You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.06.30 | ১৫ আষাঢ়,১৩৭৮ বুধবার, ৩০ জুন ১৯৭১ | একাত্তরের দশ মাস - রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী - সংগ্রামের নোটবুক

১৫ আষাঢ়,১৩৭৮ বুধবার, ৩০ জুন ১৯৭১

–বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত এক বিবৃতিকে বলেন, আমাদের মুক্তিযুদ্ধে চলছে এবং প্রিয় মাতৃভূমি থেকে দখলদার বাহিনীর শেষ সৈনিকটিকে বিতাড়িত না করা পর্যন্ত তা চলবে। তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধ এখন মাঝপথে রয়েছে। মুক্তিফৌজের বীর যোদ্ধারা রণাঙ্গনেই প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার ঔদ্ধত্যপূর্ণ বেতার ভাষণের জবাব দেবে। বাংলাদেশের জনগণ ইয়াহিয়ার ভাষণের ঘৃণাভরে প্রত্যাখান করেছে। ইয়াহিয়ার শাসনতান্ত্রিক পরিকল্পনা সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর সাথে একটি নিষ্ঠুর রসিকতা ছাড়া কিছুই নয়। (বিডি-১পৃঃ ৩৩২)

-কানাডা পাকিস্তানে জেট বিমানের খুচরা যন্ত্রাংশ সরবরাহ বন্ধ ঘোষণা করে।

–৩০ শে জুন, বুধবার “দি টাইমস”- এ প্রকাশিত এক পূর্ণ পৃষ্ঠা বিজ্ঞাপনের বাংলাদেশ অনুষ্ঠিত গণহত্যার বিরুদ্ধে প্রবাদ এবং বাংলাদেশে সরকারকে স্বীকৃতি দানের দাবি জানানো হয়। ১৫ই জুন ব্রিটিশ পার্লামেন্টে বাংলাদেশ সমর্থক সদস্যরা যে প্রস্তাব পেশ করেন তা বড় বড় অক্ষরে ছাপিয়ে তাঁর নিচে দু’শজনেরও বেশি পার্লামেন্ট সদস্যের নাম প্রকাশ করা হয়। এদের মধ্যে ১১ জন প্রিভি কাউন্সিলার এবং ৩০ জনেরও বেশি প্রাক্তন মন্ত্রী নাম রয়েছে। (স্বঃ সং: প্রঃ বাঃ পৃঃ৮৪)

-ওয়াশিংটনে জনৈক সরকারী মুখপাত্র বলেন, ২৫ মার্চের পর মার্কিন সরকার পাকিস্তানকে সামরিক অস্ত্রের জন্য কোন লাইসেন্স দেনদি কিংবা মেয়াদ উত্তীর্ণ কোন লাইসেন্স নবায়ণও করেননি। তবে, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক অস্ত্র বিক্রি নিষিদ্ধ করার আগে পাকিস্তানকে যে লাইসেন্স দেয়া হয়েছিল তাঁর একটি চালান নিয়ে আগামী এক বা দু মাসের মধ্যে অস্ত্র ও গোলাবারুদ বোঝাই পাঁচটি জাহাজ পাকিস্তানের পথে রওনা দেব। (দৈঃ পাঃ)

-জাতিসংঘের উদ্বাস্তু দফতরের হাই কমিশনার প্রিন্স সদরুদ্দিন লন্ডনে এ সংবাদ সম্মেলনে ভারতে উদ্বাস্তু সমস্যা সামধানে বিশ্বের বিভিন্ন সরকার ও জাতিসংঘ সংস্থাগুলোকে ঐক্যবদ্ধভবভাবে এগিয়ে আসার আবেদন জানান। তিনি বলেন, পাকিস্তানের পূর্বাংশে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য বিশ্বাস ও সমঝোতার পরিবেশ সৃষ্টির উদ্দেশ্য রাজনৈতিক সমাধান প্রয়োজন রয়েছে। (দৈঃপাঃ)

-পাকিস্তান সেনাবাহিনীর চীফ অব ষ্টাফ জেনারেল আবদুল হামিদ খান দশদিন পূর্বাঞ্চল (অধিকৃত বাংলাদেশ) সফর শেষে রাওয়ালপিন্ডি ফিরে যান।(দৈঃপাঃ)

-প্রাক্তন প্রাদেশিক মন্ত্রী হাশিম উদ্দিন আহমদ ময়মনসসিংহে এক জনসভায় বলেন, সীমান্তবর্তী শহরগুলোতে ভারতীয় অনুপ্রবেশকারীরা (মুক্তিযোদ্ধা) অশুভ কর্মতৎপরতা চালাচ্ছে। তাঁদের এই তৎপরতা গভীর উৎকণ্ঠা কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। (বা বা) ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত সর্দার শরণ সিং বেলগ্রেডে প্রেসিডেন্ট টিটোর সাথে বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেন। যুগোশ্লাভ প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশের শরণার্থীদের দুরাবস্থায় তাঁর সমবেদনা প্রকাশ করে এবং সহযোগিতা ও সমর্থনের নিশ্চয়তা দেন।

-কলকাতার ইংরেজি দৈনিক ষ্টেটসম্যানের প্রধান সম্পাদকীয়তে পশ্চিমা দেশগুলোর রাজনৈতিক সমাধান ও ইয়াহিয়া খানের পূর্ববঙ্গে সামরিক সমাধানের উস্কানীমূলক বক্তব্য তীব্র সমালোচনা করছে।

-এ দিন কলকাতার ‘দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকায় “রাজনৈতিক মীমাংসার নামে ধোঁকাবাজি বাংলাদেশ মানবে না” শিরোনাম মওলানা ভাসানীর বিবৃতি ছেপেছেন। মওলানা ভাসানী বলেছে, “জীবনের সম সম্পদ হারিয়ে-নারীর ইজ্জত বিকিয়ে, ঘরবাড়ি হারিয়ে, দেশ থেকে বিতাড়িত হয়ে এবং দশলক্ষ অমূল্য প্রাণ প্রদান করে স্বাধীন বাংলাদেশের জনগণ রাজনৈতিক মীমাংসার নামে ধোঁকাবাজি কিছুতেই গ্রহণ করবে না তাঁদের একমাত্র পথ হয় পূর্ণ স্বাধীনতা না হয় মৃত্যু। এর মাঝে গোঁজামিলের কোন স্থান নেই।”

–এদিন কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকায় ‘আমেরিকা ভাসানীকে কি বলেছিলঃ বড় বড় সব দেশই এক’ শিরোনামে উপসম্পাদকীয়তে সাংবাদিক বরুণ সেন গুপ্ত উল্লেখ করেন, ভাসানী সাহেব এ ব্যাপারে যা বলেছেন তা বিস্মিত হবার মতো তিনি বলেছেনঃ মাস পাঁচেক আগের ঢাকায় এক মার্কিন রাষ্ট্রদূত আমাকে এসে বল্লো, যদি পূর্বদেশ গড়ার আহবান দেন আপনারা যদি পূর্ববঙ্গ, পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, নাগা পাহাড় ইত্যাদি নিয়ে পূর্বদেশ সরকার প্রতিষ্ঠা করেন। আমরা কথা দিতে পারি তা হলে সঙ্গে সঙ্গে ২২.২৩ টি রাষ্ট্র আপনাদে স্বীকৃতি দেবে। উল্লেখ্য শ্রী বরুণ সেন গুপ্তের উপসম্পাদকীয় মতামতে মুজিবনগরের সকল মহল মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। ডিসেম্বর ৭০ সালের ঢাকায় কতিপয় দৈনিকে বৃহৎবঙ্গ প্রসঙ্গ উত্থাপিত হওয়ার তখনও নির্বাচন নিয়ে অনুরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছিল। তাছাড়া পত্রিকায় মওলানা ভাসানী কোথায়? বামপন্থী বিরোধী দল থেকে উত্থাপন করা হয়েছিল। পরবর্তী ঢাকা থেকে প্রকাশিত মধ্যরাতের অশ্বরোহী গ্রন্থে (পৃঃ২১৫) সাংবাদিক ফয়েজ আহমেদ উল্লেখ করেন, (মওলানা ভসানী) একাত্তর সালের আট এপ্রিল লন্ডনের পথে আত্মগোপন করে ভারত অভিমুখে যাত্রা করেন। ভারত থেকে লন্ডনে পৌছানোর সহজ পথ বেছে নেয়ার সিদ্ধান্তটি ছিল ভ্রান্ত। এই রাজনৈতিক ভুল সিন্ধান্তের ফলেই তিনি ভারত সরকার কর্তৃক অঘোষিত গৃহবন্দী হয়ে পড়েন এবং তার বিপ্লবী সরকার গঠনের পরিকল্পনাটি স্বাভাবিকভাবেই বানচাল হয়ে যায়। জীবনে তার সবচাইতে বেদনাদায়ক ঘটনা এই ব্যর্থতা। উল্লেখ্য এধরনের প্রচারের বিরুদ্ধে ১২ নভেম্বর বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর নিকট লিখি এক পত্রে তিনি গৃহবন্দী থাকার সংবাদ দূরভিসন্ধিমূলক বলে উল্লেখ করে। (স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রবাসী বাঙ্গালী, পৃঃ১৮৩) আবার-দেখা যাচ্ছে, ১৯৮৭ সালে প্রকাশিত ‘ স্বাধীনতা ভাসানী ভারত’ গ্রন্থে সাইফুল ইসলাম লিখেছেন মওলানা সাহেব নিজ হাতে লেখা এক পত্রে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে জানিয়েছেন, আমার শেষসংগ্রাম বাংলাদেশকে স্বাধীন করা সমাজতন্ত্রবাদ প্রতিষ্ঠা ভারতের সহিত কনফেডারেশন (পৃঃ১৩৫)

-৩০ জুন “দি ডেইলি টেলিগ্রাফ” এ প্রকাশিত এক সংবাদে বলা হয়, বাংলাদেশে পাকিস্তানী কর্তৃত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য ইয়াহিয়া খানের পরিকল্পনা বানচাল করার উদ্দেশ্যে গেরিলা যোদ্ধারা ২৮ শে জুন রাত্রিবেলা ঢাকা শহরের কেন্দ্রস্থলে দু’টি শক্তিশালী বোমা নিক্ষেপ করে। ঢাকা থেকে মিস ক্লেয়ার হোলিংওয়ার্থ কর্তৃক প্রেরিত এই সংবাদ আরও বলা হয়, পাকিস্তানে বেসামরিক শাসন-ব্যবস্থা প্রবর্তনের সিদ্ধান্ত ঘোষণার কয়েক ঘন্টার মধ্যেই বোমা নিক্ষেপ করে ইয়াহিয়া খানের প্রস্তাব প্রত্যাখান করে।

-ওয়াশিংটন ডেইলি নিউজ (৩০ জুন সংখ্যা) সম্পদকীয় স্তম্বে বর্বর গণবিরোধী পাকিস্তান সরকারের সমর্থনে মার্কিন সরকারের উদার সামরিক অর্থনৈতিক সাহায্য প্রদার করার ব্যাপারটি দূরদৃষ্টিহীনতা বলে সমালোচনা করে। উল্লেখ্য, মার্কিন জনগণ সেখানকার রাজনীতিক ও পত্র-প্রত্রিকা মার্কিন সরাকারের গণবিরোধী নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠেলেও পাকিস্তানে মার্কিন সামরিক ও অর্থনৈতিক সাহায্য সহয়তা প্রদান অব্যাহত থাকে।

-জুন মাসে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার, মুজিবনগর সর্ববিধভাবে সাংগঠনিক কাঠামো প্রতিষ্ঠা করতে সমর্থ হয়। মন্ত্রণালয়, দপ্তর, কেন্দ্রীয় সাহায্য ও পুর্নবাসন কমিটি, যুব অভ্যর্থনা ও যুব-শিবির স্থাপনের কাজ এগিয়ে চলে। দেশের অভ্যন্তরে ছাত্র-যুবক ও কিন্তু সম্প্রদায়ের ওপর পাক-সেনাদের নির্যাতন বৃদ্ধির কারণে সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে এদের আগমণ এপ্রিল মাসের শুরু থেকে অব্যাহত থাকে। ভারত সরকারে সহয়তার সীমান্তবর্তী সঙ্গতস্থানে যুব-শিবিরে গড়ে ওঠে। আওয়ামী লীগ সাংসদের এসব অভ্যর্থনা ও যুব-শিবির পরিচালনার দায়িত্ব দেয়া হয়। কিন্তু প্রশিক্ষণ শিবিরগুলো নিয়ন্ত্রনে দায়িত্বে থাকে ভারতীয় সেনাবাহিনী। পরবর্তীকালে এই প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশ সরকার, মুজিবনগর, স্বরাষ্ট্র ও ত্রান মন্ত্রণালয়ের অধীনে যুব ও যুব অভ্যর্থনা শিবিরগুলো পরিচালনার জন্য একটি পর্ষদ গঠনে করে। অধ্যাপক ইউসুফ আলী সভাপত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। লেখককে সম্বনয়ে অতিরিক্ত দায়িত্ব দেয়া হয়। অবশ্য, এই জুন মাসে সরকারের মূল দায়িত্ব হয় প্রথমতঃসকল মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করা; দ্বিতীয়ঃ স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের সম্পর্কে আন্তজার্তিক স্বীকৃতি আদায় করা; তৃতীয়ঃ শরণার্থীদের স্বাধীন স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের আস্থা স্থাপন করা। উল্লেখ্য, মুজিবনগরে বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রী-সভার সদস্যবৃন্দ, বিপ্লবী আমল্য ও কর্মীদের এসব গুরুদায়িত্ব পালনে একনিষ্ট প্রচেষ্টার কোন অবহেলা ছিল না। ২৮ জুন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার বেতার ভাষণে বাঙালীদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে শরণার্থীদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের আহবান কোন ফলোদয় হয়নি। কেননা, এই শরণার্থী জন্যগোষ্ঠীর শতকরা আশি ভাগই হিন্দু সম্প্রদায়ভুক্ত। তাছাড়া, এসেছে পাকিস্তানে বে-আইনী ঘোষিত আওয়ামী লীগের নেতা ও অসংখ্য কর্মী সমর্থক এবং দলমত নির্বিশেষে অগণিত তরুণ ও যুবক। আর এসেছে কয়েকহাজার বিদ্রোহী সামরিক, আধা-সামরিক ও পুলিশ বাহিনীর সদস্য। এসেছে সিএসপি, ইপিসিএস আমলার দল। এই শরণার্থীদের পক্ষে স্বেচ্ছায় “পূর্ব পাকিস্তানে” ফিরে যাওয়া কোনক্রমএই সম্ভব নয়। কারণ, তার অর্থ হবে আত্মহত্যারই শামিল। বিদেশী সাংবাদিকদের বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ প্রকাশনা। ব্রিটিশ সাংসদ সহ বহু আন্তর্জাতিক সংস্থা সরেজমিনে ঘটনা মূল্যায়ন; সর্বোপরি প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদের নেতৃত্ব, পররাষ্টনীতি জোরালো ঘোষণা; বাংলাদেশ স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ’ বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। (লেখক)

রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেব।

এই দেশের মানুষকে মুক্ত করে       

   ছাড়বো ইনশা আল্লাহ।

Reference:

একাত্তরের দশ মাসরবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী