You dont have javascript enabled! Please enable it! 1954.05.31 | সরকার কর্তৃক ৯২-ক ধারা প্রবর্তনের যৌক্তিক ব্যাখ্যা |  অবজারভার  পাকিস্তান - সংগ্রামের নোটবুক
তারিখ সুত্র শিরোনাম
৩১শে মে, ১৯৫৪       অবজারভার  পাকিস্তান সরকার কর্তৃক ৯২-ক ধারা প্রবর্তনের যৌক্তিক ব্যাখ্যা

 

পাকিস্তানের অখন্ডতা রক্ষায় গৃহীত পদক্ষেপ : প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা

করাচী, মে ৩০:পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী সন্ধ্যায় রেডিওতে জাতীর উদ্দেশ্যে বললেন “আমাদের প্রদেশের শাসনব্যবস্থা গ্রহনের একমাত্র লক্ষ্য হল পূর্ব বাংলাকে রক্ষা করা এবং পাকিস্তানের অখন্ডতা বজায় রাখা।
পূর্ব বাংলায় ৯২- ক ধারা আরোপের পর পরই প্রধানমন্ত্রী ২৯ মিনিটের ভাষণে কেন্দ্রীয় সরকারের চুড়ান্ত পদক্ষেপ সম্পর্কে স্পষ্ট ধারনা দেন।তিনি বলেন পূর্ব পাকিস্তানের শাসন ব্যবস্থা বস্তুত ভেঙে গেছে এবং ফজলুল হকের মন্ত্রীত্ব প্রদেশের মানুষের জীবন এবং সম্পত্তি রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছে।
জনাব মোহাম্মদ আলী একটা সিদ্ধান্তে এসে জাতিকে নিশ্চিত করলেন যে, সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় আমরা এই বিষয়টি নিয়ে বিন্দুমাত্র প্রভাবিত হইনি যে, প্রদেশের মন্ত্রীত্ব মুসলীম লীগের মন্ত্রীত্ব নয় বরং যুক্তফ্রন্টের মন্ত্রীত্ব।তিনি আরও বলেন অতীতে যখন একই অবস্থা হয়েছিল কেন্দ্রীয় সরকার সিন্ধু এবং পাঞ্জাবের মুসলীম লীগের মন্ত্রীসভা ভাঙতে দ্বিধাবোধ করেনি।
কেন্দ্রের তথ্য
জনাব মোহাম্মদ আলী বলেন যে, সরকারের কাছে থাকা তথ্যের আলোকে দুটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে উঠে, প্রথমত, সংহতিনাশক শক্তি এবং শত্রুপক্ষের এজেন্ট যারা পূর্ব পাকিস্তানে সক্রিয় ভাবে মুসলমানদের বিরুদ্ধে মুসলমান, শ্রেণীর বিরুদ্ধে শ্রেণী এবং কেন্দ্রের বিরুদ্ধে প্রদেশকে দাঁড় করিয়ে পাকিস্তানের ঐক্য নষ্ট করতে চান। দ্বিতীয় বিষয়টি হল জনাব ফজলুল হক এবং তার সহকর্মীরা পরিস্থিতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না।
প্রধানমন্ত্রী বলেন যে, এই দুঃখজনক পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে পূর্ব পাকিস্তানের নৈরাজ্যবাদী গোষ্ঠীর পৈশাচিক কর্মকান্ডের কারণে এবং যুক্তফ্রন্টের বিজয়ের পর পরই চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ ও খুলনার শিল্প এলাকায় দ্রুত ছড়িয়ে পড়া বিশৃঙ্খলার কথা উল্লেখ করেন।
—- তিনি আরও উল্লেখ করেন, চন্দ্রঘোনা পেপার মিলে ১৩ জন নিহত হওয়ার ঘটনা, জেল কর্মচারী ও জনতার মধ্যে ঢাকায় সংঘটিত সংঘর্ষ এবং সর্বশেষে আদমজী পাটকলের দাঙ্গা যেখানে শিশু নারীসহ চারশ’র অধিক নিরীহ মানুষ নিহত হওয়ার কথা।
প্রধানমন্ত্রী বলেন যে, এসকল বিশৃঙ্খলা ছিল উদ্দেশ্য প্রণোদিত। তিনি ঘোষণা করেন, প্রাদেশিক কল্যাণ এবং পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ অক্ষুন্ন রাখতে হলে কোন সরকারই এই অচলাবস্থা উপেক্ষা করতে পারে না।তিনি উল্লেখ করেন, ১৭ মে তারিখে পরিস্থিতির ক্রমাবনতি ঠেকাতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য প্রাদেশিক সরকারকে নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে।
একই সময়ে প্রাদেশিক সরকারকে নিশ্চিত করা হয় যে, কেন্দ্র তাদেরকে “প্রদেশে শাসন পুনঃস্থাপন ও বজায় রাখার জন্য সর্ব প্রকার সহায়তা দেবে।
কেন্দ্রের নির্দেশনা অগ্রাহ্য
জনাব মোহাম্মদ আলী কেন্দ্রীয় সরকার কতৃক প্রস্তাবিত কার্যাবলির উল্লেখ করেন, জনাব ফজলুল হক জনসম্মুখে এই প্রস্তাবনাটি অস্বীকৃত জানান যে এই নৈরাজ্যের পেছনে সাম্যবাদী কিংবা অন্যান্য বিধ্বংসী উপাদানের কোন হাত আছে। তিনি আরো বলেন যে যুক্তফ্রন্টের নেতারা চমৎকার অভিযোগ করেছেন যে কেন্দ্র এবং মুসলিম লীগ যুক্তফ্রন্টের সম্মানহানীর জন্য এইসব দাঙ্গা প্ররোচিত করেছে। “এটি ” তিনি বলেন, “ অবশ্যই ইচ্ছাকৃত মিথ্যাচার এবং বিদ্বেষপূর্ণ প্রচেষ্টা মানুষকে বিভ্রান্ত করার এবং রাজনৈতিক রাজধানীকে একটি চরম বিপর্যয়ে ফেলানোর জন্য।
“ জনাব মোহাম্মদ আলী ঘোষণা করেন যে ,জনাব হকের সাম্প্রতিক বক্তব্যে কোলকাতা উচ্চারণনের প্রেক্ষিতে তিনি এবং তার সহকর্মীরা ধরে নিয়েছেন যে, তাদেরকে এমন একজন রাজনৈতিক নেতার সাথে কথা বলতে হবে যিনি মৌলিকভাবে পাকিস্তানের বিরোধী। এটি পরিষ্কার যে তিনি কিংবা তাঁর মন্ত্রীসভা প্রদেশের পরিচালনায় উপযুক্ত ছিলেন না অথবা ৪ কোটি ২০ লাখ মানুষের শান্তি ও আত্মবিশ্বাস এবং সমৃদ্ধির লক্ষ্যে কাজ করার জন্য তাদের ওপর ভরসা করা যায় না। হক মন্ত্রীসভা বাতিল করা ছাড়া কেন্দ্রের আর অন্য কোনো উপায় ছিল না।
প্রধানমন্ত্রী তাঁর বেতার বার্তায় প্রদেশে গভর্নরের শাসন কতদিন চলবে তার কোন নির্দেশনা দেননি কিন্তু বলেন যে ৯২(ক) ধারা বজায় থাকবে,” যতক্ষন না প্রদেশে সাধারণ অবস্থা পুনরুদ্ধার হয় ও জনগণের এবং জনগণের আত্মবিশ্বাসের যোগ্য মন্ত্রীসভা প্রতিনিধি সফলভাবে কাজ করতে পারে।
“ জনগণের প্রতি সতর্কবাণী”
তিনি জনপগণকে অভ্যন্তরীণ শত্রুদের বিরুদ্ধে এবং প্রাদেশিকতার বিপদের বিরুদ্ধে সতর্ক করেন এবং তরুণদের শত্রু দ্বারা প্ররোচিত্র না হতে অনুরোধ করেন। তিনি সরকারী কর্মচারীদের নিপীড়নের ভয় থেকে মুক্ত হয়ে এবং সামাজিক ও প্রশাসনিক শাসন পুনরুদ্ধারের জন্য তাদের কর্তব্য অনুযায়ী দায়িত্ব পালন করতেও বলেন।
জনাব ফজলুল হকের কেন্দ্রীয় সরকারের সাথে আলোচনার কথা উল্লেখ করে জনাব মোহাম্মদ আলী বলেন যে তিনি এবং তাঁর সহকারীরা এককভাবে নিশ্চিত এবং সন্দেহমুক্ত যে যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রীবর্গের ওপরে পরিস্থিতি মোকাবেলায় কার্যকর পদেক্ষেপ নেওয়ার ব্যাপারে ভরসা করা উচিত না এবং ভরসা করা যায়ও না। “এটি পরিষ্কার যে তাঁর গত করাচি সফররের পর থেকে জনাব ফজলুল হকের মানসিক গঠনে লক্ষণীয় রূপান্তর ঘটেছে।
প্রধানমন্ত্রী প্রকাশ করেন যে তাঁর এখানে পূর্ববর্তী সফর কালে তিনি জনাব হক তাঁর প্রদেশে সাম্যবাদ বৃদ্ধি সম্পর্কে উদ্বেগ প্রকাশ করেন এবং এমনকি একটি শক্তিশালী কেন্দ্রের সমর্থন করেন কিন্তু তাঁর দ্বিতীয় সফরে তিনি বলেন যে পূর্ববঙ্গ কোন সাম্যবাদী ও সাম্যবাদ ছিল না।
আবারো নিউ ইয়র্ক টাইমস
জনাব মোহাম্মদ আলী রয়টারের এবং নিউ ইয়র্ক টাইমসের সাথে জনাব ফজলুল হকের সাক্ষাতকারেরও উল্লেখ করেন যেখানে রিপোর্ট করা হয় যে তিনি বলেন, তাঁর উদ্দেশ্য ছিল পূর্ববঙ্গের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা এবং পরবর্তীতে এই বিবৃতির অস্বীকার করেন। তিন দিন পর, যাই হোক” মোহাম্মদ আলী বলেন, “ জনাব ফজলুল হক আবার তাঁর মত পরিবর্তন করেন এবং এই অমার্জিত আলোচনায় পরিষ্কারভাবে আমাদের বলেন যে তাঁর উদ্দেশ্য ছিল একটি স্বাধীন পূর্ববঙ্গ”।
জনাব মোহাম্মদ আলি কলকাতায় জনাব হকের বিবৃতিরও উদ্ধৃতি দেন যেটাকে তিনি পরবর্তীতে “চতুর ব্যাখ্যা “ বলেন এবং ঘোষণা দেন যে,” আমি জনাব ফজলুল হক এবং তাঁর বিভিন্ন বিবৃতিকে আমার দেশবাসীর চিন্তা ও বিচারের জন্য ছেড়ে দিলাম। আমার কোনো সন্দেহ নেই যে তাদের রায় হবে যে জনাব ফজলুল হক পাকিস্তানের একজন বিশ্বাসঘাতক।“ তিনি জনাব ফজলুল হক সম্পর্কে কায়েদ-এ-আজমের প্রকাশ্যে বলা অভিমতেরও উল্লেখ করেন যেখানে তিনি তাকে “ একটি অভিশাপ” বলেছিলেন।
সম্পূর্ণ বার্তা
নিম্নোক্তটি হল প্রধানমন্ত্রীর বেতার ঘোষণার সম্পূর্ন বার্তা
“আমার সহকর্মীরা এবং আমি সাম্প্রতি পূর্ববঙ্গের অবস্থা সতর্কভাবে বিবেচনা করেছি। আমরা পূর্ববঙ্গের মূখ্যমন্ত্রী এবং করাচিতে তাঁর সহকর্মীদের সাথে আলোচনার পর কৃতজ্ঞচিত্তে এই উপসংহারে এসেছি যে, প্রদেশের প্রশাসন ফলত ভেঙে পড়েছে, বর্তমান মন্ত্রীসভা না পারছে পূর্ববঙ্গের জনগণের জীবন এবং সম্পদের নিশ্চয়তা দিতে না পারছে প্রশাসন এবং জনগণের মধ্যে সেই আত্মবিশ্বাস প্রদান করতে যা একটি সুশ্রৃঙ্খল ও উন্নয়নশীল সরকারের অন্যতম পূর্বশর্ত। অতএব আমরা পাকিস্তান কতৃক গৃহীত ভারত সরকার আইন ১৯৩৫ এর ৯২(ক) ধারা অনুযায়ী প্রাদেশিক প্রশাসন দখল করে নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তদনুসারে, ৯২(ক) ধারার অধীনে প্রাদেশিক মন্ত্রীসভা বাতিলের প্রয়োজনীয় নির্দেশ জারি করা হল।
“তারা আইন ও শাসন এবং জনগণের আত্মবিশ্বাস পুনরুদ্ধার করতে, যা সংসদীয় সরকার করে, নুন্যতম প্রয়োজনীয় সময় পর্যন্ত বলবত থাকবে।