শিরোনাম | সুত্র | তারিখ |
পররাষ্ট্র দপ্তরের জন্য প্রস্তুতকৃত পাকিস্তান সরকারের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে কয়েকটি মুল্যায়ন | পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয় | ———- ১৯৭১ |
গণহত্যার জন্য পাকিস্তান দায়ী
আন্তর্জাতিক আইনের মৌলিক নিয়মকে সম্পুর্ন উপেক্ষা করে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বাঙালী হত্যা এবং জালাও পোড়া্ও ‘মিশন’ চলতে থাকল। এই গণহত্যা হিন্দু হোক বা মুসলমান, বৌদ্ধ হোক বা খ্রিস্টান প্রত্যেক ‘বাঙ্গালী’কে অপসারন করার পৈশাচিক নকশার ফল। এর উদ্দেশ্য ছিল এমন একটি জাতিকে ধ্বংস করা যার জনগণ জাতিগত ও বর্নগত ভাবে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সম্পুর্ন আলাদা।
বাঙালিদের ‘দোষ’ ছিল যে, তারা বেঁচে থাকার অধিকার চেয়েছিল। পুর্ব পাকিস্তানের মানুষ এবং এর সম্পদের উপর এ নির্মম অর্থনৈতিক শোষণ করা হচ্ছিল, পাকিস্তানকে একটি একক রাষ্ট্র হিসেবে টিকিয়ে রাখার জন্য পুর্বের মত এখন তা বন্ধের আহ্বান করা হয়েছে। একটি দেশের সংখ্যা গরিষ্ঠ মানুষ কিছু মুষ্টিমেয় পশ্চিম পাকিস্তানি শাসক দ্বারা উপনিবেশিত হয়ে থাকার অনুভুতি আর সহ্য করবে না। এই অনুভুতি দীর্ঘ সময় সহ্য করা কষ্টকর কিন্তু কোন প্রতিকার খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না কারন বাঙালীদেরকে জেনেশুনে ক্ষমতায় আসার আসল পথ থেকে দূরে সরিয়ে রাখা হয়েছিল।
আইয়ুব খানের পতনের পর জেনারেল ইয়াহিয়া খান জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রতিশ্রুতি নিয়ে আসেন। সারা দেশে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে এবং জনপ্রতিনিধিরা নির্বাচিত হয়েছেন কিন্তু যখন ক্ষমতা হস্তান্তরের ইচ্ছা, আসল পরীক্ষার সম্মুখীন হল, তখন তা একেবারেই ধসে পড়ে। জ. আ. ভুট্টো এবং সামরিক জান্তা কেউই সংখ্যাগরিষ্ঠের গণতন্ত্রের শাসন মেনে নিতে প্রস্তুত ছিল না। যখন ইয়াহিয়া খান এবং জাতীয় পরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠের নেতা শেখ মুজিবর রহমানের মধ্যে আলাপালোচনা চলছিল তখনই হঠাৎ আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত একটি সংগঠিত সেনা বাহিনী নিরস্ত্র এবং নিরীহ মানুষের ওপর হামলা চালায়।তারা এমন একটি জাতিকে ধ্বংস করার জন্য হত্যা, জালাও পোড়াও, ধর্ষন আর লুট করল যারা আর কোন অপমান এবং শোষন সহ্য করতে প্রস্তুত ছিল না।
ইয়াহিয়া খানের ২৬শে মার্চের ভাষন পরিষ্কার ভাবে সেই পরিকল্পনার ইঙ্গিত দেয় যার উপর ভিত্তি করে এই গণহত্যা চালানো হয়েছিল। ‘শেখ মুজিব ও তাঁর দল ছিল পাকিস্তানের শত্রু’ সে জন্য তাদের নির্মুল করতে হবে। ডিসেম্বরের নির্বাচনের ফলাফলের দিকে তাকালে, যেখানে আওয়ামী লীগ সারে ৭ কোটি পুর্ব পাকিস্তানি জনগণের ১৬৯টির মধ্যে ১৬৭টি আসন পেয়েছিল, দেখা যায় যে এটা খুবই স্পষ্ট ছিল যে সমগ্র জাতি মুজিব সাংবিধানিক উপায়ে যে কর্মসুচি অর্জন করতে চেষ্টা করছিলেন তাকে সমর্থন করেছিল।
সেনাবাহিনী তাই পুরো জাতিকে তাদের লক্ষ্যে পরিনত করে এবং নির্বিচারে হত্যা ও অগ্নিকান্ড চালায়। তারা কিছু নির্বাচিত ব্যক্তির উপর তাদের আক্রমণ সীমাবদ্ধ রাখেনি বরং জনগণের মধ্য থেকে যেকোন ধরনের বাঙালীয়ানা মনভাব দূর করার জন্য পুরাদমে আক্রমন চালায়। এটা পরিষ্কার ছিল যে পাকিস্তানি আর্মি তাদের নাগালের মধ্যে এমন কাউকে থাকতে দেবে না যে নিজেকে বাঙালী হিসেবে দাবি করে, হোক সে মুসলিম কিংবা হিন্দু।
জার্মানিতে হিটলারের জাতীয়-সমাজতান্ত্রিক সরকার আশি লক্ষের ও বেশি মানুষ্কে হত্যা করেছিল। পরবর্তিতে জাতিসংঘ গণহত্যার অপরাধের শাস্তি এবং এর প্রতিরোধের জন্য নীতিমালা গ্রহন করে এবং ধারা-২ এ এটাকে এভাবে সংজ্ঞায়িত করেন যে, এমন কোন কাজ, যা একটি জাতি, গোষ্ঠি, বা ধর্মীয় সম্প্রদায়কে আংশিক বা সম্পুর্নভাবে ধ্বংস করার জন্য হত্যা বা শারীরিক ও মানসিকভাবে গুরুতর ক্ষতির উদ্দেশ্য করা হয়। এই নীতিমালা এই অপরাধকে আন্তর্জাতিক আইনের আওতায় শাস্তিযোগ্য হিসেবেও ঘষনা করে এবং এবং এটা শাসক ও সরকারি কর্মকর্তাদের ওপরও প্রয়োগ যোগ্য করে (ধারা-৪)।
এরসাথে মানবাধিকারের সর্বজনীন সঙ্গা এবং জাতিসংঘ সনদ, উভয় দ্বারা স্বীকৃত মৌলিক মানবাধিকারের ধারনা সম্পৃক্ত। যদি মানবতাবিরোধী অপরাধ আন্তর্জাতিক আইনের লংঘন করে, তাহলে বাংলাদেশে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কর্মকান্ড জাতিসংঘ এবং এর অঙ্গ সংগঠন উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহনের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রন করবে।
বর্তমানে পাকিস্তানি শাসকদের বাংলাদেশে ঘটানো গণহত্যা ছারা দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের পর এতবড় আর কোন গণহত্যা ঘতেনি। নিছক নৃশংস বল প্রয়োগের মাধ্যমে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ‘দ্বৈত গণহত্যা’ চালাচ্ছে,- এক, বাঙালীদের একটি জাতি হিসেবে নির্মুল করা এবং দুই, হিন্দু সম্প্রদায়কে নির্মুল করা। যে কেউ নিজেকে বাঙালী হিসেবে দাবি করলে, সে মুসলিম হোক আর হিন্দু তাকে গুলি করা হত এবং হিন্দু হলে তাকে বেয়নেট দিয়ে খুচিয়ে মারা হত। সহজ ভাষায় এটা গণহত্যা এবং এটাই এখন পাকিস্তানি সেনাবাহিনী করছে। যদি বিশ্ব বিবেকের কাজ করতে হয় তাহলে বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থার থেকে বড় আর কোন ইস্যু হতে পারে না। গণহত্যা এমন একটি অপরাধ যার শাস্তি অবশ্যই পাওয়া উচিত।
সংযোজনী ১-জেনোসাইড কনভেনশন.
সংযোজনী ২-বাংলাদেশের ১০ জন প্রত্যক্ষদর্শী শরণার্থীর সাক্ষাতকার যারা সীমান্তপার হয়ে এসেছে।
এই বর্ননাগুলো আলাদা আলাদা চিঠির আকারে আছে যা ইতমধ্যেই জেনেভায় মানবাধিকার কমিশনের কাছে পাঠানো হয়েছে। এই জবানবন্দি গুলোর পাশাপাশি জাতীয় পরিষদের কিছু সদস্য যারা নিউ ইয়র্ক যাবেন, তারা নিজেদের অভিজ্ঞতা লিখবেন এবং সেগুলো ও এর সংগে জমা দিতে হবে।
সংযোজনী ৩
ইংরেজিতে প্রদত্ত দুটি ব্যক্তিগত বিবৃতি। একটি ঢাকা জিঞ্জিরার কলিমউদ্দিন মিয়ার এবং আর একটি ঢাকা মালিবাগের জনাব আব্দুল করিমের। উভয়ই তাদের নিকট আত্বীয়কে হারিয়েছে যখন পাকিস্তানি বাহিনী তাদের চোখের সামনে তাদের গুলি করে।
…………………………………………………..
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সামরিক জান্তা আন্তর্জাতিক আইনের নিম্নলিখিত বিধান লঙ্ঘন করেছে: –
১) যুদ্ধবিগ্রহ আইন। যুদ্ধের আক্রমন থেকে স্বাধারন মানুষের মুক্তির মতবাদ।
২) ১৮৯৯ সালের হেগ কনভেনশন-২ এর ২৩(ছ) ধারা এবং ১৯০৭ সালের হেগ কনভেনশন। এই ধারায় জারি করা হয় ‘শত্রুর সম্পদ ধ্বংস ও আত্মসাৎ করা বিশেষভাবে নিষিদ্ধ, যতক্ষন না সেসব ধ্বংস বা আত্মসাৎ যুদ্ধের জন্য খুব বেশি জরুরী না হয়’।
৩) জাতিসংঘ দ্বারা স্বীকৃত মৌলিক মানবাধিকার, (ক) প্রস্তাবনায় জাতিসংঘের মূল লক্ষ্য একটি হলো, ‘মৌলিক মানবাধিকার, মর্যাদা এবং ব্যক্তি মানুষের মুল্য, নারী এবং পুরুষের সমানাধিকার এবং জাতীয় বৃহৎ ও ক্ষুদ্র স্বার্থে বিশ্বাস পুনর্নিশ্চিত করা।
(খ) ধারা ১ এর ২য় অনুচ্ছেদ হল, “সমান অধিকারের নীতি এবং জনগণের আত্ম প্রত্যয়ের ওপর ভিত্তি করে জাতি সমুহের মধ্যে বন্ধুত্বপুর্ন সম্পর্ক গড়ে তোলা”।
(গ) ধারা ১ এর ৩য় অনুচ্ছেদ হল, আন্তর্জাতিক সহযোগিতা অর্জন ………………. মানবাধিকারকে সম্মান এবং জাতি, ধর্ম, বর্ন নির্বিশেষে মৌলিক স্বাধীনতাকে প্রচার ও উৎসাহিত করার জন্য।
(ঘ) ধারা 3 (খ) সনদ, “স্বাধারন পরিষদের গবেষণা আরম্ভ করা উচিত এবং এ উদ্দেশ্যে সুপারিশ করা উচিত…………….. মানবাধিকারকে উপলব্ধি করার জন্য এবং জাতি, ধর্ম, বর্ন নির্বিশেষে সবার মৌলিক স্বাধীনতা্র জন্য”।
(ঙ) ধারা ৫৫(গ) “মানবাধিকার রক্ষায় সার্বজনীন শ্রদ্ধা এবং জাতি, ধর্ম, বর্ন নির্বিশেষে সবার মৌলিক স্বাধীনতা্” কে জাতি সংঘের প্রচার করা উচিত।
(চ) ধারা ৫৬ঃ “সকল সদস্য ৫৫ ধারায় উদাত্তভাবে ধার্য করা উদ্দেশ্য অর্জনের লক্ষ্যে সংগঠনের সাথে যৌথ এবং পৃথক ভাবে ব্যবস্থা গ্রহনের জন্য অঙ্গীকার করবে”।
(ছ) ধারা ৭৬(গ) “মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধা এবং জাতি, ধর্ম, বর্ন নির্বিশেষে সবার মৌলিক স্বাধীনতা্কে উৎসাহিত করা”।
(জ) ধারা ৬৬(২) মানবাধিকার রক্ষা এবং সবার মৌলিক স্বাধীনতা রক্ষার প্রচারের উদ্দেশ্যে সুপারিশের জন্য ECOSOC সরবরাহ করে।
(ঝ) ধারা ৬৮ঃ ECOSOC অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে “কমিশন্ স্থাপন করবে” এবং মানবাধিকারকে উন্নিত করবে।
(ঞ) ধারা ১(২) জনগণের আত্মপ্রত্যয়ের অধিকার।
৪) ডিসেম্বর ১০, ১৯৪৮ এ জাতি সংঘের সাধারন পরিষদ মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষনা প্রচার করে। এটা মানুষের জন্য ম্যাগনা কার্টা।
(ক) ধারা ৩, প্রত্যেক মানুষের মৌলিক অধিকার, “বাচার, স্বাধীনতার এবং ব্যক্তি নিরাপত্তার”।
(খ) ধারা ১৫ উল্লেখ করে প্রতিটি মানুষের একটি জাতির অন্তর্গত হওয়ার অধিকার, অর্থাৎ জাতীয়তার অধিকার।
(গ) ধারা ২১ “সরকারের ক্ষমতার ভিত্তি হবে জনগণের ইচ্ছা” এবং এই ইচ্ছা “সার্বজনীন এবং সমান ভোটাধিকারের” ভিত্তিতে “মেয়াদি ও প্রকৃত নির্বাচনের” মাধ্যমে প্রকাশিত হবে।
৫) ১৯৬৬ সালের ১৬ ডিসেম্বর, মানবাধিকার সাধারন পরিষদের আন্তর্জাতিক কনভেনশন মানবাধিকারের দুইটি ধারাকে আন্তর্জাতিক কনভেনশনে রুপান্তর করে এবং কোন আপত্তি ছাড়াই সেগুলো গৃহীত হয় এবং উভয় চুক্তিই স্বাক্ষরের জন্য উন্মুক্ত রাখা হয়। পাকিস্তান উভয় চুক্তির সমর্থনেই ভোট দিয়েছিল।
(৬) ১৯৪৮ সালের ডিসেম্বর মাসে “গণহত্যা সম্মেলনে” স্বাক্ষরকারী দেশ সমূহের মাঝে পাকিস্তানও ছিল।
(a) ধারা-২ঃ গণহত্যা মানে হচ্ছে,” কোন গুষ্ঠি দ্বারা ইচ্ছাকৃত ভাবে কোন নির্দিষ্ট গুষ্ঠি বা সংঘ বা কোন ধর্মীয় গুষ্ঠিকে বা কোন নৃ-গুষ্ঠিকে আংশিক বা পূর্ণ ধ্বংসের উদ্দেশ্যে হত্যা বা শারীরিকভাবে গুরুতর আঘাত করে বা মানষিকভাবে আহত করে এবং নিয়মিত ইচ্ছাকৃতভাবে লড়াইয়ে জড়িয়ে পরে শারীরিকভাবে ক্ষতি করে জন্মরোধ করে এবং জোর পূর্বক তাদেরকে এক দল থেকে অন্য দল বা ধর্মে স্থানান্তরিত হতে বাধ্য করে তা গণহত্যা বলে বিবেচিত হবে।”
(b) ধারা-৩ঃ শাস্তিযোগ্য অপরাধ; গণহত্যা, গণহত্যার ষড়যন্ত্র, জনগণকে গণহত্যার প্ররোচনা দেয়া, গণহত্যার চেষ্টা করা এবং গণহত্যায় কু-কর্ম করা।
(c) ধারা-৪ঃ ধারা-৩ অনুযায়ী কোন ব্যাক্তি যদি গণহত্যা বা উল্লেখিত কোন একটি অপরাধের সাথে জড়িত থাকে তবে তার বিরুদ্ধে শাস্তি দিতে হবে যদি সে সাংবিধানিক ভাবে কোন পফে থাকে বা সরকারী কর্মকর্তা হয় বা সাধারণ মানুষও হয়।
৭। ন্যুরেমবার্গ ট্রাইব্যুনাল অনুযায়ী, যুদ্ধের আগে বা পরে কোন সাধারণ জনগণের উপরে খুন, ধ্বংস, নির্বাসন, দাসত্ব এবং অন্যান্য অমানবিক কার্যক্রম করা হলে তা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ বলে গণ্য হবে। গণহত্যা সাধারণ সভায় সর্বস্মমতিক্রমে একটি প্রস্তাব পাশ হয় এবং আন্তর্জাতিক আইনের পূনর্ব্যক্ত করে একে ন্যুরেমবাগ ট্রায়াল স্বীকৃতি দেয়া হয়। তাই মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে একটি অপরাধ।
জেনেভা কনভেনশন
৮। ১৯৪৯ সালের জেনেভা সম্মেলনের ধারা-৩। পাকিস্তান ১৯৪৯ এবং ১৯৫১ সালের জেনেভা সম্মেলনকে অনুমোদন দেয়। পাকিস্তান জেনেভা বেসামরিক নিয়মাবলী ধারা ৪৪ এবং ৬৮(২) অনুমোদন করে। ধারা ৩ এর কোন বিশেষ অপরাধের জন্য সংরক্ষিত ছিলনা। ১৯৪৯ সালের ২১ এপ্রিল থেকে ১২ আগস্ট পর্যন্ত অনুষ্ঠিত ৪টি জেনেভা সম্মেলনের প্রতিটির জন্য ধারা-৩ গৃহীত হয়। ধারা-৩ হচ্ছেঃ
“স্বশস্ত্র যুদ্ধে যদি আন্তর্জাতিক কোন ব্যাক্তি অংশ নেয় তবে উচ্চ পর্যায়ের চুক্তিবদ্ধ দলের উভয় পক্ষকে নিদেনপক্ষে নিম্নলিখিত নিয়মাবলী মানতে হবেঃ
১। কোন ব্যাক্তি যদি সরাসরি যুদ্ধে অংশ না নেয়ক বা আত্মসমর্পণকারী সেনা সদস্যও হয় বা পক্ষাঘাতগ্রস্ত বা আহত, আটক বা যে কোন একটির কারণ যদি থাকে তবে তার সাথে মানবিক আচরণ করতে হবে সেক্ষেত্রে কোনো প্রতিকূল জাতি, বর্ণ, ধর্ম বা বিশ্বাস,লিঙ্গ ভেদ, জন্ম বা অর্থ, বা অন্য কোন মানদন্ডে বিচার করা যাবেনা।পরিশেষে উল্লেক্ষিত ব্যাক্তিদের ক্ষেত্রে নিম্নলিখিত কাজগুলা নিষিদ্ধ সবখানে এবং সব সময়ের জন্যঃ
(a) ব্যাক্তিবিশেষে কারো জীবনের উপর নৃশংসতা এবং নির্যাতন।
(b) গুম বা বন্দী রাখা।
গ) ব্যক্তিগত মর্যাদার উপর তীব্র আঘাত, বিশেষত অমর্যাদাকর ও অবমাননাকর আচরণ।
ঘ) সভ্যজাতিসমূহের দ্বারা অপরিহার্য হিসেবে স্বীকৃত বিচারিক সুবিধাদি প্রদান নিশ্চিত করার মাধ্যমে নিয়মসম্মতভাবে স্থাপিত/গঠিত আদালতের পূর্ববর্তী রায় ব্যতিরেকে বিচার/শাস্তি প্রদান ও রায় কার্যকর করা।
২) আহত ও অসুস্থ ব্যক্তিদেরকে বাছাই করা ও চিকিৎসা সুবিধা প্রদান করা হবে (আন্তর্জাতিক আইনবিষয়ক দলিল ১৯৫০-৫১, নেভাল ওয়ার কলেজ ইউএসএ ভলিউম ৪৭, পৃষ্ঠা ৮২)।
এই শর্তাদি প্রধানত সেইসব গৃহযুদ্ধের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য যেক্ষেত্রে সহিংসতার/যুদ্ধাবস্থার কোনো আলামত পরিলক্ষিত হয়নি (ওপেনহাইম ভলিউম ২, পৃষ্ঠা ৩৭০)।
IX) পাকিস্তান রেডক্রস-এর আন্তর্জাতিক কমিটির সদস্যদেরকে যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ ও অন্যান্য সাহায্য প্রদানের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশে যেতে অনুমতি দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল। আন্তর্জাতিক ব্যাপ্তির নয় এমন সংঘর্ষ তথা গৃহযুদ্ধের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য ১৯৪৯ সালের জেনেভা কনভেনশনের আর্টিকেল/ দফা ৩ এর একটি অনুচ্ছেদে উদ্ধৃত হয়েছে যে, “একটি নিরপেক্ষ মানবতাবাদী সংস্থার, যেমন রেডক্রস, আন্তর্জাতিক কমিটি সংঘর্ষরত পক্ষগুলোকে সেবা বিতরণ করতে পারবে।” রেডক্রস এই নীতির আলোকে সেবা প্রদানের প্রস্তাব দিয়েছিল কিন্তু পাকিস্তান তা অনুমোদন করেনি।
X) যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে বেসামরিক জনগণের সুরক্ষার্থে সম্পাদিত চতুর্থ জেনেভা কনভেনশন, ১৯৪৯।
XI) যুদ্ধ-বিগ্রহের নিয়মনীতি/ বিধি
যুদ্ধ-বিগ্রহের নিয়মনীতির লঙ্ঘনঃ যুদ্ধবন্দি ও যুদ্ধরত নয় এমন ব্যক্তিবর্গের, বেসামরিকদের সুরক্ষার্থে সম্পাদিত হেগ ও জেনেভা কনভেনশন। এক্ষেত্রে মূল বিষয়টি হলো সাধারণত সুনির্দিষ্ট সামরিক শর্তাধীন এক ধরণের আনুপাতিকতা। উদ্দেশ্যটা যেমনই বাস্তবসম্মত তেমনই মানবিকঃ নির্বিচারে হত্যা, হৃতমনোবল জনতা, অস্ত্রশস্ত্র ইত্যাদি বেসামরিক ব্যক্তিদেরকে গেরিলা যোদ্ধায় পরিণত করেছিল এবং ক্ষুব্ধ শত্রুপক্ষের হাতে বন্দি সৈন্যদেরকে বিপন্ন করেছিল।
ইউএস আর্মি ফিল্ড ম্যানুয়াল ২৭/১০ (স্থলযুদ্ধের আইন) অনুসারে, “বিবদমান/ যুদ্ধরত পক্ষদেরকে সামরিক উদ্দেশ্য সাধনকল্পে প্রয়োজনীয় নয় এমন যে কোনো ধরণের বা মাত্রার সহিংস কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকতে হবে এবং মানবতা ও যুদ্ধসম্পর্কিত সৌজন্যের আদর্শের সাথে সঙ্গতি রেখে লড়াই করতে হবে”।
এই বিধিবিধানগুলো পরাজিত শত্রুসৈন্য, আহত ছত্রীসেনা (প্যারাশুট-জাম্পার) ও অন্যান্য অসহায় মানুষকে বুলেট ও বিষসহ নিষিদ্ধ অস্ত্রের প্রয়োগ থেকে রক্ষা করে। নিষিদ্ধ লক্ষ্যবস্তু বলতে (সামরিক উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত না হওয়ার শর্তে) হাসপাতাল, গীর্জা, জাদুঘর এবং ঊপকূলে অবস্থানরত জেলে-নৌকাগুলোকে বোঝানো হয়। এক্ষেত্রে নির্যাতন, লুটতরাজ ও রাজনৈতিক গুপ্তহত্যা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
কেবলমাত্র কমান্ডারদের আদেশক্রমেই অবৈধ শত্রু-আঘাতের প্রত্যাঘাত করা যাবে, তবে আদালতে বিচারব্যতিরেকে শাস্তি দেওয়া যাবে না এমন বেসামরিকদের বিরুদ্ধে কখনোই এটি করা যাবে না।
শান্তি ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ
১৯৪৯ সালের জেনেভা কনভেনশনে বলা হয়েছে যে, “যেকোনো সক্ষম ব্যক্তি এবং জনতার শক্তি তাদের উদ্দেশ্য নির্বিশেষে নিষিদ্ধ”। এতে আরো বলা হয় যে, “যুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেনি এমন ব্যক্তিদের সাথে সকল পরিস্থিতিতেই মানবিক আচরণ করা হবে”। এছাড়া সুনির্দিষ্টভাবে নিষিদ্ধ কর্মকাণ্ডের মধ্যে রয়েছে ‘সমষ্টিগত দণ্ড বা শাস্তি’ যেমন গেরিলারা লুকিয়ে থাকতে পারে— এই সন্দেহে কোন গ্রাম পুড়িয়ে দেওয়া। ১৯০৭ সালের হেগ কনভেনশনের মাধ্যমে “অরক্ষিত শহর, গ্রাম, বাসস্থানসমূহে বা ভবনগুলোর উপরে যে কোনো উপায়ে বোমাবর্ষণ নিষিদ্ধ” করা হয়েছে।
জাতিগত বৈষম্য
জাতিগত বৈষম্য, ১৯৬০ সালের সাধারণ পরিষদে ১০৩ (১) নং প্রস্তাব। সাধারণ পরিষদে ঘোষণা করা হয়েছিল যে, “মানবতার সবোর্চ্চ স্বার্থে ধর্মসংক্রান্ত ও তথাগত জাতিগত নিপীড়ন ও বৈষম্যের একটি তাৎক্ষণিক সমাপ্তি টানা দরকার।”
বিশ্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণাপত্র
XII) বিশ্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণাপত্রঃ
অনুচ্ছেদ-১: মানুষ জন্মগতভাবে স্বাধীন এবং সমমর্যাদা ও সমানাধিকারসম্পন্ন। তাদের বুদ্ধি ও বিবেক আছে; সুতরাং সকলেরই একে অপরের প্রতি ভ্রাতৃত্বসুলভ মনোভাব নিয়ে আচরণ করা উচিত।
অনুচ্ছেদ-২
অনুচ্ছেদ-৩
অনুচ্ছেদ-৫: কাউকে নির্যাতন অথবা নিষ্ঠুর, অমানবিক অথবা অবমাননাকর আচরণ অথবা শাস্তিভোগে বাধ্য করা চলবে না।
অনুচ্ছেদ-৭: আইনের দৃষ্টিতে সকলে সমান এবং কোনরূপ বৈষম্য ব্যতিরেকে সকলেই সমানভাবে আইনের আশ্রয় লাভের অধিকারী।
অনুচ্ছেদ-৯: কাউকে খেয়াল-খুশিমত গ্রেফতার, আটক বা নির্বাসন দণ্ডে দণ্ডিত করা যাবে না।
অনুচ্ছেদ-১০: প্রত্যেকেই তার অধিকার ও দায়িত্বসমূহ এবং তার বিরুদ্ধে আনীত যে কোন ফৌজদারী অভিযোগ নিরূপণের জন্য পূর্ণ সমতার ভিত্তিতে একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বিচার-আদালতে ন্যায্যভাবে ও প্রকাশ্যে শুনানী লাভের অধিকার রয়েছে।
অনুচ্ছেদ-১১: (১) কোন দণ্ডযোগ্য অপরাধে অভিযুক্ত হলে প্রত্যেকেরই আত্মপক্ষ সমর্থনের নিশ্চয়তা দেয় এমন গণ-আদালত কর্তৃক আইন অনুযায়ী দোষী সাব্যস্ত না হওয়া পর্যন্ত নির্দোষ বলে বিবেচিত হওয়ার অধিকার রয়েছে।
(২) কাউকেই কোন কাজ বা ত্রুটির জন্য দণ্ডযোগ্য অপরাধে দোষী সাব্যস্ত করা চলবে না, যদি সংঘটনকালে তা জাতীয় বা আন্তর্জাতিক আইন মোতাবেক দণ্ডযোগ্য অপরাধ বলে গণ্য না হয়ে থাকে।
অনুচ্ছেদ-১৯: প্রত্যেকেরই মতামত সংরক্ষণ এবং প্রকাশের স্বাধীন অধিকার রয়েছে; বিনা হস্তক্ষেপে মতামত পোষণ এবং রাষ্ট্রীয় সীমানা নির্বিশেষে ও যে কোন উপায়ে ধারণা ও মতামত সন্ধান, গ্রহণ ও জ্ঞাপন করার স্বাধীনতা এই অধিকারের অন্তর্ভুক্ত।
অনুচ্ছেদ-২১: (১) প্রত্যেকেরই প্রত্যক্ষভাবে অথবা অবাধে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে নিজ দেশের সরকারে অংশগ্রহণের অধিকার রয়েছে।
(৩) জনগণের ইচ্ছা-আকাঙ্ক্ষাই হবে সরকারের ক্ষমতার ভিত্তি; এই আকাঙ্ক্ষা বিশ্বজনীন ও সমান ভোটাধিকারের ভিত্তিতে নৈমিত্তিকভাবে অনুষ্ঠিত প্রকৃত নির্বাচন দ্বারা ব্যক্ত হবে; এরূপ নির্বাচন গোপন ব্যালট অথবা অনুরূপ অবাধ ভোটদান পদ্ধতিতে অনুষ্ঠিত হবে।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অবস্থান
১. পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পিছু হটার বা পশ্চাদপসরণের কোনো জায়গা নেই। বার্মার (মায়ানমার) সাথে এক চিলতে সীমানা বাদে বাংলাদেশের অবশিষ্ট ভূ-খণ্ড ভারত দ্বারা পরিবেষ্টিত। পালাবার অন্যান্য উপায়ের মধ্যে রয়েছে আকাশপথ ও নৌপথ যেক্ষেত্রে ভারতীয় উপকূল ধরে ৩০০০ মাইলেরও বেশি পথ পাড়ি দিতে হবে। অন্য ভাবে বলতে গেলে, সৈন্যদের পিছিয়ে যাওয়ার কোন সুযোগ নেই, যেটি যে কোন যুদ্ধের ক্ষেত্রে অপরিহার্য। সুতরাং মনঃস্তাত্ত্বিকভাবে তারা দুর্বল ও মনোবলহীন এবং একারণেই তারা যতটা হওয়ার কথা তার চেয়ে বেশি বেপরোয়া।
২. পাকিস্তানের সাধারণ সৈন্যগণ মূলত সিন্ধু, বেলুচিস্তান ও সীমান্ত প্রদেশের মানুষ। একদিকে যেমন এই অঞ্চলের সৈন্যদের মধ্যে বিবাদ ও সংঘর্ষের খবর পাওয়া গেছে এবং তেমনি অন্যদিকে পাঞ্জাবি সৈন্যরাও শান্তিতে নেই। এমন খবরও পাওয়া গেছে যাতে সমর্থিত হয় যে, অনেকক্ষেত্রে সীমান্ত প্রদেশের এবং বেলুচ সৈন্যরা আমাদের লোকদের সাথে তুলনামূলক কম গুরুতর, এবং কখনো কখনো সহানুভূতিসম্পন্ন, আচরণ করেছে।
৩. পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে বিদ্যমান এই পাঞ্জাবি-অপাঞ্জাবি বিভেদের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করার চেষ্টা করা উচিত।
৪. পাকিস্তান সেনাদেরকে, বিশেষ করে অফিসারদেরকে, মৃত অবস্থায় পাবার চেয়ে একা অবস্থায় আটক করার দিকে গুরুত্বারোপ করা উচিত। মুক্তিবাহিনী ইউনিটগুলোতে এই মর্মে দিকনির্দেশনা প্রদান করা উচিত।
৫. ভাল ব্যবহার এবং শত্রুর প্রতি শ্রদ্ধাপূর্ণ আচরণ সবসময়ই স্বাগতিক দেশের আত্মবিশ্বাস ও জয়ের প্রতি সংকল্প পরিস্ফুট করে তোলে। এটা মর্যাদা ও শ্রদ্ধালাভের যোগ্যতা বাড়ায় এবং আন্তর্জাতিক যুদ্ধবিগ্রহের নিয়মনীতির প্রতি আমাদের দায়বদ্ধতা পালনের অঙ্গীকার ব্যক্ত করে।
৬. পাকিস্তান প্রতিদানপ্রথা অনুসরণ বা বিনিময় করবে এবং হত্যা করার বদলে মুক্তিবাহিনী সদস্যদেরকে বন্দি করার আবশ্যকীয়তা উপলব্ধি করতে পারে,— এই আশায় যে যুদ্ধ শেষে তারা সেই বন্দিদের বিনিময়ে তাদের বন্দি সৈন্যদের ফিরে পাবে।
৭. শেখ মুজিবের মুক্তিদানের ব্যাপারটি সুরক্ষিত করার স্বার্থে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বন্দিদেরকে, বিশেষ করে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের জিম্মি করা, ব্যবহার করা যেতে পারে।
বাংলাদেশে কর্মরত পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের উদ্দেশ্যে প্রত্যেকদিন প্রতিবেলার সম্প্রচার-অধিবেশনে একবার করে উর্দুতে একটি ৫-মিনিটের কর্মসূচি সম্প্রচারের ক্ষেত্রে নিম্নোক্ত প্রস্তাবনা পেশ করা হলঃ
১. বেলুচিস্তান, সীমান্ত ও সিন্ধু প্রদেশ থেকে আগত সৈন্যদের উদ্দেশ্য করে বক্তব্য প্রদান।
২. তাদেরকে ব্যাখ্যা করা যে তারা যে মানুষদেরকে হত্যা করছে তাদের শতকরা ৯০ ভাগই মুসলমান এবং তাদেরকে (সৈন্যদেরকে) আসলে পাঞ্জাবিরা ভুলপথে পরিচালিত করছে। এক্ষেত্রে ইসলামের আদর্শ বিবৃত করা যেতে পারে।
৩. বেলুচস্তিান, সীমান্ত ও সিন্ধু প্রদেশের সৈন্যদের এই দৃষ্টিভঙ্গিকে স্বাগত জানানো ও তাদের এই উপলব্ধির প্রশংসা করা যে তারাও আসলে পাঞ্জাবিদের দ্বারা সমভাবে শোষিত হচ্ছে এবং পূর্ববঙ্গের যুদ্ধ সম্পর্কে পাঞ্জাবিরা তাদেরকে ভুল বুঝিয়েছে। তাদেরকে বলা হয়েছিল যে পূর্ববঙ্গের যুদ্ধটা ছিল ভারতীয়দের বিরুদ্ধে কিন্তু পৌঁছানোমাত্রই তারা আবিষ্কার করেছে যে তারা বাংলাদেশের নিরপরাধ লোকদের সাথে লড়াই করছে।
৪. বিভিন্ন ক্ষেত্রে এবং বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশের জনগণের প্রতি তাদের (সিন্ধু, বেলুচিস্তান ও পাঞ্জাবের) সহানুভূতি ও সমর্থনের প্রশংসা করা এবং তাদের আর নিজেদেরকে বিভ্রান্ত হতে দেওয়া উচিত নয়— এই উপলব্ধির প্রশংসা করা।
৫. তাদের যে পশ্চাদপসরণের কোনো উপায় নেই, এটা ব্যাখ্যা করা এবং বিশদভাবে তাদের লজিস্টিক উপকরণের তথা রসদের অপ্রতুলতা বিবৃত করা যেতে পারে। তাদের উপলব্ধিতে এই সত্যটি প্রতিষ্ঠা করতে হবে যে তারা একটি অচেনা, বিদেশি ভূখণ্ডে লড়াই করছে কিন্তু বিজয় আমাদের সুনিশ্চিত।
৬. তাদেরকে উপলব্ধি করানো যে সময় ফুরিয়ে যাওয়ার আগেই তাদের আত্মসমর্পণ করা এবং মুক্তিবাহিনীর কাছে নতি স্বীকার করা উচিত। সেটা করলে তাদেরকে যুদ্ধবন্দি হিসেবে বিবেচনা করা হবে এবং সেইমত আচরণ করা হবে। তাকে হত্যা করা হবে না, বরং তাকে খাদ্য ও আশ্রয় দেওয়া হবে এবং যুদ্ধ শেষে সে পশ্চিম পাকিস্তানে ফিরে যাবে নাকি সমানাধিকারসম্পন্ন নাগরিক হিসেবে বাংলাদেশে বসতি স্থাপন করবে— তাকে এটা বেছে নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হবে।
পশ্চিম পাকিস্তান সরকার সম্প্রতি পশ্চিমা বিশ্বে তাদের বিশেষ রাষ্ট্রদূত এবং বেতনভুক্ত এজেন্টদের মাধ্যমে বাংলাদেশের নিরপরাধ মানুষের সাথে তারা যে খুন ও নৃশংস অপরাধ করছে তার যৌক্তিকতা প্রমাণে আত্মপক্ষ সমর্থনমূলক প্রচারণা শুরু করেছে। পাকিস্তান সরকারের অন্যায় ও গণহত্যাকাণ্ডমূলক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে সারা বিশ্বব্যাপী ঘনীভূত হতে শুরু করা জোরালো জনমতের ফলে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী এখন আত্মপক্ষ সমর্থনমূলক নানা অজুহাত খুঁজে বের করতে ব্রতী হয়েছে। এর অংশ হিসেবে সম্ভাব্য সব ধরণের অজুহাত ও যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করে অনেক চেষ্টা করা হয়েছে কিন্তু তা সবই শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়েছে। ফলে, উপায়ান্তর না দেখে, বর্তমানে ব্যাপারটিতে ভিন্ন রঙ চড়িয়ে একে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করা হচ্ছে।
মুক্তি সংগ্রামের ও স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধের এই মহৎ ও পবিত্র উদ্দেশ্যকে এখন সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্পে দূষিত করার চেষ্টা করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে যে বাঙালিরা অবাঙালিদেরকে হত্যা করেছে, সুতরাং পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এই হস্তক্ষেপ কেবলই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের স্বার্থে। এই হীন ও জঘন্য অপপ্রচারের চেয়ে ডাহা মিথ্যা আর কিছুই হতে পারে না। বাংলাদেশ সরকার এতে ক্ষুব্ধ বোধ করছে যে কিছু পশ্চিমা সংবাদপত্রও এমন মনগড়া গল্প ফেনিয়ে পরিবেশন করছে। মে মাসের ২ তারিখের ‘সানডে টাইমসে’ অ্যান্থনি মাসকারেনহাসের প্রেরিত প্রতিবেদনটি কেবল এমন একটি গল্পের পশ্চিম পাকিস্তানি সংস্করণমাত্র, যা কোনো যুক্তিতেই ধোপে টেকে না। মি. রোজেনব্লম-এর ক্ষেত্রেও একই কথা খাটে যিনি, সহজেই অনুমেয় যে, পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আনুকূল্যে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বাংলাদেশ সফর করেন।
নিম্নের ঘটনাসমূহের মাধ্যমে এই অপপ্রচারের জঘন্যতা ও অসারতা টের পাওয়া যায়ঃ
১. আমাদের জানামতে, ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চের পূর্বপর্যন্ত একটি সংবাদপত্রেও এমন কোনো সংবাদ প্রকাশিত হয়নি যে বাংলাদেশের কোনো অঞ্চলে বাঙালিরা একজন অবাঙালিকে হত্যা করেছে।
২. পশ্চিম পাকিস্তানিসহ প্রায় ৪০-৫০ জন বিদেশি সাংবাদিকের কেউই তাঁদের বাংলাদেশে অবস্থান করার সময়ে এই বিষয়ে একটি বাক্যও লেখেননি। এমন কোনো ঘটনা বাংলাদেশে ঘটে থাকলে অবশ্যই তা তাঁদের চোখে পড়ত।
৩. কোনো বিদেশি বা পশ্চিম পাকিস্তানি সাংবাদিক শেখ ও ভুট্টোসহ কোনো নেতাকে একবারের জন্যও কখনো এ ব্যাপারে কিছু জিজ্ঞাসা করেননি কিংবা নেতাদের আয়োজিত ধারাবাহিক সংবাদ সম্মেলনগুলিতে আদৌ এই বিষয়টি উপস্থাপন করেননি।
৪. বিশেষত যদি এটাই এই সামরিক নৃশংসতার কারণ হয়ে থাকবে, তবে ইয়াহিয়া খান কেন তাঁর ২৫শে মার্চের বক্তৃতায় এটি উল্লেখ করেননি? এরকম কোন ঘটনা যদি ঘটেই থাকত, ইয়াহিয়া খান কোনোভাবেই এটিকে আত্মসমর্থনমূলক প্রধান একটি কারণ হিসেবে উপস্থাপন করার সুযোগ হারাতেন না।
৫. পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্যদের আয়োজিত একটি সফরে আমন্ত্রিত হয়ে ছয়জন সাংবাদিক এতে অংশগ্রহণ করেন কিন্তু তাঁদের কেউই কোনো লেখায় এই ছেলেভুলানো যুক্তিটির উল্লেখ করেননি। পক্ষান্তরে ‘অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের’ সংবাদদাতারা ঘন ঘন বাংলাদেশে এসেছেন এবং তাঁদের অন্তত একজন ২৫শে মার্চে পাকিস্তান সরকার কর্তৃক বিতাড়িত হওয়ার আগপর্যন্ত অনেকদিন থেকেই ঢাকায় উপস্থিত ছিলেন, কিন্তু এই বিষয়ে কিছু লেখেননি।
অন্যদিকে শেখ মুজিব তাঁর বক্তৃতা, দিকনির্দেশনা এবং ১লা মার্চ থেকে ২৫শে মার্চ পর্যন্ত সংবাদ সম্মেলনগুলোতে খুব স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন যে বাঙালি এবং অবাঙালি সবাই সমান এবং বাংলাদেশের নাগরিকদের কাছে বিশ্বাসের স্তম্ভ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত শেখ মুজিব-প্রদত্ত জাতীতাবাদের সংজ্ঞাটি ছিল এরূপ যে, “সমস্ত মানুষ— বাঙালি, অবাঙালি, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ,— বাংলাদেশে বসবাসকারী যে কেউ, তাদের জাতিধর্মবর্ণ নির্বিশেষে বাঙালি হিসেবে পরিচিত হবে।”
……………………
মি. অ্যান্থনি মাসকারেনহাস বিভিন্ন এলাকায় আবিষ্কৃত মৃতদেহের সংখ্যা সম্পর্কে পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্যদের সরবরাহকৃত হিসাব উল্লেখ করতে দ্বিধা করেননি। তিনি অবশ্য নিজে মৃতদেহগুলো দেখেছেন কিনা বা সেগুলো অবাঙালিদের মৃতদেহ হিসেবে যাচাই করেছেন কিনা তা উল্লেখ করেননি। এমনকি তিনি যদি স্বচক্ষে দেখেও থাকেন, মৃতদেহগুলো সম্ভবত ততদিনে পচে গিয়েছিল এবং তাঁদের ভাষাগত পরিচয় নিরূপণের কোনো উপায় ছিল না। তাহলে তিনি কীভাবে বলতে পারেন যে তাঁরা (মৃতরা) অবাঙালি ছিল?