শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
মুক্তিযুদ্ধ ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টি | পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টির প্রচারপত্র | ৭ জুন,১৯৭১ |
পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির নেতৃত্বে বরিশাল ও অন্যান্য জেলায় জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ চলছে, একে সমর্থন করুন! জাতীয় শত্রু খতমের মাধ্যমে সমগ্র পূর্ব বাংলায় গেরিলা যুদ্ধ চালিয়ে যান! জাতীয় মুক্তিফ্রন্ট গঠন করে নিজেদেরকে ঐক্যববদ্ধ করুন! নিজেদের শক্তির উপর নির্ভর করে পূর্ব বাংলায় জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করুন।
পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি কর্তৃক পূর্ব বাংলার জনগনের উদ্দেশ্য প্রচারিত। (পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি, পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন কর্তৃক ৩রা জুন,১৯৭১ প্রতিষ্ঠিত)
(১)
পূর্ব বাংলার বীর জনগণ পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক সামরিক ফ্যাসিস্টদের সুদীর্ঘ তেইশ বৎসরের ঔপনিবেশিক শোষন ও লুন্ঠনের পাহাড় উপরে ফেলার জন্য দেশের অফিস-আদালত -যোগাযোগ-ব্যবসা-বানিজ্য বন্ধ করে দেয় | এভাবে তারা সমগ্র পূর্ব বাংলার পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাষকগোষ্ঠীর লুন্ঠন ও শোষনের যন্ত্রকে বিকল করে দেয় |
ঔপনিবেশিক সামরিক ফ্যাসিস্টরা জনগনের জাতীয় মুক্তির শান্তিপূর্ণ সংগ্রাম দমন করার জন্য বাংলার রাজধানী ঢাকার বুকে চরমতম ফ্যাসিবাদী বর্বরতা প্রদর্শন করে এবং অন্যান্য শহরে সৈন্য মোতায়েন করে হত্যা, লুট,অগ্নিসংযোগ ও গ্রেফতার চালায় |
যেখানেই অত্যাচার সেখানেই বিদ্রোহ-বিপ্লব |অহিংস অসহযোগের ভুল পথ পরিত্যাগ করে জনসাধারণ ফ্যাসিবাদী বর্বর হামলার বিরুদ্ধে অস্ত্রহাতা বিদ্রোহী দেশপ্রেমিক বেঙ্গল রেজিমেন্ট,ইপিআর,পুলিশ, আনসার,সরকারি কর্মচারী,ছাত্র, শ্রমিক, কৃষক,বুদ্ধিজীবী অর্থাৎ পূর্ব বাংলার সমগ্র জনসাধারণ অস্ত্রহাতে রুখে দাঁড়ায় এবং অধিকাংশ জেলা দখল করে নেয়,সামরিক দস্যুদের সেখানে খতম করে এবং ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও করে|
পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক সামরিক ফ্যাসিস্টরা পুনরায় সমগ্র পূর্ব বাংলায় তাদের দখল কায়েমের জন্য বিরাট শক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং হত্যা,লুট,অগ্নিসংযোগ এবং ধর্ষণের তান্ডবলীলা শুরু করে | বিশেষ করে হিন্দু জনসাধারণের উপর তারা যে অত্যাচার চালায় তা হিটলারের ইহুদীবিরোধী তৎপরতাকে ম্লান করে দিয়েছে | এভাবে তারা পৃথিবীর বুকে অত্যাচারের নির্মমতম নজীর স্থাপন করে | সঠিক নেতৃত্ব ও পথে পরিচালিত না হওয়ায় সশস্ত্র দেশপ্রেমিক প্রতিরোধ ভেঙ্গে পড়ে,সামরিক দস্যুরা সমগ্র পূর্ব. বাংলাব্যাপী তাদের ফ্যাসিস্ট ঔপনিবেশিক দখল করতে সক্ষম হয়|
(২)
পূর্ব বাংলার শ্রমিক আন্দোলন প্রতিনিয়ত আওয়ামীলীগ ও তার নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী,সকল দেশপ্রেমিক পার্টি ও জনসাধারণের প্রতি ঐক্যবদ্ধ হয়ে সঠিক পথে সংগ্রাম পরিচালনা করতে আহ্বান জানায় | বরিশাল জেলার ঝালকাঠীর মুক্তিবাহিনী ও আওয়ামী লীগের দেশপ্রেমিকরা আহ্বানে সাড়া দেয় | তাদের অংশগ্রহণসহ অন্যান্য দেশপ্রেমিকদের নিয়ে স্থানীয় ভিত্তিতে জাতীয় মুক্তিফ্রন্ট গঠন করা হয় |
ঐক্যবদ্ধ মুক্তিবাহিনী তফসিলী হিন্দু সম্প্রদায় অধ্যুষিত পূর্ব বাংলার বৃহত্তম পেয়ারা বাগান কুরিয়ানা,ডুমুরিয়া,ভীমরুলী এলাকায় গেরিলা যুদ্ধ পরিচালনা করে|
এই গেরিলা যুদ্ধের রূপ হয় প্রধানত জাতীয় শত্রু খতম করা | অতি অল্প সময়ের মধ্যেই কয়েকশত জাতীয় শত্রু খতম করা হয়,দুজন পুলিশসহ দুই ইজ্ঞিন বিশিষ্ট একটি স্পীড বোট দখল করা হয়|
মে মাসের প্রথম থেকে শুরু করে প্রায় দেড়মাস সময়কালীন এ অঞ্চলের গেরিলা যুদ্ধে পাকিস্তানি সামরিক দস্যুরা এত ভীতসন্ত্রস্ত হয় যে,তারা বরিশাল জেলার প্রায় সমস্ত সৈন্য এবং অনেক থানার পুলিশ নিয়ে এ অঞ্চল ঘেরাও করে |তারা জলপথে কারফিউ জারী করে,গানবোট,সপীডবোট,লঞ্চ দিয়ে দিনরাত পাহারা দেয়,বরিশাল জেলার কয়েক হাজার মুসলিম জনসাধারণকে হত্যার ভয় দেখিয়ে পেয়ারা গাছ কাটা,মুক্তিবাহিনীকে খোঁজ করা,হিন্দুদের বাড়ি লুট করা,তাদেরকে খতমের জন্য নিয়ে আসে|
এ অঞ্চলের সমস্ত ঘরবাড়ি তারা জ্বালিয়ে দেয়,লুট করে,শত শত লোককে হত্যা করে,পেয়ারা গাছ কেটে ফেলে,কিন্তুু মুক্তিবাহিনীর সন্ধান তারা পায়নি | মুক্তিবাহিনী তাদের ঘেলাও পার হয়ে বরিশাল জেলার বিভিন্ন স্থানে জাতীয় শত্রু খতমের মাধ্যমে গেরিলা যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে | কোন শক্তিই তাদেরকে ধ্বংস করতে পারবেনা| বরিশালের গেরিলা যুদ্ধের সমর্থনে পূর্ব বাংলার অন্যান্য স্থানে জাতীয় শত্রু খতমের মাধ্যমে গেরিলা যুদ্ধ চলছে |
(৩)
পূর্ব বাংলার জাতীয় প্রশ্ন নিয়ে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও সোভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদীরা আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রে মেতেছে| তারা লুন্ঠন-শোষন বজায় রাখা এবং চীন জনগন কমিউনিজম বিরোধিতার জন্য গোটা পাকিস্তান ও ভারত যৌথ সামরিক জোট বা পূর্ব বাংলা-ভারত যৌথ সামরিক জোট স্থাপনের দ্বিমুখী লক্ষ্য সামনে রেখে, তাদের সমর্থকদের নেতৃত্বে পূর্ব বাংলার জাতীয় সংগ্রামকে ব্যবহার করছে |পাকিস্তান যাতে তাদের হাতছাড়া না হয় এ জন্য তারা একে সাহায্য ও সহায়তা করছে|এ উদ্দেশ্যে তারা নিজেদের মাঝে সহযোগিতা করছে আবার পাকিস্তান-বাংলাদেশের উপর একচেটিয়া প্রভাব স্থাপনের জন্য নিজেদের মাঝে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও করছে|
মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ, সোভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ, আমলাতান্ত্রিক পূঁজিবাদ ও সামন্তবাদ এই চার পাহাড়ের শোষনের প্রতিনিধিত্বকারী ভারতীয় প্রতিক্রিয়াশীল শাষকগোষ্ঠী তাদের সমর্থকদের নেতৃত্বে পূর্ব বাংলার মুক্তিসংগ্রাম সমর্থন ও সহায়তা করছে| তাদের উদ্দেশ্য হলো পূর্ব বাংলায় এই চার পাহাড়ের শোষন ও লুন্ঠন কায়েম করা এবং চীনবিরোধী জনগন ও কমিনিস্ট বিরোধী বাংলা-ভারত যৌথ সামরিক জোট স্থাপন করা|
● অতীতে নেতাজী সুভাষ বোস ভারতের আনয়নের জন্য জাপানী ফ্যাসিস্টদের সহায়তায় আজাদ হিন্দু ফৌজ ও সরকার গঠন করে এবং জাপান-জার্মান ফ্যাসিস্টদের মিত্র হিসেবে কাজ করে| জাপানী ফ্যাসিস্টদের সহায়তার প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল আজাদ হিন্দু ফৌজ ও সরকারকে নিজের সাহায্যকারী শক্তি হিসেবে ব্যবহার করা| দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরাজয় জাপানীদের এ স্বপ্ন নস্যাৎ করে দেয়| এভাবে প্রতিক্রিয়াশীলদের সহায়তায় ভারতকে মুক্ত করার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়|
অতীত. ও বর্তমান বিশ্বের ঘটনাবলী আমাদের শিক্ষা দেয় মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ, সোভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ ও ভারতীয় প্রতিক্রিয়াশীলদের সহায়তায় কখনই পূর্ব বাংলা বা বিশ্বের অন্য কোন দেশ,জাতি ও জনগনের সত্যিকার মুক্তি আসতে পারে না এদের সহায়তা জাতীয় মুক্তি সংগ্রামকে হয় বানচাল করবে বা জাতীয় মুক্তির নামে চার পাহাড়ের শোষন ও লুন্ঠন পূর্ব বাংলায় কায়েম করবে|
পূর্ব বাংলার দেশপ্রেমিক জনগন ও বিশ্বের বিপ্লবী জনগন পূর্ব বাংলার জাতীয় প্রশ্নে সাম্রাজ্যবাদ,সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ ও ভারতীয় সম্প্রসারণবাদের এ সকল জঘন্য চক্রান্তকে কখনই সমর্থন করতে পারে না|
কাজেই পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক শাষকগোষ্ঠীকে উৎখাত করার সাথে সাথে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ,সোভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদকে ও পূর্ব বাংলা থেকে উৎখাত করতে হবে এবং ভারতীয় সম্প্রসারণআবাদের মাধ্যমে চার পাহাড়ের শোষন কায়েমের বিরোধিতা করতে হবে এবং প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির সাহায্যের উপর ভিত্তি না করে নিজেদের শক্তির উপর নির্ভর করে সংগ্রাম পরিচালনা করতে হবে|
(৪)গত কয়েক মাসের অভিজ্ঞতা প্রমান করেছে পূর্ব বাংলার জনগনের মহান জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম সঠিকপথে পরিচালিত করার জন্য একটি বিপ্লবী রাজনৈতিক পার্টির প্রয়োজন | এইরূপ একটি বিপ্লবী পার্টি প্রতিষ্ঠার জন্য পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন গত সাড়ে তিন বৎসর ধরে বিপ্লবী কাজ করে আসছে | এ সময়কার বিপ্লবী অনুশীলনে পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলনের রাজনৈতিক,সাংগঠনিক,সামরিক লাইনের সঠিকতা ঐতিহাসিক ভাবে প্রমানিত হয়েছে| পক্ষান্তরে মণি সিং-মোজাফফর সংশোধনবাদী,হক-তোয়াহা নয়া সংশোধন বাদী দেবেন-মতিন-ট্রটস্টিক চে’বাদী,কাজী-রনো ষড়যন্ত্রকারী বিশ্বাসঘাতক চক্র রাজনৈতিক,সামরিক ও তত্ত্বগত ক্ষেত্রে সম্পূর্ণরূপে পরাজিত হয়েছে| পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলনের কর্মীরা জাতীয় মুক্তির গেরিলা যুদ্ধ সূচনা ও পরিচালনা করার মাধ্যমে জাতীয় মুক্তিবাহিনী গড়ে তুলেছে ; দেশপ্রেমিক জনসাধারণকে ঐক্যবদ্ধ করে জাতীয় মুক্তিফ্রন্ট গড়ে তুলেছে ; বিপ্লবী অনুশীলনের প্রক্রিয়ার মতাদর্শগত ক্ষেত্রে পুর্নগঠিত হচ্ছে | এভাবে সর্বহারা রাজনৈতিক পার্টি প্রতিষ্ঠার যথাযথ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে|
এ কারনে পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন তার ঐতিহাসিক ভূমিকা সমাপ্ত করে পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি প্রতিষ্ঠা করেছে| ইহা পূর্ব বাংলার সর্বহারা শ্রেনীর রাজনৈতিক পার্টি এবং এর পথপ্রদর্শক. তাত্ত্বিক ভিত্তি হলো মার্কসবাদ লেনিনবাদ মাও সেতুঙ চিন্তাধারা| ইহা হচ্ছে বিশ্বের বিপ্লবী সংগ্রামবের অভিজ্ঞতার সার সংকলন, ইহা বিপ্লবের বিজ্ঞান | ইহার প্রয়োগের মাধ্যমেই পূর্ব বাংলার বিপ্লব বাস্তবায়িত হবে|
পূর্ব বাংলার বাঙালি জাতির অস্তিত্ব আজ বিপন্ন ;পূর্ব বাংলার সকল সংগ্রাম রু দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক পার্টি, ব্যক্তি, গোষ্ঠী, ধর্মীয়, ভাষাগত উপজাতীয় সংখ্যালঘু,মুক্তিবাহিনী, বিভিন্ন শ্রেণী, স্তর,অর্থাৎ পূর্ব বাংলার সমগ্র জনগন ঐক্যবদ্ধ হোন;বরিশালের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে জাতীয় মুক্তিফ্রন্ট গঠন করুন; নিজেদের শক্তির উপর নির্ভর করে জাতীয় শক্তি খতমের মাধ্যমে গেরিলা যুদ্ধ চালিয়ে যান;জাতীয় শত্রুর অস্ত্রে নিজেদেরকে সজ্জিত করুন;গ্রামসমূহ থেকে পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক সরকারের দালালদের উৎখাত করুন;গ্রামকে মুক্ত করুন;- এভাবে পূর্ব বাংলার ভূমিতে নিজেদের শক্তির উপর নির্ভর করে পাকিস্তানী সামরিক দস্যুদের পরাজিত ও ধ্বংস করুন;পূর্ব বাংলাকে মুক্তি করে স্বাধীন গনতান্ত্রিক, শান্তিপূর্ণ, নিরপেক্ষ, প্রগতিশীল, পূর্ব বাংলার প্রজাতন্ত্র কায়েম করুন|
পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি-জিন্দাবাদ |
জাতীয় মুক্তিফ্রন্ট-কায়েম করুন| জাতীয় মুক্তিবাহিনী-জিন্দাবাদ |
জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ-জিন্দাবাদ|
পাকিস্তানী ঔপনিবেশিক সামরিক দস্যু ও তাদের দালাল জাতীয় শত্রুদের খতম করুন| মণি সিং-মোজাফফর সংশোধনবাদী,দেবেন-মতিন ট্রটস্ফি-তে’বাদী,কাজী, রনো ষড়যন্ত্রকারী-ধ্বংস হোক|