শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
বাংলাদেশের জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম সমন্বয় কমিটির ঘোষণা | বাংলাদেশের জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির ঘোষণাপত্র | ১ জুন, ১৯৭১
|
বাংলাদেশের জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির ঘোষণা
সম্প্রতি মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী ঐক্যবদ্ধভাবে বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামকে অগ্রসর করিয়া লওয়ার যে আহবান ও নির্দেশ দিয়েছেন তাহাকে অবলম্বন করিয়া বাংলাদেশের ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে পরিচালিত) কমিউনিষ্ট বিপ্লবীদের পূর্ব বাংলা সমন্বয় কমিটি পূর্ব বাংলার কমিউনিষ্ট পার্টি (দেবেন শিকদারের নেতৃত্বে), শ্রমিক-কৃষক কর্মীসংঘ, বাংলাদেশের কমিউনিষ্ট পার্টি (হাতিয়ার), পূর্ববাংলা কৃষক সমিতি, পূর্ববাংলা শ্রমিক ফেডারেশন, বাংলাদেশ শ্রমিক ফেডারেশন (পূর্ব পাকিস্তান শ্রমিক ফেডারেশন) এবং পূর্ব বাংলা বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়ন প্রভৃতি রাজনৈতিক ও গণসংগঠনের প্রতিনিধিরা এক সম্মেলনে মিলিত হইয়া “বাংলাদেশ জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম সমন্বয় কমিটি” গঠন করিয়াছে এবং সর্বম্মতভাবে নিম্নোক্ত ঘোষণা প্রণয়ন করিয়া বাংলাদেশের জনগণের নিকট উপস্থাপিত করিতেছেন।
বর্তমান পরিস্থিতি
সারা বাংলাদেশ ও বাঙ্গালী জাতির জীবনে আজ এক চরম মুহূর্ত উপস্থাপিত। পাকিস্তানের ফ্যাসিষ্ট জঙ্গীশাহীর হানাদার বাহিনী ট্যঙ্ক, বোমারু বিমান, মেশিনগান, মর্টার, রকেট, গানবোট প্রভৃতি অত্যাধুনিক অস্ত্রে সুসজ্জিত হইয়া নিরস্ত্র, নিরীহ, শান্তিপ্রিয় বাংলাদেশের জনগণের উপর সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত অবস্থায় শুরু করিয়াছে এমন এক বর্বর হামলা, সভ্য দুনিয়ার ইতিহাসে যাহার তুলনা খুঁজিয়া পাওয়া যায় না। হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ। খ্রিষ্টান, ধর্ম, বর্ণ, নারী, পুরুষ, শিশু, যুবক, বৃদ্ধ নির্বিশেষে সমগ্র সাড়ে সাত কোটি জনতাই এই হানাদার দস্যুদের বর্বর নির্যাতনের শিকারে পরিণত হইয়াছে। বাংলাদেশের এমন কোন শহর, গ্রাম বা অঞ্চল নাই যেখানে এই পরদেশ লুন্ঠনকারী দস্যুর দল নির্বিচারে গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ, ধনসম্পত্তি বিনষ্ট, লুটতরাজ ও নারী নির্যাতন করে নাই। পাকিস্তানের ফ্যাসিষ্ট জঙ্গীশাহীর এই হামলা অত্যন্ত আকস্মিক ও বর্বর। দীর্ঘ চব্বিশ বছর গোটা বাঙালী জাতি রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দিক হইতে চরমভাবে নিপীড়িত হইবার পর এইবারই সর্বপ্রথম জাতীয় মুক্তির আশার আলো দেখিতে শুরু করিয়াছিল। জাতীয় মুক্তি এই সুতীব্র আকাঙ্খা লইয়াই বাংলাদেশের শ্রমিক-কৃষক-ছাত্র-মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবি তথা সমগ্র জনতা ইতিপূর্বে বারবার রক্তঝরা সংগ্রামের পথে অগ্রসর হইয়াছিল। এই জনতাই মুক্তির দুর্বার আকাঙ্খা লইয়া হাজার হাজার বীর সন্তানের রক্তের বিনিময়ে সৃষ্টি করিয়াছিল ১৯৬৮-৬৯ সালের গৌরবোজ্জ্বল সুমহান গণঅভ্যুত্থান। ১৯৭০ সালের বির্বাচনে বাংলার জনগণ আবার সেই জাতীয় মুক্তির কামনাকেই বুকে করিয়া একচেটিয়াভাবে আওয়ামী লীগকে ভোটদান করিয়াছিল। তাহারা আশা করিয়াছিল শান্তিপূর্ণ উপায়ে দীর্ঘ চব্বিশ বছরের নিপীড়ন ও নির্যাতনের অবসান করিয়াছিল। কিন্তু ঠিক সেই মুহুর্তে নিরস্ত্র অপ্রস্তুত জনতার উপর নামিয়া আসিল শাসকগোষ্ঠীর সশস্ত্র হামলা। তবে এই হামলা জনগণের আকাঙ্খা অবদমিত করিতে পারে নাই বরং শোষকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ঘৃণাকে আরও বেশী করিয়া তীব্র করিয়া তুলিয়াছে। তাই অপ্রস্তুত অবস্থায় হইলেও জনগণ প্রতিরোধ সংগ্রাম শুরু করিয়াছে। যে যেভাবেই পারিয়াছে সশস্ত্র আক্রমণের পাল্টা আক্রমণ করিয়াছে। বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ই পি আর, পুলিশ ও বাংলার অসংখ্য তরুণ হানাদারদের বিরুদ্ধে শুরু করিয়াছে সশস্ত্র অভিযান। বাংলাদেশের জনগণ আজ নির্মম অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়া এই শিক্ষা লাভ করিয়াছে যে শান্তিপূর্ণ উপায়ে আপসের পথে বাংলার জনগণকে বাঁচিয়া থাকার তাগিদেই আজ হানাদার দস্যুদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র লড়াই অব্যাহত রাখিতে হইবে।
জাতীয় মুক্তিফ্রন্ট গড়ার আহবান
বাংলাদেশের এই অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা মনে করি বাংলার সমগ্র জনতাকে ঐক্যবদ্ধভাবে লড়াইয়ের পথে অগ্রসর হইত হইবে। প্রতিটি রাজনৈতিক দল ও গ্রুপ, গণ-সংগঠন ও শ্রেণী-সংগঠন এবং প্রতিটি নাগরিকের মহান কর্তব্য পরষ্পরের মধ্যে সমঝোতা রক্ষা করিয়া ঐক্যবদ্ধভাবে দেশমাতৃকার শৃংখল মোচনের সুমহান ব্রত লইয়া মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহন করা। কেননা এই যুদ্ধ সমগ্র জাতির যুদ্ধ, সমগ্র জনগণের যুদ্ধ। সমগ্র জনগণের অংশগ্রহন ব্যাতিরেকে আধুনিক অস্ত্র-শস্ত্রে সুসজ্জিত হানাদার সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে জয়লাভ করা সম্ভব নয়। এই বাস্তব উপলব্ধির ভিত্তিতে মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী যে আহবান ও নির্দেশ দিয়েছেন তাহাকে অবলম্বন করিয়া ১লা জুন বাংলাদেশের কতিপয় রাজনৈতিক দল, গ্রুপ, ব্যক্তি, গণ-সংগঠন ও শ্রেণী-সংগঠন একত্রিত হইয়া “বাংলাদেশের জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম সমন্বয় কমিটি” গঠন করিয়াছেন। এই সমন্বয় কমিটির আশু লক্ষ্য হইল সুনির্দিষ্ট কর্মসূচী ও কর্মপদ্ধতির ভিত্তিতে বাংলাদেশের সরকারের ও মুক্তিসংগ্রামরত সকল শক্তির সহিত সংযোগ ও সমন্বয় সাধন করিয়া জাতীয় মুক্তিযুদ্ধকে সাফল্যের পথে অগ্রসর করিয়া লওয়া। আমরা বিশ্বাস করি, বাংলাদেশের জাতীয় মুক্তিসংগ্রামকে সফল করিয়া তুলিবার জন্য প্রয়োজন সকল দলমত ও ব্যক্তির সমবায়ে গঠিত সুসংহত ও ঐক্যবদ্ধ জাতীয় মুক্তিফ্রন্টের। তাই এই সমন্বয় কমিটির তরফ হইতে আমরা আওয়ামী লীগসহ স্বাধীনতাকামী অন্যান্য সকল রাজনৈতিক দল, গ্রুপ, গণ-সংগঠন, শ্রেণী-সংগঠন ও দেশপ্রেমিক ব্যক্তিবর্গের নিকট এইরূপ একটি জাতীয় মুক্তিফ্রন্ট গঠনের আহবান জানাইতেছি।
চূড়ান্ত লক্ষ্য
এই সমন্বয় কমিটির চূড়ান্ত লক্ষ্য হইল বাংলাদেশকে হানাদার দস্যুদের হাত হইতে মুক্ত করিয়া বাংলার বুকে সাম্রাজ্যবাদ, সামন্তবাদ ও একচেটিয়া পুঁজিবিরোধী একটি স্বাধীন, সুখী, সুন্দর গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা। ইহা হইবে এমনই একটি সমাজ ব্যবস্থা যেখানে যুগ যুগ ধরিয়া শোষিত কৃষক জোতদারী-মহাজনী শোষণের নাগপাশ হইতে একটি সত্যিকারের মুক্তিলাভ করিবে, যেখানে জমির উপর তাহার মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হইবে, যেখানে শ্রমিক পাইবে স্ত্রী-পুত্র-কন্যা-পরিবারসহ মানুষের মতো বাঁচিবার গ্যারান্টি, যেখানে বেকারত্ব অভিশাপ থাকিবে না, যেখানে ছাত্রের জন্য থাকিবে বিজ্ঞানভিত্তিক সার্বজনীন গণতান্ত্রিক শিক্ষাব্যবস্থা, যেখানে বুদ্ধিজীবির জন্য থাকিবে সৃজনশীল প্রতিভা বিকাশের পরিপূর্ণ সুযোগ। প্রতিটি নাগরিকের জন্য থাইবে পরিপূর্ণ রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় স্বাধীনতা। এই সমাজ নারীর স্বাধীনতা ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করিবে। উন্নতমানের কৃষিব্যবস্থা ও শিল্পবিকাশের মাধম্যে গড়িয়া তুলিব আত্মনির্ভরশীল অর্থণীতি ও একটি সমৃদ্ধশালী দেশ। এক কথায় এই সমাজ ব্যবস্থায় সমগ্র জনগণের জন্য থাকিবে অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসা প্রভৃতির নূন্যতম গ্যারান্টি। এই বাংলা হইবে শ্রমিক, কৃষক, মেহনতি মানুষ, মধ্যবিত্ত, দেশপ্রেমিক ধনিক শ্রেণীর বাংলা-জনতার বাংলা।
আশু করণীয়
উপরোক্ত লক্ষ্য অর্জন করিবার জন্য পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীকে প্রতিহত ও সম্পুর্ণরূপে উৎখাত করিবার কর্মসূচী হইতেছে সমন্বয় কমিটির আশু কর্তব্য। আমাদের এই কর্তব্য মহান ও কঠিন। যেহেতু হানাদারবাহিনী সামরিক দিক দিয়ে শক্তিশালী, অন্যদিকে যেহেতু জনগণের হাতে অস্ত্র নাই, সেহেতু এই সমন্বয় কমিটি মনে করে যে গেরিলা যুদ্ধের কায়দায় ক্রমান্বয়ে শত্রুকে দুর্বল করিয়া এবং নিজেদের শক্তি সঞ্চয় করিয়া দীর্ঘ প্রক্রিয়ার ভিতর দিয়াই অগ্রসর হইতে হইবে। অন্যদিকে যেহেতু হানাদারবাহিনী বিদেশী বর্বর এবং সাড়ে সাত কোটি জনতার তুলনায় তাহাদের লোকবল অত্যন্ত নগণ্য, সেহেতু এই যুদ্ধে জনগণের জয় যে সুনিশ্চিত সে সম্পর্কেও এই সমন্বয় কমিটি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে। এই সমন্বয় কমিটি আরও মনে করে যে, সমগ্র জনগণের শক্তির পূর্ণ ব্যবহারের উপরই যুদ্ধের সাফল্য নির্ভর করে। কোন বিদেশী শক্তির উপর নির্ভর করিয়া নয়, নিজেদের শক্তিতে বলীয়ান হইয়াই এই মুক্তিযুদ্ধ চালাইয়া যাইতে হইবে। জনতার মধ্য হইতে সশস্ত্র গণফৌজ গড়িয়া তোলার লক্ষ্যকে সম্মুখে রাখিয়া আমাদের গেরিলা যুদ্ধের সূচনা করিতে হইবে। জনতার সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ কৃষকরাই হইবে গণফৌজের মূল শক্তি। বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ গ্রামাঞ্চল হইবে সশস্ত্র গেরিলা যুদ্ধের ঘাঁটি। এই গেরিলা যুদ্ধ পরিচালিত হইবে বাংলাদেশের মুক্তিফৌজের সহিত যোগাযোগ রক্ষা ও সমন্বয় সাধন।
তাই জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের এই পর্যায়ে সমন্বয় কমিটি জনগণের নিকট নিম্নলিখিত করণীয় কর্তব্য উপস্থিত করিতেছেঃ
১। বাংলাদেশের প্রতিটি গ্রামে জনতার বিভিন্ন অংশের প্রতিনিধি সমবায়ে সর্বদলীয় গণ-মুক্তি পরিষদ গঠন করিতে হইবে। এই গণ-মুক্তি পরিষদ গ্রামের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, প্রশাসনিক ও সর্বিবিধ কর্তৃত্ব গ্রহণ করিবে, গ্রামরক্ষীবাহিনী গঠন ও পরিচালনা করিবে এবং গণ-আদালত গঠন করিয়া বিচার ব্যবস্থা পরিচালনা করিবে।
২। পাক-জঙ্গীশাহী সরকারকে দেয়া খাজনা, ট্যাক্স, ঋণ ও সুদ পরিশোধ সম্পূর্ণরূপে বন্ধ রাখিতে হইবে।
৩। যাহারা অতিরিক্ত মুনাফার আশায় প্রয়োজনতিরিক্ত খাদ্যশস্য মজুদ রাখিবে গ্রাম গণ-মুক্তি পরিষদ তাহাদের সেই উদ্বৃত্ত খাদ্যশস্য বাজেয়াপ্ত করিয়া গরীব জনসাধারণের মধ্যে বিক্রয়ের ব্যবস্থা করিবে।
৪। গ্রাম গণ-মুক্তি পরিষদ গ্রামে গরীব-জনসাধারণের উপর নিপীড়নমূলক মহাজনী ব্যবস্থা বন্ধ করিবে।
৫। ক) যাহারা পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর সহিত কোন প্রকার সহযোগিতা ও সাহায্য প্রদান করিবে অথবা চর হিসেবে কাজ করিবে, গ্রাম গণ-মুক্তি পরিষদ তাহাদের কঠোরতম শাস্তি প্রদান করিবে এবং তাহাদের সকল সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করিয়া গরীব ও ভূমিহীন কৃষকদের মধ্যে বিতরণ করিবে।
খ) যে সকল জোতদার জাতীয় মুক্তির সপক্ষে থাকিবে তাহাদের সহিত পারষ্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে এমন ব্যবস্থা গ্রহণ করিবে হইবে যাহাতে গরীব কৃষক ও ক্ষেতমজুরদের উপর জোতদারের পূর্বতন শোষণ লাঘব হয়।
৬। বাংলাদেশের যে সকল নাগরিক বাস্তুহারা হইয়া দেশত্যাগ করিতে বাধ্য হইয়াছেন গ্রাম গণ-মুক্তি পরিষদ তাহাদের যাবতীয় সম্পত্তি তত্ত্বাবধান করিবে।
৭। যথোপযুক্ত বিলিবণ্টন, উৎপাদন বৃদ্ধি, কেনাবেচা, কুটিরশিল্পের বিকাশ সাধন প্রভৃতির মাধম্যে গ্রাম এলাকার আত্মনির্ভরশীল স্বয়ংসম্পূর্ণ অর্থনীতি গড়িয়া তুলিতে হইবে। এই ব্যবস্থার মূল ভিত্তি হইবে পারষ্পারিক সাহায্য ও সহযোগিতা (mutual aid and mutual cooperation)।
৮। শিক্ষা ও সংস্কৃতি ক্ষেত্রে জাতীয় ভাবধারা সৃষ্টি করিতে হইবে। প্রচলিত শিক্ষা ও কুলষিত সাংস্কৃতিক রীতিনীতি সম্পূর্ণভাবে বর্জন করিতে হইবে।
৯। ক) গ্রামে গ্রামে কৃষক-শ্রমিক-ছাত্র ও অন্যান্য জঙ্গী তরুণদের সমবায়ে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গেরিলাদের গঠন করিতে হইবে। এই গেরিলাদল সুযোগ ও সুবিধামত বিচ্ছিন্নভাবে অবস্থিত শত্রুকে খতম ও ক্ষতিসাধন করিবে এবং শত্রুর অস্ত্র কাড়িয়া লইয়া নিজেদের অস্ত্রবল বৃদ্ধি করিবে।
খ) হানাদা বাহিনী বাংলাদেশের মাটিতে যাহাতে নির্বিঘ্নে চলাফেরা, অস্ত্র-শস্ত্র, রসদপত্র সংগ্রহ ও সরবরাহ করিতে না পারে এবং নির্বিবাদে শাসন ও শোষণ চালাইতে না পারে, তাহার জন্য সকল প্রকার যোগযোগ ব্যবস্থা ও সরবরাহ লাইন ইত্যাদির ক্ষতিসাধন করিতে হইবে।
গ) গেরিলাদলকে জনগণের আস্থা ও ভালবাসা অর্জনের জন্য
-জনগণকে শ্রদ্ধা করিতে হইবে।
-জনগণকে সাহায্য করিতে হইবে।
-জনগণকে রক্ষা করিতে হইবে।
ঘ) গেরিলা দল সামরিক দায়িত্ব সম্পাদনের সাথে সাথে জনগণের মধ্যে জাতীয় মুক্তির সপক্ষে রাজনৈতিক প্রচার আন্দোলনও চালাইবে।
ঙ) যে সকল ব্যক্তি হানাদার পাক-সরকার ও পাক বাহিনী অথবা তাহাদের এজেন্টদের সহিত সেচ্ছায় রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামরিক অথবা যে কোন প্রকার সাহায্য ও সহযোগিতা করিবে তাহারা জাতীয় শত্রু বলিয়া পরিগণিত হইবে। পূর্ণ তদন্ত করিয়া সমষ্টিগত ভিত্তিতে তাহাদের খতম অথবা যে কোন প্রকার শাস্তি প্রদান করা হইবে।
১০। যাহারা জনগণের মনোবল নষ্ট করিবার জন্য গোপনে বা প্রকাশ্যে কোন প্রকার প্রচারকার্য চালাইবে তাহাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করিতে হইবে।
১১। যাহারা জনগণের দুরবস্থার সুযোগে ডাকাতি, গুন্ডামি ও অন্যান্য সমাজবিরোধী কার্যকলাপে লিপ্ত গণ-মুক্তি পরিষদের মাধ্যমে তাহাদের বিরুদ্ধে কঠোরতম শাস্তির ব্যবস্থা গ্রহণ করিতে হইবে।
১২। যাহারা মুক্তিসংগ্রামকে বিভক্ত ও বিপর্যস্ত করার জন্য কোন প্রকার সাম্প্রদায়িক ক্রিয়াকলাপ, উস্কানি অথবা প্রচারণা করিবে তাহাদের কঠোরতম শাস্তির ব্যবস্থা করা হইবে।
১৩। শহরাঞ্চলে শত্রুকে বিপর্যস্ত ও ব্যস্ত রখিবার জন্য ”আঘাত করো ও সরিয়া পড়ো” নীতির ভিত্তিতে গেরিলা তৎপরতা চালাইতে হইবে।
১৪। সর্বস্তরের জনগণকে জঙ্গীশাহীর প্রশাসনিক ও সকল প্রকার ব্যবস্থার সহিত সম্পর্ক ছিন্ন করিয়া চলিতে হইবে।
১৫। বাংলাদেশের শ্রমিক শ্রেণীর প্রতি তাহাদের পূর্ব ঐতিহ্য অনুসরণ করিয়া শাসকগোষ্ঠী কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত অর্থনীতির অচলাবস্থা অব্যাহত রাখিবার উদাত্ত আহবান সমন্বয় কমিটি জানাইতেছি।
এই সমন্বয় কমিটি ইহার অন্তর্ভুক্ত প্রতিটি সংগঠনের কর্মীদের প্রতি এই ঐতিহাসিক দায়িত্ব জনগণের সাথে থাকিয়া সুচারুরূপে সম্পন্ন করিবার নির্দেশ প্রদান করিতেছে। এই সমন্বয় কমিটির বহির্ভূত যাহারা অনুরূপভাবে বাংলার মুক্তি সংগ্রামে কাজ করিয়া যাইতেছে বা ভবিষ্যতে করিবে তাহাদের সহিত পরিপূর্ণ সহযোগিতার ভিত্তিতে উপরোক্ত দায়িত্ব পালন করিয়া যাইতে হইবে।
আমাদের ঘোষণা
এই পরিস্থিতিতে আজিকার এই জীবন-মরণ সন্ধিক্ষণে সামাদের প্রিয় মাতৃভূমি ও জনগণের প্রতি গভীর দায়িত্ববোধের কথা স্মরণ রাখিয়া, “বাংলাদেশ জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম সমন্বয় কমিটি” বাংলাদেশের এবং পৃথিবীর স্বাধীনতাকামী মানুষের নিকট দৃঢ়তার সহিত নিম্নোক্ত ঘোষণা পেশ করিতেছিঃ
● সাম্রাজ্যবাদ, সামন্তবাদ ও একচেটিয়া বৃহৎ পূঁজিবাদীগোষ্ঠীর সেবাদাস পাকিস্তানের ফ্যাসিস্ট জঙ্গী শাসকচক্রের হানাদারবাহিনী গণহত্যা, লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগ, নারী ধর্ষণ ও ব্যাপকভাবে নাগরিক বিতাড়নের মাধ্যমে বাঙ্গালী জাতিকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করিবার যে সুপরিকল্পিত অভিযান চালাইতেছে তাহা প্রতিরোধ ও প্রতিহত করিয়া “স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতান্ত্রিক বাংলাদেশ” প্রতিষ্ঠা করার দৃঢ়সংকল্প ঘোষণা করিতেছে।
● এই সমন্বয় কমিটি বাংলাদেশে যে সশস্ত্র জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম চলিতেছে তাহাকে ঐক্যবদ্ধভাবে সাফল্যের পথে অগ্রসর করিয়া লইয়া যাইবার জন্য বলিষ্ঠ শপথ করিতেছে এবং যাহারা অসীম সাহসিকতার সহিত আত্মত্যাগের মধ্য দিয়া এই জাতীয় মুক্তিসংগ্রামে অংশগ্রহণ করিতেছেন তাঁহাদের সহিত একাত্মতা ঘোষণা করিতেছে ও তাঁহাদের প্রতি সংগ্রামী অভিনন্দন জ্ঞাপন করিতেছে।
● সমন্বয় কমিটির সকল প্রকার দেশী-বিদেশী আপসমূলক চক্রান্তকে প্রতিহত করার শপথ গ্রহণ করিতেছে এবং সুস্পষ্ট ঘোষণা করিতেছে যে, বাংলাদেশের মাটি হইতে হানাদারবাহিনী নির্মূল না হওয়া পর্যন্ত এই সংগ্রাম থামিবে না। প্রতি ইঞ্চি জমির জন্য এবং প্রকৃত জাতীয় মুক্তির জন্য বাংলাদেশের জনগণের রক্ত দিয়েছে, দিতেছে এবং ভবিষ্যতেও দিবে।
● বাংলাদেশের জাতীয় মুক্তিসংগ্রামে যাঁহারা শহীদ হইয়াছেন, যাঁহারা লাঞ্ছিত ও নির্যাতিত হইয়াছেন, স্বর্বস্য হারাইয়াছেন, এই সমন্বয়কমিটি তাঁহাদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও সমবেদনা প্রকাশ করিতেছে। যাঁহারা চরমভাবে নির্যাতিত হইয়া শেষ পর্যন্ত দেশত্যাগে বাধ্য হইয়াছেন, এই সংস্থা মুক্ত স্বাধীন পরিবেশে তাঁহাদের নিরাপদ পুনর্বাসনের জন্য সংগ্রামের সংকল্প ঘোষণা করিতেছে।
● বাংলাদেশের শ্রমিক, কৃষক, ছাত্র-যুবক, বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ই পি আর, পুলিশ, আনসার, মোজাহিদ এবং সকল স্বেচ্ছাসৈনিকেরা দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হইয়া স্বতঃপ্রবৃত্তভাবে যে জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে অংশগ্রহণ করিতেছেন এই সমন্বয় কমিটি তাঁহাদের প্রতি সংগ্রামী অভিনন্দন জ্ঞাপন করিতেছে।
● বাংলাদেশের জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের প্রতি এবং বাস্তুহারা শরনার্থীদের প্রতি ভারতীয় জনগণ বিশেষ করিয়া পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, আসাম ও মেঘালয়ের জনগণ যে সাহায্য ও সহযোগিতা করিয়াছেন তাঁহাদের জন্য এই সমন্বয় কমিটি তাঁহাদের প্রতি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করিতেছে।
● এই সমন্বয় কমিটি সিন্ধী, বালুচ, পাঠান, পাঞ্জাবী জনগণ বিশেষ করিয়া শ্রমিক, কৃষক, মেহনতী জনগণের নিকট পাকিস্তানী ফ্যাসিষ্ট জঙ্গী শাসকচক্রের বাংলাদেশে গণহত্যার বিরুদ্ধে এবং বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের সপক্ষে তীব্র গণ-আন্দোলন গড়িয়া তুলিবার আহবান জানাইতেছে।
● এই সমন্বয় কমিটি বিশ্বের সকল স্বাধীনতাপ্রিয় জনগণ, গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের নিকট বাংলাদেশের জাতীয় মুক্তসংগ্রামকে সর্বতোভাবে সাহায্য করিবার আবেদন জানাইতেছে। অফুরন্ত জনবল আমাদের রহিয়াছে, অর্থ রসদ, ঔষদপত্র ও নৈতিক সমর্থন।
● এই সমন্বয় কমিটি বাংলাদেশ সরকার ও মুক্তিসংগ্রামরত সকল শক্তির সহিত সংযোগ ও সমন্বয় সাধন করিয়া জাতীয় মুক্তিসংগ্রামকে ঐক্যবদ্ধভাবে সাফল্যের পথে অগ্রসর করিয়া লইবার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করিতেছে।
● এই সমন্বয় কমিটি বাংলাদেশের আওয়ামী লীগসহ সকল রাজনৈতিক দল, শ্রেণী-সংগঠন ও গণ-সংগঠন এবং ধর্ম, বর্ণ, ভাষা, সম্প্রদায় নির্বিশেষে সকল দেশপ্রেমিক জনগণকে “জাতীয় মুক্তিফ্রন্ট” গঠন করিয়া গণ-যুদ্ধের মাধ্যমে পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীকে ঐক্যবদ্ধভাবে মোকাবিলা ও বাংলাদেশের মাটি হইতে উৎখাত করিবার জন্য উদাত্ত আহবান জানাইতেছে। এই সংস্থা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে যে, যেহেতু জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম সমগ্র জনতার লড়াই, সেই জন্য সমগ্র জনতার আশা আকাঙ্খার পরিপূরক একটি সুসংহত ও ঐক্যবদ্ধ জাতীয় মুক্তিফ্রন্টই তাহাকে নিশ্চিতভাবে চূড়ান্ত বিজয়ের পথে অগ্রসর করিয়া লইয়া যাইতে পারে।
বাংলার সংগ্রমী জনতা!
সারা বাংলাদেশ ব্যাপী মরণপণ যুদ্ধ চলিতেছে- স্বাধীনতার যুদ্ধ। লাঞ্ছিত অপমান মোচনের, পরাধীন দেশমাতৃকার শৃংখল মোচনের এই জীবন-মরণ লড়াইয়ে আমরা সকলেই শরীক হইয়াছি। বাংলাদেশ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত এই যুদ্ধের ক্ষান্তি নাই, শ্রান্তি নাই। যে দস্যুর দল আমাদের পিতা-মাতা, ভ্রাতা-ভগ্নী, পুত্র-কন্যাকে হত্যা করিয়াছে, মা-বোনের সম্ভ্রম বিনষ্ট করিয়াছে, আসুন, আমরা তীব্র প্রতিহিংসার জ্বালা ও ঘৃণা লইয়া সেই দস্যুর উপর সশস্ত্রভাবে ঝাঁপাইয়া পড়ি। তাহাকে খতম করি। রক্তের প্রতিশোধ গ্রহণ করি। আমাদের যুদ্ধ ন্যায়ের যুদ্ধ। তাই জয় আমাদের অবশ্যম্ভাবী। পাকিস্তানী হানাদার দস্যুর পরাজয় অনিবার্য। বাংলাদেশ স্বাধীন হবেই।
-স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ জিন্দাবাদ।
-জনতার সশস্ত্র বিপ্লব জিন্দাবাদ।
১লা জুন
১৯৭১ সাল।
বাংলাদেশ জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম সমন্বয় কমিটি