১৯ ফাল্গুন ১৩৭৭ বৃহস্পতিবার ৪ মার্চ ১৯৭১
-আজ রাতে কারফিউ ছিলনা। গতরাতে ক্ষুব্দ জনতা আবার কারফিউ ভঙ্গ করে। গগনাবিদারী জয়বাংলা , স্বাধীনতার শ্লোগানের পুরষ্কার হল গুলী বর্ষণে মৃত্যুবরণ।
-সকাল ছয়টা থেকে দুপুর ২ টা পর্যন্ত সারাদেশে সর্বাত্মক হরতাল।কলকারখানায় বাজছে না বাঁশী। মানুষ নেই অফিস আদালতে। অগ্নিগর্ভ দেশ আজ পথে নেমেছে।
-ঢাকার কারফিউ তুলে নেয়া হয়। খুলনা ও রংপুরে কারফিউ বলবৎরাখা হয়। । খুলনায় পাকবহিনীর গুলিতে বহু হতাহত। ঢাকায় গত দু’দিনে মৃতের সংখ্যা দাঁড়ায় ১২১ জনে ।
-সিটি আওয়ামীলীগের নেতৃত্বে ফরিদপুরে ইতিহাস বৃহত্তর প্রতিবাদ মিছিল বের হয়।
জনতারপদভারে শহর কেঁপে উঠে ।
ঢাকার সঙ্গে জল-স্থল-বিমান পথ বিছিন্ন হয়ে যায় পশ্চিম পাকিস্তানের।
-যশোরে হানাদার বাহিনীর গুলীতে মিছিলকৃত চারুবালা ধর প্রথম শহীদহন। জনতা লাশের মিছিল বের করে। স্বাধীনতা ধ্বনি তোলে-প্রতিরোধ বাহিনী গড়ে উঠে
-সমগ্র বাংলাদেশ বিভিন্ন এলাকায় জনসভা, মিছিল ও গায়েবানা জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এক কথায় ঢাকায় সফল হরতাল পালিত হয়। বেতার ও টেলিভিশনেও হরতালের সমর্থনে জয় বাংলার বর্ন্দনীগীতি প্রচারিত হয় ফলে রেডিও পাকিস্তান পরিণত হয় ‘ ঢাকা বেতার কেন্দ্র’ রূপে। বেতার ও টেলিভিশন শিল্পীরা হরতালের সমর্থন করে বেতার ও টেলিভিশনে অংশ গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকে।
-বঙ্গবন্ধুর শেখ মুজিবুর রহমান অন্য এক বিবৃতিতে বলেন চরম ত্যাগ স্বীকার ছাড়া কোনদিন কোন জাতির মুক্তি আসেনি। তিনি উপনিবেশবাদী শোষনের বিরুদ্ধে জনগণকে রুখে দাঁড়াতে বলেন। যে কোন মুল্যে জনগণের স্বাধিকার আদায়ের সংগ্রাম চালিয়ে যেতে জনগণকে উদাত্ত আহবান জানান। তিনি ৫ ও ৬ মার্চ সকাল ৬টা হতে দুপুর ২টা পর্যন্ত হরতাল পালনের আহবান জানান ।-(লেখক)
-বাংলার মুক্তি আন্দোলনের চতুর্থ দিনটি পূর্ণ হরতাল বিক্ষুব্ধু শোভাযাত্রা , গায়েবানা জানাজা , সভা ও স্বাধীনতা শপথ নেবার মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হয়, দেশের সর্বত্র বেসামরিক শাসন ব্যবস্থা সম্পূর্ণ অচল হয়ে পড়ে ফলে অকার্যকর কারফিউ তুলে নেওয়া হয়। ঢাকা বিমান বন্দরে সাধনার মানুষের প্রবেশ নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়। ঢাকা শহরে সর্বত্র ব্যারিকেড রচনা চলতে থাকে, সকল সরকারী ও বেসসরকারী অফিস, আদালত, সমস্ত ব্যবসা ও শিল্প প্রতিষ্ঠান, স্বায়ত্তশাসন সংস্থা, বিমান , রেল, ষ্টিমার, লঞ্চ,বাস ট্যক্সি ব্যাংক, ইনসিউরেন্স, ষ্টক একক্সচেঞ্ছ সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ঐ দিনও বন্ধ থাকে।
চট্টগ্রামের অবস্থার আরও অবনতি ঘটে বাঙালী অবাঙালী সংঘর্ষে অব্যাহত থাকে ফলে হতাহতের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। ৩ ও ৪ মার্চ দুই দিন চট্টগ্রামে ১২০ জন ও ৩৩৫ জন আহত হয়, এদের মধ্যে ধারালো ছুড়ি ও গুলীর আঘাতে ১০০ জন এবং হাসপাতালে ২০জন আহত মৃত্যু ঘটে। খুলনায় ২ মার্চ থেকে পূর্ণ হরতাল চলছিল, শহরে সান্ধ্য আইন জারী করা হয়ম, ৩ মার্চ খুলনায় সেনাবাহিনীর গুলী বর্ষণে ৬ নিহত ও ২২ জন আহত হয়। দৌলতপুরে একটি মিছিলের উপরে বোমা নিক্ষিপ্ত হলে পথের পাশের একটী বাড়ির মালিক উত্তেজিত জনতার হাতে নিহত হয়।
খুলনার এক বিরাট প্রতিবাদ শোভাযাত্রার ওপরে টেলিফোন একক্সেঞ্জ এর কাছে সেনাবাহিনী গুলী বর্ষণ করে ফলে বেশ কয়েকজন হতাহত হয়।
-মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী এক বিতৃতিতে লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে সাত কোটি বাঙ্গালীর স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের দাবী জানান, তিনি ঐ বিবৃতিতে বলেন যে তিনি কংগ্রেস, খেলাফত, মুসলীম লীগ , আওয়ামীলীগ ও ন্যপের মাধ্যমে আন্দোলন করছেন কিন্তু তার এই ৮৯ বছর বয়সে এবারকার মত গণজাগরণ ও সরকারের অগণতান্ত্রিক ঘোষণার বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ বিক্ষোভ দেখান।
-বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এক বিবৃতিতে শোষন ও উপনিবেশিক শাসন বজায় রাখার ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানোর আহবানে বাংলাদেশের প্রতিটি নারী , পুরুষ ও শিশু যে স্বতঃস্ফূর্ত সাড়া দিয়েছেন সে জন্য বীর জনগণকে অভিনন্দন জানান। তিনি ঐ বিবৃতিতে আরও
বলেন যে বাংলাদেশের নিরস্ত্র বেসমারিক জনগণ যথাঃ কৃষক , শ্রমীক ও ছাত্ররা তাদের অধিকার কেড়ে নেওয়ার বিরুদ্ধে যে সাহস দৃঢ় সংকল্প নিয়ে বিক্ষোভ প্রদশন করেছে, বিশ্বের জনগনের তা জানা দরকার।
-তিনি বলেন যে সরকারী ও বেসরাকারী অফিসের কর্মচারী বেতন পাননি শুধু বেতন প্রদানের জন্য সেগুলার আড়াইটা হতে সাড়ে ৪টা পর্যন্ত খোলা থাকবে। শুধু হাসপাতাল , এম্বুলেন্স , ডাক্তার ,সাংবাদিক, পানি,বিদ্যুৎ,গ্যাস ,টেলিফোন , দমকল, ইত্যাদি হরতালের আওতার বাইরে।
-আবুজর গিফারী কলেজের সম্মুখে কলেজের সাধারণ সম্পাদক শহীদ ফারুক ইকবালের স্মৃতি সৌধের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করতে গিয়ে শহীদ ফারুকের পিতা জনাব আফসার উদ্দীন বলেন, যে ফারুককে তিনি হারিয়েছেন কিন্তু বাংলার ৭ কোটি সন্তান কে তিনি পেয়েছেন, তাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের সাফাল্যের মধেই তিনি ফারুখকে খুঁজে পাবেন।
-পূর্ব পাকিস্তান সাংবাদিক ইউনিয়ন ঐ দিন এক জরুরী সভায় বাঙলার জনসাধারণের সার্বিক মুক্তি আদায়ে গণআন্দোলনের সাথে একত্বতা ঘোষণা করে। ঐ দিন বেতার ও টেলিভিশন শিল্পীরা এক বিবৃতিতে জানান যে, ২ মার্চ থেকে তারা বেতার ও টেলিভিশন কোন অনুষ্ঠান করছে না, তারাও এ সংগ্রামের একাত্মতা ঘোষণা করে।
-করাচীতে আসগর খান ক্ষমতা হস্তান্তরের আহবান জানান।
-মিলিটারী গুলিতে নিহত শহীদের জন্য আজ গায়েবানা জানাজা বায়তুল মোকাররমে অনুষ্ঠিত হয়, পরে শোক মিছিল। গন্তব্য শহীদ মিনার।
-পিপিপি প্রধান জেড, এ, ভুট্টো আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতার প্রশ্ন উত্থাপন করেন।
-বঙ্গবন্ধু ১০ মার্চ ঢাকায় প্রস্তাবিত নেতৃ সম্মেলনে যোগদানের অস্বীকৃতই জানালে, পিডিপি নেতা নূরল আমিন তিনিও এই সম্মেলনে যোগদান প্রত্যাখ্যান করেন।
-ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতি ও ৫৫ জন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ‘পাকিস্তান অবজারভার ’ দৈনিকের গণবিরোধী ভূমিকায় তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে।
-এডমিরাল আহসান পুর্বাঞ্চলের লাটগিরিতে অব্যাহতি দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানে রওনা হয়ে যান ।
-লেঃ জেঃ খানকে পূর্বাঞ্চলের গভর্নর নিয়োগ করা হচ্ছে টেলিফোন এ সংবাদে জানার পর লেঃজেঃ সাহেব জাদা ইয়াকুব খান পদত্যাগের ইচ্ছা প্রকাশ করেন।
-রাত ১১ টায় বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে রাও ফরমান আলী বঙ্গবন্ধুর কাছে কতিপয় প্রস্তাব নিয়ে যান । প্রত্যুত্তরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বললেন, পাকিস্তান বাঁচতে পারে,সেজন্য চিন্তাভাবনা করার মতো মানসিক অবস্থা থাকতে হবে। দেখুন, আমার লোকেরা পথে ঘাটে বেঘোরে মারা যাচ্ছে ।রাও ফরমান আলী বলেলেন সেনা বাহিনীর সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হওয়া খুব ভাল হবে কী? বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বললেন, আপনারা যদি আমার কথা মেনে নেন। তবে, এমন সময় তাজউদ্দীন সাহেব ঢুকলেন, ঢুকেই তিনি কোন ভূমিকা না করেই বলতে শুরু করলেন, এখন আর এক ছাদের নিচে আমাদের অবস্থান সম্ভব নয়, তা ছাড়া যেখানে ভুট্টো রয়েছে। (সুত্রঃ ভুট্টো শেখ মুজিব বাংলাদেশ পৃঃ৫৯)
-চট্টগ্রামে নির্বিচারে নিরস্ত্র বাঙ্গালী হত্যার প্রতিবাদে বিকালে লালদিঘির ময়দানে আওয়ামীলীগের নেতৃত্বে গনসমাবেশ আয়োজন করা হয় । এই বিশাল গণ সমাবেশ বিপ্লবী বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি জনাম এম আর সিদ্দিকী।
_ঢাকায় অলি আহাদের সভাপতিত্বে জাতীয় লীগের এক জরুরী সভা অবিলম্বে সামরিক শাসন প্রত্যহার ও নির্বাচিত জন প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবী জানালেন।
-মুসলিম লীগ (কনভেশন) সাধারণ সম্পাদক এ, এন এম, ইউসুফ সংসদের অধিবেশন ১০ই মার্চ ডাকার জন্য প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার প্রতি আহবান জানান।
-জামিয়তুল উলেমা-ই-ইসলামের নেতা মাওলানা গোলাম গাউস হাজারভি, পিপিপি নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টোর সংসদ অধিবেশনে উপস্থিত না হওয়ার জন্য হুমকির সমালোচনা করেন।
-বেলুচিস্তান ন্যাপ (ওয়ালী) জাতীয় সংসদ অধিবেশন স্থগিত করার প্রতিবাদে সমগ্র বেলুচিস্তানে ১২ই মার্চ হরতাল পালনের সিদ্ধান্ত নেয়। [দৈনিক ইত্তেফাক,দৈ পাঃ আজাদ)
জেনারেল ইয়িহিয়া RTC প্রস্তাব সম্বন্ধে কিসিং আরকাইভ লিখছেঃ-
President Yahya Khan’s invitation to RTC, wasrejectedon March 4 by Sheikh Mujibur Rahman, Who alleged that the Army was shooting down unarmed Bengalis in the streets of Dacca and who declared that “ with a military build-up[in East Pakistan] continuing and the harsh language of weapons ringing in our cars, the invitation to such a conference is in effect being made at gunpoint”
–on the same day (March4) Mr. Nurul Amin Leader of PDP-the only other East Pakistan party, other than The Awami League, to be represented in the National Assembly , Where it has two seats also announced that he would decline President Yahya’s invitation, (K C’A pp 24566)
সংবাদ শিরোনাম, মার্চ ৪ ১৯৭১
-নিহতদের সংখ্যা ১৫- উন্নীত , আহত ১৩৩ জনকে হাসপাতালে ভর্তি (সংবাদ)
-শহীদ মিনারে ছাত্র ইউনিয়নের সভাঃ যুক্তফ্রন্ট গঠন করিয়া সংগ্রাম পরিচালনার ডাক (সংবাদ)
-ঢাকা চট্টগ্রামে ১১৩ জন নিহত , বহু আহত (পূর্বদেশ)
-ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ১২৮ জন শিক্ষকের অভিযোগঃ দেশের বর্তমান পরিস্থিতির জন্য শোষক শ্রেনী দায়ী (পূর্বদেশ)
-এপসু’র সভাঃএ সংগ্রাম কেউ রুখতে পারবেনা (দৈনিক পাকিস্তান)
-লাশের সারি-কান্নার মিছিল (মেডিকাল কলেজ রিপোর্টার) (দৈনিক পাকিস্তান)
-ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের বিবৃতি (দৈনিক পাকিস্তান)
-Slogans break clam of Night (The Morning News)
-Mujib visits injured in Hospital(The morning News)
বন্দর নগরী চট্টগ্রামের দৈনিক আজাদী সংবাদ শিরোনামঃ
৪ মার্চঃ প্রথম সংবাদ (ব্যানার হেড লাইন)—“ক্ষমতা হস্তান্তর দাবীতে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের জন্য শেখ মুজিবের আহবান /কর ও রাজস্ব আদায় বন্ধ করুন।” দ্বিতীয় সংবাদ(৪ কলাম) পরস্পর বিরোধী জনতার সংঘর্ষে ও গুলী বরস্নে/৭৫ জন নিহত ও কয়েকজন আহত। সংবাদে বলা হয় গতকাল পাহাড়তলী এলাকায় ওয়ারলেস কলোনী, পুরাতন ইস্পাহানী ফারম গেইট কলোনী, টাইগার পাশ, ফিরোজশাহ কলোনী ও খুলশী কলোনীতে সংঘষের ফলে ৭৫ জন নিহত ও কয়কশত আহত হইয়াছে বলে প্রকাশ । দুই কলামের তিনটি পৃথক সংবাদ মিছিলে জনসভা-গণজমায়েত চট্টগ্রামের সর্বত্র হরতাল পালিত হয়। লাল দিঘির জনসভায় ডাক/শান্তিপূর্ণ সঙ্গগ্রাম অব্যাহত রাখুন শাসনতান্ত্রিক সংকটকল্পে বৈঠকের জন্য/দ্বাদশ পার্লামেন্টারী নেতার প্রতি প্রেসিডেন্টের আমন্ত্রণ। এক কলামের দুইটি সংবাদ শেখ মুজিবের প্রত্যাখান ও আহুন নেতৃসম্মেলন/ পিপিপ’র যোগদান সিদ্ধান্ত (সংবাদ দুইটি প্রেসিডেন্টের আমন্ত্রণ সংবাদের পাশে ছিল)।
Reference:
একাত্তরের দশ মাস – রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী