১৪ চৈত্র ১৩৭৭ রোববার ২৮ মার্চ ১৯৭১
-সকালে স্বাধীন বাংলাবেতার কেন্দ্র থেকে পুনরায় বঙ্গবন্ধুর পক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা স্ব-কণ্ঠে প্রচার করলেন মেজর জিয়াউর রহমান। (ইংরেজীতে লিখিত সংশোধিত ঐতিহাসিক ঘোষণাটি মার্চ ৩০ তারিখে দেয়া হল) -আজ ঢাকায় শুধু পাকিস্তান অবজারভার দু’পাতা কাগজে বের হয়েছে। পুরো ষাট কলাম জুড়ে কাঠের হেড লাইনঃ ইয়াহিয়া ব্রডকাস্টস।
-২৬ মার্চের ইয়াহিয়া খানের রেডিও ভাষণের পূর্ণ বিবরণ। মার্শাল’ ল অর্ডার। এক পাশে ছোট্ট সংবাদ শিরোনামঃ মুজিব এরেস্টেড।
-জগন্নাথ কলেজ সংলগ্ন পরিত্যাক্ত ভবনে বাঙ্গালী, শিক্ষক, শিল্পী, ব্যারিস্টার ও হোটেল কর্মচারী সহ ৮৮জনকে নির্মমভাবে পাক বাহিনী হত্যা করে। স্থানীয় বিউটি বোর্ডিং প্যারিদাস রোড, ফরাশগঞ্জ, বাংলাবাজার ও শাখারী বাজার থেকে এসব হতভাগ্যদের ধরে আনে পাক সেনারা। জনৈক মনোরঞ্জন ঘোষাল নামে একজন অলৌকিকভাবে বেঁচে যান। তিনি পরে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে যোগদান করেন।
-ঢাকা রেডিও সামরিক কতৃপক্ষের বরাদ দিয়ে বলা হয় সকাল ৮-১২টা পর্যন্ত সান্ধ্য আইন শিথিল করা হয়। ঢাকা শহরে কবরের নিস্তব্ধতা চলছে। ইংলিশ রোডে, বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় আগুনে পোড়া বিকৃত শত শত লাশ ও আগুনের ধোঁয়া তখন গণহত্যা ও ধ্বংসের স্বাক্ষর বহন করছিল।
-নোয়াখালীতে আবদুল মালেক উকিলের নেতৃত্বে হাজার হাজার ই,পি, আর ও আনসারকে সংগঠিত করা হয়। সমগ্র নোয়াখালীতে প্রতিরোধ গড়ে ওঠে। জেলা প্রশাসক ও মুক্তিকামীছাত্র ও আওয়ামীলীগ নেতৃবৃন্দ বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ করেন।
-ঐতিহ্যবাহী মুরারীচাঁদ কলেজের অদূরে চা বাগানের শ্রমিকদের পাকবাহিনী হত্যা করে। খাদিম নগরের চা-বাগানের সরল সাধারণ শ্রমিক আবাল বৃদ্ধ বনিতাকে আগুনে পুড়িয়ে ও গুলি করে হত্যা করে। অগণিত নারী শিশুর আর্ত চিৎকারে আকাশ বাতাস ভারী হয়ে উঠেছিল। হিটলারকেও পাকবাহিনী হার মানিয়েছে। -শমসেরনগরে জনতার প্রতিরোধের ওপর ১০মে পাঞ্জাব রেজিমেন্টের একদল সৈন্য ক্যাপ্টেন গোলাম রসুলের নেতৃত্বে গোলাবর্ষণ করে এই গোলাবর্ষণে বহু হতাহত হয়। উল্লেখ্য ২৬ মার্চ রাতেই মেজর খালেদ মোশাররফ, অরুনাভ পাল, আবদুল বাছিত, আমজাত আলী ও আবদুর মান্নান প্রমুখের সাহায্যে ব্রাহ্মণবাড়িয়া রওয়ানা হন।
-চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক আবদুর রব এবং ফরহাদ (স্বেচ্ছাসেবক) কাপ্তাই রোডের ওপর এক গেরিলা অপারেশনে মৃত্যু বরণ করে।
-রংপুর শহর ও ক্যান্টনমেন্টের পার্শ্ববর্তী এলাকা ও আশেপাশে গ্রামের অগণিত উত্তেজিত মানুষের দল দেশী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ক্যান্টনমেন্ট আক্রমণে এগিয়ে আসে। মিঠা পুকুর, বলদি পুকুর, বদরগঞ্জ থেকে অসংখ্য সাঁওতাল তীর ধনুক হাতে ঝড়ের বেগে মূলধারায় মিশে গিয়ে ক্যান্টনমেন্টের চারদিক মানুষ ঘিরে ফেললো। ক্যান্টনমেন্ট থেকে পাকবাহিনীর এল এম জির মেশিনগানের ঝাঁক ঝাঁক গুলি সংগ্রামী জনতার বুক ভেদ করে দিল, ৬০ জন সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো। সাঁওতালদের ছোড়া বৃষ্টির মতো তীর বেশ ক’জন পাকবাহিনীর সৈন্য নিহত হল। পাকবাহিনীর সৈন্যরা মর্টার কামান দিয়ে নিশবতগঞ্জের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিল। অকুতোভয় সাধারণ কৃষক ও সাঁওতালরা পিছু সরে যেতে বাধ্য হল।
-২৭জন পাকবাহিনীর সঙ্গে পাবনা শহরের বুকে লড়াই শুরু হয়ে যায়। কারফিউ জারী হয়। কারফিউ আইন ভঙ্গকারীদের মধ্যে ১০ জন সৈন্যদের গুলিতে নিহত হয়। পাকবাহিনী টেলিফোন এক্সচেঞ্জে আশ্রয় নেয়। জনতা ঘিরে ফেলে তারপর গোলাবিনিময়ে সবকজন পাকবাহিনী নিহত হয়। ৯: ৪৯৪। উল্লেখ্য হামলাকারীরা শহরে এসব আওয়ামীলীগ নির্বাচিত এম পি এ আমিনুদ্দী, ডাঃ অমলেন্দু দাক্ষে এবং আরো অনেক রাজনৈতিক নেতা ও কর্মী গ্রেফতার করে শেষ অবধি পর্যন্ত তাদের সবাইকে পাকবাহিনী হত্যা করে। ৯:৪৯২
টিক্কা খাঁ ১৫ দফা নির্দ্দেশ জারী করলেন ঢাকায়ঃ
১. পূর্ব পাকিস্তানের সবরকম রাজনৈতিক কার্যকলাপ বন্ধ থাকবে।
২. সামরিক কতৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া খবরের কাগজে বেতারে, টিভিতে, প্রচারপত্রে পুস্তিকায় কোন কিছু প্রকাশ করা যাবে না।
৩. আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে বিন্দু মাত্র প্রকাশ বা প্রচার করা যাবে না।
৪. সকল কর্মচারীকে ২৪ ঘন্টার মধ্যে কাজে যোগদান করতে হবে। অমান্যকারীদের সামরিক আদালতে বিচার করা হবে।
৫. সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে।
৬. কোন নাগরিক আগ্নেয়াস্ত্র রাখতে পারবে না। নিকটতম থানায় জমা দিতে হবে।
৭. সমস্ত ব্যাংক বন্ধ থাকবে।
৮. সশস্ত্র স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের তৎপরতা চলবে না।
৯. দেশী অস্ত্র শস্ত্র কেউ রাখতে পারবে না।
১০. আগামী ৭২ ঘন্টায় কোন পাঁচজন একত্রে বের হতে পারবে না। ধর্মীয় অনুষ্ঠানের জন্য সামরিক শাসকের অনুমতি লাগবে।
১১. ধর্মঘট লকআপ চলবে না।
১২. সামরিক প্রশাসন যেকোন স্থানে তল্লাশি চালাতে পারবে।
১৩. লুঠ, ঘেরাও, অগ্নিসংযোগ বরদাস্ত করা হবে না।
১৪. কোন বিদেশী কাউকে অস্ত্র সরবরাহ করতে পারবে না।
১৫. সমস্ত সাইক্লোষ্টাইল বা রিপ্রোডাকশন মেশিন সামরিক শাসকের হাতে জমা দিতে হবে।
-কলকাতার আনন্দ বাজার পত্রিকায় লিখছেঃ দু’দিনের লড়াইয়ে গোটা পূর্বপাকিস্তানের প্রায় এক লক্ষ লোক মারা গিয়াছে বলে বিভিন্ন সীমান্ত এলাকা থেকে ভারত সরকারের দফতর
গুলোতে খবর পৌছছে। সেনাবাহিনী নির্বিচারে গুলি চালাচ্ছে। লড়াই এখনও সবচেয়ে বেশী চলছে ঢাকা এবং রংপুরে।
-ই,পি, আর ও ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের ৪শ জন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আত্মরক্ষার জন্য জমায়েত হয়। অধ্যাপক মল্লিকের সঙ্গে এস পি শামসুল হক, মেজর জিয়া ও ক্যাপ্টের ভূইয়ার টেলিফোনে পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়। (১৫খণ্ড পৃঃ ৬)
-কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট থেকে পালিয়ে এসে ক্যাপ্টেন আইন উদ্দিন বিদ্রোহী বাঙালি মুক্তি ফৌজের সাথে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় যোগ দেন। (৯:১৮৬)
Reference:
একাত্তরের দশ মাস – রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী