শিরোনাম | সুত্র | তারিখ |
“মোনাফেকদের ক্ষমা নেই” | বাংলাদেশ সরকার,প্রচার দপ্তর | …………১৯৭১ |
গণপ্রজাতান্ত্রিক বাংলাদেশ সরকার
মোনাফেকদের ক্ষমা নেই
ক্ষমতার দম্ভে, উম্মত্ততায় মানুষ বিবেকবুদ্ধি হারিয়ে এমন সব কথাবার্তা বলে থাকে যখন মনে হয় মানুষ তাঁর আসন হারিয়ে জানোয়ারের স্তরে নেমে এসেছে।
পাকিস্তানের ২৩ বছরের ইতহাস এরূপ বহু নজির সৃষ্টি করেছে। পশ্চিম পাকিস্তানের কায়েমী স্বার্থবাদী গোষ্ঠী নিজেদের স্বার্থে এতটুকু হতে পড়তে দেখলেই অস্থির হয়ে ওঠে। ন্যায় নীতির সমর্থকদের বিরুদ্ধে পশ্চিম পাঞ্জাবী গোষ্ঠী ও তাঁদের তাঁবেদারগণ তখন তাঁদের বিরুদ্ধে কুৎসা রটনায়, ষড়যন্ত্রে লেগে যায়। পাকিস্তানের ২৩ বছরের ইতিহাসের ষড়যন্ত্রের ইতিহাস, শোষণ ও পীড়নের ইতিহাস।
সিরাজউদ্দৌলা নাটকে নাট্যকার নবাব সিরাজউদ্দৌলার মুখ দিয়ে জানিয়েছেনঃ “মীরজাফর, জগৎশেঠ, রাজবল্লভ, উমিচাঁদের দল কি আর জন্মগ্রহন করবে না গোলাম হোসেন?” নাট্যকারের সে আশঙ্কা অমুলক নয়। বাংলায় বহু বিশ্বাসঘাতক জন্ম নিয়েছে এবং তাঁরা বহাল তবিয়তে রাংলাদেশ ও বাঙালীর সাথে বেইমানী করে চলছে। বাংলার এই বেঈমান, বিশ্বাসঘাতকগণই কায়েমি স্বার্থবাদী গোষ্ঠীর পদলেহী হয়ে দেশ ও দেশের সর্বনাশ করে চলছে। এদের দাস-সুলভ মনোভাবের উপর নির্ভর করে তাদের পাঞ্জাবী প্রভুরা বাঙালীর বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা, বাঙ্গালীদের উৎখাত করে।
বাংলার মানুষ যখনই তাদের হক আদায়ের দাবী জানিয়েছে, ইনসাফের আওয়াজ তুলেছে, সুখে-শান্তিতে, মর্যাদার সাথে বাঁচতে চেয়েছে তখনই পশ্চিম পাকিস্তানী গোষ্ঠী তাদের “দেশদ্রোহী”, “বিচ্ছিনতাবাদী”, “ভারতের দালাল” বলে কুৎসা রটনা করে বাংলার সরল, সহজ মানুষের মনে ঘৃণা ও বিদ্বেষ সৃষ্ঠির চেষ্টা করেছে।
অদৃষ্টের নির্মম পরিহাস! যে দেশের সিংহপুরুষ মরহুম এ, কে ফজলুর হক লাহোর প্রস্তাব উথাপন করল, যে দেশের মানুষ তাদের প্রিয় নেতা মরহুম হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানির নেতৃত্বে পাকিস্তানের পক্ষে নিরঙ্কুশ সমর্থন দিয়ে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠাকে সুনিশ্চিত করেছিল, যে দেশের মানুষ তাদের প্রাপ্য আসন কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, মরহুম লিয়াকত আলী খান, চৌধুরী খালিকুজ্জামান, চৌধুরী মোহাম্মদ আলী, খানা আবদুল কাইয়ুম খাঙ্কে ছেড়ে দিয়েছিল, সে দেশের মানুষ ও তাদের নেতৃবৃন্দের দেশপ্রেমে কটাক্ষ করা হয়েছে। অদৃষ্টের নির্মম পরিহাস! যে দেশের আবাল-ব্রিদ্ধ-বনিত, নিজেদের অটুট ধর্ম-বিশ্বাস পঞ্জেগানা নামাজ আদায়ে ভুল করে না, ধর্মীয়ও অনুশাসন মেনে মদ খেয়ে বেহুশ হয়ে থাকে না, কামুক নারীর উলঙ্গ নৃত্য ও উৎকট সঙ্গীত শুনে ক্লাবে,ক্যাবারেতে আল্লাহর শান খুঁজে ফেরে না, ধমীয় বিধান মেনে যারা জিঘাংসাকে সংযত করে প্রীতি ও সৌহার্দ্যের বাণী প্রচার করে, যে দেশের মানুষ পশ্চিম পাঞ্জাবী শোষণ ও শাসনকে ছোট ভাইয়ের উৎপাত বলে মনে করে নির্যাতনের অবসান কামনায় তাদের উপর আল্লাহতালার হেদায়েত বর্ষণের প্রাথনা জানায়, সেই বাংলাদেশের মানুষের ধর্ম বিশ্বাসে সন্দেহ সৃষ্টি করার অপপ্রয়াস চালান হয়েছে ও হচ্ছে।
অদৃষ্টের নির্মম পরিহাস! যারা কায়দে আজম মোহাম্মাদ আলী জিন্নাহকে বিনা চিকিৎসায়, অবহেলায় মৃত্যুবরণ করতে বাধ্য করেছিল, যারা লিয়াকত আলী খাঙ্কে হত্যা করেছিল, যারা নিজেদের প্রভুত্ব বিস্তারে রাজনিতিতে ষড়যন্ত্রের আমদানি করে পাকিস্তানের পরিবেশকে বিষাক্ত করে তুলেছে, যারা ব্রিটিশের গোলামি করেছে আর পড়ে গোষ্ঠীস্বার্থে জনপ্রতিনিধিদের সরিয়ে দিয়ে নিজেরাই পাকিস্তানের ভাগ্য বিধাতা হয়েছে, যারা
পাকিস্তানে গণতন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে স্বৈরতন্ত্র ও সামরিক শাসন চালু করেছে, যারা কাসিম ভাট্টির মত চোরাচালানকারীর সাথে আঁতাত করে কোটি কোটি তাকার সোনার চোরাকারবার করেছিল, যারা ইরান, আফগান সীমান্তে চোরাকারবার ও চোরাচালানের খোলাবাজার চালু রেখেছে, যারা ইরান-তুরস্কের মাধ্যমে ইহুদীদের সাথে গোপন সংযোগ রেখেছে, বাংলাদেশের বরেণ্য নেতৃবেন্দ ও বাংলার গণপ্রতিনিধিবৃন্দকে দেশদ্রোহী বলে অভিযুক্ত করছে।
কায়েমি স্বার্থবাদী মহল ও তাদের পদসেবীগন, যারা জাতির স্বার্থের চাইতে, নিজেদের স্বার্থের উপর অধিক গুরুত্ব দিয়ে আসছে, যারা তাদের স্বার্থে কোটি কোটি লোককে অভুক্ত রেখে, অনটনে রেখে, বেকার রেখে, বন্যা ও জলোচ্ছ্বাসে বাঙালীর জানমাল ধ্বংস হয়ে যেতে ষড়যন্ত্র করেছে আকাশচুম্বী বৈষম্যের সৃষ্টি করে মানুষের মনকে বিষাক্ত করে দিয়েছে; যারা ষড়যন্ত্র করে, সামরিক শক্তির প্রয়োগ এবং নির্বিচার গনহত্যার ও পোড়ামাটি নীতির অনুসরণে বাঙ্গালী, বেলুচী ও পাঠানদের মনকে তিক্ত করে দিয়েছে এবং যার ফলে নির্যাতিত-নিপীড়িত বাঙালী, বেলুচী ও পাঠান আজ পশ্চিম পাঞ্জাবীদের সাথে একাত্ম হতে পারছে না,যার অপরিহার্য ফল হিসাবে পাকিস্তান আজ খান খান হয়ে গিয়েছে, সেই কুটচক্রী, কায়েমি স্বার্থবাদী পশ্চিম পাঞ্জাবী গোষ্ঠী বেঁচে থাকার দাবীকে মুখর বাংলার মানুষের বিচ্ছিনতাবাদী বলে প্রচার করেছে।
অদৃষ্টের নির্মম পরিহাস! মুসলমান মুসমানের উপর নিরজাতন করতে পারবে না, হত্যা করতে পারবে না, অমুসলমানদের জান্মালের পূর্ণ নিরাপত্তা মুসল্মাঙ্কে দিতে হবে,অহেতুক আশান্তি সৃষ্টি করতে পারবে না-ইসলামের এই সুস্পষ্ট নির্দেশ লুংঘন করে যারা স্রেফ নিজের প্রভুত্ব, শোষণ ও শাসন অক্ষুণ্ণ রাখার উদ্দেশ্যে বাংলাদেশের মুসলমানদের নির্বিচার হত্যা করছে, তাদের ধন-সম্পত্তি লুট করছে, তাদের বাড়ী-ঘর জ্বালিয়ে দিচ্ছে,হিন্দু বৌদ্ধ খৃষ্টানদের উপর চরম নির্যাতন চালিয়ে তাদেরভিটামাটি থেকে উচ্ছেদ করেছে, যাদের ভাড়াটিয়া সৈন্য নিজেদের মুসলমান বলে দাবী করছে আর বাংলার মুসলমান নারীদের উলঙ্গ করে মা-বাপের সামনে পর পর পাশবিক অত্যাচার চালিয়ে শেষে গুলি করে মারছে, নিস্পাপ শিশু-কন্যাদের, যাদের সঙ্গে রাজনীতি বা দুনিয়ার কোন সম্পর্ক এখন গড়ে ওঠেনি তাদের খুন করছে, মুসলমান বাঙ্গালিকে গ্রেপ্তার করে তাদের দিয়ে গর্ত খুঁড়ে গুলী করে মারার পর তাদেরই সে গর্তে ফেলে দিচ্ছে, নিরাপরাধ সাহিত্যিক, সাংবাদিক, শিক্ষক, শিক্ষাবিদ ও শিল্পীদের নির্বিচারে খুন করেছে ও করেছে, যারা মদে চুর হয়ে থাকে, কোরআন-হাদিসের বিধি-বিধানের ধার ধারে না, যার সুন্নী সম্প্রদায়কে দাবিয়ে রেখে শিয়া-কাদিয়ানি প্রভুত্ব কায়েমের চক্রান্ত্রে মেতে উথেছে-তারাই ইসলামের জিগির তুলে বাঙালীর সরল মনকে বিভ্রান্ত করার অপচেষ্টা চালাচ্ছে।
পশ্চিম পাকিস্তান হানাদারগন যদি ইসলামে বিশ্বাসী হত তাহলে তাঁরা নিরাপরাধ বাঙ্গালিকে নির্বিচারে হত্যা করতে পারত না। বাঙালীর বুকে গুলী লেগে যখন মৃত্যু নেমে আসে, তখন তাঁর মুখ দিয়ে কি কালেমা উচ্চারিত হয় না? কি অপরাধ করেছিল বাংলার নারী ও শিশু সন্তানেরা? কেন আজ তাঁরা সর্বহারা হয়ে গ্রাম্থেকে গ্রামান্তরে প্রান ভয়ে ছুটে চলেছে? ইয়াহিয়া খান কেন নির্বাচন দিয়েছিল,কেন বলেছিল নির্বাচন সুষ্ঠ নিরপেক্ষ হয়েছিল,আজ আবার কেনই বা আওয়ামী লীগকে বে-আইনী করল,বাঙ্গালির উপর নরপিশাচ ভারাটিয়াদের অতর্কিতভাবে লেলিয়ে দিল?
ধর্ম যদি রাষ্ট্রীয় বন্ধনী, তবে সাউদী আরব কেন ইয়ামেনের মুসলমানদের উপর নির্যাতন চালাচ্ছে-মিশর, সিরিয়া ইরাক,ইরস্ক, তুরস্ক,লিবিয়া, আলবেনিয়া, তিউনিসিয়া, মরক্কো,সুদান পাকিস্তান এক হতে পারল না কেন? পাকিস্তান কেন আফগানিস্তানের বিরুদ্ধে বিষোদগার করেছে? পাকিস্তান ইরান ও তুরস্কের মাধ্যমে কেন ইহুদীদের সাথে জগাজগ রক্ষা করে চলেছে আর বাইরে দেখাচ্ছে তাঁরা ইসরাইলের বিরধি-এ মোনাফেকীর জবাব দেবে কে?প্যালেস্টাইনের মুসলমান মুক্তিফৌজ আজ জর্ডানের মুসলমানদের হাতে কেন খুন হচ্ছে? বাঙালী কি এতই বুজদিল?বাঙ্গালি সব জানে,সব বোঝে, কেবল সময়ের অপেক্ষায় আছে।বাঙ্গালি আজ সম্পূর্ন সচেতন।
আর এই ক্ষমতালোভী স্বার্থপর মহলের পদলেহন করে তাদের মনন্তুষ্টির জন্যে চাটুকারিতা করে চলেছে বাংলার কিছু সংখ্যক বিশ্বাসঘাতক, পিশাচ হানাদারদের সাময়িক সাফল্যকে তাঁরা স্হায়ী সাফল্য বলে মনে করে, হানাদার পশুদের সাথে হাত মিলিয়ে বাংলার গণজীবনে হাহাকার সৃষ্টি করেছে। বিশ্বাসঘাতকদের কেউ কখনো বিশ্বাস করে না- ইতিহাস তাঁর সাক্ষী। মীরজাফরকে রেহাই দেওয়া হয়নি। বিশ্বাসঘাতক যাদের জন্যে দেশ ও জাতির সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে, স্বার্থসিদ্ধির পর তারাই তাদের খতম করে দেয়। তাই বিসসাসঘাতকের জান-মাল দু’দিক থেকেই বিপন্ন। বাংলার মুক্তিকামী মানুষ, বাংলার মাতি থেকে এসব বিশ্বাসঘাতক মোনাফেক, পরগাছাদের নির্মূল করে দিতে বদ্ধপরিকর। এ অভিযান চলছে। ইতিমধ্যেই বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে কয়েকজন বিশ্বাসঘাতককে বিলোপ করে দেয়া হয়েছে। বিশ্বাসঘাতককে তাদেরর কাজের জন্য চরম মূল্য দিতে হবে। কোন ক্ষমা নেই। তাদের উৎখাত করা হবেই-তাদের পাঞ্জাবী প্রভুদের বেষ্টনী ভেদ করে মুক্তি সংগ্রামী বুলেত বিশ্বাসঘাতকের লাগবেই। নির্যাতিত, নিপীড়িত মানুষের তীব্র জ্বালায় বিশ্বাসঘাতকদের ধন-সম্পত্তি দাউ দাউ করে জ্বলবে। জাতীয় স্বার্থে বাঙালী শত্রুকে ক্ষমা করবে না, করতে পারে না-তাদের চরম শাস্তি দেওয়া হবে।
আজকের এ সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম। বাঙালীর এ সংগ্রাম বাঁচার সংগ্রাম, সত্য ও ন্যায়ের সংগ্রাম। মানুহস নিজের গরজে রাষ্ট্র সৃষ্টি করে। রাষ্ট্রের জন্য মানুষের সৃষ্টি নয়। মানুষকে মেরে রাষ্ট্র হতে পারে না। বাঙালী তাদের দু’যুগের তিক্ত অভিজ্ঞতায় নিজেরাই নিজেদের শাসন করার দাবী জানিয়েছে; বাঁচার মত বাঁচতে দাবী জানিয়েছে। বাংলাই তাদের সন্তানদের জন্যে উপযুক্ত শিক্ষা লাভের, চিকিৎসার দাবী জানিয়েছে; অনাহার- অনটনের তাহ থেকে মুক্তিলাভের দাবী জানিয়েছে, বন্যা ও প্লাবনের কবল থেকে রক্ষা করার দাবী জানিয়েছে, বেকারত্বের অবসানে কর্মসংস্হানের দাবী জানিয়েছে। মানুষের মৌলিক অধিকার শান্তিতে ও সুখে বাস করার দাবী জানিয়েছে। অন্য কোন অপরাধ করেনি। বাঙালীর অটুট সংকল্প, ঐক্য ও দৃঢ়তা তাঁর মুক্তি আনবে; বাঙালী পশ্চিম পাকিস্তানী অক্টোপাসের কবল থেকে মুক্ত হবেই।
আল্লাহতা’লা প্রতিশ্রুতি দিয়েছেনঃ সত্যের জয় ও মিথ্যার বিনাশ অবশ্যম্ভাবী। বাঙালী এত সম্পূর্ণ বিশ্বাসী।
জয়বাংলা