১৬ চৈত্র ১৩৭৭ মঙ্গলবার ৩০ মার্চ ১৯৭১
-চট্টগ্রাম বেতারের কালুরঘাট ট্রান্সমিটারটি পাকবাহিনীর বোমারু বিমানের আক্রমণে বিধ্বস্ত হয়। সেখানে সুবেদার ছাবেদ আলী তার প্লাটুন নিয়ে অবস্থান করছিলেন। উপায়ান্তর না দেখে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের বীর শব্দ সৈনিকগণ মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তায় একটি ক্ষুদ্র এক কিলোওয়াট ট্রান্সমিটার বয়ে নিয়ে যায় মুক্তাঞ্চল রামগড়ে। তারপর আগরতলা। -পাক বিমানবাহিনীর হামলার পর মুক্তিফৌজরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। চকবাজারে ক্যাপ্টেন হারুন ও লেঃ শমসের মবিন চৌধুরী যুদ্ধ করেন এবং আহত হন। লেঃ শমসের মবিন চৌধুরী পাকসেনাদের হাতে বন্দী হন। -গোপালপুর (রাজশাহী) রেলক্রসিং এর মুক্তিযোদ্ধা ও জনতার সঙ্গে পাকবাহিনীর লড়াই ছিল প্রতিরোধ যুদ্ধের অন্যতম ঘটনা। এই লড়াইয়ে ৬ ট্রাক একটি জীপসহ বিপুল অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত পাকবাহিনীর সৈন্যদল সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে ছিল এবং জনতার হাতে পাক বাহিনী সৈন্যদলের অধিনায়ক মেজর রাজা আসলাম নিহত হয়। উত্তরবঙ্গ চিনিকলের অফিসার কর্মচারীর এই প্রতিরোধ যুদ্ধকে সফল করার জন্য সর্বাত্মক সহযোগীতা করেছিলেন। -নোয়াখালী আব্দুল মালেক উকিল এম, এন, এ পরিচালিত প্রতিরোধ বাহিনী ব্লুনিয়ায় পাকবাহিনীর সঙ্গে লড়াইয়ে ৪০ জন পাকসেনাকে বন্দী করে ও প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ হস্তগত হয়। পরে এসব অস্ত্রশস্ত্র শুভপুরের যুদ্ধে কাজে লাগে। -মেজর আবু ওসমানের নেতৃত্বাধীন বীর মুক্তিযোদ্ধারা পাকবাহিনীর সঙ্গে তুমুল যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। পাকবাহিনী দামুড়হুদা, আলমডাঙ্গা, ঝিনাইদহের পথে পালাতে থাকে। ২৫৬ জন পাকসেনা ঘটনাস্থলে নিহত হয়। গ্রামবাসী পলায়নরত ক’জন পাকসেনাদে দা সড়কি দিয়ে খতম করে। লেঃ আতাউল্লাহ মুক্তিবাহিনীর হাতে আত্মসমর্পণ করে। এই পাঠান সৈনিক জনতার পানে তাকিয়ে কেঁদে ফেলে। প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র থাকা স্বত্ত্বেও কেন আত্মসমর্পণ করল তা এক বিরাট জিজ্ঞাসা? -ফরিদপুর থেকে ট্রেনে কুষ্টিয়ায় সব রকম রসদ পাঠালেন, জেলা ও সিটি আওয়ামীলীগ নেতৃবৃন্দ। এম, পি, এ ইমামউদ্দিন আহমেদ, সিটি আওয়ামী লীগ সেক্রেটারী ও ছাত্রনেতৃবৃন্দের ভূমিকা ছিল অগ্রগণ্য। এম, এন, এ কে, এম ওবায়দুর রহমান ও এম, এন, এ শামসুদ্দিন মোল্লা সর্বাধিক পদক্ষেপ গ্রহণ করলেন।
-হানাদার পাকবাহিনী রংপুর ক্যান্টনমেন্ট থেকে বের হওয়ার এতদিন সাহস পায়নি বা বের হয়নি। আজ থেকে রংপুর শহর সহ গ্রাম-গঞ্জের ওপর নির্বিচারে গুলি বর্ষণ করে মানুষ হত্যা ও নির্মম পাশবিক অত্যাচার চালিয়ে এবং আগুন জ্বালিয়ে বাড়িঘর মহল্লা গ্রাম ধ্বংস করতে থাকে। -রংপুর এ-পি-আর দশম উইং এর সহকারী কমাণ্ডার ক্যাপ্টেন নওাজিশ আহমেদ পরিবার পরিজন লালমনিরহাট পাঠিয়ে দিয়ে কয়েকজন ই-পি-আর নিয়ে পালিয়ে তিস্তা নদীর পাড় সুন্দরগঞ্জে গোপন আশ্রয় গ্রহণ করে। -চট্টগ্রাম থেকে সর্বজনাব এন আর সিদ্দিকী, জহুর আহমেদ চৌধুরী, আতাউর রহমান খান এবং আব্দুল্লাহ আল হারুন সাধ্রম সীমান্দ দিয়ে আগরতলা পৌঁছান। আগরতলা শচীন সেনগুপ্তের কাছে আওয়ামীলীগ নেতাগণ অস্ত্রশস্ত্রের সহায়তার আবেদন জানান মুখ্য মন্ত্রী শচীন সেন শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে আলোচনা ক্রেন এবং জনাব এম আর সিদ্দিকীকে দিল্লে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানান। -ফ্রান্সের বন্দরে নোঙ্গর করা পাকিস্তানী জাহাজ থেকে সাবেক পাকিস্তান নৌবাহিনীর আটজন দুর্জয় সাহসী বাঙ্গালী নাবিক পাকিস্তান নৌবাহিনী ত্যাগ করে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করে। -আনন্দ বাজার পত্রিকা আজ লিখেছেঃ আওয়ামীলীগের কয়েকজন নেতা সোমবার (২৯ মার্চ) ওপারে থেকে এপারে এসেছেন। সকলেরই একই লক্ষ্য- ভারত থেকে অস্ত্র সাহায্য সংগ্রহ করা। মুক্ত কুষ্টিয়ার প্রধান পরিচালক ডাঃ আশহাবুল হক টেলিফোনে শ্রী অজয় কুমার মুখোপাধ্যায় সঙ্গে কথা বলেছেন। তারও আবেদন ছিলঃ আপনারা অবিলম্বে সাহায্য পাঠান। কুষ্টিয়া মিলিটারী ব্যারাককে চতুর্দিক দিয়ে ঘিরে ফেলা হয়েছে। সৈন্যদের বলা হয়েছে আত্মসমর্পণ করতে। উল্লেখ্য এ সময়ে ফরিদপুর থেকে কে এম ওবায়দুর রহমান ডঃ হকের সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ করেন এবং মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ফরিদপুর থেকে ট্রেনযোগে রসদ পাঠানোর ব্যবস্থা নেন। -সীমান্তের চারদিক থেকে শিরোনামে আনন্দ বাজার পত্রিকা অবরুদ্ধ বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় সশস্ত্র সংগ্রামের বিবরণ ছাপে। -সাতাশ বছর বয়সে নিবেদিত প্রাণ সাংবাদিক সাইমন ড্রিঙ্ক ২৫ মার্চ ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে ছাদে পালিয়ে থেকে গণহত্যার ও জলন্ত ঢাকার সংবাদ সংগ্রহ করেছিলেন।
ডেইলি টেলিগ্রাফ এর সাংবাদিক সাইমন পাকবাহিনীর বিমান বন্দরের তল্লাসী থেকে সংগ্রহকৃত তথ্যাদি রক্ষা করে ব্যাংকক থেকে প্রতিবেদন প্রেরণ করেন লন্ডনে। ২৫ শে মার্চ পরে এই প্রতিবেদনই বহিব্ররবিশ্বে ঢাকার গণহতয়ার প্রথম বিস্তারিত সংবাদ। সাইমন ডিঙ্ক তাঁর প্রতিবেদননে বলেনঃ ঐক্যবদ্ধ পাকিস্তানের নামে ঢাকাকে একটি বিধ্বস্ত এবং ভীতি সন্ত্রস্ত নগরে পরিণত করা হয়েছে। চব্বিশ ঘন্টায় নির্মম নিষ্ঠুর শেলিং এর দ্বারা পাক সেনাবাহিনী অন্তত সাতহাজার লোককে হত্যা করেছে, বিস্তির্ণ এলাকা করছে সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত। ইয়াহিয়া খান পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা আন্দোলনের সমাপ্তি করতে চেয়েছে। সামরিক সরকার দাবী করেছে অবস্থা শান্ত কিন্তু দেখা যাচ্ছে হাজার হাজার মানুষ গ্রাম অঞ্চলে পালিয়ে যাচ্ছে শহরগুলো ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। এবং প্রদেশের নানা জায়গায় চলছে হতাযজ্ঞ মফস্বলের শহরগুলোর খবর যতদূর পাওয়া যায় তাতে মনে হয় অন্তত ১৫ হাজার লোক নিষ্ঠুরভাবে হত্যার শিকার হয়েছে ঐ রাতে। ঐ রাতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একমাত্র ইকবাল হলেই দু’শো ছাত্রকে হত্যা করা হয়। রুমগুলো বন্দুকের গুলিতে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন, দুদিন পরেও সবদেহ গুলোকে পূততে দেখা যায়। অনেক শবদেহ পুকুরে ভাসতে দেখা যায়, সাতজন শিক্ষক নিহত আর বারজনের পরিবারকে বন্দুকের গুলিতে শেষ করে দেয়া হয়। বহু ছাত্রদের মৃতদেহ একটি গর্তে ফেলে বুলডোজার দিয়ে সমান করে দেয়া হয়। (দীর্ঘ প্রতিবেদনের অংশবিশেষ) -প্রথমে আত্মরক্ষা, তারপর প্রস্তুতি এবং সবশেষে পালটা আঘাতের পর্যায়ক্রমিক লক্ষ্য স্থির করে সাহসী তাজউদ্দীন ফরিদপুরে ও কুষ্টিয়ার পথে পশ্চিম বাংলার সীমান্তে গিয়ে উপস্থিত হলেন ৩০ মার্চ সন্ধ্যায়। বিদ্রোহী সিপাহীদের পাশে প্রতিরোধ সংগ্রামে যোগ দিয়েছে দেশের আবালবৃদ্ধ বইন্তা। স্বাধীনতার জন্য সারাদেশ একতাবদ্ধ। (মুলধারা ৭১ পৃঃ ৯) উল্লেখ্য জনাব তাজউদ্দীন আহমেদ সীমান্তে পূছার পূর্বে মাগুড়ার সোহরাব হোসেন এম এন এ এবং ঝিনাইদহের আব্দুল আজিজের বাসায় অবস্থান করেন। চুয়াডাঙ্গায় মেজর আবু ওসমান চৌধুরী, মাহবুবুর রহমান এস্পি এবং তওফিক এলাহি সাহেব, মহকুমার প্রশাসকের সঙ্গে আলোচনা করেন। কুষ্টিয়ায় প্রতিরোধ সংগ্রাম তীব্র সংঘর্ষে রূপান্তরিত হয়। -মুক্তিবাহিনীর সাথে হানাদার বাহিনীর বিক্ষিপ্ত লড়াই চলে। কুমিরায় তুমুল যুদ্ধ হয়। সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র থেকে মেজর জাইউর রহমান ইংরেজীতে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে সংশোধিত স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন।
ঘোষণাটি নিম্নে দেয়া হলোঃ
The government of the sovereign state of Bangladesh on behalf of our, Great Leader, the Supreme Commander of Bangladesh Sheikh Mujibur Rahman, we here by proclaim the independence of Bangladesh. And that the government headed by Shiekh Mujibur Rahman has already been formed. It is further proclaimed that Sheikh Mujibur Rahman the sole Leader of the elected representatives seventy five million people of Bangladesh, and the government headed by him is the only legitimate government of the people of the independent sovereign state of Bangladesh, which legally and constitutionally formed, and worthy of Being recognized by all the governments of the world. I therefore, appeal on behalf of our Great Leader Sheikh Mujibur Rahman to the governments of all the democrat countries of the world, specially the big powers and the neighboring countries to recognize the legal government of Bangladesh and take effective steps to stop immediately the awful genocide that has been carried on by the army of occupation from Pakistan. The guiding principle of the new state will be first neutrality, second peace and third friendship to all and enmity to none. May Allah help us. Joy Bangla.
(আমাদের মহান নেতা, বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে আমরা স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করছি। ইতিমধ্যে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে সরকার গঠিত হয়েছে। এ সঙ্গে আমরা আরো ঘোষণা করছি যে, বাংলাদেশের সাড়ে সাতকোটি জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমান এবং তাঁর নেতৃত্বাধীন সরকারই স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের একমাত্র আইন সম্মত সরকার, যা বৈধ এবং সাংবিধানিকভাবে গঠিত হয়েছে। এ সরকার বিশ্বের সকল সরকারেরই স্বীকৃত পাবার যোগ্য। সুতরাং আমাদের মহান নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে আমি বিশ্বের সকল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বিশেষতঃ বৃহৎশক্তি ও প্রতিবেশী রাষ্ট্রসমূহের সরকারের প্রতি বাংলাদেশের বৈধ সরকারকে স্বীকৃতি প্রদানের আবেদন জানাচ্ছি। একই সাথে অবিলম্বে দখলদার পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বীভৎস গণহত্যা বন্ধের কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য তাঁদের প্রতি আহ্বান জানাই। নতুন রাষ্ট্রের মূলনীতি হবে প্রথমতঃ নিরপেক্ষতা, দ্বিতীয়তঃ শান্তি, তৃতীয়তঃ সকল দেশের সাথে বন্ধুত্ব কারো সাথে শত্রুতা নয়। আল্লাহ আমাদের সহায় হোন।
জয় বাংলা।)
-ঢাকার মর্নিং নিউজ এক পাতা প্রকাশিত হয়েছে। সংবাদ শিরোনাম ছিলঃ
-মর্নিং নিউজ দুটো মুখ্য শিরোনাম সংবাদ দিয়েছে-
(১) শেখ মুজিব ১৯৬৬ থেকে স্বাধীনতার প্রচেষ্টায় ছিলেন।
(২) পাকিস্তান রক্ষা পেল- ভুট্টো বলেছেন।
‘মুজিব ওয়ান্টেড সেপারেশন রাইট ফ্রম সিক্সটিসিক্স।’
‘পাকিস্তান সেভড; সেইজ ভুট্টো। অর্থাৎ শেখ মুজিব ১৯৬৬ থেকে পূর্ববঙ্গকে বিচ্ছিন্ন করতে চেয়েছেন। ২৫ মার্চ পাকবাহিনীর অপারেশন সার্চলাইট পাকিস্তানকে রক্ষা করেছে, জেড, এ ভুট্টোর উক্তি।
Reference:
একাত্তরের দশ মাস – রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী