১৭ ফাল্গুন ১৩৭৭ মঙ্গলবার ২ মার্চ ১৯৭১
—আওয়ামী লীগ প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের আহবানে সমগ্র বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত স্বতঃস্ফূর্ত হরতাল পালিত হল।দোকানের ঝাপ বন্ধ,কারখানার চিমনিতে ওঠেনি ধোঁয়া ,স্তব্ধ কলের চাকা, কর্মচারীরা যোগ দেয়নি কাজে,অফিস আদালতে সর্বত্র স্তব্ধতা ছেয়ে রেখেছিল।সকাল ১১টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহাসিক বটতলায় ছাত্র জনতার বিশাল সমাবেশ।ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত স্বাধীন পতাকা উক্তোলনকরে।স্থানাভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের পশ্চিম প্রবেশ পথের গাড়ি বারান্দায় ছাঁদে দাঁড়িয়ে ছাত্রনেতৃবৃন্দ সভা পরিচালনা করেন।সভাপতিত্ব করছেন ছাত্রনেতা নূরে আলম সিদ্দিকী।অন্য তিন জন ছাত্রনেতাও উপস্থিত।জানা যায় পতাকা তুলেছেন আ,স,ম, আব্দুর রব।পতাকা পরিকল্পনা ও অঙ্কন করেছেন শিল্পী শিব নারায়ণ দাশ।
বিকেলে পল্টন এবং বায়তুল মোকাররমেজনসমাবেশ হয়।সকল রাজপথেই জনতার ধল।আকস্মিক ভাবে রাত ৭টা থেকে কারফিউ জারী করা হয়। বিক্ষোভে ফেটে পড়া নগরবাসির কাছে পরাজিত হয় সামরিক স্বৈরাচারের কারফিউ। শতাধিক বিক্ষুব্ধ মানুষ স্বৈরাচারের বুলেটে লুটিয়ে পড়ে রাজপথে রাতের শরীর ভারী হবার সঙ্গে সঙ্গে নগরীর হাসপাতালগুলোতে বুলেট বিদ্ধ মানুষের ভিরবাড়তে থাকে । ঢাকার সব এলাকাতেই কারফিউ ভঙ্গকারী জনতার উপর গুলিবর্ষণ করা হয়েছে । -বঙ্গবন্ধু এক বিবৃতিতে বলেনঃ যারা শক্তি দ্বারা জনগনের মোকাবেলা করতে চান তাদের এ ধরনের বেপরোয়া পথ থেকে বিরত থাকার জন্য আবেদন জানাচ্ছি । বাঙ্গালীরা আর নির্যাতিত হতে রাজী নয়, তারা তাদের অধিকার অর্জনে দৃঢ় সংকল্প। বাংলাদেশের জনগণের স্বাধিকার অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত আমাদের আন্দোলন অব্যহত থাকবে । ৬ মার্চ পর্যন্ত প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে দুপুর দুইটা পর্যন্ত হরতালের ঘোষণা করেন। ৩ মার্চ কে জাতীয় শোক দিবস ঘোষণা করেন। (সংবাদ ,আজাদ) ন্যাপ(ওয়ালী), ছাত্রলীগ,ছাত্র ইউনিয়ন, জতীয় শ্রমিক লীগ, ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র, কৃষকসমিতি সহ বহু সংগঠন হরতাল পালনে অংশ গ্রহণ করেন।
—বিশ্ববিদ্যালয় চত্তর থেকে একটি ছাত্র জনতার মিছিল বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে গমণ করে ।
-১১০ নম্বর সামরিক আদেশ জারী হয় এই আদেশ বলে পত্র পত্রিকা সমুহে পাকিস্তানের সংহতি বা সার্বভৌমত্বের পরিপন্থী খবর, মতামত স্থির চিত্র প্রকাশ নিষিদ্ধ করা হয়।- ঢাকা শহরে পূর্ণ হরতাল পালিত হয়। জঙ্গী মিছিলে আর স্বাধীনতার স্লোগানে ঢাকা শহর মুখরিত হতে ওঠে । সকাল এগারটার দিকে ফার্মগেট বিক্ষুব্ধ জনতার উপর সামরিক বাহিনীর গুলি বর্ষণ ও বেওনেট চার্জে অন্তনঃ৯ ব্যক্তি হতাহত হয়। -ন্যাপের উদ্যোগে পল্টন ময়দানে এবং জাতীয় লীগের উদ্যোগে বায়তুল মোকাররমে দুইটি প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়, ন্যাপের সভায় বক্তৃতা করেন, জনাব মহীউদ্দিন আহমেদ, আব্দুল হালিম , মতিয়া চৌধুরী, সাইফুদ্দিন আহমদ মানিক, নরুর রহমান ও নুরুল ইসলাম এবং জাতীয় লীগের সভায় জনাম আতাউর রহমান (দৈঃপা)
– ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ঐতিহাসিক সভা ও স্বাধীন বাঙলার পতাকা উত্তোলন।
-২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কলাভবনে অনুষ্ঠিত ঐতিহাসি ছাত্রসভাতে সর্বপ্রথম স্বাধীন বাঙলা পতাকা উত্তোলিত হয় এবং স্মরণকালের ঐ বৃহত্তম ছাত্র সভাতেই স্বাধীন বাঙলাদে প্রতিষ্ঠার জন্য যে কোন ত্যাগ স্বীকার এবং শেষ পর্যন্ত সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার সংকল্প ঘোষণা করা হয়। এই সভা বটতলায় হবার কথা ছিল কিন্তু অভূতপূর্ব জন সমাগমের কারণে সভামঞ্চকলাভনের গাড়ী বারান্দার ওপরে নিয়ে যাওয়া হয় এবং মঞ্চ থেকে মাইকযোগে অবিরাম স্বাধীনতার শ্লোগান দেওয়া হতে থাকে । সকাল পৌনে দশটায় ডাকসুর সহসভাপতি আ,স,ম, আব্দুর রব মাইক যোগে সভার শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনেন। সভার শুরুতে ছাত্রলীগ সভাপতি নুরে আলম সিদ্দিকী সমবেত ছাত্রদের বঙ্গবন্ধুর নের্তত্ব ও নির্দেশ অনুযায়ী স্বাধীনতার সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার শপথ গ্রহণ করান। সভায় ছাত্রলীগ সম্পাদক শাহজাহান সিরাজ এবং ডাকসুর সাধারণ সম্পাদক আব্দুল কুদ্দুস মাখনও বত্তৃতা করেন। এই সভাতেই সর্বপ্রথম সবুজ পটভুমিকার ওপর লালবৃত্তের মাঝখানে সোনার বাঙলার সোনালী মানচিত্র সম্বলিত স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয় । সভা চলাকালে জনাব তোফায়েল আহমদ এসে সভায় যোগদান করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে২ মার্চের ঐ ঐতিহাসিক সভায় অসহযোগ আন্দোলন শুর করার এবং বঙ্গবন্ধু মুজিবের নির্দেশ অনুযায়ী স্বাধীনতা সংগ্রাম পরিচালনার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। সভাশেষে এক বিরাট শোভাযাত্রা তোফায়েল আহমদ ,নূরে আলম সিদ্দিকী, আ,স,ম, আব্দুর রব, শাহাজাহান সিরাজ ও আব্দুল কুদ্দুস মাখনের নেতৃত্বে স্বাধীনতার শ্লোগান দিতে দিতে বায়তুল মোয়াররম গমন করে।(দৈঃপাঃ) -রাত্রে ঢাকা শহরে হঠাত বেতার মারফতে সন্ধা ৭টা থেকে সকাল ৭টা পর্যন্ত কারফিউ ঘোষনা করা হয়। কারফিউ ঘোষনা করার সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন ছাত্রবাস ও শ্রমিক এলাকা থেকে ছাত্র জনতা ও শ্রমিকেরা কারফিউর বিরুদ্ধে প্রচণ্ড শ্লোগান তুলে কারফিউ ভঙ্গ করে মিছিল বের করে, তাদের শ্লোগান ছিল,‘সান্ধ্য আইন মানি না,’‘জয় বাংলা,’ ‘বীর বাঙ্গালী অস্ত্র ধর- বাঙলাদেশ স্বাধীন কর।’ সমস্থ শহরে কারফিউ ভঙ্গ করে ব্যারিকেড রচনা করা হয়। ডি, আই, টি এভ্যিনিউর মোড়,মর্নিং নিউজ পত্রিকা অফিসের সামনে রাত সাড়ে নয়টার সামরিক বাহিনী জনতার ওপরে গুলিবর্ষণ করে। বিরাট এক জনতা কারফিউ ভঙ্গ করে গভর্নর হাউজের দিকে এগিয়ে গেলে সেখানেও গুলী চালানো হয়।(দৈঃপাঃ)
–জনাব আতিউর রহমান খান জাতীয় লীগের উদ্যোগে বায়তুল মোকাররমের এক জনসভায় গণ আন্দোলন শুরু করার জন্য আওয়ামী লীগ, ভাসানী ন্যাপ, ওয়ালী ন্যাপ, ও ন্যাশন্যাল লীগের মধ্যে সমন্বয় সাধন করে কর্মপন্থাগ্রহণের আহবান জানান । অধিবেশন স্থগিতঃ নেতৃবৃন্দের প্রতিবাদ। (সংবাদ২,৩,৭১) শহীদ মিনারে ওয়ালী ন্যাপের জনসভাঃ পূর্ববাংলার দাবী প্রতিষ্ঠিত না হলে জনগণ নিজস্ব পথ বেছে নেবে। (পূর্ব দেশ ১.৩.৭১) অধিবেশন অনির্দিষ্ট কাল স্থগিতঃ হরতাল, বিক্ষোভ। (পূর্বদেশ২,৩,১৯৭১) ঢাকায় ৬৮ জন আহত।(পূর্বদেশ মার্চ ২,১৯৭১) পূর্ববাংলার নেতৃবৃন্দের প্রতিবাদ।(দৈনিক পাকিস্তান ২,১৯৭১) বিক্ষুব্ধ ছাত্র সমাজ ।(দৈনিক পাকিস্তান মার্চ২,১৯৭১) অধিবেশন স্থগিত (সম্পাদকীয়)। দৈনিক পাকিস্তান মার্চ ২,১৯৭১) উত্তেজনাপূর্ণ সমাপ্তির মুখে তীব্র বিক্ষোভের ফলে খেলা বন্ধ। (দৈনিক পাকিস্তান ২ মার্চ ১৯৭১)
বন্দরনগরী চট্রগ্রামের দৈনিক আজাদীর শিরোনামঃ
২রা মার্চ প্রথম সংবাদ (ব্যানারহেড লাইন) “সমঝোতায় পৌছার জন্য/ নেতৃবৃন্দকে আরও সময় দেওয়ার উদ্দেশ্য প্রেশিডেন্ট ইয়াহিয়ার সিধান্ত/জাতীয় পরিষদ অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা।” দ্বিতীয় সংবাদ (৩ কলাম) “সাংবাদিক সম্মেলনে শেখ মুজিবের আহবান /ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে ও যে কোন ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত হউন।” অপর (৩ কলাম) সংবাদে “ শহরে- বন্দরে-গ্রামে গঞ্জে বিক্ষোভের ঢেউ/আজ জেলা ব্যাপী পূর্ণ হরতাল” গতকাল বেতারে প্রেসিডেন্ট সিধান্ত প্রচারিত হবার সঙ্গে সঙ্গে চট্টগ্রাম শহরের সর্বত্র এবং গ্রাম গঞ্জে বিষ্ফোরণ ঘটে। মিছিলে মিছিলে অগণিত ছাত্র-যুবক জনতার কন্ঠে ক্রোধের দাবানল আবার উনসত্তুরের গণ অভ্যুথানের উত্তাপ ফিরিইয়া আনে । কোন দিক হইতে কোন প্রতিষ্ঠানের মিছিল ছুটিয়া আসে তাহা খেয়াল রাখাই মুসিবত হইয়া পড়ে।” অপর সংবাদ (৩কলাম) “জাতীয় পরিষদ অধিবেশন স্থগিত সিধান্ত /গণ বিক্ষোভের প্রচণ্ড বিস্ফোরণে রাজধানী ঢাকা প্রকল্পিত ।” (আজাদী)
Reference:
একাত্তরের দশ মাস – রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী