শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
বাংলাদেশ কেন”? পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে বৈষম্যের একটি সংখ্যাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ | বাংলাদেশ রিলিফ কমিটি,
লন্ডন |
———– ১৯৭১ |
বাংলাদেশ কেন?
পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে বৈষম্যের একটি সংখ্যাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ
বাঙ্গালীদের স্বাধীনতা দাবির পরিপ্রেক্ষিতে পশ্চিম পাকিস্তানী সেনা সরকার পূর্ব পাকিস্তানের অধিবাসীদের উপর বর্বর ও নৃশংস হামলা চালায়। বাঙালীরা প্রকৃতপক্ষে যা চেয়েছিল তা হচ্ছে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক সাম্য। সাম্প্রতিক ঘটনাসমূহ প্রমাণ করে যে এখানে অপসারণের কোন পরিকল্পনা ছিল না এবং বাঙ্গালীদের সেটা অর্জনের জন্য কোন ধরণের সশস্ত্র প্রস্তুতিও ছিল না। তারা আত্মবিশ্বাসের সাথে প্রেসিডেন্ট ইয়া হিয়া খানের রাজনৈতিক সদিচ্ছার উপর ভরসা করেছিল। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানী আর্মি নিরস্ত্র বাঙ্গালীদের উপর রীতিমত কসাইগিরি চালায় যা বাঙ্গালী জনসাধারণদেরকে সম্পূর্ণ স্বাধীন দেশ গড়বার সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করে। পূর্ব পাকিস্তানের বাংলাভাষী এবং পশ্চিম পাকিস্তানীদের মাঝে একটি সুস্পষ্ট বিভাজন রেখা তৈরি করা হয়। পশ্চিম পাকিস্তানীদের দ্বারা পূর্ব পাকিস্তানের জনগনের উপর চলমান শোষণের ফলাফল হিসেবে এই সিদ্ধান্তটি অনিবার্য ছিল। বিশ্বের নিকট এটা আশ্চর্যজনক কিছু হয়ে আসেনি। বরঞ্চ এরকমটা যে হবে তা অনেক আগে থেকেই অনেকে ধারণা করে আসছিলেন। এক ধর্ম ব্যতীত দুদেশের মধ্যে অন্য কোন মিল নেই। নৃতাত্ত্বিক, সাংস্কৃতিক, চিন্তাচেতনায়, ভাষা, জীবনযাপন- প্রতিটি ক্ষেত্রেই তারা ২টি ভিন্ন জাতি। দুই জাতির মধ্যে বিদ্যমান বিরোধ নিষ্পত্তির কোন উদ্যোগ তো নেওয়াই হয় নি বরঞ্চ কেবল অর্থনৈতিক শোষণ ও সামাজিক বৈষম্য করা হয়েছে। পূর্ব পাকিস্তান যেন রয়েছে কেবল মাত্র পশ্চিম পাকিস্তানী ধনবান বনিক, শিল্পপতি ও ঠিকাদার, সামরিক ও সরকারি কর্মকর্তা শ্রেণীর উন্নতির জন্য। গত ২৪ বছরের পাকিস্তানী সরকারের সময়ে বেশিরভাগ পরিচালিত হয়েছে পশ্চিম পাকিস্তানীদের দ্বারা। শাসন তন্ত্র এমনভাবে করা হয়েছে যাতে পূর্ব পাকিস্তানের মাধ্যমে পশ্চিম পাকিস্তান মরুভূমির উন্নতি হয়। সত্যিকার অর্থে পাকিস্তান সরকার সর্বচ্চ চেষ্টা করেছে যাতে এসকল অনিয়মের হিসেব জনসম্মুখে না আসে। তারপরেও যতটুকু তথ্য প্রকাশ হয়েছে সেখান থেকেই এই বৈষম্যের ব্যাপারটি পরিষ্কার হয়ে উঠে।
গড় বার্ষিক বাজেট
মোট রাজস্ব | ৬,০০০ মিলিওন রুপি | পশ্চিম পাকিস্তান | পূর্ব পাকিস্তান |
সামরিক খাতে খরচ | মোট ৬০% | ৫০% | ১০& |
বেসামরিক খাতে খরচ | মোট ৪০% | ২৫% | ১৫% |
যখন পূর্ব পাকিস্তান মোট রাজস্বের ৬০% আয় করে কিন্তু বিনিময়ে মাত্র ২৫% খরচ পায় তখন পশ্চিম পাকিস্তান মোট রাজস্বের ৪০% আয় করে ৭৫% খরচ করে।
বৈদেশিক বানিজ্য ও আমদানি-রপ্তানি আয়
১০ বছর সময়ে
১৯৫৮-১৯৬৮ |
পশ্চিম পাকিস্তান
|
পূর্ব পাকিস্তান
|
বৈদেশিক বানিজ্যের ক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তান রপ্তানি করে মোট বানিজ্যের ৫৯% কিন্তু আমদানি করে মাত্র ৩০% যেখানে রয়েছে খাদ্য ও নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী এবং অতিক্ষুদ্র পরিমানে উন্নয়ন সামগ্রী। একই সময়ে পশ্চিম পাকিস্তান মোট বৈদেশিক আয়ের ৪১% আয় করে কিন্তু ৭০% রপ্তানি করে। এর উল্লেখযোগ্য অংশ ব্যয় করা হয় বিভিন্ন উন্নয়ন মূলক কাজে যেটা হয়ে থাকে পুরোপুরি পশ্চিম পাকিস্তান অঞ্চলে।
আন্তঃপ্রদেশ বানিজ্য ১৯৬৪-৬৯
পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তানে রপ্তানি | পূর্ব পাকিস্তান থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে রপ্তানি |
৫২৯২ মিলিওন রূপি | ৩১৭৪ মিলিওন রূপি |
পূর্ব পাকিস্তানের অর্থ কিভাবে পশ্চিম পাকিস্তানে পাচার হয় এটি তার একটি উদাহরণ। ধারণা করা হয় যে ১৯৪৭ থেকে এই পর্যন্ত পাচার করা সম্পদের অর্থমূল্য ৩০০০ মিলিওন ইউরো।
এবার ১৯৬৪-৬৫ সালে রপ্তানিকৃত পণ্য সমূহ দেখা যাকঃ
পাট ও পাট জাতীয় পণ্য (সব পূর্ব পাকিস্তানের) | ১২৪৫৮০ মিলিওন রূপি |
তুলা ও তুলা জাতীয় পণ্য (প্রধানত পশ্চিম পাকিস্তানের) | ৫১৮৮০ মিলিওন রূপি |
পশুর ছাল ও চামড়া (প্রধানত পূর্ব পাকিস্তানের) | ৬১৩০ মিলিওন রূপি |
চা (সম্পূর্ণ পূর্ব পাকিস্তানের) | ১০০০ মিলিওন রূপি |
পশম (সম্পূর্ণ পশ্চিম পাকিস্তানের) | ৭৩০০ মিলিওন র্যপি |
অন্যান্য (পূর্ব ও পশ্চিম মিলিয়ে) | ৫৬২০০ মিলিওন রূপি |
উন্নয়ন প্রজেক্ট এর জন্য বরাদ্দ কৃত অর্থের শতকরা হিসাবঃ
বিসয় | পশ্চিম পাকিস্তান | পূর্ব পাকিস্তান |
উন্নয়ন বিভাগের জন্য বৈদেশিক বানিজ্যের অর্থ | ৮০% | ২০% |
বৈদেশিক সাহায্য (ইউএস এইড সহ) | ৯৬% | ৪% |
ইউএস এইড | ৬৬% | ৩৪% |
পাকিস্তান শিল্প উন্নয়ন করপরেসন | ৫৮% | ৪২% |
পাকিস্তান শিল্প অর্থ ও বিনিয়গ সন্সথা | ৮০% | ২০% |
শিল্প উন্নয়ন ব্যাংক | ৭৬% | ২৪% |
বাড়ি নির্মাণ | ৮৮% | ১২% |
৭৭% | ২৩% |
উপরের তথ্য থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যে বিভিন্ন শিল্পখাতে পশ্চিম পাকিস্তান মোট উন্নয়ন বিনিয়োগের ৭৭% পায় যা কেবল মাত্র মোট জনসংখ্যার ৪০% এর কাজে আসে।
পাকিস্তানের জন্য বৈদেশিক সাহায্য
১৯৬৫ সালে পাকিস্তানে আশা চাইনিজ ঋণ ছিল ৬০ মিলিওন ইউএস ডলার যার অধিকাংশ খরচ হয় পশ্চিম পাকিস্তানে যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ৯ মিলিওন মার্কিন ডলার খরচে স্থাপিত হেভি মেশিনারি কমপ্লেক্স। অন্যদিকে পূর্ব পাকিস্তানে খরচ হয় ১২৫০০০ মার্কিন ডলার পানি ও শক্তি উন্নয়নের জন্য। অথচ ঋণশোধ করা হয় পাট ও পাটজাত দ্রব্য দ্বারা।
সুঁই গ্যাস প্রজেক্টের জন্য বিশ্বব্যাংক ১৯৫৪ সালে ১৪ মিলিওন মার্কিন ডলার এবং ১৯৬৫ সালে ১৫ মিলিওন মার্কিন ডলার চুক্তি করে পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে। একই উৎস থেকে ১৯৬৪ সালে করাচী বন্দর উন্নয়নের জন্য পায় ১৭ মিলিওন মার্কিন ডলার এবং ৩০ মিলিওন পায় পাকিস্তান ইনভেস্টমেন্ট এন্ড ক্রেডিট কর্পোরেশন যার অধিকাংশ খরচ হয় পশ্চিম পাকিস্তানে। আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা (ইউএন এজেন্সি) ৫ মিলিওন মার্কিন ডলার পশ্চিম পাকিস্তানে এবং ৪.৫ মিলিওন মার্কিন ডলার পূর্ব পাকিস্তানে দেয় শিক্ষা প্রজেক্ট এ।
তেল অন্বেষণের জন্য রাশিয়া পশ্চিম পাকিস্তান কে ১১ মিলিওন হতে ১৮ মিলিওন মার্কিন ডলার দেয় ১৯৬৫ সালে।
১৯৪৭-১৯৬৫ সালে ইউকে ৬৪ মিলিওন ইউরো ঋণ দেয় যার সিংহভাগ খরচ হয় পশ্চিম পাকিস্তানে।
ইউএস এইডের প্রদত্ত ৩.৬ বিলিওন মার্কিন ডলার থেকে ২.৭ বিলিওন খরচ হয় পশ্চিম পাকিস্তানের মংলা বাধ ও তারবেলা বাধ নিরমানে। অন্যদিকে পূর্ব পাকিস্তানে খরচ হয় মাত্র ০.৯ বিলিওন বন্যা নিয়ন্ত্রনের জন্য। এসমস্ত ঋণ নিঃসন্দেহে পশ্চিম পাকিস্তানের মরুভূমিকে উর্বর করে তলে অথচ পৃথিবীর সবচেয়ে উর্বরভুমি পূর্ব পাকিস্তানের বন্যা সমস্যায় কার্যকর কোন সমাধান নিয়ে আসেনি। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ ১৯৫৩ সাল থেকে সাইক্লোন ও বন্যার মত দুর্যোগের ভোগান্তি বয়ে বেড়াচ্ছে।
তুলনামূলক শিল্প উন্নয়ন
উভয় অঞ্চলে স্থাপিত শিল্প কারখানা সমূহ | পশ্চিম পাকিস্তান | পূর্ব পাকিস্তান |
তুলা শিল্প | ১৯৪৭/৪৮ এ ৩৫০ ১৯৬৬/৬৭ এ ৬৮৩৬ প্রতি মিলিওন ইয়ার্ড এ বৃদ্ধি ১৮৫৩% |
১৯৪৭/৮ এ ৫০৮ ১৯৬৬/৭ এ ৫৫০ প্রতি মিলিওন ইয়ার্ড এ বৃদ্ধি ৮.২৫% |
চিনি শিল্প | ১৯৪৭/৪৮ এ ১০ ১৯৬৬/৬৭ এ ৩০৪ প্রতি ‘০০০ টনে বৃদ্ধি ২৯৪৩% |
১৯৪৭/৮ এ ২৫ ১৯৬৬/৭ এ ১১২ প্রতি ‘০০০ টনে বৃদ্ধি ৩৪৮% |
সিমেন্ট শিল্প | ১৯৪৭/৮ এ ৩০৫ ১৯৬৬/৭ এ ১৯৩৪ প্রতি ‘০০০ টনে বৃদ্ধি ৫৩৪% |
১৯৪৭/৮ এ ৪৬ ১৯৬৬/৭ এ ৭৫ প্রতি ‘০০০ টনে বৃদ্ধি ৬৩% |
উপরের টেবিল হতে দেখা যায় যে কিভাবে পূর্ব পাকিস্তানে পশ্চিম পাকিস্তানের তুলনায় অত্যন্ত ধীর গতিতে সিল্পায়ন করা হয়েছে যেখানে পশ্চিম পাকিস্তানে শিল্পায়নের গতি অতি দ্রুত। ১৪৭ সালে পূর্ব পাকিস্তানে পশ্চিম পাকিস্তানের তুলনায় বেশি শিল্প কারখানা ছিল। বোম্বে হতে আগত ধনিক শ্রেণীর অভ্যন্তরমুখী প্রবাহ এই বিষয়ে খুব দ্রুত পরিব্রত্ন নিয়ে আসে।
কাঁচামাল উৎপাদন সিল্পের ক্ষেত্রে পশ্চিম ও পূর্ব পাকিস্তানে বিনিয়োগ ছিল যথাক্রমে ৭৫% ও ২৫%। এছাড়া পূর্ব পাকিস্তানের শিল্প কারখানাগুলোর বেশিরভাগের মালিকানা ও কর্তৃত্ব ছিল পশ্চিম পাকিস্তানীদের হাতে। যাদের মূল লক্ষ্য ছিল পূর্ব পাকিস্তান থেকে টাকা রোজকার করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া। ১৯৪৭ সাল হতে এক হিসেবে দেখা যায় পশ্চিম পাকিস্তানে পাঠানো অর্থের পরিমাণ ৩০০০ মিলিওন মার্কিন ডলার।
এধরণের অর্থ পাচারের উপর অঞ্চলিক রাজ্যের কোন নিয়ন্ত্রণ ছিল না।
আধুনিকায়নের মূল বস্তু ইস্পাত এখন পশ্চিম ও পূর্ব পাকিস্তানের ২টি কারখানায় উৎপাদন হচ্ছে। এবিষয়ে পশ্চিমের জন্য বরাদ্দ হয়েছে ৫৬ মিলিওন এবং পূর্বের জন্য বরাদ্দ হয়েছে ১১ মিলিওন মার্কিন ডলার।
কৃষি উন্নয়ন
বিষয় | পশ্চিম পাকিস্তান | পূর্ব পাকিস্তান |
১৯৯৬৪-৬৮ সালে প্রতি ‘০০০ নিউট্রিয়েন্ট টনে সার বিতরণ | ৭৩৯ ৬৬% |
৩৭১ ৩৩% |
১৯৬৪-৬৯ সালে প্রতি ‘০০০ টনে উন্নত বীজ বিতরণ | ১৯৫১-৫২ এ ৩৪২ ১৯৬৬-৬৭ ৮৯% |
১৯৫১-৫২ এ ৪০ ১৯৯৬৬-৬৭ এ ১১% |
প্রতি ‘০০০ টনে উন্নত মাছের উৎপাদন ২৭৩% | ৫৬ ১৫৩ |
১৭৫ ২৫৯ ৪৮% |
হুইল টাইপ ট্রাক্টর এর বিতরণ | ২০০৬৯ ২০০০ |
১৮২৫ ৩৫০ |
অন্যান্য | ৯১% | ৯% |
এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে পূর্ব পাকিস্তানে বেশি পরিমাণ আবাদি জমি রয়েছে এবং প্রায় প্রতি জমিতেইতেই বছেরে ২ থেকে ৩বার করে ফসল ফলানো হয়ে থাকে। শুধু চাষযোগ্য জমির দিক থেকেই নয়, ফসল উৎপাদনের দিক থেকেও পশ্চিমের পরিমাণ খুব কম। এই বিষয়টাকে বুঝতে এরা খুবই গড়িমসি করছে।
কৃষি ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে, পাকিস্তান কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক ৬০০ মিলিওন রূপি ধার দেয় যার বেশিরভাগ পায় পশ্চিম পাকিস্তানী কৃষকগণ। বেশিরভাগ সেচ প্রকল্প গুলো পরিগনিত হয় চুক্তিবদ্ধ প্রজেক্ট হিসেবে এবং তা পশ্চিম পাকিস্তানে সরকারের অর্থায়নেই নির্মাণ হয়ে থাকে। এটা অত্যন্ত সচেতনভাবে ৭৫ মিলিওন বাঙ্গালিকে না খাইয়ে রাখবার সমান। ফেদেরাল আর্মির ৫০০০০০ এর মধ্যে বাঙ্গালী ২০০০০ জন। এই ৪৮০০০০ জন পশ্চিম পাকিস্তানীরা তাদের আয় খরচ করে পশ্চিম পাকিস্তানে যা ওই অংশের অর্থনৈতিক উন্নতিতে পরোক্ষ ভুমিকা রাখছে। অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন ১৯৫৯ সালে পূর্ব পাকিস্তানীরা পশ্চিম পাকিস্তানীদের থেকে ২০% খারাপ অবস্থায় রয়েছে। ১৯৬৮ সালে এর পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ৪০% ।
শক্তি উন্নয়ন
আরেকটি উন্নয়ন সুচক হল প্রতি জনসংখ্যার জন্য কি পরিমাণ বিদ্যুৎ শক্তি উৎপাদন হচ্ছে তা নির্ণয়। পাকিস্তানে শক্তি উৎপাদন বেড়েই চলেছে। পশ্চিম পাকিস্তানে পানি, তাপ ও অন্যান্য উপায়ে মোট ৮৩৮০০০ কিলো ওয়াট বিদ্যুৎ তৈরি হচ্ছে (মোট উৎপাদনের ৮৩%) অন্যদিকে পূর্ব পাকিস্তানে হচ্ছে ১৭৯৫০০ কিলো ওয়াট (মোট উৎপাদনের ১৭%)। বিভিন্ন শক্তি উতপাদনে বৈদেশিক সাহায্যের একটি বড় অংশ ব্যবহার হচ্ছে। ১৯৫৯-৬৪ এই ৫ বছরে ২টি বৃহত্তর সেচ ও শক্তি প্রকল্পে ইন্দুস বেসিনকষ্ট এ ১৮০০মিলিওন মার্কিন ডলার এবং অয়াপদা তে ১৪৫৩ মিলিওন রূপি খরচ হয়।
২০ বছরে শিক্ষার বিকাশ
এলাকা | পশ্চিম পাকিস্তান | পূর্ব পাকিস্তান |
প্রাথমিক বিদ্যালয় | ১৯৪৭/৮ এ ৮৪১৩ ১৯৬৮/৯ এ ৩৯৪১৮ বেড়েছে সাড়ে ৪ গুণ |
১৯৪৭/৮ এ ২৯৬৬৩ ১৯৬৮/৯ এ ২৮৩০০ কমেছে কারণ বাচ্চাদের সংখ্যা বেড়েছে |
উচ্চ বিদ্যালয় | ১৯৪৭/৮ এ ২৫৯৮ ১৯৬৫/৬ এ ৪৪৭২ বেড়েছে ১৭৬% |
১৯৪৭/৮ এ ৩৪৮১ ১৯৬৫/৬ এ ৩৯৬৪ বেড়েছে ১১৪% |
কলেজ | ১৯৪৭/৮ এ ৪০ ১৯৬৮/৯ এ ২৭১ বেড়েছে ৬৭৫% |
১৯৪৭/৮ এ ৫০ ১৯৬৮/৯ এ ১৬২ বেড়েছে ৩২০ % |
মেদিক্যাল/ইঞ্জিনিয়ারিং/কৃষি কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় | ১৯৪৭/৮ এ ৪ ১৯৬৮/৯ এ ১৭ বেড়েছে ৪২৫% |
১৯৪৭/৮ এ ৩ ১৯৬৮/৯ এ ৯ বেড়েছে ৩০০% |
শিক্ষিতের হার বৃদ্ধি | ১৯৪৭/৮ এ ২(৬৫৪ জন) ১৯৬৮/৯ এ ৬(১৮৭০৮ জন) বেড়েছে ৩০ গুণ |
১৯৪৭/৮ এ ১(১৬২০ জন) ১৯৬৮/৯ এ ৪(৮৮৩১ জন) বেড়েছে ৫ গুণ |
মজার ব্যাপার হল পূর্ব পাকিস্তানে স্কুলগামী মানুষের সংখ্যা বাড়লেও সরকারের অনাগ্রহতার জন্যে স্কুলের সংখ্যা কমে গেছে কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানে একই সময়ে সরকার একটি বিশাল পরিমাণ অঙ্কের অর্থ বিনিয়োগ করেছে স্কুলের পিছনে যার ফলশ্রুতিতে সেখানে স্কুলের সংখ্যা সাড়ে ৪ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এটা কি পশ্চিম পাকিস্তানী শিশুদের সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়ে তুলবার পরিকল্পনা নয়? একই চিত্র কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা ক্ষেত্রেও যেখানে অনেকগুলো প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এতে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে পাকিস্তানী সরকার পূর্ব পাকিস্তানের জনগোষ্ঠীকে শিক্ষাগত দিক থেকে পঙ্গু করে রাখবার পাঁয়তারা নিয়েছে তাদেরকে যথাযোগ্য সুযোগ সুবিধা দেয়া থেকে বিরত হয়ে। এবার স্কলারদের সঙ্খ্যার দিকে তাকান যাক। ১৯৪৭ সালে যেখানে পশ্চিমের চেয়ে পূর্বে দিগুন পরিমাণ স্কলার ছিল যা পরবর্তী ২০ বছরে ৫ গুণ বেড়েছে, সেখানে পশ্চিম পাকিস্তানে বেড়েছে ৩০ গুণ। কৃষি, চিকিৎসা, বিজ্ঞান, শিল্প গবেষণা কেন্দ্রগুলোর ১৬টির মধ্যে ১৩টি রয়েছে পশ্চিম পাকিস্তানে। এমনকি কলম্ব প্ল্যান, ফোর্ড ফাউন্ডেসন, কমনওয়েলথ এর মতন শিক্ষা বৃত্তি গুলোর অধিকাংশই পায় পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণ। কিছু কিছু ক্ষেত্রে এসবের কোন ধরণের বিজ্ঞাপন পূর্ব পাকিস্তানের পত্রিকায় প্রকাশ না করে সরাসরি পশ্চিম পকিস্তানের হাতে উপহার হিসেবে দেয়া হয়।
চাকরির ক্ষেত্রেও একই ধরণের বৈষম্য দেখা যায়। সিভিল, মিলিটারি ও অন্যান্য চাকরির ক্ষেত্রেও বাঙ্গালীদের শিক্ষা ব্যবস্থার মতন কম গুরুত্ব দেয়া হয়। পশ্চিমের অধিবাসীরা সকল চাকরির নিয়োগের ক্ষেত্রে অধিক সুবিধা পেয়ে থাকে কেননা বেশিরভাগের নিয়োগ কেন্দ্র পশ্চিমে অবস্থিত। আর্মি, নেভি, বিমান বাহিনী, সকল সরকারি দপ্তর এমনকি বেসরকারি দপ্তরও পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থিত। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তানের পত্রিকায় এসকল জায়গার নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ পায় না। কোন কোন ক্ষেত্রে এখানে ইন্টার্ভিউ নেয়া হয় না। এর উপর বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নিয়োগ বোর্ড এর মেম্বাররা পশ্চিম পাকিস্তানী হন যাদের মধ্যে পূর্বের অধিবাসীদেরকে নেবার মানসিকতা থাকে না। আর্ম ফোর্স এ শারীরিক যোগ্যতা এত বেশি কঠিন যে তা বেশিরভাগ বাঙ্গালীদের জন্যই অনুপযুক্ত। এরফলে এক্ষেত্রে বাঙ্গালীদেরকে বাদ দেয়া আরও সহজতর হয়ে গেছে। নিচের ছকে এ বিষয়ে আরও ভালোভাবে দেয়া হলঃ
পশ্চিম পাকিস্তান | পূর্ব পাকিস্তান | |
্সিভিল সার্ভিস | ৮৪% | ১৬% |
ফরেন সার্ভিস | ৮৫% | ১৫% |
ফরেন হেড মিশন (সংখ্যা) | ৬০ | ৯ |
আর্মি | ৯৫% | ৫% |
আর্মি অফিসার ও জেনারেল র্যাঙ্ক | ১৬ | ১ |
নেভি টেকনিক্যাল | ৮১% | ১৯% |
নেভি নন টেকনিক্যাল | ৯১% | ৯% |
এয়ার ফোর্স পাইলট | ৮৯% | ১১% |
আর্মড ফোর্স (সংখ্যা) | ৫০০০০০ | ২০০০০ |
পাকিস্তান এয়ার লাইন্স (সংখ্যা) | ৭০০০ | ২৮০ |
পি আই এ ডিরেক্টরস (সংখ্যা) | ৯ | ১ |
পি আই এ ম্যানেজার (সংখ্যা) | ৫ | নাই |
রেইলওয়ে বোর্ড ডিরেক্টর (সংখ্যা) | ৭ | ১ |
প্রাতিষ্ঠানিক বৈষম্য
১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের রাজধানী হিসেবে করাচী নির্ধারিত হওয়ার ঘটনা পশ্চিমকে একটি বড় শক্তি দিয়েছে। ২০০ মিলিওন রূপি লেগেছে একে উন্নত করতে এবং উন্নয়ন সাধনের পর এটি পশ্চিম পাকিস্তান আঞ্চলিক সরকারের কাছে পুরোপুরি হস্তান্তর করা হয়েছে। সকল ইনকামও তাই আঞ্চলিক সরকারের হাতে যাচ্ছে। এরপর আবারও ২০০ মিলিওন রূপি খরচ করা হচ্ছে ইসলামাবাদকে উন্নত করবার জন্য রাজধানী হিসেবে। অন্যদিকে পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকার জন্য বরাদ্দ মাত্র ২০ মিলিওন রূপি।
আর্মি, নেভি, বিমান বাহিনীসহ সকল দপ্তর পশ্চিমে করা হয়েছে। একই সাথে সকল মিলিটারি একেদেমিও। এইটা উল্লেখ্য যে ৬০% বাজেট যায় মিলিটারিদের জন্য যার আবার ৮০% খরচ হয় মিলিটারি কন্ট্রাঙ্কটর, আর্মড পারসনাল যাদের সকলেই পশ্চিম পাকিস্তানী।
সকল পাবলিক ও প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানের হেড কোয়ার্টার যেমন স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তান, পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ার লাইন্স, ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান এবং অন্যান্য ব্যাংক, ইনস্যুরেন্স কোম্পানি, পাকিস্তান ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন, ন্যাশনাল শিপিং কর্পোরেশন, ফরেন মিশন এবং আরও ১০০টা পাকিস্তানী ও বৈদেশিক এজেন্সির প্রধান দপ্তর অবস্থিত পশ্চিম পাকিস্তানে যার প্রধানও পশ্চিম পাকিস্তানী এবং এসকল প্রতিষ্ঠানের পলিসি এমনি হয়ে থাকে যেন পশ্চিম পাকিস্তানীরাই অধিক সুবিধা লাভ করে।
সামাজিক উন্নয়ন
সামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রেও একই বৈষম্য লক্ষ্য করা যায়। এখানে কিছু পরিসংখ্যান দেয়া হলঃ
পশ্চিম পাকিস্তান | পূর্ব পাকিস্তান | |
জনসংখ্যা | ৫৫ মিলিয়ন | ৭৫ মিলিয়ন |
ডাক্তারের সংখ্যা | ১২৪০০ | ৭৬০০ |
হাসপাতালের আসনসংখ্যা | ২৬০০০ | ৬ |
গ্রাম্য স্বাস্থ্য কেন্দ্র | ৩২৫ | ৮৮ |
শহুরে কমিউনিটি উন্নয়ন প্রজেক্ট | ৮১ | ৫২ |
পূর্ব পাকিস্তানকে বলা হয় পৃথিবীর অন্যতম দরিদ্র দেশ। এমনকি অর্থনীতিবিদ, নিরপেক্ষ ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনের বিস্ময় প্রকাশ করেছেন যে কিভাবে পূর্ব পাকিস্তানকে তার সহযোদ্ধা পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে তুলনা করা যায়?
সিভিল লেবার ফোর্স এ চাকরি | পশ্চিম পাকিস্তান | পূর্ব পাকিস্তান |
গ্রামাঞ্চল ৫৯% শহর ৪১% |
গ্রামাঞ্চল ৮৬% শহর ১৪% |
পশ্চিম পাকিস্তানে শিল্পোন্নয়ন গঠিত ছিল ৪% ক্ষেত্রে লাবার ফোর্স, চাকরি এবং উন্নতর জীবন নির্বাহের মাধ্যম। পূর্ব পাকিস্তানে দরিদ্র উন্নয়ন সিল্পায়নের ক্ষেত্রে ছিল ১৪% শহরের সকল চাকরির ক্ষেত্রে। এই বিষয়টি পার ক্যাপিতা ইঙ্কাম ও গ্রস ডোমেস্টিক প্রডাক্ট এ প্রভাব ফেলে।
পার ক্যাপিতা ইনকাম পাকিস্তানী রুপিতে |
পশ্চিম পাকিস্তান | পূর্ব পাকিস্তান |
১৯৬০ এ ৩৫৫ ১৯৭০ এ ৪৯২ |
১৯৬০ এ ২৬৯ ১৯৭০ এ ৩০৮ |
মাথাপিছু আয়ের ক্ষেত্রে ১৯৬০ সালে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের তফাত ছিল ৮৬। দশ বছর পর এটি বেড়ে দাঁড়ায় ১৮৪। অন্য কথায় বলা যায় জীবন ধারণের মান পূর্ব পাকিস্তানে দিন দিন ক্মছে এবং পশ্চিম পাকিস্তানে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে।
গ্রস ডোমেস্টিক প্রডাক্ট পার ক্যাপিতা | পশ্চিম পাকিস্তান | পূর্ব পাকিস্তান |
১৯৫৯/৬০ এ ৩১২ ১৯৬৪/৬৫ এ ৩৯১ |
১৯৫৯/৬০ এ ২৪২ ১৯৬৪/৫ এ ২৯৭ |
পূর্ব পাকিস্তানে প্রধান খাদ্যশস্য ধান এবং পশ্চিম পাকিস্তানে গম। এবার নিম্নে এসম্পরকে কিছু তথ্য দেখা যাক
পশ্চিম পাকিস্তান | পূর্ব পাকিস্তান | |
ধান প্রতি মাউন্দ (৮২ পাউন্দ) | ১৮ রূপি | ৫০ রূপি |
গম প্রতি মাউন্দ (৮২ পাউন্দ) | ১০ রূপি | ৩ রূপি |
যখন একজন পূর্ব পাকিস্তানীকে তার সঙ্গির তুলনায় অনেক বেশি দামে খাবার সংরহ করতে হয় অথচ তার আয় অত্যন্ত অল্প তখন সে কিভাবে ভালো স্বাস্থ্যর কথা চিন্তা করতে পারে?
বিষয়টি আরও পরিষ্কার হবে যদি আমরা গ্রামাঞ্চলে খাদ্য পুষ্টি বিবেচনায় আনি
পশ্চিম পাকিস্তান | পূর্ব পাকিস্তান | |
গ্রামাঞ্চলে গ্রহণকৃত ক্যালরির পরিমাণ ১৯৬০ – ৬৫ জনপ্রতি প্রতিদিন | ১৬২৫ | ১৫৫৬ |
শহর অঞ্চলে এই বৈষম্য আরও প্রকট ( ইউকে তে ক্যালরি গ্রহণ করে ৩২৫০)
পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে প্রাপ্ত এসকল তথ্য অনুসারে বলা যায় যে পূর্ব পাকিস্তান অর্থনৈতিক দিক থেকে কারও সাহায্য ছাড়াই টিকে থাকতে সক্ষম। উন্নতির জন্য যে নুন্যতম সম্পদ প্রয়োজন তা আছে এই দেশের, কেবল চিন্তাধারাটুকু নেই। পর্যাপ্ত বৈদেশিক সহায়তা এবং নিজস্ব সম্পদের সদ্ব্যবহার এর সুযোগ পেলে বাংলাদেশের একটা সময়ে উন্নতি না করবার কোন কারনেই নাই। বিশ্ব শক্তির বোঝা উচিৎ যে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতা অর্জনের জন্য পূর্ণ প্রস্তুত, আর এই সচ্ছলতা অর্জনের অধিকার কোন ক্রমেই বিলম্বিত করে রাখা উচিৎ নয়।
সর্বোপরি সামাজিক ও অর্থনৈতিক দিক হতে সে যে অবহেলা ও অন্যায় আচরনের শিকার হয়েছে গত দুই দস্ক ধরে, সুষ্ঠু বিচার পাওয়া এবং স্বরাজ পাওয়া এখন তার নইতিক অধিকার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সকল তথ্য ও পরিসংখ্যান অফিশিয়াল ও অন্যান্য বিশ্বস্ত উৎস হতে নেওয়া হয়েছে যেমন ন্যাশনাল প্ল্যানিং কমিশন, পাকিস্তানের ২০ বছর, সেন্ট্রাল ব্যুরো অব পাকিস্তান, ডিপার্টমেন্ট অব ইনভেস্টমেন্ট প্রোমোশন, সেন্ট্রাল বোর্ড অব রেভিনিউ, সেন্ট্রাল স্ট্যাটিস্টিকস অফিস, পাকিস্তান ইয়ার বুক ১৯৭০, মেরিন ফিশারিজ ডিপার্টমেন্ট, পাকিস্তান ইকোনমিক সার্ভে, গবর্নমেন্ট অব পাকিস্তান বাজেট, কেসিং কনটেম্পোরারি আর্কাইভস, ফিন্যান্সিয়াল টাইমস, দ্য ইকোনমিকস, ডিপার্টমেন্ট প্রস্পেক্টস অফ পাকিস্তান ( একজন নরয়েজিয়ান অর্থনীতিবিদ রচিত)