১৮ চৈত্র ১৩৭৭ বৃহস্পতিবার ১ এপ্রিল ১৯৭১
-যশোর ক্যান্টনমেন্ট থেকে লেঃ সৈয়দ আনোয়ারুল ইসলামের নেতৃত্বে বহু বাঙালি সৈন্য পালিয়ে এসে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেয়। পাকসেনারা যশোর শহরে অসংখ্য মানুষকে হত্যা করে, কয়েকটি গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছে। অবাঙালীরা পাকসেনাদের এসব ধ্বংসযজ্ঞ পরিচালনায় সাহায্য করেছিল।
-মেজর এম আবু ওসমান চৌধুরীর নেতৃত্বে কুষ্টিয়ার যুদ্ধে পাক বাহিনীর মেজর শোয়েবসহ ৩জন জুনিয়র অফিসার ও ২০০ জন জোয়ান নিহত হয় এবং লেঃ আতাউল্লা শাহ মুক্তিফৌজের কাছে আত্মসমর্পণ করে। এই যুদ্ধে বেশ অস্ত্রশস্ত্র মুক্তিফৌজের হস্তগত হয়।
-নাটোরের এস, ডি, ও কামালউদ্দিন নওগাঁ ই,পি,আর, কমাণ্ডার মেজর নজমুল হক এর নেতৃত্বে আনসার বাহিনীর দ্বারা মোলাভূমি পাকবাহিনীর প্রচণ্ড প্রতিরোধযুদ্ধ হয়। আনসার কমাণ্ডার মোঃ ইউসুফ এর নেতৃত্বে গোপালপুরে পাকবাহিনীর মেজর আসলাম আহত অবস্থায় মুক্তিবাহিনীর হাতে ধরা পরে।
-সুবেদার রহমতুল্লাহ তার অবাঙালী মেজর সাফায়েৎ হোসেনকে হত্যা করে এবং সমস্ত জোয়ান নিয়ে ফুলবাড়ীতে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। (৯:৩৯৫)
-বাংলাদেশ পাকুবাহিনীর গণহত্যা সম্বন্ধে সিনেটের কার্য বিবরণীতে সিনেটের কেনেডির তীব্র মন্তব্য প্রকাশ পায়। কেনেডি বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক দ্বন্দের পরিণতিতে সেখানে বিপুলসংখ্যক বেসামরিক নাগরিককে আত্মহুতি দিতে হয়েছে। সেখানে অবর্ণনীয় গণহত্যা চলছে। পূর্ব পাকিস্তানের বর্তমান অবস্থা আমেরিকানদের কাছে অত্যন্ত বেদনাদায়ক। কেননা, সেখানে আমাদেরই সরবরাহকৃত সমরাস্ত্র বেসামরিক নাগরিকদের ওপর ব্যবহৃত হচ্ছে। আমাদের কামান, ট্যাঙ্ক, বিমান জনগণের দুঃখ-দুর্দশা বাড়িয়ে চলেছে। যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সাহায্য সংক্রান্ত চুক্তির শর্তাবলী লংঘন করেই এ কাজ করা হচ্ছে।
-২৫ মার্চ থেকে দু’দিন ঢাকা ও শহ্রাঞ্চলে প্রায় ৩০ হাজার লোক নিহত হয়েছে বলে ত্রিপুরায় আগত জনৈক সাংবাদিক জানান। (যুগান্তর) উল্লেখ্য, ‘দি পিপলস’ পত্রিকার বার্তা সম্পাদক জনাব আবদুস সোবহান প্রথম বাঙালি সাংবাদিক, ঢাকার গণহত্যার সংবাদ আগরতলায় ইউ এন আই সংবাদ সংস্থাকে জানিয়েছেন।
-চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এ আর মল্লিক, রেজিস্টার খলিলুর রহমান এবং ডঃ আনিসুজ্জামান সহ অনেকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ত্যাগ করেন। ৩১ মার্চ থেকেই ক্যাম্পাস খালি হয়ে যাচ্ছিল। (১৫খঃ পৃঃ৭)
-৪র্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টের ক্যাপ্টেন আইন উদ্দিন আখাউড়া আওয়ামীলীগের সহায়তায় আগরতলা পৌঁছান। লেঃ কর্ণেল দাসের কাছ থেকে অস্ত্র সংগ্রহ করেন। আলী আজম এম, এন, এ, লুৎফুর হাই বাচ্চু বেঙ্গল রেজিমেন্টের সর্বাত্মক সহায়তা করেন। (৯খঃ পৃঃ ১৯২) উল্লেখ্য মার্চ ৩১ নায়েক সুবেদার গোলাম আম্বিয়ার নেতৃত্বে ই পি আর সৈন্যরা আখাউড়া পাঞ্জাবীদের ঘেরাও করে পরে গোলাগুলির পর ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় প্নাজাবী অফিসার ধরা পরে। তারা হলো লেঃ কর্নেল খিজির হায়াত খান, সাদেক নেওয়াজ, লেঃ আমজাদ সাইদ। তাদেরকে তেলিয়াপাড়া মুক্তিবাহিনী পূর্বাঞ্চল সদর দপ্তরে নিয়ে যাওয়া হয়। তাদেরকে ভারতীয় সৈন্যদের কাছে দিয়ে দেয়া হয়। (৯খঃ পৃঃ ১৯২)
-চট্টগ্রাম শহরে চূড়ান্ত লড়াই পর্যায় হালিশহর পতনের পর পাক সেনাদের পুরো দৃষ্টি পরে কোর্ট হিলের উপর। এটাই ছিল ক্যাপ্টেন রফিল-উল-ইসলাম (পরে মেজর) নেতৃত্বাধীন বাহিনীর সর্বশেষ ঘাঁটি, সর্বশেষ আশা। মাত্র ত্রিশজন মুক্তিফৌজের সঙ্গে পাকিস্তানী এক ব্যাটালিয়ন ট্যাংক নিয়ে প্রচণ্ড আক্রমণের মুখে অলৌকিকভাবে মুক্তিফৌজরা অবস্থান ত্যাগ করে। (৯ খঃ পৃঃ ১০১)
-রাজশাহী, খুলনা ও আরও কয়েকটি স্থানে পাকিস্তানী স্যাবর জেট বুধবার বোমাবর্ষণ করেছিল। পাক বিমানবাহিনীর এই হানায় বহু নিরস্ত্র লোক নিহত হয়েছে। চট্টগ্রামে প্রত্যেকটি গৃহ একটি দুর্ভেদ্য দুর্গে পরিণত হয়েছে; রংপুর ও কুষ্টিয়া জেলা মুক্তিফৌজের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। ২৫ মার্চ থেকে দু’দিনে ঢাকা ও শহরাঞ্চলে প্রায় ৩০ হাজার লোক নিহত হয়েছে বলে ত্রিপুরায় আগত পাক-সাংবাদিকরা জানান। (যুগান্তর ৯ঃ ৫৫৮)
-সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি আরো বলেন যে, পূর্ব পাকিস্তানে নির্বিচারে রাজনৈতিক নেতা, ছাত্র ও নিরীহ জনগণকে হত্যা করার খবর পাওয়া গেছে। তিনি পূর্ব পাকিস্তানের জন্য দুঃখ ও সমবেদনা প্রকাশ করেন। আমেরিকা যে সমস্ত অস্ত্রশস্ত্র পাকিস্তানকে দিয়েছে, সেগুলো দিয়ে জনগণের ওপর নির্যাতন চালানো হচ্ছে। তিনি বলেন যে, আমেরিকা সরকারের এই হত্যাকাণ্ডকে নিন্দা করা কি উচিত নয়? তিনি আশা প্রকাশ করেন যে, আমেরিকান সরকার এই ব্যপারে সক্রিয় মানবতাবাদী পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন। (বিডি-১, পৃঃ ৫২০-৫২১)
-মার্কিন সিনেটর হ্যারিশ সিনেটে এক ভাষণে বলেন যে, পূর্ব পাকিস্তানের দুঃখজনক ঘটনাবলী বিশ্ববাসী জেনে ফেলবে, এ ভয়ে পাকিস্তান বিদেশী সাংবাদিকদের বহিষ্কার করেছে। সাংবাদিককদের বহিষ্কার এটাই প্রমাণ করে যে, পূর্ব বাংলায় ব্যপক হত্যাকাণ্ড ও ধ্বংসলীলা চলছে। এই দুঃখজনক পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে বিশ্বের এগিয়ে আসা উচিত। এই পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্রের আশু কর্তব্য হলো পাকিস্তানকে সর্বপ্রকার অর্থনৈতিক ও সামরিক সাহায্য বন্ধ করে দেয়া।
-মেজর চিত্তরঞ্জন দত্ত রশীদপুর থেকে তার হেড কোয়ার্টার মৌলভীবাজারে স্থানান্তর করেন। পথিমধ্যে নয়নপুরে পাক বাহিনীর সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। পাকবাহিনীর হাতে উন্নতমানের অস্ত্রশস্ত্র থাকা সত্ত্বেও হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধাদের ‘জয় বাংলা’ ধ্বনিতে পাক বাহিনী মুক্তিবাহিনীর সংখ্যাগরিষ্ঠতয়ার কথা ভেবে ভীত হয়ে পিছু হটে যায়।
-উল্লেখ্য মৌলভী বাজার থেকে সিলেট আক্রমণ করা রণকৌশলগত দিক থেকে সুবিধাজনক ছিল। মৌলভীবাজারের অবস্থান এমন স্থানে ছিলো যে সেখান থেকে দুটো প্রধান সড়ক সিলেট থেকে একটি কুলাউড়া হয়ে এবং অপরটি শেরপুর শাদিপুর হয়ে মৌলভীবাজারে মিলেছে। যদি শত্রুরা কুমিল্লা অথবা ব্রাহ্মণবাড়িয়া যেতে চায় তবে মৌলভীবাজারে অনিবার্যভাবেই আসতে হবে।
-৩১ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের দু’টি প্ল্যাটুন শেরপুরে এবং এক প্ল্যাটুন সৈন্য শাদিপুরে প্রতিরক্ষা অবস্থান নেয়। সিলেট আক্রমণের জন্য শেরপুর ও শাদিপুর ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থান। পাক বাহিনীর কাছে স্বয়ংক্রিয় মেশিনগান তিন ইঞ্চি মর্টার ও চাইনিজ রাইফেল ছিল। শেরপুর শাদিপুর পারাপারের ফেরী নৌকাগুলো পাকবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে। (সিলেট মুক্তিযুদ্ধ।)
আমেরিকান হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনজন অধ্যাপক ‘পূর্ব পাকিস্তানে সংঘর্ষঃ তার কারণ ও ফলাফল’ শীর্ষক একটি দলিল প্রকাশ করেন। এদের মধ্যে ছিলেন অধ্যাপক এডওয়ার্ড এস ম্যাসন (আমেরিকান ইকোনমিক এসোসিয়েশনের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট) অধ্যাপক রবার্ট ডর্ফম্যান (বিশ্বব্যাংকের প্রাক্তন উপদেষ্টা) এবং অধ্যাপক স্টীফেন এ মার্গলীন (বিশ্বব্যাংক, মার্কিন সরকার ও জাতিসংঘের প্রাক্তন উপদেষ্টা)। এই দলিলে বলা হয়, পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা অবশ্যম্ভাবী। বেসামরিক নাগরিকদের ব্যাপকভাবে হত্যার ফলে পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনৈতিক স্বায়ত্বশাসন লাভের আন্দোলন স্বাধীনতার সংগ্রামে পরিণত হবে এবং যথাসময়ে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হবে। পাকিস্তানের দুই অংশের জনসাধারণের জীবনযাত্রার মান অসম, এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই। পশ্চিম পাকিস্তানের কুক্ষিগত কেন্দ্রীয় সরকারও তা স্বীকার করে। পূর্ব পাকিস্তানে পাটের বিনিময়ে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা ও বৈদেশিক সাহায্যের অধিকাংশ পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়োজিত করার অভিযোগ করা হয়েছে। এই অভিযোগ সত্য বলে অধ্যাপকরা মনে করেন। শেখ মুজিবের রাজনৈতিক কর্মসূচীর প্রতি জনসাধারণের অকুণ্ঠ সমর্থন সাম্প্রতিক নির্বাচনে প্রমাণিত হয়েছে। এর প্রত্যুত্তরে ইয়াহিয়া খান পূর্ব পাকিস্তানে সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে। আমেরিকার নিজের স্বার্থে স্বাধীন বাংলাদেশকে অবিলম্বে স্বীকৃতি দেওয়া কর্তব্য বলে অধ্যাপকরা অভিমত প্রকাশ করেন। মুজিবনগর থেকে পুস্তিকাকারে প্রকাশিত হয়।
-‘দি ডেইলি টেলিগ্রাফ’- এর কূটনৈতিক সংবাদদাতা কতৃক প্রদত্ত এক সংবাদে বলা হয়, পূর্ব পাকিস্তানের নেতা শেখ মুজিবকে ঢাকা থেকে বিমানযোগে লাহোরে নিয়ে আসা হয়েছে বলে বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গিয়েছে। তিনি কোথায় ও কিভাবে রয়েছে সে সম্পর্কে পাকিস্তান সরকার নীরব থাকার নীতি গ্রহণ করেছে।
-‘দি টাইমস’- এ প্রকাশিত এক সংবাদে বলা হয়, ৩১ মার্চ ভারতীয় পার্লামেন্টে গৃহিত এক প্রস্তাবে পূর্ব বাংলার সাড়ে সাতকোটি জনসাধারণের ঐতিহাসিক অভ্যুত্থান সফল হবে বলে আশা প্রকাশ করা হয়। শ্রীমতি গান্ধী নিজেও প্রস্তাব উত্থাপন করে বলেন, পূর্ব বাংলার জনগণের প্রতি ভারতীয় জনগণের পূর্ণ সমর্থন রয়েছে এবং তারা সর্বপ্রকার সাহায্য করার জন্য প্রস্তুত। (স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রবাসী বাঙালি- প
Reference:
একাত্তরের দশ মাস – রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী