You dont have javascript enabled! Please enable it! 27.03.1971 | ১৩ চৈত্র ১৩৭৭ শনিবার ২৭ মার্চ ১৯৭১ | একাত্তরের দশ মাস - রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী - সংগ্রামের নোটবুক

১৩ চৈত্র ১৩৭৭ শনিবার ২৭ মার্চ ১৯৭১

-রাত ৮টায় মেজর জিয়া বিপ্লবী স্বাধীন বাংলা বেতার থেকে নিজেকে রাষ্ট্র প্রধান হিসেবে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন। উল্লেখ্য মেজর জিয়াউর রহমানের এই স্বাধীনতা ঘোষণার বক্তব্য নিয়ে জনমনে বিভ্রান্তি দেখা দেয়। তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে স্বাধীনতা ঘোষণা না করে নিজেকে রাষ্ট্র প্রধান ও সর্বাধিনায়ক ঘোষণা করেন। চট্টগ্রাম সংগ্রাম কমিটির সদস্য সর্বজনাব এম এ হান্নান, মীর্জা আবু মনসুর ও মোশারফ হোসেন ফটিকছড়িতে অবস্থানরত জনাব এ কে খানের কাছ থেকে স্বাধীনতাপত্র খসড়া নিয়ে কালুর ঘাট ট্রান্স মিটার সেন্টারে মেজর জিয়াউর রহমানের নিকট পৌঁছে দেন। ২৮ মার্চ সকালে স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র থেকে জিউয়ার রহমানের নিকট পৌঁছে দেন। ২৮ মার্চ সকালে স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে মেজর জিয়াউর রহমান স্বাধীনতা ঘোষণা পাঠ করেন। (১৫ খঃপৃঃ ১৯১) তাঁর সেই ঐতিহাসিক ঘোষণাটি ছিল নিম্নরূপঃ

-‘আমি মেজর জিয়া মহান জাতীয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করছি। দেশের সর্বত্র পাকিস্তান দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা হয়েছে। প্রিয় দেশবাসী, আপনারাও যে যেখানে আছেন, হাতের কাছে যা কিছু পান- তাই নিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলুন। ইনশাল্লাহ, জয় আমাদের সুনিশ্চিত। সেই সাথে আমরা বিশ্বের সকল মুক্তিকামী দেশ থেকে আন্তরিক সাহায্য ও সহযোগিতা কামনা করছি। জয় বাংলা।’  এই ঘোষণার সাথে সাথে বাংলাদেশে গণমানসে অদ্ভুত চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়। জয় বাংলা ধ্বনিতে মুর্হুমুহু রাতের আকাশ বিদীর্ণ হতে লাগলো।

-ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী লোকসভায় ও রাজ্য সভায় পূর্ববাংলার সামরিক বাহিনীর দ্বারা গণহত্যাজনিত উদ্ভুত পরিস্থিতি সম্বন্ধে বক্তব্য রাখেন। তিনি গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের স্বপক্ষে ভারত সর্বদাই সোচ্চার থাকবে বলেন। পূর্ব পাকিস্তানে যা ঘটছে তা শুধু ঐ এলাকার জন্যই নয় বরং গোটাদেশের জন্য মহাবিপদ ডেকে আনবে, তিনি মন্তব্য করেন।

-হোটেল কন্টিন্যানটাল থেকে পালিয়ে বিদেশী সাংবাদিকদেরকে ব্যাংককে ফেরত পাঠানো হল। এইবার বিদেশী সাংবাদিকদের মাধ্যমে ঢাকা, চট্টগ্রামের ভয়াবহ প্রতিরোধের সংবাদ গণমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। ২৫ মার্চ সামরিক বাহিনীর পৈশাচিক অপারেশন সার্চ লাইটের গণহত্যার খবর প্রথমবারের মতো প্রকাশ হয়ে পড়ে। আকাশবাণী, ভয়েজ অব আমেরিকা, সারা বিশ্বে ঢাকার নরমেধযজ্ঞের খবর ছড়িয়ে দেয়।

-প্রথম পর্যায়ে ঢাকা, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, নোয়াখালী, সিলেট, ময়মনসিং, খুলনা, যশোর, ফরিদপুর, কুষ্টিয়া, রাজশাহী, পাবনা, দিনাজপুর, বগুড়া, রংপুর প্রভৃতি জেলায় সশস্ত্র আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে প্রস্তুতি নেয়া হয়। ঢাকা চট্টগ্রাম, কুষ্টিয়া, যশোর, সিলেটে পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তি ফৌজের সংঘর্ষ হয়। বহু পাকিস্তানী সৈন্য নিহত হয়েছে এ সংবাদ আকাশবাণী প্রচার করে।

-চট্টগ্রাম পোর্টে এস ভি সোয়াত জাহাজ থেকে অস্ত্র খালাস করার পর বাঙলী। সৈন্যদের ১৭ নং জেটির প্লাটফর্মে চোখ বেঁধে দাঁড় করায়। বিকেল ৪টায় শতাধিক অভুক্ত ক্লান্ত বাঙলী। সৈন্যদের হত্যা করে হানাদার বাহিনী। কর্ণফুলি নদীতে এই সব বীরদের লাশ ভেসে উঠে। শুধুমাত্র সুবেদার রব গুলি চালাবার মূহুর্তে নদীতে ঝাঁপ দিয়ে বেঁচে যান।

-ভয়ার্ত, নিরাশ্রয়ী জনস্রোত অবশেষে ভারতের অভিমুখে যাত্রা করে। জনস্রোত যেন জলস্রোত হয়ে দাঁড়ালো। আকাশবাণী থেকে সীমান্ত খুলে দেবার সংবাদ প্রচারিত হয় সংবাদ পরিক্রমায় (রাত ৯-৪৫মিঃ)।

-পাকিস্তানের কোন সংবাদ পত্রেই পূর্ববাংলার সামরিক বর্বরতার কোন খবরতো দূরের কথা, ঘটনার সঙ্গে সামান্য সত্যতা আছে এমন খবরও প্রকাশ করেনি বা করতে পারেনি। ঢাকায় কোন পত্রিকা প্রকাশিত হয়নি। -চৌত্রিশ ঘন্টা নরমেধযজ্ঞ শেষে ক্লান্ত ঘাতকরা ক্যান্টনমেন্টে ফিরে যায়।

-আজ সকাল আটটা থেকে অপরাহ্ন ৩টা পর্যন্ত সান্ধ্য আইন শিথিল করা হয়। পুনরায় সান্ধ্য আইন জারী করা হয়। মেশিনগান সাজিয়ে পাকবাহিনী লক্ষ্ণীবাজার, ফরাসগঞ্জ, পোস্তগোলায় গলিপথে হিন্দু ও আওয়ামীলীগ সমর্থকদের খুঁজতে বেড়োল।

-ঢাকা আজ প্রেত নগরী আবাল বৃদ্ধ বণিতা শহর ছেড়ে গ্রামমুখি খচ্ছে নিরাপদ স্থানের উদ্দেশ্যে। সামরিক বাহিনীর যানবাহন চলাচল ছাড়া ঢাকা নিস্তব্ধ।

-তেজগাঁ বিমানবন্দরে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পেট ভর্তি সোলজার এনে নামিয়ে দিচ্ছে পি আই এস ৭০৭ জেটগুলো।

-সন্ধ্যায় কার্ফু চলাকালে এয়ার ফোর্সে মেসের পুর্বদিকে নাখাল পাড়া পাকবাহিনী অগ্নিসংযোগ করে এবং মেশিনগান দিয়ে অসহায় শতাধিক বাঙলীকে হত্যা করে।

-নোয়াখালী থেকে চট্টগ্রাম সংগ্রাম কমিটির কাছে রেল টেলিফোনে সংবাদ পৌঁছে, কুমিল্লা থেকে পাকসেনাদের বিরাট দল চট্টগ্রাম অভিমুখি হয়েছে। ক্যাপ্টেন ভুঁইয়া ও ক্যাপ্টেন রফিকের নেতৃত্বাধীন ইপিআর, ইবিআর সদস্যগণ কুমিরাতে পাকসেনাদের প্রতিহত করার প্রস্তুতি নেয়। প্রচণ্ড লড়াইয়ে পাকবাহিনী যানবাহন ফেলে পাহাড়ে আশ্রয় নেয়। এই প্রতিরোধে মুক্তিযোদ্ধাদের চট্টগ্রাম-ফেনী নদী পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণে এসে যায়। মুক্তিযোদ্ধারা চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থানে অবস্থান গ্রহণ করেন।

-দিনাজপুরে কারফিউ চলছিল। দিনাজপুরে পাঞ্জাবী সৈন্যসংখ্যা তখন ছিল ২৫০ জন। হঠাৎ পাকসেনারা পুলিশের উপর চড়াও হল দুপুর ২টাতে। ইপিআর ক্যাম্পে তখনও কিছু হয়নি ওদের সংখ্যা ছিল ৭০০। পাঞ্জাবীদের উদ্দেশ্য ছিল খেতে বসিয়ে ব্রাশ ফায়ার করবে। জনৈক তরুণ ইপিআর উপলব্ধি করে পেছন দিয়ে সবাইকে নিয়ে পাঞ্জাবীদের উপর হামলা চালায়। বিহারী পাড়ায় পাঞ্জাবী কেউ আশ্রয় নিয়ে থাকবে তবে পাকসেনা সব খতম। জনতা জয় বাংলা ধ্বনি দিয়ে রাস্তায় বেড়িয়ে পড়ল।

-সিলেটের বানিয়াচং উপজেলার হলদারপুরে কৃষকদের ওপর পাক বিমানগুলো কয়েকবার বোমাবর্ষণ করে। বহু হতাহত হয়। বাড়িঘর মসজিদ, মাদ্রাসা, গো মহিষ বোমার শিকার হয়েছিল। কৃষকদের ওপর বোমাবর্ষণ এই প্রথম।

-সিলেট শহরে পাক বাহিনীর নৃশংসতায় নিহত হয় ৫০ জন। পাকসেনারা মির্যা জাঙ্গালস্থ নিম্বার্ক আশ্রমে আক্রমণ চালায়, হত্যা করে আশ্রমের রাম বিহারী ধর ও পাচুবাবুকে।

-শ্রীমঙ্গল চা বাগানের সাধারণ কর্মীদের ভাড়াউড়া শ্রীমঙ্গল সড়কের পাশে কালি মন্দিরের সামনে সকলে জড়ো করল পাক হানাদাররা। তারপর রাহামাড়ার পুলের গভীর খাদে গুলি করে শতাধিক চা বাগানের শ্রমিকদের হত্যা করে। অসহায় নিরীহ চা শ্রমিকদের ওপর হামলা- নাৎসীদেরকেও হার মানিয়েছে।

-বরিশালে নুরুল ইসলাম মঞ্জুরের (এম, এন, এ) নেতৃত্বে সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। এখানে স্থানীয় এম এন, এ ও এম, পি, এ সহ মেজর এ্‌ এ জলীল ও ছাত্র নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। (৯ঃখঃ পৃঃ ৫০৬) জেলা প্রশাসক আইয়ুবুর রহমান প্রতিরোধ সংগ্রামে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন।

-ফরিদপুরে নির্বাচিত জাতীয় প্রাদেশিক পরিষদ সদস্যবৃন্ধ জেলা আওয়ামীলীগ, সিটি আওয়ামীলীগ, ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দ সমন্বয়ে প্রতিরোধ সংগ্রাম কমিটি গঠন করে। আওয়ামী লীগ নেতা কে, এম ওবায়দুর রহমান এম, এন এ আহ্বায়ক মনোনিত হয়। জেলাপরিষদ ডাক বাংলাতে সার্বক্ষণিক কন্ট্রোল রুম স্থাপন করা হয়। অনুরূপভাবে গোয়ালন্দ, গোপালগঞ্জ, মাদারীপুরে আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব প্রতিরোধ কমিটি গঠন করা হয়। রাজবাড়িতে ডাঃ মালেক ও কাজী হেদায়েত হোসেন প্রতিরোধ সংগ্রাম পরিচালনার জন্য আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দদের নিয়ে তৎপর থাকেন। সদর মহকুমার নির্বাচিত পরিষদ সদস্যগণ ও ছাত্রনেতৃবৃন্দ প্রতিরোধ সংগ্রামের পরিকল্পনা করেছিলেন। মাইকযোগে বা বিভিন্ন স্থানে প্রতিরোধ সম্বন্ধে শহরবাসীদের জানিয়েছিলেন। ‘উদয়ের পথে শুনি কার বাণী’ রবীন্দ্রনাথের এই পংক্তিটি ছিল প্রচারণার বিশেষ আহ্বান।

-কলকাতার যুগান্তর পত্রিকা লিখেছেঃ শেখ মুজিবুর রহমান এক বার্তায় আজ (২৬শে মার্চ) বিশ্ববাসীকে জানিয়েছেন, বাংলাদেশের মানুষ তাদের স্বাধীনতার জন্য সাহসের সঙ্গে যুদ্ধ করছে। এক গোপন বেতার কেন্দ্র থেকে শেখ মুজিবের প্রচারিত বার্তা এখানে শোনা গেছে। বেতারে বলা হয়েছে, ঝড়ের বেগে মুক্তিফৌজ এগিয়ে চলেছেন। চট্টগ্রাম, কুমিল্লা ও শ্রীহট্টের সকল গুরুত্বপূর্ণ স্থান পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলস বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে আছে। ঢাকা কেন্দ্র ছাড়া আর সকল কেন্দ্রের রেডিও শুনুন। জয় বাংলা।

-মেজর শাফায়েত জামিল এর নেতৃত্বে লেঃ কবির, লেঃ হারুন, ক্যাপ্টেন গাফফার ও জেসিওগণ ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় পাক বাহিনীদের বন্দী করে এবং বিদ্রোহ ঘোষণা করে মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করে। দুপুর ২টায় মেজর খালেদ মোশাররফ ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌঁছেন। মেজর জামিল চতুর্থ বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মুক্ত এলাকার দায়িত্ব মেজর খালেদ মোশাররফকে হস্তান্তর করেন এবং তাঁর নির্দেশে পরবরতী কর্মপন্থা নির্ধারণ করেন। উল্লখ্য এই বিদ্রোহে ৭২জন পাক সেনা নিহত হয় ও ৩ জন অফিসার গ্রেফতার হয় বিদ্রোহী মুক্তিফৌজের হাতে। (৯ খঃ পৃঃ ১৮৭)।

এ দিনের ঘটনার উল্লেখ করে কিসিং কনটেম্পরারী আরকাইভস লিখেছেঃ

  • An Official Statement in Dacca on march 27 said that reports of fighting in East Pakistan ‘as carried by certain foreign news agencies’ were ‘completely without foundation’. The Martial Law authorities also announced that Sheikh Mujibur Rahman had been arrested at his residence on night of March 25-26. [KCA. 24569]
  • The British High commissioner in Pakistan, sir Cyril Pickard, was called to the Pakistan Foreign office in Islamabad on March 27 to receive a complaint that the B.B.C and other responsible news media had, it was alleged, been issuing ‘unauthenticated and tendentious’ reports about events in East Pakistan derived from ‘sources Known to be hostile to Pakistan,’. The U.S Ambassador, Mr. Joseph S. Farland, was also called to the Foreign office to receive a similar complaint with regard to Voice of America broadcasts. [KCA, pp. 24569]
  • The Pakistan Government lodged a strong protest with the Indian High commissioner in Islamabad on March 27 at India’s ‘deliberate and blatant interferences’ in Pakistan’s internal affairs [KCA, pp. 24597]

দৈনিক দ্যা স্টেটম্যান পত্রিকায় ইউ এন এন আই সংবাদ সংস্থার পরিবেশিত সংবাদে বলা হয়ঃ বাংলাদেশের অভ্যুদয় হয়েছে। শেখ মুজিবুর অরহমান এক গোপন বেতার থেকে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র ঘোষণা করেছেন। শুক্রবার পশ্চিমাঞ্চলীয় সেনারা পুনরায় নিয়ন্ত্রণ স্থাপনের জন্য শক্তি প্রয়োগ করলে ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস ও পুলিসের সহযোগিতায় জনসাধারণ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে প্রতিরোধের সৃষ্টি হয়েছে। দেশটি গৃহযুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়েছে। গত ২৪ ঘন্টায় চট্টগ্রাম ও চালনায় কমপক্ষে ১০,০০০ পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্য অবতরণ করেছে। পাঁচটি জাহাজে তারা এসেছে। তাদেরকে ঢাকা, কুমিল্লা ও যশোরের ক্যান্টনমেন্ট সমূহে পাঠান হয়েছে। ফলে পূর্ব পাকিস্তানে এখন মোট সৈন্য সংখ্য ৭০ হাজারে উন্নীত হয়েছে।

-ঢাকা থেকে গা ঢাকা দিয়ে আওয়ামীলীগ নেতা তাজউদ্দিন আহমদ ও ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম ফরিদপুরে ইমামউদ্দিন আহমদ, এম, পি, এর বাসায় ওঠেন। ফরিদপুর জেলা সিটি আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ তাঁদের নিরাপত্তার জন্য সর্বাধিক গোপনীয়তা রক্ষা করেন। পরের দিন মাগুড়ার পথে তাঁদের এগিয়ে দেয়া হয়।

-ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী লোকসভায় বলেনঃ আমরা আশা করেছিলাম পাকিস্তানের নির্বাচন প্রতিবেশী পূর্ব বাংলায় একটি নতুন পরিস্থিতির সৃষ্টি করবে যার দ্বারা আমরা আরো ঘনিষ্ঠতর হয়ে নিজেদের জনগণের আরো সেবার করে সম্পূর্ণ নতুন পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারবো। আমরা আওয়ামীলীগের বিজয়কে স্বাগত জানিয়েছিলাম। সেটা কারো অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের জন্য নয়, আমরা যে মূল্যবোধের জন্য সংগ্রাম করেছিলাম আওয়ামীলীগও সেই মূল্যবোধ নিয়ে সংগ্রাম করেছে বলেই। পাকিস্তানকে শক্তিশালী করার একটা অপূর্ব সুযোগ হারিয়েছে। আমরা ঘনিষ্ঠভাবে ঘটনাবলী পর্যবেক্ষণ করেছি। গণহত্যা ও অন্যান্য বিষয়ে সদস্যগণ যে নানাবিধ পরামর্শ দিয়েছেন আমরা সেসব বিষয়ে পুরোপুরি সচেতন রয়েছি।

-সম্প্রতি স্বাধীনতার ঘোষক ও ঘোষণা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এক্ষেত্রে বলে রাখতে চাই, ২৬ মার্চ সকালে ফরিদপুরে পুলিশ কন্ট্রোল ওয়ারলেস থেকে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা বার্তা আমরা পাই। জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপার ও আওয়ামীলীগ নেতৃবৃন্দ সে বার্তা শহরে প্রচার করেছে মাইক নিয়ে। লেখকের সে বিষয়ে কিছু ভূমিকা ছিল। তবু এক্ষেত্রে সাংবাদিক রাজনীতিক নির্ম্মলসেনের উদ্ধৃতি দিচ্ছিঃ ‘আমি মনে করি একটি বিশেষ পরিস্থিতিতে ১৯৭১ সালের সাতাশে মার্চ স্বাধীন বাংলা বেতার থেকে মেজর জিয়াউর রহমান নিঃসন্দেহে কৃতিত্বের দাবীদার। একটি নির্দিষ্ট সময়ে এবং একটি নির্দিষ্ট প্রেক্ষিতেই এই ঘটনাটি বিবেচ্য। কিন্তু এর বেশী কিছু নয়। প্রকৃতপক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা হয়েছিল ১৯৭১ সালের ৭ইমার্চ আজকের সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। যদিও এই ঘোষণার আনুষ্ঠানিকতা ছিলনা। এছাড়াও একটি ঘোষণা ২৬ শে মার্চ রাতে শেখ সাহেব পাঠিয়ে ছিলেন বেতার মারফত। ঘোষণাটি ২৬শে মার্চ আমাদের থানার ডাকঘরে এসেছিল। আহ্বান এসেছিল শেখ মুজিবুর রহমানের নামেই। আমি নিজের চোখে সে ঘোষণা দেখেছি। এ ব্যপারে কারো ধার করা কথা বা তত্ত্ব শুনতে বা বুঝতে আমি রাজি নই। আমি জিয়াউর রহমানের অমর্যাদা করতে চাইনা। কিন্তু তাঁর সমর্থকদের তাঁর সীমাবদ্ধতা ও তাঁর ভূমিকার সঠিক মূল্যায়ন করতে হবে। একটি কথা স্বীকার করতে হবেই যে স্বাধীনতা সংগ্রাম হয়েছিল শেখ মুজিবুর রহমান এবং আওয়ামীলীগের নামে। এ আন্দোলনে মওলানা ভাসানীর গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল। অবদান ছিল বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও কোটি কোটি সাধারণ মানুষের। কিন্তু এ রাজনৈতিক দল বা তাদের নেতাদের নামে কোটি কোটি মানুষ সংগ্রামে নামেনি। তাদের দলীয় সদস্যরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এ সংগ্রামে যোগ দিয়েছে প্রাণও দিয়েছে অকাতরে। কিন্তু বাংলার মানুষের কাছে প্রথমে দু’টি নামই ছিল উল্লেখযোগ্য। তা হচ্ছে শেখ মুজিব এবং আওয়ামীলীগ। ১৯৭১ সালে আমি বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকা ঘুরেছি। ঢাকা শহরে পাঁচবার ঢুকেছি। ফরিদপুর, নোয়াখালী, ঢাকা, কুমিল্লার বিভিন্ন এলাকায় গিয়েছি। একাধিক বার সীমান্ত পারাপার করেছি। বিশ্ববিদ্যালয়ে খেলার মাঠে গিয়ে রাজাকারদের প্যারেড দেখেছি। প্রেসক্লাবের সামনে গিয়ে দেখেছি সত্যি সত্যি প্রেসক্লাব ভবন ধূলিসাৎ হয়েছে কিনা। কাছে গিয়ে দেখেছি ভাংগা শহীদ মিনার। গ্রামে গিয়ে দেখেছি মুক্তিবাহিনীতে যাবার প্রতিযোগিতা। কান্না দেখেছি অসংখ্য তরুণের। পিতা-মাতা ছেড়ে যাবার দুঃখ নয়, মুক্তিবাহিনীতে না যেতে পেরে। ওদের কাছে পরিচিত ছিল শেখ মুজিবুর রহমান ও আওয়ামীলীগ। অন্য বিশেষ ব্যক্তি বা রাজনৈতিক সংগঠন নয়। তবে সংগ্রামের এক পর্যায়ে সকল সংগঠন ছাড়িয়ে উঠেছিল মুক্তিবাহিনী। কোন দল নয়, মুক্তিবাহিনীই ছিল সকলের আদরের ধন। এর সঙ্গে শেখ মুজিবুর রহমানের নামটিও ছিল অচ্ছেদ্য। সূত্রঃ (মা জন্মভূমি পৃঃ ৫২-৫৩)

Reference:

একাত্তরের দশ মাসরবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী