জীবনচিত্র নামঃ ডা. আব্দুন নূর
Dr. Abdun Nur
পিতার নামঃ মো. খোরশেদ আলী
পিতার পেশাঃ কৃষি
মাতার নামঃ বশিরুন নেছা
ভাইবোনের সংখ্যাঃ এক ভাই ও দুই বোন; নিজক্ৰম-প্রথম
ধর্মঃ ইসলাম
স্থায়ী ঠিকানাঃ গ্রাম ও বাড়ি-দৌলতপুর মাঝরবাড়ি,
ইউনিয়ন-৩নং বাহাদুরপুর, ডাকঘর-দৌলতপুর বাজার,
উপজেলা-বড়লেখা, জেলা-মৌলভীবাজার
শহীদ ডা. আব্দুন নূর
নিহত হওয়ার সময় ঠিকানাঃ ঐ
জন্মঃ ৯ নভেম্বর ১৯২১
শিক্ষাগত যোগ্যতাঃ
এলএমএফ
শখঃ সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চা
চাকরির বর্ণনাঃ
বাৰ্মা অয়েল কোংঃ মেডিকেল অফিসার
সমাজসেবাঃ সমাজসেবামূলক বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকতেন
রাজনৈতিক সম্পূক্ততাঃ ছাত্রলীগ, ১৯৪০, সাধারণ সদস্য। আওয়ামী লীগ, ১৯৫০, সাধারণ সদস্য
হত্যাকারীর পরিচয়ঃ
নামঃ আছদ্দর আলী, মনই মিয়া, মেকদিল হোসেন ও শফিক খান
সংগঠনঃ রাজাকার
নিহত হওয়ার তারিখঃ ১২ জুলাই ১৯৭১
মরদেহঃ
প্রাপ্তি স্থানঃ শাহবাজপুরের ভয়াল গর্তে
প্রাপ্তি তারিখঃ ২ জানুয়ারি ১৯৭২
সন্ধানদানকারীর পরিচয়ঃ আত্মীয়-স্বজন
কবরস্থানঃ দৌলতপুর জামে মসজিদ সংলগ্ন(দ্রষ্টব্য-ছবি)
মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হিসেবে সাহায্য/দান/পুরস্কারঃ
স্ত্রীর নামঃ শামছুন নাহার বেগম
সন্তান-সন্ততিঃ তিন পুত্র ও দুই কন্যা
রহিমা বেগমঃ অষ্টম শ্রেণী, গৃহিণী
শামছুদ্দোহাঃ এসএসসি, প্রয়াত(১৯৯৪ সালে)
শামিম আহমদঃ এইচএসসি, আমেরিকা প্রবাসী
শাহিন আহমদঃ এসএসসি, লন্ডন প্রবাসী
নাজমা ইয়াছমিনঃ এসএসসি, আমেরিকা প্রবাসী
তথ্য প্রদানকারী
নিলুফার শামসুদ্দোহা লিমা
শহীদ চিকিৎসকের নাতনি
দৌলতপুর, ডাকঘর-দৌলতপুর বাজার,
থানা-বড়লেখা, জেলা-মৌলভীবাজার
৯২ মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ
আমার পিতা
শহীদ ডা. আব্দুন নূর
ইকবাল মো. শামছুদ্দোহা স্বপন
বাবাকে ওরা যেদিন ধরে নিয়ে যায় সে তারিখটা মনে পড়ছে, ১২ জুলাই ১৯৭১। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক দেওয়ান ফরিদ গাজীকে একখানা চিঠি লিখেছিলেন বাবা। গোপনীয় চিঠি। কিন্তু সে চিঠিটা বেহাত হয়ে পাক হানাদারদের হাতে পড়ে। আর তার মাশুল দিতে হলো বাবার জীবন দিয়ে।
আমার বাবা শহীদ ডাক্তার আব্দুন নূরকে একাত্তরের স্বাধীনতা সংগ্রামে রাজাকারদের চক্রান্তে পাকিস্তানি ঘাতকরা নির্মমভাবে হত্যা করে। বাবার অপরাধ তিনি একজন বাঙালি। তাঁর অপরাধ তিনি বাঙালির স্বাধীনতায় বিশ্বাসী। বাবা ছোটবেলা থেকেই ছিলেন একজন মেধাবী ছাত্র। ম্যাট্রিক পাস করে চিকিৎসাশাস্ত্ৰে এল এম এফ ডিগ্রি লাভ করেন।
বাৰ্মা অয়েল কোম্পানিতে মেডিকেল অফিসারের চাকরি নেন। পাঁচ বছর চাকরির পর ইস্তফা দিয়ে নিজ এলাকা মৌলভীবাজার জেলার বড়লেখা থানার দৌলতপুরে চলে আসেন। উদ্দেশ্য-এলাকাবাসীর সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করবেন। বাবা বরাবরই ছিলেন সৎ, সাহসী ও নিষ্ঠাবান সমাজসেবক। সমাজকর্মে তাঁর দান অপরিসীম। ভাষা আন্দোলনেও বাবার যথেষ্ট ভূমিকা ছিল। আইয়ুববিরোধী আন্দোলনে তাঁকে একবার কারাবরণ করতে হয়েছে। অদম্য সাহসে তবু বাবা সামনেই অগ্রসর হয়েছেন। সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সমর্থনে বাবার প্রচারাভিযান সবাইকে উদ্বুদ্ধ করেছে।
আওয়ামীলীগ তথা বাঙ্গালির নির্বাচনী বিজয়কে পাকিস্তানিরা সহজভাবে মেনে নেয়নি বলে ক্ষমতা হস্তান্তরের নামে চলে প্রহসন। তারপর অসহযোগ আন্দোলন। সর্বোপরি মহান মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধে একজন সংগঠকের ভূমিকা পালন করেছেন বাবা। বাবার স্বাধীনতাকামী কর্মকাণ্ডকে প্রতিক্রিয়াশীল চক্র সহজভাবে নেয়নি। তাই ‘দুশমন’ হিসেবে তাঁকে তারা চিহ্নিত করে এবং সময়ের অপেক্ষায় থাকে। তাদের কালো তালিকাভুক্ত হলেন বাবাসহ দেশের মুক্তিকামী সচেতন মানুষ। বাবা জানতেন প্রতিক্রিয়াশীলরা যে কোনো মুহুর্তে তাঁর ওপর চড়াও হবে। কিন্তু তাই বলে তিনি কৰ্তব্যে অবহেলা প্রদর্শনের পাত্র
মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ ৯৩
নন। ‘দেশের জন্য জীবন যায় যাক’-এটাই ছিল বাবার মূলমন্ত্র। বাবা তাঁর এলাকার বিভিন্ন গ্রাম থেকে ছাত্র, যুবক, কৃষক, শ্ৰমিক সবাইকে সংগঠিত করে ভারতে পাঠাতেন। তারা ভারতের বিভিন্ন ক্যাম্পে সামরিক ট্রেনিং নিয়ে অস্ত্ৰ হাতে দেশমাতৃকার মুক্তিসংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তো।
অনেক মুক্তিযোদ্ধা আমাদের বাড়িতে আত্মগোপন করে থাকতো। তাদের খাবার, বাসস্থান এবং আহতদের চিকিৎসার ব্যাপারে বাবা ছিলেন অত্যন্ত সজাগ। কিন্তু এ কাজগুলো চলতো অত্যন্ত গোপনে। মুক্তিযুদ্ধের সার্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে তিনি ভারতে অবস্থানরত সংগঠকদের সাথে গোপনে পত্রালাপ করতেন। সমস্যা ও উদ্ভূত পরিস্থিতির খবরাখবর দিতেন। এমনি একটি চিঠি লিখেছিলেন আওয়ামী লীগ নেতা ও মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক দেওয়ান ফরিদ গাজীকে। চিঠি লিখে বাবা অপেক্ষায় ছিলেন কখন উত্তর আসে। কিন্তু সে চিঠির উত্তর আসেনি। বরং আসে তাঁর মৃত্যু পরোয়ানা। দু’জন রাজাকারের বিশ্বাসঘাতকতায় চিঠিখানা পাকসেনাদের হাতে পড়ে। আর যায় কোথায়? তলব করা হয় আমার বাবাকে।
চারজন রাজাকারসহ পাকিস্তানি সৈন্যরা হানা দেয় আমাদের বাড়িতে। আগত রাজাকারদের মধ্যে ছিল ইটাউরী গ্রামের সৈয়দ আছন্দর আলী, মনই মিয়া, নেকদিল হোসেন ও পুকুয়ার শফিক খান। যখন বাবাকে ওরা বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে যায় তখন আমার ছোট ভাই শামীম ও শাহীন গুলি খাওয়া পাখির মতো মাটিতে লুটিয়ে পড়ে ছটফট করছিল। আমাদের মা অজ্ঞান হয়ে পড়েন। কারো কিছু বলার ছিল না সেদিন। বাবাকে গ্রেফতার করে দৌলতপুর বাজারে পাকসেনা ক্যাম্পে নিয়ে যায়। বাবার উপর চলে চরম নির্জাতন, পাশবিক অত্যাচার। একাত্তরের ১২ জুলাই বাবাকে ওরা ধরে নিয়ে গিয়েছিল। তারপর বড়লেখায় পাঠিয়ে দেয়। সেখানে হানাদারদের এক জন মেজর অবস্থান করতো। তাঁর ডেরায় বাবাকে সপ্তাখানেক আটকে রাখে। সেখানে
৯৪ মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ
শহীদ ডা. আব্দুন নূর
তাঁর ওপর চলে পৈশাচিক শারীরিক নির্যাতন। এক সপ্তাহ নির্যাতনের পর বাবাকে পাঠানো হয় শাহবাজপুর পাকসেনা ক্যাম্পে। তারিখ ছিল ২০ জুলাই ১৯৭১। আমাদের বাড়ি থেকে তিন মাইল দূরবর্তী এক ক্যাম্পে তাঁকে কিছু জিজ্ঞাসাবাদের পর শাহবাজপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের পশ্চিমে এক নির্জন স্থানে নিয়ে যায়। সীমান্তবর্তী অঞ্চলে কারফিউ বিকেল চারটা থেকেই বলবৎ থাকতো। এখানে সাক্ষ্য আইনও কার্যকর হতো। লোকচক্ষুর অন্তরালে, সন্ধ্যার আবছা আঁধারে পূর্বেই থেকেই একটি গর্ত করে রাখা ছিল। বাবাকে দাঁড় করানো হয় গর্তের পাশে। তৃষ্ণায় তাঁর প্রাণ যায় যায়। হায়েনাদের একজনকে এক গ্লাস পানির জন্য অনুরোধ করেন। পাশের একজন সাথে সাথে এক গ্লাস পানি নিয়ে আসে। বাবার মুখের সামনে গ্লাসটা ধরতেই এক হানাদার বেয়নেটের আঘাতে গ্লাসটা ভেঙে দেয়। পানি নিয়ে আসা লোকটিকে বেদম প্রহার করে। বাবার তৃষ্ণা আর মিটলো না। সন্ধ্যা হতে আর বাকি নেই। এক্ষুণি হয়তো মসজিদ থেকে আজান শোনা যাবে। অস্তমিত সুর্্যের পানে তাকিয়ে বাবা কী যেন ভাবছেন। তাঁর মুখটা বিড়বিড় করছে। এমনি সময়ে হানাদারদের বুলেট তাঁর বুক বিদ্ধ করলো। সন্ধ্যার নীরবতা খান খান হয়ে ভেঙে পরলো। বাংলা প্রকৃতি বাবার আর্তচিৎকারে কেঁদে উঠলো।
স্বাধীনতার পর আমাদের আত্মীয়স্বজন শাহবাজপুরের সেই ভয়াল গর্ত থেকে তুলে এনে বাবার লাশটি ধর্মীয় মর্যাদায় আমাদের পারিবারিক গোরস্তানে ১৯৭২ সালের ২ জানুয়ারি সমাহিত করেন। শত শত লোক ঐ দিন বাবার নামাজে জানাজায় অংশ নেন। তাঁরা চোখের জলে বাবার প্রতি সম্মান ও আমাদের সমবেদনা জানান।
দেশ স্বাধীনের আগে ফেরারি আসামির মতো আমরা যত্রতত্র ঘুরেছি। স্বাধীনতা লাভের পর আমরা যখন বাড়িতে এলাম তখন এসে দেখি কিছু নেই। খাঁখাঁ করছে ঘরবাড়ি। শুধু শূন্যতা আর শূন্যতা। শহীদ পরিবার হিসেবে আমরা দেশ ও সমাজের কাছে কী পেলাম? শহীদের স্বল্প সত্যিই আজ ভূলুন্ঠিত? তা না হলে আমার বাবাসহ লক্ষ শহীদের মুল্যায়ন কতোটুকু হলো? বাবার স্মৃতিচারন করতে আজ তাই ঝাপসা হয়ে আসে চোখ। মর্মান্তিক বেদনায় বুকটা টনটন করে ওঠে। আমাদের এ ব্যাথা ক’জনই-বা অনুধাবন করেন?
(জুন ১৯৯৩ সালে লিখিত)
প্রাসঙ্গিক উল্লেখযোগ্য তত্থসূত্রঃ
ক. মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বুদ্ধিজীবী তালিকা; তথ্য ও বেতার মন্ত্রণালয়, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার; প্রকাশকালঃ ১৮ ডিসেম্বর ১৯৭২।
খ. বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধেঃ দলিলপত্র; সম্পাদনাঃ হাসান হাফিজুর রহমান; প্রকাশনাঃ তথ্য মন্ত্রণালয়, গনপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার; প্রকাশকালঃ আষাঢ় ১৩৯১; জুন ১৯৮৪; ৮ম খণ্ড; পৃ. ৭০৭ ।
গ. স্মৃতি ১৯৭১; সম্পাদনাঃ রশীদ হায়দার; প্রকাশনাঃ বাংলা একাডেমী; ২য় খণ্ড, ২য় পুনর্মুদ্রণ, প্রকাশকালঃ ফাল্গুন ১৪০২, ফেব্রুয়ারি ১৯৯৬; পৃ. ৪৯।
ঘ. দৈনিক সংবাদ বিশেষ সংগ্রাহক সংখ্যা-৩, যেসব হত্যার বিচার হয়নি; পরিকল্পনায়ঃ অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন। প্রকাশকালঃ সোমবার ১৪ ডিসেম্বর, ১৯৯৮; পৃ. ৩০, ৪৩।
ঙ. সিলেটের যুদ্ধকথা; লেখকঃ তাজুল মোহাম্মদ; প্রকাশনাঃ সাহিত্য প্রকাশ; প্রকাশকালঃ ফাল্গুন ১৩৯৯, ফেব্রুয়ারি ১৯৯৩; পৃ. ৪।
মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ ৯৫
Reference: মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ – বায়জীদ খুরশীদ রিয়াজ