You dont have javascript enabled! Please enable it! 16.04.1971 | ২ বৈশাখ ১৩৭৮ শুক্রবার ১৬ এপ্রিল ১৯৭১ | একাত্তরের দশ মাস - রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী - সংগ্রামের নোটবুক

২ বৈশাখ ১৩৭৮ শুক্রবার ১৬ এপ্রিল ১৯৭১

–পাঁচ গড় দখলের মধ্যে দিয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দিনাজপুর জেলায় পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ লাভ করে জনপদের পর জনপদ অগ্নিসংযোগ করে, হুত্যা, ধর্ষণ লুটপাট চালায়।

–প্রচণ্ড লড়াইয়ের পর মুক্তিসেনারা নিরাপদ আশ্রয়ে গেলে পাকবাহিনী কুষ্টিয়া ও লাকসামের শহরের কর্তৃক লাভ করে।

–কেন্দ্রীয়  শান্তি কমিটির কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য নাম ঘোষণা করা হয় । এরা হচ্ছে খাজা। খয়রুদ্দীন আহবায়ক নুরুল আমীন, এ, কিউ, এম শফিকুল ইসলাম, অধ্যাপক গোলাম আজম , মাহমুদ আলী , আব্দুল জাব্বার খদ্দর , মওলানা সিদ্দিক আহমদ, আবুল কাশেম, ইউসুফ আলী চৌধুরী ৯ (মোহন মিয়া) মওলানা সৈয়দ মোহাম্মদ মাসুম আব্দুল মতিন , অধ্যাপক গোলাম সারাওয়ার, ব্যারিষ্টার আফতাবুদ্দিন, পীর মোহাসে  উদ্দিন, আহাদ (দুদু মিয়া)এস, এম এম সোলায়মান এক, কে রফিকুল হোসেন , নুরুজ্জামান , আতাউল হক খান। তোয়াহাবিন হবিব, মেজর আফসার উদ্দিন, দেওয়ান, ওয়ারেসেত আলী ও হাকিম ইরতাজুর রহমান খান।

–নূরুল আমীনের নেতৃত্বে শান্তি কমিটির নেতৃত্ব গভর্নর জেনারেল টিক্কা খানের সাথে দেখা করেন।

—কুমিল্লা ত্রিপুরা সীমান্ত এলাকায় মুক্তিবাহিনী পাক বাহিনীর হামলা প্রতিহত করে। ভারতীয় গোলান্দাজ বাহিনী গোলাবর্ষণ করে এ হামলায় সাহায্য করে।

–কুষ্টিয়, চুয়াডাঙ্গা, বেনাপোলও কসরা সীমান্তে সারাদিন ধরে মুক্তি বাহিনী ও পাকসেনাদের মধ্যে সংঘর্ষ চলে।

–ঢাকায় কার্ফুর মেয়াদ সকাল ৫ টা থেকে রাত সাড়ে ১০টা পর্যন্ত শিথিল করা হয়।

–সামরিক কর্তৃপক্ষ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ও কর্মচারীদের অবিলম্বে কাজে যোগদান নির্দেশ দেন ।

–রাজশাহীর সারদায় প্রতিরোধ বাহিনীর সাথে পাকবাহিনীর প্রচণ্ড লড়াই হয়।আব্দুর রাজ্জাক (মুকুল) নামে নিবেদিত যোদ্ধা গুরুতর ভাবে আহত হয়।

–সন্ধ্যায় লর্ড সিনহা রোডে অস্থায়ী সরকারের কাছে জনাব গাজীউল হক বগুড়ার মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে প্রতিবেদন পেশ করেন।

–গভীর রাতে কলকাতা প্রেসক্লাব থেকে সকল সাংবাদিক বিপ্লবী বাংলাদেশ সরকার সদস্যদের সাথে  সাক্ষাৎকার জন্য ভারতীয় সহায়তার যাত্রা করে। কুষ্টিয়ার এম, এন, এ, আফজালুর রশিদ( ব্যারিষ্টার বাদল ) লিয়াজো ও প্রটোকলের দায়িত্ব পালন করেন।

–কীড ষ্ট্রীট থেকে গণ প্রতিনিধিগণও অনুচ্চারিত স্থানের উদ্দেশ্য গভীর রাতে যাত্রাকরে। উল্লেখ্য চুয়াডাঙ্গার বিপ্লবী সরকার গঠন ও শপথ গ্রহণের কথা ছিল।ডাঃ আসাবুল হক এম , এন , এ বিদেশী সাংবাদিকদের কাছে একথা ফাঁস করে দিলে পাকবাহিনী চুয়াডাঙ্গা দখল করে নেন। সেজন্য বিপ্লবী বাংলাদেশে সরকারের মন্ত্রীসভা শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের স্থান সম্বন্ধে গোপনীয়তা রক্ষা করা হয়।

–আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্র থেকে প্রত্যহ শরণার্থীদের বিধৃত বিচরণ প্রচার করে। পাক বাহিনী নারকীয় লোমহর্ষক গণহত্যার বিবরণ সাড়া বিশ্বের গণ মাধ্যমে প্রচার হটে থাকে।

–ডেইলি টেলিগ্রাফের প্রতিবেদক সাইমনের প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ যুক্তরাষ্ট্রীয় পত্রিকা ওয়াশিংটন প্রকাশ করে। উল্লেখ্য ২৫ মার্চের রাতে সাইমন ডিল ঢাকা ইন্টার কন্টিনেন্টাল হোটেলের ছাদে লুকিয়ে ছিলেন।  তিনি এ এপ ফটোগ্রাফার মিসেল লবেল্টকে  সঙ্গে জলন্ত শহর ও পৈশাচিক গনহত্যার সংবাদ নিয়ে বহু কষ্টে তল্লাসী এড়িয়ে বিমানে ব্যাংককে পৌছান। ঢাকা প্রথম বিস্তারিত সংবাদ প্রকাশিত হয় ৩০ মার্চ টেলিগ্রাফ।

–সমশেরনগর , ছাগলনাইয়া , বেলনিয়া থেকে মুক্তিবাহিনী ও পাকবাহিনী মধ্যে প্রচণ্ড গোলাবিনিময় হয়। হতাহতের সংবাদ জানা যায় নি।

–সিনেটর স্যাক্সবিকে লিখিত এক পত্রে যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্য সংস্থার চিকিৎসক ডাঃ জন রোহডি বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভয়াবহ পরিস্থিতি উল্লেখ করেন। পত্রে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ঢাকায় কন্স্যুল মিঃ ব্লাডের পত্রের উল্লেখিত ঘটনার উদ্ধৃতি দেন। সেনেটর ইউলিয়াম বি স্যাকবি পাকিস্তানের ইয়াহিয়া সরকারের যুক্তরাষ্ট্র সরকারের সকল প্রকার সাহায্য বন্ধের আবেদন জানান।

–কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, লাকসাম পাকবাহিনীর পতন ঘটে। মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটে যায়।

–কুড়িগ্রাম ন্যাশনাল ব্যঙ্ক ভেঙে সমুদয় টাকা নিয়ে আসার পরিকল্পনা মত ট্রাক ও জীপ ভর্তি টাকা দিনহাটার ভারতীয় সেন্ট্রাল ব্যাংকে (এক কোটি ষাট হাজার) টাকা জমা রাখে মুক্তি বাহিনী।

–চুয়াডাঙ্গার স্থানীয় ও দুরবর্তী ব্যাঙ্কের টাকা পয়সা, সোনাগয়না মেজর আবু ওসমান চৌধুরী নেতৃত্ব ডাঃ  আসাবুল হক ক্যাপ্টেন তৌফিক এলাহি, ক্যাপ্টেন মাহবুব এবং আরও কয়েকজন গণ্যমান্য ব্যক্তির মিলিত প্রচেষ্টায় (আনুমানিক সাড়ে ৪ কোটি টাকা ও আধ মণ সোনা এবং চাউল আটা বোঝাই ট্রাক যোগে) মুক্তিবাহিনীর বেনাপোলে নিয়ে যায়।

–পাকবাহিনীর মুক্তিযোদ্ধাদের সীতাকুণ্ডে অবস্থানের ওপর আঘাত হানে। তাঁরা গোলান্দাজ বাহিনীর সহায়তার কয়েকদফা হমলা চালায়। নৌবাহিনীর কামানগুলো ব্যাপকভাবে গোলাবর্ষণ করে। মুক্তি যোদ্ধার পাল্টা আঘাতহেনে শত্রু পক্ষের প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি কর।

–কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটির কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য নাম ঘোষণা করা হয়। এরা হচ্ছেণঃ খাজা খয়রুদ্দিন আহবায়ক নুরুল আমীন, এ কি এম শাফিকুল ইসলাম, অধ্যাপক গোলাম আযম, মাহমুদ আলী, আব্দুল জাব্বার খদ্দর, মওলানা সিদ্দিক আহমদ, আবুল কাশেম, ইউসুফ আলী চৌধুরী (মোহন মিয়া) মওলানা সৈয়দ মোহাম্মদ মাসুম, আব্দুল মতিন, অধ্যাপক গোলাম সারওয়ার, ব্যারিষ্টার আফতাব উদ্দিন, পীর মোহসেন উদ্দিন আহমদ (দুদু মিয়া), এস এম এম সোলায়মান, এ কে রফিকুল হোসেন, নুরুজ্জামান, আতাউল হক খান, তোয়াহা বিন হাবিব, মেজর আফসার উদ্দিন দেওয়ান ওয়াবেসাত আলী, হাকিম ইরতাজুর রহমান খান, নুরুল আমীনের নেতৃত্ব শান্তি কমিটির নেতৃত্ববৃন্দ গভর্নর লেঃ জেনারেল টিক্কাখানের সাথে দেখা করেন।

–এই দিনে কুমিল্লা থেকে ৩০ টি গাড়ীসহ পাক কনভরের উপর এ্যাম্বুশ করে লেঃ মাহবুব এবং লেঃ দিদার যথেষ্ট কৌশলের এবং যুদ্ধ নিপুনতাঁর পরিচয় দিয়েছিলেন,

এই যুদ্ধে লেঃ মাহবুব এবং লেঃ দিদারুল আলমের সম্মিলিত দলটি ২টি মেশিনগান ৬টি হালকামেশিন গান এবং অজস্র রাইফেল আহত ও নিহত শত্রুসেনাদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেন। পাকসেনারা বিধ্বস্ত গাড়ীগুলো থেকে কয়েকহাজার এ্যামুনিশন উদ্ধার করেন। মেজর খালেদ মোশাররফ বাহিনীর ৪র্থ বেঙ্গল বি কোম্পানীরা সৈন্যরা এই আম্বুশ করেছিলেন।

–১৬ এপ্রিল শুক্রবার ব্রিটেনের প্রভাবশালী সাপ্তাহিক পত্রিকা নিউস্টেটসম্যন এর প্রথম পৃষ্ঠায় প্রকাশিত “দি ব্লাড অব বাংলাদেশ” শীর্ষক সম্পাদকীয় নিবন্ধে বলা হয়, রক্তের বিনিময়ে যদি স্বাধীনতা অর্জন করতে হয়, তাহলে বাংলাদেশ অত্যধিক রক্ত দিয়েছে। জাতীয় স্বাধীনতা অর্জনের জন্য সরকারের পতন ও দেশের সীমানা পরিবর্তনের উদ্দেশ্যে যেসব সংগ্রাম পরিচালিত হয়েছে তাদের মধ্যে পুর্ব বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রাম সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী ও স্বল্পকাল স্থায়ী বলে প্রমাণিত হতে পারে। পূর্ববাংলার স্বাধীনতা সংগ্রাম সাময়িকভাবে পরাজিত হতে পারে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই সংগ্রাম ন্যায়সংগত বলে স্বীকৃতি পাবে।

—সিনেটার এডওয়ার্ড মাস্কী ৬ এপ্রিল তারিখে ওয়াশিংটনে প্রদত্ত এক বিবৃতিতে বলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক পাকিস্তানকে সামরিক সাহায্য দান অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে। দুনিয়ার সর্বত্র উত্তেজনা ও সংঘাত এড়ানোর জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করা আমেরিকার কর্তব্য বলে তিনি মনে করেন।
উপরোক্ত তারিখে ব্রিটেনের বামপন্থী রাজনৈতিক দল দি সোস্যালিষ্ট লেবার লীগ এর উদ্যোগে পূর্ব লণ্ডনের টয়েন-বী হলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সমর্থনে একটি বিরাট জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। আশাতীত জনসমাগমের ফলে বহু বাংগালী শ্রোতা হলের বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলেন সভায় গৃহীত এক প্রস্তাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে সমর্থন জানিয়ে পাকিস্তানী সৈন্যবাহিনী প্রত্যাহার ও শেখ মুজিবের মুক্তিদাবী করা হয়। তাছাড়া বাংলাদেশে গণহত্যা অনুষ্ঠানের জন্য রক্ত পিপাসু ইয়াহিয়া চক্র সমর্থক চীনের তীব্র নিন্দ করা হয়।

Reference:

একাত্তরের দশ মাসরবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী