৩ বৈশাখ ১৩৭৮ শনিবার ১৭ এপ্ৰিল ১৯৭১
— কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুর মহকুমার মুক্তাঞ্চল ভবের পারায় (বৈদ্যনাথ তলা) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের অস্থায়ী রাজধানী মুজিবনগরে বাংলাদেশ সরকার গঠন করা হয়। সকাল ১১টার পর দেশী বিদেশী সাংবাদিক ও হাজার হাজার স্থানীয় বাসিন্দাদের উপস্থিতিতে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সনদ পাঠ করেন আওয়ামী লীগের চীফ হুইপ অধ্যাপক মুহম্মদ ইউসুফ আলী, এই আনুষ্ঠানিক ঘোষণাপত্ৰ পাঠের মধ্যে দিয়ে ২৬ মার্চ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের যে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন তা সাংগঠনিক রূপ নেয়।
-অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি উপস্থিত জনতা ও সাংবাদিকদের সঙ্গে তাঁর মন্ত্রিসভা-সদস্যদের পরিচয় করিয়ে দেন। সশস্ত্ৰ বাহিনীর অভিবাদন গ্রহণ করে জাতীয় সংগীত গীত হয়। তিনি ভাষণে বলেন, পৃথিবীর মানচিত্রে আজ যে নতুন রাষ্ট্রের জন্ম লগ্নের সূচনা হলো তা চির দিন থাকবে। পৃথিবীর কোন শক্তি তা মুছে দিতে পারবে না।
— মুজিব নগরে শপথ অনুষ্ঠানে দেশী, ভারতীয় ও বিদেশী ১২৭ (একশ সাতাশ জন) সাংবাদিক উপস্থিত ছিলেন। জনাব আব্দুল মান্নান এম, এন, এ, সভা পরিচালনা করেন। শ্ৰীফণিভূষন মজুমদার, আব্দুর রব সেরনিয়াবাত ও সোহরাব হোসেন সহ যশোর খুলনার বহু গণপ্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন। প্রধান মন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ এক প্রেস বিবৃতিতে বলেন, বাংলাদেশ আজ যুদ্ধে লিপ্ত। পাকিস্তানের উপনিবেশিক নির্যাতনের বিরুদ্ধে এই যুদ্ধ। এটা
আমাদের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার সংগ্রাম, আমাদের বাঁচা মরার সংগ্রাম, এ ছাড়া আমাদের আর কোন গত্যন্তর ছিল না।
-পাকিস্তান আজ মৃত এবং অসংখ্য আদম সন্তানের লাশের তলায় পাকিস্তানের কবর রচিত হয়েছে। বাংলাদেশ শত সহস্ত্র মৃত্যু বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে দুর্লঙ্ঘ্য প্রাচীর হয়ে থাকবে। স্বাধীন বাংলাদেশ আজ একটা বাস্তব সত্ৎ সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালী তাদের অজেয় মনোবল ও সাহসের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম দিয়েছে এবং প্রতিদিন হাজার হাজার বাঙ্গালী সন্তান রক্ত দিয়ে এ নতুন জাতিকে ধূংস করতে পারবে না। আজ হোক, কাল হোক, দুনিয়ার ছোট বড় প্রতিটি রাষ্ট্রকেই গ্রহণ করতে হবে এ নতুন জাতিকে, স্থান দিতে হবে বিশ্ব রাষ্ট্রপুঞ্জে আমাদের সংগ্রামকে সোভিয়েট ইউনিয়ন, ভারত এবং বিশ্বের অন্যান্য বহু দেশের স্বাধীনতা প্রিয় মানুষ যে সমর্থন দিয়েছেন, তা আমরা চিরকৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করবো। গণচীন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফুন্সি, গ্রেটবৃটেন, ও অন্যান্য দেশের কাছে অনুরূপ সমর্থন আশা করি। তা পেলে তাঁদের অভিনন্দন জানাবো।প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ বৈদ্যনাথ তলার নতুন নামকরণ মুজিবনগর ঘোষণা করেন।
বাহ্মণবাড়িয়া পাকবাহিনীর হাতে পতন ঘটে। মুক্তিফৌজ সীমান্ত অতিক্রম করে।
-রংপুরের হবিগঞ্জে বীর রেজিমেন্টের ১৭ জনকে ক্যানেলের ধারে পাকবাহিনী হত্যা করে। সৈন্যরা চলে গেলে গ্রামবাসীরা লাশ দাফন করে।
-মেহেরপুর বৈদ্যনাথ তলার নতুন নাম করণ করেন প্রধান মন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ মুজিব নগরে বিদেশী সাংবাদিকগণ মুজিব নগরে বিপ্লবী সচিবালয় দেখেন। মেজর আবু ওসমান চৌধুরীর বাহিনী ও মামবুব এস,পি, মন্ত্রিসভার নিরাপত্তা ও গার্ড অবঅনার পরিচালনা করেন। কর্নেল (অবঃ) এম এ জি ওসমানী সামরিক বাহিনীর অভিনন্দন জানান অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামকে। অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন আব্দুল মান্নান এম এন এ (টাঙ্গাইল)।
ভারতের প্রধান নেতা জয় প্রকাশ নারায়ণ পাটনাতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সর্বাত্মক সাহায্য ও বিপ্লবী বাংলাদেশ সরকারের স্বীকৃতি দানের জন্য আহবান জানান। পরে তিনি বাংলাদেশ সংগ্রামের সমর্থনে জনমত সৃষ্টি করতে ৪৬ দিনের বিশ্ব সফরে বের হন।
বিপ্লবী মন্ত্রীসভার শপথ অনুষ্ঠানের পর মুজিবনগরের ইপিআর ক্যাম্পে অবস্থান নেয়। বিদেশী সাংবাদিক ও অভ্যগতগণ ভারতে চলে যাবার পর বিপ্লবী মন্ত্রীসভার সদস্যগণ অনুচ্চারিত স্থানের (কলকাতার) উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। উল্লেখ্য সমগ্র অনুষ্ঠান সমাপ্তির একঘন্টার মধ্যে পাকবাহিনী মেহেরপুর দখল করে নেয়।
-ফরিদপুর জেলা প্রশাসক ও এম এন এ কে, এম ওবায়দুর রহমানের সাথে হেমায়েত বাহিনীর প্রধান হেমায়েত সাক্ষাৎ করেন এবং পুলিশী বাহিনী ও অস্ত্র শস্ত্রের নিয়ন্ত্রুণ হাতে পাবার দাবী জানায়।
-উল্লেখ্য, আন্তর্জাতিক আইননানুযায়ী বঙ্গবন্ধু কর্তৃক স্বাধীনতা ঘোষণা এবং গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার প্রতিষ্ঠা সম্পূর্ণ বৈধ। কেননা যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকনের মতানুসারে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নিকট যদি ক্ষমতা হস্তান্তর না করা হয় এবং গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় বাধার সৃষ্টি করা হয়, তা হলে সে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল জনগণের ইচ্ছানুসারে ফেডারেশন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বাধীন রাষ্ট্রগঠন করতে পারে।
ভারতের বিভিন্ন রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক সংগঠন থেকে গণ প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতি চাপ সৃষ্টি করতে থাকে। শ্ৰীমতি ইন্দিরা গান্ধী ঐসব Clamourersজন্য প্রশ্নোত্তরে বলে, এখন নয়, উপযুক্ত সময়ে স্বীকৃতি দেয়া হবে, ওটা সরকারের সিদ্ধান্তের ওপর ছেড়ে দিন। “Not yet, At the appropriote time, Leave that for the Government to decide.”
–রাত ১১-৩০ মিঃ মেজর শাফায়েত জামিল, ক্যাপ্টেন আইনউদ্দিন সহ পাঁচ অফিসার ও ৬০জন সৈন্য নিয়ে তিতাস নদীর ব্রীজ ধ্বংস করেন।
-কলকাতার দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত হয়ঃ পূর্বাবাংলার অশীতিপর বৃদ্ধ নেতা মওলানা আবদুর হামিদ খান ভাসানী গতকাল মাঝরাতে সীমান্তের এপারে এসে কোন এক যায়গায় কেন্দ্রীয় শিল্পোপান্নয়ন মন্ত্রী মঈনুল হক চৌধুরী ও আসামের তথ্য রাষ্ট্র মন্ত্রী সৈয়দ আমেদ আলীর সঙ্গে দেখা করে। একই পত্রিকায় অন্য আরেকটি সংবাদে বলা হয় গতকাল মাঝরাতে আসাম বাংলাদেশ সীমান্তের কাছাকাছি কোন এক জায়গায় তিনি মৌলানা ভাসানী ভারতের কাছে আবেদন জানান। উল্লেখ্য মওলানা ভাসানী ভারতের আসাম মুসলিম লীগের সভাপতি থাকাকালীন কোন এক সময় মইনুল হক সাহেব ছিলেন সংগঠনের সম্পাদক। পূর্বদিন রাত্রে (১৬ এপ্রিল) ফুলবাড়ি রেষ্ট হাউস থেকে মন্ত্রী মঈনল হক দিল্লীতে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাথে ফোনে আলাপ করে অনুমতি দিয়েছিলেন। কেননা একদিন ভারত সরকার ভাসানচারের এই বিপ্লবী মওলানাকে বিপদজনক মনে করে আসাম থেকে বের করে দিয়েছিলেন। দু’যুগ পরে ভারতের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী তাকে আসামের মাটিতে অভ্যর্থনা জানালেন। রাজনীতির গতিপথ বিচিত্ৰ স্বাধীনতা ভাসানী ভারত সাইদুল ইসলাম পৃষ্ঠাঃ১১
তাজউদ্দীন স্থানটির নামকরণ করলেন মুজিব নগর:
১৯৭১ এর ১৭ এপ্রিল। সকাল ন’টা। অস্থায়ী সরকারের প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমদ অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও অন্যান্যদের নিয়ে বৈদ্যনাথতলায় মঞ্চে এলেন। আশেপাশের গ্রাম থেকে চেয়ার আনা হয়েছে। সংগৃহীত চেয়ারগুলোর একটাও পূর্নাঙ্গ নয়। কোনটার হাতল নেই, কোনটার বা পা নেই। পাহারাদের জন্য নিয়োজিত আনসারদের তখনো রান্না হচ্ছিলো। ক্যাপ্টেন মাহবুব আর জনাব তওফিক এলাহী চৌধুরী তখন অনুষ্ঠানসূচী প্রণয়নে ব্যস্ত। গার্ড অব অনার দেয়ার জন্য কয়েক প্লাটুন ইপিআর এবং কিছু মুজাহিদ প্রস্তুত। ক্যাপ্টেন মাহবুব তাদের নিয়ে গার্ড অব অনার দিলেন অস্থায়ী সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতিকে। কথা ছিলো মেজর ওসমান পরিচালনা করবেন গার্ড অব অনার অনুষ্ঠান কিন্তু তিনি যুদ্ধক্ষেত্রে তখন শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে লিপ্ত। ফলে যুদ্ধক্ষেত্রে থেকে ফিরতে তার বিলম্ব হলো। প্রায় হাজার দুই লোক এসেছিলো অনুষ্ঠানে দৰ্শক হিসেবে। শতাধিক বিদেশী সাংবাদিক, ফটোগ্রাফার ও টিভি ক্যামেরাম্যান এসেছেন। বেলা ১১টা নাগাদ বহু প্ৰতীক্ষিত অনুষ্ঠান শুরু হলো। একটা জীপে করে জনাব তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, কর্নেল ওসমানী ও অন্যান্য কয়েকজনকে নিয়ে মঞ্চের তোরণের কাছে এলেন। গার্ড অব অনার ও জাতীয় সঙ্গীতের পর নেতৃবৃন্দ মঞ্চে বসলেন। গগনবিদারী শ্লোগান বিপুল করতালির মাঝে নেতৃবৃন্দ মঞ্চে বসলেন। গগনবিদারী শ্লোগান বিপুল করতালি আর উল্লাসের মাঝে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের স্বাধীনতা সনদটি পাঠ করলেন আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারী পার্টির চীফ হুইপ অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউসুফ আলী। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান সৈয়দ নজরুল ইসলাম প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দিন আহমদ স্বাধীনতা সনদের স্বপক্ষে ঐতিহাসিক ভাষণ দেন। এই সভায়ই কৰ্ণেল আতাউল গণি ওসমানীকে (বর্তমানে জেনারেল) মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি হিসেবে ঘোষণা করা হয়। অন্যান্য মন্ত্রীরা ছিলেন পররাষ্ট্র মন্ত্রী খোন্দকার মুশতাক আহমদ, মন্ত্রী পরিষদের সদস্য জনাব এম, মনসুর আলী ও জনাব এ,এইচ, এম, কামরুজ্জামান কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুর মহকুমাধীন ভবেরপাড়া গ্রাম সেই গ্রামের বৈদ্যনাথতলায় এক ছায়াঘেরা আম্রকাননে অনুষ্ঠিত এই ঐতিহাসিক ঘটনাকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন স্থানের নামকরণ করলেন মুজিব নগর।
(স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের শপথ গ্ৰহণ অনুষ্ঠানের বর্ণনা)
-বাংলাদেশ সরকারের বর্হিপ্রচার দপ্তইর (বাংলাদেশ মিশন ৯ সার্কাস এভ্যেনিউ) থেকে ইংরেজীতে প্রকাশিত বাংলাদেশ ১ম বর্ষ ১ সংখ্যায় বলা হয়। বাংলাবাহিনী দিনাজপুর রণাঙ্গনে বড় রকমের সাফাল্য অর্জন করেছেন। তারা দিনাজপুর শহর থেকে পাক সাঁজোয়া বাহিনীকে হটিয়ে দিয়েছেন। বাংলা বাহিনীর এই আক্রমণে পাক বাহিনীর বিশেষ ক্ষতি সাধিত হয়। এছাড়া রংপুর শহরের বীরগঞ্জে বাংলাবাহিনীর হাতে পাক বাহিনী পর্যুদস্ত হয়েছে চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, ও ঢাকাতে পাক বিমান বাহিনী প্রচণ্ড বোমাবর্ষণ করেছে এবং মেশিনগান থেকে গুলি চালিয়েছে। রংপুরের উপকণ্ঠে পাকফৌজ দু’শ সাঁওতালকে হত্যা করেছে। তাদের ঘরবাড়ি সব পুড়িয়ে দেয়া হয়।—স্বাধীন বাংলা বেতারে প্রকাশ গত ১৬ এপ্রিল মুক্তিবাহিনীর তীব্ৰ পাল্টা আক্ৰণের মুখে পাক বিমান বাহিনীর তিনখানা বিমান ধ্বংস হয়। এই নিয়ে মোট ১৭ খানা বিমান ধ্বংস হয়। পাক বিমান বাহিনী ময়মনসিংহ, ফেনী, আশুগঞ্জ, শীতাকুণ্ডে প্রচণ্ড বোমা বর্ষণ করে। মুক্তি বাহিনী চুয়াডাঙ্গায় পাকবাহিনীর হামলা ব্যর্থ করে দিয়েছে। ময়মনসিংহ কুমিল্লার ৯০০ কিলোমিটার পথে তুমুল যুদ্ধ চলেছে।
Reference:
একাত্তরের দশ মাস – রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী