You dont have javascript enabled! Please enable it! 1952.12.22 | নাজিমউদ্দিন কর্তৃক মূলনীতি কমিটির চূড়ান্ত রিপোর্ট | পাকিস্তান গণপরিষদ - সংগ্রামের নোটবুক

শিরোনাম

সূত্র

তারিখ

নাজিমউদ্দিন কর্তৃক মূলনীতি কমিটির চূড়ান্ত রিপোর্ট

পাকিস্তান গণপরিষদ

২২শে ডিসেম্বর, ১৯৫২

 

২২ ডিসেম্বর ১৯৫২ সালে গণপরিষদে মূলনীতি কমিটির রিপোর্ট উপস্থাপন করবার সময়ে আলহাজ্ব খাজা নাজিমউদ্দিন মহোদয় প্রদত্ত ভাষণ।

জনাব রাষ্ট্রপতি,
মহোদয়,
আমি ১২ মার্চ, ১৯৪৯ এর তারিখে এই গণপরিষদের সিদ্ধান্ত দ্বারা নিয়োগপ্রাপ্ত মূলনীতি কমিটির প্রতিবেদন উপস্থাপন করছি। মহোদয় আপনার মনে আছে যে মরহুম শহীদ-ঈ-মিল্লাত জনাব লিয়াকত আলী খান ২৮ সেপ্টেম্বর ১৯৫০ সালে এই কমিটির অস্থায়ী রিপোর্ট উপস্থাপন করেছিলেন। এই পরিষদ এর সিদ্ধান্ত অনুযায়ী৩১ জানুয়ারি ১৯৫১ রিপোর্টটি মূলনীতি কমিটির কাছে ফেরত পাঠানো হয় যাতে করে আইনের অনুকূলে আরো গুরুত্বপূর্ণ কোন পরিবর্তন আনা সম্ভব হয় ও গণপরিষদের দফতরে গৃহীত হয় এবং প্রয়োজনীয় মনে হয় এমন সুপারিশগুলো সংযোজিত হয়। প্রচুর পরিমানে সুপারিশ গ্রহণ করা হয় এবং সেকারনে, সুপারিশসমূহ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার জন্য মূলনীতি কমিটি একটি উপ-কমিটি গঠন করে। গঠিত উপকমিটি তাঁর প্রতিবেদন পেশ করে ৮ জুলাই, ১৯৫২ সালে। মূলনীতি কমিটি এর উপকমিটি এবং আইনগত ও অধি নিয়োগ প্রাপ্ত উপকমিটি সমূহের রিপোর্ট বিবেচনা করে। সবগুলো রিপোর্টই এই বছর গৃহীত হয়েছে। রিপোর্টের প্রথম খসড়া যখন প্রস্তুত হয়েছিলো, তাতে আইন বিশেষজ্ঞদের পরীক্ষা-নিরীক্ষার ভিত্তিতে কিছু আইনগত দিক উঠে এসেছে। তালিমাতে-ঈ-ইসলামী বোর্ড আরও নতুন কিছু পর্যবেক্ষণ উপস্থাপন করে। বিবিধ দিক বিবেচনার লক্ষ্যে কমিটি নভেম্বর মাসে বৈঠক ডাকে। এই কারনসমূহের জন্য২২ নভেম্বর রিপোর্টটি উপস্থাপন করা সম্ভব হয়নি যা সেদিন আমি ব্যাখ্যা করেছি । রিপোর্ট উপস্থাপনের এই বিলম্ব বিভিন্ন মহলে নিন্দিত হয়েছে। যাইহোক, এটা মনে রাখা উচিত, জনগণের কাছ থেকে বর্ধিত তারিখ পর্যন্তদফতর এর সুপারিশ পাওয়ার কথা ছিল। পরবর্তীতে সকল সুপারিশ সারণিতে উপস্থাপন করে অতঃপর ছাপিয়েসদস্যদের মধ্যে বিতরণ করা হয়েছে যাদের এটাকে বিচার বিবেচনা করতে সময়ের প্রয়োজন। আপনি যদি প্রতিবেদনের ভুমিকা অংশটি পড়ে দেখেন তাহলে আপনি জানতে পারবেন একাধিক কমিটি নিয়মিত বিরতিতে বৈঠক করেছে এবং তাদের বিবেচনার ক্ষেত্রে কোন প্রকার অযাচিত বিলম্ব হয়নি। এটা সত্য যে কমিটি গুলো নিয়মিত বৈঠকে থাকতে পারেনি, কারন কমিটিগুলোতে অনেক কেন্দ্রীয় এবং প্রাদেশিক মন্ত্রী অন্তর্ভুক্ত ছিলেন যাদের নিজেদের অনেকদায়িত্ব পালনে ব্যস্ত থাকতে হয়েছে। আমাদের আরও মনে রাখা উচিত প্রস্তাবের উদ্দেশ্যের মধ্যে আমাদের জন্য অনেক বড় দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে যেমন ইসলামের বিধানকে বিংশ শতাব্দীর গণতান্ত্রিক সাংবিধানিক প্রক্রিয়ার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ করে তোলা। এমন কাজের ক্ষেত্রে প্রয়োজন নিবিড় চিন্তা ও আলোচনা’র মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণ, যাতে করে আমরা শুধুমাত্র আমাদের বিশ্বাসের মৌলিক শিক্ষায় এবং বিংশ শতাব্দীর প্রগতিশীল গণতন্ত্রে নয় বরং আমাদের সামগ্রিক ঐতিহ্য এবং ইতিহাসে নতুন সংযোজন ঘটাতে পারি। মহোদয় এটা আপনার বোধগম্য হবে যে এটা অত্যন্ত সূক্ষ্ম এবং সুগভীর ধারণাপ্রসূত দায়িত্ব ছিল যখন সমগ্র দেশ কমিটির সুপারিশগুলো পড়বে,আমি নিঃসন্দেহে বলতে পারি, পরিষদ আমার সাথে একমত হবে যে কমিটি অত্যন্ত যত্নের সাথে এমন মহান এবং ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেছে।
প্রস্তাবের উদ্দেশ্য, যার মধ্যে আমাদের রাজনৈতিক বিশ্বাস এবং আশা আকাঙ্খা নিহিত তা কমিটির আলোচনা-পর্যালোচনার ক্ষেত্রে আলোকবর্তিকার ভুমিকা পালন করেছে। মরহুম শহীদ-ঈ-মিল্লাত তার ঐতিহাসিক ঘোষণায় সিদ্ধান্তক্রম গৃহীতের ক্ষেত্রে একে সকালের প্রথম আলোক বিচ্ছুরণের সাথে তুলনা করেছেন যার নিচে আমরা গৌরবের দিনের ভোরকে সম্মান জানাই। এই প্রতিবেদনকে আকাশকে আলোকিত করার সূর্যের সোনালী রশ্মির সাথে তুলনা করার অনুমতি দিন আমাকে। এখানে সেই মূলনীতি গুলো এই পরিষদের গৃহীত হওয়ার জন্য উপস্থাপন করা হয়েছে যেগুলোর উপর ভিত্তি করে আমাদের সংবিধান হবে বলে আমরা ভাবছি। সংবিধান একটি দেশের জন্য ছাঁচ যার উপর নির্ভর করে সেই দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থা নিজেকে সৃষ্টিশীল করে তোলে; এটা সত্য যে ছাঁচ নিজ থেকে কর্মোদ্যম সঞ্চার করতে পারে না, আবার এটাও সত্য যে কর্মোদ্যম তার গতি খুঁজে পায় যদি কর্মপন্থা সঠিকভাবে নির্ধারিত থাকে। কমিটি প্রদত্ত সুপারিশ আমাদের উদ্দেশ্য পূরণ করবে এমন বিশ্বাস থেকে আমি রিপোর্টটি উপস্থাপন করছি। আমার মতে সুপারিশ গুলো শুধুমাত্র আমাদের আকাঙ্ক্ষারই নয়আমাদের প্রয়োজন এবং মেধারও প্রতিফলন করে।
এই রিপোর্টের সমালোচনা হবে না এমন আশা আমি করি না। উদ্দেশ্যের প্রয়োগের পক্ষে সুপারিশ করার চেয়ে উদ্দেশ্যের ক্ষেত্রে সর্বসম্মতি পাওয়া সহজ। আপনি যদি পরিষদের সংরক্ষিত নথির দিকে তাকান আপনি দেখতে পাবেন প্রস্তাবের যৌক্তিকতাও প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। কিন্তু যখন জনগনের কাছে এর প্রয়োগ এবং যৌক্তিকতা উপস্থাপন করা হয়েছিলো তা সর্বসম্মতি পেয়েছিলো। সংবিধান একটি জাতির আশা আকাঙ্ক্ষার স্বরূপ উদ্দেশ্যগুলো বাস্তবায়ন করতে পারে তথাপি সমাদৃত নাও হতে পারে; কারন যে আকাঙ্খা গুলো সহজে বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়, সংবিধান সে আকাঙ্খা পূরণের একটি অসম্পূর্ণ উপায়। চূড়ান্ত গন্তব্য ঠিক করা সেই গন্তব্যে পৌঁছানোর পথ ও প্রক্রিয়ার ঠিক করার চেয়ে সহজতর। কিন্তু আমি নিঃসন্দেহ যে দেশে গৃহীত অন্য যেকোনো সুপারিশের চেয়ে এই সুপারিশ গুলো অনেক বেশী স্বীকৃতি পাবে। কিছু ক্ষেত্রে দ্বিমত তৈরি হতে পারে। কিছু কিছু মত বিরোধ সুচিন্তিত আলোচনার মাধ্যমে দূর করা যাবে। অন্য দ্বিমত গুলো হয়তো আরও মৌলিক। আমি মনে করি না সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসমর্থন পাওয়ার মতো প্রতিবেদন তৈরি করা কঠিন হতো।
আপনি হয়তো চাইবেন আমি কিছু সবচেয়ে সুবিদিত কিছু সুপারিশ ব্যাখ্যা করি। আমি সর্বপ্রথম সেই সকল বিধানগুলো প্রয়োগ করবো যেগুলো, বাস্তবায়িত হলে, আমাদের দেশ একটি ইসলামী প্রজাতন্ত্রে পরিণত করবে। ইসলামের শিক্ষাই এই সুপারিশ নির্ণয়ের প্রতিটি ধাপে পথপ্রদর্শক নীতির ভূমিকা পালন করেছে। আমাদের কোন সুপারিশই কোরআন এবং সুন্নাহ নির্ধারিত সীমার বাইরে নয়। ইসলামের শিক্ষার সাথে দ্বন্দ্বমূলক যেকোনো বিধান প্রতিহত করার জন্য আমি গণপরিষদের দৃষ্টি আকর্ষণ করবো। আপনি জেনে থাকবেন আইন তৈরি হয়েছে যাতে নতুন সংবিধানের কোন বিধান কোরআন এবং সুন্নাহ’র বিধানের বাইরে যেতে না পারে। যে কোন ইস্যু কিংবা বিষয়ে কোরআন এবং সুন্নাহ এর পরিপন্থী বলে পরিগণিত হয় তবে সেক্ষেত্রে ইসলামিক আইনে বিজ্ঞ এবং প্রজ্ঞাবান ব্যক্তিবর্গের একটি বোর্ড রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ে পরামর্শক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হবে। যদি বোর্ড সেই বিরুদ্ধ মতামতকে সমর্থন করে তবে সেক্ষেত্রে রাষ্ট্রপ্রধানকে গণপরিষদে পুনঃবিবেচনার জন্য বিলটিকে পাঠানোর অধিকার দেয়া হয়েছে।
চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের জন্য শুধু আইনসভার সংখ্যাগরিষ্ঠতারই প্রয়োজন হবে না, এটার সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম সদস্যদের সমর্থনও প্রয়োজন হবে , কারন এসব সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে কুরআন ও সুন্নাহ এর সংশ্লিষ্টতা রয়েছে ।
অজ্ঞতার কারনবশত ভুল সিদ্ধান্ত নেয়ার সম্ভাবনা দূর হবে, বেশিরভাগ মুসলিম আইন প্রণেতার খোদ ইসলাম শিক্ষার বিপক্ষে যাওয়ার একটি সম্ভাবনা মনে উদয় হতে পারে।আমার ধারনা এরকম আকস্মিক ঘটনা নাও ঘটতে পারে, তবে, আল্লাহ না করুন, যদি দৈব ক্রমে দেশের অধিকাংশ মুসলিম সদস্য যারা অশিক্ষা নয় বরং ইচ্ছাকৃতভাবে ইসলামের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটায়, অ-ইসলামিক আইন প্রণয়ন করে, তবে কোন ধরনের সাংবিধানিক রক্ষানীতি দেশকে ইসলামিক বিশ্বাস থেকে বিচ্যুত হতে রক্ষা করতে পারবেনা। ইসলাম সত্যিকার অর্থে এদেশে সমৃদ্ধি লাভ করতে পারবে যতক্ষণ পর্যন্ত জনগন প্রকৃত মুসলিম থাকবে। যদি কখনও মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ আইনপ্রনেতারা ইসলামের শিক্ষার সাথে বিশ্বাস ঘাতকতা করে, তারা বিধানসভার আস্থা হারাবে যা আমাদের সুপারিশ অনুযায়ী শুধুমাত্র মুসলিমদের নিয়ে গঠিত হবে।“জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে রাষ্ট্র তার ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব ব্যবহার করবে”, এই বক্তব্যের উপর গুরুত্ব দিয়ে এইক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নিতে আমরা বাধ্য ছিলাম । যেমনটি বলছিলাম, এই সিদ্ধান্ত শুধুমাত্র সবার সম্মতি সাপেক্ষে নয় বরং বিশিষ্ট ওলামা যেমন মরহুম মাওলানা শাব্বির আহমেদ উসমানী , যিনি কিনা এর অন্যতম লেখক, তাদের সবার সম্মতিতে নেয়া হয়েছে। সংবিধানে জনপ্রতিনিধিদের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নির্ধারকের ক্ষমত দিয়েজনগনের কর্তৃত্বের এই নীতি আমরা রক্ষা করবো ।

ধর্মের লেবাসে ক্ষীণদৃষ্টি নিচু মানসিকতা অথবা ছদ্মবেশের মাধ্যমে ইসলামিক গণতন্ত্র সচেতনতা তৈরীর মহান দায়িত্ব রুপায়িত করতে আধুনিক বিশ্বের প্রতি ইসলামের প্রগতিশীল প্রকৃতি অব্যাহত রাখতে সুপারিশ করা হচ্ছে। ধর্মের প্রতি সত্যিকারের আগ্রহ সম্পূর্ণ রুপে নিরাপদ এবং ধর্ম নিজেই এর মঙ্গলজনক কাজের জন্য পরিপূর্ণ সুযোগ পাচ্ছে।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ হল রাষ্ট্রপ্রধান হবেন নির্বাচিত এবং তাকে অবশ্যই মুসলিম হতে হবে। ইসলামিক ব্যবহারের জন্য এটি রাখা হচ্ছে। এটি কম গণতান্ত্রিক নয়। এভাবে বলা যেতে পারে যে যেখানে দেশের জনসংখ্যার সবাই মুসলিম নয়, তাই রাষ্ট্রপ্রধান একটি নির্দিষ্ট ধর্মের হওয়াটা গ্রহণযোগ্য নয়। এধরনের সমালোচনা নিছক অগভীর। আমরা যদি আইন ও বিশ্বের প্রধান গণতান্ত্রিক রেওয়াজ লক্ষ্য করি তবে দেখতে পাই যে, প্রতিবেদনে সুপারিশকৃত আইনের ধারাসমুহ এমন বিশেষ কিছু নয়। যুক্তরাজ্যের গণতন্ত্রে শাসককে অবশ্যই শুধুমাত্র খ্রিস্টানই নয়, বরং চার্চের সাথে সম্পৃক্ত একজন হতে হয়। একারনেই ব্রিটিশ রাজপ্রধান ব্রিটিশ চার্চেরও প্রধান। আমার আসলে জানা নেই যে যুক্তরাস্ত্রে প্রটেস্টান্ট ব্যতীত কোন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছে কিনা। আমি এমন কাউকে চিনিনা যে মহান গনতন্ত্রের নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট সবচেয়ে জনপ্রিয় ধর্মের অনুসারী হতে পারেনা বলে দাবি করবে। বিশ্বের মাত্র ২টি নেতৃত্বস্থানীয় প্রজাতন্ত্রের উল্লেখ করেছি আমি। গণতান্ত্রিক বিশ্বের বাইরে,যারা সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক ইউনিয়ন এর কমিউনিস্ট পার্টির অন্তর্ভুক্ত নয় তারা কেউই ভোটাধিকার পান না; দায়িত্বপ্রাপ্ত হিসেবে নির্বাচিত হবার সম্ভাবনা তাই কল্পনাতীত । অতএব পাকিস্তানের রাষ্ট্রপ্রধান মুসলিম হতে হবে, আমাদের এমন দাবির কারনে গণতান্ত্রিক আচরণ লঙ্ঘনের দায়ে অভিযুক্ত হতে পারিনা।
এই সুপারিশে আরো অন্যান্য বিষয় আছে যা দীর্ঘমেয়াদে সংবিধান এর দেওয়া নির্দিষ্ট কলাকৌশলের চেয়ে অধিক কার্যকরী হিশেবে প্রমানিত হবে। প্রসঙ্গত আমি আপনাকে রাষ্ট্রনীতির পরিচালনাতত্ত্ব-এর কথা বলতে পারি, যেখানে উদ্দেশ্যমূলক বিশ্লেষণ এর সাথে সাথে বলা হয়েছে, সেই আদর্শের কথা যা পাকিস্তান রাষ্ট্র মেনে চলবে এবং আরও কিছু আশু উদ্দেশ্য যেগুলো এই নীতির একটি অংশ হবে। এখানে আপনি তত্ত্বগুলো সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত ধারনা পাবেন যেগুলো কমিটির সদস্যদের মতে রাষ্ট্রের ইসলামী পরিবেশ বজায় রাখতে এবং পর্যায়ক্রমিক উন্নতিতে একতি সত্যকার ইসলামী গনতন্ত্রে গড়ে ওঠায় সহায়ক হবে, যেখানে কুরআন ও সুন্নাহ এর আলোকে মুসলিমরা তাদের ব্যক্তি ও সমষ্টিগত জীবন পরিচালনা করতে পারবে এবং অমুসলিমরাও তাদের অধিকার ও স্বার্থের সম্পূর্ণ সুরক্ষা ও নিরাপত্তা পাবে।
আমি বিশেষভাবে আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করছি বিধিটিতে যে, মুসলমানদের সকল ধরণের সুবিধা নিশ্চিত করা হব যার দরুন তারা বুঝতে পারবে কুরআন ও সুন্নাহ মোতাবেক জীবনধারা কেমন এবং প্রত্যেক মুসলমানের জন্য কুরআন শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা উচিত হবে। আমি এখানে স্পষ্টভাবে বলতে রাখতে চাই একদলের কুরআন ও সুন্নাহের ব্যাখ্যা আরেক দলের উপর যেন চাপিয়ে দেওয়া হবে না এবং এই চেষ্টাও করা উচিৎ যেন এমন একটি শিক্ষাব্যবস্থা প্রণয়ন করা যায় যাতে কোন নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের বিশ্বাস ও ঐতিহ্যের সাথে সাংঘর্ষিক কিছু না হয় এবং এই বিষয়ে তাদের নিজস্ব সংস্কৃতিকে সম্পূর্ণভাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। এটি আমার অজানা নয় যে কিছু কিছু ক্ষেত্রে কিছু মুসলমানের ব্যক্তিগত আইন যেমন উদাহরণস্বরূপ, তালাক সংক্রান্ত বিধিবিধান বিশেষ আইনী আদালত দ্বারা জারি ও বিচারনির্ণয় করা উচিত। আমি ব্যাখ্যা করব কেন এটা কোনো সাংবিধানিক বিষয় নয় এবং আইন দ্বারা সমাধান সম্ভব। আমি জানি এই বিষয়টি ইতিমধ্যেই বিদ্যমান আইন কমিশনে নিরীক্ষণ করা হচ্ছে, যা বিদ্যমান আইনগুলোকে আমাদের মূলনীতির সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ করার ক্ষেত্রে সুপারিশ প্রণয়নের জন্য নিয়োগ করা হয়েছে।
উদ্দেশ্যের সমাধানকল্পের (Objectives Resolution) আদেশপত্র(Mandate)অনুসারে এই প্রতিবেদন একটি যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকার প্রস্তাব করছে। এর প্রস্তাবনায় যুক্তরাষ্ট্রের কোনোরকম দূর্বলীকরণ করা ছাড়াই প্রদেশের স্বায়ত্বশাসন এর মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। আমাদের মতে, এতে রাষ্ট্রের সামগ্রিক জীবনযাপনে একজন অংশগ্রহণকারী হিশেবে প্রদেশের জনগন মর্যাদা অর্জন করবেন। বিপত্তিগুলোর মধ্যে একটি ছিল সাংবিধানিক ক্ষমতার ভারসাম্য বিধান করা তথা পাকিস্তানের দুটি অংশের মাঝে দায়িত্ব বণ্টন। আসনসভার দুইটি সংসদে সম প্রতিনিধিত্বের মাধ্যমে এই যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের দুটি অংশের মাঝে সমতা নিশ্চিত করাই ছিল এই প্রতিবেদনের উদ্দেশ্য । আমাদের মতে এভাবেই দুটি অংশের মাঝে সুখী আন্তঃস্বাধীনতা আসবে এবং ঐক্যবদ্ধ থাকার তাগিদকে উৎসাহিত করবে। আস্থা ও বিশ্বাস এর জন্য কেন্দ্রীয় আইনসভায় এমনভাবে সাজানো হয়েছে যেন ছোট ছোট প্রদেশগুলোও যথাযথ গুরুত্ব বহন করবে। আমার বিশ্বাস সকল প্রদেশই এরূপ বিন্যাসের গুরুত্ব ও সমতা অনুধাবন করতে পারবে।
প্রতিবেদনের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যগুলোর মধ্যে রয়েছে নির্বাচন অনুষ্ঠান, স্থায়ী সেবার স্থিতিশীলতা এবং পাবলিক সার্ভিস কমিশনের স্বাধীনতার বিষয়ে সুপারিশ। আপনি খেয়াল করে থাকবেন, পক্ষপাতহীন নির্বাচনের জন্য সকল প্রকার সতর্কতা গ্রহণ করা হয়েছে এবং উত্থাপিত যেকোন প্রকার অভিযোগের জন্য ন্যায়বিচারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। একইভাবে সেবার স্থিতিশীলতার জন্য বিধান তৈরি করতে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে যার অধিকার ও সুবিধাসমূহ যথাযথভাবে রক্ষা করা হবে এবং সৎ সরকারী কর্মচারীদের রাজনৈতিক কারনে নিপীড়ন সম্ভব হবে না। কেন্দ্রে ও প্রদেশে, একইভাবে সম্পূর্ণ স্বাধীন পাবলিক সার্ভিস কমিশন প্রতিষ্ঠা করার সুপারিশ করা হয়েছে এবং কমিশন যেন যেকোনো ধরনের রাজনৈতিক বা নির্বাহী চাপ মুক্ত থাকতে পারে সে ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন করা হয়েছে। বিচারবিভাগকে সম্পূর্ণরূপে স্বাধীনতা দিতে এবং নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচারবিভাগকে আলাদা করার জন্য প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। বিচারবিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণ এর জন্য শুধু ইতিবাচক সুপারিশই নয় বরং অনমনীয় করা হয়েছে। আইনের আধিপত্য স্থাপন করা হয়েছে; এই ক্ষেত্রে কেউ কোনো ব্যতিক্রম দাবী করতে পারবে না বা সুবিধা পাবে না। এই প্রস্তাবনাগুলো যদি সংক্ষিপ্তাকারে সাংবিধানিক পরিষদে অনুমোদন পায়, তবে নির্বাহী বিভাগ যেমন একদিকে সংসদের নিয়ন্ত্রণে শৃঙ্খলাবদ্ধ হবে অন্যদিকে স্বাধীন বিচারবিভাগের তত্ত্বাবধানে থাকবে। নির্বাহী বিভাগকে আরও ক্ষমতা দেওয়ার ব্যাপারে হয়ত বিতর্ক থেকে যায়, তবে আমাদের মতে তা সম্পূর্ণরূপে গণতান্ত্রিক হতো না ।
এখন আমি সরকারের গঠনতন্ত্রে আসি। প্রদেশ এবং কেন্দ্র, উভয়ক্ষেত্রেই নির্বাহীবিভাগ সংসদগুলোর কাছে দায়বদ্ধ থাকবে এবং তাদের অনাস্থার ক্ষেত্রে কার্যহীন হতে বাধ্য থাকবে। প্রদেশগুলোতে আইনসভা হবে এককক্ষ বিশিষ্ট এবং কেন্দ্রে তা হবে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট। এতদসত্ত্বেও গনপরিষদ সভার কাছেই থাকবে প্রকৃত কর্তৃত্ব। আর দ্বিতীয় কক্ষ শুধুমাত্র দ্রুত আইন পর্যালোচনার প্রস্তাবনা পেশের সুবিধা ভোগ করবে। এর আগেও যেমন বলেছি, কেন্দ্রীয় মন্ত্রণালয় শুধুমাত্র গণপরিষদ সভার নিকট দায়বদ্ধ থাকবে এবং সকল আর্থিক প্রস্তাব এর সূচনা সেখান থেকেই হবে। প্রাদেশিক আইনসভা এবং কেন্দ্রের গণপরিষদ সভা সকল প্রাপ্তবয়স্ক ভোটারদের মাধ্যমেই নির্বাচিত হবে। কোন বিশেষ কারণেই কোন আসন বরাদ্দ থাকবে না অথবা কোনো শ্রেণীকে কোনো গুরত্ব দেওয়া হবে না, হোক তা মনোনয়ন কিংবা বিশেষ কোন নির্বাচকমণ্ডলী সৃষ্টির মাধ্যমে।
সংখ্যালঘুদের অধিকার ও সুবিধাসমূহ নিয়ে তৈরীকৃত অন্য কমিটির একটি প্রতিবেদন, যা এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজনীয় নয়; কিন্তু মৌলিক নীতিনির্ধারণ কমিটি তাদের উন্নয়নের কথা একান্তভাবে চিন্তাভাবনা করে, তাদের প্রতিনিধিত্বের ব্যাপারে ভেবেছে যে, বাইরের কোনো হস্তক্ষেপ ছাড়া বিভিন্ন আইনসভায় তারা তাদের নিজস্ব প্রতিনিধি নির্বাচিত করাই তাদের প্রধান রাজনৈতিক নিরাপত্তা হবে। পরিশেষে, সর্বস্তরের প্রাপ্তবয়স্ক ভোটারদের দ্বারা নির্বাচিত কক্ষের উপএওই সকল ক্ষমতা ন্যস্ত থাকছে । আমি অকৃত্রিম গর্বের অনুভূতি নিয়ে বলতে চাই যে মৌলিক নীতিনির্ধারণ কমিটি একটি পরিপূর্ণ গণতান্ত্রিক সংবিধানের প্রস্তাবনা দিয়েছে এমনকি যা আগের আগের অনেক পুরনো গনতন্ত্রের সংবিধান থেকেও অধিক গণতান্ত্রিক।
প্রস্তাবিত সংবিধানের অধীনে শুধুমাত্র বিশ্বাস ও আদর্শ হিসাবে যা গৃহিত তা ব্যতিত জনগণের ইচ্ছার কোন শৃঙ্খল থাকবে না ।
আমি সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করি যেন সর্বোচ্চ ক্ষমতার কার্যকরী ও বিজ্ঞ ব্যবহার দেশের সর্বোচ্চ আদর্শ ও সর্বোত্তম স্বার্থের পথে হয়; এমন একটি সংবিধানের প্রস্তাবনা আমাদের জনগনের বিজ্ঞতার উপর আস্থা স্থাপন, যা হয়ত এখন আমাদের জনগনের রাজনৈতিক প্রজ্ঞার অভাবে যৌক্তিক মনে হচ্ছে না কিন্তু আশা করা যায়, এটি সেই রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার পথপ্রদর্শক হবে যা একাই একটি জাতিকে গণতান্ত্রিক কর্তৃত্ব চর্চার পথ ও উপায় শেখাতে পারে। আমরা এসব প্রস্তাবনাসমূহ উত্থাপন করছি কারণ আমরা বিশ্বাস করি এবং আস্থা রাখি অসীম জ্ঞানী সৃষ্টিকর্তা আমাদের জনগণকে প্রতি পদক্ষেপে নির্দেশনা দেবেন এবং সুখ, সমৃদ্ধি এবং ইসলাম ও মানবতার সেবার লক্ষে তাদেরকে পরিচালিত করবেন। আমরা যদি আমাদের ভেতরে আদর্শগুলোকে আমাদের বিশ্বাসে স্থির রাখতে পারি, আমার ন্যুনতম সন্দেহও নেই যে আমাদের প্রচেষ্টা অবশ্যই একদিন পুরস্কৃত হবে।
সংবিধানকে কখনোই শিক্ষাগত রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পূর্ব পরিকল্পিত ধারণার সাধারণ নীতির উপর ভিত্তি করে বিচার করা উচিত হবেনা। এটাকে অবশ্যই জাতির বিভিন্ন বিভাগে সর্বোচ্চ পরিমান অর্জনের ভিত্তিতে বিবেচনা করা উচিত। বিশুদ্ধ রাজনৈতিক দলিল হিসাবে বিবেচনা করতে হবে, এই প্রতিবেদনে চাহিদা থাকবে না, তবে আমাদের বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে প্রধান চুক্তিগুলো প্রতি মূর্ত হিসাবে থাকবে যেখানে এই রিপোর্টকে উল্লেখযোগ্য অর্জন হিসাবে গণ্য করা হবে। গণতান্ত্রিক ইসলামী সংবিধান অনুযায়ী অ-মুসলিম সংখ্যালঘুদের স্বার্থ সংরক্ষণ করতে এটি একটা মূলনীতি নির্ধারন করে; প্রস্তাবিত সংবিধান ফেডারেশনের সাথে ঘনিষ্টভাবে স্বায়ত্বশাসিত রাজ্য তৈরী করবে ; প্রথমবারের মত এটা লক্ষ লক্ষ নাগরিক এর উপর সম্পূর্ণ রাজনৈতিক ক্ষমতা অর্পণ করবে ও তাদের সরাসরি নির্বাচিত প্রতিনিধিদের উপর সর্বোচ্চ ক্ষমতা প্রদান করবে। এটা সামাজিক বিচার ব্যবস্থা ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতা সুগঠিত করবে।তাছাড়া এটা ধর্ম-চর্চা ও প্রশিক্ষনের এবং নৈতিকতার মান বজায় রাখার নিশ্চয়তা দিবে ; এটা সকল ধরনের জুলুম ও বিশেষ সুবিধা বাতিল করবে। সংক্ষেপে বলা যায়, যা আমাদের পুরো জাতিকে শেকলে আবদ্ধ করে রেখেছে এবং এর সমৃদ্ধিকে বাধাগ্রস্ত করেছে- এটা এমন সব ধরনের বিপত্তি দূর করবে ।সংবিধান বাস্তবায়নের পরে, পুরো জাতির জন্য,অর্জিত স্বাধীনতার ব্যবহার এবং প্রয়োজনীয় ইতিবাচক অগ্রগতি ও সমৃদ্ধির জন্য ।জনগনের হাতেই জাতির ভাগ্য নির্ধারিত হবে;তাদেরকে শুধুমাত্র তাদের এই ক্ষমতা ব্যবহার করতে হবে বুদ্ধিমত্তার সাথেএবং তাদের মহান অতীতের নিরীখে যথাযথ একটি ভবিষ্যত নির্মানের লক্ষ্যে।
জনাব, এই কথাগুলো বলে আমি এই সংসদে এই প্রতিবেদন সমর্পন করছি।