You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.07.11 | ২৬ আষাঢ়, ১৩৭৮ রবিবার, ১১ জুলাই ১৯৭১ | একাত্তরের দশ মাস - রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী - সংগ্রামের নোটবুক

২৬ আষাঢ়, ১৩৭৮ রবিবার, ১১ জুলাই ১৯৭১

-বাংলাদেশের উচ্চপদস্থ সামরিক অফিসার ও সেক্টোর কমান্ডারদের প্রথম সম্মেলন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয়। ৮ থিয়েটার রোডস্থ বেসামরিক সেক্রেটিরিয়েটে এই সম্মেলন হয়। সেনাপতি কর্নেল ওসমানী এদিন অনুপস্থিত ছিলেন।  ১। কর্নেল (অবঃ) এম.এ.রব, এন এ ২। গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ,কে খোন্দকার ৩। মেজর (অবঃ) নরুজ্জামান ৪। মেজর চিত্তরঞ্জন দত্ত ৫। মেজর জিয়াউর রহমান ৬। মেজর কাজী মোঃ শফিউল্লাহ ৭। মেজর মীর শওকত আলী ৮। মেজর খালেদ মোশাররফ ৯। উইং কমান্ডার কে, এ , বাশার ১০। মেজর ওসমান চৌধুরী ১১। মেজর রফিকুল ইসলাম ১২। মেজর নজমুল হক ১৩। মেজর এম, এ, জলিল ১৪। মেজর এম.আর. চৌধুরী।

-এই অধিবেশনে কর্নেল আব্দুর রব, এম এন এ –কে বাংলাদেশ বাহিনীর চীফ অব ষ্টাফ এবং গ্রুপ ক্যাপ্টেন খোন্দকার আব্দুর করিম ডেপুটি চীফ অব ষ্টাফ নিযুক্ত হলেন। সম্মেলনে কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। তন্মধ্যে সেক্টোরের সীমানা নির্ধারণ, গেরিলাযুদ্ধের  আয়োজন এবং গেরিলাদের শ্রেণীবিন্যাস ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত ছিল। এই সম্মেলনে পাকবাহিনীর সকল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন  করে দেয়া সহ ঢাকা শহরে অস্বাভাবিক অবস্থা সৃষ্টির সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। তাছাড়া মুক্তিযুদ্ধের সুবিধার্থে সমগ্র বাংলাদেশকে ১১টি সেক্টরে বিভক্ত করা হয়। সামরিক অধিনায়কদের ঐসব সেক্ট্রেরের দায়িত্ব নিযুক্ত করা হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের দুটি প্রধান ভাগে ভাগ করা হয়। নিয়মিত বাহিনী বা আর্মি ব্যাটালিয়ন, সেক্টর ট্রুপ্স এবং এফএফ বা অনিয়মিত বাহিনী। মেডিকেল টিম, ইন্টেলিজেন্স চেইন এবং রাজনৈতিক পরামর্শ দানের ব্যবস্থা ছিল। এপ্রসঙ্গে পরবর্তীতে একাত্তরের স্মৃতিচারণ গ্রন্থে আহমেদ রেজা লিখেছেনঃ মেজর জিয়ার উদ্যোগে যুদ্ধ কাউন্সিল গঠনের প্রস্তাব উত্থাপিত হলো এই সম্মেলনে। এই প্রস্তাবের অন্তর্নিহিত অর্থই ছিল কর্নেল ওসমানির সামরিক নেতৃত্ব প্রতি অনাস্থা প্রকাশ। এই প্রস্তাবের পক্ষে ছিলেন, মেজর মীর শওকত, উইং কমান্ডার বাশার, মেজর নুরুজ্জামান, মেজর জলিল মেজর মঞ্জুর প্রমুখ সেক্টরের অধিনায়ক। মেজর শফিউল্লা ও মেজর দত্তের ভূমিকা ছিল নিরপেক্ষ।

কিন্তু  মেজর খালেদ মোশারফ যুদ্ধ কাউন্সিল গঠনের কঠোর বিরোধিতা করেন। …ক্ষমতা দখলের জন্য মেজর জিয়ার সম্ভবত এটিই ছিল প্রথম প্রত্যক্ষ প্রচেষ্টা। (পৃঃ১৪৯) ব্যারিষ্টার আমীর-উল ইসলাম লিখেছেন, ‘স্বাধীনতা যুদ্ধকালে ক্ষমতার দ্বন্দ ও রাজনৈতিক উচ্চভিলাষ চরমভাবে দেখা  দেয়। এই উচ্চাভিলষ যুবক,ছাত্র নেতা থেকে শুরু করে বন্দুকধারী মুক্তিযোদ্ধা, সিপাই, চাকরিজীবী সকলের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। রাজনীতিকদের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ ছিল তবে উচ্চাভিলাষীর সংখ্যা তত বেশী ছিল না।…অপরদিকে,সামরিক বাহিনীর মধ্যে মুজিব বাহিনী সৃষ্টির ফলে এই অবিশ্বাস আরো বৃদ্ধি পায়। একজন সংসদ সদস্য থাকা সত্ত্বে ওসমানী মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতির দায়িত্ব পালন করায় বহু সামরিক অফিসারের মধ্যে তাকে এড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতা লক্ষ্য করা গেছে। তাদের বক্তব্য ছিল সেনাবাহিনী থেকে অবসরপ্রাপ্ত ব্যক্তির অধিনায়ক হওয়া উচিত নয়। …সামরিক বাহিনীর মধ্যে ক্ষমতার প্রতিযোগিতা তখন থেকেই শুরু হয়। শফিউল্লাহ, জিয়া ও খালেদ এই তিনজনের মধ্যে ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল বলে আমার ধারণা। শফিউল্লাহ ও খালেক দু’জনেই যুদ্ধে বীরত্বের পরিচয় দেন। এরা চিরকাল বীর হিসেবে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। জিয়ার তেমন কোন বীরত্বের নজির নেই তবে তার মধ্যে ক্ষমতার অস্পষ্ট প্রস্তুতি তখন থেকেই লক্ষ্য করা গেছ। (মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি, পৃঃ ৯৪)

-পিকিং ও ওয়াশিংটন থেকে যুগপৎ বিবৃতি প্রকাশঃ ১৯৭২ মে মাসের মধ্যে প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন পিকিং সফরে যাবেন। (সংবাদপত্র) পাকিস্তানী পত্রিকায় প্রকাশঃ কিসিঞ্জার-চৌ এন লাই বৈঠক ঘটানোর কৃতিত্ব ইয়াহিয়ার।

আট নম্বর সেক্টরাধীন মুক্তাঞ্চলে ‘কাশীপুরে’ ক্যানাডীয় টেলিভিশন টীম বাংলাদেশের ছাত্র, যুবক, কৃষক-শ্রমিক রাজনীতিক ও নিয়মিত বাহিনী সমন্বয়ে গঠিত মুক্তিবাহিনী ডকুমেন্টারী ছবি তোলেন। পরে বিশ্বের গণমাধ্যামে তা প্রদর্শিত হয়।

-ময়মনসিংহ বাহাদুরাবাদ জগন্নাথগঞ্জ রেল্লাইনের বিদ্যাগঞ্জ সেতু এবং ঢাকা ময়মনসিংহ লাইনের কাওরাইদ রেলসেত এদিন মুক্তিবাহিনীর গেরিলাদল উড়িয়ে দেয়। মুক্তিবাহিনীর হাতে বিভিন্ন স্থানের সংঘর্ষে বহু পাকবাহিনী নিহত হয় বলে জানা যায়। (সংবাদপত্র)

-মুন্সিগঞ্জ এলাকা সম্পূর্ণভাবে মুক্তিবাহিনী নিয়ন্ত্রণে এসে যায়। মে-জুন তিন মাস ধরে তেরটি শিবিরে গেরিলাদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। আজ গেরিলাদের প্রথম দলটি প্রশিক্ষণ শেষ করেছে। তাদেরকে বিভিন্নস্থানে প্রেরণ করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। অপারেশন চালানোর সম্পূর্ণ কর্তৃত্ব সেক্টর কমান্ডারদের উপর  অর্পিত হয়। অপারেশনের নির্দ্দেশগুলো ছিল মাইনিং গেরিলা আক্রমণ এ্যাম্ববুশ, সেতু সহ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করা, দালাল শান্তি কমিটির সদস্যদের খতম করা, এবং বিদ্যুৎসহ টেলিযোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করা।

–পাক রেডিও বলেঃ পাকিস্তানের সেনাবাহিনী পূর্ব পাকিস্তান থেকে দুস্কৃতিকারী, বিদ্রোহী ও রাষ্ট্রদ্রোহীদের নির্মূল করার পর ক্রমে ক্রমে সেখানকার অর্থনৈতিক জীবনে স্বাভাবিক অবস্থা।    

ফিরে আসছে। দৈনিক পাকিস্তানে প্রকাশিত এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে যে, ১১, ১৮ ও ২০ জুলাই তারিখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় রাজাকারদের চাঁদমারী প্রশিক্ষণ অনুষ্ঠিত হবে।

   ফিলিপাইনের  ‘সানডে টাইমস’ পত্রিকায় পাকিস্তানকে মার্কিন অস্ত্র সরবরাহ করার জন্য তীব্র সমালোচনা করা হয়।

এদিন মুক্তিযোদ্ধারা শালদা নদী, মিরেশ্বরাই, চাঁদপুর, লাতু, শাহজাবপুর, ঝিকরগাছা, প্রভৃতি স্থানে মাইন আক্রমণ, সেতু ধ্বংস গেরিলা অপারেশনের দালাল রাজাকার হত্যা, বিদ্যুৎ কেন্দ্র ও টেলিযোগাযোগের প্রভূত ক্ষতি সাধন করে।

পূর্ব পাকিস্তান রেডক্রসের চেয়ারম্যান বিচারপতি এ.কে এম নূরুল ইসলাম জেনেভা সফর শেষে ঢাকায় প্রত্যাবর্তন করেন।

পশ্চিম পাকিস্তান পিডিপির সভাপতি নওয়াবজাদা নুসরুল্লাহ খান লাহোরে এক বিবৃতিতে বলেন, একটি ইরানী দৈনিকের সাক্ষাৎকারে পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো বে-আইনী ঘোষিত আওয়ামী লীগ অ তার নেতা শেখ মুজিবর রহামানের সাথে বর্তমান সরকারের একটি মীমাংসাভিক্তিক ফর্মূলার ব্যাপারে আলাপ আলোচনা করা উচিত বলে যে পরামর্শ দিয়েছেন তা দুঃখজনক। জনাব খান বলেন বেআইনী আওয়ামী লীগের সাথে পাকিস্তানের যে কেউই আলোচনা করতে যাবেন। তিনিই জাতীয় স্বার্থ বিরোধী কাজ করবেন। জনাব ভুট্টো সাক্ষাৎকার বলেন, সেনাবাহিনী পূর্ব পাকিস্তানের বর্তমান সমস্যা সমাধান করতে  পারেন না, সেখানে যথা শিগগির সম্ভব বেসামরিক শাসন কায়েম করা উচিত। নসরুল্লাহ খান ভুট্টোর এ মন্তব্যের সাথে দ্বিমত প্রকাশ করে বলেন, ভুট্টোর এ উক্তি পাকিস্তানের শত্রুদের মনোবলকে দৃঢ় করবে। (সংবাদপত্র)

‘দি সানডে টাইমস’-এ প্রকাশিত এক নিবন্ধে ব্রিটিশ পার্লামেন্টারী প্রতিনিধি দলের সদস্য মিঃ রোডান্যালড প্রেনটিস বলেন যে, শেখ মুজিব এবং আওয়ামী লীগের কাছে গ্রহণযোগ্য একটা রাজনৈতিক সমাধান পূর্ব বাংলার বর্তমান সংকট নিরসনের একমাত্র উপায়। ইয়াহিয়া খানকে একথা অবশ্যই মেনে নিতে হবে।

 জাতিসংঘে বিভিন্ন দেশ থেকে শরণার্থীদের উদ্দেশ্যে প্রদত্ত ১৭,৫০০,৮০০ ডলার প্রাপ্তিসহ দেশ সমূহের নাম প্রকাশ করেন। (KCA, pp. 24686)

 কায়রোর সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘রোজ আল ইউসূফ’ পূর্ব বাংলায় পাকসেনাদের গণহত্যা ও ভারতে বাঙালী শরণার্থীদের উপস্থিতিকে বিশ্লেষণ করে এক সম্পাদকীয়তে মন্তব্য করা হয় অস্বাভাবিক পদ্ধতিতে বাংলা ভাগ করার জন্যই এ সমস্যা বর্তমানে চূড়ান্ত রূপ নিয়েছে। এই সমস্যা থেকে উপমহাদেশ বিশ্ব সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে বলে সাপ্তাহিকীতে আশাংকা প্রকাশ করা হয়।

লেঃ জেঃ এ. এ. কে. নিয়াজী (জুলাই ১০) চট্টগ্রাম অ পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় সেনাবাহিনী পরিদর্শন করেন। এই সফরকালে চাকমা প্রধান ও জাতীয় পরিষদ সদস্য (স্বতন্ত্র) রাজা ত্রিদিব রায়ও উপস্থিত ছিলেন। (দৈঃ পাঃ)

Reference:

একাত্তরের দশ মাস – রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী