের সীমানা নিয়ে একটি আন্দোলন শুরু হয় যা পরিশেষে আইয়ুব শাসকের সমাপ্তি ঘটায়। পূ্র্ব পাকিস্তানে স্টুডেনটস অ্যাকশন কমিটি কর্তৃক প্রনীত ১১ দফা কর্মসূচি দ্বারা আন্দোলন বেগবান হয় এবং এগুলো শাসন বিরোধী রাজনৈতিক দল দ্বারা সমর্থিত হয়।
৬ দফা এবং ১১দফা কর্মসূচির সাথে অসামরিক মুক্ত জীবন যাপন ,শিক্ষা সংষ্কার,ছাত্র ও শ্রমিক দাবি, নিরপেক্ষ ও স্ব্ধীন পররাষ্ট্রনীতি, ব্যাংক ও বীমা ইত্যাদি জাতীয়করনের দাবি সংযোজিত হয়।
পশ্চিম পাকিস্তানে বিরোধী দল,সাধারন জনগন ও বাহিনী সরাসরি নি্র্বাচন এবং সংসদীয় গনতন্ত্রের জন্য ঐক্যবদ্ধ ছিল। একনায়কতান্ত্রিক আইয়ুব শাসকগোষ্ঠি ঐক্যবদ্ধ গন আন্দোলনের চাপ প্রতিরোধ করতে না পেরে ক্ষমতামচ্যূত হয়।
ইয়াহিয়ার প্রবেশ
তারপর ইয়াহিয়া খান শাসক শ্রেণীকে উদ্ধার করতে এলেন। ইয়াহিয়া পাকিস্তানে সামরিক আইন জারি করলেন; আইয়ুবের সংবিধান বাতিল করলেন এবং তার অপ্রকৃত গণতন্ত্র সরিয়েদিলেন। জনসাধারনের বিদ্যমান চাপে ইয়াহিয়া বাধ্য হয়ে নির্দিষ্ট কিছু দাবি স্বীকার করে,যথা, প্রাপ্তবয়স্কের ভোটাধিকারের ভিত্তিতে সরাসরি নির্বাচন। এক একক ও সাবেক প্রদেশের পুনঃস্থাপনের বিভাজন এবং ‘সমতা’ যা১৯৫৫সালের পূর্বে চালু করা হয়েছিল।দেশের জন্য একটি সংবিধান যা নির্বাচিতজাতীয় পরিষদ দ্বারাপ্রণীত তা বাতিল করা হয়। কিন্তু ইয়াহিয়া একটি বৈধ কাঠামো জারি করেন যা কট ,‘’ইন্টার আলিয়া জারি ‘’, যা রাষ্ট্রপতি, ইয়াহিয়া খান দ্বারা প্রমাণীকৃত করতে হবে। এতে জাতীয় পরিষদের স্বাধীনতা সীমাবদ্ধ হয়।
১৯৭০ এর ডিসেম্বরে প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।ফলাফল ছিল চমকপ্রদ । পূর্ব পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের১৬৯টি আসনের মধ্যে সর্বমোট১৬৭ টি আসনজিতেছে; যা জাতীয় পরিষদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার (মোট ৩১৩ টি আসনের মাঝে) সঙ্গে আওয়ামী লীগের দল তৈরি হয় ।
আওয়ামী লীগেকে ভোট প্রদানের দ্বারাপূর্ব পাকিস্তানের জনগণ আসলে স্বায়ত্তশাসনের জন্য ভোট প্রদান করে। আর তা শাসকশ্রেণীকেবিচলিত করে তুলে।
পশ্চিম পাকিস্তানে জেড এ ভুট্টো৮৪ টি আসন ( ১৪৪তি আসনের মাঝে )এন এ আসনে জয়ী হন, কিন্তু এসব আসন শুধুমাত্র পাঞ্জাব ও সিন্ধু প্রদেশে থেকে ছিল। যাইহোক, শাসকশ্রেণী তাদের ষড়যন্ত্র হিসাবে একটি বিড়ালের থাবা যেমন ভুট্টোকে ব্যবহার করে গণতন্ত্রকে বিপন্ন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
খুব তাড়াতাড়ি ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের প্রথম সেশনের জন্য একটি তারিখ ঘোষণা করেন ৩রা মার্চ, ভুট্টো ঘোষণা করেন যেতার দল জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যোগদান করবে না; এবং নিদিষ্ট তারিখেরঅধিবেশনে সরাসরি প্রত্যক্ষ সংগ্রামের হুমকি প্রদান করেন ।আর ইয়াহিয়া তা ন্যায্য চিন্তা করে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করেন এবং এর পরিবর্তে বিভিন্ন দলের নেতাদের নিয়ে একটি গোলটেবিল সম্মেলনের চিন্তা করেন । কিন্তু এই অস্বাভাবিক পদক্ষেপ গ্রহণ করার আগে আওয়ামী লীগ, যারা জাতীয় পরিষদের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় জয়ী তাদের সাথে পরামর্শ করার বিবেচনাও করেনি।
শান্তিপূর্ণ শেষ গণআন্দোলনের: শিখর
স্বাভাবিকভাবেই যথেষ্ট কারনে সকল গণতান্ত্রিক দল জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করায় ক্ষুব্ধ ছিল এবংঅযৌক্তিক ও হাস্যকর ধারনা হিসেবে গোল টেবিল বৈঠক প্রত্যাখ্যান করেছে। কিন্তু হাজার হাজার জনগন খবরটি শুনার সাথে সাথেইইয়াহিয়া খানের এই উচ্চ হস্তান্তর সিদ্ধান্তের প্রতিবাদেনেতাদের প্রতিক্রিয়ারআগেই স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে রাস্তায় নেমে আসে ।
তা সত্ত্বেও, উত্থান তার শান্তিপূর্ণ চরিত্র হারায় নি। জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করার প্রতিবাদে আওয়ামী লীগ ২য়মার্চ থেকে পাঁচ দিনের জন্য একটি সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দেয়। এটা সকল গণতান্ত্রিক দল সমর্থিত। সমগ্র মানুষ সম্পূর্ণরূপে এই আহ্বানে সাড়া দেয়। যথারীতি শাসক চক্র ভীতিপ্রদর্শন এবং সহিংসতা দ্বারা এটা দমন করার চেষ্টা করে। কারফিউ ঢাকা ও অন্যান্য শহরের উপর আরোপ করা হয়েছিল এবং যখন মানুষ শান্তিপূর্ণ মিছিল করছিল তাদেরকে মেশিনগানের আগুনের নিচে পতিত করা হয়েছিল। যদিওশাসক চক্রের ষড়যন্ত্র মানুষের মনোবল ভেঙে দিতে ব্যর্থ হয়।
৬ই মার্চ শান্তিপূর্ণ ধর্মঘটের পঞ্চম দিনে ইয়াহিয়া জাতীয় পরিষদের অধিবেশনের জন্য একটি নতুন তারিখ ঘোষণা করেন।২৫শেমার্চ, কিন্তু একই সাথে পূর্ব পাকিস্তানের জনগন এবং নেতাদের এই সঙ্কটের জন্য দায়ী করেন যা আসলে ইয়াহিয়া খান নিজে এবং শাসক দলের কারনে তরান্বিত হয়েছিল।তিনি এমনকি তথাকথিত “পাকিস্তানের“সংহতি ও অখণ্ডতা ”বজায় রাখার জন্য সামরিক ব্যবস্থা নেওয়ার আশঙ্কাও করেন।
একইসাথে সামরিক জান্তা লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খানকে পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক প্রশাসনে নিযুক্ত করেন; যে কি না,কম বুদ্ধি ও নিষ্ঠুর প্রকৃতির একটি নীচ জীব, যাকেপূর্ব পাকিস্তানের সামরিক প্রশাসক হিসাবে নিযুক্ত করা হয়। শান্তিপূর্ণ গণআন্দোলনের দমন করতে এই সামরিক জান্তা ইতিমধ্যে সামরিক আক্রমণ দ্বারা তার পদক্ষেপ দেখিয়েছেন ।
৭ইমার্চ, সামরিক আইন প্রত্যাহারএবং ক্ষমতা জনগণের নির্বাচিতপ্রতিনিধিদের কাছে হস্তান্তরনা করা পর্যন্ত শেখ মুজিবুর রহমান ধারাবাহিকভাবেশান্তিপূর্ণ অসহযোগ আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করেন।শেখ মুজিবুরের দাবী ও কার্যক্রম সব গণতান্ত্রিক দল দ্বারা সমর্থিত হয় এবং সমগ্র মানুষ মহান উদ্যম সঙ্গে সাড়া দেয়। আক্ষরিক ভাবেই দেশের সব কার্যক্রম স্থবির হয়ে এসেছিলেন। মিলস, কারখানা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সকল সরকারি, আধা-সরকারি. অফিস এবং হাইকোর্ট ও নিম্ন আদালত এবং পূর্ব পাকিস্তানের পরিবহন ব্যবস্থা, ইত্যাদি সহ সকল প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে এসেছিল। পুলিশ ও গোয়েন্দা শাখা সহ পূর্ব পাকিস্তানের বেসামরিক প্রশাসন আওয়ামী লীগের নির্দেশনা অনুসরণ করে। সংক্ষেপে, পূর্ব পাকিস্তানের আওয়ামী লীগের ভার্চুয়াল নিয়ন্ত্রণ ছিল।
এই পর্যায়ে ইয়াহিয়া খান পূর্ব পাকিস্তানে শেখ মুজিবুরের সাথে আলোচনা করতে আসার ঘোষণা দেন। আলোচনা১৪ই মার্চ থেকে শুরু। এরপরআলোচনার কিছু সময়ের জন্য অব্যাহত হয়। একই সময়ে ইয়াহিয়া প্রকাশ্যে ঘোষণা করে যে তিনি আওয়ামী লীগ নেতাদের (যেমন ক্ষমতা হস্তান্তর এবং সামরিক আইন বাতিল ) দাবীর সাথে নীতিগতভাবে সম্মত হয়েছে।
আলোচনাইয়াহিয়া খান ও শেখ মুজিবুরের উপদেষ্টাদের মধ্যে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। অতঃপর মানুষ যখনএকটি রাজনৈতিক নিষ্পত্তির দৃষ্টিশক্তি দেখতে শুরু করেছিল তখনইপূর্ব পাকিস্তানের নিরস্ত্র ও শান্তিপূর্ণ লোকদের বিরুদ্ধে আকস্মিক এবং অগ্নিশর্মা আক্রমণ এসেছিল।২৫শেমার্চ রাতে, নামমাত্র সতর্কবাণী ছাড়াই তাদের উপর এবং এমনকি ইয়াহিয়া-মুজিব এর আলোচনা শেষে, বিশ্বাসঘাতক মিথ্যাবাদী ইয়াহিয়া খানের ভাড়াটে গুন্ডাদের বাংলাদেশের নিরপরাধ মানুষের বিরুদ্ধে ছড়িয়ে দেয়া হয়।
একটি নতুন পর্যায়ের শুরু: মুক্তির লক্ষ্যে সংগ্রাম
এভাবে পাকিস্তানের সামরিক জান্তারা গণতন্ত্র ও স্বায়ত্তশাসনের শান্তিপূর্ণ সকল সংগ্রামের পথ বন্ধ করেছে এবং মানুষ বাধ্য হয়েছে তাদের নিজস্ব প্রতিরক্ষা এবং গণতন্ত্র ও জাতীয় অধিকারের প্রতিরক্ষায় অস্ত্র তুলে নিতে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীরসৈন্য,সেইসাথে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস এবং এর সাথে পুলিশ সহ সবদিক থেকে মুক্তিফৌজ (মুক্তিবাহিনী) গঠনের জন্য মানুষ যোগদান করেন এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনী যা ছিল স্বাধীনতা সংগ্রামের বিরুদ্ধেএকটি বিদেশী দখলদার বাহিনীর মতো আচরণ (যা বাস্তবে পশ্চিম পাকিস্তানী শাসনের ঔপনিবেশিক প্রকৃতি প্রমাণিত)।
উপরের ঘটনা এবং কার্যক্রমের তথ্য থেকেনিম্নলিখিত সিদ্ধান্ত টানা যেতে পারে।
* বাংলাদেশের মানুষের বর্তমান সংগ্রাম গণতন্ত্র ও স্বায়ত্তশাসনের পথে তাদের দীর্ঘ সংগ্রামের চূড়ান্ত পর্যায়।
* এমনকি পাকিস্তানের শাসক চক্রের পুনরাবৃত্তি এবং একগুঁয়ে মনোভাবগণতন্ত্র এবং স্বায়ত্তশাসন অস্বীকার করার পরও,মানুষ শান্তিপূর্ণ পথ পরিহার করেনি বরং ক্ষমতাসীন সামরিক একনায়কতন্ত্রের সঙ্গে একটি রাজনৈতিক সমঝোতা করার চেষ্টা করে। ক্ষমতাসীন সামরিক জান্তার সশস্ত্র হামলারকারনে মানুষ স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ শুরু করতে বাধ্য হয় ।
* বাংলাদেশের জনগণকে সামরিক একনায়কত্বের বিশ্বাসঘাকতায়এবং বর্বর হামলার কারনে অস্ত্র হাতে তুলে নিতে বাধ্য করা হয়েছে।
* পাকিস্তানের গত কয়েক মাসের ঘটনাগত চব্বিশ বছরের ইতিহাসকেসন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত করেছে যে স্বীকৃতগণতন্ত্র শাসকশ্রেণীর চিন্তা থেকে সর্বাধিক দূরে ছিল। অতএববাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য এটা অনিবার্য ছিল যে, আজ না হোক কাল গণতন্ত্র ও স্বায়ত্তশাসনের সংগ্রামের জন্য সশস্ত্র সংগ্রামে বিকশিত হবে। কারণ, এখন পুরোপুরি স্পষ্ট হয়ে গেছে। পাকিস্তান অতি প্রতিক্রিয়াশীল শাসকশ্রেণী কখনোই পাকিস্তানে গণতন্ত্র চালু করবে না এবং শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের মাধ্যমে পাকিস্তান থেকে সামরিক আমলাতান্ত্রিক একনায়কতন্ত্র স্থানচ্যুত করা সম্ভব হবে না। সংক্ষেপে বলতে গেলে, বর্তমান যুগে সামাজিক উন্নয়নের জন্য গনতন্ত্র অত্যাবশ্যক এবং অনিবার্য প্রয়োজনীয়তা। বাংলাদেশের বিচ্ছিন্নতাবাদ একটি ঐতিহাসিক প্রয়োজনীয়তা ছিল।
গত চব্বিশ বছর ধরে গণতন্ত্রে বাধা এবং শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতির পরেও দীর্ঘ প্রতীক্ষিত সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। প্রতিক্রিয়াশীল শাসক চক্র জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে অস্বীকার করে এবং বাংলাদেশের মানুষের উপর আক্রমণ শুরুর মাধ্যমে পাকিস্তানের বর্তমান সংকটময়পরিস্থিতি ত্বরান্বিত করেছে। নোংরা ইয়াহিয়া খানের প্রতিক্রিয়াশীল শাসক চক্র যারা কেবলমাত্র দায়ী মৃত্যু এবং প্রকাণ্ড সম্পদ হারানোর লক্ষ লক্ষ মানুষকে নিষ্ক্রিয় করা জন্য।
বাংলাদেশের জনগণ এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেছেন। তারা লক্ষ লক্ষ জীবন উৎসর্গ করেছে এবং তারা আরো বেশি কিছু করার জন্য প্রস্তুত। নির্মম, ঔপনিবেশিক দখলদার বাহিনীর থেকে বাংলাদেশকে স্বাধীন এবং একটি ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, এবং শুধু সামাজিক শৃঙ্খলা প্রতিস্থিত করার আগে তারা বিশ্রাম করবে না।
বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি