শিরোনাম | সুত্র | তারিখ |
১৯৫৬ শাসনতন্ত্র বিল সংক্রান্ত বিতর্ক | পাকিস্তান গণপরিষদ | জানুয়ারী-ফেব্রুয়ারী ১৯৫৬ |
জনাব আবুল মনসুর আহমেদ (১৬ই জানুয়ারি, ১৯৫৬):……… একটি সংবিধানকে কাঠামোবদ্ধ করতে, সাধারণভাবে বলতে, দুইটি ধরন বিবেচনা করা হয়- একটি হ’ল যুক্তরাষ্ট্রীয় এবং অপরটি একক ধরনের। যদি আমাদের একটি যুক্তরাষ্ট্রীয় ধরন থাকে তাহলে আমাদের একক সরকার গঠন হতে সম্পূর্ণ আলাদা আমাদের কাঠামো থাকবে, এমনকি খুব সুক্ষ বিষয়েও।যদি আমরা একটি মানুষ এবং একটি দেশ বিবেচনা করি তাহলে আমাদের একটি ভাষা এবং একটি রাজধানী থাকবে, এবং সেই হিসেবে রাজধানী সেখানেই হবে যেখানে রাষ্ট্রের বেশিরভাগ জনগন বাস করে। রাজধানী করাচী এবং ঢাকাতে হবে তা নিয়ে কোন প্রশ্ন হতে পারে না। দুই পক্ষের মধ্যেসমতা নিয়ে কোন প্রশ্ন হতে পারে না। আপনি এই শর্তাবলীতে চিন্তা করতে পারেন না। সম্পূর্ণ পাকিস্তান একটি দেশ এবং এর জনগণ একটি জাতি, তাহলে এই দুই পক্ষের জনগণের মধ্যে কোনো বৈষম্য থাকতে পারে না। এটিই একমাত্র যৌক্তিক নিষ্পত্তি। কিন্তু, স্যার, ফলস্বরূপ এটি কিছু সহজাত পরিণাম ঘটাবে। যদি আপনি এক-জনগণ তত্ত্বের দিকে অগ্রসর হন, যদি আপনি একক-গঠনের সরকারের ভিত্তির দিকে অগ্রসর হন আপনার অবশ্যই একই ভোটাধিকার, এক অর্থনীতি, এক ক্যালেন্ডার, এক ভাষা, এক মান সময় এবং এক রাজধানী থাকতে হবে। তখন রাজধানী আপনাআপনি ঢাকাতে স্থানান্তরিত হয়। স্যার, আপনি কি এই প্রশ্নটা পুনরায় তুলতে ও উত্থাপন করতে চান- কেউ কি চান: আমরা কি জনগণের ভোটের মাধ্যমে একটা একক ধরনের সরকার গঠন করব এবং পাকিস্তানের রাজধানী করাচী থেকে ঢাকাতে স্থানান্তরিত করব? এখন, স্যার, যেটা নতুন সমস্যা এবং আরো সমস্যা সৃষ্টি করতে থাকবে। সেক্ষেত্রে সমস্যা সমাধানের পরিবর্তে আমরা সমস্যা সৃষ্টি করতে থাকবো। কার্যত, গত আট বছর যাবত আমাদের একক ধরনের সরকার ছিল এবং কোন পরিস্থিতি ছিল আপনি সে সম্পর্কে ইতোমধ্যে অবগত আছেন। আমি আবারো বলছি যে যদি আপনি এক-রাজ্য তত্ত্বের সাথে, একটি একক সরকার ব্যবস্থার সাথে অগ্রসর হন, এটি হবে স্বাভাবিক পরিণাম। সেক্ষেত্রে আমরা এই ভিত্তির দিকে অগ্রসর হই যে অধিকাংশ জনগণের মুখের ভাষাই হবে রাষ্ট্রভাষা অর্থাৎ, বাংলা, এবং শুধুমাত্র বাংলা পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে আখ্যা দেওয়া হবে।তাহলে আপনি কেন দুই পক্ষ নিয়ে কথা বলছেন? আপনি কেন সমতার কথা চিন্তা করছেন? কেন দুইটি ভাষা? কেন আপনি ছয় মাস রাজধানী এখানে এবং বাকি ছয় মাস ওখানে রাখার কথা বলেছেন? চলুন, আমরা জনগণের ভোটের মাধ্যমে যাই। যদি আমরা সে পথে যাই তখন ভৌগোলিক সীমারেখা উপেক্ষা করা হবে। পূর্ব পক্ষের চেয়ে পশ্চিম পক্ষের জনগণ বেশি ভোগান্তির শিকার হবে। তাই, স্যার, এসব বিষয় বিবেচনা করে আমাদের তাত্ত্বিক হওয়া উচিত হবে না। লাহোর সমাধানের খসড়া পবিত্র হাতে করা হয়েছিল, যে হাত সমাধান খসড়ার কলমটি চালিয়েছিল তা আসলেই সৃষ্টিকর্তার ছিলো। এটি পাকিস্তানের নিয়তি ঠিক করেছিলো। যদি পাকিস্তানের সৃষ্টি সর্ব ভারত মুসলিম লীগের সম্পূর্ণ চাহিদা কংগ্রেস এবং ব্রিটিশ সরকার দ্বারা স্বীকার করার পরও হয়ে থাকে, তাহলেও পাকিস্তান দুইটি বিস্তৃত বিচ্ছিন্ন অংশ বিভক্ত থাকবে। এটি উক্ত রেজল্যুশনে দৃষ্টিগোচর হয়েছিল। পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দ এবং এর জন্য একটি সংবিধানের রচয়িতাগণ এই অসাধারণ ভৌগলিক অবস্থানের সাথে সম্মুখীন হয়েছিলেন। আট বছর ধরে সংবিধানের রচয়িতাগণ তাদের প্রাণপণ চেষ্টা করেছেন–সংবিধান রচনার জন্য সকল আন্তরিকতাসহ। আমি তাদের মধ্যে একজন নই যে আমাদের পুরানো মুসলিম লীগের বন্ধুদের যারা সংবিধান রচনার দায়িত্বে ছিলোন তাদের কটুক্তি করবে; আমি তাদের সদিচ্ছার দিকে আঙ্গুল তুলব না। আমি তাদের মধ্যে একজন না যারা আত্মতুষ্টির সাথে অগ্রসর হয় যে তারা ছাড়া অন্য সবাই নিষ্কর্মা এবং অকেজো। আমি স্বীকার করি যে তারা দেশকে একটি সংবিধান দিতে তাদের প্রতিভার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছে। কিন্তু তারা কেন ব্যর্থ হ’ল? তারা কি এই পদ্ধতিতে চেষ্টা করেন নাই এবং-এখানে সেখান কিছু যুক্ত করা বা অপসারিত করার সে পদ্ধতি?
তারা করেছিল। এমনকি তখন তারা ব্যর্থও হয়েছিল। তারা দীর্ঘ আট বছর সময় নিয়েছিল এবং শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়েছিল। তারা দেশকে একটি সংবিধান দিতে ব্যর্থ হয়েছিল। তারা এই জন্য ব্যার্থ হয়নি যে তাদের একটা আন্তরিক ইচ্ছার অভাব ছিল। না, স্যার। একটি সংবিধান রচনার জন্য তাদের আন্তরিক ইচ্ছা ছিল। তারা ভালো উদ্দেশ্যের সাথে সক্রিয় ছিল এবং যে সকল উদ্বেগের প্রয়োজন ছিল তাতে আচ্ছন্ন ছিলেন, এবং এরপরও তারা ব্যর্থ হয়েছেন। তারা ব্যর্থ হয়েছেন কারণ তাদের চিন্তাশক্তির অভাব ছিল।
যখন আমরা দেখলাম যে আমাদের নেতৃবৃন্দ দেশকে একটা সংবিধান দিতে ব্যর্থ হচ্ছিলো যখন আমাদের জমজ ভাই, বড় ভাই নয়, বরং ছোট ভাই-ভারত-দেশকে একটি সংবিধান প্রদান করেছে(নিজেদের অধীনে এত বড় এলাকা এবং ঐ দেশে এত মানুষের বসবাস থাকায় বস্তুত ভারত একটি বহুজাতিক দেশ), যদিও আমরা সেই সংবিধান পরিষদের সদস্য ছিলাম না, আমরা পাকিস্তানের প্রেমিক, দেশপ্রেমিক যারা পাকিস্তানের জন্য লড়াই করেছিল, যারা পাকিস্তানের যোদ্ধা ছিলাম এবং যারা কায়েদ-ই-আযমের প্রতিনিধি ছিলাম, আমরা নিজেদের মাথা গুলোকে একত্র করেছিলাম এবং দেশকে একটি সংবিধান প্রদানে নেতৃবৃন্দদের সাহায্য করতে নিজের সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছিলাম। এবং তা কী ছিলো? আমরা তাদের লাহোর সমাধানের প্রত্যাবর্তন মনে করিয়ে দিয়েছিলাম: পাকিস্তান আন্দোলনের কাগজী নোঙ্গর। আমরা তাদের কায়েদ-ই-আজমের ঐতিহ্য অনুসরণ করার জন্য এবং তার শেষ ইচ্ছাকে অগ্রাহ্য না করতে অনুরোধ করেছিলাম। আমরা বলেছিলাম, “ঐ নীতিগুলো থেকে আলাদা হবেন না। যদি আপনারা তা করেন, আপনার দেশকে একটি সংবিধান প্রদানে ব্যর্থ হবেন। এবং এটিই ঘটেছিল। এখন যখন আমরা নতুন সংবিধান পরিষদে এসেছি আমরা একই কথা বলছি: ভৌগলিক অবস্থানকে বিবেচনায় নিন কারণ এটি মূল বিষয়। পাকিস্তানের ভিত্তিতে রাজনৈতিক যে প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছিল তার তুলনায় অনেক বেশি নজর দিতে হবে অর্থনীতিতে। সংবিধান প্রণেতাগণ যে অসুবিধার মুখোমুখি হয়েছিলেন তা রাজনৈতিকের চেয়ে বেশি অর্থনৈতিক।
স্যার, আধুনিক গণতন্ত্রের নীতি এর রাজনীতির চেয়ে অর্থনীতির উপর বেশি নির্ভর করে। অর্থনীতির সু-প্রতিষ্ঠিত স্বতঃসিদ্ধ সত্য হল; “একজনের আয় হল আরেকজনের ব্যয়।” এই তত্ত্বকে রাজনৈতিক অর্থনীতি পর্যন্ত সম্প্রসারণ করলে আপনি দেখবেন যে সরকারের ব্যয় হল জনগণের আয়; এবং সরকারের আয় হল জনগণের ব্যয়। এটিই নীতি যার উপর প্রজাতান্ত্রিক, রাজতান্ত্রিক, যুক্তরাষ্ট্রীয় অথবা একক গণতন্ত্র কাজ করছে।
স্যার, ঐ মানদণ্ড অনুযায়ী আমরা পাকিস্তানে কী খুঁজে পাই? এই ভৌগলিক ব্যতিক্রমের দরুন দুই পক্ষে অর্থ সঞ্চালিত হয় না। পূর্ব পাকিস্তান থেকে নিয়ে আসা অর্থ কখনো পূর্ব পাকিস্তানে ফেরত যায় না। এটাই অর্থনীতির প্রাকৃতি। আপনি কিছু করতে পারবেন না; আমি কিছু করতে পারবো না, এমনকি আমি যদি এই দেশের প্রধানমন্ত্রীও হতাম আমি এই পরিস্থিতিতে কিছু করতে পারতাম না এবং অর্থ সঞ্চালিত করতে পারতাম না। এমনকি যদি আমি অর্থমন্ত্রীও হতাম তখনও আমি দেশের ভৌগোলিক অবস্থানকে অগ্রাহ্য করে এই সমস্যার সমাধান করতে পারতাম না। এটা সামনে এসে দাড়াবেই। অর্থ কখনওই সঞ্চালিত হবে না। সরকারি সংস্থার মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ করা হয় কিন্তু এর পুরোটা সরকারি সংস্থার মাধ্যমে ব্যয় করা হয় না। স্যার, এক পলকেই আপনি দেখতে পাবেন যে পূর্ব পাকিস্তান থেকে যে অর্থ আসছে হয় আপনার আপনার চাপরাসি এবং সম্মানিত মন্ত্রীগণ সমেত আপনার বেতনে না হয় স্পীকারের বেতনে ব্যয় করা হচ্ছে। জনাব চুন্দ্রীগর এবং উচ্চ আদালতের বিচারকগণ, চাপরাসি সমেত যুক্তরাষ্ট্রীয় আদালতের বিচারকগণ, আমাদের বাঙালি মন্ত্রীগণ জনাব হামিদুল হক চৌধুরীসহ এবং আমার শ্রদ্ধেয় বন্ধু, জনাব কে. কে. দত্ত বেতন পাচ্ছেন। কিন্তু সকল অর্থ পশ্চিম পাকিস্তানে ব্যয় হচ্ছে এবং আপনার ভুলে যাওয়া উচিত নয় যে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো এবং এর অর্থনীতিতে পূর্ব পাকিস্তান সমান অনুপাতে অবদান রাখছে। এটিই ভূগোল!
জনাব, আমাদের সরকারের প্রকাশিত পরিসংখ্যান থেকে আমি দেখাবো যে, ১৯৪৭-১৯৪৮ থেকে ১৯৫৪-১৯৫৫ পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় রাজস্বে পূর্ব পাকিস্তানের অবদান ছিলো ১৬৮ কোটি ১৪ লাখ। এই সময়ে রাষ্ট্রীয় রাজস্বে পশ্চিম পাকিস্তানের অংশীদারীত্ব ছিলো ৫৫৩ কোটি ৫৩ লাখ । এই অংকগুলো জনাব গুরমানির মতো আমাদের পশ্চিম পাকিস্তানি ভাইদের হয়ত উৎফুল্ল করবে এবং বলবেঃ ‘দেখো! পূর্ব পাকিস্তান এর অবদান মাত্র ১৮ শতাংশ। পশ্চিম পাকিস্তানের অবদান এর তিনগুনের বেশী।’ সেটা তাদের খুব আনন্দিত করবে । কিন্তু জনাব, খরচের অংশটা দেখুন। এই ৯ বছর সময়ে কেন্দ্রীয় সরকার পশ্চিম পাকিস্তানে ৭৯০ কোটি ৬৭ লাখ ব্যয়ের বিপরীতে পূর্ব পাকিস্তানে ব্যয় করেছে ৪২ কোটি ৬৬ লাখ । জনাব, অতএব আমরা আমাদের অবদানের চেয়ে অনেক কম পেয়ে থাকি। জনাব, ব্যয়ের জন্য আমরা প্রায় ১২৫ কোটি ৫০ লাখ পরিমান কম পাই এবং এই অর্থ পশ্চিম পাকিস্তানে ব্যয় হয় এবং তারপরেও এই ৮ বছরে কেন্দ্রীয় বাজেটে ২৩৭ কোটি ১৪ লাখ ঘাটতি ছিলো ।এটা ঋন থেকে মেটানো হয়েছে যার জন্য পূর্ব পাকিস্তান সুদ দিচ্ছে। এইভাবে আমরা দ্বিগুন শাস্তি ভোগ করছি । জনাব, এটাই পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনৈতিক অবস্থার চিত্র। এখন, এই ঘাটতি জাতীয় আয় ও পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের মাথাপিছু আয় কমিয়ে দিয়েছে এবং ওইমাত্রায় তাদের দারিদ্র্যের দিকে ঠেলে দিয়েছে । সরকারের দেওয়া আরেকটি প্রচারপত্র আছে এবং আমি কেন্দ্রীয় সরকারের প্রকাশিত সেই প্রচারপত্র থেকে উদ্ধৃত করছি । আমি ৩৪ নং পৃষ্ঠা থেকে উল্লেখ করছি , এবং যে কেউ বইটা দেখতে পারেন।
মাননীয় ডেপুটি স্পিকারঃ ওই বইটি কোথায় ?
জনাব আবুল মনসুর আহমেদঃ বইটির নাম ‘পাকিস্তান ১৯৫৪-৫৫’।
মাননীয় ডেপুটি স্পিকারঃআমার কাছে এটা নেই।
জনাব আবুল মনসুর আহমেদঃ আপনার কাছে কোনো কপি নেই ?
মাননীয় ডেপুটি স্পিকারঃআপনি কি কোনো কপি দিয়েছিলেন ?
জনাব আবুল মনসুর আহমেদঃ এই ১২ কোটি ৫০ লাখ পরিমান ঘাটতি পূর্বপাকিস্তানের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি (unrequited drain)। এই ক্ষতি শুধু একমুখী গতির কেন না এটা শুধু আসতে থাকে কিন্তু কখনো ফেরত যায় না। যেমন আমি বলেছিলাম সরকারের ব্যয়ই জনগনের আয় , এই ক্ষেত্রে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের ব্যয় পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের জন্য আয় নয় । এটা একমুখী প্রবাহ । এটা পূর্ব পাকিস্তান থেকে আসে কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানে ফেরত যায় না, পশ্চিম পাকিস্তানে বিশোষিত হয়ে যায় । অতএব, ধীরে ধীরে বেড়ে পূর্ব পাকিস্তান খুব দ্রুতই দরিদ্র্য হয়ে যাবে। এই বই থেকে আমি আরেকটি চিত্র উল্লেখ করবো।
মাননীয় ডেপুটি স্পিকারঃএটা কি বই?
জনাব আবুল মনসুর আহমেদঃ এটি পাকিস্তান তথ্য, প্রচার ও চলচ্চিত্র বিভাগ থেকে প্রকাশিত।
মাননীয় ডেপুটি স্পিকারঃ ওটা টেবিলে রাখুন।
জনাব আবুল মনসুর আহমেদঃ জনাব, আমি এটা টেবিলে রাখছি; আমি এটা টেবিলে রাখবো এবং আমার নোট থেকে উদ্ধৃত করবো ।
মাননীয় ডেপুটি স্পিকারঃ বই থেকেই উদ্ধৃত করুন কিন্তু পরে সভার টেবিলে বইটি রাখবেন।
জনাব আবুল মনসুর আহমদঃ আমি এই জায়গা থেকে উদ্ধৃতি করছি। ১৯৪৭-৪৮ সালে কেন্দ্রীয় রাজস্বে পূর্ব পাকিস্তানের অবদান ছিল ২৮ শতাংশ, ১৯৪৮-৪৯ সালে এটি ২৬ শতাংশে নেমে আসে, ১৯৪৯-৫০ সালে ২৫ শতাংশে, ১৯৫০-৫১ সালে ২৪.৫৭ শতাংশে, ১৯৫১-৫২ সালে ২৪.৭ শতাংশে, ১৯৫২-৫৩ সালে ২০.৮ শতাংশে, ১৯৫৩-৫৪ সালে ১৯.৪ শতাংশে, ১৯৫৪-৫৫ সালে ১৪.৭ শতাংশে, ১৯৫৫-৫৬ সালে ১২.৪৭ শতাংশে।
মাননীয় সহকারী স্পিকারঃ আপনি কোথা থেকে এইসব পরিসংখ্যান নিয়েছেন?
জনাব আবুল মনসুর আহমদঃ এই বই থেকে।
মাননীয় সহকারী স্পিকারঃ এই বই থেকে?
জনাব আবুল মনসুর আহমদঃ হ্যাঁ জনাব। আমি এই বই আপনার কাছে রেখে যাচ্ছি এবং এই ফাঁকে আমাকে পরিসংখ্যানের হিসেব অনুযায়ী এগোতে দিন। আপনি দেখতে পাবেন, ২৮ শতাংশ থেকে ১২ শতাংশে নেমে আসতে আমাদের মাত্র ৯ বছর লেগেছে। এই নয় বছরের পরিক্রমায় কেন্দ্রীয় রাজস্বে পূর্ব পাকিস্তানের অবদান ২৮ থেকে ১২ শতাংশে নেমে এসেছে। এই প্রক্রিয়ায় শূন্য শতাংশে নেমে আসতে পূর্ব পাকিস্তানের আর কত সময় লাগতে পারে বলে আপনি মনে করেন-মাত্র আরো আট বছর স্যার। জনাব, এই প্রক্রিয়া যদি চলতে থাকে তাহলে ১৯৬৫ সালে পূর্ব পাকিস্তান শূন্যতে নেমে আসবে। কেন্দ্রিয় রাজস্বে তখন পূর্ব পাকিস্তানের শূন্য অবদান থাকবে। এটা গাণিতিক, এটা ভৌগোলিক অবস্থানের পরিণাম। এটা কিভাবে ঘটে জনাব? কারণ, যেমনটা আমি বললাম, এটা অবশ্যই ভৌগোলিক কারণে ঘটে। আমাদের ভৌগোলিক অবস্থান পাল্টানো সম্ভব না। আমাদের সংবিধান প্রণয়নের ক্ষেত্রে এই ভূগোলকে কঠিন সত্য হিসেবে বিবেচনায় নিতে হবে, ভূগোল হচ্ছে সেই ভিত্তি যার উপর একটা দেশের অবস্থান, একটি ভাষা বর্ণিত হয়, একটি দেশের সীমান্ত নির্ধারিত হয় এবং একটি জাতি সংজ্ঞায়িত হয় জনাব। এটি একটি বিশেষ পরিস্থিতি যার মুখোমুখি আমরা দাঁড়িয়ে আছি।
এখন জনাব, আমি আপনাকে যে পরিসংখ্যান দিয়েছি সে অনুযায়ী যদি হিসেব করা হয়, তাহলে সেটি এমন দাঁড়ায় যে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ কেন্দ্রিয় রাজস্ব থেকে আট বছরে ২ কোটি বা মাথাপিছু ১০ রুপীর সমতুল্য রাজস্ব পেয়েছে, যা বছরে মাথাপিছু ১-২ রুপীতে নেমে আসে।
মাননীয় সহকারী স্পিকারঃ আপনি কিভাবে এই সংখ্যায় উপনীত হলেন?
জনাব আবুল মনসুর আহমদঃ ৪২ কোটি রূপীকে ৪ কোটি ২১ লাখ জনসংখ্যা দিয়ে ভাগ করে, ইত্যাদি, পুরোটাই নিখাদ গাণিতিক হিসাব জনাব। আট বছরের সেই একই সময়ে পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণ ২৩৫ কোটি রুপী পেয়েছে, যেটি কিনা বছরে মাথাপিছু ৩২ রূপীর সমান।
মাননীয় সহকারী স্পিকারঃ কি?
জনাব আবুল মনসুর আহমদঃ বছরে মাথাপিছু ৩২ রুপী। জনাব, এটা হচ্ছে ভূগোলের ফল, বরং এটা হচ্ছে ভূগোলের শাস্তি। ভূগোল অবশ্যই তার অবস্থান জাহির করে এবং অবশ্যই তার নিজস্ব পন্থা আছে। জনাব, আপনি বাংলার কথা অনেক শুনেছেন, ইতিহাসে যা “সোনার বাংলা” নামে পরিচিত ছিল এবং যেটিকে মধু ও দুধে পূর্ণ বলা হত। পাকিস্তানের অর্জনের পর এটা কোথায় গেল? এটি কি এতই দরিদ্র দেশ হয়ে গেল যে কেন্দ্রিয় রাজস্বে মাত্র এই ১২ শতাংশের মত অবদান রাখতে পেরেছে।
মাননীয় সহকারী স্পিকারঃ আপনি কি আমার দিকে এই প্রশ্ন করছেন?
জনাব আবুল মনসুর আহমদঃ না জনাব। জনগণ আমাকে এই প্রশ্ন করতে পারে। যদি বিজ্ঞ স্পিকার মহোদয় উপস্থিত থাকতেন তাহলে অবশ্যই তারা তার দিকেও এই প্রশ্ন ছুড়ত।
কেন্দ্রিয় রাজস্বে পূর্ব পাকিস্তানের অবদান শুধুমাত্র এইটুকু পরিমাণ- এই ধারণা নিয়ে আমাদের চালিয়ে যাওয়া উচিত না। এখানে, বাংলায় যাকে বলে “শুভঙ্করের ফাঁকি” সেটা আছে জনাব। এটার মানে হচ্ছে গাণিতিক প্রবঞ্চনা। পশ্চিম পাকিস্তান এবং পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থিত যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী থেকে যে অর্থ সংগ্রহ করা হয়, সেটিকে পশ্চিম পাকিস্তানের অবদান বলে গণ্য করা হয়। রাজনৈতিক অর্থনীতিতে দুটি সুস্পষ্ট শব্দ আছে “অবদান” এবং “সংগৃহীত”। “সংগৃহীত” মানে সবসময় এই না যে কারো “অবদান”। করাচীতে যে অর্থ সংগ্রহ করা হয় সেটার মানে এই না যে সেই অর্থ করাচীর মানুষের বা পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের। এখানেই গাণিতিক প্রবঞ্চনার পুরোটা লুকিয়ে আছে। জনাব, এই প্রবঞ্চনার কারণে যেটি হচ্ছে, শিল্প, বাণিজ্য এবং শুল্ক বিভাগ থেকে যে কর আদায় করা হয়, অর্থাৎ আমদানি কর, রপ্তানি কর, আয় কর এবং কেন্দ্রিয় আবগারী শুল্ক- এই চারটি সবচেয়ে বড় ক্ষেত্র যেগুলো কেন্দ্রিয় সরকারের মোট রাজস্বের ৯০ শতাংশ গঠন করে- তা করাচী থেকে সংগ্রহ করা হয়। এখন, তাহলে শিল্পই কি আর বাণিজ্যই কি যদি এটা জনগণের অবদান না হয়? একটি দেশের উদ্বৃত্ত আয় থেকে শিল্প- বাণিজ্য গড়ে উঠে। এর মানে হচ্ছে উৎপাদনকারীরা এখানে কম ব্যয় করে এবং বাইরে থেকে যন্ত্রপাতি কেনার জন্য অর্থ সঞ্চয় করে। এরাই হচ্ছে যারা আসলেই একটা দেশের শিল্পের স্থপতি। তাদের অবদান কি, জনাব?
মাননীয় জনাব আই আই চুন্দ্রিগর (পশ্চিম পাকিস্তানঃ মুসলিম)ঃ এটি বিলের সাধারণ আলোচনার সাথে সম্পর্কযুক্ত কিনা সেই ব্যাপারে আমার পয়েন্ট অফ অর্ডার নিতে চাচ্ছি। প্রথম পাঠে শুধুমাত্র বিলের সাধারণ নীতিমালার উপর আলোচনা করা যেতে পারে এবং সম্মানিত সদস্য বিশদ বিবরণের দিকে যাচ্ছেন আর যে ব্যাপারগুলো ইতোমধ্যে বলে ফেলেছেন সেগুলোরই পুনরাবৃত্তি করছেন।
মাননীয় সহকারী স্পিকারঃ আপনার পয়েন্ট অফ অর্ডার সম্পূর্ণভাবে সঠিক। আমি নিজে মাননীয় সদস্যকে মোকাবেলা করার চেষ্টা করে যাচ্ছি।
জনাব আবুল মনসুর আহমদঃ আমি আপনার ক্ষমা প্রার্থনা করছি।
মাননীয় সহকারী স্পিকারঃ মাননীয় জনাব চুন্দ্রিগর কর্তৃক উত্থাপিত পয়েন্ট অফ অর্ডারটি সম্পূর্ণভাবে প্রাসঙ্গিক এবং তা গৃহীত হল।
জনাব আবুল মনসুর আহমদঃ এই সংসদে আমি যা পেশ করছি তা সম্পূর্ণ প্রাসঙ্গিক।
মাননীয় সহকারী স্পিকারঃ আমি বলছি যে পয়েন্ট অফ অর্ডারটি সম্পূর্ণ প্রাসঙ্গিক।
জনাব আবুল মনসুর আহমদঃ আপনি ধরে নিচ্ছেন আমি যা বলছি তা সম্পূর্ণ প্রাসঙ্গিক।
মাননীয় সহকারী স্পিকারঃ ঠিক আছে, চালিয়ে যান, কিন্তু শুধু মনে রাখবেন যে আপনি বিশদ বিবরণে যাচ্ছেন যা পুরোপুরি অপ্রয়োজনীয়।
জনাব আবুল মনসুর আহমদঃ এখন, জনাব, আমি এটা পেশ করছিলাম যে কেন্দ্রিয় রাজস্বের ৯০ শতাংশ অবদান শিল্প, বাণিজ্য, আয়কর এবং কেন্দ্রিয় আবগারীর। এবং জনাব, ব্যয় এর খাত শেষ হওয়ার পরে আমাদের আয়ের যে উদ্বৃত্ত থাকে সেটিই হচ্ছে এই শিল্প ও বাণিজ্য। এখন জনাব, শিল্প কি? আমরা বাইরের দেশগুলোতে নিবন্ধ পাঠাই বৈদেশিক মুদ্রার জন্য এবং তা দিয়ে ক্রেতাদের বা শিল্পের জন্য পণ্যদ্রব্য নিয়ে আসি। এটি যদি ভোক্তাদের জন্য হয়, তাহলে সেটা ক্ষয়প্রাপ্ত হয়; যদি শিল্পের জন্য হয় তাহলে সেটি পরবর্তী উৎপাদনের ভিত্তি হয়ে উঠে। এখন, জনাব, এটা আলাদা আলাদা ভাবে পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের উদ্বৃত্ত, আপনি এই সংখ্যায় আসেন, আমদানি ও রপ্তানি, আপনি দেখতে পাবেন যে রপ্তানির মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তান যে পরিমাণ পায়, তা সেখানে ব্যয় করা হয় না; এটা এখানে খরচ করা হয় এবং এটি শিল্পের উন্নয়নে ও ব্যাবসা-বাণিজ্য গড়ে উঠায় সাহায্য করে।
সম্মানিত ডেপুটি স্পিকারঃ যখন আমরা সেই তফসিলে থাকব তখন আপনি এটা আলোচনা করতে পারেন।
জনাব আবুল মন্সুর আহমাদঃ আমি এটি পুরো আলোচনা করছি আর প্রথমে তফসিলে অথবা ১ম অনুচ্ছেদে কথা বললে তেমন কিছু এসে যায়না।
জনগন কে দেয়া প্রতিশ্রুতির ব্যত্যয় এই বিল।
শেখ মুজিবুর রহমান( ২১শে জানুয়ারি, ১৯৫৬)ঃ আমার বন্ধুরা বলেন, তুমি কেন প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন চাও। এটা তো ২১ দফায় নেই। এটি একটি অনিশ্চিত ব্যপার। আমি ভাবি বন্ধু ফরিদ আহমেদ যদি তাঁকে যারা নির্বাচিত করেছেন তাদের একথা বলতেন। আপনি জানেন স্যার, নির্বাচন নিকটবর্তী হলে জনগণ আপনাকে একটা ইস্তেহার দেবে এবং এই ২১ দফা জনগনের দেওয়া।তারা এই ২১ দফার উপর ভিত্তি করে আমাদের ভোট দিয়েছিল।তারা কখনই জনাব সোহরাওয়ারদি অথবা জনাব ফজলুল হক বা মাওলানা ভাসানির জন্যে ভোট দেয়নি। তারা এই ২১ দফার জন্যে ভোট করেছিল, অন্যথায় যারা নির্বাচিত হয়েছেন এবং এখানে এসেছেন, তারা তাদের জীবদশায় কখনই এই সাংবিধানিক সভায় আসতেন না। এই বিষয়টি পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে ১ম অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে এবং আপনি যদি অন্যদের মত আমাকেও পড়ে শোনানোর অনুমতি দেন, আমি আপনাকে এটা দেখাব।
সম্মানিত ডেপুটি স্পিকারঃ এটি আগেও পড়া হয়েছে।
শেখ মুজিবুর রহমানঃ স্যার, প্রতিরক্ষা, বৈদেশিক বিষয়াবলী ও মুদ্রার সাথে সাথে কেন্দ্রীয় সরকারও একটি শক্তিশালী কেন্দ্রীয় সরকার হতে পারে।
সম্মানিত ডেপুটি স্পিকারঃ এই যুক্তিগুলো আগেও জনাব আবুল মন্সুরের কাছ থেকে শুনেছি আমরা। নতুন কিছু শুনতে চাই।
শেখ মুজিবুর রহমানঃ স্যার, আমি বিস্তারিত আলোচনায় যাবনা। আমি শুধু উল্লেখ করে যাচ্ছি। আমাদের বন্ধুরা বলেন যে, ৩টি বিষয় থাকলে এটি একটি দুর্বল কেন্দ্র হবে, কিন্তু স্যার, আমরা প্রমাণ করতে পারি যে এটি শক্তিশালী একটি কেন্দ্র হবে। স্যার, পূর্ব বাংলার জনগন কেন বিগত ৮ বছর যাবত প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের জন্য লড়ছে? স্যার, দুর্ভাগ্যজনক ভাবে আমার ইচ্ছামত ব্যবহারের কোন সময় নেই কিন্তু আপনি সেই অনুমতি দিলে পূর্ব বাংলার জনগণের সাথে তাদের অন্যায়ের চিত্র তুলে ধরতে পারব। স্যার জনাব গুরমানির কথা অনুযায়ী, পূর্ব বাংলা কেন্দ্রীয় সরকারকে ২৫ শতাংশ রাজস্ব প্রদান করত। তারা বলে যে পড়ে এটা ২০ শতাংশে নেমে যায় বর্তমানে মাত্র ১৪ শতাংশ। এটা তাদের কথা। অর্থাৎ, প্রতিনিয়ত এটা কমে যাচ্ছে। এই হ্রাস অনুযায়ী, ১৯৬০ সাল নাগাদ এটি শুন্য হয়ে যাবে স্যার। পূর্ব বাংলা তাহলে ধ্বংসের মুখে।
সম্মানিত ডেপুটি স্পিকারঃ জনাব আবুল মন্সুর আমাদের তাই, জানিয়েছেন।(হাসি)
শেখ মুজিবুর রহমানঃ স্যার আমি শুধু আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। এটি স্যার এরকমঃ পাকিস্তানের শরীরে ২টি হাত রয়েছে। একটি পশ্চিম পাকিস্তান আর অন্যটি পূর্ব পাকিস্তান। তারা একটি হাত কে সবল বানাচ্ছে আর অন্যটিকে দুর্বল। স্যার, এই নীতিটি ভুল আর এটি দেশকে ধ্বংস করে দেবে। কেন্দ্রীয় সরকারি চাকরিতে ৫৬ শতাংশ জনগণের ৫শতাংশও সুযোগ পাচ্ছেনা। পুর্ব পাকিস্তানের জনগণ শিক্ষিত কিন্তু তারা তাদের অংশ পাচ্ছে না। স্যার আমরা পশ্চিম পাকিস্তানের জনগন কে দোষারোপ করিনা। এমনকি আমরা তাদেরও স্বায়ত্তশাসন চাই। যদি পূর্ব পাকিস্তান স্বায়ত্তশাসন লাভ করে, পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণও স্বায়ত্তশাসন পাবে। আমরা শাসক জান্তাকে দোষারোপ করছি।
এই জাগিরদার জমিদারেরা, এই বিশাল জমির মালিকেরা এবং পশ্চিম পাকিস্তানের শাসক জান্তা পশ্চিম পাকিস্তানের জনগনের মতামতকে দাবিয়ে রাখছে। তারা এতটাই দমনের শিকার, তারা কাঁদতে পারেনা, তাদের কোন চাহিদা করতে পারেনা, কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের জনগন রাজনৈতিক ভাবে সচেতন। তারা যেকাউকে এবং সবাইকে চ্যালেঞ্জ করে। তারা জনাব ফজলুল হক, জনাব সোহারাওয়ার্দী, মওলানা ভাসানীকে চ্যালেঞ্জ করে; তারা তাদের নেতাদের চ্যালেঞ্জ জানিয়েছে।তারা তাদের নেতাদের বলেন, “আপনি যা করছেন সেটা ভুল এবং আমরা আপনার জন্য ভোট প্রদান করব না, কিন্তু তারা দমনের শিকার, নির্যাতিত এবং অর্থনৈতিক ভাবে তারা ক্ষতিগ্রস্ত। তাদের কোন ভূমি নেই ; নেই কোন আশ্রয়স্থল। কিন্তু জনাব পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের বিরুদ্ধে আমাদের কোন বিরূপ মনোভাব নেই, কিন্তু ক্ষমতাসীন জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে আছে, যারা গণপরিষদের এক কালো অধ্যায়ের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসেছে তাদের মধ্যে একজন যে জেলা পরিষদে নেই অথচ সে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রী হয়ে গেছে এবং সেই সব মানুষ বলছে তারা পূর্ব পাকিস্তানের জনগনের পক্ষে কথা বলতে চায় এবং তারা বলেছে এই খসড়া সংবিধানের পক্ষে নাকি পূর্ব পাকিস্তানিদের সমর্থন আছে।জনাব,আমি কিছু দিন আগেই পূর্ব পাকিস্তান থেকে এসেছি এবং সেখানের জনগনের মনের কথা আমি জানি। আমি জানি যে তারা এই অমুসলিম অগণতান্ত্রিক স্বৈরশাসকদের প্রত্যাখান করেছে। এবং এটা পাকিস্তানিদের পক্ষে গ্রহনযোগ্য না, বিশেষত পূর্ব পাকিস্তানের জনগনের পক্ষে।এই সকল জনগনরা ভেবেছিলো এই যে তারা জনাব পাঠানের মতো করাচিতে উপবেশন করবে, তিনি আর কখনো পূর্ব পাকিস্তানে ফিরে যাবেন না; তিনি এখানেই নিবেশিত হবেন। সুতরাং এই সকল লোকজন আরো চিন্তা করে নেয় যে তারা কিছু অর্থ উপার্জন করবে এবং এখানেই ঘর-বাড়ি তৈরি করবে। তারা কখনও ফিরে যেতে পারবেনা কারন তারা সম্পূর্ণ প্রাদেশিক স্বায়িত্তশাসনের চাহিদার বিপক্ষে যাচ্ছে যেটা জনগনের দাবি।আপনি চাইলে আমাদের মারতে পারেন, চাইলে জেলেও পাঠাতে পারেন। কখনও কখন আমরা শুনি যে আমাদের জীবন ঝুঁকির মুখে, কিন্তু আমরা ভীত নই। ২১দফা কর্মসূচিরর ভিত্তিতে, আঞ্চলিক স্বায়িত্তশাসনের ভিত্তিতে ও আমরা জনগনের দ্বারা নির্বাচিত হয়েছি। তারা চাইলে ধোঁকা দিতে পারে কিন্তু আমরা পারি না।
জনাব আব্দুল আলিম :- আমরা কখনো বিশ্বাসঘাতকতা করিনি।
শেখ মুজিবুর রহমান :- জনাব পূর্ব পাকিস্তানের জনগন কখনো খসড়া সংবিধান গ্রহন করবে না। আপনি চাইলে আমাদের গ্রেফতার করতে পারেন।আপনি ইতিমধ্যে আমাদের বন্ধুদের গ্রেফতার করেছেন এবং চাইলে আরো অধিক লোককে আপনি গ্রেফতার করাতে পারেন। আমি আমার বন্ধুদের কাছে আপিল করব, সম্মানিত জনাব চুন্দ্রিগর, যিনি যুক্তরাষ্ট্রীয় বিচারালয়ে ভেঙ্গে যাওয়া গণপরিষদ নিয়ে লড়েছেন এবং সৌভাগ্য বশত যিনি এখন আইন মন্ত্রী, ২১দফা কর্মসূচিরর ভিত্তিতে সংবিধান রচনা করতে।যদি আপনি সংবিধানকে জোর ঠেলে সরাতে চান তাহলে সেটি আপনি পারেন, কিন্তু যদি আপনি এই সংবিধানে বল প্রয়োগ করেন, তখন আপনি আগুনের সাথে খেলা করবেন। আমি মাত্রই পূর্ব বাংলা থেকে এসেছি, এবং আমি জানি সেখানকার জনগনদের অনুভূতি, কৃষিবিদ, গরীব ব্যবসায়ী এবং পূর্ব বাংলার অন্য সব সাধারণ জনগণের।যদি আপনি এই সংবিধানকে ঠেলে সরাতে চান, শুধুমাত্র সৃষ্টিকর্তাই জানেন কি হতে পারে।আমরা চাই যে শাসক গোষ্ঠীর সাথে সাথে পাকিস্তান সংরক্ষিত হবে তার দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্যেও যারা মহান আত্মত্যাগের বিনিময়ে পাকিস্তান অর্জন করেছে। এইসব লোকেরা এখন যারা পরিষদে আছে তারা পাকিস্তানের জন্য ২-আনা সংগ্রামও করেনি। তারা চাইতেছে ইসলামের নামে পাকিস্তানকে ধ্বংস করতে। আপনি যদি ২১-দফার উপর ভিত্তি করে সংবিধান গঠন করেন, আমরা আপনাকে সহযোগীতা করব, আমরা আপনার সাথে যোগদান করব, কিন্তু আপনি যদি জনগনের ইচ্ছার বিরুদ্ধে যান, আমরা এই স্বৈরাচারী ও অগণতান্ত্রীক সংবিধানের বিরুদ্ধে আমাদের অভিমত পরিবর্তন করব, শুধু মাত্র পূর্ব পাকিস্তানের জন্য নয়, বরং পশ্চিম পাকিস্তানেও। আপনি যদি একটি গণতান্ত্রীক সংবিধান পাশ করতে রাজি থাকেন তাহলে আমরা আপনাকে ৭দিনের মধ্যে এটি পাশ করতে সাহায্য করব, এমনকি ৩দিনের মধ্যেও, কিন্তু সংবিধান অবশ্যই গণতান্ত্রিক ভিত্তিতে হতে হবে, ২১-দফার ভিত্তিতে হতে হবে, অন্যথায় এটার তীব্রভাবে করব আমরা।
জনাব আতাউর রহমান খান ( ২৭শে জানুয়ারি, ১৯৫৬):- জনাব…….যদি পূর্ব পাকিস্তানের জনগন এটা মনে করে যে তারা ভিন্ন, তো এরাই হলো সেইসব মানুষ যারা তাদের সেটা ভাবতে বাধ্য করেছে।
তারাই এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছেন। গত আট বছর ধরে এরা জনগনকে এমনভাবে বিকলাঙ্গ করে রেখেছে যে তাদের এভাবে ভাবা ছাড়া আর কিছু করার ছিল না। যেমন, মওলানা ভাসানীর বক্তব্য এখানে একটি উত্তেজনাকর অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে, এটার কারনে এখানে হৈচৈ শুরু হয়েছে। জনাব আব্দুল মনসুন আহমেদের বক্তব্যও একই প্রভাব ফেলেছে। বড় ধরনের বিশ্বাসঘাতকতা করার জন্য তাকে পাঠানো হয়েছিলো।
সম্মানিত ডেপুটি স্পিকার :- কিন্তু আমরা এটা আলোচনা করছি না।
জনাব আতাউর রহমান খান:- না জনাব, আমি শুধু মাত্র জনগণের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছি। জনাব আবু মনসুর আহমেদ একটি বক্তব্য দিয়েছেন।কি ছিল তার বক্তব্য?
সম্মানিত ডেপুটি স্পিকার :- আমি জানিনা তার বক্তব্য কি ছিল, কিন্তু আমি এটা জানি যে আইন সভায় আজকের আলোচ্য বিষয় কি।
জনাব আতাউর রহমান খান :- জনাব, সে সেটা এই আইন সভায় বলেছে।
জনাব ইউসুফ এ. হারুন :- তিনি কি বলেছেন?
জনাব আতাউর রহমান খান :- তিনি সবকিছু আইন সভায় বলে দিয়েছেন এবং আপনারা যদি সেটা না জানেন………।
জনাব ইউচুফ এ. হারুন :- সেটা কি ছিল বলুন।
জনাব আতাউর রহমান খান :- জনাব, তিনি বলেছেন আমরা দুটি ভৌগলিক এবং অর্থনৈতিক ইউনিট; আমরা দুটি জনগোষ্ঠী আমরা দুটি সংস্কৃতি পেয়েছি, আমাদের দুটি ধারনা; আমরা দুটি ভাষা পেয়েছি। এসব কিছুই জনগণকে স্তম্ভিত করেছে এই। এটা তাদের অবাক করেছে। আমি বিস্মিত হই এটা ভেবে যে গত আট বছরের অনিয়ম তাদের বিবেককে নাড়া দিয়েছে কিনা। জনাব, তাদের কোন নীতিবোধ নেই। দেশের জন্য তাদের ভালবাসা লোক দেখানো ছাড়া আর কিছুই নয়; তারা শুধু তাদের ভুল গুলো ঢাকার জন্য একটি আদর্শবানী প্রচার করছে। এটা শুধুমাত্র প্রকৃত সমস্যাকে ধামাচাপা দেওয়ার জন্য। জনাব, এখনো পর্যন্ত পশ্চিম পাকিস্তানের কোন সংবাদপত্র কি পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি হওয়া অন্যায় অবিচার নিয়ে লিখতেছে; কোন সংবাদপত্র কি শাসক গোষ্ঠির মুখোশ উন্মোচন করে কিছু লিখেছে; কোন সংবাদপত্র কি দুঃখ প্রকাশ করছে, সমবেদনা জানিয়েছে এবং বলেছে যে এমন বৈষম্যের জন্য তারা লজ্জিত?
স্যার, জনাব আবুল মনসুন আহমেদ ইতিমধ্যেই বৈসাদৃশ্যেরর একটি তালিকা দেখিয়েছেন। কেন্দ্র থেকে আদায় করা ১৫১ কোটি রাজস্বের মাত্র ৪৬কোটি তারা পুর্ব পাকিস্তানে ব্যয় করেছে। একই ভাবে প্রায় ৬০০কোটি রপ্তানির বিপরীতে, পূর্ব পাকিস্তানে আমদানির জন্য শুধু মাত্র ২৯৩ কোটি ব্যয় করা হয় এবং পশ্চিম পাকিস্তানকে এর চেয়ে অনেক বেশি দেওয়া হয়েছে। জনাব, তারা সব ক্ষেত্রেই এটা করেছে। কেন্দ্রীয় সেবার জন্য তারা যে ১২ কোটি ব্যয় করেছে, তার মধ্যে পূর্ব বাংলার জনগনের জন্য খরচ করে মাত্র ৬০লক্ষ। জনাব, এখানে কি কোন তারতম্য আছে? জনাব, কেন্দ্রীয় সরকারের ৪২ হাজার কর্মচারীর মধ্যে মাত্র ২,৯০০ জন পুর্ব পাকিস্তানের আর সেটাও নিম্ন শেনীর এবং খুব কম প্রায় শুন্যের কোঠায় আছে উচ্চ পর্যায়ে। কেন্দ্রীয় সেবার ১২ কোটির মধ্যে মাত্র ৬০ লক্ষ পুর্ব বাংলায় ব্যয় করা হয়েছে। জনাব, এই হচ্ছে অবস্থা, অর্থাৎ অর্থ এবং সেবার ৫শতাংশ এবং ৯৫শতাংশ তাদের জন্য এবং এর সাথে, তারা আমাদের ভাই বলে স্যার। তারা আমাদের দেহের রক্ত চুষে নিয়েছে, আমাদের শুষ্ক কঙ্কালসার আর বিকলাঙ্গ বানিয়েছে এবং এরপরও তারা বলছে তারা আমাদের ভাই। আমরা যদি এটা বিপক্ষে কিছু বলি, তারা বলে তোমরা বিশ্বাসঘাতক, তোমাদের বাঁচার কোন অধিকার নেই, তোমাদের গুলি করে মারা উচিৎ,” জনাব ওটাই তাদের মনোভাব। মহোদয় এখন যখন আমরা সংযুক্ত হয়ে একজাতি হয়ে গেছি এবং অনন্তকাল ধরে এক হয়েই থাকতে হবে –সেটা করার কিছু পদ্ধতি আছে। স্যার, ত্রুটিটা এখানে ভৌগলিক। এমনকি, এক হয়ে থাকা মানুষরাও এই ভৌগলিক কারনে পৃথক হয়ে যায়। আমেরিকার ইতিহাসে, অস্ট্রেলিয়ার ইতিহাসে, নিউজিল্যান্ডের ইতিহাসে এটি স্পষ্ট। এই মানুষ গুলোর ধমনীতে একি রক্ত বইলেও শুধু ভৌগলিক কারনে তারা বিচ্ছিন্ন। মহামান্য মহোদয়, এটা অস্বীকার করা যায় না যে আমরা দুটো আলাদা দেশ হিসেবে ছিলাম। প্রকৃত অর্থে আমাদের জোড়া দিয়ে এক দেশ করা হয়েছে আর তা করতে কিছু অবশ্য করনীয় রয়েছে। এমিলন তো অবশ্যই সুখকর হওয়া চাই, আন্তরিক হওয়া চাই। আর তা করার কিছু নির্দিষ্ট পদ্ধতি আছে, চলুন, আমরা সেই পদ্ধতি অনুসরন করার চেষ্টা করি। শুধু একটা আইন, ভারত সরকার আইন বা স্বাধীনতা আইন দুটো মন জোড়া লাগাতে পারে না। হৃদয়ে হৃদয়ে নিজে থেকে মিল হলে তবেই মিলন সম্ভব, তার জন্য আপনি কি করেছেন?
……যদিও বড়ই তুচ্ছ, তবুও আমি আপনাকে একটা ছোট্ট কথা বলি স্যার। ঢাকা বিমান বন্দরে বিভিন্ন দূরত্ব থেকে ছেড়ে আসা এবং ছেড়ে যাওয়া বিমানের ঘোষণা ইংরেজি ও উর্দুতে করা হলেও বাংলায় করা হয় না, এই বিষয়টি আমি প্রায় মাস তিনেক আগে এই সংসদেই বিবৃত করেছিলাম। চারকড়িও লাগবেনা, কারো একটা পয়সাও যাবেনা- কত বাঙ্গালী ছেলে বসেই আছে যারা সহজেই ঘোষণা দিয়ে জানাতে পারে যে অমুক বিমান করাচীর উদ্দেশে ছেড়ে যাচ্ছে, যারা এর যাত্রী তারা দয়া করে লাউঞ্চেআসুন। এখন দেখুন স্যার, প্রায় মাসতিনেক আগে আমি এই অনুরোধ করার পরেও কারো সেদিকে লক্ষ্য করার লক্ষন নাই। এটা কি বলুন? আমাদের আবেগ- অনুভুতির এমনি কি কদর দেন আপনারা? মানুষের ওপর এটা একটা ব্যাপক প্রভাব রাখতে পারত। এই ঘোষণা বাংলায় করার ব্যাবস্থা করতে পারলেও তা মানুষের মনে অসাধারন প্রভাব রাখতে পারত কারন, যে জাতি গতআট বছর ধরে বাংলা ভাষার জন্য অনুনয়পূর্ণ আবেদন করে আসছে তারা এই ভেবে সান্ত্বনার একটা লাইন পেত যে আমাদের আবেগের কিছু মূল্য অন্তত তারা দিয়েছে। এটা আমাদের একজনের আরেক জনের প্রতি আন্তরিকতা অনেক দূর এগিয়ে নিতে পারত এর পূর্ব বাংলার মানুষের মনের অনেক ক্ষোভ মুছে দিতে পারত। একটা কড়ি লাগেনা- পয়সা লাগেনা, যেহেতু ইংরেজি এবং উর্দুতে ঘোষণা আপনারা দিয়েই থাকেন, বাংলাতে ও একটা ঘোষণা খুব সহজে দেওয়াই যায়, কিন্তু মহোদয় তাতো করা হয়নি………
তো স্যার এই হলো আমাদের এই পারের ভাইদের মনো ভাব। তারপর দেখুন, আমাদের তো অর্থনৈতিক স্বাধীনতা চাই, চাই অর্থনৈতিক মুক্তি, কারন দুইটা অংশ সম্পূর্ণ আলাদা। আমাদের অর্থনৈতিক কাঠামোও পুরপুরি ভিন্ন। আমাদের অবশ্যই এসব বিষয়ে পৃথক ব্যাবস্থা থাকা দরকার। যদি আপনি আমার এ কোথার কোন গুরুত্ব না দেন তবে শুধু আঘাতই করা হবে, ভালবাসা হবেনা। বিষয়টা অনেকটা একটা বাচ্চার মত, যে তার সেই মায়ের হাতে সব সময় মার খায় যেই মাই তাকে ভালবাসে, তবে এই ক্ষেত্রে আপনি আমকে শুধু মেরেই চলেছেন কিন্তু আমার প্রতি ভালবাসার কোন প্রকাশ নাই! আমি এই ছোট্ট অনুরোধটা তিন মাস আগে করেছিলাম আর আমি বুঝতে পারছিনা, কি আপনাকে সেটা বাস্তবায়নে বাধা দিলো। এটাই তো মনোভাব স্পষ্ট করে দেয় স্যার। তাহলে আমরা তাদের কাছে কি করে আশা করি? কিভাবে ধরে নেই যে এরচেয়েও বড় বিষয়ে সমঝোতায় আসা যাবে, যখন এই সামান্য ব্যাপারটিতেই একমত হওয়া সম্ভব হচ্ছে না।এথাকেই এই লোকগুলোর মনোভাব সম্পর্কে ধারনা পাওয়া যায়। শাসকগোষ্ঠীর এই মানুষগুলো, যারা গতআট বছর ধরে এদেশ শাসন করে এসেছে, খোদাচান, বানাচান, যদি আগামীতে আর কিছু দিন শাসন চালিয়ে যায়, তবে একমাত্র স্যার আর অই খোদাই জানেন পূর্ব বঙ্গের পরবর্তী অবস্থা কি হবে। স্যার, এই সংবিধানের মাধ্যমে পূর্ব বাংলায় চালিয়ে আসা অন্যায়, অসমতা আর অপকর্ম চিরস্থায়ী হয়ে যাবে। এই বিষয় গুলো সংশোধনের জন্য কোথাও কোন সুযোগ বা আইন নেই, আর তাই সংবিধানের পর সংবিধান আসবে যাবে তার সাথে এগুলোও চলতেই থাকবে।…
মহোদয় বর্তমান পরিস্থিতির আলোকে একটি ছোট্ট কথা আমি বলতে চাই। যতদূর বিষয়টিতে পূর্ব বাংলার মানুষ জড়িত, আমি বঝাতে চাইছি, সমগ্র পাকিস্থানের মানুষ জড়িত, আমি তাদের দুই দলে ভাগ করি- স্বায়ত্তশাসনবাদী আর কেন্দ্রিকরনবাদী।
মাননীয় ডেপুটি স্পীকারঃ কি এরা/তারা?
জনাব আতাউর রহমান খানঃ এরা হলো স্বায়ত্তশাসনবাদী আর কেন্দ্রিকরনবাদী। প্রায় সাড়ে ছয় কোটি মানুষ স্বায়ত্তশাসনবাদী, যারা প্রত্যেক অঞ্চলের স্বায়ত্তশাসনে বিশ্বাসী। আর আমি যত দূর বুঝি, এই পটভূমীতে আবার চার ধরনের মানুষ আছে, এরা হলোঃ
প্রথমত, সাধারন পাকিস্থানি, যারা সাধারনত স্বায়ত্তশাসনবাদী, যাদের প্রাদেশিকবাদীও বলা যায়।
দ্বিতীয়ত, ইন্দ-পাকিস্থানী পুঁজিপতি। এরা মূলত কেন্দ্রিকরনবাদী, যাদের মূল প্রকৃতি হলো কাঁচামাল উৎপাদনকারীদের কোন ঝামেলা ছাড়াই, নিয়ন্ত্রণ ছাড়াই শোষণ করা, আর এই উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই এরা কেন্দ্রীয় শাসনে বিশ্বাসী।
তৃতীয়ত, পাকিস্থানী সামন্তপতি, যাদের প্রতিরক্ষাও বৈদেশিক বিষয়ে কোন আগ্রহ নাই। তারা শুধু চায় কিছু কাজ আর কিছু যা প্রতিরক্ষার উদ্দেশ্য সাধন করে।
চতুর্থত, সাধারন ইন্দ-পাকিস্থানী, এই শ্রেণীটি সাধারনভাবে মুজাহির নামেও পরিচিত যদের পরিস্থিতি করুন। শুধু কিছু নির্দিষ্ট রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের জন্য এদের ব্যাবহার করা হয়। আর যখন সেই স্বার্থের জন্য তারা ঠিক মানানসই হয়না, দুর্ভাগ্যবশত তাদের ভারতীয় দালাল বলে চালিয়ে দেওয়া হয়। আমি ক্ষমতায় থাকলে তাদের ব্যাবহার করতে চাই, আর যদি তারা আমার পরিকল্পনা ও প্রয়োজনমত না চলে, তবে আমি তাকে ভারতীয় দালাল বলব। এমনটা বলায় সেই মানুষের আর জায়গা থাকে না, এক পা এই পারে আরেক পা ওইপারে, এই পরিস্থিতিতে তার কাছে কি আসা করা যায়। এমনি চার শ্রেণীর মানুষ রয়েছে। এই শ্রেণী ভাগে আপনি খেয়াল করে দেখবেন যে, স্বায়ত্তশাসনবাদীর রয়েছে মোট মানুষের প্রায় ৯০%, কারন সাধারন পাকিস্থানীরা স্বায়ত্তশাসনবাদী। তারা চায় বাঁচতে, চায় অন্যদের বাঁচতে দিতে। নিজে নিজে নির্ধারণকারি/ আত্মনির্ধারণকারী মানুষের স্বায়ত্তশাসিত হতে পারাটা অধিকার। পীর মোহম্মদ আলী রাশিদ অথবা জনাব হামিদুল হক চৌধুরী যে প্রেক্ষিতে স্বায়ত্তশাসন বুঝিয়েছেন এখানে এই প্রেক্ষিতে বুঝবেন না…
আমি ইতি মধ্যে বলে দিয়েছি যে, এটা চিরস্থায়ী দাসত্তের সনদ হতে চলেছে। এতে এমন কিছু উপাদান আছে যা ইসলাম বিরোধী এবং গণতন্ত্র পরিপন্থি আর আমি সেগুলোর ব্যাখ্যা দিব। (বিরতি) স্বায়ত্তশাসন এর প্রয়োজন যে অনুভব করে তার চাইতে ভালো এটা আর কে করতে পারে? অ প্রত্যাশিত সাফল্যে মন্ত্রী হতে ১৫০০ মাইল পার করে যে এসেছে, সে তো আর স্বায়ত্তশাসন নিয়ে ভাবতে পারেনা। তাই আমাকে স্বায়ত্তশাসনের একটা বিশ্লেষণ দিতে হবে।
মহোদয় বিভিন্ন রাজনৈতিক শব্দের ভিন্ন পটভূমিতে ভিন্ন অর্থ রয়েছে। এই সংসদেই গণতন্ত্রের সংজ্ঞা দশজন দশভাবে দিতে পারে আর সবগুলই কারো না কারো কাছে গ্রহণযোগ্য হবে। ওই সংজ্ঞামূলক অর্থ নিয়ে আমাদের মাথা ঘামানো উচিৎ না। আমরা সবচেয়েযে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের সম্মুখীন তা হলো দেশের ভৌগলিক পরিস্থিতি এবং পূর্ব বাংলার মানুষের গতআট বছরের কায়-ক্লেশ, ভোগান্তি। যদি দেশের দুই অংশ পাশাপাশি অবস্থান করতো, আমি অবশ্যই একক সরকারই বেশি পছন্দ করতাম- একদেশ, একসরকার, একভোট, একঅর্থনীতি…
তাই স্যার, শুধু যদি দেশের এই ভৌগলিক বিষয়টি না থাকত, এককসরকার অবশ্যই উৎকৃষ্ট ব্যাবস্থাপনা হতো। এই যখন আমাদের অবস্থান, আমদের অবশ্যই, সংঘ/যুক্তরাষ্ট্র থাকা দরকার, সংঘ/যুক্তরাষ্ট্র ব্যাবস্থা দেশের ভেতর শক্তিশালী আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন স্বীকার করে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে, আমদের বন্ধুরা সংঘ/যুক্তরাষ্ট্র ব্যাবস্থার ধারনা দিয়ে শুরু করলেও এমন সব ব্যাবস্থা রেখে দিয়েছেন যার ফলে এককসরকার অথবা স্বৈরতান্ত্রিক সরকারই খুঁজে পাওয়া যায়।
কোন প্রদেশকে একক স্বায়ত্তশাসিত সংঘের নিয়মে অন্তর্ভুক্ত করা, তারা এটা ভাল ভাবে গ্রহণ করেনি। যখন আমরা একটা সংঘ, প্রদেশ অবশ্যই সংঘের অন্তর্ভুক্ত হবে এবং প্রদেশ অবশ্যই স্বায়ত্তশাসিত হবে। আপনি প্রদেশকে কোন স্বায়ত্তশাসন দেননি এবং আপনি কোন রক্ষাকবচ দেননি…………
আমি আপনাকে বলেছিলাম স্বায়ত্তশাসনের সমর্থকগণ স্বায়ত্তশাসনকামীদের চান এবং কেন তারা এটি চান। আমি যেমন আপনাকে আগেই বলেছিলাম যে দেশের ভৌগোলিক অবস্থান এত বৈচিত্র্যময় এবং সেই অনুসারে দেশের অর্থনৈতিক বিভাগ এত নিখুঁত যে পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনীতি থেকে আলাদা হয়ে পূর্ব বাংলার অবশ্যই স্বতন্ত্র অর্থনীতি থাকতে হবে তা না হলে এটি বেঁচে থাকতে পারবে না। গত ৮ বছরে আমাদের অস্তিত্ব দেখিয়েছে যে যদি না এবং যতক্ষন না আমরা আলাদা হচ্ছি এবং আগামী ৮ বছরের মধ্যে পূর্ব বাংলায় স্বতন্ত্র অর্থনীতি হচ্ছে আমরা সম্পূর্নরুপে গরিব হয়ে যাব এবং এটি আমাদের ধ্বংস ডেকে নিয়ে আসবে। তাই সংকল্প হলো বেঁচে থাকা এবং পাকিস্তানের একটি অখন্ড অংশ হিসেবে বেঁচে থাকা এবং পাকিস্তানের উন্নতিতে অবদান রাখা। কেন্দ্রীকরণবাদীদের মনে একটা সংশয় আছে, যারা মূলত শাষক গোষ্ঠী, যদি প্রদেশ শক্তিশালী হয়ে যায় তবে কেন্দ্র আরও দুর্বল হয়ে যাবে। আমার তত্ত্ব পুরোপুরি ভিন্ন। আমি পুরোপুরি ভিন্নমত পোষণ করছি এবং আমি অনুভব করি যে যদি না এবং যতক্ষন না আপনি পাকিস্তানের দুই অংশকে শক্তিশালী করছেন ততক্ষণ আপনি শক্তিশালী পাকিস্তান পাবেন না। আপনি সমৃদ্ধ পাকিস্তান পাবেন না। পাকিস্তানের কোন ভবিষ্যৎ থাকবে না। তাই সমৃদ্ধ ও সংহতি এবং শক্তিশালী পাকিস্তানের স্বার্থে পাকিস্তানের অন্যান্য অংশের, বিশেষ করে পূর্ব বাংলাকে, এখানের কেন্দ্রীয় সরকারের ন্যায় শক্তিশালী করা প্রয়োজন। গত ৮ বছর ধরে এটা করা হয়নি এবং সংবিধানেও কোন বিধান নেই যা পাকিস্তানের এই অংশকে পূর্বের চেয়ে কিঞ্চিত শক্তিশালী করবে। আমার বিজ্ঞ বন্ধু জনাব হামিদুল হক চৌধুরী গতকাল বলেছিলেন যে পূর্ব বাংলায় যথেষ্ট পরিমানে স্বায়ত্তশাসন দেয়া হয়েছে এবং তাই নিয়ে পূর্ব বাংলাকে সন্তুষ্ট থাকতে হবে। আমি কঠোরভাবে এই দৃষ্টিভঙ্গি প্রত্যাখ্যান করছি এবং এটি পুরোপুরি ভুল ধরে নিচ্ছি এবং প্রধানমন্ত্রী প্রদেশের শক্তি হিসেবে যা দেখিয়েছেন সত্যিকার অর্থে তা প্রদেশের শক্তি নয়। প্রকৃতপক্ষে আপনি ক্ষমতা বৃদ্ধি বা আয় বৃদ্ধি করে না এমন আরও কিছু বিষয় সংযুক্ত করে স্বায়ত্তশাসনকে ছেঁটে ফেলেছেন। প্রকৃতপক্ষে আপনার কাছে আছে ফাঁপা প্রাদেশিক তালিকা এবং যার দরুন আপনি দেখাতে চাইছেন যে দেশে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন দেয়া হয়েছে। আমি সত্যিই জনাব চৌধুরীর মনোভাব বুঝতে পারছি না যতদূর পূর্ব বাংলার জন্য আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন নিয়ে উদ্বিগ্ন। গত ৮ বছর ধরে কেন্দ্রীয় সরকার দেখিয়েছে যে যদিও এই ৮ বছর আমরা বলেছিলাম যে এক প্রকার কেন্দ্রীয় সরকার বিরাজ করেছিল তবুও সকল কার্যকরী উদ্দেশ্যে একটি একক সরকার বিদ্যমান ছিল। অর্থনীতির উপর, শিল্পের উপর, অর্থের উপর, ব্যবসার উপর একক আধিপত্য ছিল এবং এ সকল বিষয় কেন্দ্রের হাতে ন্যস্ত ছিল, কার্যকরী অর্থে সবকিছু। প্রদেশ, বিশেষত পূর্ব বাংলা এর থেকে কোন সুযোগ-সুবিধা পায়নি। এখন, জনাব, প্রতিরক্ষা বিষয়ে আমি আপনাকে একটা কথা বলতে চাই যে ৪০ কোটির মধ্যে যা দেশে গত কয়েক বছর ধরে প্রতিরক্ষা খাতে খরচ করা হয়েছে, কেবলমাত্র ১৪ কোটি পূর্ব বাংলায় ব্যয় করা হয়েছে, যা বোঝায় বছরে ২ কোটি রুপি বা তারও কম। এই ধরনের আচরণ কেন করা হল, কেন সৎ-মায়ের মত ব্যবহার, কেন এমন অসভ্য আচরণ। এটা কি ঠিক, এটা কি ভ্রাতৃসুলভ, তারা কি বলতে চায় যে তারা আমাদের ভাই এবং আমরা তাদের ভাই। এটা কি সত্যিই ভ্রাতৃসুলভ মনোভাব যে পূর্ব বাংলার প্রতি তারা কোন অনুভূতি দেখাবে না ? তারা পূর্ব বাংলায় সামরিকভাবে সকলকে সজ্জিত করেনি এবং প্রত্যেকটি সম্ভাব্য ঘটনা ভেবে যে এখানে কোন প্রতিরক্ষা নেই এই ভেবে যেন পূর্ব বাংলা চিন্তিত থাকে। তারা মনে করে যে পশ্চিম পাকিস্তানের প্রতিরক্ষাই হলো সমগ্র পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা।
জনাব, কেন্দ্রীয় গোষ্ঠী, শাসক গোষ্ঠী, পূর্ব বাংলার কৌশলগত অবস্থান কখনই বঝেনি এবং একবার আমাদের সেনাপ্রধান বলেছিলেন পূর্ব বাংলা অরক্ষিত। যদি তা অরক্ষিত হয় জনাব, তাহলে এটি যেভাবে আছে সেভাবে রেখে দিতে সমস্যা কোথায়। এটা নিয়ে আদৌ কোন বিরক্ত হবেন না। যদি তা রাখতে না চান তাহলে এটি অন্যত্র ছুড়ে ফেলে দিন। কখনও বলবেন না যে এটি অরক্ষিত এবং সেই অজুহাতে আপনি পূর্ব বাংলার জন্য এক আনাও খরচ করবেন না……
এখন, আমি সংবিধানের আর্থিক দিক নিয়ে কথা বলছি। পূর্ব বাংলার রাজস্ব আয় থেকে ১৭২ কোটি অর্জিত হয়েছিল এবং এর মধ্য থকে গত ৮ বছরে ৪৫ কোটি পূর্ব বাংলায় খরচ করা হয়েছে। বিশ্বের যে কোন দেশের অর্থনৈতিক নীতি হলো যে খাত থেকে রাজস্ব অর্জিত হয়েছে সেই একই খাতের পেছনে সমস্ত অর্থ ব্যয় করা।
সম্মানিত ডেপুটি স্পিকারঃ আপনি সংবিধানের কোন ধারাটি নির্দেশ করছেন?
জনাব আতাউর রহমান খানঃ আমি অর্থ কমিশনের সাথে সংশ্লিষ্ট ধারাটি নির্দেশ করছি। এটি খসড়া সংবিধান বিলের ১১৪ অধ্যায়। জনাব হামিদুল হক চৌধুরী সরকারের পক্ষ থেকে আমাদের বলেছেন যে প্রতিকারের সকল ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে এবং মহৎ উদ্ভাবনের মাধ্যমে এমন ভাবে সকল সংশোধন করা হয়েছে যে তারা এখন একটি জাতীয় অর্থ কমিশন গঠন করতে সক্ষম এবং এটি আমাদের সকল সমস্যার প্রতিকার করবে এবং এর ফলে পূর্ব বাংলার প্রতি আর কোনরূপ অবিচার করা হবে না। এর উওরে আমি বলেছিলাম এই জাতীয় অর্থ কমিশন দ্বারা কীভাবে প্রতিকার পরিমাপ করা সম্ভবপর নয়। আমি এখন আপনাদের দেখাব কীভাবে এটি আরেক ধাপ্পাবাজি। কিন্তু তিনি বলেছিলেন এটি মহৎ। আমি বলেছি এটা একটা নাটক এবং কীভাবে এটা ধাপ্পাবাজি তা আমি দেখিয়ে দিব। আমি আপনাকে পূর্বেই বলেছিলাম যে এই সূক্ষ্ম নীতি আমাদেরকে ধাঁধাঁয় ফেলবে এবং এটা অবশ্যই তাদের পরিকল্পনায় ছিল। প্রথম দর্শনে খুব সহজে আবিষ্কৃত ভাল উদ্দেশ্য শেষে প্রতারনা হিসিবে সনাক্ত হয়। এটা এভাবে সনাক্তকৃত হয়েছিল এবং এটা জনগনের সাথে প্রতারনা এবং জনগনের ধারনার সাথে প্রতারনা। এখনই এটা আমি প্রমাণ করে দিব। আমাকে পূর্ব বাংলার আর্থিক অবস্থা সম্পর্কে বলতে দিন। আমি ইতিমধ্যে বলেছি যে ১৭২ কোটির মধ্যে পূর্ব বাংলায় কেবলমাত্র ৪৫ কোটি খরচ করা হয়েছে এবং ১২৪ কোটি পূর্ব বাংলা থেকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে এবং এই অর্থ কেন্দ্রীয় রাজকোষে চলে গেছে এবং আক্ষরিক অর্থে সেখানে দ্বৈত-নিরাপদ অর্থ শোষণ হয়েছে। যদি এই ১২৪ কোটি পূর্ব বাংলায় খরচ করা হত তাহলে তা দেশে আরও আয় বৃদ্ধি করত কিন্তু এটা না করে তারা ঐ প্রদেশকে করেছে শুষ্ক এবং এই অংশকে করেছে সমৃদ্ধ। তাই অসমতা বেড়েই চলেছে কারণ সেখান থেকে যে অর্থ খরচ করা হয়েছে তা আর উৎসে ফিরে আসেনি। জনাব, এটা অনেকটা হৃদপিন্ড ও শরীরের মত। হৃদপিন্ড শরীরে রক্ত প্রেরণ করে এবং শরীরের মধ্য দিয়ে যাওয়ার পর রক্ত আবার হৃদপিন্ডে ফিরে আসে। যদি তা ফিরে না আসে তাহলে হৃদপিন্ড শুকিয়ে যায়। তাই, এইক্ষেত্রেও ঠিক একই অবস্থা বিরাজ করছে। যদি সেই আয় ফিরে না আসে তাহলে আরও আয় শুকিয়ে যাবে। অতএব, জনাব, যদি কেন্দ্রীয় গোষ্ঠী এই ঘটনা আরও ৮ বছর সচল রাখে, বাংলা পুরোপুরি দেউলিয়া হয়ে যাবে এবং আর্থিকভাবে সম্পূর্ন ধ্বংসের সম্মুখীন হবে। যা বন্ধ করা উচিত ছিল। কিন্তু এটা বন্ধ করা হয়নি, উপরন্তু প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে যে আর্থিক রাজস্ব চিন্তিত পর্যন্ত, বাংলা অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। জনাব, এই অর্থের সাথে সম্পৃক্ত, আমি স্টেট ব্যাংক সম্পর্কে বলতে চাই। এখন স্টেট ব্যাংক দেশের বৈদেশিক বিনিময়কে নিয়ন্ত্রণ করে। ব্যবসা ও শিল্প দ্বারা অর্থ সংগৃহীত হয় এবং ব্যবসার ক্ষেত্রে আপনি খুঁজে পাবেন যে পূর্ব বাংলা থেকে যে পণ্য রপ্তানি ও আমদানি করা হয় তার কোন আনুপাতিক ভারসাম্য নাই। জনাব, যে দেশ যত বেশি রপ্তানি করবে যদি তা আমদানি দ্বারা ভারসাম্য রক্ষা করা না হয় তাহলে পণ্য বাইরে চলে যাওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। পুর্ব বাংলার ক্ষেত্রে এখনও এটা ঘটেনি।
বিগত আট বছরের জন্য মোট বাণিজ্যিক জের রপ্তানি ক্ষেত্রে ৬৬৪ কোটি টাকা এবং আমদানি ক্ষেত্রে ২৯২ কোটি টাকা এবং ৩৭২ কোটি টাকা জের রয়েছে। পশ্চিম পাকিস্তানে রপ্তানি ক্ষেত্রে ৫৮৬ কোটি টাকা এবং আমদানি ক্ষেত্রে ৮২৬কোটি টাকা এবং ২৩৯ কোটি টাকার অনুমোদনহীন জের রয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানে এই ৩৭২ কোটি টাকা আনা হয়নি যা আনা যেত এবং দেশের পণ্য সামগ্রী রপ্তানির নামে চালান হয়ে গেছে এবং পণ্য সামগ্রীর প্রশ্নে দেশটিকে দরিদ্র করে রেখেছে। কিন্তু সে অনুপাতে আমদানির মাধ্যমে সে পরিমাণ পণ্য আসেনি, উৎপাদক, শ্রমিক এবং অন্যান্য সকল শ্রেণীর মানুষ যারা এই বিষয়ে আগ্রহী তাদেরকে কোন প্রেষণা দেয়া হয়নি এবং দেশটি ক্রমশ দরিদ্র হয়ে যাচ্ছে। স্যার, এটা এইভাবে কাজ করে, যখন দেশ পণ্য উৎপাদনের দিক দিয়ে গরিব হয়ে যায়, শ্রমিকরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে কেননা অর্ধেক উৎপাদনের প্রতি তাদের কোন উৎসাহ থাকবে নাহ এবং কাঁচামালের উৎপাদকরা কাঁচামাল উৎপাদন করতে পারবে না, যার ফলে দেশের আয় কমে যাবে এবং এই ভাবে প্রতি বছর হ্রাস পাবে এবং অর্থনীতিবিদদের হিসাব অনুযায়ী আর ৮ বছর পর পূর্ববাংলার অবস্থান শুন্যতে এসে পৌঁছাবে।
মাননীয় ডেপুটি স্পীকারঃ আমি আগে তা শুনেছি
মিঃ আতাউর রাহমান খানঃ ঠিক আছে স্যার, বৈদেশিক আয় এর দ্বারা এই অবস্থা এবং এর সমাধান হওয়া উচিৎ। এতে কোন ক্ষতি নেই। এতে কেন্দ্রস্থল কোনভাবেই দুর্বল হয়ে পরবে না। কেউই এতে বিস্মিত হবে না। আসলেই এর আবস্থা কি? পাকিস্তানের স্টেট ব্যাংক এর দ্বারা বৈদেশি আয়ের সমস্ত কিছু নিয়ন্ত্রিত হবে। অন্য সকল দেশের মতো স্টেট ব্যাংককে বিভক্ত করা যেতে পারে। যেমন তা আমর বন্ধু জনাব মনসুর বললেন অনেক দেশই রেয়েছে যারা নিছক দূরত্বের কারণে স্টেট ব্যাংক কে ২ টি অংশে বিভক্ত করেছে। এমনকি প্রতিবেশী দেশ ভারতে ও।
১৯৫৫ সালের জানুয়ারি মাসে আমিঃ নেহরুর একটি বিবৃতিতে পড়েছিলাম তারা রিজার্ভ ব্যাংককের ৫ অথবা ৬ টি জোন তৈরি করতে যাচ্ছে, কেন্দ্রস্থলে সামগ্রিকভাবে থাকবে যুক্ত্ররাষ্ট্রীয় রিজার্ভ ব্যাংক।
মাননীয় ডেপুটি স্পীকারঃ আপনি কি এই বিধানটি সংবিধানে চাচ্ছেন।
মিঃ আতাউর রাহমান খানঃ জী স্যার,স্টেট ব্যাংক এর মাধ্যমে বৈদেশিক আয় নিয়ন্ত্রণ করার জন্য সেখানে দুটি অংশের জন্য দুটি স্টেট ব্যাংক থাকা উচিৎ। সেখানে কারাচিতে একটি ফেডারেটিং এবং ২টি শাখার একটি লাহরে এবং অন্যটি ঢাকাতে থাকা উচিৎ।
আমি অর্থনীতির অবস্থা সম্পর্কে এই সভায় বলেছি যে আমরা এখান থেকে বিষয়গুলো সাজাতে চাই। বানিজ্য, শিল্প এবং অন্যান্য যে সকল বিষয়ের ক্ষেত্রে, এটা আমাদের জন্য একটি শক্তিশালী ক্ষেত্র তৈরি করা এবং দেখানো জরূরী যে কেন্দ্রীয় বানিজ্য বিভাগের ত্রুটিপূর্ণ নীতি নির্ধারণের জন্য আমরা অনেক ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছি। এটা আমদের সাথে থাকলে, আমরা ভুক্তভোগী হতাম না। স্যার, পূর্ব বাংলার জন্য সরকারের এই অবমুল্যায়িত সিদ্ধান্ত পুর্ব পাকিস্তানের জন্য একটি সাজানো ঘটনা এবং এই সিদ্ধান্ত পুনঃমুল্যায়ন; একটি দুঃস্বপনের মতো। আমি আপনাকে দেখাচ্ছি এটা কিভাবে হয়েছিল। অবমূল্যায়নের সময়, বৃহৎ রপ্তানি , বৃহৎ যন্ত্রপাতি, ভারী যন্ত্রপাতি এবং অন্যান্য জিনিস নিয়ে আসবে এবং দেশ তাতে উপকৃত হবে। কিন্তু অবমূল্যায়নের সময় যে মেশিনারি ওই সমস্ত বৃহৎ রপ্তানির পরিবর্তে এসেছিল তার ফলে পূর্ব বাংলা বিন্দুমাত্র উপকৃত হয়নি। যে সময়ে খুব খুব বেশি রপ্তানি হচ্ছিল, পাকিস্তান একটি ভাল অবস্থানে ছিল যার জন্য দায়ী ছিল দেশটির টাকা। কিন্তু এর ফলে পশ্চিম পাকিস্তান সামগ্রিক ভাবে উপকৃত হয়েছিল। স্যার বর্তমানে পশ্চিম পাকিস্তান সম্পূর্ণরূপে শিল্পোন্নত হয়ে গিয়েছে। এমন একটি পর্যায়ে পৌঁছেছে, যেমন তা আমার বন্ধু মিঃ আবুল মনসুর বললেন, শিল্পগুলো এমন পর্যায়ে রয়েছে যেখানে তারা অতিরিক্ত উৎপাদন করতে পারবে এবং তা রাপ্তানি করেত পারবে। পূর্ববাংলায় শিল্প অগ্রগতি খুবই কম এবং ভবিষ্যতে পূর্ববাংলা নিজেকে শিল্পোন্নত করতে পারবে সে সম্ভাবনা একেবারেই নেই।
এখন এই পুনঃমুল্যায়ন পুর্ব বাংলার শিল্পায়নকে থামিয়ে দিয়েছে এবং এরপর আর কোন সুযোগ থাকবে না যদি না সমগ্র পৃথিবীতে কোন উত্থান এবং অভ্যুত্থান না ঘটে।
মাননীয় ডেপুটি স্পীকারঃআপনি কি প্রস্তাব করছেন?
মিঃ আতাউর রাহমান খানঃ আমি বলেছি যে এই বিষয়গুলো প্রাদেশিক বানিজ্যের সাথে থাকা উচিত এবং শিল্প প্রদেশে থাকা উচিত।
মাননীয় এম এ খুহরু (পশ্চিম পাকিস্তান মুসলিম)ঃ বৈদেশিক বানিজ্যের কি হবে ?
মিঃ আতাউর রাহমান খানঃ আমি বৈদেশিক বানিজ্য সম্পর্কে বলেছি। আমি বলেছি কেন্দ্রীয় প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র ও মুদ্রাসহ তিনটি বিষয় সেখানে থাকা উচিৎ। এখন আপনি যদি মনে করেন আপনি সবকিছু প্রতিরক্ষার অধীনে নিয়ে আসবেন। আপনি যদি এই এই অবস্থার পরিবর্ধন করেন, দেশের প্রতিটি বিষয়ে প্রতিরক্ষার একটি দাবী থাকবে। উদাহরণস্বরূপ, যুদ্ধের ক্ষেত্রে প্রতিরক্ষার জন্য যে মানুষ লোহার উপর জুতা সারাই করে তার রিকুইজিশনও লাগবে এবং আপনি বলতে পারেন এইটা সেনাবাহিনীর লোকদের জন্য দরকারি। সুতরাং এই ভাবে প্রতিরক্ষার অধীনে সকল কিছু এবং সকল বিষয় আনা যেতে পারে। সুতারং পররাষ্ট্র এর অধীনে আপনি যে কোন কিছু আনতে পারেন যা এর পরিধিতে পরে। পররাষ্ট্র বলতে সেই সম্পর্ককে বোঝায় যা পাকিস্তান ও অন্যান্য দেশের মাঝে বিদ্যমান। কিন্তু যদি জনাব হামিদুর হক চৌধুরী সকল কিছু এর অধীনে অন্তর্ভুক্ত করতে চান তিনি তা করতে পারেন। উদাহরণস্বরূপ, যদি আমি লন্ডনে একটি চিঠি লিখি সেটাও পররাষ্ট্র এর অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। একই ভাবে যদি আমার অস্ট্রেলিয়াতে এখন কোন বন্ধু থাকে এবং সে যদি আমাকে একটি পারসেল পাঠায়, জনাব হামিদুর হক চৌধুরী খুলতে পারেন এবং দেখতে পারেন তাতে কি আছে কেননা যে সকল বিষয় পররাষ্ট্র এর সাথে সম্পর্কিত এই কারণে যে এটি কোনও বিদেশি রাষ্ট্র থেকে এসেছে এবং সকল কিছু যা কিনা বিদেশি রাষ্ট্র এর সাথে সম্পর্কিত তা পররাষ্ট্র এর অধীনে আসবে। এখন এটা আমদের উদ্দেশ্য নয়। জনাব হামিদুর হক চৌধুরী ১৯৫০ সালের ২১ দফা কর্মসূচী এর একজন লেখক ছিলেন যখন ঢাকা গ্র্যান্ড ন্যাশনাল কনভেনশন হয়েছিল যার আমি সভাপতিত্ব করেছিলা্ম কমিটির মূলনীতির রিপোর্ট এর বিরুদ্ধে যা প্রয়াত লিয়াকত আলী খান ব্যক্ত করেছিলেন। সে একজন জামিন ছিলেন এবং আমরা সেখানে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যে এই তিনটি বিষয় কেন্দ্রীয়করণ হবে। এখন এর প্রতিটি শব্দ এবং অর্থ এবং সংজ্ঞা পরিষ্কার ভাবে জনাব হামিদুর হক চৌধুরী বুঝতে পারবেন। তিনি এখন বলতে পারেন না যে প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র ও মুদ্রা এই সবকিছুর অন্তর্ভুক্ত। আমি উদাহরণ দিয়েছি এবং দেখিয়েছি কিভাবে মানুষ প্রতারিত হচ্ছে, একটি নির্দিষ্ট বিষয়ের জন্য আকাশ কুসুম সব বলা হচ্ছে। স্যার যদি যদি হামিদুর হক চৌধুরী পররাষ্ট্র মন্ত্রী থাকেন তাহলে তিনি সে সকল জিনিস সেখানে নিয়ে আসতে পারবেন। তিনি পররাষ্ট্র এর অধীনে সকল কিছু জড় করতে পারবেন। কিন্তু, স্যার যদি আমি পররাষ্ট্র মন্ত্রী হই, আমি বলব এগুলা বৈদেশিক নীতি না। এগুলো সহজেই প্রাদেশিক ভাবে মোকাবিলা করা যায়। বৈদেশিক বানিজ্য এবং বৈদেশিক মুদ্রা পাকিস্তানের স্টেট ব্যাংক দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতে পারে, ২ টি স্টেট ব্যাংক ২ টি স্থানে থাকবে, একটি ঢাকাতে আন্যটি লাহরে এবং ফেডারেল ব্যাংক এর হেড কোরটার কারাচিতে থাকবে। এটা সংবিধানে দেয়া যেতে পারে। এই সম্পর্কিত কোনও জটিলতা নেই।
স্যার, আজকাল পূর্ব বাংলার প্রতি অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বৈষম্যের কথা বলা হচ্ছে; বলা হচ্ছে যে সকল ক্ষেত্রে পূর্ব বাংলার প্রতি যে অবিচার করা হয়েছে, তার নির্বাণ হিসেবে ন্যাশনাল ফাইন্যান্স কাউন্সিল (জাতীয় অর্থ পরিষদ) প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। স্যার, মন্ত্রণালয় এবং অন্যান্য ব্যবস্থাপনা তো আগেও বিদ্যমান ছিল, কিন্তু তারা কখনো (অবিচারের) প্রতিকারের চেষ্টাও করেনি।
স্যার, আজকাল পূর্ব বাংলার প্রতি অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বৈষম্যের কথা বলা হচ্ছে; বলা হচ্ছে যে সকল ক্ষেত্রে পূর্ব বাংলার প্রতি যে অবিচার করা হয়েছে, তার নির্বাণ হিসেবে ন্যাশনাল ফাইন্যান্স কাউন্সিল (জাতীয় অর্থ পরিষদ) প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। স্যার, মন্ত্রণালয় এবং অন্যান্য ব্যবস্থাপনা তো আগেও বিদ্যমান ছিল, কিন্তু তারা কখনো (অবিচারের) প্রতিকারের চেষ্টাও করেনি।
ফলে আমি নিশ্চিত নই এমন কী আহামরি ভূমিকা, এমন কী অলৌকিক অগ্রগতি জাতীয় অর্থ কমিশন সাধন করবে…
স্যার, আপনি দেখবেন যে নির্বাচনই হচ্ছে এককভাবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার যা প্রকৃতপক্ষে একটি প্রদেশের স্বায়ত্তশাসনের গতিপ্রকৃতি নির্ধারণ করে। প্রাদেশিক তালিকায় ইতোপূর্বে অন্তর্ভুক্ত প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন আয়োজনের ব্যাপারটি এখন নতুন পরিকল্পনা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। এটা আসলে পূর্ব বাংলা এর আগে যেটুকুওবা স্বায়ত্তশাসন ভোগ করতে পারত, তার পথ একেবারে রুদ্ধ করে দিয়েছে। এইভাবে বলছে না যে, আমরা তোমাদেরকে এতগুলো খাত দিয়েছি, বিশ বা ত্রিশটি খাত। খাতগুলো ঠিকমতই আছে, কিন্তু তাতেই একটি দেশটি স্বায়ত্তশাসিত হয়ে যায় না; সত্যি বলতে, গণতন্ত্রের মূলনীতি যে নির্বাচন,— খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি ব্যাপার,— তা-ই কেড়ে নেওয়া হয়েছে। দেশে এখন যা ঘটছে তার প্রেক্ষাপটে বিচার করলে বলতে হয়, এই দেশের প্রশাসন চালাচ্ছে মূলত একটি দলীয় সরকার। কেন্দ্রীয় সরকারে ক্ষমতাসীন দলটির বিপরীতে পূর্ব বাংলায় একটি একদলীয় সরকার গঠিত হতে পারে। সুতরাং প্রাদেশিক আইনসভার নির্বাচনের দায়ভার অবশ্যই প্রাদেশিক সরকারের হাতে ন্যস্ত থাকা উচিত, কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে নয়। কিন্ত এই অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে, এবং এই বন্দোবস্তের মাধ্যমে স্বায়ত্তশাসন যদিওবা দেওয়া হয় বা যদিবা কিছুমাত্র থেকেও থাকত, তা সম্পূর্ণভাবেই কেড়ে নেওয়া হয়েছে।
ভারত সরকার আইনের ২৩ ধারায় প্রাদেশিক তালিকায় তেলকূপ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল যার মাধ্যমে অঙ্গরাজ্যে কিছু রাজস্ব যোগ হতে পারত। খুব সতর্কতার সাথে এটিও কেড়ে নেওয়া হয়েছে কারণ এতে করে পুনরুদ্ধারের সম্ভাবনা আছে। অর্থাৎ প্রদেশটাকে আরো নিঃস্ব করে তোলা হয়েছে। বেশ কিছু খাত দেওয়া হয়েছে, কিন্তু তাতে কী এসে যায়? উদাহরণস্বরূপ, রেলওয়েকে প্রাদেশিক তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার প্রত্যয় ব্যক্ত করা হয়েছে, যা একটা চরম ধোঁকাবাজি ছাড়া আর কিছুই না। সংবিধানে এ ব্যাপারে কী বলা আছে? সাংবিধানিক কাঠামোতে এটি প্রাদেশিক তালিকায় নয় বরং কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষকে দেওয়া হয়েছে এবং বলা হয়েছে যে কর্তৃপক্ষকেই এই সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে এটা প্রাদেশিক তালিকায় রাখা হবে কি হবে না। এটা প্রাদেশিক সরকারের আওতায় নাও থাকতে পারে। স্যার, এই হল আপনাদের প্রাদেশিক তালিকা, যাতে বেশ কিছু খাত দেখানো হয়েছে, এবং যেই খাতগুলো আমি বুঝতে পারি না। আমি বুঝি না কৃষি জমির ক্ষেত্রে সংস্থা কর (এস্টেট ডিউটি) কী হতে পারে। আমি প্রতিশীর্ষ কর (ক্যাপিটেশন ট্যাক্স) বুঝি না। লটারি, বাজি (বেটিং), জুয়া, ফিশারিজ, গুপ্তধন (ট্রেজার ট্রুভ), বিদ্যুৎ, গ্যাস ও গ্যাস বিষয়ক কর্ম, জীবিকা/বৃত্তি, পান্থশালা, সরাই-মালিক, সুরা এবং আরো কিছু খাতের উল্লেখ রয়েছে শুধু এটা প্রমাণ করার স্বার্থে যে প্রাদেশিক তালিকায় এসবের অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে স্বায়ত্তশাসন মঞ্জুর করা হয়েছে; কিন্তু প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন এর কোথাও নেই। আপনাদেরকে আগেই যেমন বলেছি, প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের শিকড়টাই তো কেটে ফেলা হয়েছে, আপনি যতই এতে পানি ঢালার চেষ্টা করুন না কেন। এভাবে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন আসবে না।
বিরোধী দলীয় নেতা হিসেবে জনাব হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দির “১৯৫৬ সালের সংবিধান/ গঠনতন্ত্র”বিষয়ে বক্তব্যের সারসংক্ষেপ
৩১ জানুয়িারি, ১৯৫৬
স্যার, পত্রপত্রিকায় আমরা যে বিরোধী দলের কথা শুনেছি এবং এই হাউসের/ সংসদের আওতায় যাদের স্বপক্ষে মতপ্রকাশ করেছি, সেটি কি নেহায়েত কাগজে-কলমে একটি বিরোধী দল, নাকি এটি সত্যিই জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার উপর প্রতিষ্ঠিত, তা স্বচক্ষে যাচাই করতে সম্প্রতি আমি পূর্ব বাংলায় গিয়েছিলাম। স্যার, আমি নির্দ্বিধায় ঘোষণা করতে পারি যে, বাংলার মানুষেরা চরমভাবে বিক্ষুব্ধ।
পূর্ব বাংলার জনগণের এখানকার মন্ত্রিপরিষদ বা তাদের দ্বারা প্রণীত গঠনতন্ত্রের উপরে বিন্দুমাত্র আস্থা নেই এবং তারা আশা করে যে তাদের কল্যাণ ও উন্নয়নের জন্য গঠনতন্ত্রে পর্যাপ্ত সুযোগ/ বন্দোবস্ত থাকা উচিত এবং এই ব্যাপারটি মন্ত্রিপরিষদের প্রশাসন বা অপপ্রশাসনের হাতে ছেড়ে দেওয়া উচিত নয়।
সেখানে জনমনের অনুভূতির তীব্রতা এই ধরণের যে সেখানকার মন্ত্রিপরিষদ এই চাপ সহ্য করতে পারবে কিনা এটা বলা মুশকিল, যেমনটা দেখা গেছে যে ইতোমধ্যেই মন্ত্রিপরিষদ সাংবিধানিক প্রস্তাব পেশ করার লক্ষ্যে আইনসভার অধিবেশন ডাকতে দ্বিধা করেছে; তাদের উপরে জনগণের আস্থা যাচাইয়ের পরীক্ষায় নামতে দ্বিধা করেছে। আমি একমাত্র একটি উদ্দেশ্যেই তা করতে চাই। মন্ত্রিসভাকে অবশ্যই পাকিস্তানের স্থিতিশীলতা ও অখণ্ডতার রক্ষণ ও উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হবে। আমি এবং আমার দল বিশ্বাস করি যে পাকিস্তানের ভিতরে বসবাসকারী আমরা সকল নাগরিক ও প্রজা মিলেই একটি জাতি যার নাম পাকিস্তানী জাতি; আমরা যেকোন প্রদেশ অথবা এলাকা থেকেই এসে থাকি না কেন, আমাদের উৎপত্তি, জাত, বর্ণ, গোত্র, ধর্ম, মতবাদ নির্বিশেষে আমরা সবাই এক পাকিস্তানী জাতি। আমার চেতনায়, আমরা সবাই মিলে একটি দেশের একটি জাতি। স্যার, একজন পাকিস্তানী হিসেবে, আমি কোনদিন পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে বিভাজন হবে, এটা কল্পনাও করতে পারি না। আমি এমনকি বিভাজন ধারণাটির কথাই চিন্তা করতে পারি না।আমাদেরকে একসাথে বসবাস করতে হবে…পাকিস্তানের কোন অংশই অন্য অংশটি ছাড়া অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারবে না,- এই বোধই আমাদেরকে একতাবদ্ধ রাখার মূল সূত্র। আমরা হাজারটা উপায়ে পরস্পরের উপর নির্ভরশীল; সুতরাং কোনো একটা অংশের কারো ক্ষেত্রে এরকম ঘোষণা দেওয়াটা জড়বুদ্ধির পরিচায়ক হবে যে, “ঠিক আছে, অন্য অংশের সহযোগিতা ও নির্ভরতা বাদ দিয়ে অন্য কোনোভাবে আমাদের ভাগ্য সন্ধান করে দেখা যাক।” আমি মনে করি, উভয় অংশের জন্যই এই উপলব্ধিটা জাগ্রত হওয়া প্রয়োজন। পশ্চিম পাকিস্তান পূর্ব পাকিস্তান ও পাকিস্তানের মঙ্গলের জন্য যতটা আন্তরিক, আমি মনে করি, পূর্ব পাকিস্তানও পশ্চিম পাকিস্তান ও সমগ্র পাকিস্তানের উন্নতি নিয়ে ততটাই আগ্রহী। কিন্তু আপনি আসলেই যদি একটি পারস্পরিক সমঝোতাপূর্ণ উপলব্ধিতে পৌঁছানোর ঐকান্তিক আগ্রহ পোষণ করেন, যা পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের সরকারের জন্য অপরিহার্য, আমাদের অবশ্যই পরস্পরের সাথে বাদবিসংবাদ বাদ দিয়ে যত দ্রুত সম্ভব একত্র হতে হবে, এমনকি এই সংসদের মাধ্যমে হলেও। এটা অনস্বীকার্য যে, পাকিস্তানের এই অংশে (পশ্চিম পাকিস্তান) উন্নয়নের তুলনায় পূর্ব বাংলায় উল্লেখ করার মত কোনো উন্নয়নই ঘটেনি। আমরা এ দেশের মঙ্গল কামনা করি। আমরা সুখী যে এই দেশটা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সর্বোপরি সমগ্র পাকিস্তানই শক্তিশালী ও সুসংহত হচ্ছে। পাকিস্তানের উভয় অংশে সমানতালে উন্নয়ন হওয়াই যুক্তিসংগত। যদি এর একটা অংশই শুধু উন্নত হয় ও অন্য অংশটি অনুন্নত রয়ে যায়, তাহলে নিশ্চিতভাবেই পাকিস্তান দুর্বলতর হবে। এটাও সত্যি যে পূর্ব বাংলার নাগরিকদেরও এগিয়ে আসার এবং আপনাদের কাছে সুবিবেচনা দাবি করার অধিকার আছে। অবশ্যই তাদের এগিয়ে এসে বলার অধিকার রয়েছে যে এতগুলো বছর ধরে বিভিন্নভাবে পূর্ব বাংলাকে শুধু আরো দরিদ্রই করে তোলা হয়েছে। আমি পরিসংখ্যানের ভেলকিতে আগ্রহী নই। আমাদের সামনের এই ব্যাপারগুলো সত্য। এগুলো ঘটছে। দেশের এই প্রান্তে (পূর্ব বাংলা) উন্নয়ন বলতে প্রায় কিছুই হয়নি। একটি পাটকল বা কাগজকল স্থাপন করেই আপনারা মনে করছেন যে তা দেশের এই অংশের উন্নয়নের জন্য যথেষ্ট। অথচ এখানে ৪ কোটি মানুষ নিরন্তর ঝড়বন্যার মধ্যে দিনাতিপাত করে এবং তাদের জীবিকা এতটাই নাজুক যে (নিত্যপণ্যের) সামান্যতম মূল্যবৃদ্ধিও তাদেরকে অনাহারের মুখে ঠেলে দেয়। মনে রাখবেন যে ব্রিটিশ সরকার ভারত থেকে একটা টুকরাও ভারত শাসনের সুবিধার্থে নিয়ে যায়নি। তারা এই উদ্দেশ্যে এখান থেকে কিছুই ইংল্যান্ডে নিয়ে যায়নি এবং এখান থেকে যে টাকাটা গিয়েছে তা এখানকার ব্যবসাবাণিজ্যের মুনাফা হিসেবে গিয়েছে। আমরা কি ভুলে গিয়েছি যে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে আমাদের অভিযোগের প্রধান দফাই ছিল এই যে ভারত থেকে ইংল্যাণ্ডে অর্থ পাচার হতে থাকার কারণে আমাদের দেশটা নিঃস্ব হয়ে পড়ছিল। আর দুর্ভাগ্যজনকভাবে ঠিক এই ব্যাপারটিই আজ পূর্ব পাকিস্তানে ঘটছে। সেখান থেকে অর্থ পাচার হয়ে যাচ্ছে এবং সেই ঘাটতি আর পূরণ হচ্ছে না; ফলে সেখানে আমাদের জনগণ দরিদ্র থেকে দরিদ্রতর হয়ে পড়ছে
…স্যার, পূর্ব বাংলার সম্পদসমূহ দেশের এই প্রান্তের (পশ্চিম পাকিস্তানে) স্বার্থে ব্যবহৃত হচ্ছে অথচ এর পাশাপাশি পূর্ব বাংলায়ও উন্নয়ন কার্যক্রম এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যেত। পূর্ব বাংলা নদীমেখলা ভূখণ্ড। এখানে (উন্নয়নের স্বার্থে) বেশ কিছু খাল কাটা হয়েছে কিন্তু আমাদের রয়েছে প্রাকৃতিক নদীসমূহ।
আর কী অবস্থা সেই নদীসমূহের আজ? পলি জমে ভরাট হয়ে যাওয়া নদী ও খালগুলো নিষ্কাশনের ব্যবস্থা কি নেওয়া যেত না? আজ পূর্ব বাংলার অবস্থা খুবই সঙ্গীন এবং আমি অত্যন্ত শংকিত।
………… এবং, সবকিছুর পরেও আমরা কি এটি অস্বীকার করতে পারি যে আমরা বিভিন্ন বিদেশী সংস্থা থেকে যথেষ্ট সহায়তা পেয়েছি, এবং আমরা সেসব বিদেশী সাহায্য নিচ্ছি এবং আমরা এটাও অস্বীকার করতে পারি না যে এর খুব সামান্য অংশই পূর্ব পাকিস্তানে ব্যয় করা হচ্ছে।
যদি এটি বিদেশী সহায়তা হয়ে থাকে তবে উভয় অংশেরই এর সুবিধা ভোগ করার অধিকার রয়েছে। এছাড়াও জনাব, এক্ষেত্রে অন্য একটি ব্যপার পূর্ব বাংলার জনগণের মনে রয়েছে এবং তা হল প্রতিরক্ষা প্রশ্ন এবং এর ভিত্তি। জনাব, আমি কোশলের প্রশ্নে যাচ্ছি না; কিন্তু ব্যাপারটা হল সেনাবাহিনীর দেখাশোনা করা উচিত। কিন্তু আমি চাই পূর্ব বাংলার জনগণকে প্রশিক্ষণ দিয়ে আগের মত একটি শক্তিশালী সেনাবাহিনী গঠন করতে। বাংলা রেজিমেন্টই অন্যান্য রেজিমেন্টের আগে তাদের খ্যাতি তৈরি করেছিল, অনেকটা মাদ্রাস রেজিমেন্টের মত একই সময়ে নিজদের পরিচয় তৈরি করেছিল। তাই এখানে কিছু একটা করতে হবে; সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষণে মনোযোগ দিতে হবে এবং আপনারা সৈনিক তৈরি করবেন কি করবেন না, পূর্ব বাংলা তার শত্রুদের বিরুদ্ধে রক্ষিত হবে কি হবে না, পশ্চিম পাকিস্তান শুধুমাত্র নিজেদেরকেই রক্ষা করবে কি না, এসব ব্যাপারে আমি মাথা ঘামাতে চাই না কিন্তু এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত যে প্রতিটি দেশপ্রেমিক নাগরিক চায় নিজ দেশরক্ষায় নিয়োজিত থাকতে।
………… কেননা পূর্ব বাংলা এসব অনুন্নয়ন মেনে নেওয়ার মত কোন অনগ্রসর এলাকা নয়, বলা যায়, জনগন এগিয়ে আসছে না এবং এখানে এখনো এমন কিছু নেয় যেন মনে হয় জনগন এখনো আদিম অথবা তেমন কিছু একটা। এই মতামতের আসলেই সেখানে কোন প্রাসঙ্গিক যৌক্তিকতা নেয়।
……………… আমরা এবার এই প্রদেশের সংবিধানের দিকে নজর দেই। এটি কি সত্যি ধারা ১৯৩৫ এর পরিবর্ধন? যেকোন ক্ষেত্রেই আমি খুব সামান্যই তা দেখতে পাই। সবকিছু আগে যেখানে ছিল এখনো সেখানেই আছে; ক্ষমতা এখানে এখনো যেমনটা আগে ছিল। আপনি হয়ত বলতে পারেন যুক্তরাষ্ট্রীয় সংবিধান, যেহেতু এটি আগে যুক্তরাষ্ট্রীয় ছিল না। কিন্তু একই তালিকার অস্তিত্ব রয়েছে; হয়ত এর সামান্য কিছু পরিবর্তন হয়েছে কিন্তু একই তালিকা ১, তালিকা ২ এবং তালিকা ৩ রয়েছে। এই মুহূর্তে যখন ভারত ঐক্যমূল সরকার গঠন করেছে তখনও এখানে সেই একই তালিকা ১, তালিকা ২ এবং তালিকা ৩ বর্তমান এবং তাহলে ভারত সরকারের আইনের সাথে আপনারা কিভাবে পার্থক্য দেখাবেন। আপনি হয়ত বলতে পারেন ক্ষমতার শেষ অবশিষ্টাংশ সংবিধানের ধারা অনুযায়ী প্রদেশগুলোকে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ক্ষমতার সেই অবশিষ্টাংশগুলো কি? ওগুলোর কি আদৌ কোন অস্তিত্ব রয়েছে?…… জনাব, যেখানে আপনি সবসময় ধারা ১৯৩৫ এর মতবিরোধ করেছেন, যা সবসময় গনতন্ত্র এবং দেশের স্বার্থ বিরোধী ছিল। আমি এখন শুধুমাত্র কয়েকটি দৃষ্টান্ত দেখাবো এবং তারপর আপনার কাছে জবাব চাইব কেন আপনি আপনার উন্নত চিন্তাধারা দিয়ে সবকিছু সঠিক করার প্রয়াস চালাননি?
রাষ্ট্রপতির ক্ষমতায়নের ঘটনাটাই দেখুন…… আপনি রাষ্ট্রপতিকে ব্রিটিশ সার্বভৌমত্ব ত্যাগ করার পর ক্ষমতা অর্পণ করেছিলেন। ব্রিটিশ সার্বভৌমত্বের রয়েছে সর্বোচ্চ ক্ষমতা, কিন্তু ব্রিটেনে একটি প্রচলন রয়েছে, সেই প্রচলনকে ভাঙ্গার সামর্থ্য কোন সার্বভৌমত্বের ছিল না, এটি একটি অলিখিত নীতি এবং সার্বভৌমত্বের ক্ষমতাও এখানে অলিখিত। যত দ্রুতই এটি আপনার খাতায় লিখুন না কেন, যত দ্রুতই এটি সংবিধানে যুক্ত করেন না কেন, এটি যতই ন্যায়সঙ্গত হোক না কেন, এই নীতিকে পরিত্যাগ করা হবে।
আপনি আইনত এই নীতি বাস্তবায়নের জন্য কখনোই তাদের উপর ভরসা করতে পারবেন না; আপনাকে অবশ্যই বিশৃঙ্খলা, উত্তেজনা এবং বিপ্লবের মধ্য দিয়ে যেতে হবে এবং আমি অবশ্যই এই প্রক্রিয়াসমূহের মধ্যে দিয়ে যেতে ইচ্ছুক নই। তাই সবচেয়ে ভালো হয় আপনি আর কখনোই ব্রিটিশ সার্বভৌমত্বে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা নিয়ে কোন কথা বলবেন না, অথবা আপনি যদি কখনো এটি নিয়ে কথা বলেও থাকেন সেক্ষেত্রে আপনি সেসব নীতিগুলোর ব্যাখ্যা দিবেন যেসব দ্বারা ঐ ক্ষমতাকে সীমাবদ্ধ করে রাখা হয়। জনাব, তাই এক্ষেত্রে আমার মনে হয় যখন মন্ত্রিসভা রাষ্ট্রের প্রতি আস্থা হারিয়েছে তখন রাষ্ট্রপতি নিজ ক্ষমতা বলে জাতীয় পরিষদের সাধারণ সমাবেশ ভেঙ্গে দিয়েছেন। আমার কাছে জনাব, এই পুরো ব্যাপারটি এতটাই হাস্যকর যে হয় সরকার এটি প্রত্যাহার করে নিবে, নয়তো অন্য কোন কিছুটা যুক্তিসংগত কিছু যুক্ত করবে। গণতান্ত্রিক সংবিধানে রাষ্ট্রপতির উপর রাষ্ট্রের প্রতি আপনার বিশ্বাস হারানোর সম্ভাব্যতার বিচার ছেড়ে দেয়া যায়। হাঁ, যদি তিনি মনে করেন বর্তমান মন্ত্রিসভা যে বিচারব্যবস্থার অধীনে রয়েছে তার উপর যদি মন্ত্রিসভার আস্থা না থাকে সেক্ষেত্রে কিছু ক্ষমতার দাবি উত্থাপন করা যেতে পারে যার মাধ্যমে ০১১ ধারা অনুযায়ী মন্ত্রিসভা ভেঙ্গে দেয়া যায় কেননা অন্যান্য ভিন্ন ব্যপারেও তারা জনগনের আস্থা ভঙ্গ করেছে।জনাব, রাষ্ট্রপতিকে একটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ক্ষমতা দেয়া হয়েছে যার মাধ্যমে তিনি সম্পূর্ণ সংবিধান পরিবর্তন বা বাতিল করে দিতে পারেন, যেমন প্রয়োজনে তিনি জরুরী অবস্থা ঘোষণা করতে পারেন। যেকোন জরুরী অবস্থা ঘোষণা করার সবরকম ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির উপর ন্যস্ত।
… অতঃপর,মহাশয়,আমরা এই সংবিধানে আরেকটি বিধান যুক্ত করি,উদাহরনস্বরূপ;মৌলিক অধিকারসমূহ।কেনো এই মৌলিক অধিকারসমূহ সংবিধানে পুরোপুরি সরিয়ে রাখা হয়েছে,যদি শর্তগুলি জরুরি সংযুক্তি হত।কিন্তু এই সকল মৌলিক অধিকার যদি শর্তাদি দ্বারা আবদ্ধ হয়ে যায়,বেষ্টিত হয়ে যায় এই পরিস্থিতি দ্বারা,এবং চলতেই থাকে,তাহলে এই মৌলিক অধিকারসমূহের কি প্রয়োজনীয়তা?আপনি ভারতীয় সংবিধান থেকে এটা উদ্ধৃত করেছেন…
মাননীয় মহাশয় ই. ই. চুন্দ্রিগরঃ আমি ইহা অন্য আরেকটি দলিল থেকে উদ্ধৃত করেছি।
এইচ. এস. সোহওয়ার্দী মহাশয়;হয়ত অন্য কোনো দলিল,কিন্তু,ভারতীয় সংবিধানও তাহলে অন্য কোনো দলিল থেকে ধার করেছে,আর তাই তার ধরণ ও উৎস একই,কিন্তু আমার বিশাল সংশয় আছে যে,মাননীয় সদস্য এই সকল মৌলিক অধিকার যে সংবিধান থেকে উদ্ধৃত করেছেন তাতে এই সকল শর্ত ও প্রতিবন্ধকতার সন্নিবেশ আছে কিনা।আমি ইহা ভারতীয় সংবিধানের সাথে তুলনা করেছি।তখনকার সংবিধানে কিছু নির্দিষ্ট শর্ত ও বাধা ছিলো কিন্তু এটা খুবই জরুরি শব্দ,উদাহরণস্বরূপ; “যুক্তিসঙ্গত”।সেখানে যুক্তিসঙ্গত বাধা ছিলো এবং যেইমাত্র শব্দটা ভালভাবে ঢুকানো হল,যুক্তিসঙ্গত শব্দটা যেন ছেটে ফেলা হল-কেউ ততটা করতে পারে না যা অধিকার করার প্রতিশ্রুতি দিতে পারে কেননা তা আদালতে আইনের মাধ্যমে তলব করা যায়,কিন্তু সংবিধানে যদি যুক্তিযুক্ত বাধা থাকে ও “যুক্তিসঙ্গত” শব্দটি সমর্থনীয় হয়ে যায়,তৎক্ষণাৎ আদালত এই বিবৃতি দেয়ার অবস্থানে পৌঁছাবে যে-যদি আইন-সভা মৌলিক অধিকারের বিষয়ে যুক্তিসঙ্গত বাধা সরিয়ে নেয়-এটা অসাংবিধানিক কারণ তা অযৌক্তিক।সুতরাং,মহাশয়,যেই শব্দটা মৌলিক অধিকারে দিতে আপনি সমর্থ হয়েছেন তা এখানে দিয়ে আমাদের বিভ্রান্ত করবেন না দয়া করে।মৌলিক অধিকার একেবারে মূল্যহীন…
…কিন্তু আবার, মহাশয়,মৌলিক অধিকার ও নির্দেশনা নীতিমালায় আরো কিছু ফাঁক আছে যা পূরণ হওয়ার আশা রাখছি।আমি নির্দেশনা নীতিমালার অধিকারে এমনকিছু খুঁজে পাইনি যা কৃষক ও শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষা করবে এবং তাদের কে শোষণের হাত থেকে বাঁচাবে।
এটি একটি অসাধারণ প্রচেষ্টা। আমি বিশ্বাস করি, এটি মানুষের সামাজিক ও অর্থনৈতিক কল্যাণ ঘটাতে সাহায্য করবে। বাড়িওয়ালা ও ভাড়াটিয়া এবং মালিক ও শ্রমিকদের মধ্যে সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটাবে। নীতিনির্ধারণ ও মৌলিক অধিকারের ভিত্তিতে এটা পর্যাপ্ত নয়, কারণ যে সকল কৃষক শস্য উৎপাদন করে তাদেরই জমির মালিক হওয়া উচিত। এটি সাংবিধানিক ভাবেই হওয়া উচিত। অন্তত এটা সরকারের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত।
জনাব, এখন অন্যান্য সমস্যাও বেড়েছে। সেখানে সবকিছুই সংবিধানপরিপন্থী, এমনকী সামরিক প্রশিক্ষণ, পূর্ব-বাংলার জনগণের সামরিক বাহিনীতে অংশগ্রহণ এবং দেশের প্রতিরক্ষাবাহিনীর অংশগ্রহণ মূলনীতি নির্ধারণের প্রক্রিয়া পর্যন্ত। সেখানে বৈদেশিক অর্থ-সংক্রান্ত কোনো কিছু ছিল না, একই সাথে দুই দেশের উন্নয়ন এবং সমঅধিকার বিধান ছিল না। সেখানে সেবাসংক্রান্ত কোনো বিষয় ছিল না। এই সংবিধান রেখে লাভ কী তাহলে? এই সংবিধান সকল সমস্যা সমাধানের মূল এবং ১৯৩৫ সালের ভারতীয় সরকারের কিছু নির্দিষ্ট ধারানুযায়ী করা হয়েছে। আমাদের জন্য দুঃখজনক, দেশের জন্য দুঃখজনক যে এই সংবিধান আর অনুসরণ করা হচ্ছে না।
জনাব, এখন আমাদের প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের প্রসঙ্গে আসি। এই বিষয়ে চরমাবস্থায় আসতে পারেন না। একই সাথে আপনাকে বিবেচনা করতে হবে যদি পূর্ব ও পশ্চিম প্রদেশের দুই রাজনৈতিক দল একই মতৈক্যে না আসে, তাহলে আমাদের কি করা উচিত, আমি চিহ্নিত করেছি যে পশ্চিম পাকিস্তানের ক্ষমতাসীন দলসকল সুযোগসুবিধা ভোগ করতে চায়।
বার বার তারা তাদের সমতার কথা সংবিধান থেকে তুলে নিয়েছে, তারা এটা নির্দিষ্ট করছে যে, জাতীয় সংসদে সদস্যসংখ্যা বৃদ্ধি পেলেও এই সমতা ঠিক থাকবে। আমি দুঃখের সাথে জানাচ্ছি যে, তাদের এই সমতাসহ সবকিছু তাদের দ্বারাই প্রত্যাখিত হয়েছে। আমি বলছি যে আঞ্চলিক স্বায়িত্তশাসন সংযোজিত না থাকলে বাংলাদেশি জনগণ এই সমতা গ্রহণ করতো না।
এটাই তাদের উদ্দেশ্য ছিল। কোনো দলের একটি অংশের উচিত নয় অন্য দলের অন্য কোনো অংশের উপর কর্তৃত্ব করা। সব কিছুই চুক্তি এবং একটি লেনদেনের প্রক্রিয়ার মাধ্যমে হওয়া উচিত, জোর করে নয়। আর এজন্যেই তাদের সমতা রক্ষা করা উচিত। জাতি ও গোষ্ঠী হিসেবে পশ্চিমারা পূর্ব জাতি ও গোষ্ঠীকে শোষিত করেছিল। আমি এখানে জাতি শব্দটি সাধারণ অর্থে ব্যবহার করেছি, পাকিস্তানি জাতি হিসেবে নয়। যেহেতু তারা দূরত্বের কারণে পৃথক সুতরাং তাদের অবশ্যই আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন আছে। এটাই সমতার মূল ভিত্তি, আর সমতার সারকথা ছিল এই যে বাঙালি যা বলতে চেয়েছিল তা একত্রে বলা উচিত ছিল আর এই জন্যে আমাদের সংযোজিত নির্বাচকমণ্ডলী থাকা উচিত।
প্রধানমন্ত্রী জনাব মো. আলীর বক্তব্যের অংশবিশেষ, সংবিধানের ৪র্থ খসড়া, ফেব্রুয়ারি ১, ১৯৫৬।
জনাব পাকিস্তান উপমহাদেশের মুসলমান সংগ্রামের মাধ্যমে একটি স্বদেশ জয় করতে চায় যাতে তারা নিজস্ব উপায়ে বেঁচে থাকতে এবং নিজেদের সংস্কৃতি গড়ে তুলতে পারে।
সোহরাওয়ার্দি: আমরা সহমত।
মহামান্য জনাব মোহাম্মদ আলী: এই যুদ্ধ উপমহাদেশের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ উত্তর-দক্ষিণ এবং উত্তর-পশ্চিম পাকিস্তানের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর সম্পর্কে চরম অবনতি ঘটাবে। এজন্যেই মূলত পাকিস্তানের অস্তিত্ব প্রতিষ্ঠার জন্যে আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে। এটাই কয়েদ-ই-আজমের বক্তব্য হতে পারে।
পাকিস্তান সৃষ্টির জন্যে আমরা গত ১০ বছর অনাহারে অভুক্ত অবস্থায় আল্লাহ’র কৃপায় বেঁচেছিলাম, যা আজ নিষ্পত্তির পথে (এটি ছিল ১৯৪৭ সালের অক্টোবর মাস) “আমাদের দেশ সৃষ্টির পেছনে মূল উদ্দেশ্য ছিল যে আমরা সেখানে স্বাধীনভাবে এবং আমাদের মতো করে ঐতিহ্যগতভাবে বাঁচতে পারবো এবং সেখানে ইসলামের মৌলিক সামাজিক বিষয়গুলো স্বাধীন থাকবে।”
সোহরাওয়ার্দি: একদম ঠিক, আমি আপনার সাথে একমত।
জনাব মোহাম্মদ আলী: এটাই ছিল পাকিস্তান সৃষ্টির মূল কারণ। এবং দেশের ঐতিহ্য, এবং সম্ভাবনাময় পরিবেশে, ইসলামের চেতনায় বতর্মান জাতি গঠন করা। এটাই ছিল পাকিস্তানের অস্তিত্বরক্ষার মূল হাতিয়ার। এই স্বধীনতা এবং বিবেক সুরক্ষিত রাখতে অবশ্যই বাধাকে অতিক্রম করতে হবে। কেউই অজ্ঞাত কাউকে সম্মান করে না। প্রত্যেক গাছই তার বীজ থেকে সৃষ্টি হয় এবং সেখান থেকে ফুল হয়। এটা মূলত শুরুতে একটি ছোট বীজ থেকে সৃষ্টি হয় যা পরে শাখা-প্রশাখা বিস্তারের মাধ্যমে, সময়ের সাথে বিরাট গাছে পরিণত হয়। গাছটা ফল দিয়ে মানুষের উপকার করে এবং মানুষ এইজন্যে গাছকে মূল্যায়ন করে। জনাব- আমরা বহু বছর ধরেই ঠিক একই ভাবে ইসলামিক চেতনা ও ঐতিহ্যধারণ করে আসছি। পাকিস্তানের মুসলিমরা নিজেদের জন্যেই স্বাধীনতা চেয়েছিল, তারা পাকিস্তানে বসবাসরত অন্য গোষ্ঠিদের অবজ্ঞা করতে চাইত না। আমাদের বিশ্বাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হল: অমুসলিমরা এখানে সমঅধিকার এবং সম্মান নিয়ে পাকিস্তানের নাগরিক হিসেবে যার যার ধর্মপালনে স্বাধীনতা ভোগ করবে। এটাই পাকিস্তান সৃষ্টির মৌলিক অবকাঠামো।
এবং কিভাবে আমরা পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানকে একত্রিত করবো যেখানে ১৫৫০ মাইলের ব্যবধান বিদ্যমান? কিভাবে আমরা আমাদের ভৌগলিক ত্রুটিগুলোকে দূর করবো? এটা মূলতঃ একমাত্র ইসলামিক চেতনার কল্যাণেই সম্ভব ও সেটা মূলতঃ দু’টি দেশকে একসাথে থাকতে এবং কাজ করতে সাহায্য করবে। বিরোধী দলীয় প্রধান যেটাকে ইস্যু হিসেবে নিয়েছিল সেটাকে আমি আন্তরিকভাবে অনুমোদন দিয়েছি। তাদের এই বিষয় থেকে সরে আসতে কোন প্রশ্ন ছিল না। যদিও তারা এর মর্মার্থ অনুধাবন করতে পারেনি। জনাব সোহরাওয়ার্দি তাদের ক্ষমা করেছিলেন যারা এটাকে ‘ইন্টেলেকচুয়াল এক্সারসাইজ’ হিসেবে নিয়েছিল। আমি আশা করি, এই সকল বুদ্ধিজীবীদের মাধ্যমে বিকৃত কোনো কিছু গণমনে ছড়াবে না। এবং তারা নানাবিধ বুদ্ধিদীপ্ত কাজ করবে এবং নিশ্চিতভাবে তারা রাজ্যের জন্যে ক্ষতিকর কিছুই করবে না। এবং আমার যে সকল বন্ধু বেপরোয়াভাবে জাতীয় বিষয়ে কথা বলে তারা মূলতঃ ভুল পথেই আছে। আমি তাদেরকে সবিনয়ে অনুরোধ করবো নিজেকদের সংশোধন করতে।
আমরা এখনো গঠনমূলক পর্যায়ে আছি,এবং যদিও পাকিস্তান জাতীয়তাবাদের ধারণা,একটি দেশ ও একটি জাতির যৌথ সংস্কৃতির উজ্জ্বল, দ্যুতিময় ধারণা,তবে অন্য সবকিছুর মতো এটার মাঝেও কিছু খুঁত আছে। অন্ধকারময় খুঁত,যেটার মাধ্যমে ভাঙ্গনের বীজ মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে পারে।এই খুঁতগুলোকে টিকে থাকতে সহায়তা করে এমন কোনো কাজ যাতে স্বদেশপ্রেমী মানুষ না করে। অসাবধানতায়, বা অন্য কারণে বে,কোনো ধরণের সাহায্য করা থেকে তিনি যেন বিরত থাকেন,যার প্রবনতা আমাদের রাষ্ট্রে বিদ্যমান।শেষবারের মত,আমরা আমাদের মতগঠন করি এবং সম্পূর্ণ পরিষ্কার হই যে,পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান একই;তাদের সম্পূর্ণ স্বতন্ত্রভাবে সংযুক্ত করা উচিত।এভাবেই আমাদের টিকে থাকা সম্ভব।আমাদের জাতি যেই স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করেছে তা আমাদের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ।আমি মানি যে,স্বাধীনতা অর্জনের জন্য আমাদের জাতি ভীষণ ত্যাগ স্বীকার করেছে এবং তারা এখনো সেই ত্যাগ স্বীকার করে যাচ্ছে।(আমি এই ব্যাপারে পরে আসছি)। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে,কোনো ভুল বোঝাবোঝি ঘটানোর প্রয়াস,এদের মাঝে কোনো খাঁদ তৈরি হওয়া,স্বাধীনতাকে বিপর্যস্ত করে,কারন এটা রাষ্ট্রের অখণ্ডতাকে বিপর্যস্ত করে।অন্যভাবে বলতে গেলে আমাদের সংস্কৃতির উন্নতি সাধনের এই স্বাধীনতা,এমন একটি পরিবেশ থাকা যা ইসলামিক চেতনাকে উন্নীত করবে তা জীবনহীন হয়ে পড়বে এবং পরিসমাপ্তি ঘটবে;সুতরাং অবিরাম আমাদের নিজেদেরকে এটা স্মরণ করাতে হবে।আমরা একে অপরকে ছাড়া টিকে থাকতে পারব না।অনেকেই হয়ত মনে করে থাকবেন যে দেশভাগের সময় অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেছিলেন যে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের যৌথ সংস্থান-ও একটি টেকসই অর্থনীতিসমৃদ্ধ স্থিতিশীল রাষ্ট্র গড়তে যথেষ্ট নয়।এই হতাশাবাদী ভবিষ্যদ্বক্তারা দাবি ও ভবিষ্যৎবাণী করেছিলেন যে পাকিস্তান কয়েক মাসের মধ্যে ভেঙ্গে যাবে ও এর ইতি ঘটবে।এই ভবিষ্যৎবাণী পূর্ব ও পশ্চিম উভয় পাকিস্তানকে নিয়ে ছিলো।তারা ভেবেছিলেন পাকিস্তান নিজেকে রক্ষা করতে সক্ষম হবে না এবং যদি কোনভাবে সক্ষম-ও হয়,এটা সমাপ্তির প্রতি কিছু উৎসাহশূন্য চেষ্টা হবে কেননা উন্নতির জন্য আর কোনো সম্পদ বাকি থাকবে না।এটা ছিল সেই সময়ে কিছু বিশিষ্ট বিশেষজ্ঞের দেয়া পূর্বাভাস।এই পূর্বাভাস মিথ্যা প্রতিপন্ন হয়েছে এবং পাকিস্তান এখানে-শক্তিশালী ও উন্নতিশীল।এতা সম্ভব হয়েছে কারন পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের সম্পদ সবরকম ভাবে একত্রে ব্যবহারযোগ্য।একা পূর্ব বা পশ্চিম পাকিস্তান কেউ-ই টিকে থাকার আশা করতে পারে না।আমরা আমাদের স্বাধীনতাকে রক্ষা করতে একত্রে ভীষণ ত্যাগ স্বীকার করেছি।আমি একটা উদাহরণ দেই।আমাদের রাজস্বের বিশাল অংশ প্রতিরক্ষা বাহিনীর রক্ষনাবেক্ষণে চলে যায় কেননা এটা আমাদের স্বাধীনতা রক্ষা ও তা অক্ষুণ্ণ রাখতে প্রয়োজন।রাষ্ট্রের নিরাপত্তাই রাষ্ট্রের সর্বপ্রথম জায়গা দখল করে আছে।প্রতিরক্ষা ব্যয় রাষ্ট্রের অলাভজনক ব্যয়,এটা দেশের রাজস্বের থেকে একটি বড় অংশ নিয়ে যায় কিন্তু কিছুই ফেরত দেয় না।এবং মুল্যবান সম্পদ,যা দেশের উন্নতি সাধনে এবং জীবনযাপনের মান উন্নয়নে ব্যবহার করা যেত,তা বছরের পর বছর প্রতিরক্ষার জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে,যাতে আমাদের স্বাধীনতা ও নাগরিক অধিকার অক্ষুণ্ণ থাকে।আমি স্মরণ করছি মৃত মাননীয় লিয়াকত আলী খান বলেছিলেন যে দেশের নিরাপত্তা বিপন্ন হওয়ার থেকে দেশের মানুষকে বস্ত্রহীন ও ক্ষুধার্ত দেখবেন।এটাই দেশের মানুষের উদ্দীপনা এবং আমরা তাতে অবৈধ হস্তক্ষেপ না করি।আমরা একে কোনভাবে দুর্বল না করি। আমরা কোনভাবেই আমাদের ইচ্ছার ভিত দুর্বল না করি এবং ঐক্যের সাথে টিকে থাকি ও শক্তিশালী হই ও উন্নতিসাধন করি…..
দেশভাগের সময় পাকিস্তান একটি গরীব দেশ ছিল,কাঁচামাল তৈরি করতো,অনেক ছোট শিল্পকারখানা এবং ব্যবসায়ের উপর তেমন নিয়ন্ত্রণ এবং প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিকভাবে পুরোপুরি উন্নত ছিল না।এটা এখনো একটি গরীব,অনুন্নত দেশ যার বার্ষিক আয় বিশ্বের সর্বনিম্ন আয়ের দেশগুলোর একটি।এবং এটা পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান উভয়ের ক্ষেত্রে সত্যি। আমাদের অনেক দীর্ঘ পথ পারি দিতে হবে। আমাদের জাতির জীবনযাত্রার মান যতটা উন্নত করতে পারলে আধুনিক বিশ্বে পর্যাপ্ত উচ্চতায় আমরা গণ্য হতে পারি, ততটা।
পাকিস্তান সৃষ্টির প্রতি যে মনোভাব জেগে উঠেছিল তা হল উত্তর-পূর্ব ও উত্তর-পশ্চিম এর মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল, অর্থাৎ উভয় পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান, ভারতের বাকি অংশ থেকে অনেক বেশি অনুন্নত ছিল। এইসব এলাকায় খুব অল্প পরিমাণে শিল্পায়ন হত, খুব কম অর্থনৈতিক উন্নতি হত। এবং আমাকে যদি পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে তুলনা করতে বলা হত,তাহলে পূর্ব পাকিস্তানের অনুন্নত ছিল আরও বেশি।উন্নত দেশগুলোর সাথে তুলনা করলে, আমরা বলতে পারি যে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান উভয়-ই এখনো প্রাইমারি স্কুলের পর্যায়ে আছে,কিন্তু সেখানেও পশ্চিম পাকিস্তান দ্বিতীয় শ্রেণীতে থাকলে পূর্ব পাকিস্তান ছিলো মাত্র প্রথম শ্রেণীতে।এটা ছিল দেশভাগের সময়কার অবস্থা।পূর্ব পাকিস্তানে যোগাযোগের সকল উপায় কলকাতায় গিয়ে মিলিত হত।সংস্কৃতি,ব্যবসায় এবং শিল্প সবকিছুর কেন্দ্রবিন্দু ছিল কলকাতাকেন্দ্রিক।পূর্ব পাকিস্তান কিছুই ছিল না শুধু কাঁচামাল উৎপাদক ছাড়া,প্রধানত পাটের যার কোনো স্তূপ করার গুদাম ছিল না,কেবল কলকাতাতে পাট পার করে দেয়া হত,এখানে ছিল ২০০ বছরের অবহেলা।১০০ বছর ধরে একটা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ব্যবসায়িক লাভের জন্য সম্পদ শোষণ করে গেছে।পরে,আমার খুঁটিনাটিতে যাওয়ার প্রয়োজন নেই,কিন্তু যারাই হান্টার-এর “দি মুসালমানস অফ ইন্ডিয়া” বইটি পড়েছেন,পূর্ববঙ্গের মুসলিমদের অবস্থা ভাল করেই জানেন।সাংস্কৃতিক,অর্থনৈতিক এবং সবরকম ভাবেই তারা প্রচণ্ডভাবে অনুন্নত।দেশভাগের সাথে,কলকাতা ভারতে যাচ্ছে,এই অবস্থা সামনে আসে এবং যে প্রথম কাজ পাকিস্তান সরকারের সম্মুখীন হয় তা হল পূর্ব বাংলার অর্থনৈতিক স্বাধীনতা অর্জন যার অর্থনীতি সম্পূর্ণ কলকাতানির্ভর ছিল,চট্টগ্রাম বন্দর কে উন্নত করা,যোগাযোগ ব্যবস্থা পুনর্গঠন,অন্তর্দেশীয় নদীপথ যাতায়াতব্যবস্থা পরিকল্পনা ও উন্নতকরণ,পাটের গুদাম স্থাপন করা এবং আরো অনেক ছোট ও বড় জিনিস,যা করতে হত শুধুমাত্র অর্থনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে।সেখানে কোনো ব্যাংকিং সুবিধা ছিল না,কোনো বানিজ্য বা শিল্প ছিল না,সব ছিল কলকাতাকেন্দ্রিক।সব নতুন করে তৈরি করতে হত।ঢাকায় একটি নতুন রাজধানী তৈরি করতে হত।প্রশাসনের ক্ষেত্রে,পূর্ববাংলার মুসলিমদের প্রতিনিধিত্ব খুব-ই দুর্বল।আমি এটাকে সর্বদা পাকিস্তানের অনেক বড় দুর্ভাগ্য হিসেবে বিবেচনা করেছি যে দেশভাগের সময়,পূর্ব পাকিস্তানের মুসলিমদের থেকে বিশাল সংখ্যায় শিক্ষিত প্রশাসক ছিল না।
মালিক মোহাম্মদ ফিরোজ খান (পশ্চিম পাকিস্তান,মুসলিম): শুধু একজন আইসিএস কর্মকর্তা।
মাননীয় মোহাম্মদ আলী: শুধু একজন আইসিএস কর্মকর্তা-আমি শুধুমাত্র পূর্ব পাকিস্তানের মুসলিমদের কথা বলছি কেননা বেশিরভাগ হিন্দু ভারত কে বেছে নিয়েছেন।তারা যদি পূর্ব পাকিস্তানে থাকতেন,তাহলে অবস্থা ভিন্ন হত।পরিস্থিতি এমন ছিল।খাদ্য অর্থনীতি খুব অনিশ্চিত অবস্থায় ছিল এবং,আমি যেমন বলেছি,সেখানে কোনো শিল্পকারখানা ছিল না এবং খুব সামান্য বাণিজ্য ছিল।এই অভাবগুলো পূরণ করার ছিল।এদের গুরুত্ব প্রথমেই ছিল কারন যোগাযোগব্যবস্থা, বন্দর,বাণিজ্য,প্রশাসনের মৌলিক কাজ না করে উন্নতিসাধন অসম্ভব ছিল।এগুলো প্রয়োজনীয় প্রারম্ভিক শর্ত,উপ-ভিত্তি যার উপর একটি অর্থনীতি গড়ে তোলা যায়।পশ্চিম পাকিস্তান,এই সকল মান-এ বেশি উন্নত ছিল।সত্যি,সেই বিশাল বিশৃঙ্খল-এ এর ভূমিকা ছিল যা লাখো মানুষকে দেশান্তর গমনে বাধ্য করেছে এবং কিছু মাসের জন্য,পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনীতি ব্যহত হয়েছে,কিন্তু হিন্দুদের অভিপ্রয়াণে যে শুন্যস্থান তৈরি হয়েছিল তা খুব দ্রুত পূরণ করেছে সেসব শরণার্থীরা যারা ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এসেছে জ্ঞান,কর্মদক্ষতা,ব্যবসায়িক যোগাযোগ এবং মূলধন নিয়ে।পশ্চিম পাকিস্তান কোনো রাজধানীর ক্ষতি ভোগ করেনি।ভারতের সাথে খালের পানি নিয়ে দ্বন্দ্ব পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য সমস্যা তৈরি করেছে,এবং খুব বিশাল ব্যয়সাধন করতে হবে-উন্নতিসাধনের জন্য না যা ভুলবশত বলা হয়েছে কিন্তু দেশভাগের সময় যে স্থিতিবস্থা ছিল তা সংরক্ষনের জন্য।
প্রশাসনিক সেবার ক্ষেত্রে প্রকৌশলী প্রযুক্তিবিদ এবং অন্যান্যদের মধ্যে পশ্চিম পাকিস্তানে মোটের উপর বৃহৎ সংখ্যক মুসলিম ছিল এবং তাদের মধ্যে অনেকেই যারা ভারতের সংখ্যালঘু প্রদেশ হতে এসেছিল সম্ভবত আমি মনে করি যে আরো সহজে সম্প্রিইক্ত মুরগী ছিল। অতএব পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনীতি –একটি অনুন্নত অবস্থায় থাকা সত্ত্বেও এবং আমার বর্ণিত শর্ত দ্বারা ক্ষতিগ্রস্থ হওয়া স্বত্তেও একটি শক্ত অবস্থানে ছিল,এমনকি মালকন্ড জলবিদ্যুৎ প্রকল্প ,নিম্ন সিন্ধু বাঁধ প্রকল্প,রসুল জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের মত পরিকল্পনা ইতোমধ্যে অগ্রবর্তী পরিকল্পনার ধাপে পৌঁছেছে এবং এমনকি সম্পাদনে অগ্রসর হচ্ছে। ব্যাংকিং ,ব্যবসায়,শিল্প প্রভৃতিতেও বিভক্তির সময় পশ্চিম পাকিস্তান অগ্রসর রাষ্ট্র ছিল। দেশভাগের সময় পশ্চিম পাকিস্তানের করারোপণ পরিচায়ক ছিল কিছু পরিমাণে। দুইটি অর্থনৈতিক করারোপণের ক্ষেত্রে পশ্চিম পাকিস্তানের কর আদায়ে কেন্দ্রীয় এবং প্রাদেশিক ক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তানের করের তিনগুণ পার্থক্য ছিল। এই অসমতা এখনো অনেক বেশি যদিওবা তখনকার মত অত বেশি না। এগুলোই ছিল শর্ত যা কেন্দ্রীয় সরকার কতৃক পরিচালনা হয়েছিল। এটি গুরুত্বপূর্ণভাবে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে যাওয়া উচিত যেখানে প্রথম অগ্রাধিকার হলো, যেমনটি আমি বলেছিলাম পূর্ব বাংলার অর্থনৈতিক স্বাধীনতার বিজয়। চট্টগ্রাম বন্দরের উন্নতি, পাট গাঁট এর এবং উৎপাদনের ক্ষমতার উন্নতি,ইবি আর এর সংগঠনসমূহের সকল কার্যসমূহ সর্বপ্রথম হাতে নেয়া হয়। সামরিক বাহিনীর পুনঃসংগঠন কেবলমাত্র যেখানে ক্যান্টনমেন্ট,অধ্যাদেশ এবং সাপ্লাই ডিপোআছে সেখানেই সাধন সম্ভব এবং সামরিক বাহিনীর পুনঃসংগঠন রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ গুরুত্বপূর্ন বিষয় ছিল। আমাদের স্মরন করা উচিত যে আমাদের অনেক ছোটজিনিসের ইউনিট রয়েছে, সত্যি, অনেক প্রস্তুতি সমর বাহিনী বর্তমানে পরিচিত পশ্চিম পাকিস্তানে স্থাপন করা হয়েছে।এটি একটি সম্পূর্ন শতাব্দী ধরে ঘটে আসছে কৌশলগত প্রয়োজনের ফলাফল হিসেবে। পুনপঃসগঠিত সামরিক বাহিনীর জন্য সেখানে পশ্চিম পাকিস্তানে কোনো ক্যান্টনমেন্ট ছিল না, কোন সুবিধা ছিল না।যে কেউ এসব উৎপাদক বস্তুনিষ্ঠভাবে দেখবে। বস্তুনিষ্ঠতা এই সময়ে রাষ্ট্রের বিষয়সমূহের বোঝার জন্য যে কারো জন্যই গুরুত্বপূর্ণ। এটি সত্য যে পশ্চিম পাকিস্তানের উন্নয়ন পূর্ব পাকিস্তানের তুলনায় অনেক দ্রুত ছিল। কিন্তু এটি সম্পূর্ণরূপে মিথ্যা যে পূর্ব পাকিস্তান দরিদ্র এবং দেশবিভাগের সময়ের তুলনায় দরিদ্র ছিল।শেখ মুজিবর রহমান (পূর্ব বাংলাঃ মুসলিম)ঃ বেপারগুলো সেখানে।মাননীয় জনাব মোহাম্মদ আলীঃ এটি পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে একই হারে উন্নতিনা করতে পারলেও এটি উন্নতি করেছে,আমার নম্র অভিমতেঅনল্প উন্নতি।শেখ মুজিবুর রহমানঃ কোনো উন্নতি নেই।মাননীয় জনাব মোহাম্মদ আলীঃ একতি মহৎ চুক্তি করা প্রয়োজন এবং এটি করার জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। আমরা পূর্ব পাকিস্তানের উন্নতিত হার বৃদ্ধির ক্ষেত্রে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ যাতে এটি পশ্চিম পাকিস্তানের সমকক্ষ হতে পারে। এটি গুরুত্বপূর্ণ যে দেশের সকল অংশ অবিশেষে উন্নয়ন হোক।একজন সম্মানিত সদস্যঃ এটি সংবিধানে রাখুন।
মাননীয় ডেপুটি স্পিকার: দয়া করে চুপ থাকুন।
মাননীয় জনাব মোহাম্মদ আলীঃ আমি যেমন বলেছিলাম যে পূর্ব পাকিস্তানের আনিত অভিযোগ সম্পূর্ণ ভুল। কেন্দ্রীয় রাজস্বে পূর্ব পাকিস্তানের অবদান শতকরার হিসেবে পর্যায়ক্রমে নেমে আসছে তা দেখানোর জন্য কিছু সংখ্যা ব্যাবহার করা হয়েছে। এখন এটি খুব একটা হচ্ছে না। এটি উপরে যাওয়া শুরু করেছিল এবং কেন তা নিচে নেমে এল? কারণ যখন কোরিয়ার সহসা উন্নতির সময় যখন পাটের মূল্য বেড়ে যায়, পাটের শুল্ক বৃদ্ধি পেয়েছিল এবং কেন্দ্রীয় সরকারের রাজস্বের উৎসগুলো যার ফলে উন্নত হয়েছিল। যখন এই দামগুলো কমে যায় তখন পাটের শুল্ক অনেক নিচে নেমে যায়। এই হ্রাসের পিছনে এটিই মূলত দায়ী। আরেকটি অন্যতম বিষয় হল পূর্ব পাকিস্তানে উৎপাদিত সুপারির উপর শুল্ক অপসারণ করা। এইসকল পরিসংখ্যানের দিকে তাকিয়ে , যেকারো খুব সাবধানে অন্তর্নিহিত বিষয় গুলো লক্ষ্য করা উচিত। এই সভায় অনেক সংখ্যার উদ্ধৃতি দেয়া হয়েছে। আমি দুঃখের সাথে বলছি যে বেশিরভাগই ভুল ,কোনো ছোট অঙ্কে নয় বরং বৃহৎ অঙ্কে।
শেখ মুজিবুর রহমানঃ আমরা প্রমাণ করতে পারি যে এটি সঠিক।
মাননীয় ডেপুটি স্পিকারঃ আপনি তা পরে প্রমাণ করতে পারবেন।কিন্তু এখন আপনি শুনুন প্রধানমন্ত্রী কি বলেন।
শেখ মুজিবুর রহমানঃ আমরা ধৈর্য সহকারে শুনছি। আমরা জানি প্রধানমন্ত্রী বলছেন।
মাননীয় জনাব মোহাম্মদ আলীঃ আমি কি একটি জিনিস বলতে পারি? আমি কখনো সভার কোনো সদস্যকে বাধা প্রদান করি নি যতই বিরক্তি বোধ করি না কেন। এমন অনেক সময় গিয়েছে যখন আমার উপর বক্তব্য আরোপিত হয়েছে যা সম্পূর্ণ মিথ্যা। তবু,আমি কখনো হস্তক্ষেপের জন্য দাঁড়াইনি। আমি অনুরোধ করছি যাতে একই সৌজন্য আমার প্রতি দেখানো হয়।
শেখ মুজিবুর রহমানঃ জনাব, আমরা সবসময়ই সেই সৌজন্য দেখিয়েছি।
জনাব ফজলুর রহমানঃ জনাব, মিথ্যা শব্দটি শিষ্টাচার বহির্ভুত।
মাননীয় জনাব মোহাম্মদ আলীঃ ঠিক আছে, আমি বলছি অসত্য। এখন, জনাব একজনের অনুসরণ করার জন্য নীতিটি কি? সর্বপ্রথমেই দেশের জন্য অর্থনৈতিক স্বাধীনতা যেটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তার মানে ,কার্যত, যে আমাদের নিজস্ব উৎস হতে যা কিছুই আমরা উৎপাদন করব ,জীবনের মৌলিক চাহিদা পূরণে, খাদ্য ,বস্ত্র ,বাসস্থান ইত্যাদি ,আমরা নিজেরাই উৎপাদন করব। এবং আমরা অবশ্যই দেশের অর্থনীতিতে তা করব একটি একক অর্থনীতি হিসেবে, কাঁচামালের উপস্থিতিতে হোক বা অন্য কোন সুবিধা হোক, আমরা যাতে সর্বোচ্চ সুবিধা নিতে পারি এবং সর্বোচ্চ অর্থনৈতিক উন্নয়ন করতে পারি, আমরা সেটিকে সেখানেই উন্নয়ন করব সমগ্র দেশের স্বার্থে। আমরা অবশ্যই নিশ্চিত করব যে সমগ্র দেশে একই উন্নতি সাধন করতে হবে। হয়ত এখানে কিছু কাঁচামাল বিদ্যমান, ওখানে কিছু কাঁচামাল বিদ্যমান কিন্তু আমাদের অবশ্যই চেষ্টা করতে হবে যাতে আমরা এর সর্বোচ্চ সম্ভাব্য ব্যবহার করতে পারি সেটি পূর্ব কিংবা পশ্চিম পাকিস্তান দুই জায়গায়ই বিদ্যমান। এই নীতি পরিকল্পনা বোর্ডের তৈরীকৃত পরিকল্পনায় প্রতিফলিত হতে দেখা যাবে এবং যেটি খুব শীঘ্রই দেশবাসীর সামনে আনা হবে। এটি এমন কোনো বিষয় নয় যা আমি কিছু ব্যক্তিগত প্রতিশ্রুতিকে সম্পূর্ণ করার জন্য কিংবা সম্পূর্ণ না করার জন্য কিছু ভবিষ্যত অনির্দিষ্ট দিনের জন্য রেখে দিচ্ছি। গত দুই বছর ধরে পরিকল্পনা বোর্ড দেশের ও দেশের বাইরের বিশিষ্ট বিশেষজ্ঞদের সহায়তায় সমগ্র দেশের পরিকল্পনা তৈরী করার কাজে নিয়োজিত আছে। আমি জোর দিয়ে বলছি যাতে এই সকল পরিকল্পনা সমগ্র দেশে একই উন্নয়ন নিশ্চিত করে, যে তাদেরকে পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের প্রাদেশিক সরকারের সন্তুষ্টির জন্যে আলোচনায় বসার প্রস্তুতি নিতে হবে এবং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দেশের সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করা উচিৎ।
জাতীয় আর্থনৈতিক পরিষদের কাছে পরিকল্পনা প্রস্তাব করতে হবে। আমি মনে করি দলবদ্ধভাবে কাজ করাটা আমাদের একতা-সম্প্রীতি তৈরীতে জরুরি ভূমিকা রাখবে। এই সম্মেলনে কেন্দ্রীয় সরকার অপ্রাদেশিক সরকারে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীগণ উপস্থিত থেকে একত্রে কাজ করবেন। তারা অবশ্য অসম্মতও হতে পারেন, সম্ভবত অবশ্যই আসম্মতি জ্ঞাপন করবেন। কিন্তু আমার ধারণা, বিশেষ কারণে সবাই মিলে বসে তথ্য ও পরিসংখ্যান পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে কোনো সিদ্ধান্তে আসলে সেটাই দেশের জন্য সবথেকে ভালহবে। আমার নিজস্ব অভিজ্ঞতা থেকেই দেখছি, আজ যেমন আমরা পশ্চিম পাকিস্তানের ক্যাবিনেট মন্ত্রীগণ এবং পূর্ব পাকিস্তানের মন্ত্রীগণের সাথে বসে শুধু পূর্ব বা পশ্চিম পাকিস্তান না, সারাদেশের উন্নতি বিষয়ক বিভিন্ন প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা করি। আমার বিশ্বাস, এরকম উদ্যম নিয়ে কাজ করলে অবশ্যই কাংক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছানো যাবে।
আমার যদিও এই বিতর্কিত বিষয়ে জড়ানোর ইচ্ছে নেই তবুও দু’-একটি সাধারণ পরিসংখ্যান উল্লেখ করতে চাই। আগেই বলা হয়েছে যে পশ্চিম পাকিস্তানের সম্পদ জলে যাচ্ছে। এটা মোটেই ঠিক হচ্ছে না। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে কেন্দ্র কী পাচ্ছে-কেন্দ্রীয় রাজস্বে পশ্চিম পাকিস্তান মূলতঃ কেন্দ্রীয় ঋণ বাড়িয়ে দিচ্ছে। কেন্দ্রীয় সরকারের রাজস্ব ব্যয়ের ভিত্তিতে পূর্ব বাংলাকে কেন্দ্রীয় সরকার সবসময় সংকীর্ণ করে রাখত এবং মোটা অংকের লোন রাজ্য সরকারকে আগাম দিত কেন্দ্রীয় সরকার। কেন্দ্রের ব্যয়ের থেকে রসিদ অতিরিক্ত হয়।
জনাব আব্দুল মনসুর আহমেদ: প্রশ্ন।
সম্মানিত জনাব মোঃ আলী: বেশ কয়েক কোটি অতিরিক্ত। এটাই প্রথম ব্যপার। দ্বিতীয়তটি বৈদেশিক লেনদেন। এই ব্যপারে ভাবতে গেলে বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে ব্যবসাবানিজ্যের সাথে সাথে পাকিস্তানের বাকি অংশ নিয়েও ভাবতে হবে। পশ্চিম পাকিস্তান আর অন্যদেশের উৎসগুলির সম্পদের মধ্যে বিশেষ আলাদা কিছু নেই। ১৯৪৯-৫০ থেকে ১৯৫৪-৫৫ পর্যন্ত পশ্চিম পাকিস্তানের বাণিজ্যিক আয় বেড়েছে ১৩৬ কোটি আর পূর্ব পাকিস্তানের ৪০ কোটি কমেছে।
মোঃ আবুল মনসুর আহমেদ: ভুল কথা।
সম্মানিত জনাব মোঃ আলী: এই বাণিজ্যিক ঘাটতি অন্যদেশের সঙ্গে যেমন ব্যবসায় আছে তেমন অভ্যন্তরীণ ব্যবসা থেকেও হচ্ছে। কিন্তু আমদানি-রপ্তানির মোট পার্থক্যের হিসাব মূল পরিশোধের হিসাবের থেকে অনেকটা আলাদা। পরিশোধের হিসাব অন্যান্য বিষয় যেমন জাহাজযোগে প্রেরণ, বীমা, মূলধনের স্থানান্তর, সোনার গতিবিধি ইত্যাদি। এই বিষয়ে দেশের ভেতরের সঠিক পরিসংখ্যান নেই। কারণ একই অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় থাকা একটি দেশের আলাদা আলাদা অংশের জন্য হিসাব রাখার মত মানসিকতাই কারও নেই। রেমিটেন্স এবং হস্তান্তর চলছে ঠিকই কিন্তু এর কোনো পরিসংখ্যান নেই। অবশ্য সোনার ক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তান থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে কিছু নামে মাত্র পরিসংখ্যান আছে। তাছাড়া ও দেশের বাইরের মজুদ, প্রতিরক্ষা সরঞ্জামের ব্যয়ও আমলে আনতে হবে।
এটা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে পৌঁছে গেছে। এছাড়াও বিদেশী দূতাবাসগুলোর খরচ আছে। প্রতিরক্ষা মজুদ আমদানি, তাদের প্রশিক্ষণের জন্যে অস্ত্র-গোলাবারুদ অথবা রাস্তায় চলাচল করা যানবাহনগুলো অর্থনীতির কোনো উপকারে আসে না।
মোঃ আবুল মনসুর আহমেদ: প্রশ্ন।
সম্মানিত জনাব মোঃ আলী: দেশের সম্পদ থেকেই প্রতিরক্ষা খাতে অযথা খরচ হলেও তা অর্থনীতিতে কোনো ভূমিকা রাখে না। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে কেন্দ্রীয় সরকার যে বড় অঙ্কের রাজস্ব পায় সেটাই এই খাতে ব্যয় করে। এটাই বাস্তব অবস্থা। কেন এটাকে একটা নির্দিষ্ট জায়গায় খরচ করতে হবে? মোটেই লাভের জন্যে না। এটাকে কৌশলগত বিবেচনার মাধ্যমে ব্যয় করা হয়। সীমান্তের সিভিল আর্মড ফোর্স এর ব্যয়ও উল্লেখযোগ্য কিন্তু লাভজনক নয়। প্রতিরক্ষাবাহিনীর বেতন যেন অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখে সেই জন্য এখন একটা ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। প্রায় ১০০ বছর ধরে পাকিস্তানের নির্দিষ্ট কিছু জেলা থেকেই বেতন উত্তোলন করা হচ্ছে। আর এখন পর্যন্ত এই জেলাগুলিই পাকিস্তানের সবথেকে দরিদ্রতম। দেশবিভাগের পূর্বে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে প্রায়শঃ এই জেলাগুলিকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে দরিদ্র করে রাখার অভিযোগ আসত। যে জেলাগুলো থেকে আমরা বেশি কর পাই তার সাথে ধনী জেলা যেমন: লালপুর, মুলতান ইত্যাদির সাথে তুলনা করে দেখলে বোঝা যায় দরিদ্য জেলাগুলিতে দেওয়া বেতন কোনো কাজেই আসছে না। আমি দেশের নাগরিকদের সাথে একমত যে তাদের সকলেরই প্রতিরক্ষা বাহিনীতে যোগদানের সমান অধিকার আছে। (সমস্বরে: সঠিক, সঠিক)
মহামান্য মোস্তাক আহম্মেদ গুরমানি: কর্তব্য।
সম্মানিত জনাব মোঃ আলী: যে উদ্যোগগুলো নেয়া হচ্ছে তার সাথে আমি একমত এবং ঘাটতি কমানোর জন্য এগুলো বাস্তবায়ন হোক তা আমি জোর দিয়ে চাই। কয়েক বছর আগে পশ্চিম পাকিস্তানের বর্ধনশীল সংগ্রহের বিষয়ে একটা কমিটি গঠন করা হয়েছিল। এই কমিটির গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ ছিল যেন তরুণদের প্রশিক্ষণের জন্যে মিলিটারি একাডেমি তৈরী করা হয়। দূর্ভাগ্যজনকভাবে তেমন কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি একটি ছোট পরিসরে কাজ শুরু হলেও তা আগায়নি। আমি মিলিটারি একাডেমি তৈরীর উদ্দেশ্যে ৪০ লাখ টাকা অনুমোদন দিয়েছি এবং দ্রুতই কাজ শুরু হবে।
সম্মানিত জনাব মোঃ আলী: বিরোধীদলের সম্মানিত নেতা জানতে চেয়েছেন পূর্ব পাকিস্তানে কেন নৌঘাঁটি তৈরী করা হয়নি। তিনি বোধহয় জানেন না, আমি চট্টগ্রামে নৌঘাঁটি তৈরীr জন্য অর্ডার পাশ করেছি।
জনাব জহিরউদ্দিন: আবুল মনসুরের বক্তৃতা কাজে লেগেছে মনে হচ্ছে।
জনাব আবু মনসুর আহমেদ: আমার বক্তৃতার পরে?
কয়েকজন সম্মানিত সদস্য: না (সহাস্যে), না।
সম্মানিত জনাব মোঃ আলী: অনেক আগেই।
জনাব জহিরউদ্দিন: সেই বক্তব্যের আগে, যেটাতে আমরা ৪০ লক্ষ রুপীর কথা শুনেছিলাম।
মহামান্য মুশতাক আহমেদ গুরমানী: এই স্বীকৃতি সঠিক ভাবে অর্জন করা হয়নি।
সম্মানিত জনাব মোঃ আলী: প্রায় এক মাস আগে আমি ৪০ লক্ষরুপীর অর্ডার পাশ করেছি।
মাননীয় ডেপুটি স্পিকার: সে তার বক্তৃতার খসড়া তৈরি করছিল তখন (হাসি)।
সম্মানিত জনাব মোঃ আলী: মহাশয়, পূর্ব পাকিস্তানকে অর্থনৈতিকভাবে উন্নত করার দৃঢ় প্রত্যয়ের কথা বলেছিলাম এবং পূর্ব পাকিস্তান প্রতিরক্ষার কাজেও যথাযথ ভূমিকা রাখতে পারে, সেজন্য যা যা করণীয় সবই করা হবে।
পাঁচটি প্রদেশকে একীভূত করে দু’টো প্রদেশে কমিয়ে আনাটা একটা সুবিধা বয়ে এনেছে। আগে পূর্ব পাকিস্তান ৫টি প্রদেশের একটি হওয়াতে, ৫টি প্রাদেশিক সরকারের দাবি-দাওয়ার সাথে প্রতিযোগিতা করতে হত। আজ মাত্র দুটি প্রাদেশিক সরকার হওয়ার কারনে অবধারিতভাবেই পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের দাবিগুলোকে অবশ্যই সমানভাবে বিবেচিত হবে। (সমস্বরে: সঠিক, সঠিক)
জনাব আবু মনসুর আহমেদ: তবে রাজধানী কিন্তু এক প্রদেশেই।
সম্মানিত জনাব মোঃ আলী: সম্ভবত এই দৃষ্টিকোন থেকে বিষয়টা সদস্যরা ভাবেন নি, কিন্তু এটা অনিবার্য পরিনতি এবং আমি মনে করি এটা পশ্চিম পাকিস্তান একীকরন করার ভালো একটা ফল।
জনাব জহিরউদ্দিন: আন্তরিকভাবেই এই সমমর্যাদা সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
সম্মানিত জনাব মোঃ আলী: দেশভাগের সময় খুব অল্প সংখ্যক কর্মকর্তা সরকারী চাকরিতে যুক্ত ছিল, যা আমি ইতিমধ্যেই উল্লেখ করেছি। তারপর থেকে ২০ ভাগ মেধার ভিত্তিতে নিযুক্ত হচ্ছে- আমি কেন্দ্রীয় প্রশাসনের কথা বলছি যেখানে ২০ ভাগ মেধানুযায়ি, ৪০ ভাগ পূর্ব পাকিস্তান থেকে আর বাকি ৪০ ভাগ পশ্চিম পাকিস্তান থেকে এবং তার ফল স্বরুপ বেশিরভাগ শীর্ষ প্রশাসনিক কাঠামোতে অনুপাত সমান যা দেশভাগের সময় একেবারে শুন্যের কোঠায় ছিল, যা এখন ২০-২৫ ভাগের মধ্যে আছে।
কেন্দ্রীয় সচিবালয়ের পদায়নের ক্ষেত্রে প্রায় ২৫ ভাগ কর্মকর্তাই পূর্ব পাকিস্তানের এবং আমি বিশেষ কিছু ব্যবস্থা নিয়েছি পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিনিধিত্ব আরো বাড়ানোর জন্য। আমি নিসন্দেহে বলতে পারি সাত বছর বা তারপর পরই এই ধরনের সমস্যার কথা সবাই ভুলে যাবে।
জনাব জহিরউদ্দিন: আমরা আশা করি আপনি সেখানে থাকবেন।
সম্মানিত জনাব মোঃ আলী: পর্যাপ্ত সংখ্যায় পূর্ব পাকিস্তান এবং পশ্চিম পাকিস্তান থেকে নিয়োগ করা হবে সব ধরনের সরকারী প্রতিষ্ঠানে এবং দেশ বিভাজনের সময়কার অসমতা থেকে উদ্ভূত অস্বস্তি বা অসন্তোষ দূর হয়ে যাবে। ইহা আমাদের সবারই আন্তরিক আকাঙ্ক্ষা যে এই অসমতা অবশ্যই থাকবে না। এটা তখনই সম্ভব যখন পূর্ব পাকিস্তান অনুধাবন করবে যে প্রশাসনে তাদের সমভাবে প্রতিনিধত্ব করতে পারছে, ন্যায্যতার ভিত্তিতে সবাইকে বিচার করা হচ্ছে। তা না হলে সঠিকভাবে ব্যবস্থা নিলেও সবসময়ই এক ধরনের সন্দেহ রয়ে যাবে। রাজধানী পশ্চিম পাকিস্তানে থাকাটা এক ধরনের পার্থক্য তৈরি করতে পারে এবং পূর্ব পাকিস্তানের জনগনের জন্য অসুবিধা বয়ে আনবে। সেজন্য আমাদের প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরনের উদ্যোগ নিতে হবে, ঐসব সমস্যাগুলো যতটা সম্ভব দূর করা বা কমিয়ে আনার জন্য। (বাধাপ্রাপ্ত)
সম্মানিত পীর আলী মোহাম্মদ রশীদ: চলমান কথাবার্তাগুলো শুধু শব্দ দূষনই তৈরি করছে।
মাননীয় ডেপুটি স্পিকার: অর্ডার, অর্ডার!
মহামান্য মুশতাক আহমেদ গুরমানী: পাকিস্তান বেতারের এটা কাজে লাগানো উচিত, উৎস হিসেবে এটা বেশ ভালো।
সম্মানিত পীর আলী মোহাম্মদ রশীদ: কোনো সন্দেহ নেই, আমরা এর সুবিধা কাজে লাগাবোই (বাধাপ্রাপ্ত)
সম্মানিত জনাব মোঃ আলী: একটি অনিবার্য প্রভাব হল দূরত্ব, যার কারনে বিচ্ছিন্ন ও অবহেলিত এই ভাবনাগুলো বাড়তে থাকে। হুবহু একই অবস্থা পসগচিম পাকিস্তানেও থাকতে পারে ঠিক পূর্ব পাকিস্তানের মত এবং তা অবহেলার মাত্রা সেখানে বেশিও মনে হতে পারে। এর আগে আমি যেমন বলেছি, পূর্ব পাকিস্তান এবং পশ্চিম পাকিস্তান দুটোই দরিদ্র অঞ্চল। আপনাকে দেশটির প্রত্যন্ত এলাকায় যেতে হবে। করাচীর দিকে তাকাবেন না। দেশের গ্রামীন প্রান্তিক জনগোষ্ঠী দারিদ্র্য সীমার নিচে বাস করছে, হতাশা-দুর্দশার মাঝে সময় কাটাচ্ছে পাকিস্তানের প্রায় সব জায়গার মতই। করাচী আসলে বিভ্রান্তই করবে, যেখানে মানুষজন দালান-কোঠা বা শিল্প-কারখানা কদাচিৎ দেখতে পায়, সেখানে করাচীর সার্বিক চিত্র পশ্চিম পাকিস্তানের সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাওয়াকেই বোঝাবে। কিন্তু আমি আগে যেমন বলেছিজীবন মান কে উন্নত জায়গায় শুধুমাত্র বড় শহরে নেয়া হবে না, একেবারে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের দুর্গম গ্রামে ও যার ছোয়া পৌছে যাবে। আমাদের জনগনকে বিজ্ঞান ও নতুন প্রযুক্তি এবং উৎপাদন পদ্ধতি সম্পর্কে জানতে হবে। তাদেরকে শিক্ষিত হতে হবে। আমাদের জনসংখ্যার ৯০ ভাগই নিরক্ষর। স্বাস্থ্যসেবাকে উন্নত করতে হবে। এক হাজার একটা জিনিস বাস্তবায়ন করতে হবে। এবং এটাই অন্যতম একটা কারন, কেন আমি অধীর আগ্রহী হয়ে আছি, সংবিধানকে খুব দ্রুত পাশ করানোর জন্য। সামাজিক ও অর্থনৈতিক যেসব সমস্যা আমরা এখন মোকাবেলা করছি, সেই দিকে আমাদের মনোযোগ দিতে হবে। আমাদেরকে অবশ্যই মৌলিক সাংবিধানিক কাঠামো প্রস্তুত করতে হবে, কিন্তু সত্যিকারের জটিলতা কারন তারাই যারা গনমানুষের কল্যানের ব্যাপারে উদ্বিগ্ন যা পূর্ব বা পশ্চিম পাকিস্তান যেখানেই হোক যা আমাদের সবাইকে বিবেচনা করা উচিত।
আমি এখন সংবিধানের কিছু বিষয় নিয়ে বলতে চাই। ভৌগোলিক কারনে এটা অনিবার্য যে আমাদের অবশ্যই যুক্ত প্রদেশীয় সংবিধান থাকতে হবে। রাজধানীর অবস্থান নিয়ে এক ধরনের সামর্থহীনতা রয়েছে। এককেন্দ্রিয় সরকার ব্যবস্থা যাকে সহস্র গুন বাড়াতে পারে।
প্রাদেশিক সরকার এবং কেন্দ্রীয় সরকারের কার্য পরিধি সংবিধানে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা জরুরী। এমন কি ভারত সরকার আইন ১৯৩৫ যেখানে পরিষ্কারভাবে সন্নিবেশিত থাকা স্বত্তেও যা ভালো রকমের দ্বিধা তৈরি করে। মাননীয় বিরোধী দলীয় নেতা গতকাল অভ্যন্তরীন জলপথ ব্যবস্থা উন্নয়ন প্রকল্পের করেন এবং অবহেলার অভিযোগ আনেন কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে। সত্যিকার ভাবে এসবই প্রাদেশিক সরকারের আওতায় পড়ে। দুর্ভাগ্যবশত যুক্ত প্রদেশিয় সরকার ব্যবস্থা, সাধারন মানুষের সহজ ভাবে বোধগম্য নয়। একক সরকার ব্যবস্থা টাই মানুষ সহজে বুঝতে পারে। আমাদের ভৌগোলিক অবস্থানের কারনেই যুক্ত প্রদেশীয় সংবিধান থাকাটাই সমীচিন এবং যেখানে ভুতাত্তিক কারনেই সর্বোচ্চ প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন থাকতে হবে। প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন এর সংজ্ঞা এবং গুরুত্ব কিন্তু রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যেই থাকতে হবে। প্রদেশ গুলো একটি রাষ্ট্রের অংশ এবং সে কারনেই প্রাদেশিক স্বাধিকারের কাঠামো অবশ্যই রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব, স্থিতিশীলতার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ন হতে হবে। এই বিষয় আমি বিরোধী দলীয় নেতার সাথে সম্পূর্ণ একমত। এই ব্যাপারে তিনি যা বলেছেন তার উপরে আমি কোন মন্তব্য করবো না এবং আমি মনে করি যে কেউই যুক্তিগ্রাহ্য ভাবে দেশের সমস্যাগুলো দেখলে তারা একই উপসংহার টানবে।